.#দর্পহরন
#পর্ব-৪৭
দীর্ঘ দিন পরে তুলতুলকে নিজেদের বাড়িতে দেখে সবাই বিস্ময়ে বিস্মিত। তুলতুলের চাচা গোলাম রাব্বানীর মেয়ে হিমি তুলতুলকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো-“তুলতুলি! তুমি এসেছ? মা, চাচী দেখো তুলতুলি এসেছে।”
বলেই ছুটে এসে তুলতুলকে জাপ্টে ধরে হিমি। মিতা আর তহুরা ছুটে এসে তুলতুলকে দেখে চমকে যায়। তারা খুশি হবে না ভীত হবে তাই বুঝতে পারছে না। তুলতুল হঠাৎ কি করে এলো? ওরা এতো সহজে ওকে আসতে দিলো? নাকি তুলতুল পালিয়ে এসেছে? নানা প্রশ্ন মনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। মেয়েকে এতো কাছে পেয়েও কাছে টানতে দ্বিধা। তুলতুলের বিরক্ত লাগছিল। বেশ কিছু সময় পরে তহুরা কম্পিত কন্ঠে বললো-“ও তুলতুল, তুই সত্যি আসছিস নাকি আমি স্বপ্ন দেখতেছি?”
তুলতুল প্রায় ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে-“সত্যি আসছি মা।”
মিতা পাশ থেকে বললো-‘ওরা আসতে দিলো নাকি তুই…”
তুলতুল হেসে দেয়-“কি বলো চাচী? একা কিভাবে আসবো? উনি নিয়ে আসছে।”
এবার পেছনে দাঁড়ানো মানুষটাকে নজরে পড়ে সবার। শরীফ সংকোচ নিয়ে হাসলো সালাম দিলো তুলতুলের মা আর চাচীকে-“আসলে ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম। উনি আপনার কাছে আসার জন্য জেদ করতেছিল তাই আমি নিয়ে আসছি।”
তহুরার চোখ ছলছল, মুখজুড়ে কৃতজ্ঞতার ছায়া-“বাবাজী, কিযে খুশি দিলা এই মাকে। মেয়েটাকে আজকে আট দশ মাস পরে নিজের কাছে পাইলাম।”
তহুরার গলা কাঁপে। তুলতুল মাকে তাড়া দেয়-“মা এইসব আলাপ বাদ দেও তো। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি ঝালঝাল করে শুঁটকির ভর্তা আর ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়াও। অনেক খাইতে মন চাইছে।”
তহুরা মেয়ের আবদার শুনে হতবিহ্বল বোধ করেন। মিতার দিকে চাইতেই মিতা আশ্বস্ত করলো-“ভাবি, রান্নাঘরে চ্যাপার শুটকি আর ফ্রিজে ইলিশ মাছ আছে বাইর করেন। আমি তাড়াতাড়ি হিমির আব্বা আর ফাহিমকে ফোন দিয়ে ডাকি। ওরা খুশি হবে।”
তহুরা ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বের করে রান্নাঘরের দিকে গেলো। হিমি তুলতুলের গা ঘেঁষে জড়িয়ে আছে-তুলতুলি চলো ঘরে যাই। অনেক গল্প করবো তোমার সাথে।”
তুলতুল অনুমতির আসায় শরীফের দিকে তাকালে শরীফ হাসলো-“যান যান গল্প করুন। কিন্তু শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। আব্বা আম্মার আমানত যেন ঠিকঠাক থাকে না হলে কিন্তু আমার উপর খড়গ নামবে।”
তুলতুল খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। বোনের হাত ধরে ভেতর ঘরে চলে গেলো। ও জানলো না ওর এই প্রানখোলা হাসি দেখে কি পরিমান চমকে গেছে শরীফ। চমকের সাথে সাথে মুগ্ধতাও জায়গা করে নিলো ওর মনে। মেয়েটা এতো সুন্দর করে হাসতে পারে? কই বাড়িতে তো কোনদিন এভাবে হাসতে দেখেনি তুলতুলকে? শরীফ অনেকটা মোহগ্রস্তের মতন একা একা বসে রইলো সোফায়।
পরবর্তী একটা ঘন্টা চমৎকার সময় কাটলো তুলতুলের। তুলতুলের ভাই ফাহিম আর চাচা রাব্বী তুলতুলের আসার খবর শুনে ছুটে চলে এলো। ভাই আর চাচাকে পেয়ে কেঁদে দিলো তুলতুল। এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হলো। সবার চোখে পানি মাঝে শরীফের নিজেকে ক্লাউন মনেহচ্ছিল। সেই সাথে তীব্র অপরাধবোধ মনে বাসা বাঁধছিল। মেয়েটাকে এভাবে আঁটকে রাখার মানেই হয় না। সে বুঝলো তার বাবা মা খুব অন্যায় একটা কাজ করছে মেয়েটাকে তার পরিবার থেকে দূরে রেখে। কিন্তু কিভাবে তুলতুলকে ওই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করবে? সোহেলের বাচ্চা মেয়েটার জঠরে বড় হচ্ছে। সে পৃথিবীতে এলে মেয়েটার দায়িত্ব বাড়বে, মায়ের মমতার শেকলে বন্দী হবে। সব ভেবেই মনটা ভারী চঞ্চল হলো শরীফের।
তুলতুল পেটপুরে খেলো। শরীফ অবাক হয়ে তুলতুলকে অনাহারে থাকা মানুষের মতো খেতে দেখলো। তহুরাও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে চারপাশে তাকাতেই তুলতুলের খাওয়া থেমে যায়-“কি হইছে মা? তোমরা এমনভাবে তাকায় আছো কেন? আমি কি করছি?”
তহুরার চোখের কোনে পানি তবুও সে মিষ্টি করে হাসলো-“তুই কিছু করিস নাই তুলতুল। অনেকদিন পরে তো তাই তোকে দেখতেছি। আরেকটু ভাত নেরে মা। চ্যাপার ভর্তাটা নে।”
তুলতুল আঁতকে উঠলো-“আর না মা। পেট ফেটে যাবে এমন মনে হইতেছে। অনেক শান্তি করে ভাত খাইছি আজকে।”
তহুরা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে শরীফের দিকে তাকায়-“সবই বাবাজীর কল্যানে।”
তুলতুলও দেখলো শরীফকে। ভারী লজ্জা লাগে শরীফের। সে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়-“আমাদের যেতে হবে। বেশি দেরি করলে আব্বা অস্থির হয়ে যাবে।”
রাব্বী মাথা দুলায়-“হ্যা হ্যা যাও। সুযোগ পেলে মেয়েটাকে আবার নিয়ে আসিও। খুব খুশি হবো আমরা।”
শরীফ মাথা দুলায়। সুযোগ পেলে সে সত্যি সত্যি তুলতুলকে নিয়ে আসবে মাঝে মাঝে, এটা সে ভেবে রেখেছে।
*****
নেত্রীর বিশেষ অনুমতি নিয়ে রণ আরও দু’দিন আমেরিকা থেকে গেলো। শুভ্রা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। এতোটা সে আশাই করেনি অথচ রণ করে ফেললো। কৃতজ্ঞতায় মনটা আরেকটু দ্রবীভুত হয়ে যায় শুভ্রার। রণর প্রতি মুগ্ধতার পারদ বাড়লো আরেকপ্রস্ত। ভারী চমৎকার সময় কাটাচ্ছে তারা। বিয়ের এতোগুলো দিন পরে যেন সত্যিকার অর্থেই সে বিয়ের আমেজ পাচ্ছে। রণ পুরোটা সময় একজন সাধারণ স্বামীর মতো শুভ্রার সাথে সেটে রইলো। একসাথে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, শপিং সব মিলিয়ে জীবনের মধুরতম সময়টা কাটছে শুভ্রার।
“ম্যাডাম, কোথায় হারিয়ে গেলেন? গোছগাছ শেষ?”
শুভ্রার সম্বিত ফেরে। তাকিয়ে দেখলো রণ দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে রণ হাসলো-“আমার গোছগাছ কিন্তু শেষ।”
শুভ্রা নিজের হাতের দিকে তাকালো। ব্র্যান্ডেড ব্যাগ দুই ননদের জন্য। নতুন লাগেজটাতে জায়গা হচ্ছে না। শুভ্রা অসহায় চোখে তাকিয়ে চোখ নাচালো-“আপনি কি এই দু’টো আপনার লাগেজে নেবেন? এটা ফুল হয়ে গেছে।”
শুভ্রা নতুন লাগেজটা দেখালো ইশারায়। রণর মুখে দুষ্ট হাসি খেলে গেলো। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললো-“নেব কিন্তু ফিস দিতে হবে।”
রণর মতলব বুঝে শুভ্রার গাল লাল হলো-“হাসিখুশির জিনিস এগুলো। এরজন্য ফিস দিতে পারবোনা।”
রণ শুভ্রার কাছাকাছি চলে এলো। হাত থেকে ব্যাগ দু’টো নিয়ে বললো-“আমি ফিস ছাড়া কাজ করি না। এগুলো রেখে আসছি ফিস নিতে। আমাদের বেরুতে হবে আর দু’ঘন্টার মধ্যে। তাড়াতাড়ি সব ক্লোজ করো।”
বলেই টুপ করে চুমু দিলো শুভ্রার গালে। গালে হাত দিয়ে শুভ্রা ফিক করে হেসে দেয়। মন্ত্রী মশায় এর আচরণগুলো জনগণ টের পেলে বেশ হতো। দায়িত্ববান মানুষটাও যে এমন দুষ্ট মিষ্টি হতে পারে তা কে জানতো? গত দু’দিনের কথা ভেবে শুভ্রার রঙিন গাল আরও রঙিন হলো।
ওরা দেশে ফিরতেই ছেলে আর বউকে দেখেই জলি সব বুঝে গেছে। মেয়েটা হয়তো এ কারনেই আমেরিকা গেছিল। রণকে দখল করতে। জলির মনোভাব নিশ্চয়ই বুঝেছে শুভ্রা। এ বাড়িতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে তাই উঠেপড়ে লেগেছে শুভ্রা। কিন্তু যত যাই করুক জলি শুভ্রাকে কিছুতেই সুযোগ দেবে না। রণকে কারো হাতের পুতুল হতে দেবে না কিছুতেই। তাইতো শুভ্রা যখন জলিকে গিফট দিলো জলি মুখ কালো করে থাকলো-“ছেলের এতোগুলা টাকা নষ্ট করার কি দরকার ছিলো?”
শুভ্রা সহসা জবাব দিতে পারে না। বুঝলো জলির অপছন্দের মানুষের তালিকায় তার নাম উঠে গেছে। এখন হাজার চেষ্টা করলেও কিছু হবে না। তবুও চেষ্টা করে যেতে হবে। এটাই হয়তো তার নিয়নি।
এসে পড় থেকে রণ ভীষণ ব্যস্ত। দেখা হওয়াই দুষ্কর হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় সফর করতে হচ্ছে। এরমধ্যে সামনে আবার একটা সম্মেলন বলে বেশ জমজমাট সিডিউল মেইনটেন করতে হচ্ছে। শুভ্রা জেগে থাকার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ দিন ঘুমিয়ে যায়। সকালে ঘুম ভাঙার পরে ভীষণ আফসোস হয়। আজ একটু আগেই বাসায় ফিরে এলো রণ। শুভ্রা তখন কিচেনে কাজ করছিল। রণ এসেই ওকে ডাকলো। শুভ্রা কাছে যেতেই ফিসফিস করলো-“ঘুমিয়ে যেয় না। আমি মায়ের সাথে আলাপ সেরে আসতেছি।”
প্রতক্ষ্য প্রস্তাব, অস্বীকার করার কোন কারণই নেই। শুভ্রা বরং পুলকিত হয়। নিজেকে মনেমনে প্রস্তুত করে। কিন্তু রণ ফিরে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। বের হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-“এখনো বসে আছো? খেতে দাও প্লিজ। চরম খিদে পেয়েছে।”
শুভ্রা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তাতে রণর ধমক খেতে হলো-“আরে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? খাবার চেয়ে অন্যায় করলাম?”
শুভ্রা বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে কি হলো রণর? মা কি কিছু বলেছে? আজকের ঘটনার ব্যাপারে?
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৪৮
শুভ্রার কান্না পেয়ে গেলো। সে হুহু করে কেঁদে দিলো। রণ যেন বোকা বনে গেলো। ছুটে এসে শুভ্রার কাছে বসে ওর হাত ধরে নরম গলায় বললো-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো শুভ্রা-“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন আমার সাথে? কি করেছি আমি?”
রণ এবার কিছুটা লজ্জিত হলো। আসলেই তো এই মেয়েটার সাথে রুড আচরণ কেন করছে সে? মনে মনে নিজেকে কষে ধমক দিলো। অপরাধী মনে যত্ন নিয়ে শুভ্রার চোখের জল মুছে দিলো-“সরি সরি, প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।”
রণর মুখে সরি শুনে কিছুটা শান্ত হলো শুভ্রা-“আমার কোন ভুল থাকলে বলবেন আমি ভুল শোধরাতে চেষ্টা করবো। কিন্তু এরকম ব্যবহার মেনে নিতে পারবোনা।”
রণ শুভ্রাকে কাছে টানলো। নিজের বুকের কাছটাতে শুভ্রার মাথাটা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরলো-“সরি বলছি আবারও। আসলে মায়ের কথা শুনে খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল। সেই রাগটা তোমার উপর দেখিয়েছি। কিছু মনে করো না প্লিজ।”
শুভ্রা কিছুক্ষন পোষা বিড়ালের মতো রণর বুকে থাকলো চুপটি করে। তারপর বললো-“আন্টি আমার কথা কি বলেছে আপনাকে?”
রণ চমকে উঠলেও শুভ্রাকে বুঝতে দিলো না। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো-“তেমন কিছু না। বাদ দাও। ভুল আমারই, নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। যে যাই বলুক তাতে আমার প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত না অথচ দেখিয়ে ফেলছি। সরি এগেইন।”
শুভ্রা আর কথা বাড়ালো না। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে উঠে বসলো। তার ইদানীং খুব ভয় লাগে। রণকে হারিয়ে ফেলার ভয়। পারিপার্শ্বিকের সবকিছু মিলিয়ে প্রায়ই মনেহচ্ছে রণকে সে হারিয়ে ফেলবে। শরীর কাটা দিলো শুভ্রা। সেটা লুকাতেই দ্রুত উঠে যেতে চাইলো। রণ উদ্বিগ্ন হয়ে শুভ্রার হাত ধরে-“কি হলো? কোথায় যাচ্ছ?”
“আপনার খাবার?”
রণ মাথা নাড়ে-“উহু, লাগবে না। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বসো প্লিজ।”
রণ শুভ্রার হাত ধরে টানলো। নিজের কাছে বসিয়ে দিলো। শুভ্রার দিকে তাকিয়ে স্মাল হাসলো-“তুমি নিশ্চয়ই মায়ের ব্যবহারে খুব অবাক হচ্ছ। ভাবছো যে মানুষটাকে ব্লাকমেল করে তুমি আমাকে বিয়ে করলে সে তোমার প্রতি এতো কঠোর কিভাবে হচ্ছে, তাই না?”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। রণ শ্বাস টানলো-“যখন তোমাকে বিয়ে করানোর জেদ ধরেছিল তখন আমিও ঠিক এমনটাই অবাক হয়েছিলাম।”
শুভ্রা খানিকটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো-“কেন?”
রণ কয়েক মুহূর্ত শুভ্রার মুখপানে তাকিয়ে রইলো। কি সুন্দর টলটলে মুখশ্রী। প্রসাধন বিহীন তবুও তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। এই মুহূর্তে একদম নিস্পাপ দেখাচ্ছে। রণর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মন চাইছে অনেকটা সময় ওই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। শুভ্রা তাড়া দিলো-“কি হলো বলুন।”
রণর ধ্যানভঙ্গ হয়। মুখে খানিকটা বিষাদের ছায়া পড়ে-“কথাগুলো তোমাকে বলার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মনে হলো ভবিষ্যতের জন্যই বলে ফেলা উচিত। আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করতে হলে তুমি যদি পৃথিবীর সর্বশেষ মেয়ে হতে তবুও হয়তো মা তোমাকে পছন্দ করতো না কারণ তুমি ইব্রাহিম সালিমের মেয়ে। সেই মা হুট করে তোমাকে বউ বানাতে মরিয়া হয়ে গেলে আমি তাই ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। মাকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছিলাম সে যা করছে তা ঠিক না।বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। চিরশত্রুর মেয়েকে বিয়ে করা যায় না। কিন্তু মা তখন জেদ আঁকড়ে ধরলো। এখন দেখুন আপনাকে সহ্য করতে পারছে না। অবশ্য এক্ষেত্রে মাকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। তোমার পরিবারের হাত আছে ষোল আনা। তারা নিজের আচরণে লাগাম টানতে পারছে না। যার ফলে মায়ের পুরনো রাগ ফিরে আসছে।”
রণর কথা শুনতে শুনতে শুভ্রার মুখের আদল বদলে যাচ্ছে বারবার। শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রণ থামতেই প্রশ্ন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো-“আন্টি কেন পছন্দ করে না? আবার কি করেছে আমার পরিবার?”
রণ প্রসঙ্গ বদলে বললে-“তুমি কি জানো খুশির ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে খুশিকে বিরক্ত করছে তন্ময়? বেশ অনেকদিন যাবত এমন চলছে। খুশি ভয়ে বলেনি আমাকে। আজ খুব বাড়াবাড়ি করেছে তন্ময়। মা জানতে পেরে রাগারাগি করছে আমার সাথে। তুমি এ বাড়িতে আছো বলেই নাকি এমন হচ্ছে।”
শুভ্রার বুক ধরফর করে তন্ময়ের কথা শুনে। এতো কিছু কবে করলো তন্ময়? বাবাকে বলার পরও বাবা কেন কিছু করলো না? শাশুড়ীর রাগটা তো তাহলে দোষের নয়। শুভ্রার নিজেকে খুব অসহায় লাগে। রণ হতাশ হয়ে বললো-“আমাকে বলো কি করবো? খুশির যদি সামান্য বিপদও হয় মা তোমার সাথে কি করবে আমি জানি না। আমি জানি তোমার কোন দোষ নেই কিন্তু তোমার পরিবারের এইসব কাজ আর কতোইবা মেনে নেব বলো তো শুভ্রা? আমাকে বলে দাও কি করবো আমি? কোনদিকে যাব?”
রণকে ভীষণ অসহায় দেখালো। অসহায় দেখায় শুভ্রাকেও। ও কি বলবে ভেবে পেলো না। তন্ময় এমন কেন করছে? মেয়ের কি অভাব পড়েছে? কেন খুশির পেছনে পড়ে আছে? রণ বললো-“দেখো শুভ্রা, যেভাবেই হোক বিয়ে করেছি তোমাকে। বউ তুমি আমার। আমি কোনভাবেই চাই না তোমার প্রতি সামান্য অন্যায় করি, অসন্মান করি। কিন্তু সেই সাথে এটাও চাই না আমার মা বোন আমার কারনে সাফারার হোক। তাহলে হয়তো আমার দ্বারাও কোন অন্যায় হয়ে যেতে পারে। তুমি বলো, এখন তন্ময়কে কি করা উচিত আমার? তোমার বোনের সাথে কেউ এমন করলে কি করতে তুমি?”
শুভ্রা মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝে পেলো না। এই প্রথম নিজেকে ভীষণ অসহায় আবিস্কার করলো।
*****
রাতে শরীফকে ডেকে পাঠালেন সালিম সাহেব। শরীফ ঘরে ঢুকে বললো-“আমাকে ডাকছেন আব্বা?”
“হ্যা। বসো। তোমার লগে কথা আছে।”
শরীর খানিকটা অবাক হয়েই একবার মা আর একবার বাবার দিকে তাকালো। রিমা ইশারায় শরীফকে বসতে বললো। সালিম সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলো। শরীফের দিকে তাকিয়ে বললো-“সোহেল তো আর দুনিয়ায় নাই। আমার সন্তান বলতে তুমি আর শুভ্রা। আর সোহেল নাই যেহেতু তাই ওর সন্তান আমার সোহেলের জায়গা নিব। বাচ্চাটা জন্মের আগেই বাপ হারা। ওর মা ওকে চায়না হয়তো। সবই বুঝি কিন্তু নিরুপায় আমি। সন্তানের মায়া বড় মায়া। আমি চাইনা আমার সোহেলের বাচ্চা এতিমের মতো বড় হোক। তাই আমি আর তোমার মা একটা সিদ্ধান্ত নিছি। আমাদের মনে হইছে এমনটা হইলে সবদিক রক্ষা হবে।”
শরীফ ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার বাবা কি বলতে চাইছে। সালিম সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মন বুঝতে চাইলো পারলো না। সংকোচ হচ্ছে শরীফকে বলতে। বরাবরই শরীফের সাথে তার দূরত্ব ছিলো। এখন তাই হুট করে ছেলের কাছে বায়না ধরতে দ্বিধা লাগে। রিমা স্বামীর কাজ সহজ করতেই মুখ খুললো-“তুলতুল তোরে মানে শরীফ। ও আমার নাতি মা হইবো কিন্তু ও যোয়ান মাইয়া, ওরে এই বাড়িতে চিরকাল রাখার উপায় নাই। আবার ও না থাকলে আমার নাতি মা হারা হইবো ভাবলেই বুক কাঁপে। ভাইবা দেখলাম সব সমস্যার একটাই উপায়। তুই যদি তুলতুলরে বিয়া করোস তাইলে বাচ্চাটা বাপ মা দুজনকেই পাইবো, তুলতুলও চিরজীবন এই বাড়িতে থাকতে পারবো।”
শরীফ হা করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের বলা কথাটা মগজে ঠিকঠাক ঢুকতেই অদ্ভুত একটা অনুভবি হলো। সে ফট করে হেসে দিলো-“তোমরা পাগল হইছো আম্মা। ওই মেয়ে কি পরিমান ঘিন্না করে আমাদের তা তুমি জানো না। তোমরা ওকে জোর করে আঁটকায় রাখছো এখন আবার আমার সাথে বিয়া দিতে চাও। এই খবর শুনলে নির্ঘাত গলায় দড়ি দিব। আম্মা, ওরে ছাইড়া দাও। নিজের মতন বাঁচতে দাও। এইসব বিয়া শাদীর চিন্তা বাদ দাও। তাছাড়া বাচ্চা পেটে বিয়া হয় না।”
রিমা খেঁকিয়ে উঠলো-“তুই পাগল হইছোস শরীফ। বাপ মায়ের কাছ থিকা সারাজীবন দূরে দূরে থাইকা তুই স্বার্থপর হইছোস। নাইলে তুই বাপ মায়ের কথা বাদ দিয়া ওই মাইয়া নিয়ে ভবোস কেন? নিজের ভাইয়ের বাচ্চার জন্যও তোর মহব্বত নাই। কেমুন ভাই তুই?”
মায়ের আক্রমনে শরীফ হতবিহ্বল বোধ করে। নিজেকে বাঁচাতে বললো-“এইসব কেমন কথা আম্মা? নিজেদের নিয়ে এতো ভাবতে যাইয়া আপনে অন্যের জীবন নিয়ে খেলতেছেন। এইগুলা ঠিক না আম্মা।”
“আচ্ছা! কি অন্যায় করতেছি ক তুই। বাচ্চা হওয়ার পর ধর তুলতুলরে যাইতে দিলাম। তারপর কি হইবো? ওয় কি হাতিঘোড়া উদ্ধার করবো জীবনে? কেডা বিয়া করবো ওরে? আর বিয়া করলেও জামাই ভালো হইবো সেই গ্যারান্টি কি? আমরা তোর মতন না। তুলতুলকে নিয়ে ভাবছি দেইখাই তোরে কইছি ওরে বিয়া করতে। তোর যদি এতই চিন্তা থাকে তাইলে তুই ওরে বিয়া কইরা ওর শখ পূরণ কর। নাইলে বড় বড় কথা কইস না।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হলেন-“আহ রিমা, থামো তো। শোন শরীফ, এতো কথার কাম নাই। তুই আমাকে পরিস্কার কইরা ক তুই কি করবি। তুলতুলের এমনেও এই বাড়িতে থাকতে হইবো সোহেলের বাচ্চার মা হইয়া। আল্লাহর ইচ্ছাও তাই। তা না হইলে ওর পেটে সোহেলের বাচ্চা আইতো না। এখন কথা হইলো, তুই যদি ওরে সন্মান দিয়ে এই বাড়িতে রাখতে চাস তাইলে বিয়া কর নাইলে এমনেই থাক। এতো কথা চালাচালির কাম নাই। ভাইবা দেখ তুই কি করবি।”
শরীফ উঠে এলো। অবাক হলো সালিম সাহেব ওকে জোর করলো না দেখে। মায়ের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে হেঁটে নিজের ঘরে ফিরছিল। হুট করে সামনে তুলতুল এসে দাঁড়ায়-“আমার একটা কাজ করে দিবেন?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শরীফ। সেদিনের পর থেকে তার সাথে বেশ সহজ হয়ে গেছে তুলতুল। অন্য কারো সাথে না হলেও তার বেশ কথাটথা বলে। শরীফ হাসার চেষ্টা করে বললো-“কি কাজ?”
“আমার কিছু বই লাগবে। সময় কাটে না মনে খুব আজেবাজে ভাবনা আসে। তাই বই পড়ে সময় কাটাতে চাই। ভালো ভালো গল্পের বই যেগুলো পড়লে মন ভালো হবে সেগুলো এনে দিন। দেবেন তো?”
তুলতুল উত্তর শোনার জন্য শরীফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শরীফ হাসলো-“আচ্ছা ঠিক আছে। এনে দেব।”
“থ্যাংক ইউ।”
তুলতুল চলে যাচ্ছিলো শরীফ ডাকলো-“তুলতুল, শোনো।”
তুলতুল সাথে সাথে ফিরলো-“জ্বি, বলুন।”
শরীফের লজ্জা লাগলো হঠাৎ। কি মনে করে সে তুলতুলকে ডাকলো? সে সাথে সাথে বললো-“কিছু না। এমনিতেই ডেকেছি।”
বলেই সে হাটা দিয়ে চলে গেলো। তুলতুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
চলবে
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৪৯
মৃত্যু জীবন থামিয়ে দেয় না। পৃথিবী আপন গতিতে চলতে থাকে। ছেলের মৃত্যুতে কিছুটা স্থবির সালিম সাহেবের জীবন। বেশিরভাগ সময় বাসায় মাঝে মাঝে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুপচাপ বসে থাকেন। আগে বেশিরভাগ কাজ সোহেল সামলে নিত এখন তুহিন দেখে। এই বসে থাকার মাঝেই অনেকরকম খবর কানে আসে। ক’দিন চুপচাপ সব শুনলেন, সত্য যাচাই করলেন। তারপর আজ
সালিম সাহেব নেত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছেন। ভয়ে ভয়ে ছিলেন নেত্রী তার সাথে দেখা করবেন কিনা। কিন্তু নেত্রী তাকে অবাক করে দিয়ে দেখা দিলেন।
“সালিম, কেমন আছো?”
“কেমন আছি তা আপনার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না আপা। আমার যেমন থাকার আমি তেমনই আছি।”
নেত্রী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। সালিম সাহেব বেশ শান্ত মেজাজে বসে রইলো। নেত্রীই জানতে চাইলো-“হঠাৎ দেখা করতে আসলা? কোন জরুরি দরকার?”
একটু সময় নিলো সালিম সাহেব। মনে মনে কথা গুছিয়ে মুখ খুললো-“আপা, আপনার সাথে আছি কত বছর তা কি জানা আছে আপনের?”
হুট করে এমন প্রশ্ন শুনে নেত্রী কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সালিম সাহেবকে দেখলো। সালিম সাহেব ম্লান হাসলো-“বেয়াদবী নিয়েন না আপা। প্রশ্নটা করলাম এই কারনে যে মাঝে মাঝে সবারই অতীত মনে করা দরকার তাতে হয় কি আপনার বিপদে কে পাশে ছিলো তা নতুন করে মনে পড়ে। আমরা বর্তমানে বাঁচি এটা যেমন সত্য তেমন বিপদের বন্ধু কে হয় তাদেরও চিনে রাখা দরকার। আপা, আপনে আমার উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন নানা কাজে। আমার যে ছেলে এইসব কাজে জড়িত ছিলো আল্লহ তাকে নিজের কাছে ডেকে নিছে। এখন নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে আপনার কোন সমস্যা নাই?”
নেত্রীর চেহারা খানিকটা পরিবর্তন হলো। যদিও চেহারা দেখে মনোভাব আন্দাজ করা যায় না। নেত্রী জানতে চাইলো-“তুমি আসলে কি বলতে চাও সালিম সরাসরি বলে ফেলো।”
“আপা, আপনি বলছিলেন সংসদ নির্বাচন থেকে সরে যাইতে। আমাকে মেয়র পদে নমিনেশন দিবেন। এখন কানাঘুষা শুনতেছি আব্দুস সবুরকে নমিনেশন দিবেন। আপা, আমি আপনার বাবার সাথে কাজ করছি। এখন আমাকে এমন কোনঠাসা করা মানে অপমান করা। এই অপমান আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেছি না। মানলাম আমার অনেক ভুল আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করছি কিন্তু আপা আপনার জন্য অনেক কিছু করছি। যখন যা বলছেন আমি জান দিয়া চেষ্টা করছি। এখন আমার এই অপমানে যদি আপনি সায় দেন তাইলে আমি কষ্ট পাবো আপা। এমনিতেই ছেলের শোকে কাতর হয়ে আছি তার উপর যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে আমার দ্বারা নতুন করে ভুল হয়ে যাইতে পারে।”
নেত্রীর চোয়াল শক্ত হলো। সাথে সাথে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে হাসলো-“রাজনীতিতে ইমোশনাল হলে চলে না সালিম। এইবার সাংসদ হইতে পারো নাই বলে কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? আগামীবারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেই তো পারো। এখন যদি তোমাকে মেয়র পদে নমিনেশন দেই তাহলে আগামী বারের ইলেকশন করতে পারবা না। আর তুমি ভালো মতোই জানো সংসদ নির্বাচন মেয়রের চাইতে অনেক বেশি কাজের। ক্ষমতার দাপট বেশি।”
সালিম সাহেব মাথা নাড়েন-“না আপা, পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা অনেক কঠিন। তাছাড়া আমি যদি পাতি নেতা হতাম মেনে নিতাম। আমি পুরনো মানুষ নতুনদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া কষ্টকর আমার জন্য।”
“তোমার নিজেকে শোধরাবার কথা বলেছিলাম সালিম। পাঁচ বছর ধৈর্য্য ধরে নিজেকে শোধরাও তারপর ফিরে আসো।কিন্তু তুমি দেখি কোন কথা শুনতেছ না। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নাই। এরকম করলে তো আমি টিকতে পারবোনা।”
নেত্রীর কথায় সালিম সাহেব প্রচন্ড অপমান হলেন। নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে হাতের শেষ অস্ত্র ব্যবহার করে বসলো-“আপা, আমি তাহলে মাজহার ভাইয়ের সাথে দেখা করি। সে কি বলে শুনি।”
নেত্রীর চেহারা বদলে গেলো। মুখটা ক্রমশ লাল হয়ে গেলো-“সীমা অতিক্রম করে ফেললে সালিম। আমি তোমার ভালো চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি বুঝলে না।”
সালিম নত না হয়ে বললো-“আপনি আর কোন উপায় রাখেন নাই আপা। আমি বাধ্য হয়ে কথাগুলো বললাম। আমি মেয়র নির্বাচনে মনোনয়ন চাই আপা। সংসদ নির্বাচন আসুক তখন দেখা যাবে। আজ আসি আপা। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মাফ করবেন।”
সালিম সাহেব দাঁড়ালেন না ঝটপট রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। থমথমে মুখ নিয়ে নেত্রী তখন চেয়ারে বসে আছেন।
*****
“দিলশাদ, তন্ময়টা খুব বাড়াবাড়ি করতেছে। কি করি বলতো?”
দিলশাদ হাসলো-“সোহেলের মতো ফিনিশ করে দিব ভাই?”
ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা রণ হাসলো না-“পাগল হইছিস? সালিম সাহেব শান্ত আছে মানে যা খুশি তাই করা যাবে না। এই লোককে বিশ্বাস নাই কোন। অন্য কোন উপায় বল।”
দিলশাদ অভয় দেওয়া গলায় বললো-“তাহলে সিভিল ড্রেসে তুলে নেওয়া যায় ভাই। তারপর দিন কতোক আঁটকে রেখে রগরে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“একটাকে আঁটকে রেখে এখন পস্তাচ্ছি আবার আরেকটাকে আঁটকাবো? মাফ চাই।”
আঁতকে উঠে বিরবির করলো রণ। দিলশাদ বললো-“কিছু বললেন ভাই?”
রণ সাথে সাথে জবাব দিলো-“বলছি এটাও না অন্য কোন বুদ্ধি বল।”
“আর কি বলবো? এরা সহজ মানুষ না তাই সোজা আঙুলে ঘি তুলতে পারবেন না। এরা বেকা মানুষ এদের সাথে তেড়ামি না করলে হবে না। তন্ময় ছেলেটা খুব একটা সহজ না। ছোট বেলায় সোহেলদের সাথে থাকতো, স্কুলে মেলা কিছু করছে। কলেজে একবার মেয়েঘটিত একটা ব্যাপার ঘটাইছিল। তারপরই তড়িঘড়ি করে দেশের বাইরে গেলো। এইবারও হঠাৎ দেশে আসছে। খোঁজ নিতে পারেন কোন ঘাপলা করছে নাকি।”
“আচ্ছা, দেখছি। কিছু পেলে জানাবো তোকে।”
“ঠিক আছে ভাই।”
ফোনটা কাটতেই শুভ্রার ফোন ঢুকলো। রণ মুচকি হাসলো। আজকাল খুব ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করছে শুভ্রা। সকালের নাস্তা না করে বের হতে দেবে না রণকে। খুব ভোরে যেদিন বের হবে সেদিন একদম খেতে মন চায় না রণর কিন্তু শুভ্রার জেদের কারনে পেরে ওঠে না। তারপর বেলায় বেলায় ফোন তো আছেই। বারবার চন্দ্রানীর কথা জানতে চায়। রণ হাজার বার বলেও বোঝাতে পারেনি চন্দ্রানীর সাথে কাজ করে সে। এর বাইরে কোন সম্পর্ক নেই। শ্বাস ফেলে ফোন ধরলো রণ-
“হ্যালো।”
“কি করছেন?”
“বসে বসে চন্দ্রানীর সাথে গল্প করছি।”
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না। রণ মিটমিটিয়ে হাসছে নিঃশব্দে-“এটাই ভাবছো তো? আরে বাবা নিজের ভাবনার লাগাম টানো। জরুরি কাজ করছিলাম। ফোন করেছ কেন? দরকার কোন?”
শুভ্রার কন্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে-“বাহ! এমনিতে ফোন দিতে পারি না? আপনি নিজে তো ফোন দেনই না আমি দিলেও খুশি হন না।”
“মিথ্যে অভিযোগ।”
শুভ্রা তেতে উঠলো-“সত্য মিথ্যা জানি না। শুনুন, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবেন। আজ বিশেষ কিছু আছে। আপনার তো কিছু মনে থাকে না। কাজ করে দেশ উদ্ধার করছেন। রাখছি।”
রণকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে শুভ্রা সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। রণ ভারি ভাবনায় ডুবে গেলো। আজ বিশেষ দিন কেন? আজ কি শুভ্রার জন্মদিন? উহু, জন্মদিন আসতে দেরি আছে। তাহলে? হাসি খুশির কিংবা মায়ের জন্মদিন? আজ তারিখ কতো? পরি মড়ি করে ক্যালেন্ডার দেখলো রণ। সাত তারিখ? আজ সাত তারিখ! লাফিয়ে উঠলো রণ। এতো বড় ভুল সে কিভাবে করলো? দ্রুত হাতের কাছের জিনিস গুছিয়ে নিলো।
*****
তুলতুল বই পড়ছে আর হিহি করে হাসছে। মাঝে মাঝে লাজুকলতা হয়ে যাচ্ছে। গাল দু’টো উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বই বন্ধ করে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকছে। মালা ওকে আড়চোখে দেখছে আর বিরবির করে গালি দিচ্ছে। হঠাৎ দরজা আওয়াজ হলো। মালা দরজা খুলতেই শরীফকে দেখা গেলো-“তুলতুল আমি কি ভিতরে আসবো?”
তুলতুল অবাক হলো। ত্রস্ত হরিণীর মতো দ্রুততায় নিজেকে ফিটফাট করলো-“হ্যা,আসেন।”
শরীফ ঘরে ঢুকে একবার তুলতুলকে দেখে মুখ নিচু করলো। চেয়ার টেনে দূরত্ব রেখে বসলো। মালাকে বললো-“আমাদের জন্য দুইকাপ চা বানিয়ে আনতো মালা।”
মালা বেরিয়ে গেলে শরীফ তুলতুলের দিকে তাকালো। বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে তুলতুলকে। শরীফ বললো-“বই পড়ে কেমন লাগছে?”
“অনেক ভালো লাগতেছে। আপনাকে ধন্যবাদ। মনটা শান্তি পাইতেছে।”
শরীফ মাথা নেড়ে চুপ করে বসে রইলো। তুলতুল এবার অবাক হলো কিছুটা। মানুষটা এভাবে বসে আছে কেন? তুলতুল বলেই ফেললো-“আপনি কি কিছু বলবেন?”
শরীফ মাথা দুলায়। সে দ্বিধা নিয়ে এদিক সেদিক তাকায়। চঞ্চল চোখদুটো লুকিয়ে বললো-“আব্বা আম্মা একটা প্রস্তাব রাখছে আমার কাছে।”
তুলতুল না বুঝে জানতে চাইলো-“কিসের প্রস্তাব।”
“তারা চায় আমি তোমাকে বিয়ে করি।”
তুলতুল হা করে শরীফের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin