#দর্পহরন
#পর্ব-২
শুভ্রার ঠিক বিপরীতে বসে আছে সে। গম্ভীর মুখ নিবন্ধিত আছে মোবাইলে। টমক্রজের স্টাইলে কাটা চুলগুলো মাঝে মাঝে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্রাকে দেখে নিচ্ছিল। এরইমধ্যে ওকে নড়তে দেখে হাতের মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে চালান করে সোজা হয়ে বসলো।
আধো আধো বোজা চোখ মেলতেই সুদর্শন যুবা পুরুষটিকে দেখে হচকে গেলো শুভ্রা। ঘোর ভেঙে গেল সহসাই। চোখ দুটো বিস্ফোরিত। ছেলেটার সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভয়ের শীতল একটা অনুভূতি শুভ্রার পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। কোথায় আছে সেই প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেওয়ার আগেই তলপেটে তীব্র চাপ টের পেয়ে ছটফটিয়ে উঠলো শুভ্রা। আওয়াজ করতে যেয়ে বুঝলো তার মুখ স্কচটেপ দিয়ে আঁটকানো। নড়তে যেয়ে তীব্র ব্যাথা টের পেলো কাঁধ আর হাতে। মাথা ঘুরিয়ে দেখলো হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পায়ের থাই এর অংশটা দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে কষে পেঁচানো বিধায় শুভ্রার নড়বারও কোনো উপায় নেই। বৃথা জেনেও নিজের সমস্ত শক্তি ব্যায় করে শরীরটা নাড়াবার চেষ্টা করলো একবার। না পেরে পা দুটো মেঝেতে দাপালো কয়েকবার। তাতেও সামনের মানুষটার কোন ভ্রুক্ষেপ হলো না। অসহায় বোধ হচ্ছে শুভ্রার। অনুভূতি কাজ করছে না ঠিকঠাক। তার কি রাগ হওয়া উচিত? কি হচ্ছে তার সাথে ধারণা নেই কোন। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে কিন্তু কেন? তার অপরাধ কি? জানতে চাওয়ার উপায় নেই।
শুভ্রা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সামনে বসে থাকা ছেলেটা ওর পুরো কর্মকান্ড বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছে। মুখটা হাসি হাসি করে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে। তলপেটের চাপ বাড়ছে বলে থাকতে না পেরে আবারও মেঝেতে পা দাপালো শুভ্রা। ছেলেটা এবার দন্ত বিকশিত হাসি দিলো যা দেখে তীব্র জলীয় নিষ্কাশনের চাপ নিয়েও শুভ্রা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। মনে হচ্ছে বাইশ বছরের এক দীপ্তমান তরুন। শুভ্রার চাহুনি টের পেয়েই মনেহয় নিজেকে সামলে নিলো ছেলেটা। গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলো-“ওয়াশরুম যেতে চান?”
স্বজোরে মাথা দুলায় শুভ্রা। তবুও জায়গা থেকে উঠতে দেখা গেল না তাকে। স্থির চোখে চেয়ে থেকে বললো-“আমি আপনার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেব যদি আপনি লক্ষী মেয়ের মতো আমার সব কথা শোনের।”
উপায় না পেয়ে তড়িৎগতিতে মাথা দুলায় শুভ্রা। ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো-“দাঁড়াবেন না। আপনার বামে ওয়াশরুম।”
দীর্ঘ সময় বাঁধা থাকার কারনে হাত পা অসার হয়ে আছে। চাইলেও নড়তে পারছে না শুভ্রা। ওকে হতচকিত করে ছেলেটা প্রায় চ্যাংদোলা করে ওকে ওয়াশরুমের ভেতর পৌঁছে দিয়ে বললো-“কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন। দেরি হলে আমি ভেতরে ঢুকে যাব কিন্তু। আর হ্যা মুখের স্কচটেপ খোলার চেষ্টা করবেন না নিজেই আহত হবেন।”
প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েই বেরিয়ে গেলো ছেলেটা। তলপেটের চাপে বেশি কিছু ভাববার সুযোগ পেল না শুভ্রা। দ্রুত নিজের কাজ শেষ করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ও বেরুনো মাত্রই ছেলেটা ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। ওকে ঠেলে চেয়ারে বসিয়ে পা বেঁধে দিয়ে ওর সামনে চেয়ার টেনে বসলো-“আপনি নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বুঝতে পারছেন আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?”
শুভ্রা মাথা দুলায়।
“আপনার সুবিধার জন্য কিছু কথা বলে দিতে চাই আপনাকে। যতই চেষ্টা করেন না কেন এখান থেকে আপাতত মুক্তি পাচ্ছেন না আপনি। বিশেষ উদ্দ্যেশে আপনাকে অপহরণ করেছি। কাজ শেষ হলে স্বসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হবে আপনাকে। আপনার অন্য কোন ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই আমাদের যদি না আপনি বাধ্য করেন। শুধু কিছুদিন অতিথি হয়ে বন্দী থাকতে হবে এখানে। সেই থাকাটা কতটা ভালো হবে সেটা আপনার আচরণের উপর নির্ভর করছে। আপনি যেমন আচরণ করবেন তেমন অতিথি আপ্যায়ন হবে। আর হ্যা, রুমটা সাউন্ড প্রুফ কাজেই চিৎকার চেচামেচি করে লাভ হবে না। এখন আপনি ঠিক করুন কি করবেন।”
শুভ্র মুখে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা গো গো শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে হলোনা।
“কিডন্যাপের কারন জানতে চান?”
শুভা মাথা নাড়তেই হাসলো ছেলেটা-“কারণটা আপনার না জানলেও চলবে। এখানে আপনি যত কম জানবেন তত মঙ্গল আপনার জন্য। সেটা অবশ্য এখন বুঝবেন না। ভবিষ্যতে ভালো টের পাবেন।”
কথার মাঝে ছেলেটার ফোন বেজে উঠলো। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কেটে দিয়ে শুভ্রাকে দেখলো-“আজকের মতো যাচ্ছি। কষ্ট করে আজ রাতটা না খেয়ে থাকতে হবে আপনাকে। কাল যদি সম্ভব হয় খেতে দেব আপনাকে।”
শুভ্রা তীব্র বেগে মাথা নাড়ে, মেঝেতে পা দাপায়। খিদের তার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। সর্বশেষ দুইদিন আগে ভরপেট খেয়ে প্লেনে চড়েছিল। কাল পুরোটা দিন জার্নিতে কেটেছে বলে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। যতদূর মনে পড়ে সকাল দশটায় বেড়িয়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে। ছেলেটা আবারও মুচকি হাসলো-“একদিন দুইদিন না খেয়ে থাকাটা এমন কঠিন কোন ব্যাপার না মিস শুভ্রা। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আসছি কেমন? ঘুমিয়ে পড়ুন। আরে আরে অবাক হচ্ছেন কেন? হ্যা হ্যা এভাবেই ঘুমাতে হবে আপনাকে। দেখবেন এটাও অভ্যাস হয়ে যাবে একসময়।”
বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হলো ছেলেটার-“নরম বিছানায় ঘুম আর যা ইচ্ছা তা খাওয়া তো হলো অনেক। অনেকদিন তো আকাশে উড়লেন এবার একটু মাটিতে থেকে দেখুন কেমন লাগে। চলি কেমন? গুড নাইট।”
লোকটা বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই রুমের বাতি নিভে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল শুভ্রা। অসহ্য খিদেয় ছটফট করতে করতে শুভ্রা ভেবেই পেল না এই ছেলেটার কি ক্ষতি করেছে সে। কখনো দেখেছে বলেও মনেহয় না। তাহলে? কেন তাকে এখানে আটকে রেখেছে? কি অপরাধে? আর ছোট চাচা তো জানতো তার আসার খবর। তাকে না পেয়ে কি বাবাকে জানায়নি ছোট চাচা? আর বাবা জেনে চুপচাপ বসে থাকবে এও কি সম্ভব? ভাবনারা ডালপালা ছড়ায় কিন্তু কুল না পেয়ে আবারও একই জায়গায় ফেরত আসে। খিদেয় কাতর শুভ্রা একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।
★★★
গাড়ি এলাকায় ঢুকতেই সিটে সোজা হয়ে বসলেন ইব্রাহিম সালিম। গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছিলেন। এখন ঘুম থেকে উঠে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। ঝিমঝিম ভাব কেটে গিয়ে মাথাটা একটু একটু করে কাজ করতে শুরু করেছে। একবার ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলেন। অন্ধকার বলে পারলেন না। গাড়ির বাতি জ্বালানোর ইচ্ছে করছে না। তিনি গলা খাকরানি দিলেন-“তুহিন, কয়টা বাজে রে?”
“সাড়ে বারোটা বাজে স্যার।”
ইব্রাহিম সালিম পাল্টা জবাব না দিয়ে বাইরে তাকালেন। রাত হয়েছে বলেই রাস্তা অন্ধকার। দু’পাশের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, জনমানব শুন্য রাস্তা। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি চলছে অবশ্য। সালিম সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন। তার এলাকায় লোকেরা রাত তো দূরে থাক সন্ধ্যা থেকে ঘর থেকে বের হয় না। কারনটা কি ইব্রাহিম পরিবার নয়?
চিন্তাধারা পরিবর্তন হতে দেখে নিজের উপর বিরক্ত হলেন সালিম সাহেব। ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন তিনি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন? এরকম দূর্বল চিন্তা আসছে কেন তার মাথায়? নেত্রী একবার পিছিয়ে যেতে বললেই কি হাত পা গুটিয়ে নেবেন? একবার নির্বাচন করতে না পারলেই কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো সব শেষ হয়ে গেছে এমন ভাবনা ভাবছেন কেন তিনি? হতে পারে এটা অপজিশনের ষড়যন্ত্র। কে এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে তা জানতে হবে তো? আজকাল প্রচুর শত্রু বেড়েছে তার। নেত্রীর সাথে তার আন্তরিক সম্পর্কটাও অনেকে সহ্য করছে না। কেউ হয়তো নেত্রীর কানে বিষ ঢেলেছে তার নামে।
তা না হলে নেত্রী কেন তাকে সরে দাঁড়াতে বলবে? আর বললেই সরে যেতে হবে নাকি? শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন পদ পাওয়ার।
“স্যার, চলে আসছি।”
তুহিনের ডাকে বাস্তবে ফেরে ইব্রাহিম সালিম। তাকিয়ে দেখলেন তুহিন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লান্ত পায়ে নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন সালিম সাহেব। ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই স্ত্রী রিমা একগ্লাস জল নিয়ে এলো। তিনি নিঃশব্দে জল পান করলেন। রিমা মৃদুস্বরে বললো-“আপার শরীর ভালো আছে?”
সালিম সাহেব চোখ বুঁজে মাথা দুলালেন। রিমা তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। দু’টো জরুরি খবর দিতে হবে মানুষটাকে। সে মানুষটার মেজাজ বুঝতে চাইছেন। সালিম সাহেব রিমার অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন-“কিছু বলবা?”
রিমা মাথা নাড়লো। সালিম সাহেব গর্জে উঠলেন-“তো খাম্বার মতো খাড়াই আছে কেন? কয়া ফালাও।”
তুমুল গর্জনে রিমার শরীর কেঁপে উঠলো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি। রিমার মুখে যেন তালা লেগে লেগো। বলার সাহস করে উঠতে পারছেন না। সালিম সাহেব রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলেন-“কি হইলো? কথা কও ন কেন?”
“শারমিন দুইদিন ধইরা ফোন করে না। আইজ আমি ফোন দিছিলাম ওয় ধরে নাই।”
মেয়ের কথা শুনে কিছুটা নরম হলেন ইব্রাহিম সালিম। মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়েন-“পড়ালেখা নিয়া ব্যস্ত মনেহয়। আর ও না ধরলে মালিহাকে ফোন দাও।”
রিমা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো-“দিছিলাম। ও কইলো কিছু জানে না। ওয় জামাই নিয়া বেড়াইতে গেছে অন্য শহরে।”
রিমার জবাবে অসন্তুষ্ট হলেন সালিম সাহেব-“তুহিনকে কইছিলা? সারাদিন পরে এই খবর দিলা? আচ্ছা সকাল দেখতেছি কি করা যায়।”
“আরেক খান কথা।”
রিমার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। এই খবর পেয়ে কি করবেন সালিম সাহেব সে জানে না তবে এটা খুব জরুরি।
“আর কি কইবা? এই মাঝরাইতে বাড়িত আইসাও শান্তি নাই দেখতেছি।”
“সোহেল মাইয়্যা তুইলা আনছে আইজকা।”
রিমার কথা না বুঝে সালিম সাহেব পুনরায় জানতে চাইলো-“কি কইলা?”
রিমাকে আতঙ্কিত দেখায়-“সোহেল বিকালে এক মাইয়া তুইলা আনছে। আঁটকায়া রাখছে টং বাড়িতে। কয় ওই মাইয়াকে বিয়া করবো।”
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৩
সোহেলের চোখ মুখ কেটে একাকার। কাল রাতে সালিম সাহেব মেজাজ হারিয়ে বেদম প্রহার করেছে তাকে। প্রথমবারের মতো বাবার হাতে মার খাওয়ায় হতবাক সোহেল। নিজেকে বাঁচানোর কথা একবারও মনে আসেনি তার। নিশ্চুপ হয়ে পিটুনি হজম করেছে। সোহেল বুঝেছে তার বাবার মেজাজ কোন কারনে ভীষণ খারাপ ছিলো। তা না হলে সোহেল তার বাবার আদরের সন্তান। হাজার অন্যায় করলেও বাবা কখনো তাকে বকা দেয় না। বরং তার সব অন্যায় কাজ ধামাচাপা দেয় নিজের গরজে। এই সকালে আয়নায় নিজেকে দেখে তার একটু কষ্ট হচ্ছে বইকি।
“সোহেল, উঠছোস ঘুম থিকা?”
দরজায় বাবার গলা শুনে মুচকি হাসলো সোহেল। নিশ্চয়ই তার বাবা সারারাত ঘুমায়নি। সোহেল হাসি লুকিয়ে সারা দিলো-“উঠছি আব্বা।”
সালিম সাহেব ঘরে ঢুকে সোহেলকে দেখলেন। চেহারা দেখে তার অনুতপ্ততা বাড়লো। হাত দিয়ে সোহেলের মুখটা আলতো হাতে আদর করে দিলো-“কোন মাইয়া তুইলা আনছোস? বিয়া করবি কেন ওরে?”
সোহেল হেসে দিলো-“মা অনেক জ্বালাইতেছিল কালকে তাই মারে মিছা কথা কইছি আব্বা। বিয়া টিয়া করুম না ওরে। মাইয়াটা বহুত তাফালিং করতাছিল তাই বাধ্য হইয়া ওরে তুইলা আনছিলাম।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হলেও ছেলেকে বুঝতে দিলেন না-“ছোট খাটো ব্যাপারে মাইয়া তোলা লাগে? তোরে কি লোকে ডরায় না নাকি?”
সোহেল মাথা চুলকায়-“আব্বা, কালকে ইব্রাহিম মার্কেটে ঝামেলা হইছিল। এক দোকানী চান্দা দিব না বইলা ঝামেলা করতেছিল। মোমিন আমারে ডাকছিল তখন। ওই দোকানদারকে তুইলা আনতে গেছিলাম তখন এই মাইয়া সামনে আইসা পড়ছে। কিছুতেই দোকানদারকে আনতে দিব না। পড়ে দোকানদারকে ফালায়া এই মাইয়ারে তুইলা আনছি। দুই একদিন রাইখ্যা নদীতে ফালায় দিমু নাইলে অন্য কোন ব্যবস্থা করমু।”
“তোর এই মাথা গরম স্বভাব আর গেলো না সোহেল। এখন যদু মধু কদুরে তুইলা আনা শুরু করছোস। তোর এইসব কারবার আপার কান পর্যন্ত চইলা গেছে। এইজন্য সে এইবার আর আমারে নমিনেশন দিব না ঠিক করছে। তোরে নিয়া কি করমু ক?”
সোহেলকে বোকা বোকা দেখালো। কাল রাতে বাবার অগ্নিশর্মা হওয়ার কারনটা পরিস্কার হলো এবার। অপরাধবোধ ফুটে উঠলো তার চেহারায়। কেন যে এতো শর্টটেমপার সে? অল্পতেই দুনিয়া ধ্বংস করা রাগ উঠে যায় তার। সালিম সাহেব আরও কিছু বলবেন তার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। সোহেল আড়চোখে দেখলো ফোনটা। বন্দর থানার ওসির। কেন যেন সোহেলের মনে কু ডাকলো। এই সাতসকালে ফোন আসা ভালো লক্ষন না। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওপাশের জনের কথা শুনতে শুনতে তার বাবার চেহারার নকশা যে বদলে যাচ্ছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না সোহেলের। ফোনটা কান থেকে নামাতেই সোহেলের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন-“না যাইনা কার মাইয়া তুইলা আনছোস হারামজাদা?”
সোহেল তুতলে বললো-“কেন? কি হইছে?”
“গোলাম রসুলের মাইয়ারে তুইলা আনছোস যারে তিনবছর আগে শীতলক্ষ্যায় ভাসায় দিছিলি। ওর চাচা গোলাম রাব্বানী, হাইকোর্টের উকিল। থানায় মামলা করছে কালকা। মামলা নিতে চায়নাই থানা কিন্তু কে যেন ফোন দিছিলো মামলা নেওয়ার জন্য। মামলা না নিলে আপাকে জানাইবো হুমকি দিছে। তার উপর তোর মাইয়া তুইলা নেওয়ার পুরা ভিডিও ফেসবুকে ছাইরা দিছে।”
সোহেলের মনে মনে প্রমোদ গুনলো। কি হচ্ছে এসব? ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো-“আমি তো জানতাম না আব্বা যে ওই ছেড়ি…”
“তুই তো কিছুই জানোস না সোহেল। আমারে না ডুবায়া তুই থামবি না দেখতেছি। একদিকে সামনে নির্বাচন আরেকদিকে তোর এইসব আকাম। কই যামু ক? নির্বাচনের প্রস্তুতি নিমু নাকি তোর এইসব সামলাবো? কয়দিন আগেও তোর এই ঝামেলা সামলাইছি আইজকা আবার।”
সালিম সাহেব মাথায় হাত দিয়া বসে পড়লেন। সোহেল হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু কেমন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়েকে তুলে আনলে যে এতকিছু হবে তা সে জানতো না। এর আগে অনেকবার এমন করেছে কিন্তু কেস হওয়া দূর কারো টু শব্দ করার সাহস হয় নাই। এইবার কি হইতেছে এইসব?
সালিম সাহেবও বিস্মিত। যত যাইহোক থানায় মামলা দেওয়ার সাহস আজ পর্যন্ত হয় নাই কারো। এই গোলাম পরিবারের হঠাৎ এতো ক্ষমতা হইলো কেমনে? এদের পিছনে কে আছে? আর ভিডিও ছাড়ছে কে? যদি আপার নজরে আসে কোনভাবে তাইলে আর এইবার নির্বাচনের কোন আশা নাই। সালিম সাহেব মাথার তালুতে হাত বুলিয়ে চলছে ক্রমাগত। সোহেল ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো-“এখন কি করুম আব্বা?”
“ওই মাইয়া কই? তুই ওরে কিছু করস নাই তো?”
সোহেল ঢোক গিগলো। কালকে তুলে আনার পর পরই মেয়েটাকে রেপ করেছে সে। সারাদিনে দুই তিন দফা পাশবিক অত্যাচার করেছে। কিছুই করার ছিলো না তার। মেয়েটা খুব চেচামেচি করছিল, হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ হচ্ছিল না। সালিম সাহেব ছেলেকে মৌনতা ধারন করতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। ইচ্ছে হচ্ছে চাবকে ছেলের গায়ের চামড়া তুলে নিতে। এইরকম গাধা তার ছেলে সেটা ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ভস্মীভূত করে দেওয়া দৃষ্টি হেনে ছেলেকে একবার দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
★★★
“দেখ রাগীব আমি কিন্তু সালিমকে বলে দিয়েছি যে এবার ওকে নমিনেশন দেব না। ও কিছু না বললেও আমি জানি ও সহজে সব মেনে নেবে না। কিছু না কিছু ঝামেলা করবেই।”
রণকে খানিকটা বিচলিত দেখায়-“আমার নাম কি বলে দিয়েছেন ফুপি?”
“নাহ বলিনি। তুমি নিষেধ করেছিলে না। তবে আজ অথবা কাল বলতে তো হবেই। নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা হয়ে গেছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আর বেশি দিন তো নেই।”
“পরে জানাতে কোন সমস্যা নেই ফুপু। আশাকরি উনি কোনপ্রকার ঝামেলা ছাড়াই পদ থেকে সরে দাঁড়াবে।”
নেত্রীকে বিরক্ত দেখালো-“এতো শিওর হচ্ছ কি করে? ও অতো সহজ নয় তা তুমি ভালোই জানো। আমিও কম চেষ্টা করিনি ওর ক্ষমতা কমাতে কিন্তু পারলাম কোথায়? তোমার বাবাকে দিয়ে একবার চেষ্টা করেছিলাম। তার কি পরিনতি ছিল তুমি ভালোই জানো। ক্ষেত্রবিশেষে ও আমাকেও ভয় পায় না এটাই সমস্যা। তুমি এমন মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। আশাকরি পরে পিছিয়ে যেয়ে আমার মানসম্মান নষ্ট করবে না।”
রণ মৃদুস্বরে হাসলো-“পিছিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না ফুপু। আপনি আমার দিক থেকে নিশ্চিত থাকুন। তবে আপনাকে একটাই অনুরোধ থাকবে উনি যেন সহজে আমার পরিচয় না জানেন। একদম শেষ মুহূর্তে জানাব।”
“যেমন তুমি বলবে। যেটাই করো না কেন পিছু হটা যাবে না। এটা আমার কথা।”
রণ আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো-“এটা ওনার ছেলের গতকালের ইন্সিডেন্ট। সাংবাদিক গোলাম রসুলের মেয়েকে দিনদুপুরে তুলে নিয়েছে। ওনার আর ওনার ছেলের অত্যাচারে পুরো এলাকার মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে গেছে।”
মোবাইলে ভিডিওটা মন দিয়ে দেখলেন নেত্রী। তার চেহারা গম্ভীর হলো। মোবাইল ফেরত দিয়ে বললেন-“কি করতে চাও?”
রণ রহস্যময় হাসি দিলো-“যেটাই হবে তাতে আপনি সায় দেবেন ফুপু। নির্বাচনের মুহূর্তে জনগণ এসব খুব মনে রাখবে। সামান্য একটা স্টেপ কিন্তু কাজ হবে স্ফুলিঙ্গের মতো। ভোটের জোয়ার বইবে। আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই কি বলতে চাইছি?”
নেত্রী তৃপ্ত হয়েওঠে মাথা দুলালেন-“বুঝেছি। তুমি এবার এসো তাহলে।”
রণ উঠলো। দলীয় প্রধানের বাসভবন থেকে বেড়িয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে বসলো। ওর ব্যক্তিগত সহচর মিহির বসেছে ড্রাইভারের পাশে-“ভাই, উত্তরে না পূর্বে?
“পূর্বে চল। মিহির দিলশাদকে খবর পাঠা, ওইদিকে সব ঠিক আছে নাকি জানতে চা।”
মিহির পেছনে তাকিয়ে রণকে দেখলো-“ভাই, সব ঠিক আছে।”
রণ শান্ত হয়ে কালো কাঁচের বাইরে তাকাল। অনেক কাজ বাকী। কেবল পথচলা শুরু বলা যায়। ভাবনা কেবল একটাই, সব কাজ ঠিক মতো করতে পারবে তো?
★★★
ঘুম ভাঙতেই হাত পা ঘুরিয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙলো শুভ্রা। পরক্ষণেই চমকে চোখ মেললো। বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করলো তার হাত পা খোলা। সবচেয়ে আনন্দের কথা তার মুখের স্কচটেপটাও লাগানো নেই। আনন্দে চিৎকার করতে যেয়ে মুখ হাত দিলো শুভ্রা। দরজাটা হাট করে খোলা। ওপাশ থেকে আলোর ছটা ওর ঘরটা আলোকিত করছে। ও ধীর পায়ে দরজা সামনে এসে উঁকি দিলো। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুভ্রা আরেকটু এগুলো। বিশাল বড় একটা হলরুমে টিভি চলছে বিনাশব্দে। সেই আলোয় আলোকিত পুরো ঘর। বাইরে বের হওয়ার দরজা খুঁজলো শোভা। স্লাইডিং ডোর নজরে এলো। দ্রুত হাতে সেটা খুলতেই চমকে গেলো শুভ্রা। ওপাশে একটা রান্নাঘর যেখানে কালকের ছেলেটা কাজ করছে। ওকে দেখে বললো-“কাল আপনাকে বলেছিলাম, আপনার বন্দী জীবনে কতটা সুযোগ সুবিধা পাবেন সেটা আপনার আচরণের উপর নির্ভর করছে। এটাও বলেছিলাম, পালানোর চেষ্টা করবেন না। আজ প্রথম পরীক্ষায় আপনি ফেল করলেন। ভেবেছিলাম আজ খেতে দেব আপনাকে কিন্তু আপনি সে সুযোগ হেলায় হারালেন।”
শুভ্রা গোল চোখে তাকিয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে। ও পালাচ্ছে কিনা সেটা এই লোক দেখলো কি করে? লোকটা পিছমোড়া হয়ে কাজ করছে বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না। লোকটার কথা শুনতে শুনতেই কিনা ওর পেটের খিদেটা জানান দিলো। শুভার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেলো। কি হচ্ছে এসব ওর সাথে? কোথায় বাড়ি যেয়ে সবাই মিলে আনন্দ করার কথা ছিল। সেখানে ও কিনা বন্দী হয়ে আছে কোনো অচেনা জায়গায় অচেনা লোকের কাছে।
“ওরকম নাকি কান্না করে লাভ হবে না মিস শুভ্রা। ভদ্র মেয়ের মতো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। পরে আর সুযোগ পাবেন না।”
শুভ্রা রুমে ফিরে এলো। রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিলো ভালোমতো। নিজের লাগেজ খুঁজলো কিন্তু পেল না। গা কুটকুট করছে গোসলটা দেওয়া দরকার। কিন্তু কাপড় কোথায় পাবে? শুভ্রা পুনরায় ফিরে এলো রান্নাঘরে। ও প্রশ্ন করার আগেই লোকটা ওর দিকে ফিরলো-“আপনার লাগেজে যেসব পোশাক আছে ওগুলো পরবেন না দয়া করে। ও ঘরে আলমারিতে কাপড় রাখা আছে আপনার জন্য সেখান থেকে কিছু পরুন।”
“আমার ফোনটা?”
শুভ্রার কথায় লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো-“বন্দী জীবনে কে কবে ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে?”
“আমাকে কতদিন থাকতে হবে এভাবে?”
‘ইনফাইনাইট ডে হতে পারে। বলেছি তো কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হলে তাড়াতাড়ি ছুটি হবে আপনার। আর কথা বাড়াবেন না। যান তাড়াতাড়ি নিজের কাজ সারুন। আমার আবার ফিরে যেতে হবে।”
শুভ্রা রুমে ফিরে আলমারি খুলে থরে থরে সালোয়ার কামিজ সাজানো দেখলো। ওর পরনের পোশাকটাও দেখলো একবার। কেন যেন হাসি পেয়ে গেল তার। বোর্ডিং স্কুলে পড়া শুরু হয়েছিল সেই ক্লাস এইট থেকে। এ লেভেল পর্যন্ত দার্জিলিং এ ছিল তারপর ফ্লোরিডা। কোন এক অদ্ভুত কারনে ওকে দেশে রাখতে রাজি না বাবা। কিছুদিনের জন্য বেড়াতে গেলেও থাকার সুযোগ নেই। অথচ ওর ভীষণ ইচ্ছে করে মায়ের কাছে থাকতে। এমন না যে বাবা ভালোবাসে না তাকে। তার দুই ভাইয়ের চাইতে বরং বেশি ভালোবাসে কিন্তু কাছে রাখবে না। এই যে শুভ্রা অপহরণ হয়েছে বাবা কি জানে? মনেহয় না। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে একসেট সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
“ওয়াশরুমের দরজায় কোন লক নেই কেন?”
“ইচ্ছে করেই রাখা হয়নি। আপনার প্রটেকশনের জন্য।”
ছেলেটা খেতে বসেছে টেবিলে। শুভ্রাকে দেখে নিয়ে পুনরায় খাবারে মন দিলো ছেলেটা। শুভ্রা হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেল না। একজন এডাল্ট মেয়ে বাথরুম যাবে দরজা খোলা রেখে। হাউ রেডিকুলাস। প্রতিউত্তর করতে যেয়ে চারকোনা টেবিলও নজর গেল। শুভ্রা ঢোক গিললো। ছেলেটা সম্ভবত রামেন খাচ্ছে। লাল ঝোলের মাঝে অর্ধেক করে কেটে রাখা ডিম দেখে শুভ্রার মুখে লালা চলে এলো। ছেলেটা মধ্যে অবশ্য কোন বিকার দেখা গেল না।
“আর কিছু বলার আছে? এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে খাবারে নজর দেবেন না।”
শুভ্রা বেশ অপমানিত বোধ করলো। এরকম কিছু সে তার জীবনে প্রথম শুনলো। কিন্তু তবুও সরে যেতে পারলোনা। তীব্র পানির পিপাসা অনুভূত হচ্ছে। ছেলেটার কাছে কিছু চাইতে মন না চাইলেও চেয়ে ফেললো-“একটু পানি পাওয়া যাবে?”
ছেলেটা খাওয়া থামিয়ে পানির গ্লাস ঠেলে দিলো শুভ্রার দিকে। পুরো দুইদিন পরে পেটে পানি পড়ার সাথে সাথে পেট উল্টে বমি এলো শুভ্রার। বহু চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। শুভ্রা ঘর ভাসিয়ে বমি করলো। ছেলেটা এবার সোজা হয়ে বসলো। ওর বমি করার পুরো দৃশ্যটা দেখলো। সে তার জায়গা থেকে নড়লো না।
শুভ্রা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা বললো-“এখন ভালো বোধ করছেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো না।
“রান্নাঘরের পাশে আরেকটা ওয়াশরুম আছে ওখান থেকে বালতি আর মব নিয়ে এসে ঘরটা পরিস্কার করে ফেলুন।”
শুভ্রা বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিয়ে দূর্বল কন্ঠে বললো-“আমি!”
“তো কে? এখানে আপনার জন্য কাজের লোক নেই কোন। তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ। দেরি করিয়ে দিচ্ছেন। খাওয়াটাও ঠিক মতো খেতে দিলেন না।”
শুভ্রা দূর্বল শরীর নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করে ঘরটা পরিস্কার করলো।
“এরপর বমি আসলে বেসিনে চলে যাবেন তাহলে আর কষ্ট করতে হবে না।”
শুভ্রা জবাব দিলো না। ছেলেটাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনেহচ্ছে এখন। ওর দিকে দু’টো ওষুধ বাড়িয়ে দিলো ছেলেটা-“খেয়ে নিন। শরীর ভালো লাগবে।”
শুভ্রা কথা না বাড়িয়ে ওষুধ দু’টো গিলে নিল।
“রুমে চলুন। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
শুভ্রা টলতে টলতে রুমে এসে চেয়ারে বসলো। ছেলেটা ওকে বেঁধে ফেলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে টলে পড়লো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin