দখিনের জানলা পর্ব-২২

0
784

#দখিনের_জানলা (পর্ব-২২)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪৪.
চমচম রা’গে, ঘৃ’ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো আব্রাহামের থেকে। চমচমকে এমন করতে দেখে আব্রাহাম যেন আরো বেশি চটে গেল। এগিয়ে এসে নিজ হাতে সিটবেল্টটা বেঁধে দিলো। চমচম নিজের এত কাছাকাছি আব্রাহামকে আসতে দেখে দম খি’চে বন্ধ করে রাখে। আব্রাহাম সরে যেতেই স্ব’স্তির শ্বাস ছাড়ে। আর কোনো কথাই বলে না সে আব্রাহামের সাথে। আব্রাহামও বলে না। চুপচাপ ড্রাইভ করতে থাকে সে। চমচম দৃষ্টি জানলার কাঁচ ভেদ করে বাহিরের রাস্তায় নিয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে খেয়াল করে তার চোখের কোণ ভিজে এসেছে। সে বুঝল, এই অশ্রু তার রা’গের বহিঃপ্রকাশ।

আব্রাহাম চমচমের এমন মুখ ফিরিয়ে বসে থাকারটা স’হ্য করতে পারেনা। কিন্তু কিছু বলেও না। মেয়েটা তাকে সবসময় রা’গিয়ে দিবে, তারপর সে যখন রে’গে গিয়ে কিছু উল্টোপাল্টা করে ফেলে তখন এমন গাল ফুলিয়ে ফেলে। যেন সব দো’ষ একার আব্রাহামের। তার কোনো দো’ষই নেই। সে তো নিষ্পা’প অবলা এক শিশু।

কমিউনিটি সেন্টারে গাড়ি আসার পরও চমচম বসে রইল। আব্রাহাম এসে দরজা খুলে দেওয়ার পরই সে নামে গাড়ি থেকে। তারপর একবার ঘৃ’ণা ভরা দৃষ্টি নিয়েই আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে যায়। আব্রাহাম সেদিকে কিছুক্ষণ মদির চোখে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই হতাশ হয়ে আসে তার দৃষ্টিভঙ্গি। চমচম বোধহয় কোনো দিনই তাকে চাইবে না। না চাওয়া টা স্বাভাবিক। তারপরেও! সে কেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে চমচমের পথ চেয়ে? আব্রাহামের ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে কোথাও চলে যেতে। তার পরিপাটি, গোছানো জীবনটা হুট করেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। সে তো কখনো এমনটা হোক তা চায় নি! এখন যখন চাইছে তখন কেন সেসবের কিছু হচ্ছে না?

ভেতরে ঢোকার পর চমচমকে সবার অনেক ব’কা খেতে হয়েছে দেরি করার জন্য। চমচম চুপচাপ সব হজম করেছে। কিন্তু তার একটু খা’রা’প ও লাগে। এখন তো বড় হয়েছে সে। এখন এভাবে তাকে ব’কাঝ’কা করা কি সাজে? চিনি বোনের উপর বেশ ক্ষি’প্ত ছিল। তবে তাকে পাশে পেয়ে সব ভুলে গেল। দুই বোন বেশ কিছু ছবি তুলল একসাথে। এক ফাঁকে তারিন এসে চমচমকে বলল,

-‘তোমাকে ডাকছে আপু।’

চমচম ভাবে আব্রাহাম। তাই তারিনের কথা আমলে নেয় না। চিনিকে বাকিদের কাছে রেখে সে এদিক ওদিক হাঁটতে থাকে। দুই তিনটা বন্ধুকে সে দাওয়াত দিয়েছিল। তারা এসেছে কিনা সেই খোঁজেই মূলত বের হয় সে। দুই জনকে পেয়েও যায়। বেশ কিছুক্ষণ খোশ গল্পে ব্যস্তও হয়ে পড়ে। তাদের খাবার টেবিলে বসিয়ে সে যখন পুনরায় চিনির কাছে ফিরতে নেয় তখন তার সামনে হুট করেই ওয়াসিম এসে হাজির হয়। কালো পাঞ্জাবী পরিহিত ওয়াসিমকে আজকে যে খুব বেশি সুদর্শন লাগছে চমচম তা মনে মনে ভাবল। ভেবেই সে নিজেকে নিজে ধি’ক্কা’র দেয়। এমন ভাবনা তার মস্তিষ্কে এলো কেন? ওয়াসিম চমচমকে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে নিয়ে বলল,

-‘তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, আজরা।’

চমচম প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে না। বরাবরই এসবে তার একটু অ’স্ব’স্তি হয়। কিন্তু বসের প্রশংসা শুনে তো ভালো রিয়েক্ট দিতে হবে। তাই মৃদু হেসে বলল,

-‘ধন্যবাদ স্যার। আপনাকেও ভালো লাগছে।’

পরের কথাটা বলেই চমচম নিজেই বেকুব বনে গেল। এটা বলা উচিত হয়নি। ওয়াসিম চমচমের থেকে প্রশংসা পেয়ে গলে গেল একেবারে। বলল,

-‘ট্রুলি?’

চমচম আমতা আমতা করে বলে,

-‘ইয়েস স্যার।’

-‘স্যার বলবে এখনও? দ্যাখো, এখানে কিন্তু অফিসের বস, ইমপ্লয়ী এসবের বাহিরেও একটা নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমি চাইছি এখানে সেই সম্পর্ক কেই গুরুত্ব দেওয়া হোক। সেই ভাবেই একটা নতুন সম্বোধন…’

-‘ভাইয়া বলব তাহলে?’

চমচমের হঠাৎ এমন কথা শুনে ওয়াসিম তব্দা খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,

-‘নো নো। ভাইয়া বলার দরকার নেই।’

-‘তবে? নাম ধরে ডাকব নাকি! দেখুন সেটা কিন্তু অসম্ভব।’

-‘লাগবে না। কোনো কিছুই বলা লাগবে না। ভাইয়া তো মোটেও না। এখানে কোনো সম্বোধনেরই প্রয়োজন নেই।’

চমচম কি বলবে আর বুঝতে পারল না। তাই শুধু বাম দিকে মাথা কাত করে বোঝালো ঠিক আছে।

-‘তোমাকে তখন ডেকেছিলাম। এলে না যে?’

-‘কখন?’

চমকে উঠল চমচম। ওয়াসিম তাকে কখন ডাকল? চমচমকে এভাবে চমকে যেতে দেখে ওয়াসিম বলল,

-‘তোমার কাজিনকে দিয়েই ডাক পাঠিয়েছিলাম।’

চমচমের মনে পড়ল তারিনের কথা। সে তারমানে তখন ওয়াসিমের কথা বলছিল। কিন্তু কেন? ওয়াসিমের তাকে কি দরকার! চমচম খুব করে চাইছে ওয়াসিমের থেকে দূরত্ব রাখার অথচ ওয়াসিম যেন আরো বেশি কাছে চলে আসছে।

-‘কিছু দরকার ছিল কি?’

-‘উহু। তেমন কিছুই না। তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম শুধু।’

আয়মান পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। চমচমকে ওয়াসিমের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,

-‘চমচম? এখানে কি করছিস! চিনির বিয়ে পড়াচ্ছে তো ওইদিকে।’

কথাটা শুনে চমচমের টনক নড়ে। ওয়াসিমের থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত কদম ফেলে ছুটল চিনির কাছে। গিয়ে দেখে চিনি টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চমচমকে দেখতে পেয়েই যেন আরো বেশি ভেঙে পড়ল। চমচম এগিয়ে গিয়ে বোনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। কিছুসময় পর চিনি আর আশফাক বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়। চারিদিকে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। বিয়ের আনন্দ আরেকটু বেড়ে যায়। বর আর কনের পিতা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের নতুন, কাছের সম্পর্ককে স্বাগতম জানায়।

৪৫.
বর কনেকে নিয়ে সবাই একটা বড় গোল টেবিলে বসেছে। সেই টেবিলে চমচম বসেছে চিনির পাশে। ওয়াসিম বসেছে আশফাকের পাশে। আব্রাহাম আর আয়মান পাশাপাশি বসেছে। তারা ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন আছে। আশফাকের দুইটা কাজিন বোন, আর পারিজাত, রাইসা, তারিনও আছে। চমচমের অন্য পাশে পারিজাত বসেছে। আব্রাহাম খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বারবার ওয়াসিমকে দেখছে। যতবার তাকে তাকিয়ে দেখছে, ততবার সে চমচমের দিকেও তাকায়নি। ওয়াসিমের প্রতি আব্রাহাম একটা চাপা রা’গ আর ক্ষো’ভ অনুভব করছে। সে তাকে চোখে চোখে রাখতে গিয়ে ঠিক মতো নিজের খাবারটাই খেতে পারল না। না খেতে পারা নিয়ে তার আফসোসও নেই। সে শুধু চিন্তা করছে চমচমের সাথে কি সম্পর্ক লোকটার। নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। নয়তো চমচম এমন এক দেখায় কারো সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়ার মতো মানুষ যে নয় তা সে ভালোই জানে।

কনে বিদায় পর্বে চমচম কাঁদেনি। চিনি জানত তার বোন সহজে কাঁদে না। তারপরও এই নির্লিপ্ততা সে সইতে পারল না। সবাই একে একে বিদায় নেওয়ার পর চমচম রেস্টরুমের দিকে যায়। তারপর নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ কান্না করে। সেই কান্না সকলের অগোচরেই থেকে যায়।

ফেরার সময় বাড়ির গাড়িতেই চমচম উঠতে চায় কিন্তু তার মা তাকে আবারও আব্রাহামের সাথে যেতে বললে সে বেশ রে’গে যায়। খালামণি এসে অনুরোধের সহিত বললেন এখন চেঁচামেচি না করে যেভাবে আব্রাহামের সাথে এসেছিল সেভাবেই যেন আব্রাহামের সাথেই ফিরে যায়। দুই তিনজন অতিরিক্ত মেহমান সাথে থাকায় গাড়িতে আর জায়গা নেই। চমচম বলল উবার ডাকবে। কিন্তু পারিজাত আর বাম্পা এসে তাকে নিয়ে গেল। অগত্যা না চাইতেও আব্রাহামের গাড়িতেই উঠতে হলো তাকে। আব্রাহাম একবার আড়চোখে চমচমকে দেখল শুধু। চমচমও অনিচ্ছাসত্তেও একবার পাশ ফিরে আব্রাহামকে দেখে। আব্রাহামের শক্ত মুখশ্রী দেখে তার কেন যেন ভালো লাগল না।

সারা রাস্তা বাম্পা আর আব্রাহাম নানান কথা চালিয়ে গেলেও চমচম ছিল চুপচাপ। পারিজাত সবার কথার ফাঁকেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে! চমচম পেছন ফিরে বোনের দিকে একবার তাকায়। তাকে ঘুমিয়ে পড়ে দেখে বাম্পার দিকে একবার তাকায়। প্রয়োজনীয় দূরত্ব রেখেই সে বসে আছে। আর তার সব ধ্যান জ্ঞান আব্রাহামের সাথে কথা বলাতেই।

মাঝ রাস্তায় এসে বেশ লম্বা এক জ্যামে পড়তে হলো। বাম্পা রে’গে একটা গা’লি দিতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। আব্রাহাম বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ নিজেকে কন্ট্রোল করেছে। কিন্তু এবার আর পারে না। পাশ ফিরে চমচমের দিকে তাকায়। চমচমও তখন তার দিকেই তাকায়। ক্ষণিকে জন্য দুজনের চোখে চোখ পড়ে। এরপর চমচম দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলে আব্রাহামের মনে হয় তার শুভদৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। জ্যাম ছাড়তে আধা ঘন্টা লেগে যায়। এর মধ্যে বাম্পা আর চমচমও ঘুমিয়ে পড়ে। রাত তো কম হয়নি! সারা দিনের ক্লান্তিও তো ছিল সকলের। ঘুমিয়ে পড়াটা স্বাভাবিকই ছিল।

বাসার সামনে এসে আব্রাহাম বাম্পাকে ডাকে। আওয়াজ পেয়ে চমচম জেগে উঠে। ঘুমিয়ে পড়েছে ভাবতেই সে ল’জ্জা পায়। অতঃপর পারিজাতকে ডেকে তুলে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় চলে যায়।

পরদিন চিনির রিসিপশনের অনুষ্ঠানে সবাই গেলেও আব্রাহাম যায়নি। চমচমের অবচেতন মন আব্রাহামকে খোঁজে, না পেয়ে নিরাশও হয়।

এরপর বেশ কিছুদিন কে’টে যায়। চমচম অফিস করতে থাকে নিয়ম করে। এক সন্ধ্যায় ড্রয়িং রুমে বাবা মায়ের চেঁচামেচি শুনে সে কি হয়েছে দেখার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হতেই শুনতে পায় নিগার খানম নাকি চমচমকে আয়মানের বউ করে নিতে চায়। আর চমচমের মা এতে রাজি। তিনি চমচমের বাবাকেও বোঝাচ্ছেন যেন রাজি হয়ে যান। কথাগুলো শুনে চমচমের মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায়, রীতিমত তা’জ্জ’ব বনে যায় সে। আয়মানকে বিয়ে! ভাবতেই তো তার বি’শ্রী অনুভূতি হচ্ছে।

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে