দর্পহরন পর্ব-৮+৯

0
434

#দর্পহরন
#পর্ব-৮

পুরো ইব্রাহিম নিবাস জুড়ে পিনপতন নীরবতা গত দু’দিন ধরে। মনেই হয় না বাসায় এতোগুলো মানুষ আছে। খাওয়া বন্ধ প্রায় সবার। সবাই ভীষণ রকম চিন্তিত। এরমধ্যে আজ সালিম সাহেবকে ঢাকায় যেতে হবে। পার্টির হাইকমান্ডের জরুরি মিটিং। কয়েকটি আসনের চুড়ান্ত ফয়সালা হবে। সালিম সাহেব শারীরিক দিক দিয়ে ভীষণ দূর্বল বোধ করছেন। মন চাইছে না কোথাও যেতে। সারাজীবন দাপটের সাথে চলাফেরা করা সালিম সাহেব ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তার নিজের সাথে এমন কিছু ঘটবে। কারো এতোখানি সাহস থাকতে পারে সেটাই তার মাথায় আসেনি। এখনো ভেবে পাচ্ছেন এতোটা দুঃসাহস কে দেখাতে পারে। তার মেয়েকে কে তুলে নেবে? সে কি জানেনা তার মেয়েকে তুলে নেওয়ার পরিনাম কি হবে?

সবচেয়ে বড় কথা এ নিয়ে কোন ধরনের উচ্চ বাচ্য করতে পারছেন না। তার মেয়ে অপহৃত হয়েছে এটা লোক জানাজানি হলে সমাজ আর রাজনীতির মাঠে এর কি প্রভাব পড়বে তা ভাবতেই হৃদয় ক্রোধে গর্জন করে উঠছে। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন এরকম দুঃসাহসিক কাজ কার হতে পারে।

আরেক দিকে রিমা মেয়ের চিন্তায় শয্যাশায়ী। দিনরাত এক করে কাঁদছে। তার আদরের মেয়ে কোথায় আছে কেমন আছে কেউ জানে না। মেয়ে খেয়েছে কিনা কিংবা আদৌও বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানা নেই। নাওয়া খাওয়া বন্ধ, জ্ঞান হারাচ্ছে দিনে কয়েকবার করে। এখন বাধ্য হয়ে স্যালাইন দিতে হচ্ছে তাকে। সালিম সাহেব নিজেও মেয়ের চিন্তায় পাগলপারা। মেয়েটাকে বড়ই ভালোবাসেন তিনি। ভাবছেন, এই ভয়েই তো সারাজীবন আদরের মেয়েকে দূরে রাখলেন। মনের কোথাও চোরা অনুভূতি ছিলো, মেয়েটাকে সবকিছু থেকে দূরে রাখতে হবে। ওর কোন বিপদ হতে দেওয়া যাবে না। অথচ পারলেন না। মেয়ে তাদের সারপ্রাইজ দিতে চাইছিল। সত্যি সত্যি এমন সারপ্রাইজ তারা পেলেন যে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। এইসব ভাবনায় তিনি সারাদিন থম ধরে বসে আছেন হলরুমের সোফায়। কয়েকবার করে সবাই ডেকে গেলেও তিনি শোনেন না। চুপচাপ বসে থাকছেন। ব্যবসা রাজনীতি কোন কাজের কোন খোঁজ নিচ্ছেন না। আজ বাধ্য হয়ে সোহেল বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো-“আব্বা, এইভাবে বসে থাকলে কি শারমিনরে পামু? আপনে কিছুই বলতেছেন না কেন?”
সালিম সাহেব দূর্বল গলায় প্রতিবাদ জানালেন-“কি কমু? বেশি লোক জানলে কি হইবো বুঝতেছোস? আমার মাইয়ার মান সম্মান নিয়া টানাটানি হইবো। ওর বিয়া দিমু কেমনে? তারউপর আমার মাইয়া অপহরণ হইছে শুইনা মানুষ আমারে সস্তা মনে করতে শুরু করবো। আমার ক্ষমতা নিয়া সন্দেহ করবো। কি করুম কিছুই বুঝতাছি না।”
সোহেল ফুঁসে ওঠে-“তাই বইলা এমনে বইসা থাকুম? বইসা থাকলে শারমিনরে ফেরত পামু?”
“কি করবি জানি না। আইজকা আবার আপার লগে মিটিং আছে। দুপুরে ঢাকায় যামু।”
“আমি কই কি আমি আমার মতো কইরা খোঁজ নিমু?”
সালিম সাহেব সোহেলকে দেখলেন। কিছু একটা ভেবে মাথা নাড়লেন-“নাহ, চুপচাপ থাক। যে এইকাজ করছে তারে এতো বোকা ভাবা ঠিক হইবো না। অনেক ভাইবা এই কাজ করছে আমি শিওর। সে জানে আমরা কি ক্ষমতা রাখি। সব যাইনা বুইঝা এই কাজ করছে মানে শারমিনের খোঁজ পাওন এতো সোজা হইবো না। তারচেয়ে চুপচাপ দেখি তারা কি চায়।”
সোহেলের মুখ দেখে বোঝা গেলো এই জবাব তার পছন্দ হয় নাই। সে প্রতিবাদ করলো-“এয়ারপোর্টে আমাগো লোক আছে। তার থিকা যদি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়। কে এই কাম করছে যদি জানা যাইতো।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়-“শরীফ কইলো সে তার মতো কইরা খোঁজ নিছে। তোরে আমার ইদানীং ভরসা কম লাগে সোহেল। গত কয়েকদিন যেসব কাজ করলি সব মনোযোগ তোরে দেওয়া লাগছে। তোর আকাম সামলাইতে না হইলে হয়তো শারমিনের এই কাজ হইতোই না। নাইলে আগেই টের পাইতাম। তোর মা কবে থিকা কইতেছিল শারমিনের খোঁজ নাই। তোর আকাম সামলাইতে সামলাইতে আমার হুশ গেছিলোগা। বাদ দে বাপ। আমার মাইয়ার ব্যাপার আমি দেখুমনে। কি করতে কি করবি সব ঝামেলা পাকাই ফেলবি। তারচেয়ে তুই তোর মতো থাক কিছু করার কাম নাই।”

বাপের কথায় প্রচন্ড মর্মাহত হলো সোহেল। অপমানও কম হলো না। সে তো জানতোই না শারমিন সেদিন দেশে আসবে। তাহলে সে কিভাবে দোষী হয়? যেখানে তার কোন দোষই নেই সেখানে সম্পূর্ণ দোষ তার ঘাড়ে এলো। আবার এখন শরীফ নাকি খোঁজ নিয়েছে তাই তার খোঁজ নেওয়া যাবে না। সে নাকি সব ওলট পালট করে ফেলবে। সোহেল মেজাজ খারাপ নিজের রুমে ফিরে এলো।

তুলতুল হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে উদাস হয়ে বসে ছিল খাটে। সারাদিন সে ঘরে বসে হয় শুয়ে থাকে নয়তো কাঁদে। তাকে ওরকম বসে থাকতে দেখে সোহেলের গরম মেজাজ আরও খানিকটা গরম হলো। মনে হলো তার জীবনের সব ঝামেলার জন্য এই মেয়েটা দায়ী। এই মেয়েটাকে তুলে আনার পর থেকে যত ঝামেলা শুরু হয়েছে। সোহেল ঠাস করে দরজা আঁটকায়। আওয়াজে তুলতুল চমকে ওঠে। সামনে সোহেলকে দেখে আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলো। সোহেল তুলতুলের চুল মু/ঠো করে ধরলো-“তুই যত নষ্টের গোড়া। যেইদিন থিকা তোর সাথে দেখা হইছে সেইদিন থিকা ঝামেলা শুরু হইছে জীবনে।”
তুলতুল ব্যাথায় চিৎকার করে-“আহ! ছাড়েন আমাকে। আমি কি করছি? আমার জীবন নষ্ট করছেন আপনি। সব আপনি করছেন।”
“আমি তোর জীবন নষ্ট করছি না তুই আমার জীবন নষ্ট করছিস? কতো মাইয়া তুইলা আনছি কাউকে বিয়ে করা লাগে নাই আমার। তোকে কেন বিয়া করা লাগলো। বল?”
তুলতুল কাঁদছে-“আমি কি জানি? আমি তো আপনাকে বিয়ে করতে চাই নাই। কেন বিয়ে করছেন আমাকে?”
তুলতুলের জবাব শুনে সোহেল সজোরে চ/ড় কসালো। তুলতুল ছি/ট/কে পড়লো বিছানায়।
“হা/রা/ম/জা/দি, মুখে মুখে জবাব দেস। এতো সাহস তোর? খালি নির্বাচনটা যাইতে দে তোর কি হাল করি দেখিস। তুই কি ভাবছোস আমার বউ হইয়া বাঁইচা যাবি?”
সোহেল ওকে টেনেহিঁচড়ে মেঝেতে নামিয়ে আনে-“তুই আমার বিছানায় থাকোস কেন? আমার বউ হওয়ার কোন যোগ্যতা নাই তোর। নাম, যা এইখান থিকা। যা…”
হঠাৎ শরীফকে দরজায় দেখে থমকে গেলো সোহেল। শরীফ তুলতুলকে একনজর দেখে নজর ফিরিয়ে নিলো-“কি করছিস এসব সোহেল? বাসায় এই পরিস্থিতি আর তুই এখনও এইসব করে যাচ্ছিস? ছাড় ওকে।”
শরীফকে দেখে বুকের রক্ত ছলকে ওঠে সোহেলের। বাবার কথাগুলো কানে বাজে। মেজাজ খারাপ করে তুলতুলের হাত টেনে ধরে হিসহিসিয়ে বলে-“আমার বউ আমি যা খুশি করবো তোর কি?”
শরীফ রেগে গেল-“যা খুশি কর কিন্তু এখন না। মা অসুস্থ আর তুই যা খুশি করবি? তুই কি অমানুষ হয়ে গেছিস? ছেড়ে দে ওকে।”
মায়ের কথা বলাতে খানিকটা নরম হলো সোহেল। তুলতুলের হাতের বাঁধন আলগা করলো। তুলতুল নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। শরীফকে কৃতজ্ঞিত নয়নে একবার দেখলো। শরীফ সুধায়-“তুমি মায়ের ঘরে যাও। মা একা আছে দেখ কিছু লাগবে কিনা।”
তুলতুল যেন পালিয়ে বাঁচলো। শরীফ সোহেলের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“পরের মেয়ের সাথে এমন করিস বলেই আজ নিজের বোনের কোন খবর নেই। একবার ভেবে দেখ তুই যা করছিস ঠিক একই কাজ যদি আমাদের শুভ্রার সাথে কেউ করে তাহলে কি হবে। তোদের এইসব কাজের ফল না শুভ্রার উপর দিয়ে যায়।”
শরীফ দাঁড়ায় না। ও চলে যেতেই সোহেল প্রবল আক্রেশে কাঠের দরজায় বাড়ি দেয়।

★★★

রণ শুভ্র সাদা শার্ট গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাচ্ছে। অফ হোয়াইট রঙা গেভারডিন প্যান্টের সাথে ধবধবে সাদা শার্টে বেশ সুপুরুষ দেখাচ্ছে তাকে। জলি ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দোয়া করে দিলেন। ছেলের যেন নজর না লাগে। জলির মনে বড্ড ভয় ছেলেকে নিয়ে। এতদিন চোখের আড়ালে ছিল। মনে কষ্ট থাকলেও ভয় ছিল না। এখন চোখের সামনে থাকলেও মনে সর্বদা ভয়। রণ পর্দার আড়ালে মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে হাসলো-“মা, ওখানে কি করছো?”
জলি লাজুক হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকলো-“আজকে কি যেতেই হবে?”
রণ মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো দিল-“উফফ মা, এতো ভয় পাও কেন তুমি?”
জলির চোখ ছলছল হলো-“কেন ভয় পাই তা কি জানিস না?”
রণ মাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো-“জন্ম হলে মরতে তো হবেই মা। ভালো কাজ করে মরলে বরং সান্ত্বনা থাকবে। তুমি তো আমার সাহসী মা। এতো দূর্বল হলে চলবে?”
জলি জবাব না দিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। রণ ডাকলো-“মা, আমি যাচ্ছি। দোয়া করে দাও যেন সব ভালো ভাবে শেষ হয়।”
জলি ছেলের কপালে চুমো আঁকলেন-“সব ভালো হবে বাবাই। তুই সফলকাম হবি।”

আজ নেত্রীর কার্যালয় নেতাকর্মীদের ভীড়ে উৎসবমুখর হয়ে আছে। মনোনয়ন ঘোষণা করা হবে আজ। সালিম সাহেব শুকনো মুখে বোর্ডমিটিং এ এলেন। স্বাভাবিক কুশল বিনিময় করলেন সবার সাথে। মিটিং এ একজন নতুন মুখ দেখে বেশ অবাক হলেন সালিম সাহেব। একদম তরুন একজন ছেলে যার স্থান হয়েছে আপার পাশে। মাঝে মাঝেই আপার সাথে নিচু হয়ে কথা বলছে।
নেত্রী উপস্থিত থাকলে কানাঘুষার সু্যোগ থাকে না। ফলে সালিম সাহেব জানতে পারলেন না ছেলেটা কে। সালিম সাহেবের সবকিছু কেমন যেন অসহ্য লাগে। দুইদিন ধরে দুশ্চিন্তা, অনিয়ম সব মিলিয়ে অস্থির বোধ হয়। এমন অবস্থায় নেত্রী ডাকলো-“সালিম, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি? এতোক্ষণে একটা কথাও বললে না?”
সালিম সাহেব হাসার চেষ্টা করলেন-“না আপা, ঠিক আছি।”
“আচ্ছা বেশ। তোমার এলাকার আলাপটা সেরে নেই। তার আগে সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই আমি।”
রুমের সবাই নড়েচড়ে বসলো। রুমে উপস্থিত সকলেই নেত্রীর কাছের লোক, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসিন বয়োজ্যেষ্ঠ। নেত্রী সবার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে-“আপনাদের সাথে আগেই আলোচনা করেছিলাম এবছর আমি একদম তরুণ কিছু ছেলেপেলেকে রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্বে দেব। আমি আসলে দেখতে চাইছি আধুনিক ধ্যানধারনা, জ্ঞান নিয়ে তরুনরা কি করে দেশ পরিচালনা করে। এইজন্য অবশ্য আপনাদের কাউকে কাউকে নিজেদের পদ কনসিডার করতে হবে।

সেই ইচ্ছার ফলশ্রুতিতে আমি সর্বপ্রথম সালিমের এলাকার মনোনয়ন ঘোষণা করছি। ওর এলাকায় নতুন প্রার্থী হিসেবে রাগীব শাহরিয়ার রণকে মনোনয়ন দিচ্ছি। সালিমের সাথে এ বিষয়ে আমি আগে আলোচনা করেছিলাম। আমার সিদ্ধান্তের উপর সালিমের ভরসা আছে। সালিম, আমি চাই তুমি এবার রাগীবকে পুরোপুরি সহায়তা করবে আমাদের দল থেকে যেন সে নির্বাচিত হতে পারে। আর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তার দায়িত্ব পালনে তাকে পুরোপুরি সহযোগিতা করবে। ঠিক আছে?”

সালিম সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। চোখ দুটো বোধশক্তিহীন। বারবার রণকে দেখছিলেন। তার জায়গায় এই অল্প বয়সী ছোকরা? তাহলে সোহেলকে দিলেই হতো? চেনা জানা নেই এমন কেউ কেন? সালিম সাহেবের মনে হলো তার মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। হিসেব না মেলায় একসময় সিটেই চোখ বুজে পড়ে গেলেন সালিম সাহেব।

★★★

কয়েকদিন ধরে শুভ্রা একদম একা। রণ আসেনি একবারও। সারাদিন করার কিছু নেই খাওয়া আর ঘুম বাদে। সেটা কাহাতক ভালো লাগে। শুভ্রার পাগল পাগল লাগে। প্রথমদিন ঘুমালেও দ্বিতীয় দিন থেকে ঘুম নেই চোখে। সারাদিন অকারণে সারা ঘরময় চরকি কাটে। কিছুক্ষণ সোফায় থাকে, কিছুক্ষণ বিছানায়। রান্না করে খেতে ইচ্ছে করে না বিধায় খাওয়া হয় না। তৃতীয় দিন খিদেয় পেট চো চো করায় একবার বাধ্য হয়ে রান্নাঘরে গেছিল। ঢ্যালঢ্যালা খিচুড়ি আর ডিম ভেজে নিয়ে ডাইনিং বসেছিল। সেই বিস্বাদ জিনিস খেতে বসে আর ভালো লাগে না। কিছুটা খেয়ে কিছুটা টেবিলে ছড়িয়ে রাখে।

সময় কাটাতে শুভ্রা পাশের ঘরটাতে গেলো আজ। প্রতিটা জিনিস তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিছু যদি পাওয়া যায়। কোন কাগজ বা বই বা ডায়েরি। কে ছেলেটা কি তার পরিচয়? সেদিন একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শুভ্রারই তো শরীর খারাপ করলো তাই উত্তরটা শোনা হয়নি। আজ মনেহচ্ছে এই অজানা অন্ধকার থেকে গতদিন কষ্ট করে একটা সত্যি জেনে নেওয়া উচিত ছিল।

শুন্য হাতে আবার ডাইনিং এ বসলো শুভ্রা। ভেবে বের করার চেষ্টা করছে, ক’দিন হলো এসেছে এখানে? সাতদিন না দশদিন? এতোদিনেও কি তার বাবা বা ভাই বা চাচা কেউ তার খোঁজ বের করার চেষ্টা করেনি? আর আমেরিকায় তার কথিত প্রেমিকটিই বা কি করছে? শুভ্রা অবাক হলো নিজের আচরণে। জোসেফের কথা কেবলই মনে এলো তার। এই কয়দিনে একবারও জোসেফকে মনে আসেনি। অবশ্য এটাকে প্রেম বলা যায় কিনা সে জানে না। এ পর্যন্ত প্রেমিকের লিষ্টটা লম্বা শুভ্রার। কাউকে ভালো না লাগলে তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে এক সেকেন্ড দেরি করে না সে যেমনটা সম্পর্ক গড়তে দেরি করে না। আমেরিকার পাঁচ বছরের জীবনে জোসেফ সপ্তম বা অষ্টম বয়ফ্রেন্ড হবে হয়তো কিংবা তারও বেশি। সঠিক সংখ্যা নির্নয়ে সময় ব্যায় করার মতো সময় তার ছিলো না। অথচ আজ সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে বসেছে।

শুভ্রা ভেবে বের করার চেষ্টা করলো, কাউকে কি এমন আঘাত দিয়েছে যাতে তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তাকে কিডন্যাপ করতে পারে? অনেক ভেবেও সেরকম কাউকে খুঁজে পেলো না সে। এক সময় সবকিছু অসহ্য লাগতে শুরু করলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে শুভ্রা। তারপর ডাইনিং এর ছোট টেবিলে মাথা এলিয়ে দেয়। ওখানেই ঘুমিয়ে যায়। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, এলোমেলো চুল, বাসি পোশাক গায়ে। শুভ্রার চেহারা জুড়ে ক্লান্তির ছাপ।

কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না শুভ্রা। চোখ মেলতেই রণকে দেখলো সোফায় শুয়ে আছে চোখ বুঁজে। শুভ্রা অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো রণর পানে। শুভ্র সাদা রঙের শার্টে রণকে দেখে ধন্দ লাগে শুভ্রার চোখে। অজানা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। টেবিলে ছড়ানো ছিটানো ভাতের থালা থেকে গন্ধ আসছে। শুভ্রা উঠে দাঁড়ায়। এঁটো বাসন তুলে রান্নাঘরে নিতে চায়। কিন্তু সদ্য ঘুম ভাঙা শুভ্রার হাত কেঁপে বাসন মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে ঝনঝন আওয়াজে। রণ লাফিয়ে উঠে বসলো। আওয়াজের উৎস খুঁজে পেতে শুভ্রার দিকে তাকায়-“উঠে গেছেন?”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে পুনরায় বাসন তুলে রান্নাঘরে গেল। রণ এলো ওর পিছুপিছু-“এখন ওসব রেখে আসবেন একটু? কথা বলতাম।”
শুভ্রা তবুও জবাব দিলো না দেখে রণ আশাহত হলো-“কয়েকদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম তাই আসতে পারিনি। আসুন না প্লিজ। কাজগুলো পরেও করতে পারবেন।”
শুভ্রা শুনলো কিন্তু তাকালো না। নিজের মতো এঁটো বাসন ধুতে লাগলো। রণ হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলো। মনোনয়ন ঘোষণা হওয়ার পর সে বাসায় যায়নি। এখানে এসে বসে আছে। আর এই মেয়ে কিনা তাকে ভাব দেখাচ্ছে। রণ চুপচাপ সোফায় এসে বসলো। আধাঘন্টা পরে শুভ্রা এসে ওর সামনে বসলো-“বলুন কি বলবেন।”
রণ মিষ্টির প্যাকেট বের করলো-“আজ আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন, ভীষণ খুশি দিন। সেই উপলক্ষে মিষ্টি এনেছি। আর এই যে আপনার ডিমান্ড অনুযায়ী কিছু বই আছে এতে।”
দুটো বক্স টেবিলে উঠিয়ে রাখলো রণ। শুভ্রা সেসবে ফিরেও দৃষ্টি দিলো না। ও মুখভার করে বললো-“একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আছে আমার। দয়া করে উত্তরটা দিন।”
রণ হাসলো-“আচ্ছা, এইজন্য মন খারাপ? বলুন কি জানতে চান।”
“আমি কি আপনাকে চিনি?”
রণ মাথা নাড়ে-“নাহ, চেনেন না।”
“তাহলে আমাকে এভাবে আঁটকে রেখেছেন কেন?”
রণর হাসি চওড়া হলো-“এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আপনাকে দ্বিতীয় যে কাজটা করতে হবে সেটা হলো রুটিন মাফিক জীবন যাপন করা। এই যে কয়েকদিন আসিনি বলে আপনার জীবন অচল হয়ে আছে এমনটা করা যাবে না। আমি প্রায়ই আসবো না এখন। আপনার এই একা জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। নিজেকে সারভাইব করা শিখতে হবে।”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেল রণ বললো-“এই যে খাবার নষ্ট করেছেন তা করা যাবে না। প্রতি সপ্তাহে আপনাকে নির্দিস্ট এমাউন্ট খাবার দেওয়া হবে সেটা দিয়ে সপ্তাহ চালিয়ে নিতে হবে। তারপর ধরুন এই যে সারাক্ষণ সবঘরে লাইট জ্বালিয়ে রাখছেন বিদ্যুৎ বিল আসছে অনেক। এমন হলে হুট করে কানেকশন কেটে জেতে পারে। তখন অন্ধকারে কি করে থাকবেন সেটা ভাবুন। আগে থেকে প্রপ্রার ব্যবস্থা নিন আঁধারে কি করবেন। বুঝতে পেরেছেন? এক কাজ করা যাক। আগামীকাল থেকে তিনদিন আপনার ফ্ল্যাট আঁধার থাকবে। আপনার নেক্সট এক্সাম আঁধারে বেঁচে থাকা। এইজন্য আজকের মধ্যে যা যা প্রয়োজনীয় সব জোগাড় করে ফেলুন। যেমন ধরুন মোমবাতি কিংবা টর্চ এসব আর কি।”
“আর এসব আমি পাবো কোথায়?”
শুভ্রার প্রশ্নের রণ রহস্যময় হাসলো-“ফ্লাটে সব আছে শুধু খুঁজে নিতে হবে আপনাকে। আজকের মতো যাচ্ছি। আপনি সারভাইব করলে দেখা হবে তিনদিন পর।”
শুভ্রার হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বলছে কি ছেলেটা? এই ছেলেটা আসলে তাকে মে/রে ফেলতেই চায়। এভাবে না মে/রে বুকে গুলি চালিয়ে দিলেই হয়। অন্ধকারে থাকার চাইতে গু/লি খাওয়া উত্তম শুভ্রার জন্য।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৯

দীর্ঘ দিন পরে নিজের পিতৃভূমিতে ফিরে আপ্লূত হয় রণ। মাকে সাথে নিয়ে পিতার আদি নিবাসে আগমনটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণই হলো। ভাবেনি এতো লোকের সমাগম হবে তার আসা উপলক্ষে। সাধারণ লোকের আকন্ঠ সমর্থন দেখে সে আর জলি দু’জনেই বিস্মিত। তাদের নতুন বাড়ির নামকরণ হয়েছে। ‘দর্পন’ নামের বাড়িটা সাধারণ জনগণ, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ভীড়ে সমাগম। আসলে নেত্রীর কড়া আদেশ, প্রার্থী যেই হোক তাকে দলের সবাই মিলে সাপোর্ট দিতে হবে। কোন ধরনের কোন্দল বরদাস্ত করা হবে না।

তারউপর রণ ফ্রেশ মুখ। তার বাবা এলাকার গন্যমান্য মানুষ ছিলেন। সমাজসেবক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুনাম ছিলো। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস ছিলো। তার ছেলে হিসেবে রণ এলাকার মানুষের অন্ধ সমর্থন পেয়ে গেছে। আর বাকী রইলো রাজনৈতিক পরিপক্বতা, সময়ের সাথে সাথে সেটাও অর্জন করে ফেলবে। এটা লোকের বিশ্বাস।

লোকজনের আন্তরিকতায় জলি সিক্ত। আজ মনেহচ্ছে, ভালো মানুষের মুল্যায়ন হয় না এ কথাটা ভুল। দেরিতে হলেও ভালো কাজ আর ভালো মানুষ দুটোরই মুল্যায়ন হয়। একসময় ছেলের রাজনীতিতে যোগদানে ভীষণ ভয় ছিলো জলির। আজ সব দেখে কেন যেন ভালো লাগে। তার ছেলে এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পাবে সে তার ভাবনায় ছিলো না। ভীষণ ভালোলাগা নিয়ে জলি রণকে দেখে। ছেলে স্মিত মুখে সবার সাথে আলাপ করছে। দূর থেকে সে দৃশ্য দেখতে বড়ই ভালো লাগছে তার। গত কয়েকদিন ধরেই দূর থেকে লুকিয়ে দেখছে তবুও স্বাধ মিটছে না জলির। অবাক হয়ে ভাবছে, তার ছোট্ট ছেলেটা কবে এতো বড় হলো? এতো সেদিও বাবা বাবা করে কেঁদে জলির কোলে মুখ লুকাতো। সেই রণ আজ বাবার জায়গায়। জলি দেখে আর কাঁদে।

“মা, চলো আজ ঢাকায় ফিরবো।”
“এখানে তোর কাজ শেষ?”
জলি উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চায়। রণ মাকে দেখে হাসলো-“না মা, এখানে কাজ কেবল শুরু। আমার তো এখন এখানেই থাকতে হবে। কিন্তু তুমি এখানে এভাবে থাকলে হাসি খুশি তো পাগল হয়ে যাবে।”
জলি রাগ হলেন-“ওরা কেন পাগল হবে? ছোট আছে নাকি ওরা? ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, নিজেদের দেখে রাখতে পারে।”
রণ হেসে দিলো-“আমি তো তাহলে বুড়ো হয়ে গেছি মা।”
জলি স্নেহার্দ হয়ে জবাব দিলো-“তোর কথা আলাদা। তুই তো এতোদিন দূরেই ছিলি। এখন চোখের আঁড়াল করতে মন চায় না। আমি তোর সাথে এখানেই থাকবো। উহু কোন কথাই শুনবো না।”
রণ মাকে জড়িয়ে ধরে-“আমার সাথে মিহির আছে, জাফর আছে। তাছাড়া হাসি খুশিকে দেখে রাখতে হয় মা। ওরা বড় হয়েও ছোটদের মতো আচরণ করে। তুমি ওদের সাথে থাকো মা।”
জলি মাথা নাড়ে-“তাহলে ওদেরকেও এখানে আনি।সবাই মিলে এখানেই থাকি। এতো বড় বাড়ি সমস্যা নেই তো কিছু।”
রণ আঁতকে উঠলো-“কখনোই না মা। আমি চাই না সবাই এখানে থাকি। অন্তত নির্বাচনের আগে তো নয়ই। আমি নতুন মানুষ মা। কে আমাকে বন্ধু ভাবছে কে শত্রু তা এখনো জানি না। তাই তোমাদের নিয়ে কোন রিস্ক নেব না আমি।”
“বেশ। তাহলে আর কোন কথা নেই। আমি তোর সাথেই থাকবো।”
রণ হতায় হয়ে মাথা নাড়ে-“আচ্ছা বেশ থেকো। আমাকে তাহলে দিন ঠিক করে নিতে হবে। চারদিন এখানে থাকবো তিনদিন ঢাকায় ফিরবো। ঠিক আছে?”
জলি জবাব দিলো না। গোছগাছে মন দিলো।

★★★

“তুহিন, একটা কাজ করতে পারবি?”
তুহিন বিস্মিত হয়ে ইব্রাহিম সালিমকে দেখলো। কতদিন পরে তুহিনকে ডাকছেন সালিম সাহেব। ছেলে সোহেলের চক্করে তুহিনকে ডাকতে ভুলে গেছিলেন ইব্রাহিম সালিম। আজ এতোদিন পরে তুহিনকে কাজের জন্য ডাকছে। আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো তুহিন। দৃঢ় স্বরে বলে-“কি কাজ স্যার?”
“কি যেন নাম ছেলেটার? এই এলাকার প্রার্থী হইছে।”
“রণ?”
“হুমম। ওর হিস্ট্রি বের করে আমাকে জানা। ওই ছেলে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসলো কেমনে? এতো শর্ট টাইমে আপা এর আগে কাউরে মনোনয়ন দেয় নাই। ওর কেসটা কি?”
তুহিন হাসলো। ও জানতো এই প্রশ্মটা আসবে তাই আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলো সে।
“স্যার, ওর হিস্ট্রি জানি আমি। হাসনাত হামিদের পোলা এই রণ। এতোদিন বিদেশ আছিলো। পড়ালেখার ধার ভালো। কি পুরস্কার পাইছে জানি। ছয়মাস মতো দেশে আইছে। এলাকার ছেলে, বাপের নামধাম ভালো, সবাই এখনো একনামে চিনে ওর বাপকে। এইজন্য আপা তারে মনোনয়ন দিছে। হয়তো ভাবছে নতুন মানুষ আপনিও নিজের মতো চালাইতে পারবেন।”
ইব্রাহিম সালিম বিস্ময়ের চুড়ান্ত হলেন-“কস কি? ওরা থাকে কই এখন?”
“ঢাকায় থাকে, শান্তিনগরে ওর নানার দেওয়া জমিতে বাড়ি করছে।”
“আচ্ছা, তাইতো বলি এলাকায় দেখি নাই কেন এতোদিন। হাসনাতের বাড়ি আছে না? ওইটায় কে থাকে?”
“ওই পুরান বাড়ি ভাইঙা দশতলা বিল্ডিং হইছে। তার তিনতলায় আইসা থাকবে রন। পার্টির কাজ করব এইখানে থাইকা।”
সালিম বিস্ময় নিয়ে তুহিনকে দেখলেন-“তুই এতো কিছু জানোস কেমনে? তুই কি জানতিস ওর ব্যাপারে?”
তুহিন মাথা নাড়ে-“জানতাম না। ওই এলাকায় সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটা এখন হাসনাত হামিদের। ওই বাড়ি দেইখা একদিন খোঁজ নিছিলাম। পরে কালকে মনোনয়নের ঘোষণার পর আবার একটু খোঁজ নিলাম।”
সালিম সাহেব চিন্তিত হয়ে পান চাবালেন কিছুক্ষণ। তুহিন তাকিয়ে আছে তার দিকে। হয়তো কিছু শোনার প্রত্যাশায়। সালিম সাহেব আনমনা হয়ে বললেন-“আপাকে এতো কাঁচা কাজের মানুষ মনেহয় না। ওকে মনোনয়ন দেওয়ার পিছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে। আচ্ছা, এক কাজ কর তুহিন।”
তুহিন উৎসুক হলো-“কি কাজ?”
“ওর উপর নজর রাখ। সারাদিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা। কোথায় যায় কি করে সব নজরে রাখ।”
তুহিন সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো-“আপামনির ব্যাপারে কি আপনার সন্দেহ হয়?”
সালিম সাহেব সন্তুষ্ট চিত্তে তুহিনকে দেখলেন-“তোর মতো আর কেউ বোঝে না আমাকে। কিছু বলার আগেই বুইঝা যাস কি কইতে চাই।”
তুহিন হাসলো-“সত্যি বলতে আমি কালকে ওর পিছনে লোক লাগাইছি। দেখি সে কি কয়।”
সালিম সাহেব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে দেখলেন সালিমকে-“এইজন্যই তোরে ভালা পাই তুহিন। তুই একদম আমার মনের মতো।”
তুহিন স্মিত হেসে চুপ করে গেলো। সালিম সাহেব আবারও শুয়ে গেলেন। গতদিন মিটিং শেষ হওয়ার আগেই ফিরতে হয়েছে তাকে। মিটিং এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় আপা ডাক্তার ডেকে দেখান। ব্লাড প্রেশার বেড়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। সাথে সাথে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাকে। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। দিনদুয়েক আধো ঘুম আধো জাগরনে কাটানোর পর আজ শরীর কিছুটা ভালো বোধ করার তুহিনকে নিজের কামড়ায় ডেকে নেয়।

রণ ছেলেটার সব শোনার পরও মনটা খচখচ করছে। ছেলেটা মিটিং এর মাঝে দুই একবার তাকিয়েছিল তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি হেলা ছিল? কেন যেন রণ ছেলেটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।

★★★

পুরো বাড়ির বাতি জ্বলে উঠতেই শুভ্রা চোখের উপর হাত দিলো।
“আরেহ, আপনি তো দেখি বেশ সাহসী মেয়ে। একদম ফিট আছেন।”
রণর গলা শুনেও শুভ্রা হাত সরায় না। রণ কয়েকটা প্যাকেট এনে টেবিলের উপর রাখলো। শুভ্রা ক্লান্ত গলায় বললো-“এখানে এসেছি কতদিন হলো?”
দু’সপ্তাহ হয়নি এখনো।”
“আর কতদিন থাকতে হবে?”
“এখনো বলতে পারছি না।”
শুভ্রা ধীরে ধীরে হাত সরায়। আলোতে চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। ক্ষীন কন্ঠস্বরে জানতে চাইলো-“আমাকে কি জীবিত মায়ের কাছে যেতে দেবেন নাকি মে/রে ফেলবেন?”
রণ মৃদু হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে আছে। শুভ্রার মুখের বিস্বাদ তাকে স্পর্শ করলোনা। সে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো-“আরেহ, কি বলছেন এসব? আমাকে বুঝি আপনার খু/নি মনেহচ্ছে? আমার কাজ হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজে আপনাকে মুক্তি দেব। একদম ভাববেন না।”
শুভ্রা রণর দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“একজন মেয়েকে একদম অন্ধকারে আঁটকে রেখে আপনি কি প্রমান করতে চাইছেন আমি জানি না। তবে যা করছেন খুব খারাপ করছেন।”
রণ ভাবলেশহীন তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হেঁসে দিলো। শুভ্রার চেহারায় বিরক্তি। নিস্তব্ধ ফ্লাটে রণর হাসি বড্ড কানে লাগে বলে সে কানে হাত দিলো-“প্লিজ আস্তে হাসুন কানে লাগছে।”
রণ হাসি বন্ধ করে-“আমেরিকার কি করতেন আপনি? পড়ালেখার সময় বাদে? জব করতেন কোন? টাকা তো আপনার বাবা পাঠাতো। কাজেই জব করতেন না। কি করতেন তবে? পাবে যেয়ে নতুন বয়ফ্রেন্ড বানানো, নাচানাচি, ঢলাঢলি। খুব জম্পেশ লাইফ কাটিয়েছেন তাই না?”
শুভ্রা কড়া গলায় জবাব দিলো-“দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস। আপনার কোন ক্ষতি তো করিনি। আপনি কেন আমাকে নিয়ে এতো বদার হচ্ছেন?”
“আমি আপনাকে নিয়ে মোটেও বদার না। প্লিজ নিজেকে এতো ইমপর্টেন্ট ভাববেন না।”
“তাহলে কি অন্য কারো রোশ আমার উপর ঝাড়ছেন?”
রণ এবার বিরক্ত-“আজ এতো ওলটপালট বকছেন কেন? তিনদিন অন্ধকারে থেকে পাগল হয়ে গেলেন নাকি?”
শুভ্রা ভাঙবে তবু মচকাবে না-“পাগল হইনি তা বলবো না। আমি আসলে আর পারছি না। কোন দোষে দোষী হয়ে এই সাজা পাচ্ছি সেটাতো বলবেন?”
রণ শুভ্রাকে দেখলো খানিকক্ষণ। মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখটা শুকনো হয়ে আছে। চুলে চিরুনি পড়েনি ক’দিন বোঝাই যাচ্ছে। মুখটা ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। মুহুর্তের জন্য মনটা নরম হলো রণর। তারপরেই আবার ওর বাবার কথা মনে হয়ে কঠোর হলো।
“খাবার এনেছি আপনার জন্য। দ্বিতীয় চ্যালেন্জ পাস করেছেন সেই উপলক্ষে। আপনার পছন্দের খাবার।”
শুভ্রা খাবারের প্যাকেট খুলেও দেখলো না। রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিন। আমাকে কেন তুলে এনেছেন?”
“কারনটা আগেও বলেছি এখন আবার বলছি। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে অপহরণ করেছি। উদ্দেশ্য সফল হলে আপনাকে ফিরিয়ে দেব।”
“উদ্দেশ্যটা কি সেটাই জানতে চাইছি।”
রণ আবার পুরনো রুপে ফিরে এলো-“জানানোর হলে আগেই জানাতাম। শুধু শুধু এনার্জি ক্ষয় করবেন না। যতটা প্রয়োজন ততটা জানুন। আপনার জন্য সেটাই মঙ্গল হবে। আসছি আজ।”
শুভ্রা এবার আঁতকে উঠলো-“প্লিজ যাবেন না। গত তিনদিন হলো ঘুমাই না। গোসল হয় না। আপনি কিছুক্ষণ থাকুন প্লিজ। গোসল সেড়ে ঘন্টাখানিক ঘুমিয়ে নেই। তখন না আপনি চলে যাবেন।”
রণ কেন যেন শুভ্রার নিরীহ আবদার ফেলতে পারে না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-“আচ্ছা, আমি বসছি কিছুক্ষণ।”
শুভ্রা ধীর পায়ে উঠে গেল। রণ একপলক দেখে সোফার গা এলিয়ে দিলো। আজ রাতে মিটিং আছে ওর নির্বাচনী প্রচারনা টিমের সাথে। কিছু বর্ষীয়ান নেতা উপস্থিত থাকবে সেখানে। কাল আবার ফিরতে হবে নির্বাচনী এলাকায়। নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত রণ ঘুমিয়ে পড়লো।

খট করে আওয়াজ হতেই রণ চমকে উঠে বসলো। বুঝতে চাইলো কোথায় আছে সে। বোঝার সাথে সাথে দৌড়ে রুমে গেল। যা ভেবেছিল তাই। রুমে শুভ্রা নেই। পাশের রুমে ঢু মেরে দেখেই বাইরের দিকে ছুটলো। বাসার চাবিটা শার্টের বুকপকেটে ছিল। সেটা জায়গায় নেই। রান্না ঘরের দরজার দিকে ছুটলো রণ। দরজাটা হাঁট করে খোলা। রণর বুক ধক করে উঠলো। মেয়েটা পালিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত? কি হবে এখন? কেন সে ঘুমিয়ে গেল? তার বোঝা উচিত ছিল ওর বাবা কে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে