লেখায়_মাহজাবীন
গোঙানির আওয়াজে শোবার ঘরে বিভোর ছুটে গেলো। মিহিরিমা মাথা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। বিভোর মিহিরিমার মাথাটা বুকে রাখলো। কপালে গালে অজস্র চুমু দিলো। মিহিরিমা অস্ফুটস্বরে বলছে, “ আপনি খুব পঁচা। খুব খারাপ। আমাকে একটুও ভালবাসেন না। খালি কষ্ট দেন। “
মিহিরিমা আর বিভোরের বিয়ে হয়েছে চার বছর। এই চার বছরে এমন কোন দিন যায়নি যেদিন ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি। ঝগড়া যেকারণেই শুরু হোক না কেন, শেষে এসে দুজনেই হার মেনে নেয়। এভাবেই ওদের বিয়ের চার বছর কেটে গেছে। মিহিরিমা , বিয়ের আগে খুব হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে ছিলো। বিয়ের দুদিনের মধ্যেই সে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে একদম আপন করে নিয়েছে। কার কী দরকার, কে কোনটা খেতে পছন্দ করে, কার জন্য কী পোশাক কেনা হবে, সবদিকেই সে চারচোখ করে রাখে। মিহিরিমার শ্বশুর তাই বাড়ির আদর্শ বৌ মনে করেন। সমস্যা হচ্ছে বাড়ির অন্য কেউ মিহিরিমাকে সহ্য করতে পারে না। খুব অল্প সময়ে মিহিরিমা সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারবে এ তাদের কল্পনাতীত ছিলো। তাই উঠতে বসতে মিহিরিমা কথা শুনেছে সবার কাছে। শুধু কথা শুনলে তো হতোই, বাড়ির অন্যদের কথা শুনে বিভোর তাকে বেল্ট দিয়েও মেরেছে। মানে হলো এই যে, বাড়ির সবার জন্য সারাদিন খাটুনির পারিশ্রমিক বিভোরের বেল্টের বাড়ি। তিন বছর মিহিরিমা সবই সহ্য করেছে মুখ বুজে। বিনিময়ে একটু ভালবাসা ছাড়া কিছুই চায়নি বিভোরের কাছে। কিন্তু বিভোর ছিলো তার মায়ের প্রতি অন্ধ। মায়ের কথার ঠিক ভুল বিচার করতো না কখনো। তাই মিহিরিমার কপালে বেল্টের বাড়িগুলো অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।
পরিস্থিতি পাল্টে যায় মাস তিনেক আগে। বন্ধুদের সাথে রাস্তার পাশের খাবার খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিন মাস বিছানাশায়িত হয়ে পড়ে থাকে বিভোর। চাকরিটাও ওর চলে যায়। ডাক্তার বাড়ির অন্যদের সতর্ক করে দেন ছোঁয়াচে রোগ বলে। রাতারাতি বিভোর আর মিহিরিমার জায়গা হয় বাড়ির স্টোর রুমে। ছোট্ট একচিলতে স্টোর রুমে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে বিপদে পড়ে মিহিরিমা। বিভোর কোনকালেই সঞ্চয়ী ছিলো না। তাই ওর হাতে আলাদা কোন টাকাও ছিলো না। চিরকালের স্বল্পভাষী মিহিরিমা হঠাৎ যেন বাঘিনীর রূপ ধারণ করে। বাড়ি থেকে নিজেদের যাবতীয় জিনিস নিয়ে ছোট একটা বাসা ভাড়া নেয়। বিবাহিত স্ত্রী হলেও বিভোর মিহিরিমার প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করতো না। নিজের খরচ চালানোর জন্য মিহিরিমা টিউশনি করতো। সেই টাকায় এই তিনমাস সংসার চালিয়েছে সে। ও বাড়ি থেকে চলে আসার সময় শ্বাশুড়ি বলে দিয়েছেন বিভোরকে, বিভোর মারা গেলে যেন মিহিরিমা তাদের খবর দেয়। শত হলেও ছেলে বলে কথা, দায়িত্ব তো অস্বীকার করতে পারে না। বিভোর অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। সংসারের পেছনে টাকা ঢেলে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে।কিন্তু তার একবেলা ঔষধের টাকাও তার মা দিলো না। যে ভাইবোনদের সে নিজে না খেয়ে খাইয়েছে, তারাই তাকে গৃহহীন করেছে। আশ্চর্য এই পৃথিবী। অথচ যে মিহিরিমাকে সে তুচ্ছ কারণেও আঘাত করতে দুইবার ভাবেনি, সেই মেয়েটাই এখন তার পাশে আছে। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো বিভোর। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে বিভোর। মিহিরিমা ঘুম থেকে উঠে বিভোরকে দেখে হাসলো। সারারাত বিভোর ওর মাথা টিপে দিয়েছে। বিভোর এখন জানে তার দায়িত্ব কী। তাই কষ্ট করে আর মিহিরিমাকে মনে করিয়ে দিতে হয় না। আচ্ছা, সব পুরুষই কী স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেলো।।