#দর্পহরন
#পর্ব-৬
“রণ হোয়াট?”
শুভ্রা ধমকে উঠলো-“আগে পরে কিছু নেই? আমি কি আপনাকে চিনি? আমাকে তুলে এনেছেন কেন? আমার সাথে কি শত্রুতা? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আপনি জানলেন কি করে আমি সেদিন দেশে এসেছি?”
একের পর এক প্রশ্ন শুনে রণ হেসে দিলো। তার সেই প্রানখোলা হাসি দেখে শুভ্রা থমকালো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে রণর দিকে চাইলো। আজ খেয়াল করলো হাসলে ছেলেটার বা গালে টোল পড়ে, চোখ দুটো তারার মতো জ্বলজ্বল করে। কত উচ্চতা হবে ছেলেটার? পাঁচ এগারোর কম না। একটু নড়াচড়া করলেই শার্টের উপর দিয়ে সুগঠিত দেহের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। হাতের ঘড়ি আর পায়ের জুতোজোড়ায় সৌখিনতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। রণ অবশ্য শুভ্রার মুগ্ধতা আমলে নিলো না। সে হাসতে হাসতেই বলে-“কিডন্যাপ আপনি হয়েছেন না আমি? আচ্ছা বেশ, আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো ধীরে ধীরে দেব আমি। তবে তারজন্য শর্ত আছে আমার। শর্ত যাইহোক যদি রাজি থাকেন তাহলে উত্তর পাবেন।”
শুভ্রা আগের মতোই তেজদীপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো-“কিসের শর্ত? কোন শর্ত টর্ত মানতে পারবোনা।”
রণ গম্ভীর হলো-“ভেবে বলুন। চারদিনের বেশি হলো পেটে দানা পড়েনি। আর কয়দিন না খেয়ে থাকতে পারবেন?”
শুভ্রা ঢোক গিললো। সত্যিই তার খিদে পেয়েছে। পেট এতোটাই ফাঁকা যে ‘খেতে দে’ বলে রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে। শুভ্রার অবস্থা দেখে রণ মুচকি হাসে-“তাছাড়া এই যে ওষুধ খেয়ে গলার ব্যাথা টের পাচ্ছেন না কথা না শুনলে সে সুবিধাও কেড়ে নেব। আমার সুন্দর কথায় পটে যাবেন না। কাজের বেলায় আমি কতোটা নিষ্ঠুর সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে বাকী নেই?”
কথাটা যেন মরিচের ঝাল গেলার মতো কষ্ট দিলো শুভ্রাকে। তার গালের রং পরিবর্তন হলো দ্রুত। রণ আজ প্রথমবারের মতো মাথা নিচু করে থাকা মেয়েটাকে ভালোমতো দেখলো। ফর্সা গায়ের রং এ নিটোল মুখ। খাঁড়া নাক আর পাতলা ঠোঁট নিখুঁত হলেও চোখদুটো খানিকটা চাকমাদের মতো বলে অন্যদের চাইতে আলাদা লাগে। মাথা জুড়ে এলোমেলো একহারা চুল। আঁটোসাটো পোশাকে মেয়েলি শরীরের খাঁজগুলো একেবারে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। ও মেয়েটাকে দেখছে বুঝতে পেরে নিজের নজর সরিয়ে নিলো দ্রুত। শুভ্রার মন খারাপ বুঝেই কোমল কন্ঠে বললো-“শুনুন, আপনাকে আবারও বলছি আপনার সাথে কোনরকম খারাপ ব্যবহারের কোন ইচ্ছে আমার নেই। যে কারনে আপনাকে তুলে এনেছি সেই প্রয়োজন মিটে গেলে আপনাকে স্বসম্মানে ফিরিয়ে দেব। প্লিজ কোঅপারেট করুন।”
শুভ্রাও নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। মুখরা মেয়ের মতো বলে উঠলো-“কতটা ভালো ব্যবহার করবেন সে দেখা হয়ে গেছে আমার।”
রণ কৌফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো-“কালকের ঘটনায় আপনি একশোভাগ দোষী। ইচ্ছে করে প্ররোচিত করেছেন আমাকে। খারাপ ব্যবহারে বাধ্য করেছেন।”
রণর কথায় দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে শুভ্রা। শরীরে হাজার সুই ফুটলো। ছোট বেলা থেকেই ঝাল খেতে পারে না সে। এইজন্য কত মজার মজার বাঙালি খাবার সে খায় না। ভাইবোনগুলো এ নিয়ে তাকে কত খেপায়। কিন্তু আসলেই সে পারে না ঝাল খেতে। আর এই লোক কিনা তাকে আস্ত এক বাটি মরিচ খাইয়েছে। অপমানে কানটা গরম হয়ে উঠলো তার। পরক্ষণেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। এই ছেলেকে কিছু বুঝতে দেবে না সে। সব মনে রাখবে শুভ্রা, কিছুই ভুলবে না। হিসেব তোলা থাকলো। সময়মতো জবাব দেবে শুধু। গম্ভীর মুখে রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“কি করতে হবে আমাকে?”
শুভ্রার মুখ দেখে মনোভাব পড়তে ব্যর্থ হলো রণ। তবে মুখের কথায় সন্তুষ্ট হলো। চেহারার স্বাভাবিক হাসি ফিরে এলো-“এইতো গুড গার্লের মতো কথা বললেন। তাহলে কাজে নেমে পড়ুন। দেখি শর্ত কতটুকু পূরণ করতে পারেন।”
শুভ্রা গম্ভীর হলো-“শুনুন, আমি হোষ্টেলে থেকে বড় হওয়া মেয়ে। প্রয়োজনে সব কাজ করতে পারি।”
“রিয়েলি! আচ্ছা তাহলে প্রথম চ্যালেন্জ দিয়ে দেই আপনাকে। দেখি ফিলআপ করতে পারেন কিনা।”
শুভ্রা সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে চাইলো। রণ মুখটা হাসি হাসি করে বললো-“তিনঘণ্টা সময় আপনার হাতে। পুরো বাড়ি পরিস্কার করতে হবে।”
শুভ্রা একইরকম ভাবে তাকিয়ে থেকে বললো-“বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“একটা প্রশ্নের উত্তর।”
শুভ্রা মাথা নাচালো-“উহু, পোষাবে না। আরও কিছু চাই আমার।”
রণ ভ্রুকুটি হেনে জানতে চাইলো-“আর কি চাই?”
“পেট পুরে খেতে চাই। ভাত খাওয়াতে হবে নিজের হাতে রান্না করে।”
শুভ্রার আবদার শুনে মানা করে না রণ-“ঠিক আছে। আপনাকে ভাত খাওয়াবো। কাজ শুরু করুন।”
শুভ্রা সাবধানে পা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো রণর কাছে-“এখন রাত না দিন? বাসায় ঘড়ি নেই সময় বোঝার উপায় নেই।”
রণ গম্ভীর হলো-“সময় জানার দরকার কি আপনার?”
শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে গেলো। এই ছেলেটা আচ্ছা ত্যাদর। যেটা বলবে না সেটা নিয়ে প্রশ্ন করাই বৃথা।
★★★
গতকাল মা আর চাচা চলে যাওয়ার পর তুলতুলের আশ্রয় হয়েছে ভেতর বাড়িতে সোহেলের কামরায়। অবাক ব্যাপার হলো সোহেলকে সারারাতে একবারও দেখা যায়নি এ রুমে। তুলতুল অবশ্য অপেক্ষাও করেনি তার জন্য। আসলে অপেক্ষা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না ওর। সোহেলের উপর্যুক্ত অত্যাচারে তুলতুলের শরীরের অবস্থা নাজুক। জ্বর আর ব্যাথায় প্রান ওষ্ঠাগত। তাই রাতে সে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কাজের মেয়ের ডাকে।
“আম্মা আপনাকে ডাকে।”
সদ্য ঘুম ভাঙা তুলতুল না বুঝে জানতে চাইলো-“কে আম্মা? কে ডাকে?”
কাজের মেয়েটা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো-“আপনার শাশুড়ী ডাকে। তাড়াতাড়ি আসেন। আর বলছে ভালোমতো তৈরি হয়ে আসতে। মেকাপ কইরা আপনের মুখের দাগ ঢাকতে কইছে। বাইরে মেহমান আছে হেরা জানি কিছু না বোঝে। এই যে কাপড় রাইখা গেলাম।”
তুলতুল দেখলো একটা দামী শাড়ী সাথে গহনার বক্স রাখা। তুলতুলের ইচ্ছে হলো সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে কানতে। দু’দিন আগেও তার জীবনটা কতটা আনন্দে পূর্ণ ছিলো আর আজ মনে হচ্ছে অভিশপ্ত জীবন তার। কি থেকে কি হয়ে গেলো। সমাজের চোখে তার পরিচয় শুরুতে ধর্ষিতা তারপর এখন একজন ধ/র্ষ/ক আর খুনীর স্ত্রী। ঘৃনায় শরীর রি রি করে ওঠে। নিজের শরীরটাকে ভীষণ অচ্ছুৎ লাগে। কোনভাবে যদি সোহেলের স্পর্শ মুছে দেওয়া যেত। তুলতুলের বুকটা হুহু করে ওঠে। কান্নার দমকে হিঁচকি ওঠে।
পরক্ষনেই কালকে ইব্রাহিম সালিমের বলা কথাগুলো কানে বাজলো। লোকটা সোজাসাপ্টা হুমকি দিয়েছে কালকে-“ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে এই বাড়ির ভদ্র বউ হয়ে থাকো। বাপকে আগেই হারাইছো এখন তোমার কারনে তোমার মা ভাই আর চাচার জীবন সংকট হবে। তোমার ভাগ্য ভালো যে তোমার সাথে আমার পোলার বিয়া দিতাছি নাইলে এতোক্ষণে গাঙে ভাসতা।”
ভয়ে তুলতুলের শরীর কাঁপে। দ্রুত বিছানা থেকে নামে। বাথরুম থেকে পরিস্কার হয়ে এসে কাপড় পরে নিলো। গায়ে গহনা চরিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিল। বাইরে পা বাড়াবে এমন সময় সোহেল ঘরে ঢুকলো। চোখ দুটো টকটকে লাল। মাথার চুল উসকোখুসকো। ভয়ে তুলতুলের হাত পা কাঁপে, মাথা থেকে কাপড় খসে পড়ে। তুলতুল কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সোহেল তুলতুলকে এক পলক দেখলো। মাথায় আগুন ধরে গেল তার তুলতুলকে দেখে। এই ফকিন্নিকে কিনা বিয়ে করা লাগলো শেষমেষ। যাকে একবার ঘেটে ফেলছে তাকে প্রতিদিন দেখবে চোখের সামনে এটা ভাবলেই তার মুখ বিস্বাদ হয়ে ওঠে। তুলতুলকে তাই মুখ খিচিয়ে গালি দিলো-“ওই মা/গী শোন, বাইরে যাইয়া যদি কিছু উল্টা পাল্টা কিছু কইছোস তাইলে আইজকাই তোর জীবনের শেষ দিন। বুঝছোস?”
তুলতুল কাঁপছে ঠকঠক করে। এরমধ্যেই সে কিছু না বুঝে মাথা দুলালো। সোহেল রণমুর্তি হয়ে এগিয়ে এলো ওর দিক-“কেউ কিছু জিগাইলে কবি তুই খুব ভালা আছোস এইখানে। ঠিক আছে?”
তুলতুল আবারও মাথা দুলালো। ওর মাথা দুলানো দেখেই মনেহয় সোহেলের মেজাজ আরও খারাপ হলো-“মাথা নাড়োছ কেন হুদাই? বা/ড়ি দিয়া মাথা ফা/টা/য় দিমু কইলাম।”
তুলতুল ভয়ে মুর্তি বনে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে সোহেলের মেজাজ আরও খারাপ হলো-“আবার খাম্বার মতো খারায় রইছে। যা বাইরে যা।”
তুলতুল কাঁপা হাতে মাথায় ঘোমটা টানে। এগুতে গিয়ে বাঁধা পেল-“এই শোন, মুখে হাসি আন। এমন ম/রা মানুষের মতন মুখ কইরা রাখছোস কেন? হাস, হাসি মুখে যা।”
তুলতুল হাসার চেষ্টা করলে মুখের আদল কান্নার চাইতেও খারাপ দেখালো। সোহেল বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
বড় ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসা হলো তুলতুলকে। রিমা ওকে নিয়ে এলো। কয়েকজন লোক বসে আছে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে। ইব্রাহিম সালিমও বসে আছেন ওখানে। তুলতুলকে রিমা নিচু স্বরে কিছু বলতেই তুলতুল সালিম সাহেবকে সালাম দিলো।
“বসো বউমা। এনারা বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক। যা যা জানতে চায় বলো এনাদের।”
তুলতুল আগা মাথা কিছু না বুঝে মাথা দুলায়। ও বসা মাত্রই একজন প্রশ্ন করলো-“মিসেস তুলি, বিয়েটা কি আপনার ইচ্ছায় হয়েছে নাকি জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে? আপনারা কি পূর্ব পরিচিত? যে ভিডিও ফুটেজ লিক হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে আপনাকে জোর করে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কোনটা সত্যি?”
তুলির হাত পা ঘামতে শুরু করেছে। সে হতবিহ্বল হয়ে একবার রিমা আর একবার সালিম সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। কি বলবে কি বলবে না সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। গরম লাগছে ভীষণ। তুলতুলের মনেহলো তার মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সোহেলকে দেখা গেলো। ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে মুখে হাসি নিয়ে সে তুলতুলের পাশে বসলো। ওকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে গদগদ কন্ঠে বললো-“আরে, তুমি চুপ করে আছো কেন বউ? সাংবাদিক ভাইয়েরা যা জানতে চায় তা বলো। বলো কেন আমি তোমাকে তুলে আনলাম। বলো সত্যিটা। তোমার সাথে যে আমার সম্পর্ক আছে আর সেটা তোমার পরিবার মানবে না তা বলে দাও। তোমার আম্মা অন্য জায়গায় তোমার বিয়া দিয়ে দিবে। আমি গুন্ডা মাস্তান তাই আমার সাথে বিয়া দিবে না। তুমিও মায়ের কথা মেনে নিয়ে আরেক জায়গায় বিয়ে করতে রাজি হইছো। এইটা কি প্রেমিক হয়ে আমি মেনে নিতে পারি না নেওয়া উচিত? তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই কাজ করতে হইছে। বলো ঠিক কিনা? বলো বলো।”
তুলি সোহেলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে মিথ্যা গল্প সাজাতে পারে সেটা সোহেলকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না কিছুতেই। আর এতো নিখুঁত অভিনয় কিভাবে পারে? এরকম নিখুঁত অভিনয় আর মিথ্যে গল্প সাজিয়েই কি এই গুন্ডা আর ওর বাবাটা দিনকে রাত আর রাতকে দিন প্রমান করে? এভাবেই কি সত্যকে অন্ধকার প্রকোস্ঠে পাঠিয়ে মিথ্যেকে প্রজ্জলিত করে?
চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৭
ইব্রাহিম পরিবার এখনো যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যৌথ পরিবার বলতে সালিম সাহেবরা তিন ভাই একত্রে থাকা আর কি। বাবা গত হওয়ার পর মা বিছানাগত। এতোদিন ইব্রাহিম মোর্শেদের স্ত্রী এ বাড়ির বড় বউ মিনু পরিচালনা করতো সংসার। রিমা তার সাথে সাথে থাকতো। গত মাসখানেক সে কানাডায় তার বড় মেয়ের কাছে গেছেন। মেয়ের বাচ্চা হবে সেই উপলক্ষে। তারপর থেকে রিমার উপর সংসারের দায়িত্ব চেপেছে।
এ বাড়ির বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে। মোর্শেদের এক মেয়ে যার বিয়ে হয়েছে বাড়ির কাছেই আর সালিমের ছেলে সোহেল বাদে দুই ভাইয়ের বাকী চার ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকে। কেউ পড়াশোনা করছে কেউ পড়া শেষে চাকরি করছে। তাদের কারো মধ্যেই দেশে ফেরার টান নেই কিংবা বলা যায় দেশে ফিরতে চায় না।
ইব্রাহিম সালিমের ছোট ভাই ইব্রাহিম তাহের এখনো ব্যাচেলর। বিয়ে করেনি, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, টুকটাক লেখালেখি করেন শখের বসে। কিছুটা আলাভোলা স্বভাবের মানুষটা বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে নিজের ফ্লাটে নির্জনে থাকে। কালেভদ্রে বাবার তৈরি করা বাড়িতে আসেন। আসলে তিনি এই বাড়িতে এসে থাকতে পারেন না। দমবন্ধ হয়ে আসে তার। মনেহয় এ বাড়ির প্রতিটা ইট অভিশপ্ত। যে অন্যায় তার দুই ভাই করে তা স্বচক্ষে দেখা তার পক্ষে সম্ভব না। আবার ঠেকানোও সম্ভব না সম্পর্ক নষ্ট হবে এই ভয়ে তিনি এসব থেকে দূরে থাকেন। তার বৈরাগী জীবনে বেঁচে থাকার রসদ বলতে তার ভাইয়ের বাচ্চারা। এরা সবাই তাদের ছোট চাচাকে অত্যন্ত পছন্দ করে। তাদের জীবনের যাবতীয় সিক্রেট তাদের ছোট চাচা জানে।
সে জানা থেকেই তাদের মেঝ ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে শারমিন শুভ্রা তাকে ফোন করেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। দেশে ফিরবে সে বাবা মাকে না জানিয়ে। তার পঁচিশতম জন্মদিন সে বাবা মায়ের সাথে স্পেশাল ভাবে কাটাতে চায়। সেই হিসেবে তার ফ্লাইট ছিল দিন পাঁচেক আগে। তাহের ভাতিজীকে বরন করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু আসল সময়ে ভুলে বসে থাকলেন। যখন মনে পড়লো তখন শারমিনের ফ্লাইট ল্যান্ডের সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। তবুও ভাতিজীকে বারবার ফোন দিলেন। এয়ারপোর্টে এসে খোঁজ নিলেন কিন্তু কোন ভাবেই শারমিনের কোন হদিস পেলেন না। ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেলেন তিনি। নানা জায়গায় ফোন করেও যখন কোন কুল কিনারা পেলো না তখন সত্যি সত্যি ভীত হলেন। গেল কোথায় মেয়েটা? বাড়িতে যায়নি তো? এটা ভেবেই
বাড়িতে ফোন দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ভাবির সাথে আলাপ করে বুঝলেন শারমিন বাড়িতেও যায়নি। এবার হাত পা ঘামতে শুরু করলো। ভাইকে ফোন দিয়ে জানাবেন সেই সাহস করে উঠতে পারলেন না সোহেলের ঝামেলা শুনে। কেন যেন মনে হলো সামনে বিরাট এক ঝড় আসতে চলেছে তাদের জীবনে। সেই ঝরে তার পরিবার লন্ডভন্ড হবে।
দুইদিন অপেক্ষা করলেন। হাজার বার শারমিনের নাম্বার ডায়াল করলেন। কিন্তু বন্ধ শুনতে শুনতে কান বন্ধ হওয়ায় উপক্রম। অবশেষে মনস্থির করে লন্ডনে থাকা শরীফকে ফোন দিলেন। সব ঘটনার বিস্তারিত জানালেন। শরীফ জানালো সে খবর নিয়ে জানাচ্ছে। পরেরদিন শরীফ যখন জানালো
শারমিনের ইউনিভার্সিটিতে উইন্টারের ছুটি শুরু হয়েছে। সে তেরো তারিখ রাতে ফ্লাইটে উঠেছিল। দুবাইতে ট্রানজিট ছিলো সাতঘন্টা। সেই হিসেবে পনের তারিখ সকালে তার বাংলাদেশে ল্যান্ড করার কথা। আজ আঠারো তারিখ। শারমিনের ফোন বন্ধ। শারমিন বাসায় যায়নি তাহলে গেছে কোথায়? কোথাও না গেলে শারমিনের সাথে কি হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আঁচ করে চাচা ভাতিজা দু’জনেই ঘামতে শুরু করেছে। দু’জনেই জানে, এই ঘটনা সালিম সাহেবের কানে গেলে কেয়ামত ঘটে যাবে। শরীফ চাচাকে অভয় দিল, সে রাতেই ফ্লাইটে উঠবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। বাবাকে এখনই কিছু জানাতে মানা করে। সে এসে বাবার সাথে কথা বলবে।
মাঝে আরও একদিন কেটে গেছে। শরীফ এলো বিশ তারিখ বিকেলে। তাহের শরীফকে নিয়ে ইব্রাহিম ভিলায় পা রখলো রাত এগারোটার কিছু পরে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সালিম, মোর্শেদ, সোহেল আর রিমা। সে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আঁচলে চোখ মুছছে। সালিমের ব্যক্তিগত সহচর তুহিন দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সকলের চেহারা অন্ধকার, পুরো বাড়ি থমথমে। চাচা ভাতিজা দু’জনেই দু’জনকে দেখলো। ওদের ভেতরে ঢুকতে দেখে সকলেই অবাক হলো। বিশেষ করে শরীফকে দেখে। সালিম সাহেব বলেই ফেললেন-“তুমি হঠাৎ দেশে এলে? তোমাকে কে খবর দিলো?”
শরীফ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে-“কিসের খবরের কথা বলতেছেন? আপনাদের সবার কি হয়েছে? মা কাঁদছে কেন?”
রিমা শরীফকে দেখে দৌড়ে এলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো-“ও শরীফ, শারমিনরে কে জানি অপহরণ করছে। তুইল্লা নিছে আমার শারমিনরে। ও আল্লাহ কি হইলো এইসব?”
শরীফ আর তাহের দু’জনেই চমকে উঠে একে অপরকে দেখলো।
★★★
একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল রণর। মেয়েলি ডাকে চমকে উঠলো। সামনে সদ্য গোসল করে আসা শুভ্রা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে হাফ হাতা গেন্জি আর ঢিলেঢালা প্যান্ট। চুল থেকে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে, মুখটা টলটলে হয়ে আছে। চোখ দুটো ম্রিয়মান। ফর্সা উন্মুক্ত বাহু নেশা ধরায়। রণ নজর সরিয়ে বললো-“আপনাকে এসব পোশাক পরতে নিষেধ করেছিলাম।”
শুভ্রা চেয়ার টেনে সামনে বসলো-“শুনুন, পোশাকটা একদম নিজস্ব পছন্দ আর আরামের ব্যাপার। কাজেই এ ব্যাপারে কারো কোন কথা বলা উচিত না। আপনি যেমন সুন্দর শার্ট প্যান্ট পরে আছেন এখন কেউ যদি আপনাকে শর্টস আর স্যান্ডোগেন্জি পরে থাকতে বলে তাহলে ভালো লাগবে বলেন?”
রণ জবাব দিলো না দেখে শুভ্রা পুনরায় বললো-“আপনার শর্ত অনুযায়ী কাজ শেষ করেছি। চেক করে নিন।”
“পরে করবো। এখন খেয়ে নিন।”
রণ খাবার প্লেটে বেড়ে শুভ্রার সামনে দিলো। আয়োজন খুব সামান্য। সাদাভাত, ডাল, ডিম ভাজি আর আলুভর্তা। শুভ্রা প্রায় হামলে পড়লো খাওয়ার উপরে। কিন্তু কয়েকগ্রাস খাওয়ার পরেই ওর রুচি নেমে গেলো। পেট মুচড়ে উঠলো। গলার ব্যাথাট বেশ ভোগাচ্ছে তাঁকে, শরীরও শীতে কাঁটা দিচ্ছে। মনেহচ্ছে আবারও জ্বর আসছে। সে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো। রণ কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“খাবেন না?”
“নাহ। গলাটা খুব ব্যাথা করে আর জ্বর আসছে আবার।”
রণ জবাব না দিয়ে খাবার গুছিয়ে রাখলো। শুভ্রা ওষুধ মুখে দিয়ে রণকে ডাকলো-“আমি তো আপনার শর্তে রাজি আছি। চেয়ারে বাঁধার প্রয়োজন আছে?
“আপনি চাইলে বিছানায় থাকতে পারেন।”
“ধন্যবাদ।”
রণ ফিরে আসতেই শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন, আমার সময় কাটানোর কোন বন্দোবস্ত করুন। এভাবে থাকতে কষ্ট হয়। কখনো এমন বন্দী থাকিনি বুঝতেই তো পারছেন।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“টিভি তো নিজেই ভাঙলেন। অবশ্য থাকলেও যে দেখতে পেতেন এমন না।”
শুভ্রা বিরক্ত হলো-“আমাকে বরং কিছু বই এনে দিন।”
রণ জবাব দিলো না। শুভ্রা গায়ে কম্বল চেপে চোখ বুঝলো। আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে।
মিহির খানিকটা গম্ভীর হয়ে আছে। রণ জানতে চাইলো-“কি হয়েছে?”
“ক্যালকুলেশন উলট পালট হয়ে গেলো না? ওই সাংবাদিকের মেয়েটাকে বিয়ে করবে এইটা তো বুঝি নাই।”
“আমি ভেবেছিলাম। ওনার পক্ষে সবই সম্ভব। তবে এই কাজ সে নিজের ইচ্ছায় করে নাই। দলের চাপে করেছে। না করলে খুব খারাপ ইমেজ হতো দলের। ওনার একার জন্য সার্বিকভাবে দল ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা কেউ মানবে না।”
রণর কথায় মিহির সন্তুষ্ট হলো। একটু গম্ভীর হয়ে বললো-“ভাই, এই কয়েকদিনে ওরা অন্য সব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো বলে এইদিকে নজর পড়ে নাই। এখন যখন জেনে গেলো সাবধান থাকা লাগবে। আর আপনের পরিচয় প্রকাশ হলে আরও বেশি ঝামেলা। আপনার উপর রিস্ক বাড়বে।”
“সমস্যা কি? তুই আছিস, রাজিব আছে, দিলশাদ আসবে। আরও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়ে যাবো আশাকরি। সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং ফুপি আছে সাথে।”
মিহিরের গাম্ভীর্য কমলো না-“ভাই, মাঠে আপনার ফুপু কিছু করতে পারবে না এটা আপনিও ভালো জানেন। উনি অনেক বেশি খারাপ। এখন যা কিছু করতেছে তার জের তুলবে ভবিষ্যৎ এ নিশ্চিত থাকেন।”
“এইজন্যই তো ওনার সবচেয়ে দূর্বল জায়গাটা হাতে এনেছি। নির্বাচন পর্যন্ত নিশ্চিত আছি। তারপর কি হবে তখন দেখা যাবে। এতো ভাবিস না। আচ্ছা, এখন এসব বাদ দিয়ে বল আজকের আপডেট কি? চিঠি পাঠাইছিস?”
মিহির মাথা দুলায়-“হ্যা। সবাই চুপচাপ খুব বেশি চুপচাপ। যদি কেউ কোনভাবে টের পায়?”
মিহির চুপ করে গেল। রণ হাসলো-“টের পাওয়ার কোন উপায় আছে? পাঁচটা বছর ধরে প্রস্তুতি নিছি তাও যদি ঠিক মতো কাজ না করতে পারি তাহলে জীবন বৃথা। বাদ দে। এতো ভাবিস না। কাল আবার দলের মিটিং। দেখা যাক কি হয়। শুনতেছি পরশু নমিনেশনের ঘোষণা আসবে। শোন, তুই ওইদিকে একটু নজর রাখ। কি করে দেখ।”
“নজর আছে। এখনো কোন আপডেট নাই। ওরা হয়তো এমন কিছু কল্পনাও করে নাই। সারাজীবন যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নেওয়া মানুষকে যদি কেউ তুলে নেয় তাহলে সে কি করবে? আমার মনেহয় ওরা বুঝেই পারতেছে না কি করবে। শরীফ দেশে আসছে আজকেই।”
“ও জানলো কিভাবে?” রণ অবাক হলো।
“তা জানি না। না জানলে তো আসার কথা না। বাপকে দেখতে পারে না তবে বোনকে ভালোবাসে।”
রণ উঠে দাঁড়ায়-“আমি গেলাম। দেরি হইলে মা রাগ করবে।”
মিহির মাথা দুলায়। মিহির টের পেলো রণর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছায়া।
চলবে—
©Farhana_Yesmin