#দখিনের_জানলা (পর্ব-২৩)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৪৬.
সুপার শপ থেকে বের হতেই চমচম বাহিরের পরিবেশ দেখে থমকে দাঁড়ায়। কেননা বাহিরে তী’ব্র গতিতে হাওয়া বইছে, কালো মেঘে প্রকৃতি ছেয়ে গেছে পুরোদস্তর। কিছুসময়ের মধ্যেই যে ভারি বৃষ্টিপাত হবে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চমচম চিন্তায় পড়ে গেল। অফিস থেকে বের হয়ে দরকারি কেনাকাটা থাকায় সুপারশপে এসেছিল। এমন হবে জানলে আজ আর আসতো না। মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়েছে আরো আগেই। গতরাতে মোবাইল চার্জে দেওয়ার কথা মনে ছিল না। সকালে অফিসের জরুরী কাজে একবার মহাখালী যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে আবার অফিসে ফিরে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে একবারও মোবাইল চার্জে দেওয়ার কথা ভাবেনি। যার ফলে এখন এই অবস্থায় পড়েছে সে। একটা উবার পর্যন্ত ডাকতে পারছে না, আর না পাচ্ছে কোনো রিকশা বা সিএনজি।
একটু সামনে গেলে কোনো গাড়ি পাওয়া যায় কিনা সেই ভেবে চমচম দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতেই ভাবতে লাগল গতদিনের কথা। আয়মান নয়, আব্রাহামের জন্য তাকে চাইছেন নিগার খানম। চমচমের বুঝতে ভুল হয়েছিল প্রথমে। পরে মা রাতে এসে তাকে বেশ সময় নিয়ে বোঝালো। বাবা কোনো কথা বললেন না। তিনি চমচম যা চাইবে তাতেই সায় দিবেন। চমচমের চাওয়াটাই বড় তার কাছে।
চমচম আয়মানকে যেমন ভাবতে পারে নি জীবনসঙ্গী হিসেবে তেমনই আব্রাহামকেও পারেনি। তবে এই দুটো না পারার মধ্যেও তফাৎ ছিল। আয়মানেরটা অ’স্ব’স্তিকর একটা অনুভূতি দিয়েছিল। কেননা সেই ছোট থেকে আজ পর্যন্ত সবসময় আয়মানকে ভাই হিসেবেই মেনে এসেছে সে। আর আব্রাহামকে ভাই ডাকলেও সারা জীবন শ’ত্রুই ভেবেছে। তাই আব্রাহামের কথা যখন শুনল তখন রীতিমত রা’গ আর ক্রো’ধ এসে ভর করছিল মনের মধ্যে। পুরোনো কিছু তি’ক্ত স্মৃতি স্মরণে আসে তার। তার কথা হলো সে কুমারি থাকবে সবসময় তারপরেও আব্রাহামকে বিয়ে করবে না। সম্ভবই না। সারা রাত চমচম দু’শ্চি’ন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। বারবার আব্রাহামের মুখটা তার চোখের পাতায় ভেসে উঠছিল। আব্রাহামের সাথে কা’টানো নানান মুহূর্ত এসে তার মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল। শেষ রাতে ঘুমিয়ে সকালে যখন উঠল তখনও আব্রাহামই তার স্মরণে ছিল। অবশ্য রাতে যে সময়টা ঘুমিয়েছে সেসময়ে সে আব্রাহামকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। আর সেই স্বপ্নটা এখনও তরতাজা মনে হচ্ছে চমচমের।
কাল রাতে সে স্বপ্নে দেখেছিল আব্রাহামকে সে জোর করে বিয়ে করতে চাইছে কিন্তু আব্রাহাম করতে চাইছে না। আব্রাহাম বিয়ে যেন করতে না হয় এই জন্য তেঁতুল তলায় গিয়ে বসে থাকে। চমচমও পেছন পেছন যায় কিন্তু যত হাঁটে তত বেশি দূরত্ব বাড়তে থাকে তার আর আব্রাহামের মধ্যে। এরপর আর কিছু মনে নেই চমচমের। স্বপ্নটা যখন দেখছিল তখন কতবড় মনে হচ্ছিল অথচ যখন ঘুম থেকে উঠে সেসব ভাবতে লাগল তখন বারবার এই অল্প কিছু স্মৃতিই মনে পড়ে। মনে হয় পুরো স্বপ্ন শুধু এটুকুতেই ছিল।
গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই চমচম ভাবনার সাগর থেকে বেরিয়ে আসে। একটু একটু করে হুট করেই ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়। চমচম পড়ে অথৈ জলে! রাস্তায় আশেপাশে কোনো ছাউনি নেই, গাছ নেই। দোকান পাট সব বন্ধ করে দোকানদাররা অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে। কারণ আজ যে সহজে বৃষ্টি থামবে না তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চমচমের পুরোপুরি ভিজে যেতে দুই মিনিটও সময় লাগল না। অগত্যা আর না হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো গাড়ি আসছে কিনা আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। একটা গাড়ির দেখা পেয়েও গেল। গাড়িটা যত কাছে আসছিল চমচমের মনে তত উৎকন্ঠা কাজ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল গাড়িটা তার চেনা। আর সেটাই হলো। আব্রাহামকে নামতে দেখেই সে নিশ্চিত হলো। আব্রাহামও গাড়ি থেকে নেমেই ভিজে যেতে থাকে। কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল নেই। এগিয়ে এসে চমচমকে বলে,
-‘গাড়িতে ওঠ।’
চমচম দোনামোনা করতে থাকে। আব্রাহাম বলল,
-‘এখন আর কোনো অপশন নেই। আর একটু পর এই রাস্তায় পানি জমে যাবে। কোনো গাড়িও আসবে না। তাছাড়া ভিজে গেছিস পুরো। চল!’
কথাটা বলে আলতো হাতে স্পর্শ করে চমচমের হাত। তারপর গাড়ির দরজা খুলে তাকে ভেতরে বসিয়ে দিলো। চমচম কিছু বলল না। আজ আর কিছু বলে লাভও নেই। আজ সত্যিই সে আব্রাহামের এই সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য। আব্রাহাম গাড়িতে উঠেই ড্রাইভ করা শুরু করে দেয়। চমচম ততক্ষণে সিটবেল্টটা বেঁধে নিয়েছে। আব্রাহাম এক পলক চমচমের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আজ চমচম একটা হালকা গোলাপী শাড়ি পরেছিল। শাড়ির কাপড়টা বেশ পাতলা আর রঙও হালকা হওয়াতে ভিজে যাওয়ায় শরীরের ভাজ চোখে পড়ছিল। আব্রাহামের কোর্টটা পেছনের সিটে পড়ে আছে। সে চাইছে চমচমকে বলতে যে কোর্টটা গায়ে জড়িয়ে নিতে। কিন্ত কীভাবে বলবে বা বললে চমচম আবার কি মনে করে বসে তা ভেবেই সে বলতে পারছে না।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাহিরে এমনিতেও কালো মেঘের জন্য অন্ধকার হয়েছিল এতক্ষণ। এখন সন্ধ্যা হওয়ায় মনে হচ্ছে রাতই হয়ে গেছে। আব্রাহাম গাড়ির ভেতরের লাইটটা অফ করে দিলো। অন্ধকারে সে আর কিছুই দেখতে পাবে না। তারপরেও! চমচমের বোধহয় শীত করছে। খুব ভিজে গেছে তো! এই ভেবেই সে পেছনের কোর্টটা হাতড়ে নিয়ে চমচমের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল,
-‘ঠান্ডা লাগলে গায়ে জড়িয়ে নিতে পারো।’
চমচম ঠান্ডার জন্য নয়। ভিজে শরীরটা ঢাকার জন্যই কোর্টটা নিলো। আব্রাহামের মুখে তুই তুমি ডাকে সে একটু বিব্রতবোধ করছে। তুই বললে সে কথা বাড়াতে পারে বা কিছু বলে দিতে পারে মুখের উপর। তুমিটা বললেই আর কথা বের হয় না তার মুখ দিয়ে।
৪৭.
চমচমের আব্রাহামের সাথে কথা ছিল। বিয়ের ব্যাপারেই। আব্রাহাম সেসব নিয়ে কিছু জানে কিনা তা সে জানে না। তবে এমন একটা বিষয়ে আব্রাহামের জ্ঞান থাকবে না তেমনটাও তো হয় না আবার। তাই কিছুসময় চুপচাপ কথা সাজিয়ে নিয়ে আব্রাহামের উদ্দেশ্য বলল,
-‘কিছু কথা ছিল আমার।’
আব্রাহাম ড্রাইভ করতে করতেই একবার তার দিকে তাকালো। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
-‘বলো।’
উফ! এভাবে কেন কথা বলছে আব্রাহাম? চমচম যে কথা গুলিয়ে ফেলছে।
-‘একটা জরুরি কথা।’
-‘হ্যাঁ, শুনছি তো।’
-‘আন্টি নাকি আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে।’
এবার আব্রাহাম সরাসরি চমচমের চোখের দিকে তাকালো। বলল,
-‘কোন আন্টি? আর কীসের প্রস্তাব!’
-‘আপনার মায়ের কথা বলছি। আর কীসের প্রস্তাব মানে? আপনি জানেন না!’
-‘কি জানব?’
-‘আশ্চর্য! আমাদের বিয়ের!’
কথাটা শুনে সাথে সাথেই আব্রাহাম ব্রেক ক’ষে গাড়ির। চমচম তাতে কিছুটা চমকে উঠে। আব্রাহাম অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
-‘আমাদের বিয়ের মানে?’
চমচম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ধুর! এখন কীভাবে, কি বলবে! এদিক ওদিক দৃষ্টি নাড়া চড়া করে সে বলল,
-‘গাড়ি থামালেন কেন?’
-‘তুমি কি বলতে চাইছিলে? সেটা বলো আগে।’
চমচম মাথা নিচু করে বলল,
-‘আন্টি বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বাসায় মা আমাকে জোর দিচ্ছে আপনাকে বিয়ে করার জন্য।’
আব্রাহাম মৃদু হাসল। গাড়ি স্টার্ট দিলো পুনরায়। তারপর কিছুসময় নিরবতা পালন করল দুজনেই। চমচম আব্রাহামের নিশ্চুপতা সইতে না পেরে বলল,
-‘আপনি কিছু বলছেন না কেন?’
-‘কি বলব?’
-‘আপনার জানার কথা, আমি কোনো দিনই আপনাকে বিয়ে করতে চাইব না।’
-‘না বলে দিলেই তো পারো।’
-‘আপনি আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না। আমি না একবার নয় বারবার বলেছি। তারপরেও মা শুনছে না। আন্টি কল করেছে রাতে দুইবার। আমি তার মুখের উপর না বলতে দ্বিধাবোধ করছিলাম। তাই কলটা পর্যন্ত রিসিভ করিনি। আপনি প্লিজ আপনার মাকে বোঝান। আমাদের বিয়ে তো একটা অসম্ভব ব্যাপার, তাই না?’
-‘অসম্ভব হবে কেন? তুমি ছেলে নাকি!’
চমচম তব্দা খেয়ে গেল এমন কথা শুনে। আমতা আমতা করে বলল,
-‘বা’জে কথা বলছেন কেন?’
-‘তাহলে সমস্যা কোথায়? মানে অসম্ভব হবে কেন? ছেলে আর মেয়ের বিয়ে একটা সম্ভাব্য ব্যাপার।’
-‘আপনি কি বুঝতে পারছেন না নাকি বুঝতে চাইছেন না?’
চমচমের কন্ঠে রা’গের আভাস পেল আব্রাহাম। তাই সে ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,
-‘আমি মাকে কথা দিয়েছি বিয়ে করব। সে যাকে বলবে তাকেই করব। সো, এই নিয়ে আমার করার কিছু নেই।’
-‘আমি যে আপনাকে কতটা অপছন্দ করি তা কি আপনি জানেন না? আপনাকে আমি কখনোই বিয়ে করব না। আপনি বুঝতে পারছেন!’
-‘এত বুঝে কি হবে?’
চমচমের ধৈর্য্যের সীমা ভেঙে পড়ল একেবারে। জোর গলায় বলল,
-‘দেখুন! আপনাকে আমি লাস্ট টাইম ওয়ার্ন করছি এসব প্রস্তাব আমার বাসায় যেন না আসে। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব।’
গাড়ি তখন তাদের বাড়ির কিছুটা সামনেই এসে পড়েছিল। আব্রাহাম চমচমের কথা শুনে আবারও গাড়িতে ব্রেক ক’ষে। চমচমের হাত টেনে নিজের কাছে এনে বলে,
-‘আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? আমি তোকে মে’রেছি বলেই তো আমার উপর তোর রা’গ! তবে মা’র। তোর যত খুশি তত মা’র আমাকে। আমি কিছু বলব না। তারপরেও! এই কথা বলবি না। অন্য কাকে বিয়ে করবি তুই? ওই ওয়াসিম মাহমুদকে?’
চমচম তখন আব্রাহামের বুকের খুব কাছে ছিল। আব্রাহামের রে’গে যাওয়া মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত ছিল সে। ওয়াসিমের কথা শুনেই তার ঘো’র কা’টে। সরে আসার চেষ্টা করতে করতেই বলে,
-‘আজেবা’জে কথা কেন বলছেন? উনি আমার বস হন। এর বাহিরে আর কিছু না।’
-‘তাহলে আর কে আছে? কাকে তুই বিয়ে করতে চাইছিস!’
-‘পাত্রের কি দেশে অভাব পড়েছে?’
-‘ঠিক বলেছিস। তোর জন্য পাত্রের অভাব পড়েনি ঠিকই। কিন্তু আমার জন্য শুধু দেশ নয় বিদেশেও পাত্রীর অভাব পড়েছে। তুই যদি না হোস, তবে আর কেউই না। আর কাউকে আমার চাই না।’
চমচম অবাক না হয়ে পারল না। বলল,
-‘আমিই কেন?’
আব্রাহাম চমচমকে নিজের দিকে আরেকটু টে’নে এনে বলল,
-‘তুই কেন? এটা তো আমারও প্রশ্ন। যেখানে আমিই আজ পর্যন্ত উত্তরটা পাইনি সেখানে তুই কীভাবে পেয়ে যাবি?’
-‘আমাদের মধ্যে এমন সম্পর্ক ছিল না কখনো। এটা হয় না।’
চমচমের গলায় অসহায়ত্ব ছিল। আব্রাহাম বলল,
-‘আমি কখনো কোনো মেয়ের দিকে ঠিক করে তাকাইনি চমচম। পড়ালেখা আমার কাছে সবসময় আগে ছিল। যখন ভাবলাম এবার অন্তত জীবনটা গুছিয়ে নিব কারো সাথে তখনই তুই হুট করে চলে এলি। আমি কখনোই তোকে নিয়ে ভাবিনি। অথচ, কি হয়ে গেল!’
চমচম কিছু বলল না। চুপ করে আব্রাহামের চোখের দিকেই তাকিয়ে রইল। আজকে কেন যেন আব্রাহামের সেই চোখের ভাষাটা সে বুঝতে পারছে। তাকে আরো বেশি কাছে টেনে নিয়ে বেশ আবেগ নিয়ে আব্রাহাম বলল,
-‘ডু ইউ রিমেমবার আওয়ার ফার্স্ট কিস্ অন দ্য রুফ? দ্যাট এ’ক্সি’ডেন্টাল কিস্?’
স্মৃতির পাতায় আট বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই চুম্বন মুহূর্তটি চমচমের চোখের পাতায় ভেসে উঠল। মনে পড়তেই লাজে তার গাল দুটো লা’ল হয়ে গেল। তখন তেমন ল’জ্জা অনুভব না করলেও আজ খুবই ল’জ্জা পেলো সে। আব্রাহাম যে কোনোদিন এভাবে তাকে সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিবে তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি।
-‘আমি সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও ঘটনাটা ভুলতে পারিনি। সেদিনের পর থেকে তোকে আমি চেনা চমচম হিসেবে আর মানিনি। মেনেছি এমন একজন হিসেবে যাকে ভালোবাসা যায়, বিয়ে করা যায়, যার সাথে সংসার করে সারাজীবন কাটানো যায়। আমি কি বলতে চাইছি তা কি তুই বুঝতে পারছিস? তোর মনে প্রশ্ন থাকবে হয়তো কেন আমি সেদিন তোকে মে’রেছি, কথা শুনিয়েছি! তাহলে শোন, আমার অনুভূতি গুলো যখন আমি বুঝতে পারি তখন থেকেই আমার তোর আশেপাশে কোনো ছেলেকে স’হ্য হতো না। সে যে-ই হোক না কেন। সায়ন ভাইকে তুই টিউটর হিসেবে রাখলি অথচ আমি তখন বাসায় ছিলাম। আমিই তোকে পড়াতে পারতাম। কিন্তু তুই আমার কাছে না গিয়ে সায়ন ভাইয়ের কাছে গেলি। সেই রা’গ তো ছিল, তারই সাথে তোর আমার সাথে করা ব্যবহার গুলো, আমার প্রতি প্রকাশ করা অনীহাগুলো আমার স’হ্য হচ্ছিল না। আমি হাপিয়ে উঠছিলাম। দ্যাখ! আমি জানি, আমি যা করি বা করে এসেছি এই পর্যন্ত সবটা ভুল। কিন্তু আমার ভালোবাসার ধরণ ওইরকমই। আমি তোকে রা’গের মাঝেই ভালোবাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি। হয়তো তোকে আমি সেইভাবে বুঝিয়ে বলতে পারছি না বা পারিনি কিন্তু বিশ্বাস কর! আমার ভালোবাসাতে ছ’ল’না নেই। আট বছর আগে যেমন ভালোবেসেছি আট বছর পরেও তেমনই ভালোবাসি। পরিবর্তনটা শুধু সময়ের আর পরিমাণের। ভালোবাসাটা এই আট বছরে আরো বেড়েছে। চমচম, আই লাভ ইউ লাইক দ্য সি লাভস্ দ্য শোর! আই লাভ ইউ টু দ্য মুন এন্ড ব্যাক!’
চমচম কোনো কথা বলতে পারল না। তার চোখটা ভিজে যাচ্ছিল বারবার। আব্রাহামের এই সহজ স্বীকারোক্তিতে তার নারী সত্ত্বা কেঁপে ওঠে। যা কোমল, ভালোবাসার কাঙাল! নিজের এই নতুন রূপ আবিষ্কার করে সে নিজেই বিস্মিত হয়। তার মনের মাঝে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল দীর্ঘ কয়েক বছরের জমিয়ে রাখা বসন্তের হাওয়া। কোনো এক ভরা শ্রাবণে যে হুট করেই সেগুলো বেরিয়ে আসবে তা কি সে জানতো?
চমচমের নিরবতা দেখে আব্রাহাম তাকে ছেড়ে দিলো। মনের কথাগুলো বলে দেওয়াটা ভালো মনে করেছে সে। বলেও দিয়েছে। এখন চমচম কি করবে তা সম্পূর্ণ চমচমের ব্যাপার। আর কোনো জোরাজুরি করবে না সে। এগিয়ে যাবে না ততক্ষণ, যতক্ষণ না চমচম নিজে আসবে তার কাছে। না আসলেও চলবে। সবসময় যে সবকিছু পেতে হবে তা তো নয়। সবাই কি আর ভালোবাসার মানুষটাকে পায়? কেউ পায় তো কেউ না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই জীবন পার করে দেয়। জীবন তো থেমে থাকে না। কিছু অনুভূতির জন্য মাঝে মাঝে মানুষকে থামতে হয়। রাতের আঁধারে, নিরিবিলি বসে হয়তো কখনো কখনো সেই আক্ষেপটাকে মনে করে এক অসহনীয় য’ন্ত্র’না ভো’গ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
বাসার সামনে গাড়ি এসে থামলে চমচম একবার আব্রাহামের দিকে তাকায়। তারপর নামতে নিলেই আব্রাহাম তার হাতটা ধরে ফেলে। বলে,
-‘আমি একটা উত্তর আশা করছি তোর থেকে। তুই সেটা না দিয়ে চলে যেতে পারিস না।’
চমচম হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আব্রাহাম ছেড়ে দিলো। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে চমচম থমথমে গলায় বলল,
-‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আর কতবার বলতে হবে সেটা?’
-‘পারবি না কেন? তুই বুঝতে পারছিস না আমাকে!’
-‘না। আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বুঝি না। এসব ভালোবাসার কথা বলে লাভ নেই। আমার এসবে কোনো কিছুই যায় আসে না।’
চমচম গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই আব্রাহাম অতি দুঃখে রে’গেই গেল। গ্লাস নামিয়ে চমচমের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল,
-‘তুই একটা পা’ষা’ণ মহিলা।’
চমচম পেছন ফিরে বলল,
-‘নতুন জানলে?’
আব্রাহামের চোখটা তখন প্রায় ভিজে আসছিল। সেটা লুকাতেই বলল,
-‘তোকে কি আমি কখনোই জানতে পেরেছি? তুই দিয়েছিস সেই সুযোগ! যা আর আসব না। কোনো বিয়ের প্রস্তাবই যাবে না তোর কাছে। তুই ভালো থাক। তোর ওয়াসিমকে নিয়ে।’
আব্রাহাম গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার পরেও চমচম সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ খেয়াল করল আব্রাহামের কোর্টটা তার গায়ে। একটা পুরুষালি ঘ্রাণ আসছে সেটা থেকে। চমচম অনুভব করল কোর্টটা নয়, সে যেন গোটা আব্রাহামকেই জড়িয়ে ধরেছে।
#চলবে।