#দর্পহরন
#পর্ব-৪
তুলতুল ঘুমের মধ্যে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঠোঁটের কোন ক্ষতবিক্ষত, মুখের কয়েক জায়গা কালচে হয়ে আছে। দুই হাতের কবজিতে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ওর জামাকাপড়ের র/ক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে। রিমার খুব মায়া হলো মেয়েটাকে দেখে। গায়ের রং ফর্সার দিকে, চেহারাটা পুরাই পুতুলের মতো। এই মেয়েটার কি হাল করেছে তার ছেলে? বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। কোন মায়ের বুকের ধন তুলে এনেছে কে জানে।
মেয়েটাকে দেখে কেন যেন নিজের মেয়ে শারমিনের কথা মনে এলো। সকাল থেকে হাজার বার ফোন দিয়েছেন মেয়ের নাম্বারে কোন খবর নেই। এর আগে কোনদিন এমন হয়নি। শারমিন সবসময় ফোন ধরে, ধরতে না পারলে পরে ব্যাক করে। এবারের মতো কয়েকদিন কথা না বলে থাকেনি আগে। রুমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে মেয়ের জন্য। তার চিন্তার কথা কার সাথে শেয়ার করবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। মেয়ের বাবা এখন নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর ছেলে নিয়ে চিন্তিত। রুমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেয়েটার গায়ে হাত রাখলেন। সাথে সাথে মেয়েটা ধরমরিয়ে উঠে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার শুরু করলো-“না না না, প্লিজ কাছে আসবেন না। আমাকে মাফ করে দিন। আর কখনো এমন করবো না।”
রিমার বুকটা ধক করে উঠলো। সে বিচলিত হয়ে বললো-“মাগো, ভয় পাইয়ো না। আমি তোমাকে কিছু করুম না।”
তুলতুল মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে রিমাকে দেখলো। ভীত চাহুনি দিয়ে জানতে চাইলো-“আপনে কে? কি চান?”
রিনরিনে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠের কথাগুলো শুনে হাসলো রিমা-“কিছু চাই না। তোমারে তৈরী করতে আসছি। তোমার মা আসবে তোমাকে দেখতে।”
“মা! সত্যি মা আসবে? আমাকে নিয়ে যাবে? এখান থেকে নিয়ে যাবে আমাকে?”
বলতে বলতে কেঁদে দেয় তুলতুল। রিমার ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে বুকে নিয়ে আদর করতে কিন্তু ইচ্ছেটা দমন করলো। বলতে চাইলো, এখানে কেউ একবার ঢুকলে খুব সৌভাগ্যবতী না হলে আর বেরুতে পারে না। কিন্তু বলতে পারলোনা। রিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কোমল স্বরে বললেন-“এই যে এখানে কাপড় রাখা থাকলো। তুমি গোসল করে এগুলা পইরা তৈরি হও। আমি কিছুক্ষণ পর একজনকে পাঠাচ্ছি তোমাকে বাইর বাড়িতে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে?”
তুলতুল জবাব দিলো না। রিমা দরজার দিকে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলো-“শোন মা, তুমি কিন্তু উল্টা পাল্টা কিছু কইরো না। এরা বাপ পোলা অনেক খারাপ। রাগ উঠলে কি থেকে কি করবে নিজেরাই জানে না। তুমি তৈরি হয়ে আসো। তোমার মায়ের আসার কথা আছে। দেখ কি করে।”
তুলতুল কঠিন মুখ করে বসে আছে। সে একবার কাপড়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে। এই কাপড় পাঠানোর মানে কি? গতকালকে তুলে এনে রে/প করলো এখন কি করতে চায়? আর মা কেন আসছে এখানে? কি চায় ওরা? বাবার মতো তাকেও কি…। মায়ের সাথে শেষ দেখা করাতে চায় নাকি? তুলতুল হু হু করে কেঁদে দেয়।
★★★
দেবরের মুখেপানে উৎকন্ঠিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তুলতুলের মা তহুরা। গোলাম রাব্বানী ফোনটা কান থেকে নামাতেই তহুরা জানতে চাইলো-“রাব্বি, কি বললো ইব্রাহিম সালিম? আমার মেয়ে কোথায়?”
“ইব্রাহিম সালিম আমাদের তার বাড়িতে ডাকে ভাবি।”
পাশ থেকে রাব্বাীর বউ মিতা আঁতকে উঠলো-“না না ওর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। আমার খুব ভয় করছে।”
রাব্বি বিরক্ত হলো-“আহ মিতা, শুধু শুধু ভয় পেয় নাতো। সামনে নির্বাচন আসছে। মনেহয় না এই মুহূর্তে ইব্রাহিম সালিম উল্টো পাল্টা কিছু করবে।”
“না না রাব্বি মিতা ঠিকই বলেছে। ওদের উপর কোন ভরসা নেই। তোমার ভাইকে কিভাবে দিনদুপুরে শেষ করে দিল দেখনি? মেয়েটাকে এতো করে বোঝালাম তবুও আমার কথা কানে তোলেনি। না জানি মেয়েটা এখন কি অবস্থায় আছে।”
বলতে বলতে ঝরঝর করে কাঁদে তহুরা। মিতা জায়ের পিঠে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে। রাব্বি গুম হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর বললো-“আমি বলি কি ডেকেছে যখন যেয়ে দেখি কি বলে। যদি তুলতুলের কোন খবর পাই।”
“না প্লিজ তুমি যেয় না। আমার ভয় করে। ওদের ওপর ভরসা করা যায় কিছুতেই।”
রাব্বি মাথা নাড়ে-“উহু, এই মুহূর্তে আমাদের কিছু বলবে না ইব্রাহিম সালিম। তুলতুলের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সাংবাদিকরা সরব। শুনেছি এবার নমিনেশন পাচ্ছে না ব্যাটা। মনেহয় না কোন ভুল করবে এখন। ভাবি, তুলতুলের খবর পেতে ওর আস্তানায় যেতেই হবে। এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে কিছুই হবে না।”
তহুরা বললো-“ঠিক আছে তাহলে আমিও যাব তোমার সাথে।”
“মা, চাচ্চুর সাথে আমি যাবো। তোমার যেতে হবে না।”
তুলতুলের ভাই ফাহিম রুমে ঢুকলো। তহুরা আতঁকে উঠে বললো-“মাথা নস্ট হয়েছে তোর? ওই পাষন্ডদের কাছে তোকে কোনদিন যেতে দেব না। তোর বোন কথা না শুনে যা করেছে তাকি যথেষ্ট না? এখন তুইও ওর মতো বিপদ ডাকতে চাইছিস?”
ফাহিম বললো-“তুমি আর চাচ্চু যেতে চাচ্ছ, তোমাদের বিপদ হবে না?”
“হলে হবে। আমাদের বিপদ হলে তুই থাকবি সামাল দিতে। সবাই মিলে একসাথে বিপদে পড়ার কোন মানে নেই।”
“কিন্তু মা…”
তহুরা ফাহিমকে থামিয়ে দিলো-“আর কোন কিন্তু নয়। তুই যাবি না মানে যাবি না। কথা শেষ।”
রাব্বি মাথা দুলায়-“হ্যা ফাহিম মা যা বলছে শোন। তোর চাচী আর হিমি একা থাকবে, তুই ওদের সাথে থাক। আমি বরং হাফিজ ভাইকে ডেকে নেব আমাদের সাথে।”
মিতার কিছুতেই ইচ্ছে হচ্ছে না রাব্বিকে বাঘের গুহায় যেতে দেওয়ার কিন্তু মানা করবে সে উপায়ও নেই। তুলতুলে এ বাড়ির মেয়ে। তার বিপদে পাশে না থাকলে কি হবে? এমন বিপদ যদি হিমির হয় তাহলে? নিজের মেয়ের কথা ভেবে আরেকবার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। তুলতুল বড্ড ভালোবাসে হিমিকে, হিমিও তুলতুলকে। কাল থেকে তুলতুলের কথা জানতে চেয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে হিমি। তুলতুলটা ভালো আছে তো? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মিতার ভয়ে কম্পমান বুক থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেরুলো কেবল।
★★★
জ্ঞান ফিরে গতদিনের মত হাত পা খোলা পেল শুভ্রা। তবে আজ নিজেকে মেঝেতে আবিষ্কার করে অবাক হলো। তাহলে কি গতকাল ওকে বেঁধে রেখে যায়নি? মেঝে থেকে উঠতে যেয়ে টের পেলো হাত পা প্রচন্ড ব্যাথা। কোনরকমে উঠে ওয়াশরুম গেল। বেরিয়ে আসতেই দেয়ালে সাঁটানো চিরকুটে নজর গেলো। কৌতুহলে এগিয়ে এসে চিরকুটটা মন দিয়ে পড়লো শুভ্রা। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা আছে-“নিজেকে মুক্ত পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে আবার পালানোর পথ খুঁজবেন না। আপনার জন্য কিছু কাজ আছে আজ সেইজন্যই নিজেকে মুক্ত পেয়েছেন। ধরে নিন এটা আপনার দ্বিতীয় পরীক্ষা। কালতো ফেল করলেন আজ যেন ফেল না হয়। আজ আপনার টাস্ক হলো বাড়ি পরিস্কার করা। পুরো বাড়ি ভীষণ ময়লা হয়ে আছে খুব সুন্দর করে পরিস্কার করবেন। রান্নাঘরে চালডাল সবজি ডিম রাখা আছে। দু’জনার আন্দাজে রান্না করবেন। নিজে খাবেন আমার জন্য রাখবেন। আমি এসে কাজ দেখে আপনাকে নাম্বার দেব। কাজ না করলে বা ভালো না হলে কি সাজা হবে সেটা না হয় তখনই দেখবেন।”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। একে তো তাকে কিডন্যাপ করেছে তারউপর আবার ঢং দেখো তাদের। শুভ্রাকে দিয়ে কাজ করাবে? এই শুভ্রাকে দিয়ে? এতোবছর ধরে বাইরে কখনোই এসব করতে হয়নি তার। আর সে কিনা ঘর মুছবে? অনেক হয়েছে ভদ্রতা দেখানো। এবার সে দেখাবে কার মেয়ে সে। তারা মনেহয় চেনে না কাকে তুলে এনেছে। আজ হাড়ে মজ্জায় বুঝিয়ে দেবে কি তার পরিচয়।
শুভ্রা মেজাজ খারাপ করে রুম থেকে বেরুল। টেবিলের উপর পাউরুটির প্যাকেট দেখলো। জেলির বয়ামও আছে। দেখে খিদে পেয়ে গেলো। গোগ্রাসে দুতিন পিস পাউরুটি খেয়ে নিলো শুভ্রা। তারপর পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এ বাড়িতে জানালা নেই কোন। পুরো বাড়িতে বাইরের কোন আলো আসে না। দু’টো শোবার ঘর আছে একটা বড় হলরুম যেখানে একপাশে সোফা আর আরেক পাশে ছোট্ট টেবিল রাখা যেখানে সে বসে ছিল কিছুক্ষণ আগে। রান্নাঘরের দরজাটা লোহার, সম্ভবত ওপাশ থেকে তালা দেওয়া। শুভ্রা অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলোনা। হাল ছেড়ে দিয়ে হলরুমে ফেরত এলো শুভ্রা। টিভি ছাড়লো তবে সেখানে নিজেকে দেখে চমকে উঠলো। দাঁতে নখ কেটে ভাবছে কেসটা কি। পরক্ষনেই বুঝতে পেরে বোকার মতো হাসলো সে। আচ্ছা, এই ব্যাপার? বাড়িতে সিসিটিভি লাগানো আছে? শুভ্রার বেশি কষ্ট করতে হলো না। হলরুমের একেবারে সামনে মাথার উপরে ক্যামেরাটা জ্বলজ্বল করছে। শুভ্রার মুখের উপর স্থির হয়ে আছে ক্যামেরাটা। শুভ্রার মনে হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি উদয় হলো। সে বার কয়েক ভেংটি কাটলো ক্যামেরা বরাবর তাকিয়ে। সোফায় শুয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। নাহ, জমছে না। শয়তানী করার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। বদমাশ লোকটা তাকে আঁটকে রেখে মজা নেবে এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। কি মনে করে শুভ্রা বেডরুমে গেল।
প্রত্যেকটা ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। শুভ্রা নিজের লাগেজটা খুঁজে বের করলো। ওখান থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে আঁটোসাটো গেন্জি আর প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। পরে বেরিয়ে এসে ক্যামেরার তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
ক্যামেরার মুখোমুখি সোফায় শুয়ে পড়লো। টল ফিঙ্গার দেখিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করলো ক্যামেরার দিয়ে তাকিয়ে। মুখ ভাঙচি কাটলো কিছুক্ষণ, একসময় ক্লান্ত হয়ে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো শুভ্রা। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না, হঠাৎ গায়ে ঠান্ডা বরফের শীতল স্পর্শ পেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। হতচকিত হয়ে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। শুভ্রা তাকানো মাত্র ওর গায়ে বরফ কুচি ছিটিয়ে দিলো। সে গা থেকে বরফ ঝেড়ে ফেলতে চাইলো-“এসবের মানে কি?”
ছেলেটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো। শীতল দৃষ্টি হেনে বললো-“আপনার সাথে ভদ্র আচরণ করছি বলে মনেহয় পুরো ব্যাপারটাকে ফান হিসেবে নিয়েছেন। আপনি হয়তো ভাবছেন আমরা আপনাকে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেব। তাইতো আমার কথাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ভাবছেন, আমাকে এরা আর কি করবে। তাই না?”
শুভ্রা কিছু বললো না। ছেলেটা হাসলো-“আপনার সব ভাবনার ট্রিটমেন্ট সাথে নিয়ে এসেছি আজ।”
“মমমমমানে?”
ছেলেটা হাসি গিলে নিলো-“মনে একটু পরেই বুঝবেন। আসেন টেবিলে বসুন।”
শুভ্রা ভয়ে পিছিয়ে গেল-“কেন টেবিলে বসবো কেন? আমি কিছু খাবো না।”
“আরেহ, ভয় পাচ্ছেন কেন? খাবার খেতেই বলছি।”
বলেই যে হাসিটা দিলো তাতে শুভ্রার পা দুটো দুলে উঠলো তুমুলভাবে। মন তীব্র ভাবে পালাতে চাইছে কিন্তু পা দু’টো মাটিতে আঁটকে আছে।
“বললাম তো খাব না। খিদে নেই আমার।”
রণ কঠিন চোখে তাকালো-“আমাকে কোন অশোভন কাজ করতে বাধ্য করবেন না মিস শুভ্রা। যদি বাধ্য করেন তাহলে খুব খারাপ হবে। নিজেকে কোথাও মুখ দেখানোর অবস্থায় খুঁজে পাবেন না।”
শুভ্রা চুপসে গেলো। এই ছেলেটাকে দেখলে মনেহয় সে সব পারবে। কথা না বাড়িয়ে রণর পিছু পিছু টেবিলে বসলো। রণ এক বাটি কাঁচামরিচ এগিয়ে দিলো-“এগুলো খেয়ে শেষ করুন।”
শুভ্রার গোল গোল চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে-“কিহ! এতো মরিচ খাবো? পাগল পেয়েছেন আমাকে?”
“নাহ, সুস্থ মানুষ পেয়েছি তাই সুস্থ আবদার করেছি। কিন্তু আপনি তো সুস্থ না তাই আমার সব কথাকে পাগলামি মনেহয়। এখন ভদ্র মেয়ের মতো খেতে শুরু করুন।”
“খাব না আমি। আমার ঝাল সহ্য হয় না। আমি খেতে পারবোনা।”
রণ চুপচাপ নিজের মোবাইলটা বের করে শুভ্রার ভিডিও দেখালো-“ভাবছি আপনার বাবাকে ভিডিওটা পাঠাব। ইব্রাহিম সালিমের আদরের কন্যা কি করছে সে দেখুক।”
জবাব দিলো না শুভ্রা। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর পোশাক পরিবর্তনের ভিডিও আছে সেখানে। জিভ দাঁতে কাটে সে। ওই রুমে যে সিসিটিভি আছে ভুলে গেছিস তখন। উচিত ছিল ওয়াশরুমে যেয়ে কাপড় চেঞ্জ করা। কিন্তু তাই বলে ছেলেটা সেটার ভিডিও নেবে? লজ্জা করলো না একটা মেয়েকে এভাবে দেখতে? শুভ্রা রেগে গেলো-“লজ্জা নেই আপনার? একটা মেয়ের অজান্তে এভাবে ভিডিও করতে? দেখে তো ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।”
রণ শান্ত দৃষ্টি হেনে মুচকি হেসে বললো-“আপনাকে কে বললো আমি আপনাকে দেখেছি? নিজেকে এতো বেশি ভাববার প্রয়োজন নেই। আর আমি ভদ্রলোকই কিন্তু আপনি ভদ্রমহিলা না। তা না হলে আমার কথা শুনতেন। আমাকে চ্যালেন্জ করতেন না।”
একটু থেমে রণ তাড়া দিলো-“তাড়াতাড়ি শুরু করুন। আমার দেরি হচ্ছে কিন্তু।”
শুভ্রা মাথা নাড়তেই রণ মোবাইল তুললো-“পাঠালাম তাহলে। ইউটিউবেও আপলোড করে দেই।”
শুভ্রাকে অসহায় দেখালো-“কেন এমন জরছেন বলুন তো? কি করেছি আমি?”
“কি করেছেন! আপনি জানেন না কি করেছেন? বারবার উল্টো পাল্টা আচরণ করে আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। আমি আপনাকে বলেছি, ভদ্র ভাবে থাকলে আপনাকে সুবিধা দেব, আপনি শুনছেন?”
রণ রেগে কথাগুলো বলে মরিচের বাটির দিকে ইঙ্গিত করলো-“এবার বুঝুন। আজ কোন মাফ হবে না। আশাকরি আজকের পর আর কখনো এমন কিছু করার চেষ্টা করবেন না।”
শুভ্রা এবার নরম হলো-“আমি ঝাল খেতে পারি না। এতগুলো মরিচ খেলে আমি মরে যাব। প্লিজ এমন করবেন না।”
রণ মোবাইল তুলে ভিডিও সেন্ড করতে গেলেই শুভ্রা মরিচ হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলো। একটার পর একটা মরিচ খেয়ে যাচ্ছে। ঝালে মুখ পুড়ে যাচ্ছে তার কিন্তু থামলো না। রণ চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েস করে দেখছে তাকে। কিছুক্ষণ পর শুভ্রার চোখ দুটো থেকে জল গড়াতে শুরু করলো আপনাতেই। ক্রমান্বয়ে টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে চোখ দুটো। শুভ্রা পানি খেতে গেলো কিন্তু রণ ফট করে বোতল টেনে নিলো তার হাত থেকে। শুভ্রা হাসফাস করে উঠলো-“প্লিজ একটু পানি দিন।”
“তাড়াতাড়ি শেষ করুন।”
আদেশ করলো রণ। শুভ্রা হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। রনর নিষ্ঠুরতায় কান্না পাচ্ছে তার। তার নাক দিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে। অসহায় চাহুনি দিয়ে রণর দিকে তাকালো। রণ নির্বিকার। শুভ্রার কেন যেন জিদ চেপে গেল। সে আবারও মরিচ খেতে শুরু করেছে৷ তার মুখ, গলা, বুক, পেট সব জ্বলতে শুরু করেছে তবুও একের পর এক মরিচ খেয়ে যাচ্ছে। একসময় রণর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে বোতল এগিয়ে দিলো-“এরপর বাঁদরামো করতে মন চাইলে আজকের কথা ভাববেন।”
শুভ্রা ভেবেছিল পানিই খাবে না কিন্তু বোতল পাওয়া মাত্রই টেনে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগলো। এরপর শুরু হলো বমি। শুভ্রার সমগ্র শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে। বমি করতে করতে কান চেপে ধরলো সে। তাকে এই অবস্থায় রেখে বেড়িয়ে এলো রণ।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৫
সকালে বেরিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরেছেন ইব্রাহিম সালিম। সেই থেকে নিজের রুমে বসে আছেন। রিমা খাবার খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডেকে গেছে কিন্তু তাকে নড়তে দেখা গেলোনা। মেজাজটা বেখাপ্পা রকমের খারাপ হয়ে আছে। চারিদিকের পরিস্থিতি তার বিপরীতে চলে গেছে। ইন্টারনেটে আজকের ভাইরাল ভিডিও সোহেলের মেয়ে তুলে নেওয়া। কয়েকটা পত্রিকায় তার নানা দুর্নীতি আর অনিয়মের রিপোর্ট এসেছে আজই। এইসবই কি কোইন্সিডেন্স নাকি সোহেলের কালকের কাজের রেশ বুঝতে পারছেন না। হুট করে চারিদিকে তাকে নিয়ে এমন শোরগোল শুরু হলো কেন? হতবিহ্বল লাগে তার। এদিকে পার্টির হাইকমান্ড থেকে ফোন এসেছিল। সব ঝামেলা অতিদ্রুত মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সামনে ইলেকশন তাই দলের বদবাম হোক এমনটা তারা চায় না কিছুতেই। সব শুনে সাবেক এমপি বড়ভাই ইব্রাহিম মোর্শেদ তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছেন। ভাইয়ের পরামর্শে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। ভাবনার মাঝে সোহেল ঘরে ঢুকলো-“আব্বা, আপনের এই সিদ্ধান্ত মানতে পারুম না। বিয়ার সিদ্ধান্ত মানি না আব্বা। ওই ফকিরনি পুত্রীরে আমি বিয়া করুম না কোনমতেই।”
লাল টকটকে আঁখিদ্বয় খুলে ছেলেকে দেখলেন-“কি কইলি?”
সোহেল ঘাবড়ে গেল বাপের এমন রুপ দেখে। মিনমিনে গলায় বললো-“ওই মাইয়া, চিনি না জানি না ওরে বিয়া করুম না আব্বা।”
সালিম সাহেব চেয়ার ছেড়ে তেড়ে এলেন ছেলের দিকে-“তোরে আমি…”
মারতে যেয়েও শেষ মুহূর্তে হাত গুটিয়ে নিলেন। সোহেল ভয়ে চোখ বুজে আছে। সালিম সাহেব লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন-“তোর চাইতে তো শরিফ ভালো রে সোহেল। অন্তত ও আমার কোন ক্ষতি করে না। নিজের মতো জীবন বাইছা নিছে। তরে এতো আদর ভালোবাসা দিছি, ভাবছি তুই আমাদের বংশ উজ্জ্বল করবি। আমার যোগ্য উত্তরসুরি হবি। এখন দেখতেছি তুই আমাকে ডুবানোর তাল করছোস। আর তোর নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার।”
শরীরে বিচুটি পাতা ডলে দিলে যেমন অনুভূতি হয় বাবার কথাগুলো তেমনই লাগলো সোহেলের কাছে। বাপের জন্য সে বিনাবাক্যে বহু অন্যায় করেছে ভবিষ্যতেও করবে। তাই বাপের মুখে অন্য কারো প্রশংসা ভালো লাগে না তার। সে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। সালিম সাহেব ক্ষনকাল চুপ থেকে স্থিমিত কন্ঠে বললেন-“আপাতত বিয়া কইরা পরিস্থিতি ঠান্ডা কর। নির্বাচনের পরে বউরে রাখবি কিনা ঠিক করিস। আর ঝামেলা করিস না সোহেল। আমার কথা বুঝছোস?”
অনিচ্ছায় মাথা দুলায় সোহেল। ভীষণ রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপর। ওই হা/রা/ম/জা/দি যে একটা কু/ফা সেইটা আগে বুঝলে কোনদিন এই ভুল করতো না সে। মনেহচ্ছে এখনই যেয়ে চুলের মুঠি ধরে পানিতে চুবিয়ে মা/র/তে। সোহেলের হাত নিশপিশ করে। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে সোহেলের কাঁধে হাত রাখলেন-“মাঝে মাঝে জিতার জন্য হারতে হয় সোহেল। হারতে শিখ তাইলে জিততে পারবি। আর মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখ। যখন তখন মেজাজ হারাইলে তার পরিনতি এমনই হবে, বুজছোস?”
সোহেল একটু নরম হলো। বাবার দিকে তাকালো। সালিম সাহেব নরম গলায় বললেন-“তৈরি হয়ে যা। ওই মাইয়ার চাচা আর মা আসলে বিয়া হইবো তোদের। আপাতত কোনরকম মাথা গরম করবি না। ঠিক আছে?”
সোহেল ঘাড় হেলায়। সালিম সাহেব পিঠ চাপড়ে দিলো-“সাব্বাশ। যা এখন।”
★★★
তুলতুলের মা তহুরা, চাচা রাব্বানী আর ওর বাবার বন্ধু নতুন সূর্য পত্রিকার সাংবাদিক হাফিজ উদ্দিন সন্ধ্যার মুখে ইব্রাহিম নিবাসে পা রাখলো। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বন্দর থানার ওসিকেও ডেকেছিল তারা কিন্তু আনঅফিশিয়াল এই মিটিংয়ে উনি কিছুতেই থাকতে রাজি নন। আর কিছুদিন আছেন এই এলাকায়, কোন বিতর্কে যেতে চায় না বলে আসেননি। সালিম সাহেব কোন রাখঢাক না করেই তহুরাকে প্রস্তাব দিলো-“দেখেন আপা, আমার ছেলে একটা ভুল করে ফেলছে। আমি চাই এটা নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য না হোক। আপনার মেয়েকে আমার বাড়ির বউ করতে চাই। তাহলে আপনার মেয়ে আর আমার পরিবার দুজনেরই সন্মান রক্ষা হবে।”
এমন প্রস্তাবে উপস্থিত তিনজনই ভরকে গেলো। এইরকম কিছু ইব্রাহিম সালিম বলতে পারে তা ওদের ধারণাতেও ছিল না। তহুরা আঁতকে উঠে আকুতি জানালো-“ভাই, আপনার কাছে করজোড়ে মিনতি করছি, আমার মেয়েটাকে ফিরায় দেন। বিয়ের কোন প্রয়োজন নাই। আমরা এলাকা ছেড়ে যাব মেয়ে নিয়ে।”
ইব্রাহিম সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। মেজাজ এমনিতেই খারাপ তারউপর তহুরার কথা। মহিলা মনেহয় ভুলে গেছে কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। যে মেয়ে ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করে তাকে আর যাইহোক খোলা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ওই মেয়ে মোটেও চুপ থাকার মেয়ে না। ওর বাবাও এমন ঘাউড়া ছিল। বাবার রক্ত মেয়ের মধ্যেও জাগনা।
“আমি আপনার মেয়ের সন্মান রক্ষার চেষ্টা করতেছি আর আপনি উল্টা ভাবতেছেন। ভাবনার মিল না হইলে সমস্যা আপা। আপনার মেয়েকে এখন নিয়ে গেলে কি হবে বুজতেছেন? তারে জীবনে বিয়া দিতে পারবেন না। তাছাড়া আপনার মেয়ে আমার ছেলের কোন ক্ষতি করবে না তার গ্যরান্টি কি? শোনেন আপা, অতীত ভুলে যান নাই আশাকরি। মেয়ে বাঁইচা আছে তার বিয়া হইবো এরচেয়ে আনন্দ আর কি? আর কথা বাড়ায়েন না।”
ইব্রাহিম সালিমের কথার গভীরতা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো তহুরা। তার বুকটা হুহু করে উঠলো। মেয়েটার সাথে খুব খারাপ কিছু হয়েছে এটা বুঝতে আর বাকী নেই। তিনি অসহায় চাহুনি নিয়ে দেবরের দিকে তাকালেন। রাব্বানীর সাথে চোখাচোখি হলো। তাকেও বিভ্রান্ত দেখালো। এরকম বাঘের অরন্যে কে থাকতে চাইবে? কিন্তু এইমুহূর্তে তাদের প্রস্তাবে না করারও কোন উপায় নেই। ইব্রাহিম সালিম সময় নষ্ট করলেন না-“কিছুক্ষণের মধ্যে কাজি আসবে। আপনি আপনার মেয়ের সাথে কথা বলেন আপা। তাকে বিয়ের কথা বলেন। আমি কোন ঝামেলা চাই না আর। এমনিতেই নানা টেনশনে আছি। আশাকরি আমার পরিস্থিতি বুঝবেন।”
ইব্রাহিম সালিম উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক ওই সময় তুলতুল ঘরে এসে ঢুকলো। তুলতুলকে দেখেই গা শিউরে উঠলো তহুরার। হৃদয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। তার আদরের মেয়েটার কি হাল করেছে হায়েনাটা? তুলতুল ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। মা মেয়ের কান্নায় ইব্রাহিম নিবাসের ইটের দেয়ালেও যেন কাঁপন উঠলো। ইব্রাহিম সালিম রিমাকে ইশারা করেন সব সামলে নিতে।
ঠিক আধাঘন্টা পরে তুলতুলের তুমুল আপত্তি আমলে না নিয়ে সোহেলের সাথে তার বিয়ের কাজ শেষ হলো। নির্বাক তহুরা, প্রথমে স্বামী হারিয়ে আর আজ মেয়ে হারিয়ে। সে জানে তার মেয়ে আর বেশিদিন নেই এই পৃথিবীতে। হয়তো আজ থেকেই তার মৃত্যুদিন গোনা শুরু হলো।
★★★
খাবার টেবিলে অন্যমনস্ক হয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছিল রণ। জলি সেটা লক্ষ্য করে বললেন-“কি হয়েছে রণ খাচ্ছিস না কেন বাবাই? খেতে ভালো লাগছে না?”
“তোমার বাবাই তো বাবু নিজ হাতে খেতে পারে না মা। তুমি খাইয়ে দিলে ঠিকই খাবে। তাই নারে খুশি?”
পাশের চেয়ারে বসে থাকা খুশিকে চিমটি দিয়ে হাসি মুচকি হাসলো। খুশি ফিকফিক করে হাসে-“তা আর বলতে? বুড়ো খোকা একেই বলে।”
জলি মেয়েদের দিকে তেড়ে গেলেন-“এই তোরা চুপ করবি? ছেলেটা সবসময় দূরে দূরে থেকেছে, ওকে খাইয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলাম কোথায়? খুব হিংসুটে হয়েছিস তো?”
এতোকিছুর মধ্যেও রণকে কথা বলতে দেখা গেলো না। অন্য সময় হলে সে বোনদের সাথে সমান তালে খুনসুটি করতো। জলি ছেলের কাছে এগিয়ে এলো। রণ মাথা নাড়লো-“না মা, শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে।”
জলি উৎকন্ঠিত হয়ে এগিয়ে এসে ছেলের কপালে হাত রাখলেন-“জ্বর তো নেই বাবাই। তাহলে কি হয়েছে? কোন কারনে কি তোর মন খারাপ?”
মায়ের কথা শুনে রণ খানিকটা চমকে উঠলো-“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মা। আমি বরং শুয়ে একটু আরাম করি। পরে খিদে লাগলে তোমাকে বলবো।”
রণ হুট করে উঠে যাওয়াতে বোনেরাও একটু অবাক হলো। তাদের ভাইয়ের সত্যিই হয়তো খারাপ লাগছে না হলে ওদের সাথে কথা না বলে থাকে না রণ। রণ চলে যাওয়ায় জলি মেয়েদের সাথে গজগজ করছে-“সবসময় ভাইয়ের পেছনে লেগে থাকা। বলি তোদের কি কোন কাজ নেই? সারাদিন কত জায়গায় দৌড়ে আসে। বাসায় এসে তোদের জ্বালা।”
হাসি আর খুশি দুই বোন মুখচোখ কাচুমাচু করে খাওয়ায় মন দিলো।
রণ চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অশান্ত মনটা খচখচ করছে। জীবনে প্রথমবারের মতো বাবা মায়ের শিক্ষার বিপরীত কাজ করলো সে। সে জানে খুব খারাপ কাজ করেছে কিন্তু না করলেও চলছিল না। মেয়েটার অমন অসভ্যের মতো আচরণ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওর। সন্দেহ নেই মেয়েটা ওর বাবা আর ভাইয়ের মতোই ডাকাবুকো। রণ শুধু এপাশ ওপাশ করে। ওইসময় ফোনটা এলো। রণ দেখলো স্ক্রীনে মিহিরের নাম ভেসে উঠেছে। দ্রুত বিছানায় উঠে বসলে সে-“বল মিহির।”
মিহিরের কথা চুপচাপ শুনলো রণ। খবরটা চিত্ত চন্চল করার মতোই কিন্তু সে শান্ত রইলো। ধীর কন্ঠে জানতে চাইলো-“দিলশান কবে আসবে এদিকে?”
ওপাশে মিহির কি বললো শোনা গেলো না। রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আচ্ছা, ঠিক আছে। সময় তো বেশিদিন নাই। চিরকুটটা কালকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কর।”
ফোন নামিয়ে বিছানা থেকে নামলো রণ। ধীরে ধীরে শক্ত খোলসে আবৃত করে নিজেকে লৌহ মানব বানালেও মনের কোথায় যেন এই পথে চলতে সায় দেয় না। অথচ প্রতিদ্বন্দী খুব চালাক এবং হিংস্র। নিজের স্বার্থে হেন কাজ নেই করে না। এমন মানুষের সাথে লড়তে নিজেকে তার চাইতে খারাপ বানাতে হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দীকে বশে আনতে তারই দেখানো পথে এগুতে হচ্ছে। মন অটল করলো রণ। যত যাইহোক এবার তাকে পারতেই হবে। বাবা যা পারেনি সে করে দেখাবে। দেখাতেই হবে। এই ভাবনায় মন কিছুটা শান্ত হলো। বুকের ভার কমলো খানিকটা। কালকে অনেক কাজ করতে হবে। তাই বিছানায় যেতে দেরি করলোনা আর।
★★★
শুভার রাতে জ্বর এসেছিল। হলরুমের টেবিলের উপর প্রয়োজনীয় ওষুধ পেয়ে গেলেও অবাক হওয়ার অনুভূতি কাজ করছিল না ওর। কোনরকমে জ্বরের ওষুধ খেয়ে সোফায় গড়িয়ে গেছে। সর্বাঙ্গ জ্বলে শেষ। গলা ছিলে গেছে, চোখ ফুলে একাকার। পুরো হলরুম জুড়ে বমির ঘ্রান কিন্তু শুভ্রা পরিস্কার করার পরিস্থিতিতে নেই। শরীরের তীব্র জ্বালা ধীরে ধীরে কমে এলে ঘুম নামতে চায় চোখে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ভয় পেয়ে উঠে বসেছে আবার শুয়েছে। রাতে একা একা এই ভুতুড়ে বাসায় থাকতে ভয় লাগছিল ওর। সেসব কথা শোনার কেউ নেই বলে চুপচাপ আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে। ভাবছে গত কয়েকদিন তাহলে ঘুমালো কি করে? ওকে কি ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল? নিজের ভাবনায় বিরক্ত শুভ্রা উঠে ঘরময় পায়চারি করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দরজা জানালাগুলো চেক করে। কোথাও কোন ফাঁক দেখা যায় কিনা। পরে হাল ছেড়ে দিয়ে আবারও হলরুমে ফেরত আসে। কিছু না পেয়ে অলীক কল্পনার রাজ্যে পারি দেয়। এলোমেলো ভাবনায় ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমের কোলে নুইয়ে পড়ে।
ঘুম কয়টার দিকে ভেঙেছে জানে না শুভ্রা। এ বাড়িতে কোন ঘড়ি রাখা হয়নি। গলার তীব্র জ্বলুনির সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। পেট খিদেয় চো চো করছে। শুভ্রা পাত্তা দিলো না। সে ফাঁকা পেটেই জ্বর আর ব্যাথার ওষুধ খেল। কেন যেন ভীষণ আক্রোশ তৈরি হয়েছে তার মধ্যে। বিদ্রোহের ইচ্ছে জাগছে। সে জবাব চায়। কেন তাকে এভাবে আঁটকে রাখা হয়েছে। কি চাই ওদের? গুমোট মাথা নিয়ে শুভ্রা তাকে বেঁধে রাখা ঘরে ফিরে গিয়ে আলমারির পুরো কাপড় এলোমেলো করে নিচে ফেলে দিলো। কাঁচের জিনিসপত্র ভাঙচুর করলো অকারণে। সবঘরের বিছানা তছনছ করলো। সবার শেষে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে টিভিটায় দিকে গ্লাস ছুঁড়ে মারলো। ঝনঝনিয়ে টিভি ভেঙে পড়লো। তবুও আক্রোশ কমলো না। তিনদিনের না খাওয়া শরীরে এতো শক্তি কোথা থেকে পেলো জানে না। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে চিৎকার করলো। যদিও তার গলার স্বর শোনা গেল না খুব একটা। ফ্যাসফ্যসে কন্ঠে চিৎকার করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। যখন শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেলো তখন যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
ঘুম ভাঙতেই ছেলেটাকে তার সামনে দেখলো। ওর নড়াচড়া দেখেই বলে উঠলো-“মেঝেতে সাবধানে পা রাখবেন। কাঁচ ছড়িয়ে আছে পা কেঁটে যাবে।”
শুভ্রা সাবধানে উঠে বসলো। মাথাটা দুলে উঠলো ভীষণভাবে কিন্তু তা এই ছেলেকে বুঝতে দেবে না। সে ছেলেটার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো জুতো পড়ে বসে আছে। শুভ্রার পুরনো মেজাজ ফিরে এলো। ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বললো-“গরু মেরে জুতো দানের দরকার নেই আমার। এতো চিন্তা থাকলে ঘর পরিস্কার করে রাখতেন।”
ছেলেটা শুভ্রাকে দেখলো মন দিয়ে তারপর উচ্চ স্বরে হাসলো-“গুড জোকস। আমার জিনিসপত্র সব ভাঙবেন আপনি আর আমি সেগুলো পরিস্কার করবো যাতে আপনার পা না কাটে?”
শুভ্রা ঠোঁট টিপে বললো-“দরকার হলে তাই করবেন বৈকি।”
ছেলেটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো-“দরকার! তা দরকারটা কেন হবে?”
শুভ্রা তেরছা হাসলো-“আমাকে তুলে এনেছেন মানেই তো আমাকে দরকার আপনার। তাই না?”
ছেলেটার ভ্রু কুঞ্চিত হলো-“আপনি আবারও ভুল করছেন। আমার ভালো ব্যবহারকে দূর্বলতা ভেবে নিচ্ছেন। দেখুন আমি চাইলে আপনাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখতে পারি। কোন কষ্ট করতে হবে না আমার। কিন্তু আপনার কোন ক্ষতি করার আমার সত্যিই কোন ইনটেনশন নেই। আমার প্রয়োজন ফুরালেই আপনাকে মুক্ত করে দেব। ততদিন পর্যন্ত কষ্ট করে থাকতে হবে আপনাকে।”
শুভ্রা অটল গলায় বললো-“থাকবো কিন্তু নিজের পরিচয় দিন আপনি। কেন আমাকে তুলে এনেছেন কারণ বলুন। যুক্তিসংগত মনে হলে আমি চুপচাপ মেনে নেব।”
“সরি। কারন বলতে পারবোনা।”
“তাহলে আমিও ভালোমতো থাকতে পারবোনা। চাইলে আপনি আমাকে আরও মা/র/তে পারেন। মা/র/তে মা/র/তে মেরেও ফেলতে পারেন তাতেও লাভ হবে না।”
ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো শুভ্রার দিকে। শুভ্রা সে দৃষ্টির মানে বুঝলোনা। কেমন যেন নিস্পৃহ ভাব। তবে শুভ্রাও হারবে না আজ। সেও তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর ছেলেটা মুখ খুললো-“আমি রণ।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin