#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-৫
পিউর বাবা আহমেদ সাহেব যখন স্বচ্ছদের বাসায় ঢুকলেন তখন রান্না অনেকটাই শেষের দিকে। সুন্দর শাড়ি পরে হাসি মুখে এগিয়ে যান জেসমিন আরা। কিন্তু আহমেদ সাহেবের ড্রাইভার একের পর এক মিষ্টির প্যাকেট এনে ডাইনিং ভরে ফেললে তার ভ্রুজোড়া কুচকে যায়। আবার সেই বাড়ি বাড়ি মিষ্টি বিলি করার ঝক্কি! মিজান সাহেব বাহারি মিষ্টি দেখে তেলতেলে হাসি হাসেন।
ড্রইংরুমে অল্প স্বল্প গল্প চলে একেবারে হুট করে আত্মীয় হয়ে ওটা দুই পরিবারের। কিছুটা বিব্রতও দুপক্ষ।
স্বচ্ছ খেয়াল করে পিউ নিচু হয়ে গোপনে আলতো করে চোখের জল মুছে নিল। ওদিকে আহমেদ সাহেবও সবার অগোচরে চোখের জল মুছলো। বাপ মেয়ে একই স্বভাবের। অনুভূতি লুকাতে চায়।
হঠাৎই স্বচ্ছর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। পিউ কী তাহলে স্বচ্ছকে এড়িয়ে চলছে নিজ অনুভূতি লুকানোর জন্যে? তবে কি পিউ স্বচ্ছকে গোপনে ভালোবাসে?
খাওয়া পর্বে আহমেদ সাহেব সব বাদ দিয়ে কেবল হাঁসের মাংসই বার বার পাতে তুলে নেন। তা দেখে মিজান সাহেব উসখুস করেন।
জেসমিন আরা ভাবেন পিউ হয়তো তার বাবাকে মানা করবে। এমন গরমে এতো হাঁসের মাংস খাওয়া তো ভাল নয়। অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু পিউ নিজের মতোই কুট কুট করে খাচ্ছে। এই মেয়ে হাঁসের উপকারীতা বা অপকারীতা সম্পর্কে আদৌ জানে কিনা সন্দেহ।
শেষে জেসমিন আরা নিজেই ভদ্রতা বজায় রেখে বলেন, বেয়াই সাহেব শুধু হাঁসের মাংস খেলে হবে? অন্যান্য আইটেমও তো চেখে দেখতে হবে?
-আপা, আপনার হাতের রান্না দারুণ। বহু দিন পর তৃপ্তি নিয়ে কিছু খাচ্ছি। পরবর্তীতে অন্যান্য আইটেম খাবো। আজ এটাই তৃপ্তি ভরে খেতে দিন। আমি আরেকটু নিলাম।
মিজান সাহেব হতাশ মনে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ফেলেন।
খাওয়া শেষে আহমেদ সাহেব বলেন, আপা আপনাদের দুজনের সাথে আমি একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।
জেসমিন আরা স্বচ্ছ ও পিউকে নিজের রুমে যেতে বলেন।
আহমেদ সাহেব পাশে রাখা একটা টুল টেনে স্বচ্ছর বাবা-মায়ের মুখোমুখি বসেন। মিজান সাহেবের দুহাত ধরে বলেন, আমি কঠিন পরিশ্রম করে বড় ব্যবসায়ী হতে পেরেছি কিন্তু ভালো বাবা হতে পারি নি বেয়ান। সবসময় ব্যবসাকে প্রধান্য দেয়ায় পিউর মায়ের জরুরি সময়ে ওর পাশে ছিলাম না। আজ আমার দোষেই আমার মেয়েটা মাতৃহারা। আমি সারাজীবন আমার মেয়ের অপরাধী।
আহমেদ সাহেব ছলছল চোখে বলেন, আমার মেয়েটা খুব সোজাসরল। ওকে জগতের পংকিলতা কখনো স্পর্শ করে নি। ও অনেক কিছুই বোঝে না। আপনারা ওকে দয়া করে সামলে নিবেন। জগত সম্পর্কে অজ্ঞ বলে আমার বন্ধুর ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছিলাম। ভেবেছিলাম পরিচিত পরিবেশে মেয়েটা ভালো থাকবে। ছেলে পিউর বেস্ট ফ্রেণ্ড ছিল। কিন্তু অন্তিম সময়ে নয়ন কেন যে এমন করলো আমরা জানি না। বিয়ে করবে না আগে বললেই পারতো। এভাবে বিয়ের দিন হুট করে পালিয়ে যাবে আমরা কেউ ভাবি নি।
চরম দুঃসময়ে আপনার ছেলে উপস্থিত হলো। ওর সাথে কথা বলে আমার মনে হলো এরচেয়ে যোগ্য ছেলে আমার মেয়ের জন্য হতেই পারেনা। যেমন বিনয়ী, তেমন ধীরস্থির কথাবার্তা। জানি এখনও সে ছাত্র, তবে বয়স অনুযায়ী অনেক দায়িত্বশীল। আমার বিশ্বাস পিউ স্বচ্ছর সাথে সুখী হবে।
বেয়ান, আমার মেয়েটাকে কোনোদিন আমি একটা ধমক দেয় নি। ধমক দেয়ার কাজও কোনোদিন করে নি। ওর মন অনেক নরম। আপনারা দয়া করে আমার মেয়েটিকে আপন করে নিবেন। জানি হুট করে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আমি অপরাধ করেছি কিন্তু মেয়ে জেদ ধরেছিল আজই তার বিয়ে হতে হবে। নিরুপায় ছিলাম বলে মানা করি নি। মেয়ের সব শখ পূরণ করে করে হয়তো না বলতে ভুলে গেছি। আপনাদের কাছে হাত জোর করে বলছি আমার মেয়েটা যদি তার অজান্তে কোনো অপরাধ করে থাকে দয়া করে বকা দিবেন না। আমাকে ডেকে যত ইচ্ছে বকে দিবেন তবু মেয়েটাকে বকবেন না প্লিজ।
মিজান সাহেব বলেন, ছিঃ ছিঃ, কি বলছেন আপনি! পিউ কি মিষ্টি একটা মেয়ে! ওকে কেন বকা দেবো আমরা? তাছাড়া আমরা খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত সুখী পরিবার। পিউ আমাদের পরিবারে অনাদর পাবে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন।
আহমেদ সাহেব মিজান সাহেবকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠেন।
মিজান সাহেব অসহায় বোধ করেন। এতো বড় ব্যবসায়ী অথচ কেমন অসহায় সুরে কথা বলছে।
কেবল মেয়ের বাবা বলে কি?
বাবা তো বাবাই হয়। কিন্তু ছেলের বাবা আর মেয়ের বাবার দৃষ্টিভঙ্গি বোধহয় ভিন্ন হয়। মেয়ের বাবারা সবসময় মেনে নেয় তার আদরের রাজকন্যা অন্য ঘরে যাবেই। অথচ ছেলের বাবারা কত দম্ভ নিয়ে চলে। উচ্চ শিক্ষার জন্য কদিন পর স্বচ্ছ দেশের বাইরে যাবে ব্যাপারটা কতই স্বাভাবিক কিন্তু সে যদি বিয়ে করে পিউর বাসায় উঠতো তবে জেসমিন আরা কেন মিজান সাহেব নিজেও অক্কা পেত নির্ঘাত।
______________
স্বচ্ছর পাশে পিউ চুপ হয়ে বসে আছে। চুপ মানে একেবারেই চুপ। কেনো নড়াচড়া নেই। স্বচ্ছ অনেকক্ষণ নীরব থেকে পিউকে খেয়াল করে। বুঝতে পারে স্থির পিউর মনের ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। আলতো করে ওর হাত ধরলে নড়ে ওঠে পিউ তবে চোখ তুলে তাকায় না। ওভাবেই বসে থাকে। গাল বেয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
পিউর নরম হাতটি শক্ত মনোবলে ধরে রাখে স্বচ্ছ। কোনো কথা বলে না দুজন। মাঝে মাঝে একজনের মনের কথা অন্য জনের বুঝে নিতে হয়। কোনো বাক্য বিনিময়ের দরকার পড়ে না।
বিদায় বেলা দুজনার ডাক এলে আহমেদ সাহেব স্বচ্ছকে বুকে জড়িয়ে রাখেন অনেকক্ষণ ।
জেসমিন আরা পিউকে সামনে এগিয়ে দিলে আহমেদ সাহেব নিজ কন্যাকে সময় নিয়ে দেখেন। যেন কতদিন পর এ মুখটি দেখছেন। কপালে চুমু খেয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরেন। নিরবে বাবা মেয়ে কাঁদে। বাকিরা সরে আসে। মেয়ের গালে দুহাত রেখে বলেন ভালো শ্বশুর বাড়ি পেয়েছিস। সুখী হ মামনী। পারলে বুড়ো বাপটাকে ক্ষমা করিস।
_______
ঘুমোতে এসে নিজ বিছানায় গা এলিয়ে জেসমিন আরা বলেন, পিউ মেয়েটা মনে হয় ভালোই, কি বলো?
-হুম।
-ওর মতোই ওর বাবাও ভালো মানুষ, তাই না?
-হুম, তাই তো মনে হলো। তবে খায় বেশি।
জেসমিন আরা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলেন, আবার ছোটলোকি করছো?
-কি করে ভুলি আমার সাধের হাঁস বেটা একাই সাবাড় করতে চলেছিল।
_______
পিউ জামা কাপড় বদলে বিছানায় শুতে আসে।
স্বচ্ছ জিজ্ঞেস করে, ঘুমিয়ে যাবে এখনি?
-না, বিকালে শুয়েছি তো, এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না।
-পিউ!
-হুম!
-এখানে কেমন লাগছে?
-ভালো।
-আব্বু আম্মু?
-অনেক ভালো।
-আর আমি?
-… ভালো।
-গতকাল এই সময়ে আমাদের বিয়ে হয়েছে।
-হুম।
-আমি জানতাম না তোমার বিয়ে হচ্ছিল। ফাইজা জানায় নি আমাকে।
-ফাইজা আপু তো দেশে নেই। নিজেও জানে না। তাছাড়া জানলে কী করতেন?
-হয়তো ……. থেমে যায় স্বচ্ছ। মন যা চায় আসলেই কি তা করতে পারত? পিউকে উল্টো প্রশ্ন করে, আমি যদি না যেতাম তবে তুমি কী করতে?
-সেকেন্ড অপশনে কল দিতাম।
-এতো অল্প সময়ে কেউ আসতো না।
-কেউ না কেউ তো আসতো। আপনিও তো এসেছেন।
-তোমার কয়টা অপশন ছিল?
-পাঁচ টা।
-তাদের নাম কী?
নিশ্চুপ।
-আমি চিনি তাদের? বলো পিউ। আমি জানতে চাচ্ছি।
-কি দরকার? মন খারাপ করবেন।
-কেন, মন খারাপ করবো কেন? তোমার অপশনে কি মাহিন ছিল?
-নাহ, ও তো একটা L ছেলে।
– ‘L মানে?
-লুইচ্চা।
-তাহলে আর কার নাম ছিল?
-আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমালাম।
-তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো, পিউ।
-হ্যাঁ যাচ্ছি।
-কেন?
-আপনি ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন।
পিউ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।
-পিউ, আমি খুব সাধারণ ছেলে। এখনও ছাত্র। আমার নিজের কোনো টাকাপয়সা নেই। আমার পরিবারও তোমাদের মতো বিত্তশালী নয়। তুমি আমাকে জেদের বশে বিয়ে করেছো কি?
নিশ্চুপ।
-প্লিজ উত্তর দাও, পিউ। আমি জানতে চাচ্ছি।
নিশ্চুপ।
পিউর উত্তর না পেয়ে দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে স্বচ্ছ প্রশ্ন করে, আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো তুমি?
পিউ ওপাশ ফিরেই বলে, আমি কিন্তু সর্বপ্রথম আপনাকেই কল করেছি। সো… গুড নাইট।
স্বচ্ছ চুপ হয়ে বসে থাকে।
বিড়বিড় করে বলে, সর্বপ্রথম হতে চাই না আমি । একমাত্র হতে চাই।
চলবে।।