দর্পহরন পর্ব-২২+২৩+২৪

0
410

#দর্পহরন
#পর্ব-২২

ঢাকার অনুষ্ঠানে সত্যি সত্যি শুভ্রা ভদ্র বউ হয়ে রইলো। পুরো অনুষ্ঠানে হাসি মুখে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো, ছবি তুললো। প্রচুর প্রচুর ছবি তোলা হলো ওদের। বেশিরভাগই গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে গ্রুপ ছবি। অনেকের অনুরোধে কাপল ছবিও তোলা হলো কয়েকটা যাতে রণ আর শুভ্রা দুজনাই ভীষণ আনইজি ফইল করলো। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান শেষ হয়ে পরদিন নির্বাচনী এলাকায় চলে গেলো ওরা। এবারই প্রথম পুরো পরিবার নিয়ে এলাকায় এলো রণ। হাসিখুশি মা সবাই এসেছে। এলাকার সবাই দাওয়াত পেয়েছে। রাতে অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখতে নেমেছিলো রণ এমন সময় মিহির এলো একজনকে নিয়ে-“ভাই, ও ফাহিম। আপনার সাথে কথা বলতে আসছে।”
ফাহিম সালাম দিলো। রণ উত্তর দিয়ে আন্তরিক হেসে জানতে চাইলো-“ফাহিম, কি বিষয়ে কথা বলবে?”
“ভাইয়া, একটু আলাদা কথা বলা যাবে? বিষয়টা ব্যক্তিগত।”
রণ মিহিরের দিকে তাকালে সে আশ্বস্ত করলো। রণ ফাহিমকে নিয়ে উপরে উঠে এলো। নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরে ঘুরে গেট আঁটকে বসলো। ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো-“এবার বলো কি বলবে? তার আগে বলো তুমি কে?”
ফাহিমের চেহারা গম্ভীর হলো-“আমি তুলতুলের ভাই। সালিম সাহেব মানে আপনার শশুরের বড় ছেলে সোহেল আমার বড় বোনকে তুলে এনে শ্লীলতাহানি করেছিল। পরে বাধ্য হয়ে বিয়ের নাটক করেছে।”
শুনতে শুনতে রণর চেহারায় অসন্তোষ ফুটে উঠলো-“তুমি আমার কাছে কেন এসেছ ফাহিম?”
ফাহিম কেমন যেন বাঁকা হাসলো-“আপনি এই এলাকার নতুন এমপি, মন্ত্রীও হয়েছেন। সালিম সাহেবকে সরিয়ে যখন আপনি এলেন ভেবেছিলাম এবার বুঝি আমরা এই দানবের হাত থেকে রক্ষা পাবো। এটাও ভেবেছি আপনার কাছে এসে আমার বোনের ব্যাপারে সাহায্য চাইবো। কিন্তু তারপরে শুনলাম আপনি নিজেই এখন সালিম সাহেবের একমাত্র মেয়ের জামাই।”
রণ হেসে দিলো-“সব জানার পরও এলে কেন তবে?”
ফাহিমের চোখ ছলছল হলো-“আপুকে শেষ দেখেছি তিনমাস আগে। নামের বিয়ে হয়েছে ওই বদমাশটার সাথে কিন্তু ওই জেলখানা থেকে ছাড়া পায়নি আমার বোন। ফোন নেই ওর কাছে, মাঝে মাঝে ও নিজ থেকে অন্য কারো ফোন থেকে কথা বলে। এছাড়া কারো সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেয় না। আমার মা তার মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। আপনার কাছে একটা অনুরোধ করি, প্লিজ আমার বোনটাকে একবার দেখার ব্যবস্থা করে দিন। কোনভাবে একবার বোনটাকে এই অনুষ্ঠানে আনতে পারলে আমরা একটু কাছ থেকে বোনটাকে দেখতাম। ও কেমন আছে জানতে পারতাম। প্লিজ স্যার, একটু দয়া করেন আমার মায়ের উপর। আপনার তো নিকট আত্মীয় হয় ওরা আসতে বললে নিশ্চয়ই মানা করবে না?”
ফাহিম হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দুটো ভেঁজা-“বোনটা কেমন করে বেঁচে আছে সেটা একটু নিজ চোখে দেখতাম স্যার। অনেক আদরের বোন আমার। কত ভালো ছাত্রী ছিলো। অনার্সে ফার্ ক্লাস পেয়েছে। সেই মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ। কি থেকে কি হয়ে গেলো স্যার। একটু দেখা করিয়ে দিন না স্যার। আমার মা অনেক অসুস্থ, হয়তো বাঁচবে না বেশিদিন।”
রণ হতভম্ব হয়ে গেলো। পুরো ঘটনা বুঝো উঠতে যা সময় লাগলো। সে ফাহিমের হাত ধরে বসিয়ে দিলো। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই হু হু করে কাঁদলো-“ভাইয়া, বেশি কিছু না একটাবার শুধু বোনটাকে দেখতে চাই।”
রণর চোয়াল শক্ত হয়, হাত মুঠো করে ধরে। সালিমের নিষ্ঠুরতার আর কতো গল্প শুনবে? একটা মানুষ কি করে এতটা জঘন্য হয়? রণ ফাহিমকে ভরসা দিলো-“তুমি কাল তোমার মাকে নিয়ে এসো ফাহিম। আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমরা তোমার বোনের সাথে দেখা এবং কথা দু’টোই বলতে পারবে।”
ফাহিমের চোখ চকচক করে উঠলো-“সত্যি ভাইয়া?”
রণ মাথা নাড়লো-“সত্যি। আমি এখনো মিথ্যে বলতে শিখিনি ফাহিম। ভরসা করতে পারো আমাকে। এখন যাও, কাল সময়মতো চলে এসো।”

ফাহিমকে বিদায় দিয়ে চিন্তিত মুখায়বর নিয়ে বসে ছিলো রণ। মিহির এগিয়ে এলো-“ভাই, ফাহিম কি বললো?”
রণ হাসলো-“তুই তো জেনেশুনেই ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিস মিহির। আমি কিছু জানি না ভেবেছিস?”
মিহির আলতো হাসলো-“ছেলেটা অনেক কান্দে ভাই। মায়া লাগে দেখে।”
“ভালো কাজ করেছিস মিহির। এতোদিনে মনেহচ্ছে সালিম সাহেবের মেয়ে বিয়ে করে একটা কাজের কাজ করেছি।”
রণকে মুচকি হাসতে দেখে মিহির অবাক হলো-“আপনে কি করতে চান ভাই?”
“কি করবো তা তো জানি না। তবে কালকের অনুষ্ঠানে মেয়েটা থাকবে এটা জানি।”
বলেই উঠে গেলো রণ।

শুভ্রা হাসিখুশির সাথে বসে গল্প করছিল। রণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো ভেতরে যাবে কিনা। অনেকক্ষণ পরে হাসিখুশির নজর পড়লো ওর উপর-“আরে ভাইয়া, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো ভেতরে এসো। আমরা শাহরুখ খানের মুভি দেখছি। দিলওয়ালে দুলহানিয়া।”
ঘরে ঢুকে হাসি মাথায় গাট্টা মারে রণ-“আর কতোবার দেখবি? তিরিশ বারের বেশি দেখে ফেলেছিস।”
“রাজের মতো একজনকে না পাওয়া পর্যন্ত দেখতে থাকবো ভাইয়া।”
খুশি নিচু স্বরে কথাটা বলেই দাঁতে জিভ কাটে। রণ হো হো করে হাসলো-“ইউনিভার্সিটিতে টপার না হলে তোদের দুটোকেই রিকশাওয়ালা ধরে বিয়ে দেব। বুঝতে পেরেছিস? কাজেই বিয়ের ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ালেখায় মন দে। আর আপনি একটু আসুন তো। কথা আছে।”
শুভ্রা হা করে তাকিয়ে আছে রণর মুখপানে-“জ্বি! আমি?”
রণ গম্ভীর হলো-“তো আর কে? জরুরি কথা আছে তাড়াতাড়ি আসুন।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাসিখুশি মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রা তবুও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। এই লোকের হুট করে কি হলো? তাকে কেন ডাকছে? শুভ্রাকে বসে থাকতে দেখে হাসিখুশি ওকে তাড়া দিলো-“ভাবি, বসে আছো কেন? ভাইয়া ডাকলোনা তোমাকে? যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।”
শুভ্রা গুটিগুটি পায়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত কামরায় এলো। রণ তখনও দাঁড়িয়ে। তার মনে নানারকম ভাবনা। কিভাবে কি বলবে শুভ্রাকে তাই ভাবছে।
শুভ্রা ডাকলো-“বলুন কি জন্য ডেকেছেন আমাকে?”
রণ শুভ্রাকে দেখলো এক নজর। ঢোলাঢালা গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে আছে। গলায় একটা ওড়না ঝুলছে। রণ ধীরস্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“যে ভাইকে ছাড়াতে এতো হম্বিতম্বি করলেন সে তো গতকালের অনুষ্ঠানে এলো না। না সে এলো না তার বউ এলো। কেমন ধারা ভাই ভাবি আপনার, একটুও কৃতজ্ঞতা নেই বোন কিংবা বোনজামাই এর প্রতি?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো। রণর কোন পরিকল্পনা আছে কিনা আন্দাজ করতে চাইছে সে। রণকে স্বাভাবিক দেখালো। শুভ্রা ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো-“আপনি তো চাইছিলেন ওরা না আসুক। এখন হঠাৎ করে ওদের নিয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেন?”
“ইন্টারেস্ট এর কি আছে? একটা ভাই বিবাহিত তার মানে তার বউ আছে। কিন্তু সেই বউকে কোথাও দেখতে পেলাম না। না বিয়ের দিন আপনাদের বাসায় না গতদিনের অনুষ্ঠানে। আজব একটা পরিবার।”
রণর কথাগুলো সত্যি বলেই শুভ্রা চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নগুলো শুভ্রাও করেছিল ওর মাকে। মা বলেছে অনুষ্ঠান হয়নি তাই বউকে কারো সামনে নেই না। তোর অনুষ্ঠান হলো এরকম দেখি সোহেলের বিয়ে উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করবো। বউকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তারপর বউকে সব জায়গায় নেওয়া যাবে শুভ্রাকে চুপ থাকতে দেখে রণ খোঁচায়-“কি এখন কথা নেই কেন মুখে?”
শুভ্রা ভ্রু কুঁচকে বললো-“ভাবছি হুট করে আমার ভাইয়ের জন্য এতো দরদী হয়ে উঠলেন কেন? কি প্ল্যান আপনার বলুন তো?”
রণ হেসে দিলো-“কি প্ল্যান থাকতে পারে বলে মনেহয় আপনার? আমার সম্বন্ধী আছে সে বলে আবার বিবাহিত। তো তাদের কারো সাথেই তো পরিচয় হলো না আমার। তাই বলছিলাম আর কি। আচ্ছা বাদ দিন। না আসলে নেই।”
শুভ্রা তখনো সন্দিহান-“আপনি চাইছেন ওরা আসুক?”
রণ অবাক হওয়ার ভান করলো-“আমি কেন চাইবো? লোকে কানাকানি করে সেটাই বলেছি।”
“লোকের কানাকানি আপনি পাত্তা দেন! আমার কেন যেন মনেহচ্ছে আপনি চান ভাইয়া আর ভাবি আসুক। ভাইয়াকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোন প্ল্যান আছে আপনার।”
রণ বিমোহিত হাসি দিলো-“কোন প্ল্যান নেই। শুনুন, আমি ভুলে আপনার ভাইয়ের কথা বলে ফেলেছি। তার এখানে আসার দরকার নেই। একজন অপরাধী আমার কোন অনুষ্ঠানে না আসাই ভালো।”
শুভ্রা রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“খবরদার ভাইয়াকে অপরাধী বলবেন না। তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমান হয়েছে কি? তাহলে সে কিভাবে অপরাধী হয়? কালকে আসতে বলবো ভাইয়াকে। সে অবশ্যই আসবে।”
“আপনি বললেন আর আপনার ভাই নাচতে নাচতে চলে আসবে এটা বিশ্বাস করতে বলছেন আমাকে? এতোই যদি ভালোবাসতো আপনাকে তাহলে কাল ঠিকই আসতো। আপনি তো তাকে ছাড়াতেই আমাকে বিয়ে করেছিলেন। আর সে কিনা আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানে এলো না। ওসব দেখা আছে আমার।”
শুভ্রা নিচু স্বরে গর্জন করে উঠলো-“সে অবশ্যই আসবে। তার বউকে নিয়েই আসবে। দেখবেন কাল।”
রণ অটল কন্ঠে বলে উঠলো-“কোনদিন আসবে না। আপনিও দেখে নেবেন।”
“ভাইয়া যদি ভাবীকে নিয়ে আসে তাহলে কি করবেন আপনি?”
রণ মুচকি হাসলো-“আসবেই না। তবুও যদি এসে যায় তাহলে আপনি যা বলবেন তাই করবো।”
শুভ্রার চেহারায় ক্রুর হাসি খেলে গেলো-“আর ইউ শিওর?”
“আমি কথা দিয়ে কথা রাখি এটা নিশ্চয়ই নতুন করে প্রমান করতে হবে না?”
রণর কথায় শুভ্রা দাঁত বের দিলখোলা হাসি দিলো-“ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইলো। ভাইয়া যদি ভাবিকে নিয়ে আসে তাহলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে আপনাকে। ডান?”
“ডান।” শুভ্রার চোখে চোখ রেখে জবাব দিলো রণ।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৩

“তন্ময় ভাইয়া! তুমি! কবে এসেছো? কেউ বলেনি তো আমাকে?”
শুভ্রা বাচ্চাদের মতো আহলাদ করছে। দেখে গা জ্বলে গেলো রণর। সে ভদ্রতা করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো শুভ্রার পাশে। তন্ময় নামের ছেলেটা এগিয়ে এসে শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে-“শুধু আমি না মাও এসেছে শুভ্রা। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি।”
“সত্যি! চাচীও এসেছে?”
“হুমম, সত্যি। ওই যে দেখ।”
তন্ময় পেছনে ইশারা করতেই দেখা গেলো ওদের। পুরো ইব্রাহিম পরিবারকে। সবাইকে দেখে হাত নাড়িয়ে শুভ্রা রণর কানে ফিসফিস করলো-“ভাইয়া এসেছে ভাবীকে নিয়ে। আপনি আপনার চ্যালেন্জ হেরে গেলেন এবার শাস্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।”
রণও পাল্টা হাসি দিলো-“সব শাস্তি মাথা পেতে নেব। তার আগে আরও একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।”
শুভ্রা অবাক হলো-“আবারও? শাস্তি কিন্তু ডবল হবে বলে দিচ্ছি।”
রণ মৃদু হেসে মাথা দুলায়-“হোক। এখন দয়া করে মহিলাদের নিয়ে নিজের কামরায় গিয়ে বসুন। ওখানেই খাবার দিন। এখানে সব রাজনৈতিক নেতাকর্মী আছে। কাজেই এখানে আপনার না থাকলেও চলবে।”
শুভ্রা ভয় পাওয়া গলায় বললো-“আপনি কি করবেন ওদের? আব্বাকে আবার কিছু বলবেন নাতো?”
রণ হেসে দিলো-“আমি কি করবো? আমাকে দেখে কি মারপিট করা গু*ন্ডা কিংবা মানুষ খু*ন করা খু*নী মনেহয়?”
শুভ্রা শীতল কন্ঠে বললো-“আপনাকে বিশ্বাস নেই। সব করতে পারেন আপনি।”
রণ আশ্বাস দিলো-“ভয় নেই আজ কিছু করবো না।”
শুভ্রা ভরসা পেলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে মহিলাদের সাথে নিয়ে সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। যাওয়ার আগে তন্ময়ের সাথে রণর পরিচয় করিয়ে দিতে ভুললো না। রণ তন্ময়কে সাথে নিয়ে সালিম সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলো। মুখে হাসি ঝুলিয়ে সোহেলের সাথে হ্যান্ডসেক করলো। শরীফ আর তাহের আগে থেকে আন্তরিক রণের প্রতি এটা ওদের আচরণে বোঝা হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে দক্ষিণ দিকের প্যান্ডেলে দিকে গেলো রণ। ওখানেই এলাকার গন্যমান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের বসানো হয়েছে। এলাকার অনুষ্ঠান বলেই আয়োজনটা বাড়ির সামনের ফাঁকা মাঠে করা হয়েছে। এলাকার লোকজন আর তৃনমুল পর্যায়ের নেতা কর্মীদের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এই অনুষ্ঠান করা। রণ চায় সকলের সাথে তার সম্পর্কটা সহজ হোক। কতটুকু সফল হবে সেটা সময় বলবে।

মিনু আর রিমা জলির সাথে গল্প করছে তার কামরায়। তুলতুল এ ঘরে একা বসে আছে। শুভ্রা খাবারের প্লেট তুলতুলের দিকে এগিয়ে দিলো-“এমন চুপচাপ বসে আছো কেন ভাবি? কি হয়েছে?”
তুলতুল চমকে গেলো ভীষণভাবে। সে মিনমিন করলো-“কিছু না আপা। এমনিতেই।”
শুভ্রা খানিকটা অবাক হলো। তুলতুল মাথা তুলেও তাকাচ্ছে না পাছে শুভ্রা সব বুঝে যায় এই ভয়ে। শুভ্রা কাছে এসে বসলো। তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-“ভাবি, তোমার মুখে কি হয়েছে? কেমন যেন লাগছে দেখতে? আর বোরকা পরেছ কেন? ভাইয়া মানা করেনি?”
তুলতুলের হাত কেঁপে উঠলো। সে ব্যস্ততার ভান করে জোর করে পোলাও মেখে মুখে তুললো-“কি হবে আপা কিছু হয়নি।”
শুভ্রা তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-“কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে। কি হয়েছে সেটাই ধরতে পারছি না।”
তুলতুল এবার হাসার চেষ্টা করলো-“আরে আপা কিছু হয়নি বললাম তো। এখন কি শান্তিমতো খেতে দেবে? নয়তো খাবার রেখে দিচ্ছি।”
শুভ্রা তুলতুলকে আঁটকায়-“না না তুমি খাও ভাবি। আমি পানি নিয়ে আসছি দাঁড়াও।”
শুভ্রা ঘর থেকে বের হবে এমন সময় রণ এসে দাঁড়াল-“আসবো?”
শুভ্রা তাকায়-“হ্যা আসুন।”
রণ রুমে ঢুকে কোন ভনিতা না করে তুলতুলকে ডাকলো-“তুলতুল তুমি প্লিজ আমার সাথে এসো। তোমার মা আর ভাই অপেক্ষা করছে। তারা তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”
তুলতুল হতবাক হয়ে রণর দিকে তাকায়। অবিশ্বাসী গলায় বললো-“কি বলছেন এসব? আমার মা আর ভাই কেন এখানে আসবে?”
রণ আবারও মৃদুস্বরে বলে উঠলো-“দেরি করো না তুলতুল। তোমার হাতে সময় খুব কম। কেউ টের পাওয়ার আগেই ফিরে আসতে হবে এখানে।”
তুলতুল হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তার শরীর কাঁপছে ভীষণ ভাবে। সে কি করবো বুঝতে পারছে না। রণ তাড়া দিলো-“হাতটা ধুয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
তুলতুল যন্ত্রচালিত মানুষের মতো এগিয়ে গেলো। শুভ্রা কিছু বুঝতে পারছে না। সে পালাক্রমে তুলতুল আর রণকে দেখছে। এতোটা অবাক সে তার জীবনে হয়নি। বোকার মতো দু’জনার দিকে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো-“আপনি কি করছেন আমি বুঝতে পারছি না। ভাবিকে চেনেন আপনি?”
রণ শুভ্রার চোখে চোখ রেখে হাসার চেষ্টা করলো-“না চিনি না। আজই প্রথম দেখলাম। আর প্লিজ বোঝার চেষ্টাও করবেন না আমি কি করছি। শুধু একটা অনুরোধ আপনার চাচী আর মাকে ব্যস্ত রাখবেন দশ পনেরো মিনিট আপনার ভাবীর ফিরে আসা পর্যন্ত। পারবেন তো?”
শুভ্রা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো-“আর এমনটা আমি কেন করবো? আমার কি ঠেকা আপনাকে হেল্প করতে?”
রণ হাসি থামিয়ে বললো-“আমার জন্য করার দরকার নেই আপনার ভাবির জন্য করবেন। প্লিজ এখন প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করবেন না। ফ্রি টাইমে এসব নিয়ে ঝগড়া করার প্রচুর সময় পাবেন।”
“কিন্তু কি করতে চাইছেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এতো লুকোচুরির কি আছে এখানে? মা জানলে কি হবে?”
রণ ঠোঁটে হাত দিলো ইশারা করলো-“শশশ, আস্তে কথা বলুন। জানলে কি হবে সেটা এই মুহুর্তে না জানলেও হবে। প্লিজ দয়া করে পনেরোটা মিনিট নিজের মগজ চালানো বন্ধ করুন। আই রিকোয়েস্ট।”
শুভ্রা রাগ করে দু’ঠোঁট চেপে ধরে রাখলো। পরক্ষণেই জবাব দিলো-“তিনটে কাজ হয়ে যাচ্ছে। সবই বকেয়া রয়ে যাচ্ছে কিন্তু?”
শুভ্রার বোকা বোকা কথায় রণ হেসে দিলো-“যা খুশি চেয়ে নেবেন। আপাতত হেল্প করুন। প্লিজ!”
রণর কড়োজোরে মিনতি দেখে শুভ্রা চুপ করে গেলো। তুলতুল বেরিয়ে আসতেই রণ আশেপাশে তাকিয়ে তুলতুলকে তার পিছু আসার ইঙ্গিত দিলো।

“মা! ভাইয়া! তোমরা এখানে?”
তুলতুল এক ছুটে যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।তহুরা মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে হুহু করে কেঁদে দিলেন। ফাহিমও বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। সে মা বোনকে জড়িয়ে ধরে আছে। এরকম একটা দৃশ্য দেখে রণর চোখেও জল এলো। সে হাত দিয়ে চোখের কোলটা মুছে নিলো আলতো হাতে। তহুরা তুলতুলের মুখে হাজারটা চুমু খেলো-“তুলতুল, কেমন আছিস মা? ওরা তোকে মারে? অনেক অত্যাচার করে তাই না? কত শুকিয়ে গেছে আমার মেয়েটা।”
তুলতুল মাথা নাড়লো-“না মা মারে না। কিছুই বলে না।”
ফাহিম কান্না থামিয়ে বোনের দিকে স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকায়-“সত্যি আপা? তোমাকে বোরখা পড়াইছে কেন?”
তুলতুল মিথ্যে বললো-“আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় নাই এইজন্য। অনুষ্ঠানের আগে মুখ দেখানো মানা। তোমরা ভাইবো না আমি ভালো আছি মা।”
বলতে বলতে কাঁদে তুলতুল-“কতদিন পর তোমাদের দেখলাম মা। আমার কি যে ভালো লাগতেছে। এখন আমি মরে গেলেও আফসোস থাকবে না।”
তহুরা অস্থির হয়ে গেলো তুলতুলের কথা শুনে। পাগলের মতো বারবার বলতে লাগলো-“ও তুলতুল, তুই মরার কথা কেন বললি? মরবি কেন তুই? ওরা তোকে কি বলছে? তুলতুলরে বল তাড়াতাড়ি। থাক তুই আর যাইস না ওইখানে। চল আমাদের সাথে। তোকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব।”
তুলতুল মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মায়ের গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে রেখে বলে-“কোথায় যাব মা? বাংলাদেশের কোন কোনায় পালিয়ে বাঁচবো না। আমি তো এখন বেঁচে আছি, ভালো আছি। তোমরা আমাকে নিয়ে ভেবোনা। ভাইয়া, মায়ের খেয়াল রাখবা। কত্ত শুকায় গেছে আমার মা।”
তিনজনেরই চোখ ভেজা। রণ ঘড়ি দেখলো-“তুলতুল যেতে হবে।”
তহুরা যাওয়ার কথা শুনেই তুলতুলকে বুকের সাথে জাপ্টে ধরলো-“ও বাবা, তুমি তো এখন মন্ত্রী হইছো। আমার মেয়েটাকে আমার বুকে ফিরায় দিতে পারবা না? আমি স্বামীহারা মহিলা অনেক কষ্ট করে এই ছেলেমেয়ে দুইটাকে মানুষ করছি। আমার বুকের ধনকে আমার বুকে ফিরায় দাও না বাবা। আর কিছু চাই না বাবা, আমাদের আর কিছু চাওয়ার নাই।”
রণ মনকে কঠোর করে এগিয়ে এসে তহুরার সামনে বসলো-“খালা, বাবা ডেকেছেন তো? আপনার মেয়ে আপনার বুকে ফিরবে। তবে আজকে না খালা। আমি কথা দিচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব। ভরসা রাখেন আমার উপর।”
তারপর তুলতুলের দিকে তাকালো-“তুলতুল বোন আমার চলে তাড়াতাড়ি। ওরা সন্দেহ করুক এমনটা চাই না।”
তুলতুল অনেক কষ্টে নিজেকে তহুরার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রণ ফাহিমের দিকে তাকায়-“তোমরা এখানেই থাকো আমি না বলা পর্যন্ত বেরুবে না।”
ফাহিম মাথা দুলায়। রণ তুলতুলকে দোতলায় যাওয়ার ইশারা করে নিচে নেমে গেলো।

অনুষ্ঠান চুকে যাওয়ার পর রাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল রণ। তখনই মোবাইলে ম্যাসেজ এলো। ঘুমঘুম চোখে ম্যাসেজ খুলে দেখলো লেখা আছে-“আপনি কেথায়? রুমে আসুন এখনি।”
অবাক রণ ভাবছে সালিম সাহেবের মেয়ের আবার হলোটা কি? সে নিজ থেকে রণকে ম্যাসেজ করেছে? ক্লান্ত শরীর নড়তে চাইছে না বুঝতে পেরে রণ পাল্টা ম্যাসেজ পাঠালো-“তিনতলায় আছি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। পরে আসলে হয় না?”
শুভ্রা এবার ফোনই দিয়ে বসলো-“না হয় না। আপনার সাথে কি শর্ত ছিলো মনে নেই? এখনি আসুন। আমি ওয়েট করছি।”
অগত্যা বাধ্য হয়ে রণ উঠলো। স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে ধীর পায়ে দোতলায় নেমে এলো। শুভ্রার রুমের দরজায় টোকা দিলো-“আসবো।”
“হ্যা, আসুন।”
রণ দরজা ঠেলে ঢুকলো। শুভ্রা বিছানায় বসে আছে। তার সামনে একটা কাঁচের বল ভর্তি কাঁচামরিচ। রণকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো শুভ্রা-“তিন তিনটে কাজের পুরস্কার বাকি দেখে আমার ধৈর্য্য হচ্ছে না। জানেন তো, বাকীর কাজ ফাঁকি। তাই ভাবলাম একটা কাজের পেমেন্ট অন্তত নিয়ে রাখা দরকার। তাই না?”
রণ জবাব দিলো না। সে ভাবছে শুভ্রা কি করতে চাইছে আসলে? রণর ভাবনা বুঝেই মেয়েটা মুচকি হাসলো। গলায় মধু ঢেলে শুধালো-“আরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন এখানে আমার সামনে বসুন। আপনার প্রথম কাজের পেমেন্ট হিসেবে এই কাঁচামরিচ গুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ।”
রণ সাথে সাথে বুঝে গেলো শুভ্রার প্রতিশোন পরায়ন মনের ভাবনা। সে বেশ জোরেই হেসে উঠলো-“প্রতিশোধ নিতে চাইছেন?”
শুভ্রার মুখের হাসি গায়েব। সে গম্ভীর মুখ করে বললো-“নেওয়া উচিত না? আমার আর আপনার মধ্যে হিসেবের সমতা আসেনি এখনো। যতদিন সমতা না আসবে ততদিন আমরা প্রতিদ্বন্দি হয়ে থাকবো, স্বামী স্ত্রী হয়ে উঠতে পারবোনা।”
রণ বিরবির করলো-“স্বামী স্ত্রী হতে চাইছে কে?”
শুভ্রা না বুঝে তাকালো-“কিছু বলছেন?”
“না মানে বলছিলাম যে আমাকে সাজা দেওয়ার জন্যই আপনি ও বাড়ি গেলেন না?”
শুভ্রা রণর দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কি কথার খেলা খেলে তার খেলা পন্ড করতে চাইছে?
“না কাজের পুরস্কার নেব তাই যাইনি। সব পুরস্কার বাকী রেখে দেওয়া রিস্ক। দেখা যাবে পরে বললেন কিসের পুরস্কার। আমি বাপু কোন রিস্ক নিতে চাই না।”
“তা আর কি কি করতে হবে এরপর? বুঝতে পারছি দুইমাসের শোধ নেবেন। একেবারে বলে দিলেই ভালো হয়।”
শুভ্রার চোখ জুড়ে ক্রুর হাসি-“আগে বললে মজা আছে? শুনুন আর কথা বলবেন না। খেতে শুরু করুন তো।”
“ইয়ে মানে এতগুলো মরিচ খেতে হবে সত্যিই? কাল কিন্তু বাইরে বাইরে থাকতে হবে আমাকে। পেট খারাপ হলে ভীষণ বিপদে পড়বো।”
রণ মুখেচোখ কাচুমাচু করলো। শুভ্রা অবশ্য তাতে একটুও গললো না-“জ্বি হা। পুরো বাটি শেষ করবেন আমার সামনে বসে।”
রণ ঢোক গিললো। শুভ্রা মনে মনে খুব করে হাসলো। অন্যকে সাজা দিতে গেলে মজা লাগে। আর সেই সাজা যখন নিজের উপর এসে পড়ে তখন কেমন কঠিন লাগে এবার বোঝো মিস্টার রণ। তাছাড়া এটা তো কেবল শুরু। সামনে আরও কত কিছু করা হবে তোমার সাথে তখন কি করবে বাছাধন?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৪

“তোর ভাই আর মায়ের সাথে দেখা হইছে?”
সোহেলের কথায় তুলতুল আমুলে কেঁপে উঠলো। সোহেল জানলো কিভাবে? সে চকিতে ভয়ে ভীত নয়নে সোহেলের দিকে তাকায়। সোহেলের মুখ জুড়ে হাসি, চোখে ক্রুরতা-“কি ভাবছিলি জানুম না? মা ভাইকে সাথে নিয়া আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবি আর আমি জানুম না?”
তুলতুল আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলো-“কি বলতেছেন এইসব?”
সোহেল খাট থেকে উঠে এলো-“মিছা কতা কইছি? ভাই আর মায়ের লগে দেখা করছ নাই? ক?”
তুলতুল বুঝলো মানা করে লাভ নেই কোন। সে মাথা দুলালো-“আমি তো জানতাম না ওইখানে মা আর ভাই আসবে। দুলাভাই দাওয়াত দিছে তাই আসছে। এইখানে আমার কি দোষ? আর সত্যি বলতেছি কোন ষড়যন্ত্র করি নাই। আপনি তো আমার স্বামী, স্বামীকে নিয়ে কি ষড়যন্ত্র করবো?”
সোহেল মুচকি হেসে তুলতুলের দিকে এগিয়ে যেতেই তুলতুল পিছাতে শুরু করে। শেষ মেষ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে বুঝলো আর পেছানোর সুযোগ নেই। সোহেল ওর দুপাশে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায়-“তুই তো আমাকে স্বামী মানোস না।”
“আপনিও তো আমাকে বউ মানেন না।”
তুলতুলের উত্তর শুনে সোহেল হাসলো-“খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বাইর হইতেছে তোর মুখ দিয়া। একদিন দেখা কইরাই এতো সাহস? তোর ভাইটা তোরে এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে চায় তাই না?”
তুলতুল দ্রুত মাথা নাড়লো-“কেউ কিছু চায় না।”
সোহেলের মুখ থেকে হাসি গায়েব হলো-“যেইদিন বুঝমু একটু উল্টা পাল্টা করার চেষ্টা করতেছোস সেইদিন তোর ভাইরে শেষ করুম আগে তারপর তোরে। আমাকে তো চিনছোস এতোদিনে, নাকি? যা কই তার নড়চড় হয় না বুঝছোস তো?”
তুলতুলের শরীর কাঁপছে, গলা শুকনো। সে ঢোক গিলে নিল-“আপনে ভুল বুঝতেছেন। আমাদের মধ্যে আমার ভাইকে টাইতেছেন কেন? ওর কোন দোষ নাই। ও কিছু জানে না। সত্যি বলতেছি।”
“আমি ঠিক বুঝতেছি। এতো বোকা ভাইবো না আমারে চান্দু।”
তুলতুলের হঠাৎ কি হলো জানেনা সে সোহেলকে জড়িয়ে ধরলো-“আমার সাথে সবসময় এইরকম কু*ত্তার মতো ব্যবহার করেন কেন? কিসের এতো রাগ আমার উপর?”
সোহেল থতমত খেয়ে গেলো। বোকার মতো তুলতুলকে দেখছে। তার চোখ দুটোতে বিস্ময়। তুলতুলের এমন আচমকা পরিবর্তন সে গিলতে পারছে না। তুলতুলকে নিজের থেকে ছাড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তুলতুল সোহেলের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করলো-“কি চান আপনি? আমি নিজ থেকে আপনার কাছে আসি? মেয়ে মানুষকে এইরকম ছে ছে করলে তারা নিজ থেকে কাছে আসে না জানেন না। মেয়েদের কাছে চাইলে তাদের আদর সোহাগের সাথে নরম গলায় ডাকবেন, দেখবেন আপনার জন্য জা*ন দিব।”
সোহেল হতবিহ্বল, কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। সে দু’হাতে তুলতুলকে দূরে ঠেলে দেয়-“এই যা সর এইখান থিকা। নতুন নাটক লাগাইছে। এইগুলা কইরা সত্য লুকানো যাইবো না বুঝছোস?”
তুলতুল অভিমানী কন্ঠে মৃদুস্বরে অভিযোগ জানায়-“ভালো করলেও দোষ খারাপ করলেও দোষ। কি যে চায় মানুষ।”
সোহেল সন্দিহান নজরে তাকিয়ে দেখলো তুলতুলকে তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তুলতুলের আচরণ সন্দেহজনক, নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে তার। এদিকে সোহেল বেরিয়ে যাওয়ার পরই তুলতুল মুখ গম্ভীর করলো। মনে মনে বিশ্রী করেকটা গালি দিলো সোহেলকে। গা ঝাড়া দিলো কয়েকবার। সোহেলের কাছাকাছি আসলেই গা ঘিনঘিন করে তুলতুলের। কিন্তু সোহেল কি করে জানলো ওর মা ভাইয়ের কথা? দুলাভাইকে জানাতে হবে কথাটা।

★★★

সারারাত মুখ আর বুকের জ্বলুনিতে তরপেছে রণ। চোখ থেকে ঘুম গায়েব হয়েছে। প্রচন্ড কষ্টে পায়চারি চলছে অবিরত। ভোর থেকে শুরু হলো পেটের গন্ডগোল আর বমি। আজ বিশেষ মিটিং আছে এলাকার জনগণের সাথে কিন্তু মনেহয় না মিটিং এ যেতে পারবে। বাথরুমে দৌড়াতে দৌড়াতে গায়ে জ্বর চলে এলো রণর। বমি আর বাথরুমের চাপে সকাল দশটা নাগাত নিস্তেজ হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো রণ। মিহির রণকে ডাকতে এসে ওর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে বাধ্য হয়ে দোতলা থেকে জলিকে ডেকে নিয়ে গেলো, ডাক্তারকে খবর দিলো। রণকে দেখে হাউমাউ করে উঠলো জলি। একবেলার মধ্যে মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। জ্বর আর পেটের ব্যাথায় কিছুক্ষণ পর পর আর্তনাদ করে উঠছে। রণ বড়ই শক্ত ছেলে। সে কোকাচ্ছে মানে শরীর বেশিই খারাপ। জলি মিহিরকে আদেশ করলেন রণকে ধরে দোতলায় নিয়ে যেতে। তার চোখের সামনে থাকবে ছেলে পরিচর্যা হবে।

শুভ্রা হাসিখুশির সাথে গল্পে মশগুল। হাসি বললো-“ভাবি তোমাদের বাড়ি যাবে না?”
শুভ্রা অবাক গলায় বললো-“যাবো না কেন? আব্বা কালকে যেতে বলছে তোমার ভাইকে নিয়ে। আজকে কিবা কাজ আছে তোমার ভাইয়ের।”
হাসি অবাক গলায় জানতে চাইলো-“ভাইয়া যাবে বলেছে?”
“হ্যা। বাবাকে তো বলেছে যাবে। কেন?”
শুভ্রা সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো। হাসি হাসলো-“কিছুনা। এমনিতেই জানতে চাইলাম।”
খুশি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো-“ভাবি, তোমার ভাবীটা কিন্তু দেখতে সুন্দর। আমার খুব ভালো লেগেছে। ওনার নাম তুলতুল দেখতেও তুলতুলা। তাই না হাসি?”
“হ্যা, ভাবি। কিন্তু ওনার বাড়ির কেউ এলো না কেন? কেউ নেই ওনার? বাবা মা ভাই বোন?”
হাসির কথায় মনটা খচখচ করে ওঠে শুভ্রার। আরে তাইতো! কথাটা ভুলে গেলো কি করে? ভাবি তার মা আর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেছিল না? তাদের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলো না কেন? রণ বলেছিল পরে সব বলবে কিন্তু সে কেন রণর কাছে জানতে চাইলো না ঘটনাটা? জিজ্ঞেস করতে হবে রণকে। সে কি বাইরে বেরিয়ে গেছে নাকি বাসায়?
“আমি একটু আসছি।”
বলে বেরুতে যেয়ে জলির মুখোমুখি পড়ে গেলো শুভ্রা। জলি ভ্রুকুটি করে শুভ্রাকে দেখলো-“যাচ্ছ কোথায়?”
শুভ্রা থমকে গেলো। জলিকে গম্ভীর দেখাচ্ছে-“কাল কি খেয়েছে রণ?”
জলির প্রশ্ন শুনে শুভ্রা মনে মনে চমকে গেলো-“কেন? কি হয়েছে?”
“ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পরেছে। জ্বর, বমি, পেট ব্যাথা আর ঘনঘন বাথরুম যাচ্ছে। জানো তুমি?”
শুভ্রা ঢোক গিলে নিলো-“না, জানি না তো।”
“তা জানবে কি করে? তোমরা জেদি মেয়ে যা চাও তা পেতে হবে। পেয়ে গেলে আর সেই জিনিসের কদর নেই। বলি বিয়েটা তো জোর করে করেছ এখন সম্পর্কটা জোর করে এগিয়ে নিচ্ছ না কেন? দু’জন দুই রুমে থেকে কি প্রমান করতে চাইছো সেটাই বুঝতে পারছি না। জামাই অসুস্থ হয়ে তিনতলায় পড়ে আছে বউ জানেই না। কেমন ধারা মেয়ে তুমি?”
শুভ্রা বোকার মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে জলির দিকে। হাসিখুশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জলি পাত্তা দিলো না মেয়েদের। শুভ্রার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো-“যাও যেয়ে রণর কাছে বসো। দেখো ওর কি লাগবে।”
শুভ্রা মাথা দুলালেও জলি দেখলো না। হনহন করে চলে গেলো। শুভ্রার লজ্জা লাগছিল ভীষণ হাসিখুশির সামনে। সে ওদের দিকে না তাকিয়েই চলে এলো।

শুভ্রা ঘরে ঢুকে দেখলো রণ চোখ বুজে শুয়ে আছে। রণর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ফর্সা চেহারা হলদেটে হয়ে গেছে। শুভ্রা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। রণ চমকে উঠে বসলো-“কি হয়েছে?”
শুভ্রা মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো-“কিছু না। সরি, আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।”
রণ কিছু না বললেও চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো। আবার শুয়ে পড়লো সে। শুভ্রা ওর সামনে এসে দাঁড়ায়-“শুনুন, আপনি নিজে যেটা সহ্য করতে পারছেন না সেটা করতে আমাকে বাধ্য করেছিলেন। এখন কি ভাবতে পারছেন কি অবস্থা হয়েছিল আমার? কতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম? তারউপর দেখুন আপনার মতো এতো সেবা পাইনি আমি। একা একাই পড়ে ছিলাম কয়েকদিন। অথচ আপনি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। মানুষ কতটা হিপোক্রেট হতে পারে সেটা ভেবেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।”
শুভ্রার কথায় চোখ মেলে তাকিয়ে ওকে দেখলো রণ। চাপা অসন্তোষ ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে। উঠে বসে বললো-“এখন কি করতে হবে আমাকে? আমাকেও তাহলে আঁটকে রাখুন। খাবার পানি কিছু দেবেন না। ঘরের আলো বন্ধ করে সাতদিন আঁটকে রাখুন। আপনার মন শান্তি হবে তাতে?”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“দুই মাসের শাস্তি আপনি চালাকি করে সাতদিনে শেষ করতে চাইছেন?”
“তারমানে আপনি দুইমাস আঁটকে রাখতে চাইছেন আমাকে? আমার থাকতে কোন আপত্তি নেই। সত্যি বলছি। আমার অভ্যাস আছে। কিন্তু আমার পক্ষে তো সম্ভব হবে না বন্দী থাকা। রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করার জন্য। বিনিময়ে কি করা যাবে বলুন। যতটুকু বুঝতে পারছি আপনি আমাকে সেম টু সেম শাস্তি না দিলে শান্তি পাবেন না।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকলো। প্রচন্ত পেটব্যাথায় রণর মুখেচোখ কুঁচকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সে হাত বাড়িয়ে স্যালাইন পানির গ্লাসটা নিয়ে দুটো চুমুক দিলো। সেই পানি পেটে যাওয়া মাত্রই পেটের মধ্যে উথালপাতাল শুরু হলো। গা গুলিয়ে বমি উঠে এলো। নিজেকে আঁটকাতে না পেরে ঘর ভাসিয়ে বমি করলো রণ। গলা জ্বলে যাচ্ছে রণর। সে চেচিয়ে উঠলো সইতে না পেরে-“আহহহ।”
জলি দৌড়ে এলো-“কি হয়েছে?”
শুভ্রা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললো-“কিছু না আন্টি। বমি করেছে আমি পরিস্কার করে দিচ্ছি। আপনি যান।”
রণ অবাক হওয়ার মতো অবস্থায় নেই তবুও অবাক হলো শুভ্রার কথায়। জলি চলে গেলে শুভ্রা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। রণ মেজাজ খারাপ করে বললো-“কি?”
“কিছু না।”
“এখন আমার বমি পরিস্কার করতে হবে। তাই তো?”
শুভ্রার ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখে-“বাহ! মন্ত্রী মশাইয়ের বুদ্ধি আছে দেখা যাচ্ছে।”
রণ দূর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়লো-“আপনার মনস্তত্ত্ব বুঝতে আইনস্টাইন হতে হবে না। আমেরিকায় পড়ালেখা করলে কি হবে আপনার ঘটে সেই চিরাচরিত বাঙালি ব্রেন। এর বেশি কিছু ভাবতে পারবেন না।”
শুভ্রা চিড়বিড়িয়ে উঠলো। আঙুল উঁচিয়ে শাসালো-“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।”
রণ পাত্তা দিলো না, বাথরুম থেকে বালতি নিয়ে এলো টলতে টলতে-“আপনি প্লিজ ভাবুন দুই মাসের বন্দীত্বের বদলে কি শাস্তি দেওয়া যায়। ভেবে বলুন আমাকে। আমি যত দ্রুত সম্ভব শাস্তির কোটা শেষ করতে চাই। এটাই আমাদের দু’জনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
“কেন? আমাকে বউয়ের রোলে দেখতে চাইছেন?”
শুভ্রার কন্ঠে কৌতুক। রণ মব ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। দৃষ্টি ক্ষীন করে শুভ্রাকে দেখলো-“আপনার তাই মনেহচ্ছে? আপনার কি মনেহয় আপনি আমার বউ হওয়ার যোগ্য?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো, কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“কি বলতে চাইছেন আপনি?”
রণর গভীর দৃষ্টি শুভ্রাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। রণ শান্ত গলায় বললো-“আমার মাকে ব্লাকমেল করে খুব সহজে আমার বউ হতে পেরেছেন। অন্যথায় আপনি কখনোই আমার বউ হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। আপনার মতো মেয়েকে এই রণ তাকিয়েও দেখতো না। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। অপমানে ওর গা ফুটন্ত উনুন। চোখ দুটো আগ্নেয়গিরির লাভা। রণ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“আপনার ভাগ্য আমি আপনাকে অপহরণ করেছিলাম। আমার সেই ভুলের কথা বলে আমাকে আর আমার মাকে ব্লাকমেল করেছেন। তা না হলে আপনার মতো মাসে মাসে বয়ফ্রেন্ড বদল করা কোন মেয়ে এই রণর বউ হতো না কখনোই।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে