#দখিনের_জানলা (পর্ব-২৮)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৫৬.
বাসায় ফিরে চমচম প্রথমে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিলো কিছুক্ষণ। তারপর নিত্যদিনের মতো চা খাওয়ার জন্য কিচেনের দিকে যেতেই শুনতে পেল চিনি কাঁদছে আর তার মা পাশ থেকে হা হুতাশ করছে। চমচম অবাক হয়ে গেল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই কিছু ভাসা ভাসা কথা কানে এলো তার। আশফাক বিদেশি একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছে। কথাটা শুনেই তো চমচমের মাথায় দ’প’দ’প করে আ’গু’ন জ্ব’লে উঠল। ধুম করে মা বোনের সামনে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে চিনি ও ফাতেমা বেগম দুজনেই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। চমচম চিনির কাছে এসে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘কি হয়েছে আপু? আশফাক ভাই বিয়ে করছে মানে! কি হয়েছে!’
শেষের কথাটাতে ছিল সম্পূর্ণ পুরোনো চমচমের রা’গ। এত জোরে আর এত ক্ষি’প্ত গলায় পুরোনো চমচমই কথা বলত। আজ বহু বছর আগের চমচমটা যেন ফিরে এসেছে। চিনি হু হু করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতেই সবটা জানালো চমচমকে।
বিয়ের আগে যখন আশফাক দেশে গিয়েছিল তখন থেকেই সম্পর্কে একটা অবনতি হয়েছিল তাদের মাঝে। আশফাক খুব কম যোগাযোগ করত। বিয়ে নিয়েও তার ওত একটা মাথা ব্যথা ছিল না। দেশে ফেরার পর একপ্রকার সে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করেছিল। বিয়েতে হাসি খুশি মুখ করে থাকলেও আসলে তার ভেতর অন্য কিছু চলছিল। তাই তো প্রথম রাত থেকেই দূরত্ব রেখেছিল চিনির থেকে। চিনি ভেবেছিল আশফাক তাকে সময় দিতে চাইছে। আসলে সেটা ছিল চিনির ভুল ধারণা। কেননা, এরপর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও দুজনের মধ্যকার দূরত্ব মিটল না। বরং নতুন বাসায় ওঠার পর আশফাক রাত জেগে অফিসের কাজ করার বাহানায় আলাদা হয়ে রুমে চলে গেল। চিনির তখনই সবটা নিয়ে একটা শ’ঙ্কা জাগে মনের মধ্যে। সে প্রায় রাতেই আশফাকের রুম থেকে হাসির আওয়াজ শুনতে পেত। দরজা বন্ধ করে রাখত বলে সে গিয়ে দেখতেও পারত না। নক করলে আশফাক যেন রে’গে যেত। বলত, ‘ডিস্টার্ব করো না। আমি বিজি এখন। কাজ করছি।’ চিনি আর কি করবে! নিজের রুমে এসে বসে থাকত। এভাবেই আরো এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়। একদিন রাতের আনুমানিক তিনটা বা তার কাছাকাছি সময় চিনির ঘুম ভেঙে যায়। সে শুনতে পায় আশফাকের গলা। কারো সাথে কথা বলছে। গলার আওয়াজ এতটা স্পষ্ট ছিল যে বোঝাই যায় রুমের দরজা খোলা। কৌতূহল বশত চিনি দরজার সামনে যেতেই দেখে দরজাটা সত্যি খোলা। তবে আরেকটা দৃশ্য যেটা দেখল সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। সে দেখে, আশফাকের সাথে ভিডিও কলে একটা মেয়ে, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটি ভিন দেশের।
তার পাশেই একটা ছোট বাচ্চা। বাচ্চাটা খুবই ছোট! কয়েক মাসের হবে বোধ হয়। মেয়েটি বাচ্চাটির ছোট তুলতুলে হাত নাড়িয়ে বলছে ‘বেইবি, স্যে হায় টু ড্যাড!’
চিনি কি করবে বুঝতে পারছিল না। চেঁচিয়ে উঠল,
-‘এসব কি আশফাক!’
আশফাক হতবিহ্বল হয়ে গেল চিনির গলার আওয়াজ পেয়ে। পেছন ফিরে চিনিকে দেখে দ্রুত কলটা কে’টে দিলো। এগিয়ে এসে বলল,
-‘চিনি লিসেন! আই ক্যান এক্সপ্লেইন!’
অতঃপর আশফাকের এক্সপ্লেনেশন ছিল এমন, মেয়েটি ক্লারা। আশফাক বিদেশে গিয়ে এই মেয়েটির সাথে লিভ ইন এ গিয়েছিল। তখন পরিস্থিতির চাপে পড়েই আসলে এক বাড়িতে উঠতে হয়েছিল। তারপর হঠাৎ করেই কাছে আসা। ক্লারা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ল আর তারপর আশফাক কি করবে বুঝতে পারছিল না। দেশে ফিরে আসলেও সে বুঝতে পারে মেয়েটিকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। আর বাচ্চাটাকে সে হারাতে চায় না। চিনিকে বিয়েটা করেছে কারণ তখন আর কোনো উপায় ছিল না। বিয়ে তো ঠিক করাই ছিল। আশফাক ভেবেছিল চিনিকে নিয়ে সংসার করলে সব ভুলে যাবে। বরং সে ভুলতে পারেনি। সব শুনে চিনি শুধু হেসে বলেছিল তবে তাকে যে বলল ভালোবাসে? সেটা কি ছিল! সেই প্রশ্নের জবাব আশফাক দিতে পারেনি। এরপর আরো কয়েকদিন নিজের মন ঠিক করে চিনি নিজে আশফাককে ডিভোর্স দেওয়ার কথা জানালে আশফাক রাজি হয়ে যায়। আর এভাবেই সম্পর্কে শেষ। আসার আগে ডিভোর্স পেপারে সাইন করেই এসেছে সে। আশফাকের খুব কাছের একটা বন্ধু আছে ডিভোর্স স্পেশালিস্ট। তার জন্যই সবকিছু খুব দ্রুত সম্ভব হয়েছে।
চমচম এত সব জানার পর ভাষা হারা হয়ে পড়ল। আশফাককে চ’র’ম শা’স্তি দেওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু চিনি জানালো তার কোনো অভিযোগ নেই। সে এভাবেই ঠিক আছে। চমচম যেন কোনো কিছুই না করে। যদি করে তবে চিনি বাড়ি ছাড়বে। চমচমের আর কিছু বলার বা করার থাকল না এরপর।
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই শুনতে পেল তার ফোনে রিং হচ্ছে। হাতে নিতেই দেখল আব্রাহামের নাম্বারটা স্ক্রিনে জ্ব’ল’জ্ব’ল করছে। সেদিকেই অপলক তাকিয়ে রইল সে। একসময় কল কে’টে গেল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল এই নিয়ে তাকে আব্রাহাম চৌদ্দ বার কল করেছে। সে ফোনটা সাইলেন্ট করে চোখ বন্ধ করল। বিয়ে শাদি থেকে এই মুহূর্তে তার যেটুকু বিশ্বাস ছিল সেটাও উঠে গেছে। আর ভালোবাসা! সেটা তো কোনো দিন সে বিশ্বাস করেইনি।
৫৭.
আজ অফিস থেকে চমচমরা কক্সবাজার যাচ্ছে। এগারোটায় ফ্লাইট। দশটার একটু পরই সবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। যথা সময়ে প্লেন ছাড়ল। পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগল না। চমচমের মন মেজাজ ভালো নেই। সব সময় নানা রকম চিন্তায় বিভোর থাকে। হোটেলে আসার পর সে রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ নিজের ফাইল গুলো নাড়া চড়া করে দেখে নেয়। তিনটায় মিটিং আছে বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে। সেই মিটিং এর প্রিপারেশন নিয়ে নিলো ভালো করে।
দুপুরে লাঞ্চ সেড়ে সবাই মিটিং ভেন্যুতে গিয়ে পৌঁছালো। সেখানে গিয়ে আব্রাহামকে দেখেই চমচম চোখ সরিয়ে নিলো। তার কেন যেন ভালো লাগছে না আব্রাহামের উপস্থিতি। পুরোনো অনুভূতি গুলো ফিরে আসছে। আগে যেমন আব্রাহামকে দেখলে রা’গে গা জ্ব’লে যেতো, বি’র’ক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে যেতো এখনও তেমনই হচ্ছে। আব্রাহাম ব্যাপারটা ভালোই লক্ষ্য করে। পুরোটা সময় সে চমচমকে অবজার্ভ করে। ভেবেছিল সেদিনের করা কাজটার জন্য চমচমকে শা’স্তি দিবে কোনো ভাবে। কিন্তু চমচমের চোখ মুখের অবস্থা দেখে নিজেই যেন ছোট একটা সা’জা পেয়ে গেল। সব ভুলে ভাবতে লাগল কি হয়েছে তার চমচমের!
পরদিন বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে শেষ মিটিংটা সফল হতেই রাতে পার্টির আয়োজন করা হলো। অবশ্য সব আগে থেকেই ঠিক ছিল।
পার্টি উপলক্ষ্যে চমচম একটা রেড কালার ওয়েটলেস জর্জেট শাড়ি পরল তার সাথে মিলিয়ে হালকা জুয়েলারীও পরিধান করল। আব্রাহামরা যে রিসোর্টে উঠেছে সেখানেই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। চমচম তার সাথের সিনিয়র মহিলা কলিগের সাথে একসাথে সেখানে গিয়ে পৌঁছায়।
আয়মানের সাথেই সবার আগে দেখা হলো। পাশে মানুষ থাকায় কথা হয় না তাদের। তবে আয়মান ভ্রু উঁচু করে ঠোঁট টিপে হাসল। আয়মানের এহেন কাজে চমচম বি’র’ক্ত হলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো। ওয়াসিম আর আব্রাহাম বাকিদের সাথে আলাপ আলোচনা সাড়ছিল তখন একপাশে। চমচমকে দেখে দুজনেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। তাদের দুজনের ওই চোখের চাহনি চমচম সইতে পারল না। সৌজন্য সাক্ষাৎ করে আয়মানের কাছে গিয়েই বসল। আয়মান বলল,
-‘কীরে! ভাইয়ের সাথে কথা হলো?’
-‘ওর সাথে আমার কি কথা হবে আবার!’
-‘সেটা তুই ভালো জানিস। হাজব্যান্ড তো তোর।’
-‘বা’জে কথা বলো না।’
-‘বলছি না তো।’
-‘পার্টি শেষ হবে কখন?’
-‘কেন?’
-‘আমার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। খুব টায়ার্ড লাগছে।’
-‘এই তো আর কিছুক্ষণ।’
আর কিছুক্ষণ বললেও বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল। কারো কোনো হেল দোল দেখা গেল না। চমচম তার সেই সিনিয়রকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি অবাক হয়ে বললেন,
-‘ওমা! তুমি জানো না? আজ এই রিসোর্টেই সবাই স্টে করবে। রুম বুকিং দেওয়া হয়ে গেছে।’
চমচম বিস্মিত গলায় বলল,
-‘কি বলছেন! আমি তো জানি না এসব। কোনো প্রিপারেশন নিয়েই আসিনি।’
-‘প্রিপারেশন আমাদেরও তেমন নেই। রাতটাই তো! কিছু হবে না।’
চমচম চিন্তায় অস্থির হয়ে আয়মানকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু পেল না। পার্টি শেষ হতে হতে একেবারে অনেক রাত হয়ে যায়। চমচম এক কোণায় চুপচাপ বসেছিল। ওয়াসিম আজ খুবই ব্যস্ত থাকায় চমচমের কাছে তেমন একটা আসতে পারেনি। চমচম অন্যসময় হলে ওর না আসাতে খুশিই হতো। তবে আজ তার ওয়াসিমকে দরকার ছিল। অথচ আজ ওয়াসিম এলো না।
একসময় চমচম সোফায় ঘুমিয়ে পড়ল। তখন ঠিক কতটা বাজে সে জানেনা। জানবে কি করে! ঘুমেই তো মগ্ন ছিল। কেউ একজন তাকে ডাকছিল। চোখ মেলে সামনে আব্রাহামকে দেখতে পেয়ে ভড়কে গেল। তবে সেই সাথে যেন একটু স্বস্তি পেল। বলল,
-‘শেষ সব?’
-‘হু। এখানে কি করছিস? সবাই রুমে চলে গেছে তো।’
-‘চলে গেল! আমাকে কেউ ডাকল না কেন?’
-‘জানি না। ওঠ, অনেক রাত হয়েছে।’
-‘আমি কোথায় যাব? আমি তো জানিনা আমার রুম কোনটা।’
-‘আমি জানি। চল!’
দুজনে করিডোর বেয়ে হাঁটতে লাগল। চমচমের চোখে তখনও ঘুম। ঠিক মতো হাঁটতে পারছিল না। পা ফসকে পড়তে নিলেই আব্রাহাম এক হাতে জড়িয়ে নিলো। বলল,
-‘সাবধানে।’
রুমে এসে চমচম এত দিক খেয়াল করল না। সোজা বিছানার কাছে যেতেই টনক নড়ল। আব্রাহাম দরজা বন্ধ করছে। এক রুমেই কি থাকবে দুজন! ব্যস্ত হয়ে বলল,
-‘কি করছ? তুমি এখানে থাকবে নাকি!’
-‘আর কোথায় থাকব! রুম এটাই তো আমি বুক করেছি।’
-‘আমার জন্য তাহলে কোনটা বুক করা হয়েছে! আশ্চর্য! তুমি আমায় এখানে কেন আনলে?’
-‘রাত হয়েছে চমচম। যে যার মতো রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন কোনো আর্গুমেন্টস্ এ যেতে চাইছিনা। তারপরেও তোর জানার জন্য বলে রাখছি তোর জন্য আলাদা রুম বুক দেওয়া হয়নি।’
-‘কেন?’
-‘টাকা কম পড়েছিল তাই।’
আব্রাহাম ওয়াশরুমে চলে গেল কথাটা বলে। চমচমের ঘুম উড়ে গেল। ডিভাইনে গিয়ে বসে রইল সে। আব্রাহাম ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পরও সে উঠল না। আব্রাহাম বলল,
-‘শুতে আয়।’
-‘তুমি ঘুমাও।’
-‘হ্যাঁ, ঘুমাবো তো। তুই আয়।’
-‘আমার দরকার নেই।’
-‘জে’দ ধরিস না। তোকে টায়ার্ড লাগছে।’
চমচম উঠল। গয়না গুলো গা থেকে খুলে রাখল। ওয়াশরুমে গেল। মুখ ধুঁয়ে নিলো ভালো করে। এরপর এসে আব্রাহামের পাশে শুয়ে পড়ল। আব্রাহাম এক পলক চমচমের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল। চমচম চোখ মেলেই শুয়েছিল। আব্রাহাম আবার যখন তার দিকে ফিরল তখন সে অপর পাশে ফিরে কাত হয়ে শুয়ে থাকে। আব্রাহামও মুখ ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু সে ঘুমাতে পারছিল না। নড়চড় করতে লাগল। বেশকিছুক্ষণ হাসফাস করে একসময় অসহায় চোখে চমচমের দিকে তাকালো। কাতর গলায় বলল,
-‘তুই আসলেই একটা পা’ষা’ণ মহিলা।’
পাঁচ ছয় মিনিট পার হলো যখন তখন চমচম পুনরায় এপাশে ফিরল। আব্রাহাম তখনও তার দিকেই তাকিয়ে ছিল তা দেখে চমচম বলল,
-‘কি!’
আব্রাহাম কোনো কথা বলল না। মুখ ফিরিয়ে নিলো। চমচম হাসল। আব্রাহাম চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
-‘হাসবি না একদম।’
চমচম কিছুক্ষণ আব্রাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু এগিয়ে এসে আবার পিছিয়ে গেল। এভাবে আরো কিছুক্ষণ সময় পার হওয়ার পর আব্রাহাম উঠে বসল। বালিশ নিয়ে বিছানা ছাড়তে নিলেই চমচম তার টি শার্টে টান দিলো। চোখ নিচের দিকে রেখে বলল,
-‘কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। কাছে এসো।’
#চলবে।
(রি চেইক দেওয়া হয় নি।)