দমকা হাওয়া পর্ব-০৩

0
836

#দমকা_হাওয়া
#পর্ব-৩

জেসমিন আরা সোজা হয়ে শুয়ে আছেন সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে। মিজান সাহেব বেতালে নাক ডেকেই যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে লোকটাকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিতে। সংসারে এতোবড় প্রলয় এলো অথচ লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই। পেট পুরে কাচ্চি রেজালা খেতে পেয়েছে বাস, জীবন ধন্য! একমাত্র ছেলে এমন অঘটন করল তাতে এ লোকের কিচ্ছু যায় আসে না।
এদিকে মনের ভেতর উথালপাথাল সুনামী চলছে, এ অবস্থায় শুয়ে থাকা অসম্ভব। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জেসমিন আরা। চোখ ফেটে জল বেরুচ্ছে। স্বচ্ছ কী করে পারলো? কবুল বলার সময় মায়ের কথা একটিবারও মনে পড়লো না? মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেল। হুট করে এক মেয়ে উড়ে এসে মায়ের আদরের সন্তানকে মুহূর্তে কেড়ে নিলো। কি করে মেনে নেবে জেসমিন আরা? একটা ডানা কাটা পরী দেখে ছেলেটা মোহিত হয়ে গেল? একবারও ভাবলো না মানুষ রূপী নাগিন তুলে আনছে ঘরের মাঝে।
জেসমিন আরা শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন যেন বিশাল কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
এই মেয়ে যাদু জানে। নিশ্চিত জাদু জানে। নইলে তিনি নিজেও কেন এতো বড় ঘটনায় কোনো গণ্ডগোল করতে পারলেন না? সব এ মেয়ের জাদু মায়া। ভয়ংকর মায়া! সবাই এ মায়ায় ছাড়খার হবে। এই মেয়ে স্বচ্ছকে ধ্বংস করতে এসেছে।
নাহ্ বুক ব্যাথা বাড়ছে। সংসার ভাঙতে সময় লাগবে না। কি করে সামলাবেন তিনি? অস্থির মনে পায়চারি করেন । রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি খান। ঘুমাতে হবে। এসময় শরীর দূর্বল করলে চলবে না। নাগিন মেয়ে সুযোগ বুঝে সংসারে বিষাক্ত ছোবল মারবে। না না, তা হতে পারে না।
স্বচ্ছর রুমের দিকে তাকালে দেখেন দরজা হালকা হাঁ হয়ে আছে। রুমে এসি চলছে অথচ দরজা খোলা। স্বচ্ছ তো এমন দায়িত্বহীন কাজ জীবনেও করেনি। নিশ্চয়ই এই মেয়ে খোলা রেখেছে। বড়লোকের মেয়ে টাকা পয়সার মূল্য দিতে শিখে নি।
জেসমিন আরা দরজা টেনে দিতে গিয়ে কৌতুহল চেপে রাখতে পারলেন না। মনের মাঝে যুক্তি দাঁড় করালেন এতোদিন অবাধে ছেলের রুমে আসা যাওয়া করেছেন। হঠাৎ প্রাইভেসি দিতে হবে কেন? তাছাড়া দায়িত্বহীনের মতো দরজা খোলা থাকলে মা দায়িত্ব নিয়ে দরজা লাগাতেই পারে। তখন একটু আধটু নজর এদিক সেদিক হতেই পারে।
রুমের হালকা আলোয় দেখতে পেলেন পিউর শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট সুন্দর করে একপাশে ভাজ করে রাখা। ট্রলিব্যাগ জায়গা মতো দাঁড় করানো। গহনাগুলো সাজানো সাথে গোলাপগুলো সারিবদ্ধ ভাবে রাখা। যাক, মেয়েটা বড়ঘরের হলেও জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখতে জানে। বিছানার দিকে তাকাবেন না ভেবেও অপরাধী চোখে চেয়ে আৎকে উঠলেন । পিউ কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিশাল জায়গা জুড়ে শুয়ে আছে। স্বচ্ছর কোলবালিশটাও ওর দখলে। আর স্বচ্ছ কিনা কাঁথাবিহীন, কোল বালিশ ছাড়া দেয়ালের সাথে টিকটিকির মতো চিটকে আছে। জেসমিন আরার চোখ আবার ভিজে আসে।
কেন এমন করলি স্বচ্ছ? তোর নিজের হাল ই তো বেহাল! কেন হুট করে বিয়ে করে ফেললি? এ মেয়ে তোকে কোনোদিন শান্তি দিবে না। কেন বুঝলি না?

____________
ভোরে নাশতার টেবিলে সবাই উপস্থিত হলেও পিউ এলো না। জেসমিন আরা গম্ভীর মুখে স্বচ্ছকে প্রশ্ন করলেন, পিউ ঘুম থেকে ওঠে নি?
-না আম্মু।
-তুই ডাকিস নি?
-ওকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। আজ না হয় ঘুমাক পরে…
-তোর তো দেখি একদিনে দ্বিগুণ সাহস বেড়েছে। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে পণ্ডিত মনে করছিস? আমার উপর কথা বলা শিখে গেছিস? আমার বাসার রুলস সবার বেলায় এক। ওকে আসতে বল।
স্বচ্ছ উঠে পিউকে ডাকলে কিছুক্ষণ পর ঢুলতে ঢুলতে ডাইনিংয়ে এসে বসে পিউ।
পুত্রবধূকে ট্রাউজার টিশার্টে দেখে মিজান সাহেবের হাসি চলে আসে। দুপাশে খোলা চুলে চশমা চোখে মূর্তির মতো বসে আছে মেয়েটা। বড্ড মায়া হয় মিজান সাহেবের।
জেসমিন আরা পিউকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ঘুম কেমন হয়েছে?
-জ্বি আন্টি ভালো।
বিড়বিড় করে বলেন , ভালো হওয়ার ই কথা।
-পিউ, তোমাকে কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শোনো। আমি আমার সংসার নিয়মশৃঙ্খলায় মধ্যে চালিয়েছি এবং সবাই তা মেনে চলেছে। তোমাকেও তা মানতে হবে।
পিউ মাথা হেলিয়ে সায় দিল।
– খাবার সময় সবাই একসাথে বসে তুমিও বসবে।
– আচ্ছা।
-স্বচ্ছ কখনো পেছনে ঘুমোয় নি। ওকে পেছনে দেবে না।
-আচ্ছা।
-স্বচ্ছর রুমের আলমারির একসাইড খালি করে দেবো, তুমি সেদিকে তোমার কাপড় রেখো। স্বচ্ছর দিকটা আমি গুছিয়ে রাখি। ওটা ওভাবেই থাকবে। একদিনে সব নিজের দখলে নিতে যেও না। ঠিকআছে?
– জ্বি।
-আমার ঘরের সব কিছু টিপটপ থাকে। তুমি তোমার শাড়ি কাপড় সব গুছিয়ে রেখেছ দেখে ভালো লাগলো।
পিউ চমকে তাকায়। সে তো কাপড় গোছাতে জানে না। গতকাল গোছায়ও নি। তবে কি স্বচ্ছ গুছিয়ে রেখেছে? আড়চোখে চেয়ে দেখে, স্বচ্ছ নির্বিকারভাবে খাচ্ছে।
জেসমিন আরা আরো বললেন, স্বচ্ছর সেমিস্টার ব্রেক চলছে বলে ভেবো না সে ঘরে ফ্রি বসে আছে। একটা অনলাইন কোর্স করছে। মনোযোগ দিয়ে নিরিবিলি পড়তে পছন্দ করে স্বচ্ছ। ওর সাথে সময় অসময়ে গল্প জুড়ে দিও না। আমি তা পছন্দ করবো না। আমার পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত আমি নেই সবাই তা মেনে চলে, আজ থেকে তুমিও মেনে চলবে। ঠিকআছে?
পিউ জোরে শ্বাস টেনে বললো, আন্টি তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমি সবসময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। এখন থেকে আমার সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে আপনি সাহায্য করবেন। আর স্বচ্ছ ভাইয়ার কাপড় যেমন আপনি গুছিয়ে রাখেন তেমনি আমার কাপড়ও গুছিয়ে দিলে ভালো হবে। আসলে আমি কখনো কাপড় গোছাই নি। তবে আমি আপনার কাছ থেকে শিখে নেব।
বিছানার সামনে বা পেছনে ঘুমানো নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আই মিন আমি জানি না আদৌ আমার সমস্যা আছে কিনা। কখনো কারো সাথে বেড শেয়ার করি নি।
আপনি বললেন না স্বচ্ছ ভাইয়াকে ডিসটার্ব করতে না। আমি উনার রুমে আর যাবোই না, আপনি বললে আমি না হয় অন্য রুমে ঘুমাবো।
জেসমিন আরা পিউর দিকে চেয়ে মনে মনে ধমক দিলেন। এই মেয়ে পুরোই চালু! কি সুন্দর যা বলছি তার দ্বিগুণ মেনে চলবে বলছে। ফাজিল একটা!
–তোমাকে যতটুকু বলছি ততোটুকু করো। অতি ভালো তোতাপাখী হওয়ার চেষ্টা করো না। আমি খুব কড়া মানুষ। আমার রুলস ভাঙ্গলে সবাই শাস্তি পায়। বুঝলে? আর আজ থেকে আমাদের আঙ্কেল আন্টি ডাকবে না। আম্মু, মামনী, মা, আব্বু, বাবা যা ইচ্ছে ডেকো।
পিউ হঠাৎ জেসমিন আরারকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেলো।
মিজান সাহেব হা হয়ে গেলেন। স্বচ্ছ কি ভেবে নিজেই লাল হয়ে গেল।
জেসমিন আরা মোটেও এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কি রেগে যাবেন, নাকি গম্ভীর হয়ে থাকবেন বুঝতে না পেরে মৃদু কণ্ঠে সরো বলে উঠে কিচেনে চলে গেলেন।
_______
নাস্তা শেষে মিজান সাহেব অফিস চলে গেলেন। স্বচ্ছ নিজ রুমে। পিউ কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে ড্রইংরুমে টিভি ছেড়ে বসলো।
কিচেন থেকে জেসমিন আরা উঁচু গলায় বললেন, ভলিউম কমায় পিউ, স্বচ্ছর ডিসটার্ব হবে।
পিউ টিভি বন্ধ করে কিচেনে ঢুকলো।
রুবিনা ফুপি ও দিলু ফুপি ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে অপরিচিত পরিবারে যাচ্ছো, শাশুড়ীকে সবসময় খুশি রাখবে, পারো না পারো তার কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করবে।
পিউ কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আন্টি আপনাকে সাহায্য করি?
-তুমি সাহায্য করবে? পারো কিছু?
-জ্বি না, তবে আস্তে আস্তে শিখে নেব।
-পেঁয়াজ কাটতে পারবে? আজ বুয়া আসবে না। সবকিছু আমাকেই করতে হবে।
-পারবো আন্টি। পেঁয়াজ কোথায় আছে?
-ওপাশে রেকের নীচে।
-কটা পেঁয়াজ নেবো?
-ছয় সাতটা নেও।
-কি দিয়ে কাটবো?
-তোমার যেটায় সুবিধা।
-আমি তো জানি না কিভাবে কাটতে হয়, কি দিয়ে কাটতে হয়।
জেসমিন আরা চাল ধুচ্ছিলেন। মুখ তুলে পিউর দিকে তাকালেন।
-থাক বাদ দাও। আমি করে নেবো।
-আন্টি তাহলে অন্য কিছু করি?
-তুমি কি পারো ওটা বল।
-আমি তো কখনো কিচেনে তেমন ঢুকি নি। কি পারি বা পারবো নিজেও জানি না।
-ওহো, মায়ের অতি আদরের বুঝি?
-জ্বি না।
-জেসমিন আরা থেমে গেলেন। অবাক চোখে বললেন, মায়ের আদরের না বলতে চাইছো?.
-জ্বি।
-কেন?
-বললে আপনি মন খারাপ করবেন।
-গতকাল আমার ছেলে যে ঘটনা ঘটিয়েছে এর চেয়ে মন খারাপ করার মতো কোনো কিছু আমার জীবনে আর নেই।
পিউ মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। তা দেখে জেসমিন আরা বললেন, দেখো পিউ, যা সত্যি আমি তাই বললাম। একমাত্র ছেলের এমন অপ্রত্যাশিত কাজে যে কোনো মা-ই দুঃখ পাবে। আমার তো হার্ট এ্যাটাক করে মরে যাওয়া উচিত ছিল। কেন এমন হলো না জানি না। হয়তো এতোটা বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে যে আমি পাথর হয়ে গেছি।
বাদ দাও, তোমার কথা বলো। কেন তোমার মা তোমাকে আদর করে না?
-আমার মা বেঁচে নেই। আমার জন্মের সময় মারা গেছে। আব্বু ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে ছিল। আম্মুর মৃত্যুতে তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবে তাই আর বিয়ে করেন নি। আমি রুবিনা ফুপি ও দিলু ফুপির কাছে বড় হয়েছি।
-ওহ্,!
জন্ম হতে মাতৃহারা সন্তানের প্রতি পৃথিবীর যে কোনো মায়ের মমতা জেগে ওঠে। জেসমিন আরা তাদের থেকে ভিন্ন নয়। পিউর কথায় মন বিষন্ন হয় তার। কোনো পুরোনো ক্ষত চোখের কোণে জল এনে দিল। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তোমার ফুপিরা তোমাদের সাথেই থাকে?
-না, ওরা আসলে আমাদের নিজের কেউ না। তবে অতি আপন। দিলু ফুপির স্বামী মারা যাওয়ায় শ্বশুর বাড়ির মানুষেরা তাকে তার মেয়েসহ তাড়িয়ে দিয়েছিল আর রুবিনা ফুপির বাচ্চা না হওয়ায় তালাক হয়ে গিয়েছিল। দিলু ফুপির স্বামী আব্বুর অফিসের কর্মচারী ছিলেন। অন্যদিকে রুবিনা ফুপি নিজেই চাকরী করতেন অফিসে। আব্বু দিলু ফুপিকে বাসায় এনে আমার দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। তার দু বছর পর রুবিনা ফুপি আমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন। তখন থেকেই তারা আমাদের সাথে। দিলু ফুপির মেয়ের বিয়ে হয়েছে, এখন অস্ট্রেলিয়া থাকে।
-বুঝলাম, তোমার ফুপিরা তোমাকে অনেক বেশি আদর করে। তবে কোনো কাজ না শিখিয়ে তারা পঁচা কাজ করেছে। নিজের কাজ নিজে করা ভালো। এ বাসায় সবাই তাই করে। তুমিও আশা করি শিখে যাবে যদি তোমার স্বদিচ্ছা থাকে।
-জ্বি আন্টি, আমি পারবো।
-এখনও আন্টি ডাকছো?
-আসলে কি ডাকবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। প্রথম মা ডাকবো কাউকে তাই সেটা যেন স্পেশাল কিছু হয় তাই সময় নিচ্ছি।
জেসমিন আরা হেসে ফেলেন।
-এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। মা বলেই ডেকো। আত্মার মিল হলে যেকোনো সম্মোধন ই মধুর হয়। যাও গিয়ে টিভি দেখো।
জ্বি আন্টি বলে পিউ আবার জেসমিন আরাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল।
জেসমিন আরা ঘামে জর্জরিত গাল মুছে ভাবলেন এ- তো দেখি আধ পাগলী মেয়ে!

স্বচ্ছ স্ট্যাডি টেবিলে বসে পড়ায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বার বার দরজার ফাঁক দিয়ে পিউকেই দেখছে। মেয়েটা একবারের জন্যও এদিকে তাকাচ্ছে না। টিভির দিকে চেয়ে আছে। দুবার ওয়াসরুমে গেছে কিন্তু ডাইনিংয়ের পাশের কমন বাথরুমে। স্বচ্ছর রুমে আসে নি। স্বচ্ছর আজ বার বার গলা শুকিয়ে আসছে। এ নিয়ে চার বার ডাইনিংয়ে গিয়ে পানি খেয়ে এসেছে। প্রত্যেকবার অযথা গলা ঝেড়ে কেঁশেছে, হাঁটাহাঁটি করছে। লাভ হয় নি। আশ্চর্য মেয়ে! নিজ থেকে বিয়ে করেছে অথচ এমন ভঙ্গি করছে যেন স্বচ্ছকে চিনেই না।
পিউ উঠে জেসমিন আরাকে জিজ্ঞেস করলো, মা আমার চার্জার স্বচ্ছ ভাইয়ার রুমে। আমি কি তা আনতে পারি?
জেসমিন আরা অবাক হয়ে বলেন, আমি তো তোমাকে রুমে যেতে নিষেধ করি নি।
-আচ্ছা!
পিউ রুমে ঢুকলে স্বচ্ছ নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু মুখ তুলে তাকায় না। দম আটকে গেছে গলায়।
পিউ ট্রলি ব্যাগ খুলে কোণায় কানায় হাতড়ে বেড়ায়।
–কি খুঁজছ তুমি?
-চার্জার।
-এতোক্ষণ ধরে খুঁজছ?
-হুম পেয়ে গেছি। উঠে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে। ট্রলির চেইন খোলা রেখেই চলে যাচ্ছিল। ফিরে এসে তা বন্ধ করে জায়গা মতো দাঁড় করায়।
স্বচ্ছ আঁড়চোখে দেখে।
রুম থেকে বেরুতে নিলে স্বচ্ছ বলে, কোথায় যাচ্ছো?
-ড্রইংরুমে।
-কেন?
-এমনি।
-এখানে বসো।
-মা বকা দিবে। আমি যাই।
-তুমি শাওয়ার নিবে না? একটু পর আম্মু খেতে ডাকবে। তোমাকে গোসল বিহীন দেখলে বরং বকা দিবে।
-ওহো! পিউ আবার ট্রলি খুলে। এদিক সেদিক হাতড়ে বেড়ায়। যেন মহা সমুদ্রে ডুব দিয়েছে।
— আবার কি খুঁজছ?
— আসলে কোথায় কি আছে আমার জানা নেই।
— আমি সাহায্য করবো?
— না না পেয়ে গেছি।
একটা তোয়ালে আর টিশার্ট ট্রাউজার বের করে পিউ।
–তুমি আলমারির একপাশে কাপড় রাখতে পারো। বার বার ট্রলিতে খোঁজার দরকার পড়বে না।
— না না, ওটা পরে মা গুছিয়ে দেবেন।
–চাইলে আমিও গুছিয়ে দিতে পারি।
–না , মা রাগ করবেন তাহলে। .. আমি কি এ বাথরুমে শাওয়ার নিবো?
-এটা তো প্রশ্ন করার বিষয় না।
-কিন্তু মা…
–পিউ, আম্মু তোমাকে বাসার কিছু নিয়ম বলেছে। আমার রুমে ঢোকা, আমার সাথে কথা বলা বা আমার বাথরুম ব্যবহার করতে মানা করে নি। তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন? যাও শাওয়ার নাও।
পিউ শাওয়ার শেষে রুম থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার কাপড় কি আমাকেই ধুতে হবে?
–না, গেস্ট রুমের করিডোরে ওয়াশিং মেশিন আছে ওর পাশে ঝুড়িতে রেখে দাও। বুয়া আগামীকাল আমাদের কাপড়ের সাথে তা ধুয়ে দেবে। আর শোনো, এ বাসার মানুষদেরকে তুমি ভিন্ন গ্রহের মনে করছো কেন? কি সব অদ্ভুত প্রশ্ন করছো। একটু সহজ স্বাভাবিক হও আমরা সবাই ভালো মানুষ।
পিউ চুপ করে কথাটা শুনল, স্বচ্ছকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। ।
স্বচ্ছ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।
আশ্চর্য! এতো তাড়া কিসের মেয়েটার!
আরো কিছু কথা বলার ছিল। মনভরে দেখার বাকি ছিল।
শুনেছে ভেজা চুলে মেয়েদের অনেক স্নিগ্ধ লাগে। কিন্তু এই মেয়ে তো রীতিমতো বাইক স্ট্রাট দিয়ে মুহূর্তে গায়েব।
পুরো ঘর ভেজা চুলের সুবাসে মৌ মৌ করছে। ইচ্ছে হচ্ছে সুবাসগুলো হাতড়ে হাতড়ে নিজের বুকে পকেটে ভরে ফেলতে।
বিছানার ওপর পড়ে থাকা পিউর তোয়ালে দেখে বিজয়ের হাসি হাসে স্বচ্ছ।
ড্রইং রুমে পিউর সামনে এসে মৃদু কণ্ঠে বলে, বিছানার ওপর ভেজা তোয়ালে রেখে এসেছো কেন? মা দেখলে রাগ করবে। যাও এখনি বারান্দায় মেলে দাও।
পিউ ছুটে যাওয়ার পথে জেসমিন আরা ডেকে বলেন খেতে আসো পিউ। স্বচ্ছ, তুইও আয়।
স্বচ্ছর মুখ মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে যায়। আরেকটু পরে ডাক পড়েলে কি হত? কেবল রুমের দিকে যাচ্ছিল দুজন।
_______________
পিউ স্বচ্ছ পাশাপাশি বসে নীরবে খাচ্ছে।
জেসমিন আরা খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের পরখ করেন।
এটা কি প্রেমের বিয়ে? নাকি সত্যিই অঘটনে ঘটন?
দুজন তো ঠিকমতো কথাই বলছে না। এমন ভাবে চলছে যেন দুজন দুজনকে চেনেই না। অথচ পিউর লিস্টে প্রথম নাম ছিল স্বচ্ছর। ওটা না হয় মানা যায় বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় স্বচ্ছকে নক করেছে । কিন্তু স্বচ্ছ কেন দুম করে বিয়ে করে ফেললো? একটা স্বল্প পরিচিত মেয়ের প্রতি মানবতা দেখিয়ে একেবারে বিয়ে করে ফেলা বিশ্বাস যোগ্য নয়। কিছু তো গোলমাল আছে।
এটা অস্বীকার করার নয় দুজনকে পাশাপাশি বেশ মানিয়েছে। জেসমিন আরা চাইলেও কি এমন মোমের পুতুল চেহারার বউ খুঁজে পেতেন একমাত্র ছেলের জন্য?
পিউ খাবারের মাঝে বলল, স্বচ্ছ ভাইয়া, সবজির বাটিটা এগিয়ে দিন না।
জেসমিন আরা বললেন, ভাইয়া বলছো কেন?
পিউ মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিল, উনি তো আমাকে ভাইয়া ডাকতে বারণ করেনি।
স্বচ্ছ অবাক হয়ে বলল, তোমার সাথে আমার কথা হলো কোথায়? বারণ করার সুযোগ দিয়েছো তুমি? এ বাসায় এমন ভাবে ঘুরোঘুরি করছো যেন আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করে তুলে এনেছি।
-ছিঃ স্বচ্ছ! কেমন সুরে কথা বলছিস? ভদ্রতা কি ভুলে গেছিস?
–আমি কি করেছি? পুরো বাসায় আমি অপরাধী হয়ে আছি। অথচ পিউ…
পিউর চোখ কান্নায় ভরে আসে। স্বচ্ছ এমন রেগে যাবে সে কল্পনাও করেনি।

জেসমিন আরা নিজেও ছেলের এমন আচরণ দেখবেন ভাবেননি। বললেন, সবকিছুর জন্য সময় দরকার। পিউর হুট করে তোর সাথে বিয়ে হয়েছে। নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ একটু সময় তো লাগবে। এতো মেজাজ দেখানোর কি হলো? তোর অপরাধ অনুযায়ী আমি তোকে এখন পর্যন্ত কিছু কি বলেছি? তোর অপরাধের দায় পিউ নিবে কেন? পিউর উপর রাগ দেখাচ্ছিস কোন সাহসে? সরি বল পিউকে।

স্বচ্ছ নতমুখে সরি বলল। কিন্তু মনে মনে গাল ফুলালো, এক বার ভালোভাবে কথা বললে কী এমন ক্ষতি হতো? মেজাজ তো এমনি চড়ে নি। এক বারের জন্যও কি পাশে বসা গেল না? গতকাল থেকে কি পরিমান অস্থির হয়ে আছে মন কাকে বুঝাবে সে?

খাওয়া শেষে টেবিল গোছানোর দায়িত্ব নিল স্বচ্ছ। দুপুরে নিয়মিত একঘণ্টার ভাতঘুম দিয়ে ওঠেন জেসমিন আরা।
মনের মাঝে ক্ষীণ আশা ছিল জেসমিন আরা হয়তো পিউকে বলবেন স্বচ্ছকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এমন কিছু হলো না।
পিউ নিজ থেকে স্বচ্ছর কাছে আসতে পারত, কাজে সাহায্য করতে পারতো, একবার সরি অন্তত বলতো। স্বচ্ছ যদি সরি বলতে পারে, পিউ নয় কেন?
কিন্তু না, পিউ আবার টিভির সামনে গিয়ে বসেছে।
কাজ সেরে স্বচ্ছ পিউর কাছে গেল। মা যেহেতু ঘুমোচ্ছে এ সময়টুকু গল্প করা যাবে নির্দ্বিধায়। কাছে গিয়ে দেখে পিউ বাঁকা হয়ে বসে মাথা পেছনে ফেলে ঘুমোচ্ছে। কপাল গলা ঘেমে আছে।
হতাশ হয় স্বচ্ছ।
-পিউ ওঠো, এভাবে গরমের মধ্যে ঘুমোচ্ছ কেন? রুমে চলো, এসি অন করে দিচ্ছি।
পিউ ঘুম চোখে বলল, আচ্ছা।

স্বচ্ছ রুমে ঢুকে জানালা বন্ধ করে এসি অন করে। সময় গড়ালেও পিউ আসছে না বলে রুম থেকে বেরিয়ে দেখে পিউ নেই। পুরো ঘর খুঁজে শেষে মায়ের রুমের দরজা খুলে দেখে মায়ের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে পিউ।
স্বচ্ছর প্রচন্ড অভিমান হওয়ার কথা কিন্তু সে হেসে ফেলে। পিউর আজব আজব কথা ও কাজের কারণেই স্বচ্ছ তার প্রেমে পড়েছিল। আজ একটু পাশে পাওয়ার আশায় অযথাই মেজাজ চটে গেল। কোনো দরকারই ছিল না।
পিউকে নিজের করে পাবে তা কোনোদিন আশা করে নি স্বচ্ছ। নির্ঘুম রাতে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতো বুকের বা পাশ থেকে। বিত্তশালী বাবার আদরের রাজকন্যা পিউ। স্বচ্ছর মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কি করে পিউকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে?
অথচ আজ….
আচমকা ভালোলাগায় মুখ লাল হয়ে ওঠে স্বচ্ছর।
পিউ এখন আমার বউ…!

চলবে।।

ঝিনুক চৌধুরী।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে