#দর্পহরন
#পর্ব-২৯
রণর হাতে একটা লিষ্ট। কয়েকদিন আগে দিলশাদ পাঠিয়েছে লিষ্টটা। ওর এলাকায় কারা কারা সরাসরি সালিম সাহেবের বিপক্ষে, কারা নিউট্রাল আর কারা পক্ষে পুরো তথ্য আছে এখানে। পক্ষে বিপক্ষে ছাড়া এলাকার কিছু ব্যবসায়ী আছে যারা কোনদিকেই থাকে না। যার যখন পাওয়ার তখন তার হয়ে কাজ করে। রণ অনেকক্ষণ লিষ্ট হাতে নিয়ে বসে থাকলো। এদের মধ্যে কেবল সবুর আর ইমাদের সাথে কথা বলতে পেরেছে রণ। ওরা দলের জন্য কাজ করলেও সালিম সাহেবের কারণে কখনো পাত্তা পায়নি। আপাতত আসন্ন দলীর নির্বাচনে রণকে সাপোর্ট দেবে কথা দিয়েছে। সেই সাথে বাকী সকল সুবিধা বঞ্চিতদের সাথে কথা বলবে আস্বাস দিয়েছে রণকে। রণও তার কাজ শুরু করেছে ভেতরে ভেতরে। কয়েকটা সরকারি কাজের টেন্ডার হয়েছে যেগুলোর কাজ ইমাদ সবুর আর দুই তিনজনের মাঝে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছে। সালিম সাহেব পর্যন্ত খবর যেতে দেয়নি। আশা করছে এই কাজের পর অনেককেই তার পাশে পাবে। রণ মুচকি হেঁসে হাতের কলম দিয়ে কয়েকটা নাম কেটে দিলো লিষ্ট থেকে। কাগজটা ভাজ করে নিজের পার্সোনাল ড্রয়ারে রেখে দিলো। আজ পাশের দেশে যাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনদিনের রাস্ট্রিয় সফরে। এসে বাকী কাজ নিয়ে বসবে। তারপর হুট করে একদিন এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচনের ভোট করবে। আপাতত এমনটাই ভেবে রেখেছে রণ। কতটা সফল হবে সেটা ভবিষ্যত বলে দেবে। মিহির ফোন দিয়েছে-“ভাই, এই দিকে খুব হাঙামা হচ্ছে।”
“কি নিয়ে?”
“সবুর ভাই আর ইমাদের উপর চরাও হইছে সালিম সাহেবের লোক। মোর্শেদ আর সোহেল আবার মাঠ গরম করতেছে।”
“করুক। মিহির সবাইকে শান্ত থাকতে বল। আপাতত কেউ কিছু করবি না। আমি তিনদিন থাকবো না তোরা কেউ ঝামেলা করবি না। খুব বেশি সমস্যা হলে দিলশাদকে জানাবি।”
“ভাই, এইরকম চললে কিভাবে শান্ত থাকবে সবাই? দুই দফা মারামারি হউছে। কার্যালয়ে কাউকে ঢুকতে দিতেছে না। সোহেল কব্জা করে রাখছে।”
“রাখুক। সবাইকে বল আমি না আসা পর্যন্ত কেউ কার্যালয়ে না যাক। আমি এসে দেখবো।”
“আচ্ছা ভাই।”
মিহির যেন অনিচ্ছায় ফোন কাটলো। রণ কি ভেবে দিলশাদকে ফোন দিলো-“দিলশাদ, খবর শুনেছিস?”
“শুনেছি ভাই। আপনি ভাববেন না আমি খেয়াল রাখবো।”
“শুধু খেয়াল রাখিস বড় কোন ঘটনা না ঘটে।”
“আচ্ছা।”
তবুও মনটা শান্ত হলো না রণর। মনটা খচখচ করছে। কিন্তু এতো কিছু ভাবার সময় নেই এখন। ঘড়ি দেখলো এখনই বেরুতে হবে। আর দুই ঘন্টা পরে তার ফ্লাইট।
*****
“আরে ভাবি, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো।”
হাসি দরজায় তাকিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। শুভ্রা দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইলো-“তোমরা কি পড়ালেখা করছো? তাহলে আসবো না।”
খুশি উঠে শুভ্রাকে ধরে রুমের ভেতর আনলো-“পড়ালেখা করছি না। ভাইয়ার ছবি দেখছিলাম। তুমিও দেখো না। ভাইয়া অনেক ভালো ভালো কাজ করছে তারই নিউজ।”
শুভ্রার দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিলো। রণর হাস্যোজ্জল ছবি আছে সেখানে। প্রায় প্রতি ছবিতে সেদিনের মেয়েটাকে ওর সাথে দেখা যাচ্ছে।
“এই মেয়েটাকে চেন তোমরা?”
হাসি দেখলো-“ভাইয়া বলেছিল প্রধানমন্ত্রীর বোনের মেয়ে। কানাডা থেকে পড়ালেখা করে এসেছে। একটা প্রজেক্টের লিড হিসেবে কাজ করবে। মেয়েটার নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভারী আনকমন নাম, চন্দ্রানী। সুন্দর না নামটা?”
শুভ্রা কিছু না বলে মেয়েটাকে মন দিয়ে দেখলো। সে কি মেয়েটার থেকে কম সুন্দর? সেদিন দেখেছিল মেয়েটাকে। গায়ের রং বরং তার থেকে একটু চাপাই। চেহারা বেশ আকর্ষনীয়। সবসময় শাড়ী পরে ঘুরছে। নিজের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো। ইদানীং সে সালোয়ার কামিজ পরতে শুরু করেছে। জলির কড়া আদেশ ঘরের বউ গেঞ্জি পড়ে ঘোরা মানা। বাসায় সবসময় মেহমান আসে যায়। এরকম থাকলে লোকে বদনাম দেবে। শুভ্রা উচ্চ বাচ্য না করে মেনে নিয়েছে।
“এই ভাবী, তুমিও কিন্তু বাসায় বসে না থেকে কোন কাজে জয়েন করতে পারো?”
শুভ্রা না বুঝে খুশির দিকে তাকায়-“না মানে তোমার আমেরিকার ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে চাইলেই ভালো কোন জবে জয়েন করতে পারো।”
শুভ্রা খানিকক্ষন চুপ করে রইলো। আসলেই তো? অনেক কিছুই হতে পারতো কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো গত কয়েক মাসে তার জীবন উল্টে পাল্টে গেছে। কোন কিছু ভাবার অবকাষই পায়নি। ভাবছেই না কিছু। অথচ ক্যারিয়ার নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছিল। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো সে এতোদিনে আমেরিকাতেই কোন চাকরিতে ঢুকে যেত। এখন কেন যেন সব ভাবনা তালাবন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে ভালো লাগে না আর। হঠাৎ গায়ে হাত। শুভ্রা তাকিয়ে দেখলো হাসি। শুভ্রা হাসলো-“ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ তোমরা। এ ব্যাপারে ভেবে দেখবো। আসলেই বাসায় থেকে বোর হচ্ছি। কিছু একটা করলে আমারও সময়টা ভালো কাটবে।”
খুশি মাথা দুলায়-“যাই করো ভাইয়াকে বলে করো। নিজের লোকদের ব্যাপারে ভাইয়া খুব পজেসিভ।”
“পজেসিভ মানে? কাজ করতে দেবে না?”
“না সেটা না। সে আসলে ভয় পায় কেউ আমাদের কোন ক্ষতি না করে। এটাই কারণ।”
“আচ্ছা।”
মুখে আচ্ছা বললেও মনে মনে বললো ‘কিন্তু আমি কি তার আপনজন যে আমার জন্য পজেসিভ হবে?”
*****
“আব্বা, কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। সবকিছু হাত থিকা বাইর হইয়া যাইতেছে। কাজ অন্য মানুষকে দিয়ে দিতেছে শুভ্রার জামাই। সবাই আপনার বিরুদ্ধে চইলা যাইতেছে।”
সালিম সাহেবের চেহারা জুড়ে চিন্তার আভাস। বড় ভাই মোর্শেদ যেন সেই চিন্তায় ঘি ঢাললো-“হহহ সালিম, সোহেল কিন্তু ঠিক কইতেছে। এতোগুলা কাজ গেলো একটারও খবর পাইলাম না। এইদিকে বালু উত্তোলনের কাজ তো বন্ধই বলা যায়। সেইদিন হিরা চুপেচাপে বালু তোলার কাজ করতে গেছিলো কে জানি পুলিশে খবর দিছে। সবার সাহস বাইরা যাইতেছে। কি করবি সালিম? মাইয়া বিয়া দিয়া কি ফাইসা গেলি? জামাই এখন যা মন চায় তাই করবো?”
“আব্বা, সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন, আমাগো মানুষ ভয় পাইতো ভয়ডা কাইটা যাইতেছে। আর ভয় কাটলে কি হইবো জানেন তো? কিছু না করলে সামনে বিপদে পড়ুম।”
সালিম সাহেব সোহেল আর মোর্শেদকে পালাক্রমে দেখলো। গম্ভীর হয়েই জবাব দিলো-“মাইয়া বিয়া দিছি শুক্কুরে শুক্কুরে দেড় দুই মাস। ওখনই জামাই এর লগে বিটলামি করুম? আর জামাই ও আমাগো আপন ভাববো? এট্টু ধৈর্য্য ধরতে পারেন না আপনেরা। কিছু কাম হাত থিকা গেলে যাক না। এতো আফসোস করেন কিয়ের কিগা? অল্প কিছুর বদলে বড় কিছু যদি পান তাইলে কি সমস্যা আছে? এতোদিন তো মেলা খাইছি এখন এট্টু না হয় কয়দিন কম খাইলাম। চিন্তা কইরেন না। সময়মতো জামাই আর কামাই দুইটাই আমাগো হাতে আইবো।”
সোহেল উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকায়-“কেমনে আব্বা?”
“সময় আইলে দেখবি সোহেল। সবুর কর, সবুরে মেওয়া ফলে। জামাই বাবাজিরে ওর অস্ত্র দিয়াই ঘায়েল করুম। কিন্তু তার আগে তোরে একটাই অনুরোধ উল্টা পুল্টা কিছু করবি না। পুলিশ জানি তোর নাগাল না পায়। তোরা চুপচাপ থাক বাকী সব সামলাই নিমু আমি।”
*****
দুপুরে দেশে ফিরে সোজা অফিসে গেছিল রণ। সামনেই একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থার সম্মেলন হবে দেশে সেই নিয়ে তুমুল তোরজোর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রপ্রধানরা আসবে। সেই নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। কয়েকটা মিটিং এটেন্ড করে আর পারলোনা রণ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার পরপরই। কিন্তু ড্রয়িংরুমে ঢুকেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তন্ময়কে দেখে। তার দুই বোন তন্ময়ের সাথে গল্প করছে। ওকে দেখেই হাসিখুশির চেহারা ম্লান হয়ে গেলো। তন্ময়ও উঠে দাঁড়িয়েছে। শুভ্রা বিস্মিত, এইসময় রণ আসবে ভাবেনি। রণর বাসায় ফেরার সময় প্রায় দিনই গভীর রাত। আর আজ তো দেশের বাইরে থেকে ফেরার কথা। রণ মনে মনে ভীষন রেগে গেলো। সৌজন্যতার বশে দুটো কথা বলেই সে ঘরে ঢুকে গেলো। মেজাজ তার আকাশচুম্বী। নিজেকে শান্ত করতেই লম্বা সময় বাথটাবের উষ্ণ জ্বলে বসে রইলো চোখ বুঁজে।
ঘুমিয়ে গেছিল রণ, দরজায় করাঘাত শুনে তার ঘুম ভাঙলো-“কে?”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে জানতে চাইলো রণ।
“আমি। আপনার কি শরীর খারাপ করছে? বের হচ্ছেন না কেন? আন্টি খুব চিন্তা করছে।”
রণ জবাব দিলো না। পাঁচ মিনিট পরে টাওয়েল পড়ে বেরিয়ে এলো। রণ শুভ্রাকে দেখেও দেখলো না। শুভ্রা বেশ অপ্রস্তুত। রণ কখনো এরকম অবস্থায় তার সামনে আসেনি। আসলে আসার মতো পরিস্থিতি হয়নি। আজ কি হলো? রণ চুপচাপ আলমারির সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে গেঞ্জি বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ট্রাউজার পরার সময় লজ্জা পেলো শুভ্রা। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রণ সরাসরি বোনদের রুমে। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে ওর চোখ দুটো অসম্ভব লাল। হাসিখুশি ভীষণ ভয় পেলো। তারা বেশ বুঝতে পারছে ভাই আজ রেগে গেছে খুব।
“এই ছেলে আগে এসেছে বাসায়?”
দুইবোনের একজন হ্যা আরেকজন না সূচক মাথা নাড়ে। রণ গম্ভীর হলো-“সত্যি বল।”
হাসি ভয় পেলো-“আগে একদিন এসেছিল।”
“আমাকে বলিসনি কেন?”
খুশি জবাব দিলো-“ভাবির ভাই ভাবির কাছে আসে আমরা কি বলবো?”
“তো তোরা গল্প করতে গেছিলি কেন?”
রণ দু’হাত আড়াআড়ি ভাজ করে দাঁড়ায়। হাসিখুশি ঢোক গিললো-“ভাবি ডাকলে কি মানা করবো?”
“আর যাবিনা। ভাবির বাড়ি থেকে কেউ আসলে আর সামনে যাবি না। মনে থাকবে?”
দুই বোন স্ব জোরে মাথা দুলায়। রণ দাঁড়ায় না। জলি খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মায়ের সাথে কুশল বিনিময় শেষে চুপচাপ খেয়ে নিলো।
রণ খেতে বসতেই ঘরে ফিরেছিল শুভ্রা। তন্ময়কে দেখে লোকটা এতো গম্ভীর হয়ে গেলো কেন তা বোধগম্য হলো না শুভ্রার।
“আপনার ভাইরা কেউ এ বাড়িতে আসুক আমি চাই না।”
চমকে উঠলো শুভ্রা। রণ কখন সোফায় এসে বসেছ। শুভ্রা না বুঝে আবার জানতে চাইলে রণ কথার পুনরাবৃত্তি করলো। শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো-“কেন? ভাই বোনকে দেখতে আসবে না? এটা কেমন কথা?”
“না আসবে না। আমি চাই না আপনার চরিত্রহীন ভাইদের ছায়া আমাদের বাড়িতে পড়ুক।”
রণ গম্ভীর। ওর সুদর্শন চেহারা জুড়ে রাগের লালিমা।
শুভ্রা রেগে আগুন। সে রণর সামনে এসে দাঁড়ায়-“হাউ ডেয়ার ইউ? আমার সাহস হয় কি করে আমার ভাইদের চরিত্রহীন বলতে?”
রণর ভাব পরিবর্তন হলো না-“চরিত্রহীনকে চরিত্রহীন বলবো নাতো কি বলবো?”
“কিসের ভিত্তিতে এমন অভিযোগ তুলছেন আপনি? কি করেছে তন্ময়?”
“এতো ব্যাখ্যা দিতে পারবোনা। আমি বলেছি এ বাড়িতে ওরা কেউ আসবে ব্যস কথা শেষ।”
শুভ্রার গায়ে লাগলো কথাটা-“কেন আসবে না। ওরা আমার ভাই হয়। আমাকে দেখতে আসবে না? এ বাড়িতে আমার কি অধিকার তবে? আমি কি আপনার নামমাত্র বউ?”
রণ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো-“অধিকার! অধিকার অর্জন করে নিতে হয় স্বামীর বাড়ির সকলকে আপন করে নিয়ে, নিজের আন্তরিকতা দিয়ে। আপনি বলুনতো কি করেছেন আজ পর্যন্ত। না আমার মায়ের জন্য কিছু করেছেন না আমার বোনেদের জন্য আর না আমার জন্য। বলুন কিছু করেছেন?”
শুভ্রা স্তম্ভিত। রণ এভাবে তাকে বলবে সে ভাবেনি কখনো। রণ ঠান্ডা গলায় বললো-“আপনি পণ করে এসেছেন আমাকে ধ্বংস করবেন। বেশ ভালো কথা। কিন্তু আমি আগেই আপনাকে বলেছিলাম, আমার পরিবার থেকে দূরে থাকবেন। যা কিছু করতে চান আমার সাথে করবেন। আমাকে কষ্ট দেবেন দিন বাট নট মাই সিস্টার্স নট মাই মাদার। ওদের ক্ষতি করার কথা ভাবলেও সেটার পরিনাম ভালো হবে না।”
হুট করে এতোগুলা কড়া কথা শুনে কেন যেন কান্না পেয়ে গেলো শুভ্রার। সে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো-“আমি কি করেছি? ক’দিন পরে বাড়ি ফিরে এরকম করছেন কেন আমার সাথে? দোষটা কি আমার?”
রণ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়-“ক’দিন পরে বাড়ি ফিরেছি আপনি কি খুশি? কই দেখলাম নাতো? বেশ তো ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলেন। বাদ দিন এসব নাকি কান্না। আমি ভীষণ টায়ার্ড, ঘুমাতে হবে আমাকে।”
রণ বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে শুভ্রা তাকে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে মুখ ঠেকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো-“কেন এমন নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছেন আমার সাথে? প্রথমে কিডন্যাপ করলেন, বিনা কারণে দুইমাস আঁটকে রেখে অত্যাচার করলেন। এখন বিয়ের পর সবসময় দুরছাই করছেন। কেন করছেন এমন? কেন কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে? কেন? কেন?”
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৩০
“হাসিখুশিকে নিজের বোন মনে করি। আর আন্টিকে মা। ওদের ক্ষতি করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না। অথচ আপনি আমাকে কতবড় অভিযোগ দিয়ে দিলেন। একবারও ভাবলেন না আমি কষ্ট পাবো কিনা।”
শুভ্রার কান্না জড়ানো গলায় বলা কথাগুলো শুনে কিছুটা সময় স্থির হয়ে রইলো রণ। তারপর শুভ্রাকে ধরে নিজের সামনে নিয়ে এলো। শুভ্রার কান্না ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। ফর্সা মুখটা কান্নার দমকে কেমন রক্তলাল হয়ে আছে। রণর বুকের কোথাও যেন রক্ত ক্ষরন হয়। শুভ্রা মুখ নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। রণ ওর চিবুক তুলে ডাকলো-“শুনুন, আপনি কি সত্যিই এতো ইনোসেন্ট? মানে কিছুই জানেন না বোঝেন না?”
শুভ্রার ফোঁপানি কমলো কিছুটা। চোখের গড়িয়ে পড়া জল মুছে অবাক হয়ে বললো-“কি জানবো? আমার কি কিছু জানা উচিত?”
রণর এবার দুঃখে হাসি পেলো। সে মাথার চুল হাতালো কয়েকবার তারপর দ্বিধা নিয়ে বললো-“আপনার পরিবারের লোকগুলো কেমন সেসব কিছুই কি আপনি জানেন না? আপনার ভাই, আপনার বাবা, চাচা, তন্ময় ওদের সম্পর্কে কিছু জানেন না কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি। আপনি এ যুগের মেয়ে। ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ। তবুও এরকম অন্ধকারে আছেন কি করে সেটাই আমার বুঝে আসছে না।”
শুভ্রা এবার ভালো করে চোখের জল মুছে নিলো। বিরক্ত স্বরে বললো-“আপনি এতো হেয়ালি করছেন কেন? যেটা বলবার বলে ফেললেই তো হয়? আমার পরিবারের লোকজন কেমন বলুন দেখি? পত্রিকায় কিংবা ওয়েবে অনেক কিছুই দেখি তাই বলে সব কি সত্যি? আমরা কয়েক পুরুষ ধরে বনেদী। দাদা সাংসদ ও মন্ত্রী ছিলেন, চাচাও তাই তারপর বাবা। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ভাবে ক্ষমতায় থাকা খুব সহজ কাজ নয়। বন্ধুর চেয়ে শত্রু হবে বেশি, শুভাকাঙ্ক্ষী জমে যাবে, প্রশংসার চাইতে বদনাম বেশি হবে। আমাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আমি কিছু কিছু ব্যাপার দেখেছি নিউজে কিন্তু এটাও ভালোমতো জানি এসব সত্যি না। আমার পরিবার কখনো এতোটা খারাপ হবে না হতে পারে না।”
রণ হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল-“তাহলে তো আপনাকে কিছু বলা বৃথা। সব জেনেশুনে যখন অন্ধ সেজে বসে আছেন তখন আপনাকে জ্ঞান দিয়ে আলো ফোটানোর চেষ্টা করা অনর্থক।”
শুভ্রা রণর চোখে চোখ রাখে-“দেখুন, বাবা যখন থেকে আমাকে বুঝিয়েছে আমি এসব নিউজ, পোর্টাল এসব দেখা একদমই বন্ধ করে দিয়েছি। তাছাড়া আমি থেকেছি বাইরে বাইরে। জীবন কেটেছে ব্যস্ততায়। আপনি হয়ত জানেন না আমি নিজের খরচ নিজে চালানোর চেষ্টা করেছি সর্বদা। আমার অতো সময় কোথায় পরিবারে কোথায় কি হচ্ছে সেসব নিয়ে খোঁজ রাখবো।”
“এখন তো অঢেল সময় এখন খোঁজ রাখছেন না কেন?”
রণর কন্ঠে কৌতুক। শুভ্রা ভ্রুকুটি করলো-“টোন কাটছেন? আপনার অন্ন ধ্বংস করছি বলে?”
রণ জিভ কামড়ে বলে-“ছি ছি, এতো মিন মাইন্ড মনেহচ্ছে আমাকে?”
শুভ্রা ঠোঁট ওল্টায়-“বুঝিনা বাপু, আপনি কি বলতে চান তাই বুঝতে পারলাম না আজ অবধি।”
“চেষ্টা করলে ঠিকই পারতেন।” বিরবির করে রণ।
“কিভাবে পারতাম? সুযোগ না দিলে কিভাবে পারতাম?”
রণ রহস্য করে হাসলো। কৌতূহলে জানতে চাইলো-“তা কেমন সুযোগ চাচ্ছেন বলুন তো? আমিও আসলে বুঝতে পারছি না।”
“আপনাকে বুঝতে কি কি করতে হবে সেটা আগে বলুন। ভোর সকালে বেরিয়ে গভীর রাতে বাসায় ঢুকলে বউ কি বুঝবে আপনাকে?”
শুভ্রা ফিরে যাচ্ছিল রণ তার হাত ধরে কাছে টানলো। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলো-“তো আপনি কি চাইছেন দেশের জরুরি কাজ বাদ দিয়ে আপনার কাছে বসে থাকি? আপনাকে দেখি সারাদিন?”
শুভ্রা থতমত খেলো-“আমি কখন একথা বললাম?”
রণ ঠোঁটের কোনের হাসিটা গিলে নিলো-“মুখে না বললেও মনে মনে বলছেন নিশ্চয়ই। তা নয়তো আমি শুনতে পেলাম কি করে?”
শুভ্রা মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। ওর বোকা কান্ড দেখে রণ হো হো করে হেসে দিলো-“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ভুল কিছু বলেছি?”
“আমার মন কি বলছে তা আপনি শুনতে পেলেন কি করে? খুব মন বিশারদ হয়েছেন দেখা যাচ্ছে। এইজন্যই বুঝি চন্দ্রানীর সাথে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে আজকাল? ওর মনের কথা খুব বুঝছেন তাই না?”
রণ বেশ মজা পেলো শুভ্রার কথায়। শুভ্রাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতেই বললো-“তা একটু একটু পারছি বলতে পারেন। মেয়েটা বেশ ভালো। দেখেছেন দেশের বাইরে থাকার পরও কতো সুন্দর করে শাড়ী পরে থাকে।”
শরীরটা জ্বলে উঠলো শুভ্রার। সে হুট করে রণর খুব কাছে চলে এলো। ওর গেঞ্জির কলার মুচরে ধরে বললো-“চন্দ্রানী খুব সুন্দর শাড়ী পরে তাই না? তাতে তার শরীরের বাঁকগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। আপনার দেখতে সুবিধা হয়?”
রণ মোটেও ঘাবড়ে গেলোনা। তার চেহারা জুড়ে অস্পষ্ট হাসির রেখা ধরে রেখে বললো-“তা একটু সুবিধা হয় বইকি। কি আর করা নিজের বউয়েরটা যখন দেখার সুযোগ নেই তখন না হয় অন্যেরটাই দেখি।”
শুভ্রার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে রণর কথা শুনে। ইচ্ছে করছে রণর টুটি চেপে ধরতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“এতো শখ বউয়ের টা দেখার তো দেখুন না। কে মানা করেছে আপনাকে? দেখুন চাইলে ছুঁয়ে দিন। ঢং করে ভদ্রলোক সেজে থাকা হচ্ছে তাই না?”
রণ মুগ্ধ চোখে শুভ্রাকে দেখছে। মেয়েটা রেগে টং হয়ে আছে। নাকের ডগা বেদানার মতো রং ধারণ করেছে। রাগের বশে কতটা কাছাকাছি এসেছে মেয়েটা টেরই পাচ্ছে না। রণ হুট করে শুভ্রাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিলো-“আমি মোটেও ভদ্রলোক সেজে থাকছি না। আমি আসলেও ভদ্রলোক। বউয়ের অনুমতি ব্যাতীত তাকে দেখা তো দূর ছুঁয়ে দেওয়ারও কোন ইচ্ছে আমার নেই। বুঝলেন অবুঝ মেয়ে?”
বলেই ওর নাকে নিজের নাকটা ঘষে দিয়ে টুপ করে চুমো একে দিলো মেয়েটার নাকে। শুভ্রা হতচকিত রণর কান্ডে। এই লোক হুটহাট এমম এমন কাজ করে যে অবাক না হয়ে পারে না। লোকটার হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ে কেমন যেন লাগছে তার। বুকটা অকারণে ধুকপুক করছে। শুভ্রা কম্পিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো-“কি করছেন?”
রণ মদিরাসাক্ত গলায় বললো-“আমি কি করলাম? আপনিই তো বললেন আপনাকে কাছে টানতে।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“দেখতে বলেছি জড়িয়ে ধরতে বলিনি।”
রণ সাথে সাথে ছেড়ে দিলো শুভ্রাকে-“সরি, ভুল শুনেছি।”
শুভ্রার মনেহলো কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। মন চাইলো রণকে জাপ্টে ধরতে। কিন্তু নিজের আত্মসম্মান বাঁধা দিলো। এর চেয়ে বেশি আগানো তার পক্ষে সম্ভব না। এতোটা নিচে নিজেকে নামাতে পারবে না। তাই অনেকটা মনখুন্ন হয়েই বিছানায় নিজের জায়গায় যেয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়লো। রণ চুপচাপ ওকে দেখলো তারপর নিজেও শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর আগ মুহুর্তে বললো-“আগামী কয়েকটা সপ্তাহ ভীষন ব্যস্ত থাকবো আমি। মা আর হাসিখুশির খেয়াল রাখার দায়িত্ব তাই আপনার উপর দিলাম। বাসায় যেন অযাচিত কেউ না আসে সেটা দেখভালের দায়িত্ব আপনার উপর। আশাকরছি আপনি আপনার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবেন।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। ঝগড়া করার মুড নেই তার।
*****
“ভাইয়া, তুমি আর এসো না এখানে। ও পছন্দ করছে না।”
শুভ্রার মুখে কথাটা শুনে অবাক তন্ময়-“আমি তোর ভাই শুভ্রা। আমি আসলে কি সমস্যা হবে?”
“আমি জানি না। ও বললো বাসায় পুরুষ আসা ঠিক না। আমরা মেয়েরা থাকি এইজন্য আর কি।”
তন্ময় মুখ নিচু করে বসে আছে। কিছু একটা ভাবলো তারপর বললো-“তাহলে তোকে সরাসরি বলি, তোর ননদটাকে পছন্দ হয়েছে শুভ্রা।”
শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে ভাইকে দেখলো। ভাইয়ের চেহারা দেখে ওর শরীর কাঁপতে লাগলো। এ কি সর্বনাশা বিপদ আসতে চলেছে তার কাঁধে। সে নিচু স্বরে চেচিয়ে উঠলো-“ননদটাকে? কাকে?”
তন্ময় হাসলো-“খুশিকে। সি ইজ আ নাইস গার্ল।”
শুভ্রা ঢোক গিললো-“এসব ভুলে যাও ভাইয়া। ও শুনলে জানে মেরে ফেলবে আমাকে।”
তন্ময় তাকিয়ে রইলো-“এ কেমন কথা শুভ্রা। তোর ননদকে পছন্দ করেছি চাইলে বিয়ে করবো। এখানে মেরে ফেলার মতো কি হয়েছে?”
শুভ্রা আঁতকে উঠে বললো-“তোমার মাথা নষ্ট হয়েছে ভাইয়া। এটা কখনো সম্ভব হবে না। প্লিজ তুমি আর এসো না। এমনিতেই ঝামেলার শেষ নেই জীবনে। নতুন করে কোন ঝামেলা চাই না আর।”
তন্ময় অনড়ভাবে বসে রইলো-“তুই আমার বোন শুভ্রা। আমাকে জানিস আমি কেমন। তোর বরকে বরং বলিস আমার প্রস্তাব ভেবে দেখতে।”
শুভ্রা এবার হাতজোড় করলো-“প্লিজ ভাইয়া, এমন কিছু করো না। ও ওর বোনদের খুব ভালোবাসে। ওরা এখনো ছোট বিয়ের কথা মাথায় আনাও পাপ ওদের জন্য। আমি কিছুতেই এ কথা বলতে পারবোনা ওকে। প্লিজ ভুলে যাও এসব।”
তন্ময় উঠে দাঁড়ায়। ক্ষনকাল শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর স্মিত কন্ঠে বললো-“আজ আসছি।
প্রয়োজন হলে আবার আসবো। তোর ভাই নিজের মর্জির বাইরে একপাও নড়ে না। জানিস তো? ভালো থাকিস।”
শুভ্রা উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তন্ময়ের চলে যাওয়া দেখলো। এইজন্যই বুঝি লোকটা মানা করেছিল। ভেবে ভয়ে বুক হিম হয়ে গেলো শুভ্রার। তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। মনেহচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। বড় কোন অঘটন না ঘটে যায়। খুব ঘামতে লাগলো শুভ্রা।
চলবে—
©Farhana_Yesmin