দখিনের জানলা পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
1063

#দখিনের_জানলা (পর্ব-৩০ এবং শেষ)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৬১.
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই চিনি একটা সংবাদ পেয়ে চমকে উঠেছে। বসার ঘরে নাকি আশফাকের বাবা-মা এসে বসে আছেন। চিনি তাদের সামনে গেলে সাথে আশফাক এবং তার আরো কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকেও দেখতে পেল। তাকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে আশফাকের বাবা-মা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তার কাছে আসার জন্য। আশফাকের মা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন হু হু করে। ক্ষমা চাইলেন সবাই মিলে চিনির কাছে। তবে কেউ তাকে ফিরিয়ে নিতে আসেনি। ক্ষমা চাইতেই এসেছে। আশফাকের বাবা সবচেয়ে বেশি দুঃখী ছিলেন। চিনি মেয়েটাকে শখ করে ছেলের বউ করেছিলেন। এত দুর্দান্ত ভালো মেয়েটির এত কষ্ট তার ছেলের কারণে সেটা তিনি মানতেই পারছেন না। আশফাকের আত্মীয় বলতে তার চাচা ফুফু আর মামারা। তারা সবাই ছেলের কাজের জন্য চিনির পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইলেন। সবশেষে আশফাক সামনে এলে চিনি ফিরেও তাকায়না। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। চমচম পুরোটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে দর্শন করে পরিস্থিতিটা। যাক! সায়ন ভাই কাজটা করতে পারল অবশেষে।

অফিসে এসেই চমচম সবার আগে ওয়াসিমের রুমে গেল। ওয়াসিম তাকে দেখে খুব লজ্জিত গলায় জানালো,

-‘আমি আসলে ভাবতেই পারছি না আশফাক কীভাবে এমন একটা কাজ করতে পারল! আমাকে পর্যন্ত বলেনি এসব ব্যাপারে।’

-‘ইটস্ ওকে স্যার। আপনি এত স্যরি হচ্ছেন কেন?’

ওয়াসিম একটু মেকি হেসে বলল,

-‘আসলে তোমার হঠাৎ এখানে আসা আর এমন গম্ভীর মুখটা দেখে ভেবেছিলাম যে এই ব্যাপারেই কিছু বলবে।’

চমচম আলতো হাসল। হেসে ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে রাখল টেবিলের উপর। আশফাক একটু ধারণা করে ফেলল যে ভেতরে কি থাকতে পারে। দ্রুত খাম খুলে ইস্তফা পত্রটা পড়ে বেশ বিচলিত গলায় বলল,

-‘আজরা, এটার জন্যে তুমি রিজাইন করছ? আমি সত্যিই অবগত ছিলাম না আশফাকের কাজকর্মের ব্যাপারে।’

-‘না স্যার, আমি অন্য কারণে রিজাইন করছি।’

-‘অন্য কারণ?’

-‘চাকরি করার ইচ্ছে আর নেই। এবার একমনে সংসার ধর্ম পালন করব। আমার হাজব্যান্ডও চায় আমি এখন আর যেন চাকরি না করি।’

ওয়াসিম এবার আশ্চর্যের সর্বোচ্চ শাখায় উঠে গেল। ধরা গলায় বলল,

-‘হাজব্যান্ড? তুমি বিয়ে কবে করলে আজরা!’

-‘আই হ্যাভ বিন ম্যারিড ফর ফোর মান্থস্ স্যার।’

ওয়াসিম যেন রে’গে গেল। টেবিলে থাবা দিয়ে বলল,

-‘উইদ হুম? হু ইজ ইউর হাজব্যান্ড?’

চমচম কাঁধে ব্যাগ তুলে নিতে নিতেই বলল,

-‘উইদ দ্য লাভ অব মাই লাইফ, আব্রাহাম চৌধুরী।’

ওয়াসিম বিস্ময়ের চোটে কিছু বলতে পারল না। চমচম আসি স্যার বলে প্রস্থান করল সেখান থেকে। অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতেই আব্রাহামের কল এলো তার ফোনে। রিসিভ করতেই আব্রাহাম বলল দেখা করতে চাইছে। চমচম ভনিতা না করে ঠিকানা জেনে নিলো।

আব্রাহাম চমচমকে নিজের ফ্ল্যাটে ডেকেছে দেখা করার জন্য। চমচম আসতেই নিজে দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানালো। চমচম তাকে পরোয়া না করে বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সাজানো, গোছানো একটা পশ হাউজ বলা চলে। আব্রাহামের রুচি ভালো। সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছোঁয়া তার। চমচম ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো। আব্রাহাম তার পাশের চেয়ারে বসে বেজার মুখ করে বলল,

-‘আশ্চর্য! আমি কি ইনভিজিবল হয়ে আছি?’

পানি পান করে চমচম বলল,

-‘হলে ভালো হতো।’

-‘বে’য়া’দ’বি আর গেল না!’

-‘বউকে ভালো কিছু বলে সম্বোধন করতে শিখো আগে। বে’য়া’দ’ব বললে বে’য়া’দ’বিই করা হবে।’

চমচমের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আব্রাহাম প্রথমে ভড়কে গেলেও তার ভীষণ ভালোও লাগল। মুঁচকি হাসল সে।

-‘বউকে কি ডাকা যায়?’

-‘সেটা স্বামীই ভালো জানে।’

-‘বাবুর আম্মু ডাকব? কিন্তু এটা তো কেমন অড লাগে আমার কাছে। তাছাড়া বাবুও নেই। কি করা যায়!’

বাবু প্রসঙ্গ আসাতেই চমচম কেমন নড়ে চড়ে উঠল। একটা অন্যরকম অনুভূতিতে তার সারা শরীর দুলে উঠল। আব্রাহাম তাকে এবার অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করল।

-‘সায়ন ভাই চিনিকে বিয়ে করতে চাইছে শুনলাম। তোর ফ্যামিলিও রাজি নাকি। ব্যাপার কী! সায়ন ভাই তো ম্যারিড।’

-‘সায়ন ভাই বিয়ে করেনি।’

-‘কি বলছিস! সায়ন ভাই তো চিনির বিয়ের দুই বছর আগেই এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছে শুনলাম।’

-‘আরে ওটা ভুল বোঝাবুঝি। সায়ন ভাইয়ের এক বন্ধুর ওয়াইফ সে। বিয়ের দিন এক সাথে ছবি তুলেছিল। ওটাকেই সুমন আঙ্কেলরা ভুল বুঝেছে। সায়ন ভাইও আর সত্যিটা জানায়নি।’

-‘সায়ন ভাই চিনিকে আগে থেকেই পছন্দ করত?’

-‘হু। আপুকে বিয়ের জন্যও বলেছিল। আপু রাজি হয়নি। দুজনের মধ্যে অনেক বাকবিতণ্ডা হয়েছে। শেষে আপা রুড কিছু বলেছিল সায়ন ভাইকে। তারপর অভিমান করেই চলে গিয়েছিল। আপু বলেছিল সে বিয়ে করবেনা কোনো দিন। সায়ন ভাইও আপুকে ছাড়া বিয়ে করবে না। তাই সবার এই ভুল বোঝাবুঝিতে সায় দিয়েছিল। তবে পরে আপুকে বিয়ে করতে দেখে সে হার্ট হয়েছিল। আপুও কষ্ট পাচ্ছিল। কিন্তু ততদিনে সেও জানে সায়ন ভাই বিবাহিত। আর তারপর তো ওই শ’য়’তা’নটার সাথে আপু জড়িয়ে গেলে শ’য়’তা’ন’টা আপুকে ধোঁ’কা দেয়।’

-‘ওয়াসিমের বন্ধু তো। দুটোই ব’দ।’

-‘উনি জানতেন না এই ব্যাপারে। ইন ফ্যাক্ট আঙ্কেল আন্টিরা পর্যন্ত জানত না। তাদের ব’দ’মা’ই’শটা কিছু জানায়নি এতদিনেও। আপুকেই সবাই খারাপ ভেবে আসছিল এতদিন পর্যন্ত। আপু নিজে থেকে সংসার ছেড়েছে সবাই এটাই জানত। সায়ন ভাই আর আমিই প্ল্যান করে ওই ক্লারার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে সবরকম প্রুফ যোগাড় করে আঙ্কেলদের কাছে পাঠিয়েছি। আর আজ আঙ্কেলরা বাসায় এসে ক্ষমা চেয়েছে। আন্টি খুব কাঁদছিলেন। ওনারা মানুষ খুবই ভালো। ছেলের অপকর্মের জন্যে তারাও আমার বোনের মতো কষ্ট পাচ্ছেন। আঙ্কেল তো বলেই বসেছেন ছেলেকে ত্যা’জ্য করে দিবেন। যদিও জানি, ওসব কিছু হবে না। তারপরেও! আমার বোন যে নি’র্দো’ষ, ভুক্ত’ভো’গী তা সমাজ জানতে পেরেছে এতেই আমার শান্তি।’

-‘চিনি কি বলছে? বিয়ে করবে ও?’

-‘জানি না। বলছে তো করবে না। সায়ন ভাই তো চেষ্টা করছেন। দেখি, আপুর মনটা গলে কিনা। এমনিতেও তার বিয়ে শাদিতে ইন্টারেস্ট ছিল না যাও করেছে বাজে ভাবে ধরা খেয়েছে। এরপর আর করবে কিনা এটা আসলেই ভাবার বিষয়। ও তো আগে থেকেই রোবটের মতো ছিল। এখন তো সেটা অন্য লেভেলে চলে গেছে। ওকে এতটা নির্জীব আগে কখনো দেখিনি আমি।’

কথাটা বলতে বলতেই চমচম কেঁদে দিল। আব্রাহাম তাকে আগলে ধরল। চমচম কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-‘কেউ ওর কষ্টটা দেখল না জানো! সবাই যখন জানল ডিভোর্স হয়েছে ওকেই দোষ দিচ্ছিল। স্পেশালি রিলেটিভস্ রা তো নানান আজেবাজে কথা বলতে লাগল। আমি ওর জন্যেই চুপ ছিলাম এতদিন। কিন্তু এসব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আমার বোনের সংসার ভেঙেছে এখানে তারা টেনে আনলো যে ভাই নেই। শেষ শেষ, সব নাকি শেষ। আমার বাবা নাকি ধ্বং’স হয়ে গেছে। আমি জানি, আমার বোনটা সারাটা জীবন কতটা কষ্ট করেছে ভাইয়ের অভাব পূরণ করার জন্যে। তার এই এত শ্রম, ত্যাগ মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেল তাদের এসব কথায়। বাবা-মা, আপু সবাই কতটা আ’ঘা’ত পেয়েছিল এসব আচরণে! মানুষ যে এত জ’ঘন্য হতে পারে আমি জানতাম না।’

-‘মানুষ সবরকম হতে পারে। কাঁদছিস কেন? এই এত জ’ঘ’ন্য মানুষের মধ্যে সায়ন ভাইয়ের মতো অনন্য মানুষও তো আছে। দুনিয়াতে ভালো খারাপ দুটোই আছে। শুধু শুধু ভেঙে পড়ছিস তুই। কান্নাকাটি করলে আমার বাচ্চারই ক্ষ’তি হবে।’

চমচম চমকে উঠল। আব্রাহাম হেসে বলল,

-‘তুই কি ভেবেছিস? আমি জানব না! গতকালই জেনেছি। ডক্টর ফাহমিদা কল করেছিল আমাকে।’

চমচমের মনে পড়ল আব্রাহামের নাম্বারটা ফরমে দিয়ে এসেছিল। ডক্টর ফাহমিদা হয়তো সেখান থেকেই নাম্বার নিয়ে আব্রাহামকেও কল করে জানিয়েছে। ইশ! ভীষণ ল’জ্জা লাগছে। কক্সবাজার থেকে সেবার একসপ্তাহ পরে এসেছিল। অরক্ষিত মিলনের ফলে আসলে হুট করেই! আর টেস্টটাও চমচম লেট করে করেছে। আসলে এত চাপের মধ্যে সে নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করতেই ভুলে গিয়েছিল।

———————————–
চিনি বনানীতে এসেছিল একটা কাজে। সেখান থেকে শপিং মলে যায় টুকটাক কেনাকাটা করার জন্যে। কেনাকাটা করার পর একটা ফুড কর্ণারে গিয়ে বসতেই কেউ একজন তার পাশে এসে বসল। চিনি চমকে উঠল তাতে। সায়নকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললেও পরমুহূর্তেই উঠে যেতে নেয়। সায়ন হাত চেপে ধরে। চিনি ছাড়াতে নিলেই সায়ন কাতর স্বরে বলে,

-‘এবার যদি হাত ছেড়ে দাও তবে আর কোনো দিন আসব না, আর কোনো দিন ভালোবাসা চাইব না।’

চিনি হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই সায়ন দ্রুত বলে উঠল,

-‘চিনি আমার খুব কষ্ট হবে!’

চিনি চলে যেতে লাগল। তারপর হুট করেই ফিরে আসল। সায়নের দুঃখমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-‘Don’t know why! But my heart calls out for you.’

(সমাপ্ত)

(রি-চেইক দিতে পারিনি। ভুল থাকলে মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে