#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-৬
মিজান সাহেব খেয়াল করলেন পিউ আজ ভোরে উঠেই জেসমিন আরার সাথে কিচেনে কুটকুট গল্প করছে। জেসমিন আরাও ফুরফুরে মেজাজে আছে। ওদিকে স্বচ্ছ দিশেহারা। গম্ভীর, চুপচাপ।
নাস্তার সময় বউ শাশুড়ী মিলেই গল্প করছে, হাসাহাসি করছে। স্বচ্ছ যেন পাশের বাসার অনাকাঙ্খিত মেহমান।
নাস্তা শেষে মিজান সাহেব অফিসের জন্য তৈরি হতে রুমে ঢুকলে জেসমিন আরা পিউর সাথে ড্রইংরুমেই বসে গল্প করেন।
অন্যসময় মিজান সাহেবের অফিস যাওয়া অব্দি জেসমিন আরা তার আগে পিছে থাকে। আজ দুইবার ডেকেও পাত্তা পেলেন না ।
হতাশ হয়ে অনেকটা জোরেই জেসমিন আরাকে রুমে ডেকে আনলেন।
-আমি অফিস যাচ্ছি।
-হুম যাও। ভালো কথা, হাজার খানিক টাকা থাকলে আমাকে দিয়ে যাও তো। আজ পিউকে নিয়ে শপিং যাবো। ওকে কিছু কিনে দিবো।
-স্বচ্ছ যাবে?
-না, ও কেন যাবে? ও পড়ুক, আমরা সময় নিয়ে দেখেশুনে শপিং করবো।
-বিয়ের অনুষ্ঠানের শপিং শুরু করে দিবে নাকি?
-না না, এমনি কিনে দেব। আমি ওর শাশুড়ী না?
মিজান সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ফেলেন। জেসমিন আরার কাঁধে হাত রেখে বলেন, মন দিয়ে শোনো জেসমিন। তুমি পিউকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে, ওকে এটা সেটা কিনে দেবে ভালো কথা। ছেলের বউ হিসাবে পিউকে তোমার পছন্দ হয়েছে তা আরো ভালো কথা। কিন্তু তুমি কিছু খেয়াল করেছো?
-কোন ব্যাপারে?
-স্বচ্ছ এবং পিউর সুর তাল কম।
– স্বচ্ছ তো পড়ায় ব্যস্ত থাকে। তাই হয়তো…
-পড়ায় থাকে না থাকতে বাধ্য হয়। তোমার বাধ্য ছেলে অনুমতি ছাড়া বিয়ে করায় নিজেকে অপরাধী ভাবছে। কিন্তু তোমার তো বোঝা উচিত ওদের বিয়ে হয়েছে। ওদের একে অপরকে সময় দেয়া দরকার।
–আমি কি বাধা দিচ্ছি নাকি?
-দিচ্ছো না। কিন্তু পিউকে নিজের কাছে বেশি রাখছো। স্বচ্ছর দিকে একটু মনোযোগ দাও দেখতে পাবে ছেলেটা সারাক্ষণ উসখুস করে। তোমার বেয়াইন ঠিকই বলেছে তার মেয়েটা জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ। জামাই নিয়ে খবর নাই শ্বাশুড়িকে খুশি করায় ব্যস্ত।
-তুমি বলতে চাচ্ছো পিউ আমাকে খুশি করতে এমন করছে?
-না। মা হারা মেয়ে পিউ, তোমার সঙ্গ সে পছন্দ করছে। কিন্তু আমার ছেলেকে উপেক্ষা করে। এটা তো ঠিক না।
-মাত্র দুদিনের বিয়েতে এতো ঠিক বেঠিক চিন্তা করা লাগবে না। তুমি টাকা দাও নইলে আমি গেলাম।
জেসমিন আরা উত্তরের অপেক্ষা না করে প্রজাপতির মতো উড়ে পিউর কাছে গেলেন।
মিজান সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। জেসমিন আরার এমন রূপ দেখেছিলেন তিনি নাতাশা জন্মের পর। তখনকার চোখের ঝিলিক আবার ফিরে এসেছে। এটা ভালো লক্ষন নয়।
_________________
বুয়া এসেছে আজ। পিউকে দেখে বুঝে পাচ্ছে না কে এই মেয়ে। জেসমিন আরাকে জিজ্ঞেস করে যখন জানলো স্বচ্ছ বিয়ে করেছে তখন হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করে কান্না শুরু করলো। কেন তাকে পর ভাবা হলো, একটা কল কেন কেউ দিলো না। এ সংসারে এতবছর কাজ করেও আপন হতে পারেনি, এ জগতে আপন বলতে কেউ নাই, মাবুদ নাই কেউ নাই আপন বলে…. সুরে সুরে কাঁদতে লাগলো।
পিউ দুবার উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে। ওর খুব মজা লাগছে। কি টেলেন্ট বুয়া! ইনসট্যান্ট গান বানাচ্ছে।
পিউকে দেখে বুয়ার সুর আরো উর্ধ্বগতিতে ছুটছে।
পিউ এগিয়ে বলল, আমি নতুন বউ, কোনো কাজ পারি না, একেবারে আকাইম্মা, আমার কি হবে গো — এটাকে সুর দিয়ে একটা গান করে দেন না বুয়া।
বুয়া গোল গোল চোখে পিউর দিকে চেয়ে আছে। তার গানের সুর ভেঙ্গে চিঁ চিঁ গলা বের হচ্ছে।
জেসমিন আরা পিউকে ইশারায় সরে আসতে বলেন।
__________
পিউর পাশে বসে জেসমিন আরা খেয়াল করলেন অনবরত ঘামছে পিউ।
– তোমার কি খুব গরম লাগছে ?
– জ্বি, সমস্যা নেই। এ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।
– কিসের এ্যাডজাস্ট? তোমাদের বাসায় গরম নেই বুঝি?
পিউ মাথা নিচু করে হাসে, উত্তর দেয় না।
জেসমিন আরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা টের পান। দুই রুমের এসির বিল নিয়েই তাদের হিমসিম খেতে হয়। পিউ হয়তো তা কখনো অনুভবও করে নি।
-তোমাদের সবরুমেই এসি আছে, তাই না? গলার সর নামিয়ে বলেন, তোমার কষ্ট হবে আমাদের মতো সাধারণ পরিবারে এ্যাডজাস্ট করতে।
পিউ হেসে উত্তর দেয়, আপনাদের সঙ্গ আমার খুব ভালো লাগছে। গরমটা একটু কষ্ট দিচ্ছে। তবে সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না।
জেসমিন আরা মলিন হাসেন। অগোচরে নিজের সাজানো সংসারে চোখ বুলান। মধ্যবিত্ত হলেও নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। দুই রুমে এসি থাকাটাও বিলাসিতা বলা চলে। সেখানে পিউর উপস্থিতি জানান দিচ্ছে নিজেদেরর সীমাবদ্ধতা। পিউর জন্যও মায়া হচ্ছে। পিউ হয়তো চেষ্টা করছে, করবে। কতটুকু পারবে তা সময়ই বলে দেবে।
এরজন্য সমানে সমানে সম্পর্ক করতে বলে সবাই। স্বচ্ছ আবেগে ভেসে বিয়ে করলো কিন্তু পিউকে কতটুকু সুখী রাখতে পারবে, কে জানে।
চলবে।।