#দমকা_হাওয়া
#পর্ব-১
-হ্যালো, স্বচ্ছ ভাইয়া বলছেন?
লাউড স্পিকারে নারী কন্ঠ শুনে জেসমিন আরা মুখ তুলে স্বচ্ছর দিকে তাকালেন।
স্বচ্ছ তাতেই কাচুমাচু খেয়ে গেল।
-জ্বি বলছি, আপনি কে?
-আমি পিউ। চিনেছেন? ফাইজা আপুর কাজিন। আপনি যাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন। সেই আমি। এবার চিনেছেন?
আকস্মিক এমন কথায় স্বচ্ছ তার মায়ের সামনে কাঁশতে শুরু করে।
ওপাশে পিউ বলে চলেছে, ভাইয়া আজ আমার বিয়ে ছিল। হয়নি। বর পালিয়েছে। আমাকে বিয়ে করতে চায় না চিঠিতে লিখেছে। আমার আব্বু আর বরের আব্বু মিলে বন্দুক হাতে গাধাটাকে খুঁজছে আর কিছুক্ষণ পর পর আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আমি বলেছি সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই আমি এতো কষ্ট করে সেজেছি আমার বিয়ে আজই হতে হবে। আপনি তো জানেন আমি সাজগোজ করা ওতোটা পছন্দ করি না।
এখন আসল কথা হলো আমি একটা লিস্ট করেছি বিয়ের পাত্রদের। লিস্টের প্রথম নামটি আপনার। আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে চান?
স্বচ্ছর মুখ মুহূর্তে ঘেমে লাল আপেলের মতো হয়ে গেল। তোতলার মতো বলল, ম.. ম.. মানে?
-মানে আপনি রাজি না থাকলে আমি দ্বিতীয় জনকে কল দেবো। কিন্তু আজ বিয়ে করেই ছাড়বো। বলেন আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান?
হাতের তালুতে কপালের ঘাম মুছে আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায় স্বচ্ছ।
জেসমিন আরা পাথর চোখে তাকিয়ে আছে স্বচ্ছর দিকে।
শক্ত হাতে স্বামী, ছেলে ও সংসার নিয়ন্ত্রণ করা জেসমিন আরা পিউর কণ্ঠে নিজের সংসারে ধেয়ে আসা তুফানের বিপদ সংকেত টের পেলেন যেন। মুহুর্তে স্বচ্ছর হাত থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরলেন।
-এই মেয়ে তুমি কি বলছো এসব?
–ওহ আন্টি, আসসালামু আলাইকুম! আন্টি আমি পিউ। আজ আমার বিয়ে…
— থামো! আমি সব শুনেছি। আমার ছেলেকে কি মনে হয় তোমার? তুমি বলবে আর আমার ছেলে হুট করে তোমাকে বিয়ে করে ফেলবে?
— জ্বি না আন্টি। আমি তা বলি নি। আমার মনে হয়েছে তিনি হয়তো আমাকে পছন্দ করেন। তাই…
— তোমার ভুল হয়েছে । স্বচ্ছ তোমাকে পছন্দ করে না। করলে আমি জানতাম। আমার একমাত্র ছেলে স্বচ্ছ। ওর সব খবর আমি রাখি। তাছাড়া আমার ছেলে দেখতে যেমন রাজপুত্রের মতো তেমন চলনে বলনে। সে মেধাবী ছাত্র, আইবিএ তে পড়ে। তোমার কেন মনে হলো আমার ছেলেকে তুমি কল দিয়ে বলবে, ওমনি সে লাফিয়ে লাফিয়ে তোমাকে বিয়ে করে ফেলবে?
— আন্টি আমিও ছাত্রী ও পাত্রী দুদিকেই ভালো। কোনো প্রেম ভালোবাসার রেকর্ড নাই। সবাই বলে আমি দেখতে পুতুলের মতো সুন্দর। জিজ্ঞেস করুন স্বচ্ছ ভাইয়াকে?
আমার আব্বু স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমি তার অতি আদরের একমাত্র কন্যা। বিয়ে বাড়ি হতে পালিয়ে যাওয়া আমার বরও যোগ্য পাত্র এবং ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু ওর অন্য একটা ঝামেলা আছে বলে পালিয়েছে। ওর কথা বাদ দেই। আন্টি, স্বচ্ছ ভাইয়া আমাকে বিয়ে করলে অসুখী হবে না।
— থামো তুমি। সুখী অসুখী বহুদূর। স্বচ্ছর বিয়ে নিয়ে আমরা এখনো ভাবছি না। সে এখনো ছাত্র। তোমাকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। তুমি দ্বিতীয় অপশনে যাও।
— আন্টি আপনি একবার স্বচ্ছ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো না?
— কেন জিজ্ঞেস করবো? তার উত্তর আমি জানি। আমার কথার বাইরে সে শ্বাস পর্যন্ত নেয় না। সেখানে তুমি কে?
— আচ্ছা ঠিক আছে আন্টি! আমি তাহলে দ্বিতীয় অপশনে যাই। খোদা হাফেজ। স্বচ্ছ ভাইয়াকে একটু ফোনটা দিবেন প্লিজ। উনাকেও খোদা হাফেজ বলে দেই।
স্বচ্ছর হাতে মোবাইল দিয়ে ছেলের ওপর আত্মবিশ্বাসী জেসমিন আরা দাম্ভিকতার সাথে নিজের রুমে চলে গেলেন।
________
— হ.. হ.. হ্যালো!
— আপনি তো তোতলা ছিলেন না স্বচ্ছ ভাইয়া। এমন করছেন কেন? যাক গে, খোদা হাফেজ। ভালো থাকবেন।
-পিউ শুনো….
-ভাইয়া সময় খুব কম আমার হাতে। যদি বিয়ে করতে চান তবে আপনাকে দশমিনিট সময় দিলাম সিদ্ধান্ত নেয়ার। এরমাঝে কল করে জানালে ডান নইলে আমি সেকেন্ড অপশনে যাচ্ছি।
পিউ লাইন কেটে দিলো। স্বচ্ছ তরতর করে ঘামছে। পিউর আজ বিয়ে ছিল! সেটা ভেঙেও গেছে অথচ স্বচ্ছ জানেই না?
ওকে জানাবেই বা কে? কেনই বা জানাবে? পিউর কি হয় স্বচ্ছ?
————
কলিং বেল বাজছে। স্বচ্ছর পড়ায় যেন ডিসটার্ব না হয় জেসমিন আরা নিজেই দরজা খুললেন।
মিজান সাহেব বাজার হাতে দাঁড়ানো। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি কোনো অপরাধ করেছেন।
— কি অঘটন করেছ মিজান?
— ইয়ে…. রাগ করো না প্লিজ… দুটো হাঁস কিনে ফেলেছি?
— কি, কেন? জেসমিন আরা চিৎকার করে উঠলেন।তোমাকে বলেছি মুরগী আনতে তুমি আনলে হাঁস? না করেছিলাম হাঁস আর এনো না। গরমের সিজনে কেউ হাঁস খায়?
— প্লিজ এটাই শেষ। কেন জানি খুব খেতে ইচ্ছে হলো। একদম ড্রেসিং করে আনা। তোমার কষ্ট হবে না। তোমার যেদিন মন চাইবে রান্না কর। ছোট ছোট দুটো হাঁস। রাজ হাঁস নয়।
জেসমিন আরা গজগজ করেন। মাথাটা এমনি ধরে আছে পিউ নামক আধপাগলী মেয়ের কথা শুনে। টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে খেয়াল করলেন স্বচ্ছর দরজা আধ খোলা। রুমে উকি দিয়ে দেখেন রুম ফাঁকা। কোথায় গেল ছেলেটা?
মোবাইলে কল দিলেন। হয়তো বাইরে হাঁটতে গেছে । আসার সময় প্যারাসিটামল আনতে বলবেন।
মোবাইল বাজছে কিন্তু রুমের ভেতর থেকে। মোবাইল রেখে স্বচ্ছ কোথায় গেল?
চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে। মুহূর্তে যা ভাবলেন তা ভাবা মোটেই যৌক্তিক নয়। স্বচ্ছ এমন কাজ করতেই পারে না।
জেসমিন আরা আনমনে পায়চারি দিতে শুরু করলেন।
মিজান সাহেব ডাইনিং এ খেতে বসে দেখেন গরম গরম গরুর মাংস বাটিতে। জেসমিন আরাকে খেতে ডাকলে তিনি বিড়বিড় করে বলেন তুমি খাও আমি স্বচ্ছ এলে খাবো।
– এতো রাতে স্বচ্ছ কোথায় গেছে?
— বুঝছি না। আমার টেনশন হচ্ছে। মোবাইলটাও নেয় নি।
মিজান সাহেব ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে গরুর মাংস নিজের পাতে তুলে আরাম করে খেতে শুরু করেন।
কলিংবেল বাজতেই জেসমিন আরা ছুটে দরজা খুললেন এবং যা আশা করেন নি তাই দেখতে পেলেন।
স্বচ্ছর পাশে পুতুলের মতো নিখুঁত চেহারার একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে লাল বেনারসি জড়ানো। গলায় কানে সাদা পাথরের গহনা। লম্বা চুল বেণী করা। কাজল আর লিপস্টিক ছাড়া মুখে কোনো মেকআপ নেই। অতি সাধারন সাজ। শাড়ি কর্পোরেট মেয়েদের মতো টান টান করে পরা, এক হাতে হাত ঘড়ি অন্য হাতে লাল কাচের চুড়ি আর নাকের উপর হেরি পটার শেইপের গোল চশমা।
এতোকিছু কেন খেয়াল করছেন জেসমিন আরা? তার উচিত চিরদুঃখী শাবানার মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠা। কিংবা রোজি আফসারীর মতো শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ফুঁপিয়ে ওঠা। জেসমিন আরা কোনো অপশনেই যেতে পারছেন না। শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।
স্বচ্ছ থেমে থেমে বলল, আম্মু.. আমি…
রাগে, দুঃখে, অভিমানে ফেটে পড়া জেসমিন আরা উল্টো ঘুরে নিজের রুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা আটকে দিলেন।
মিজান সাহেব খাবারে এতো মনোযোগী ছিলেন যে কি ঘটনা ঘটেছে তা টের পেলেন না। মা ছেলের মনকষাকষি চলছে ভেবে গরুর মাংস নির্ভিঘ্নে আরো দু পিস মুখে চালান করে দিলেন। তৃপ্ত মুখে চেয়ে বললেন, কি হয়েছে রে বাপ?
স্বচ্ছ বলল, বাবা আমি বিয়ে করে ফেলেছি। ওর নাম পিউ।
চলবে।।
ঝিনুক চৌধুরী।।