দমকা হাওয়া পর্ব-০৪

0
831

#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-৪

পিউ এবং জেসমিন আরা দুজনই আরাম করে ঘুমোচ্ছে। স্বচ্ছ ড্রইং রুমে অস্থির মনে পায়চারি করছে। পিউ যদি মায়ের আগে উঠে তবে কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে।

পিউর মোবাইল ভাইব্রেশন দিচ্ছে । এ নিয়ে তিনবার। স্বচ্ছ হাতে তুলে দেখে ‘আব্বু’ লিখা।
কল ধরতেই ওপাশ থেকে করুন কণ্ঠ শোনা গেল, এখনও রেগে আছিস আব্বুর উপর? মাফ করে দে না অসহায় বাবাটাকে। আমি বুঝিনি নয়ন এমন কাজ করবে।
-আঙ্কেল আমি স্বচ্ছ, পিউ ঘুমোচ্ছে।
-ও স্বচ্ছ, কেমন আছো বাবা?
-জ্বি ভালো?
-আমার মেয়েটা কেমন আছে … বলেই তিনি কেঁদে ওঠেন।
-আঙ্কেল, পিউ ভালো আছে। ওকে ডেকে দেবো?

-না না, ঘুমোচ্ছে যখন থাক। এমনিতেই মেয়েটা অভিমান করে আছে। আমি এতো অসহায় অবস্থায় পড়েছি যে কি বলবো।
জানি আমি মস্তবড় ভুল করেছি। কিন্তু আমি তো জেনেশুনে এমন করি নি… ছেলেটা এমন করবে, ভাবি নি। তুমি কিছু মনে করো না বাবা। সব তো জানোই।
কিছুক্ষণ থেমে তিনি কাতর কণ্ঠে বললেন, পিউ আমাকে তোমাদের এখানে আসতে মানা করেছে। তবু গতকাল তোমাদের পেছন পেছন আমি ঠিকই এসেছিলাম। পিউকে বলোনা প্লিজ। মন মানছিল না।
-আঙ্কেল, এখন চলে আসুন। খুব দূর তো নয়।
-মেয়েটা রাগ করবে যে।
-আমি বুঝিয়ে বলব। আপনি চলে আসুন।
-সত্যি আসবো।
-অবশ্যই আঙ্কেল।
স্বচ্ছ এপাশ থেকেই বুঝতে পারছে পিউর আব্বুর উৎফুল্লতা। আমি আসছি বাবা এক ঘণ্টার মধ্যেই আসছি।
ফোন রাখার পর স্বচ্ছর মাথায় বাজ পড়ে। জেসমিন আরা উঠে এ খবর শুনলে অস্থির হয়ে স্বচ্ছকেই বকাঝকা করবে। কিন্তু এখন জাগালে মাথা ধরে যাবে নিশ্চিত। কি করবে ভেবে ফ্রিজ খুলে দুটো মুরগী ভিজায়, গরুর মাংস ছিল তাও ভিজায়।জেসমিন আরা উঠে অন্তত তাড়াতাড়ি রান্না চরাতে পারবে।
পেঁয়াজ কেটে কাজ এগিয়ে রাখতে হবে। স্বচ্ছ ওভাবেই হাত চালায়।
__________
জেসমিন আরা ঘুম ভেঙে পিউকে পাশে শুয়ে থাকতে দেখে খুশি হন। অজান্তেই পিউর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে চা চরাতে এসে দেখেন স্বচ্ছ ঘেমে নেয়ে পেঁয়াজ কাটছে।
-কি রে, এতো পেঁয়াজ কাটছিস কেন?
-আম্মু, পিউর আব্বু আসছে কিছুক্ষণের মধ্যে।
-কী? চেঁচিয়ে ওঠেন জেসমিন আরা। এখন? এতো অল্প সময়ে কী করবো? ঘরে তো মুরগীও নেই।
— আছে তো। আমি ভিজিয়ে দিয়েছি, সাথে গরুর মাংসও ভিজিয়েছি।
— মুরগী কোথায় পেলি? দেখি! আরে এগুলো তো হাঁস।তোর বাপকে মুরগী আনতে বলেছিলাম এনেছিল হাঁস। গরু এতো জলদি কি আর হবে। উফ! কি যে করি। আমারই ভুল হয়েছে। হুট করে যেমন বিয়ে করেছিস মেহমান তো হুট করে আসবেই। কেন একবারও মাথায় এলো না?

পিউ উঠে এসে কিচেনে উঁকি দিলো।
-মা এখন আবার রান্না করবেন? দুপুরের খাবার আমরা সব খেয়ে ফেলেছি?
— আরে কি বলে বোকা মেয়ে! তোমার আব্বু আসছে। তাই তো তাড়াহুড়ো করছি।
–আব্বু কেন আসবে? আমি তো উনাকে বলেছি সাতদিন আমি উনার মুখ দেখবো না।
জেসমিন আরা অবাক হয়ে স্বচ্ছর দিকে চেয়ে বলেন, এই মেয়ে কি বলে এসব?

স্বচ্ছ বলল, পিউ আঙ্কেলের উপর রাগ করে আছে।

–ডাস্টবিনে ফেল তোর রাগ, রাগ করলে কি বাপের মুখ দেখতে হয় না? তাহলে তো রাগ করে তোদেরকে গতকাল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া উচিত ছিল আমার। এই মেয়ে খবরদার বাবার সামনে রাগ দেখাবে তো।
পিউ দাঁত বের করে হাসি দেয়।
জেসমিন আরা অস্থিরতার মাঝেও থেমে যান। পিউর হাসি তো বেশ মিষ্টি! এই প্রথম হাসলো কি মেয়েটা?
– স্বচ্ছ রুমগুলো গুছিয়ে নে জলদি। ভালো কাপড় পর।

পিউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে জেসমিন আরা দ্রুত গতিতে রান্নাঘরে কাজ করছে। স্বচ্ছ ঝাড়ু নিয়ে সোফা ঝাড়ছে। শোপিসগুলো ঠিক করছে। কি ব্যস্ততা তাদের!
-মা, আমি কি করবো?
-তোমার নতুন আব্বুকে কল করে বলো ফেরার পথে মুরগী কিনে আনতে। তাড়াতাড়ি বসিয়ে দেবো।
-আচ্ছা!
তখনই কলিং বেল বাজলো। জেসমিন আরার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুই রান্না হয় নি। ঘরের জামা পরে আছেন। নতুন মেহমানের সামনে এভাবে যাবেন? কিভাবে কি হবে এখন?
স্বচ্ছ দরজা খুলে দেখে মিজান সাহেব এসেছে।
জেসমিন আরা খুশি হয়ে বলেন, তুমি এসেছো, জলদি দুটো মুরগী কিনে আনো।
— কেন?
— পিউর বাবা আসছে।
ততোক্ষণে হাঁস ভুনার সুবাস পেয়ে মিজান সাহেব জিজ্ঞেস করেন, হাঁস রান্না হচ্ছে নাকি?
-হ্যাঁ, ঘরে তো মুরগী নেই। তাই হাঁসদুটো রাঁধছি সাথে গরুর মাংস।
-দুটো হাঁসই রেঁধে ফেলছো?
-নয়তো কি? এতো ছোট ছোট হাঁস!
-তাই বলে দুটোই করতে হবে। রয়ে সয়ে খেতে চেয়েছিলাম।
-কি ছোটলোকী কথাবার্তা! ঘরে মেহমান আসছে আর তুমি পিউর সামনেই ছোটলোকি দেখাচ্ছো।
পিউ দুষ্টু হেসে বলে, আমার আব্বু তো হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করে। একটা পুরোই তিনি খেয়ে ফেলবে। আপনি ভাগে নাও পেতে পারেন আব্বু।
মিজান সাহেবের মুখটা ছোট হয়ে যায়। ব্যথিত মনে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ান।
-কোথায় যাচ্ছো? বললাম না মুরগী কিনে আনো।
-পারব না। যার শ্বশুর আসবে তাকে আনতে বল।
-দেখো, ঝামেলা করবা না। এখনি যাও। তুমি কি চাও স্বচ্ছ মুরগী হাতে শ্বশুরের সামনে পড়ুক?

মিজান সাহেব গজগজ করে বেরিয়ে পড়েন।
স্বচ্ছ এসে বলে, আম্মু ঘর গোছানো শেষ। আর কি করবো?
-তুই তৈরী হয়ে নে। পিউ তুমিও তৈরী হও।
-আমি কেন তৈরী হবো?
-আমি বলছি তাই। তোমাকে ব্যাখা দিয়ে বোঝানোর আমার এখন সময় নেই। যাও। শাড়ি পরো গিয়ে।
-শাড়ি? কোন শাড়ি পরবো?
-যেকোনো একটা।
-আপনি বাছাই করে দিন।
-আল্লাহ মাফ চাই । তুমি অন্য কিছু পরো। এই স্বচ্ছ, এই মেয়েকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যা। আমার কাজ এগুচ্ছে না।
পিউ হেসে আবার জেসমিন আরার গালে চুমু দিল।
জেসমিন আরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, বুঝেছি এবার যাও।

পিউ রুমে ঢুকলে স্বচ্ছ দরজা বন্ধ করে দেয়।
-বসো পিউ। কথা আছে।
-বলুন।
-বলুন না বল। তুমি করে বলবে আমাকে।
– আচ্ছা।
-শোনো, আঙ্কেলের সাথে কোনো রাগারাগি করবে না।তিনি কান্নাকাটি করছিলেন। এখানে কান্নাকাটি করলে আম্মু আব্বু তোমার উপর রাগ করবে।
-আমি কখনো কারো সাথে রাগারাগি করি না। তবু সবাই এমন ভাবে।
-ভালো। পরিবারের সাথে রাগারাগি করা উচিতও নয়।তুমি তৈরী হয়ে নাও।
-আমাকে কেন তৈরী হতে হবে? আজব!
স্বচ্ছ থেমে বলে, তুমি কি খারাপ আছো এখানে?
-না।
-তাহলে ভালো আছো বোঝাতেও নিজেকে সাজাতে হয়। ঘরের জামায় এলোমেলো চুলে তোমাকে দেখে তোমার আব্বুর মন খারাপ হবে। ভাববে কোথায় মেয়েটার বিয়ে হলো। এতে আমরা অপমানিত হবো। তুমি কি তাই চাও?
-না।
-তাহলে তৈরী হও।
-কি পরবো?
-শাড়ি পরো।
-আমি পরতে পারি না।
-তাহলে কামিজ- ওড়না পরো।
-কোনটা পরবো?
-আমি বাছাই করে দিচ্ছি দাও।
বিশাল ট্রলিটি আবার খোলা হলো। আবার সেই মহাসাগরে ডুব দিল পিউ।
স্বচ্ছ পিউর পাশে বসে বলল, সরো। কিছু কাপড় আমি আলমারিতে তুলে রাখছি। এভাবে কিছুই খুঁজে পাবে না তুমি। আমাকে করতে দাও।
পিউ সরে দাঁড়ালো।
ভাজ করা কিছু কাপড় সরাতেই পিউর অন্তর্বাসগুলো স্বচ্ছর হাতে চলে এলো। জলদি তা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল স্বচ্ছ।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, এক কাজ কর, তুমি বরং ব্যাগ থেকে একটা একটা করে কাপড় দাও আমার হাতে, আমি আলমারিতে তুলে রাখছি। পরে আম্মু সুন্দর করে তোমাকে গুছিয়ে দেবে।
পিউ ওভাবেই হাত চালায়। ওর জন্য একটা হলুদ কামিজ ওড়না পছন্দ করে দেয় স্বচ্ছ।

ওয়াসরুম থেকে হলুদ জামা পরে বেরুলে চোখ জুড়িয়ে যায় স্বচ্ছর। বিড়বিড় করে বলে, কবুল পড়া বউ!.
— কি?
— কিছু না। তোমাকে সোনালু ফুলের মতো স্নিগ্ধ লাগছে।
— মানে বান্দর লাঠি?
— ছিঃ! আমি কি তাই বললাম?
–হুম, সোনালু ফুলকে দিলু ফুপির দেশের মানুষ বান্দর লাঠি বলে।
— এরজন্যে তোমাকেও এমুহূর্তে সেকথা বলতে হলো?
— মনে হলো তাই বললাম।
— সব কথা সব জায়গায় বলতে হয় না। তুমি সাজবে না?
–গরম লাগছে অনেক।
–একটু সাজো।
পিউ আবার ট্রলি খুলে হাতরে বেড়ায় তবে এবার সাথে সাথেই ছোট একটা ব্যাগ পেয়ে যায়। ওটা নিয়ে বের হতে নিলে স্বচ্ছ বলে, আবার কোথায় যাচ্ছো?
-মায়ের রুমে।
-কেন? এখানেও আয়না আছে। এখানে সাজো।
পিউ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দেয়। চুল আচড়ানোর সময় আয়নাতে স্বচ্ছর সাথে চোখাচোখি হয়।
স্বচ্ছ ঝটপট চোখ সরিয়ে নেয়। পর মুহূর্তে ভাবে কেন চোখ সরালো? তার বউকে সে দেখতেই পারে।

চলবে।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে