দর্পহরন পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
419

#দর্পহরন
#পর্ব-২৫

সকাল সকাল শুভ্রাকে বাড়িতে উপস্থিত হতে দেখে রিমা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“এতো সকালে তুই একা একা কোথা থিকা আসলি শারমিন?”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ ছিলো সেটা মায়ের কথায় আরও বাড়লো-“এতো প্রশ্ন করো কেন আম্মা?আমার যখন ইচ্ছা তখন আসবো। নিজের বাড়িতে আসতে আবার সময় দেখা লাগবে? নাকি আমার আসা পছন্দ না তোমার? বিয়া হইছে মেয়ে পর হয়ে গেছে, তাই তো?”
রিমা হা করে মেয়েকে দেখছে। সে বুঝে পাচ্ছে না মেয়ে হঠাৎ করে এতো রেগে গেলো কেন? সে তো খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছে। মিনু কি বুঝলো কে জানে পরিস্থিতি শান্ত করতে বললো-“রিমা, বাদ দেতো। মেয়েটা সাতসকালে আসছে ওরে খাইতে টাইতে দে। প্রশ্ন পরেও করা যাবে।”
ইশারায় রিমাকে শান্ত থাকতে বললো। শুভ্রা অবশ্য তাতে শান্ত হলো না। সে গজগজ করলো আরও কিছুক্ষন তারপর বললো-“চাচী, আমি এখন খাবো না। রাতে ঘুম হয় নাই তাই ঘুমাবো। ঘুম থেকে উঠে খেতে মন চাইলে খাবো। দয়া করে তোমরা কেউ আমাকে ডাকবে না।”

শুভ্রা চলে যেতেই রিমা জায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওর হঠাৎ কি হইছে বুবু? জামাই ছাড়া সকাল সকাল চইলা আসলো কেন? কালকে এতো জোর করলাম আসলো না আর আজই সকালে চলে আসছে। দেখছেন কারবার?”
“আমার মনেহয় ঝগড়া হইছে জামাই এর সাথে।”
“কিন্তু জামাইরে তো ভালোই লাগছে আমার। ওর মা আর বোন দুইটাও ভালো। ঝগড়া কেন লাগবে? মানলাম ওরা আমাদের মতো না তাই বইলা ফেলনাও না। ঝগড়া কেন করবে?”
মিনু হাসলো-“তোর মাইয়া যে জেদি। এক্কেরে বংশের ধারা পাইছে। তয় জামাইরেও কিন্তু সোজা মনেহয় নাই। মন পরিস্কার হইতে পারে কিন্তু তেড়া আছে। নিশ্চয়ই কিছু কইছে শারমিনরে। তুই চিন্তা করিস না, আমি ওর লগে কথা কমু।”
চিন্তা করিস না বললেও রিমার মনে চিন্তা লেগে রইলো। একা একা বড় হওয়া মেয়েটা একটু বেশি জেদি সেটা তার চেয়ে ভালো কে জানে। কে জানে কি করে আসছে ওই বাড়িতে।

অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না শুভ্রার। কাল থেকে তার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। রণর বলাটা প্রতিটা কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধেছে। একজন মেয়ে হয়ে এই অপমান সে মেনে নিতে পারছেনা। দু’টো মাস রণ তার সাথে যা করেছিল সে শুধু তার মতো করেই সেই কাজের শোধ তুলতে চেয়েছে। এতে কি ভুল হয়েছে তার? রণ কেন এভাবে বলবে তাকে? মানুষটা কি নিজের কাজে একটুও অনুতপ্ত হবে না?

হ্যা, এটা ঠিক বন্দী থাকা সময়ে রণ তাকে কোনভাবে অপমান করেনি। কখনো বাজে দৃষ্টিতে তাকায়নি তার দিকে কিন্তু নানাভাবে কষ্ট তো দিয়েছে। সেই সব কি সে ভুলে যাবে সহজে? রণ হলে কি ভুলে যেত? বিয়েটা করে কি ভুল করেছে সে? এরচেয়ে আমেরিকায় ফিরে গেলেই হতো। পড়া শেষ এখন একটা চাকরি নিয়ে দিব্যি দিন কেটে যেত। কি এক প্রতিশোধের চক্করে বিয়ে ফিয়ে করে জীবনটা আরও জটিল করে ফেললো। এখন কি করবে সে? এই অপমানের পর কি ওর রণর কাছে ফেরা উচিত হবে? ভাবতে ভাবতে শুভ্রা কেঁদে দিলো হঠাৎ করে।

*****

রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রণ। জলি ওর অপেক্ষায় ছিলো। ছেলেকে দেখে এগিয়ে এলো-“তোর তো শরীর ঠিক নেই তুই কোথায় যাচ্ছিস রণ? বউমাই বা কোথায় গেলো সাতসকালে?”
“ও ওর বাবার বাসায় গেছে মা। এতো চিন্তার কিছু নেই। আর আমার একটা মিটিং আছে এলাকার কর্মীদের সাথে। তুমি প্লিজ হাসিখুশি নিয়ে ঢাকায় চলে যাও। আমি মিটিং করে সরাসরি ঢাকায় যাবো।”
জলি অবাক হয়ে বললো-“বউমা যাবে না?”
রণ ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে জবাব দিলো-“ও গেলে যাবে না গেলে যাবে না। ওকে নিয়ে এতো ভেবনা মা। বাবার বাড়ি গেছে থাকনা কিছুদিন।”
“বউ ছাড়া ঢাকায় ফিরে যাব? এটা কেমন ব্যাপার হলো রণ?”
জলির মনটা ভারাক্রান্ত হলো। রণ মাকে জড়িয়ে ধরে-“মা প্লিজ, বারবার বউ বউ করো না। ও নিজ ইচ্ছায় গেছে নিজ ইচ্ছায় ফিরবে। আর আমার পক্ষে বউ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব না। এমনিতেই কয়েকদিনের ব্যস্ততায় কাজ জমে পাহাড় হয়েছে। কিভাবে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না আর তুমি পড়ে আছো বউ নিয়ে। আমার আজ ঢাকায় ফিরতেই হবে যে কোনভাবে। তুমি প্লিজ হাসিখুশিকে রওনা দাও। দেরি করবে না মা। তুমি জানো তো তোমাদের এখানে থাকা আমি পছন্দ করছি না।”
জলিকে রুষ্ট দেখালো-“আচ্ছা ঠিক আছে চলে যাব। তুমি ঠিকঠাক মতো বের হ। ঢাকায় পৌঁছে তোকে জানিয়ে দেব ভাবিস না।”
“গুড গার্ল। আসছি তাহলে।”
রণ মায়ের কপালে চুমু একে দিয়ে বেরিয়ে এলো। জলি পেছন থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা খচখচ করছে। মেয়েটা কি রাগ করেছে কাল? কড়া কথা শুনিয়েছিল মেয়েটাকে। সেইজন্য আবার রাগ হলো নাতো রণর সাথে? কিন্তু সে তো খারাপ কিছু বলেনি। বিয়ে হয়েছে এখন স্বামীর প্রতি টান হবে না? না হয় রণ ওকে কিডন্যাপ করেছিল, অন্যায় করেছিল কিন্তু এখন মেয়েটা যা করছে সেটাই বা কতটুকু যৌক্তিক? শুভ্রার প্রতি রুষ্টতা আরেকটু বাড়লো জলির।

রণর গাড়ি ছুটছে দলীয় কার্যালয়ের দিকে। মিহিরকে ডাকলো রণ-“মিহির, সব ঠিক আছে? সবাই কি এসেছে?”
“এসেছে ভাই। আপনার কথা মতো আজ সালিম সাহেবকে আমন্ত্রণ করি নাই।”
“ভালো করেছিস। চল দেখি শুনি ওরা কি বলে। আর কাগজগুলো এনেছিস তো?”
মিহির কোলের উপরে থাকা ব্রিফকেসটা দেখালো-“সব আছে এখানে।”
রণর মুখে হাসি ফুলটো-“গুড জব মিহির।”

*****

ডাইনিং এ খেতে বসে মেয়ের বাড়ি আসার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো সালিম সাহেবের। রিমার দিকে তাকিয়ে বললো-“ওরে ডাইকা আনো। শুইনা দেখি একা আইছে কেন? ওর না জামাই নিয়া আসার কথা আছিল? কালই কইলো জামাই অসুস্থ। আইজ আবার অসুস্থ জামাই ফালায়া এইখানে আইছে কেন?”
রিমা মিনমিন করলো-“আমিও এইকথা জিগাইছিলাম। আমারে মেলা কথা শুনাইলো।”
“ওয় ডাকতে মানা করছিল। ঘুমাইতেছে মনেহয়। ঘুমাক সালিম তুই ভাবিস না। ও উঠুক আমি কথা কমু ওর সাথে।”
পাশ থেকে বড় ভাবি মিনুর কথা শুনে খাওয়ায় মন দিলো সালিম। শরীফ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সালিম সাহেব তাকে ডাকলো-“তুই কি আবার ফিরা যাবি? না গেলে আমার একটা বিজনেস সামলা। তাও তো আমি একটু হালকা হইতে পারি।”
শরীফ খাওয়া থামিয়ে জবাব দিলো-“হুট করে আসছিলাম তাই চাকরি ছাড়তে হইছিল। আবার কোন চাকরি হইলেই চলে যাব আব্বা। আপনাদের এইসব বিজনেস পোষাবে না আমার।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো-“বাইরে একা একা থাইকা এতো কষ্ট কেন করোস আমি বুঝি না। এইখানে সব আছে তবুও তোরা কেউ থাকতে চাস না। তাহেরটা তো বিয়েই করতে চায় না।”
শরীফ জবাব দিলো না। জবাব দিলেও লাভ নেই। উত্তর তার বাবার পছন্দ হবে না। শুধু শুধু অশান্তি চায় না সে। সালিম ছেলের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে বড়ভাইকে দেখলো-“ভাইজান, তন্ময় আইছে এইবার ওরে বিয়া করায় দেন। পোলা দেশে থাকুক। সবাই অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা থাকলে আমাদের এই এতোবড় ব্যবসা দেখবে কে বলেন দেখি? ইদানীং খুব চিন্তা হয় ভাইজান।”
মোর্শেদ পত্রিকা ভাজ করে রাখলো-“আমিও তাই ভাবছি সালিম। তন্ময়কে বিয়ে করাবো। দেখি তন্ময় কি বলে।”
মিনু কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলো। এদের ভাইদের মধ্যকার আলোচনায় কথা বলা বৃথা। বউদের কথা এরা শোনে না। এরচেয়ে চুপ থেকে সন্মান বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

“আব্বা!”
হুট করে সোহেল চলে এলো। তার চেহারা জুড়ে উত্তেজনা। সে সালিম সাহেবের কানে কানে কিছু বলতেই সালিম সাহেব নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠলো-“কি কস এইসব? খবর পাক্কা তো?”
“একশোভাগ পাক্কা আব্বা। ওরা এখন ওইখানে আছে।”
“আচ্ছা, চল দেখি যাই।”
সালিম সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন। মোর্শেদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো-“কি হইছে সালিম? কই যাস এখন?”
“খুব জরুরি কাজ ভাইজান। আমি পরে আইসা বলতেছি।”
“আরে খাওন খাইয়া যান না।”
“আরে রাখো তোমার খাওন। এইদিকে জীবন চইলা যাইতেছে সে পইড়া আছে খাওন নিয়া।”
সালিম সাহেব ধমক দিলো। কোনরকমে হাত ধুয়ে নিচে নেমে গেলো। সোহেল তার পিছু পিছু।

*****

“আপনারা যারা আজকে আমার ডাকে সারা দিয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আশাকরি আজকের আলোচনায় উপস্থিত সকলেই আজ এখানে আলোচিত বিষয়ের ব্যাপারে গোপনীয়তা পালনে সচেষ্ট হবেন। আমি এই এলাকার নতুন নির্বাচিত সাংসদ হওয়ার পাশাপাশি একজন মন্ত্রীও বটে। আমার দায়িত্ব দেশের প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করতে আমি বন্ধ পরিকর। তাই সারা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমার নিজ এলাকার প্রতি একটা বাড়তি দায়িত্ব এসে যায়। এই এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে এখনকার প্রতিটা মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে চাই বলেই আজকের এই মিটিং এর আয়োজন করেছি।

আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন আমি সালিম সাহেবের জামাতা। আমি হয়তো সব কাজে তাকে ফেভার করবো। আজ আমি নিজ মুখে বলছি যে, তার আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেবল বাড়ির ভেতর। বাড়ির বাইরে এই সম্পর্কের দাবিতে আমি কোন অন্যায়কে প্রশয় দেব না। এলাকার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কাউকে সে যেই হোক না কেন, কাউকেই আমি প্রশ্রয় দেব না। এটা মাথায় রাখবেন সবাই।

এতোদিন এই এলাকায় দলীয় কর্মকান্ড যেভাবে চলেছে এখন থেকে সেভাবে চলবে না। গেল কয়েকবছরে দলের কয়েকজন অনেক বেশি সম্পদশালী হয়েছে আর কয়েকজন বঞ্চিত হতে হতে দলের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়েছে। কেউ কেউ দলীয় লোকের হাতেই লাঞ্ছিত হয়ে নীরবে দল থেকে সরে গেছে। কে কি করেছেন এই সব তথ্য
আমার হাতের এই কাগজগুলোতে আছে। তবে ভয় পাবেন না কাউকে শাস্তি দেব না আমি। আমি শুধু চাই সব কিছু নতুন করে শুরু করতে। কারো প্রতি অবিচার না করতে। আর আপনাদের কার কি অভিযোগ আছে সব আমলে নিয়ে কাজ করতে।

সামনে দু’টো নির্বাচন হবে। আমি চাই আপনারা যোগ্য কাউকে নির্বাচিত করুন। সেই জন্য এখন থেকেই বিচার বিবেচনা করে কাজ শুরু করতে হবে। যারা কাজ করেছেন কিন্তু পদ বঞ্চিত থেকেছেন দীর্ঘদিন তাদের নিয়ে আমি বিশেষ কিছু করতে চাই। আপনারা কি রাজি আছেন?”
মিটিং এ উপস্থিত সকলে সমস্বরে চিত্কার করে উঠলো-“হ্যা, রাজি রাজি।”
রণর মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো-“বেশ, তাহলে প্রথম কয়েকটা কাজের জন্য তৈরি হয়ে যান আপনারা। সবুর চাচা, ইমাদ ভাই আপনাদের জন্য নির্বাচিত কাজ হলো…”
“আরে থামো থামো জামাই বাবা থামো। আমাকে ছাড়া কি করতেছ তোমরা এইখানে?”
পুরো মিটিংস্থল থমকে গেলো। সুনসান নিরবতা নেমে এলো। চারিদিকে ফিসফিস আওয়াজ। রণ অবাক হয়ে মিহিরকে দেখলে সে মাথা নাড়লো নিরবে। তারপর চুপচাপ হাতের কাগজগুলো ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে নিলো। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে রণর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হাসলো-“মানলাম তুমি মন্ত্রী হইছো কিন্তু আমি এখনো এই এলাকার দলীয় প্রধান। আর তুমি আমাকে না জানায়া মিটিং করতেছ? কামটা কি ঠিক করলা?”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৬

“মিহির, প্রতিবার এই লোক কিভাবে খবর পায়? একটাবার সফল হতে পারতেছি না কেন?”
মিহিরের মুখ কাচুমাচু-“আমি জানি না ভাই। কিভাবে জেনে যায় সত্যিই জানি না।”
“এই মিটিং এ উপস্থিত প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক কর মিহির। কে এই খবর পাস করেছ তাকে খুঁজে বের কর। তুই আবার একটা মিটিং এ্যারেন্জ কর। এবার যেন কেউ টের না পায়। কেউ না মানে কেউ না।”
রণর রণমুর্তি দেখে মিহির চুপসে গেলো। ফোনের এপাশ থেকে কিছু বলার সাহস হলো না। রণ ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। তার মেজাজ আসলেই বেশ খারাপ। গুছিয়ে আনা কাজ শেষ করতে না পারলে ভীষণ মেজাজ খারাপ হয় বইকি। সে আরামকেদারায় হেলান দিলো।

আজ নেত্রীর সাথে মিটিং ছিলো। সামনে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে নদীবন্দরকে ঘিরে। রণকে নিজের এলাকার উন্নয়নে নজরে দিতে বলেছে নেত্রী। সেই সাথে এলাকায় দলীয় শৃঙ্খলা বজায় যেন বজায় থাকে সে ব্যাপারে কড়া দৃষ্টি দিতে বলেছে। কিন্তু রণ যেন বারবার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। নিজ থেকে যাই করতে যাচ্ছে বারবার ভেস্তে যাচ্ছে তার চেষ্টা। অনেক ভেবে দিলশাদকে ফোন দিলো-“দিলশাদ, একটা সাহায্য করবি?”
“কে কে সালিম সাহেবের পক্ষে কাজ করে এর একটা লিস্ট আমি আপনাকে দেব ভাই। কয়েকটা দিন সময় দেন।”
রণ হেসে দিলো-“তুই কিভাবে জানলি আমি এটাই বলতাম তোকে?”
দিলশাদ হাসলো-“আপনার মিটিং এর ব্যাপারটা আমার কানে এসেছে। আপনি নতুন মানুষ, রাজনীতি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। আর সালিম তো অনেক পুরনো লোক আর সে লোকও ভালো না তাই কেউ কেউ তাকে পছন্দ না করলেও ভয়েই খবর জানায়। আপনার কাজে দূর্বল চিত্তের কাউকে রাখবেন না ভাই। তাতে আপনি কিছু করতে চাইলেও সফল হবেন না। আর এরপর মিটিং করলে আমাকে জানায়েন। আশাকরি এসব সমস্যা হবে না।”
“থ্যাংক ইউ দিলশাদ। মনে থাকবে।”
দিলশাদের ফোন কেটে পুনরায় মিহিরকে ফেন দিলো রণ। ওপাশ থেকে মিহির হ্যালো বলতেই রণ বললো-“সবুর চাচা আর ইমাদ ভাইয়ের সাথে কালকে ঢাকায় একটা মিটিং ফিক্সড কর। ওদের বলবি কেউ যেন না জানে। শুধু ওরা দুইজন। কারণ যতটুকু জানি ওদের দুইজনের সাথেই সালিম সাহেবের গন্ডগোল আছে। ওরা কেউ সালিম সাহেবকে পছন্দ করে না। বুঝেছিস?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাই। মিটিং ঠিক করে আমি আপনাকে সময় জানিয়ে দেব ভাই।”
“আচ্ছা।”

*****

“ভাবি, তোমাদের বিয়ে হলো কি করে? তোমার পরিবারের কেউ আসে ন কেন বাসায়? তুমিও তো তোমার বাবার বাড়ি যাওনা কোনদিন। ভাইয়ার সাথে কোথাও বেড়াতেও যাওনা কেন? তুমি সবসময় এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন?”
শুভ্রা তুলতুলকে সকাল বিকাল প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তুলতুল প্রতিবার নিরব থাকছে। শেষমেষ না পেরে তুলতুল সেদিন বলে ফেললো-“আপা, এইসব প্রশ্ন আমাকে আর কইরেন না। আমি উত্তর দিবো না। আপনার যদি কিছু জানার থাকে আপনার পরিবারের লোকদের জিজ্ঞেস করেন।”
শুভ্রা ভীষণ অবাক হয়ে বললো-“তুমি কিছু বলবে না কেন? কি সমস্যা বলো তো?”
তুলতুল জবাব দিলো না। শুভ্রা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে গেলো। সে বুঝতে পেরেছে কোন একটা ঘোলাটে ব্যাপার আছে এখানে। ব্যাপারটা কি হতে পারে সেটা জানার জন্য মনটা উশখুশ করছে তার। মায়ের খোঁজে বের হলো সে।

রিমা আর মিনু ভিডিও কলে কথা বলছিল কারো সাথে। শুভ্রা মাকে ইশারা দিচ্ছিলো কিন্তু রিমা গা করলোনা। শুভ্রা অপেক্ষা করলো ওদের কথা শেষ হওয়ার। কথা শেষ হওয়া মাত্র রিমা মেজাজ দেখিয়ে জানতে চাইলো-“কি হইছে? দেখতেছিস যে কথা বলতেছি তাও এমন করতেছিলি কেন?”
শুভ্রা ব্যস্ত গলায় বললো-“ভাবি তার মায়ের বাড়ি যায় না কেন মা? ওর মাও আসে না? শুনছি যে ওর মা আর ভাই আছে একটা। ওরা আসে না কেন?”
রিমা সন্দিহান নজরে মেয়েকে দেখলো-“তুই শশুরবাড়ি কবে যাবি শুভ্রা? জামাই ফালাইয়া আর কয়দিন বাপের বাড়ি থাকবি? বিয়া তো নিজ থিকা করছোস এখন যাস না কেন? বাপের বাড়ি আইসা নানা ব্যাপারে মাথা ঘামানি তোরে মানায়?”
শুভ্রা হতবাক হয়ে গেলো। সে দুঃখী চেহারায় মাকে বললো-“এসেছি সাতদিনও হয়নি তুমি এভাবে বলতে পারলে মা? আমি তোমাদের সব খেয়ে ফেলছি?”
রিমা রেগে গেলো-“তোরে খাওয়ার কথা কইছি আমি? এতো বেশি বোঝোস কেন তুই? বিয়া হইলে এতোদিন স্বামী ফালায়া বাপের বাড়ি থাকতে নাই। এই সহজ কথা তুই কবে বুঝবি শুভ্রা?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। সে তীব্র অভিমানে মাকে দেখলো কয়েকপলক তারপর দৌড়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করলো। মিনু পুরো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে বললো-“এমনে না কইলেও পারতি রিমা। মাইয়া কষ্ট পাইছে।”
“পাইলে পাক বুবু। আমি কোনদিকে যাব? ও কি জানতে চাইছে শুনছেন? ওরে এইসব কইলে ওর বাপ আমাকে আস্ত রাখবে বলেন? মেয়েরে কিছু জানাইব না বইলাইনা মেয়েরে সারাজীবন বাইরে বাইরে রাখলো। আমার হইছে যত জ্বালা। আর ভালো লাগে না এইসব।”
মিনু তীব্র চোখে রিমাকে দেখছে। এই মেয়ে সবসময় নরম। কিছু একটা হলেই ওলটপালট বকতে শুরু করে। সালিমের বউ হিসেবে এই মেয়েকে সবসময় অযোগ্য মনেহয়েছে তার কাছে। কিন্তু সালিমের একেই বিয়ের যোগ্য মনেহয়েছে। মিনু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলো।

রাতে সালিম সাহেব বাড়ি ফিরে শুনলো শুভ্রা সারাদিন কিছু খায়নি। দোর আঁটকে শুয়ে আছে। সালিম সাহেব মেয়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন-“আম্মা, খাবেন না আপনি? আব্বাও কিন্তু খায় নাই এখনো।”
শুভ্রা কান্না জড়িত গলায় জবাব দিলো-“খাবো না আমি। মা আমাকে খাওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো-“আচ্ছা ঠিক আছে। না খাইলেন দরজাটা অন্তত খুলেন আম্মা। সারাদিন আপনাকে দেখি নাই।”
শুভ্রা কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দিলো। সালিম সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকলো। শুভ্রা মন খারাপ করে বিছানায় বসে আছে। পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে সালিম সাহেব-“মায়ের কথায় মন খারাপ করতে আছে? মা তো একটু এমনই।”
“তাই বলে বাপের বাড়ি আসার খোঁটা দিবে? এইটা কেমন কথা আব্বা? বিয়ে হয়েছে বলে কি আর এই বাড়ি আসতে পারবোনা আমি?”
“তা কেন পারবেন না। এই বাড়ি সবসময় আপনের ছিল আপনারই থাকবে। আপনি যখন খুশি আসবেন যাবেন। কিন্তু একটা কথা সত্যি আম্মা। আপনের তো নতুন বিয়া হইছে এইভাবে আইসা থাকলে লোকে নানা কথা বলবে। মা এইটা মিথ্যা বলে নাই।”
“আব্বা আপনিও?”
শুভ্রার চেহারায় বিষাদ নামে। সালিম সাহেব নরম গলায় শুধালো-“ভুল বুইঝেন না আম্মা। একটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো। আপনি কি আব্বাকে ভালেবাসেন?”
শুভ্রা চমকে বাবার মুখ পানে চায়-“এটা কেমন কথা আব্বা? আপনাকে আমি ভালোবাসি এটা প্রমানের দরকার আছে আপনের?”
সালিম সাহেব মৃদু হাসলো-“আচ্ছা বেশ। আমার জন্যই না হয় আপনি ফিরে যান। এখন আপনার এই বাবার জন্যই আপনার ওই বাসায় থাকা বেশি জরুরি। জামাই বাবা কি করতে চাইতেছে তার কিছুই বুুঝতে পারতেছি না। আপনি থাকলে আমি অন্তত কিছু খবর সবর পাবো। বুঝছেন তো কি বলতে চাইতেছি?”
শুভ্রা ঠোঁট দু’টো দাঁতে চেপে আছে-“আপনার জামাই আমাকে না নিতে আসলে আমি ওই বাসায় ফেরত যাব না আব্বা। মানসম্মান না পেলে কোথাও থাকা কষ্টকর।”
“আপনি বুঝতেছেন না আম্মা। আপনি না থাকাতে অনেক সমস্যা হইতেছে আমার। খবর পাইছি জামাই বাবা মিটিং করতেছে আমার এন্টি মানুষের লগে। কিসের মিটিং করে তা জানি নাই। আপনি কি আপনার বাপের অসম্মান দেখতে পারবেন আম্মা? আপনার জামাই আপনার বাপকে অসম্মান করতে চাইতেছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতেছি না। আপনি ওই বাড়ি ফিরে যান আম্মা। খবর সংগ্রহ করে আমাকে জানান।”
শুভ্রা বাবার কথায় নিরবে মাথা নাড়ে-“সব বুঝতেছি আব্বা তবুও সে না নিতে আসলে আমার যাওয়া সম্ভব না।”
“মাঝে মাঝে জেতার জন্য হারা লাগে আম্মা। জিদ না করে ফিরা যান।”
শুভ্রা তবুও অটল গলায় বললো-“এই কাজটা পারবোনা আব্বা। আমাকে মাফ করেন। সে না নিতে আসলে আমি কিছুতেই যাব না।”
সালিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। মেয়ের অটল মনোভাবের কারন অনুসন্ধান করছে হয়তো। ভেবে নিয়ে মুখ খুললো-“আচ্ছা বেশ, সে নিতে আসলে যাবেন তো?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। সালিম সাহেব হাসলো-“ঠিক আছে। সে নিতে আসলেই যাইয়েন। কিন্তু এইবারের মতো হুটহাট আর আসবেন এই বাড়িতে। আব্বা না বলা পর্যন্ত তার সাথে ভাব জমায় থাকার চেষ্টা করবেন। কি পারবেননা?”
শুভ্রা চকিতে বাবার দিকে তাকায়। কি বলতে চাইছে বাবা সেটা জানতে বাবার চোখে চোখ রাখে। সালিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলো-“আপনে এইটুক না করতে পারলে আপনের জামাই আপনের আব্বাকে দুনিয়ার সামনে ছোট করবে আম্মা। আমার রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দিবে নিজের স্বার্থে। আপনি কি তা সইতে পারবেন?”
শুভ্রা মাথ নাড়লো। সালিম সাহেব কন্ঠে আদ্রতা ঢেলে বললো-“আমি জানতাম পারবেন না। তাই যতদিন আমি না বলবো ততদিন আর এ বাড়ি মুখ হবেন না। কেমন? আর সব খবরাখবর আমাকে দিতে থাকবেন। ঠিক আছে?”
শুভ্রা ঘাড় হেলায়। সালিম সাহেব মুচকি হাসলো-“তাইলে চলেন এখন খেয়ে নেই। আমার খুব খিদা লাগছে আম্মা।”

রণ শুভ্রাকে নিতে এলো তারও কয়েকদিন পরে। জলি রণকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে তবুও বউ আনার কথাটা কানে তোলেনি রণ। কিন্তু শেষমেষ বাধ্য হয়ে আসতেই হলো। একটা রাস্ট্রিয় অনুষ্ঠানে স্বস্ত্রীক আমন্ত্রণ পাওয়ায় কারণে। শশুর বাড়ি আসার পথেই বুদ্ধিটা মাথায় এলো রণর। সে মিহিরকে বললো-“ফাহিমকে একটু খবর দেতো মিহির। ওর সাথে জরুরি কথা আছে আমার।”
“ও হয়তো অফিসেই আছে। ডাকলেই পাওয়া যাবে।”
বলেই মাথা চুলকায় মিহির। রণ খানিকটা অবাক হলো-“ও কি আসে নাকি অফিসে?”
মিহির ঘাড় নাড়ে-“আসে। প্রায়ই এসে বসে থাকে। বোনের খবর পাওয়ার আশায়।”
রণ হাসলো। তার ভাবনা তাহলে ঠিক দিকেই আছে। মিহিরের দিকে তাকালো সে-“ওকে কিছু কাজ দিয়ে দে। ওর ক্যাপাবিলিটি কেমন যাচাই করি। আমি ওকে কাজে লাগাতে চাই।”
“কিন্তু সালিম সাহেব জানলে?” মিহিরের কন্ঠে দ্বিধা।
“যাতে না জানে সেইরকম কাজ দে।”
রণ মিহিরের দিকে তাকায়। মিহির বুঝে গেলো রণ কি চায়। সে মৃদু হেসে মাথা দুলায়।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৭

বিয়ের পর প্রথমবারের মতো মেয়ে জামাই আসছে বলে এলাহি আয়োজন করেছে সালিম সাহেব। রণ বেশ ভদ্রভাবেই মানা করলো-“এক মগ কফি ছাড়া আমি কিছু খাবো না। সারাদিন সময় পাই না তাই রাতে মায়ের হাতের খাবার ছাড়া কিছু খাই না। আশাকরি কিছু মনে করবেন না। শুভ্রা কি তৈরী? তাহলে রাত করবোনা।”
সালিম সাহেব হইহই করে উঠলো-“এইটা কেমন কথা? জামাই প্রথমবার আসছে না খাইলে হবে?”
রণ অবিচল গলায় জবাব দিলো-“হবে। খাওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপনার মেয়েকে বলেন রেডি হতে। কালকে সকালে জরুরি মিটিং আছে তাই যত তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরবো তত ভালো। এমনিতেও অনেক রাত হয়েছে।”
সালিম সাহেব জোর করলো না-“আচ্ছা ঠিক আছে। রিমা দেখোতো শুভ্রা তৈরী কিনা?”
রিমা চলে গেলো। সালিম সাহেব রণর পাশে এসে বসলো-“আমার মেয়েটা একটু বোকা সোকা। তুমি আমার রাগ ওর উপর দেখাইও না জামাই।”
রণর মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে শান্ত রেখে বললো-“আপনার মেয়ে কি এমন কিছু বলেছে?”
সালিম সাহেব একটু ঘাবড়ে গেল-“না না, তা বলে নাই। সেইদিন হুট করে চলে আসছিস তাই ভাবলাম কিছু হইলো কিনা।”
“কিছু হলে তাকে নিতে আসতাম না কখনোই। আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আপনার রাগ তার উপর দেখাবো এমন অবিবেচক আমি না। যাইহোক, আপনি আপনার মেয়েকে ভালোমতো বুঝায় দেন সে যেন ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকে। বিয়ে করে ফেলেছি বলে আঁটকে গেছি, তার সব অন্যায় মেনে নেব এমনটাও কিন্তু ভাববেন না।”
সালিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে অপমান সহ্য করলো। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো-“তুমি বসো আমি দেখি মেয়ের কি অবস্থা।”
রণ জবাব দিলো না। মোবাইলটা হাতে নিয়েছে এমন সময় তুলতুল এলো কফির মগ নিয়ে। কোন কথা না বলে মগটা রণর হাতে দিয়ে চলে গেলো। কাপটা তুলতে যেয়ে তাড়াতাড়ি নামিয়ে রাখলো রণ। তার বুক টিপটিপ করছে। কাপের নিচে কিছু একটা দেখেছে সে। কিন্তু কিভাবে শিওর হবে? চারপাশ দেখে নিয়ে মগটা মুখের কাছে এনে সামান্য তুলে চুমুক দিলো। দ্রুত হাতে ছোট্ট কাগজটা পকেটে পুরো স্বাভাবিক ভাবে বসলো।

শুভ্রাকে বাবা মায়ের সাথে আসতে দেখা গেলো। শুভ্রার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চুলগুলো পরিপাটি করা শুভ্রার পরনে সালোয়ার কামিজ। ওড়নাটা আলতো করে মাথায় দেওয়া। রিমা মেয়ের পাশে হেঁটে আসতে আাতে বারবার চোখ মুছছে। শুভ্রার মধ্যে কোন বিকার দেখা গেলো না। রণর মনে হলো শুভ্রার মেজাজ খারাপ। সে হয়তো তার সাথে যেতে চায়নি। রণর হাসি পেলো ওকে দেখে। মনেহচ্ছে ধরে বেঁধে জেলে নেওয়া হচ্ছে ওকে। রিমা এগিয়ে এসে রণর হাত ধরলো-“বাবা, আমার মেয়েটা অবুঝ তুমি তাকো বুঝে চইলো। ভুল করলে মাফ করে দিয় বাবা। ওকে ভালোবেসে আগলায়া রাইখো।”
রণর খুকখুক করে কাশে। শুভ্রা রাগি চোখে মাকে দেখে-“মা! আর কথা নাই তোমার? আমি ছোট মানুষ না যে আমাকে অন্য কারো দেখা লাগবে। নিজেকে নিজে দেখতে পারি আমি।”
রিমা গর্জে উঠলো-“চুপ থাক বেয়াদব মেয়ে। মা তোর সাথে কথা বলতেছে? তুই কেন মাঝখানে কথা বলিস?”
শুভ্রা হতচকিত। কয়েক পলক মাকে দেখে রেগেমেগে নিচে নেমে গেলো-“আমি গেলাম যার আসা দরকার সে আসুক।”
রণর ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি। আচ্ছা সবক মিলেছে মেয়ের। খুব ফটর ফটর করে। সে রিমাকে স্বান্তনা দিলো-“আপনি ভাববেন না। আমাদের বাড়িতে ওর কোন সমস্যা হবে না আশাকরি। আসছি এখন।”

*****

পুরোটা পথ দু’জনার কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। গভীর রাত হওয়ার কারনে ওরা একঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলো বাড়িতে। জলি শুভ্রাকে দেখে অবাক হলো-“তুমি এলে শেষ পর্যন্ত? আমি তো ভেবেছি আসবে না।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। জলি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে-“এসেছ ভালো হয়েছে। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”
পাশ থেকে রণ বলে উঠলো-“আমার খিদে পেয়েছে মা। তুমি খাবার রেডি করো আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”
জলি মাথা দুলায়। রণ চলে গেলো। শুভ্রা তবুও দাঁড়িয়ে ছিল। জলি ফিসফিস করলো-“দু’জনই রাগ করে থাকলে সম্পর্ক আগাবে না। এই যে এতোদিন গিয়ে থাকলে একবারও কথা হয়েছে রণর সাথে? যেভাবে জেদ ধরে বিয়ে করেছ সেভাবেই সম্পর্কটা ঠিক করে নাও।”
শুভ্রা বোকা বোকা চাহুনিতে জলিকে দেখলো। জলি মৃদু হাসলো-“রণ এগুবে এমন আশা করো না। ও ওর বাবার মতো। খুব জেদি। তবে যদি তুমি একবার ওর মনে জায়গা করতে পারো তাহলে তোমার জন্য সব করবে। বুঝতে পেরেছ?”
এবারে খানিকটা হাসি ফুটলো শুভ্রার মুখে। সে ভেবে পেলো না এসব কথা আন্টি তাকে বলছে কেন? যেভাবে বিয়ে হয়েছে তাতে এই মানুষটার তাকে অপছন্দ করার কথা।
“মা খাবার রেডি?”
রণ বেরিয়ে এলো। জলি ছেলের দিকে তাকায়-“তুই টেবিলে বোস আমি খাবার আনছি।”
শুভ্রা একপলক দেখলো রণকে তারপর ঘরে চলে গেলো। বাবা বলেছে রণর সাথে মিলেমিশে থাকতে যাতে ওর কাজের খবর পাওয়া যায়। রণর কাজের খবর বের করতে রণর কতটা কাছাকাছি যেতে হবে সেটা খানিকটা আন্দাজ করেছে সে। আর ভেবেই অসস্তি হচ্ছে। এই লোকের সাথে দু’টো ভালো কথাই তো বলা যায় না আর তার সাথে কিনা রংঢয়ের আলাপ করতে হবে, খাতির করতে হবে? ভেবেই অসস্তি আকড়ে ধরলো শুভ্রাকে।

“সরি।”
“হ্যাহ!”
শুভ্রা চোখ গোলগাল করে তাকায়। অবিশ্বাস তার চোখের তারায়। রণ সোফায় বসলো-“এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি আপনার মতো সেলফিশ নই। নিজের ভুল মনে হলে সরি বলতে পারি। সেদিন আপনার সাথে বেশি রুড হয়েছিলাম তাই সরি বলছি। এমনটা বলা উচিত হয়নি আমার।”
শুভ্রার চোখ খুলে আসার উপক্রম হলো। মুখ হা করে আছে। এই লোক হুট করে এমন বদলে গেলো কেন? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। শুভ্রা নিজেকে সামলে নিলো-“ইটস ওকে। কিন্তু আমার কাছে আবার সরি আশা করবেন না। আপনাকে আমি কখনো মাফ করতে পারবোনা। যদি কখনো আপনার দুই মাসের কাজের জন্য সরি বলেনও তবুও পারবোনা।”
রণ গম্ভীর হলো, শুভ্রাকে দেখলো সময় নিয়ে তারপর বললো-“আমি সরি ফিল করছি না আপাতত। কখনো ফিল করলে বলবো। মাফ করা না করা আপনার উপর।”
শুভ্রা বিছানায় রণর মুখোমুখি বসলো-“আমার মতো মেয়েকে বউ হিসেবে কখনো ভাববেন অথচ তাকে বন্দী করে রেখে কাজ উদ্ধার করতে পারবেন। পুরো ব্যাপারটা কেমন কন্ট্রাডিকটরি মনেহয় না আপনার কাছে?”
রণ জবাব দিলো না। শুভ্রা হাসলো-“আচ্ছা বাদ দিন। জানি আপনার কাছে কোন জবাব হবে না। আমার কিন্তু এখনো দুটো পুরস্কার পাওনা আপনার কাছে। মনে আছে?”
“আছে। বলুন আর কি চাই?”
“আপাতত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন তাতেই চলবে।”
“কি জানতে চান?”
“ভাবির মা আর ভাইয়ের সাথে সেদিন লুকিয়ে দেখা করিয়েছিলেন। আসল ঘটনা কি বলবেন? এতো লুকোচুরির কি আছে?”
রণ নিঃশব্দে হাসলো-“বাবা মায়ের কাছে জানতে চাননি? তারা কিছু বলেনি আপনাকে?”
শুভ্রা এবার বিরক্ত হলো-“তারা বলেনি বলেই জানতে চাইছি।”
“তাহলে আমার বলা উচিত হবে না। আমি জানি আপনি যতটা না আমার বউ তার চাইতে সালিম সাহেবের কন্যা, সোহেলের বোন। যদি পুরোপুরি আমার বউ হতেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে সব ঘটনা খুলে বলতাম।”
“আমি বুঝে পাচ্ছি না কি এমন ঘটনা যে এতো লুকোচুরি করতে হবে?”
“সেটা তো আপনার বাড়ির লোক ভালো বলতে পারবে।”
রণ সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। তার চোখেমুখে কৌতুক। এমন ভাব যেন খুব মজা পাচ্ছে শুভ্রার প্রশ্নে। শুভ্রার কন্ঠে অভিমান জমলো-“আপনি কথা দিয়েছিলেন যা চাইবো তাই দেবেন। এখন কথা রাখছেন না।”
“অন্য কিছু বলুন অবশ্যই দেব।”
“আর কিছু চাই না আমার।”
“বেশ। এবার তাহলে আমার একটা চাওয়া পূরণ করুন। কাল একজন মন্ত্রী কন্যার বিয়ের দাওয়াত আছে সেখানে যাবেন আমার সাথে।”
শুভ্রা অপলক নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো-“এইজন্যই স্বপ্রনোদিত হয়ে আমাকে নিয়ে এলেন?”
“না, ঠিক সেজন্যও না। আসলে আপনাকে মিস করছিলাম। ঝগড়া করতে না পেরে জীবনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো।”
রণ হাসছে মুচকি মুচকি। শুভ্রার হার্টবিট মিস হলো একটা। সে কন্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বললো-“মিথ্যে বলছেন!”
রণ উঠে দাঁড়ায়, হেঁটে এসে বিছানায় শুভ্রার উল্টো প্রান্তে শুয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো-“জানেন যেহেতু প্রশ্ন করা বোকামি। শুয়ে পড়ছি, কাল আমার অনেক কাজ। বাতিটা নিভিয়ে দেবেন।”
শুভ্রা অনেকটা সময় রণর পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা আজ একের পর এক ঝাটকা দিলো তাকে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে বোঝা মুশকিল। শুভ্রা উঠে রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে রণর পাশে শুলো। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ হতাশ লাগছিল। এখন মনেহচ্ছে, জীবনটা খুব একটা খারাপও না।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে