#দখিনের_জানলা (পর্ব-২১)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৪২.
মুখের উপর মিষ্টি রোদের আলো পড়তেই চমচমের ঘুম ছুটে গেল। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তার খালামণি ঘরের সব কয়টা জানালা খুলে দিয়েছে। পর্দা গুলো বটে নিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে দিয়েছে। চমচম শোয়া থেকে উঠতে নিলেই অনুভব করল গায়ের উপর কোনো কিছুর ভার। সে মাথা উঁচিয়ে দেখল বেশ কিছু শাড়ি তার গায়ের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নিজের শাড়িগুলোর এমন বেহাল দশা দেখে চমচম হতবাক হয়ে পড়ল। উঠে বসল সময় লাগিয়ে। খালামণি রুম ঝাড় দিচ্ছিলেন তখন। চমচমকে উঠতে দেখে বলল,
-‘উঠেছিস! শোন, আজকে অনেক কাজ। যতই বিয়ে ভাড়া বাড়িতে হোক তারপরেও তো নিজের ঘর দোরে একটু কাজ কর্ম থাকে। সেগুলোও তো কম নয়! মেয়ের পরিবারের জন্য বিয়ে যতটা আনন্দের তার চেয়ে বেশি বেদনার। মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠানো, পরের মন রাখার জন্য আয়োজন করতে করতেই মেয়ে পক্ষের হালুয়া টাইট হয়। বুঝলি! এই যে তোর বড় বোনটার আজ বিয়ে তুই যেখানে ভোরে উঠবি তা না! উঠলি কখন? নয়টা বাজে!’
চমচম মাথা চুলকে বলল,
-‘রাতে শুতে দেরি হয়েছিল যে তাই একটু!’
-‘থাক! আর সাফাই গাইতে হবে না। আমরাও দেরি করে শুয়েছি। কিন্তু পাঁচটার এলার্ম বাজতেই সবাই উঠে পড়েছি।’
চমচম নিজের শাড়ি গুলোকে ইশারা করে বলল,
-‘এগুলো এভাবে কে রেখেছে?’
-‘তোর মা। গতবছর তোর বাবা নাকি কলকাতা থেকে কীসের শাড়ি এনেছে সেটাই খুঁজতে গিয়ে সব শাড়ির ভাজ ন’ষ্ট করে ফেলেছে। তাই বের করে রেখেছি। এখন তুই উঠে পড়েছিস যখন তখন ভাজ করে নে। সুজির হালুয়া করেছি কিন্তু রুটি টা করা হয়নি এখনও। আমার ঘর ঝাড় দেওয়া শেষ। তুই বাকিসব গুছিয়ে নে। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে যাস। কাজ আছে।’
চমচম বি’র’ক্ত হয়ে বলল,
-‘আশা, সমুনের মা ওরা থাকতে তুমি এতসব কেন করছ?’
-‘ওদের অন্য কাজে লাগিয়েছি। আর তোর বাপের গোষ্ঠীর মানুষ গুলোকে আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। খা’রা’প দেখায় তাই বলতে পারি না। কিন্তু তাদের তো আক্কেল জ্ঞান বলতে কিছু থাকার কথা নাকি! সেই যে এসেছে কালকে থেকেই হুকুমের উপর হুকুম করছে। নিজেরা এক গ্লাস পানি ঢেলেও খেতে চাইছে না। জমিদার সবকয়টা!’
চমচম চুপ হয়ে গেল। সেও এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। মনে মনে তার ক’ষ্টও হচ্ছে। তার ফুফুরা আর চাচীরা কেমন অদ্ভুত যেন! নিজেদেরকে তারা কি মনে করে তা তারাই ভালো বোঝে। খালামণি আবারও বলে উঠলেন,
-‘কিন্তু ওই তোদের পাশের বাড়ির আব্রাহামের মা, উনি খুবই ভালো। সব কাজে কি সুন্দর সাহায্য করছেন। এই যে এখন বিরিয়ানি রেঁধে পাঠিয়েছেন। বড় এক হাঁড়িতে করে। তোর তো পছন্দ। উঠে ফ্রেশ হ। গরম গরম থাকতে খেয়ে নে। আমি এক বাটি উঠিয়ে রেখেছি তোর জন্য। যা অবস্থা তৈরি হয়েছে, একজনে দশবার করে খাচ্ছে আরেকজন একবারও পাচ্ছে না!’
খালামণি আপন মনে কথা বলতে বলতেই চলে গেলেন। চমচম সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়ল। এলো কেশে খোপা বেঁধে একে একে শাড়ি ভাজ করতে লাগল। তারপর সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হলো যখন তখন অনুভব করল দখিনের জানলা দিয়ে দখিনা বাতাস এসে তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। সে চোখ বুজে ফেলল। জানালাটা এবার এসেছে থেকে আর বন্ধ রাখে না। আব্রাহামকে ভেবে আর ঘাবড়ায় না সে। একটা পর্দা টানিয়ে দিয়েছে। পর্দা ভেদ করে আলো আসে, বাতাস গুলো শুধু পর্দাকেই উড়িয়ে নিয়ে যায়। ঘরে ঢুকতে পারে না। তবে আজ খালামণি পর্দায় ক্লিপ লাগিয়ে দেওয়াতে তড়তড় করে বাতাস ঢুকছে ঘরে। এক ফালি রোদ তার রুমের ফ্লোরে আছড়ে পড়ে চিকচিক করছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। চমচম মৃদু পায়ে জানলার দিকে এগিয়ে গেল। আজকে আকাশে মেঘ নেই। তবে খুব বাতাস হচ্ছে। হয়তো রোদের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে যেকোনো সময়। আজ কয়েক দিন এমনই তো আবহাওয়া। এই রোদ, এই বৃষ্টি! কখনো রোদের মাঝে বৃষ্টি, কখনো বৃষ্টির মাঝে রোদ দেখা দেয়।
এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে চমচম আব্রাহামের বারান্দার দিকে তাকালো। এতক্ষণ বহু ক’ষ্টে চোখকে অন্যদিকে রেখেছিল। কিন্তু শেষমেষ আর পারল না। চোখকে ব’শে নিতে ব্যর্থ হয় সে।
আব্রাহামের বারান্দা ফাঁকা। থাই গ্লাসটাও পুরোপুরি লাগানো। চমচম সেদিকে তাকিয়ে গতকালের কথা ভাবছিল। আব্রাহামকে তার অদ্ভুত লাগছে। আব্রাহামের ব্যবহার বিশেষ করে! তবে তার রা’গও হয়। গতকাল আব্রাহামের ব্যবহারটা তার যেমন ভালো লাগেনি তেমনই ওয়াসিমেরও হজম হয়নি। বারবার জিজ্ঞেস করছিল তাকে আব্রাহামের সাথে তার কী সম্পর্ক! চমচম প্রথম কয়েকবার এড়িয়ে গিয়েছিল শেষে আর না পারতেই বলে দিলো আব্রাহাম তার প্রতিবেশী। প্রতিবেশী বলাতে ওয়াসিম আরো অবাক হয়। বলে,
-‘প্রতিবেশী হয়ে এভাবে তোমার হাত ধরে টানাটানি করছিল কেন?ব্যাপারটা আমার একদমই ভালো লাগেনি।’
আব্রাহামের করা কাজটা চমচমেরও ভালো লাগেনি কিন্তু ওয়াসিমের কথা বলার ধরনটাও তার পছন্দ হয়নি। ওয়াসিম অনধিকারচর্চা করছে বলেই তার মনে হয়েছে। ওয়াসিম কালকে পুরো অনুষ্ঠানে তার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। চমচম খুঁকি নয়। একটা পুরুষের নারীর প্রতি এমন হাব ভাবের কারণ কী সে তা বোঝে। ওয়াসিমকেও সে বুঝতে পারে। ওয়াসিমের ব্যাপারটা আজ নয়! প্রথম সাক্ষাৎ এর পর থেকেই সে স’ন্দে’হ করে। আর কাল তার কাছে সবটা না হলেও কিছুটা প্রকাশ তো পেয়েছে। আর এই কিছুর আন্দাজ করেই তার ম’রি, ম’রি অবস্থা। যখন বস নিজের কর্মচারীর পেছনে পড়ে তখন ব্যাপারটা কতটা অ’স্ব’স্তি’জনক হয়ে পড়ে তা শুধু যার সাথে হয় সে-ই অনুভব করতে পারে। চমচম মন থেকে চাইছে তার ধারণা যেন ভুল হয়। তাতে একটুও সত্যতা যেন না থাকে।
ভাবনার সাগরে মত্ত থাকা চমচম হঠাৎই খেয়াল করল আব্রাহামের বারান্দার গ্লাস সরানো হয়েছে। এরপরই চোখের পলকেই ভেতর থেকে উদাম গায়ে কেবল একটা ট্রাউজার পরে আব্রাহামকে বারান্দায় প্রবেশ করতে দেখা গেল। আব্রাহামের চওড়া বুক, শক্তপোক্ত বাহু, ব্যয়ামে পেটানো শরীর দেখে চমচমের কেমন কেমন অনুভূতি হলো, ল’জ্জা পেল ভীষণ! সে দ্রুত জানলা থেকে সরে গেল। আব্রাহাম ততক্ষণে তাকে লক্ষ্য করে ফেলেছে। ওই যে! তার বারান্দা থেকে তো চমচমের বিছানা পর্যন্ত সব স্পষ্ট দেখা যায়। চমচম যে হুড়মুড়িয়ে চলে গেল সে তো খুব স্পষ্টই দেখতে পেয়েছে। আব্রাহাম হাসে। সে ভাবেওনি এই সময়ে হুট করে চমচমের দর্শন পেয়ে যাবে।
চমচম ডাইনিং টেবিলে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। সেও তো ভাবেনি হুট করেই আব্রাহামের এমন খোলামেলা দর্শন পেয়ে যাবে! তাকে ঢকঢক করে পানি খেতে দেখে পারিজাত বলল,
-‘ভূ’ত দেখলে নাকি? এমন করছ কেন?’
চমচম গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলে রেখে বিড়বিড় করে বলল,
-‘ভূ’ত নয়, ভুল কিছু দেখে ফেলেছি!’
৪৩.
বিয়ের অনুষ্ঠানটা রাতে ঠিক করা হয়েছে শুনে চমচম ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চট্টগ্রামে থাকতে রাতে বিয়ে হতে দেখেছে খুব। তবে তাদের আশেপাশে বা তার আত্মীয় স্বজনের বিয়ে কখনো রাতে হতে দেখেনি সে। সবসময় দুপুরেই খাওয়া দাওয়ার আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হতে দেখেছে। সে চিনিকে বলতেই চিনি বলল,
-‘আশফাকের ইচ্ছে ছিল এমনটাই হবে। আর আমারও ভালোই লাগে। আজকাল তো এটা অহরহ হচ্ছে।’
পারিজাত, তারিন, রাইসা সবাই বেশ উচ্ছাসিত এটা নিয়ে। চমচমকে রাইসা বলল,
-‘আরে আপু খুব মজা হবে। ফাহাদ ভাইয়ার বিয়েতে তো তুমি ছিলে না। তখনও এমন রাতেই বিয়ে হয়েছিল। এত্ত মজা লেগেছে! চিনিপুর বিয়েতে আরো মজা হবে। অনেক গুলো স্কাইশট ফাঁ’টানো হবে। আহা!’
চমচম বি’র’ক্ত চোখে সবার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল একসময় এতটা আনন্দ, উল্লাস তো সেও করেছে। বরং আরো বেশি করেছে। চারিদিক হৈ চৈ করে মাতিয়ে রাখা তার স্বভাব ছিল। ফোনের রিংটোনের শব্দে চমচমের ধ্যান ভাঙে। স্ক্রিন তাঁকিয়ে দেখল সায়ন কল করেছে। চমচমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। রিসিভ করেই বলল,
-‘সায়ন ভাইয়া! কি খবর? এতদিন পর মনে পড়ল আমাকে?’
চিনি আয়নার সামনে বসে চুলে চিরুনি করছিল। চমচমের কথা শুনে তার হাত থেমে যায়। চমচমের দিকে মুখ করে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তার চোখের চাহনি।
চমচমের কথা শুনে ফোনের ওপাশে থাকা সায়ন মৃদু হাসে। বলে,
-‘তোদের তো সবসময় মনে থাকে। কলটা দেওয়া হয় না শুধু। ভালো আছিস?’
-‘হ্যাঁ। তুমি?’
-‘হুম, আছি।’
সায়ন কিছুক্ষণ নিরব রইল। চমচমের মনে হলো সায়ন কিছু বলতে চায়। তাই সেও কথা বলল না। চুপ করে রইল। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই বেশ শীতল গলায় সায়ন বলল,
-‘চিনির আজ বিয়ে?’
চমচম চোখ তুলে বোনের দিকে তাকালো। চিনি হুট করে চমচ তার দিকে তাকানোতে একটু ভড়কে গেল। সে আগের মতো আয়নার দিকে তাকিয়ে চুলে চিরুনি চালায়। চমচম বলল,
-‘হ্যাঁ। তুমি জানতে না?’
-‘শুনেছি। বিশ্বাস হয়নি।’
চমচম হাসে। বলে,
-‘কেন? ওর বুঝি বিয়ে হতে নেই?’
-‘না! তা হবে কেন? এমনিতেই অনেক তো সময় হয়ে গেছে। আমি ভেবেছে ও হয়তো কোনো দিন কাউকে বিয়ে করবে না।’
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে সায়নের গলা কেঁপে ওঠে। চমচম বোধহয় সেই কাঁপুনি অনুভব করল। বোনের দিকে তাকালো। দেখল চিনির চোখে মুখে বিষণ্ণতা খেলা করছে। সে সায়নকে বলল,
-‘দেশে আসছ না কেন? আপুর বিয়েটা তো মিস করে গেলে। আমারটাও করবে নাকি?’
সায়ন হাসল চমচমের কথা শুনে। বলল,
-‘তুই করবি বিয়ে?’
-‘বিয়ে ফরজ তো।’
-‘ফরজ বলেই করবি? শখ টখ নেই!’
-‘না।’
-‘তোর বোনও এমনটাই বলতো। সেও তো করছে।’
-‘ফরজ তো তাই করছে। আর তাছাড়া ভালোবেসেছে। ভালোবাসলে তো বিয়ে করে। তুমিও তো করেছ।’
সায়ন কিছু বলল না। চুপ করে রইল। চমচম আবারও বলল,
-‘ভাবীর কি খবর কেমন আছে? বেবি টেবি হয়েছে? তোমার তো আবার সব গোপন রাখার রো’গ আছে। সত্যি করে বলবে?’
-‘ভাবী হলে বেবি কি আর না হবে? বেবিও হবে।’
-‘অন দ্য বোর্ড মনে হচ্ছে!’
-‘বাসার সবার কি খবর? চিনির কি অবস্থা? খুব সুখে আছে তাই না!’
সায়নের কথাগুলো মলিন ঠেকছে চমচমের। সে বলল,
-‘থাকার কথা নয়?’
-‘হুম। সুখেই তো থাকবে। আমিও না! কি অদ্ভুত প্রশ্ন করছি। আচ্ছা কল রাখছি। ভালো থাকিস সবাই। চিনিকে আমার তরফ থেকে শুভকামনা জানিয়ে দিস।’
-‘আমি কেন? তুমি নিজেই বলো। আপু তো পাশেই আছে।’
-‘আমি প্রেজেন্ট ছাড়া খালিমুখে বলতে পারব না। পরে দেখা হলে একেবারে প্রেজেন্ট নিয়ে হাসিমুখে অভিবাদন জানাবো ওকে। তুই আমার হয়ে আপাতত হলে দিলে তেমন কিছু হবে না। আমি তো বলবই। তবে এখন নয় পরে। আচ্ছা রাখছি তবে, অফিসে আছি তো এখন অনেক কাজ আছে।’
সায়ন কলটা কে’টে দিতেই চমচম চিনির দিকে তাকালো। প্রেম, ভালোবাসায় সে অভিজ্ঞ না। এসব নিয়ে তার ধারণা কম। তারপরেও তার মনে হতো তার বোন আর সায়নের মধ্যে কিছু একটা আছে। পরে তো সায়নের বিয়ের পর সেসব কনফিউশন দূর হয়েছে। এখন আবার সায়নের কথা শুনে আর বোনের এক্সপ্রেশন দেখে আবারও সেসব ভাবনা মাথায় এসে ভীড় করছে। চমচম মাথা নাড়ল। সে আবারও ভুল ভাবছে। তেমন কিছুই না। বা’জে চিন্তা যতসব। চিনির বিয়ে আজ, এখন তাকে নিয়ে এসব ভাবাও তো ঠিক না।
সন্ধ্যার সময় চমচম নিজের রুমে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত ছিল। গতকাল পার্লারে সাজার পর তার চোখ মুখ জ্ব’ল’ছিল। সাজগোজে সে অভ্যস্ত নয়। তাই বাকি সবাকে ছেড়েই বোধ হয় কেবল তারই এমন হয়েছে। তাই আজ আর সে করেনি। চিনিও বারণ করেছে। পরে মুখে দা’গ বসে গেলে খুব খা’রা’প হয়ে যাবে।
চমচমের ফুফু এসে চমচমকে শাড়ি পরতে দেখে বললেন,
-‘এই গাড়িও তো চলে যাচ্ছে। তুই যাবি কখন?’
-‘তোমরা চলে যাও ফুফু। আমি বাসায় তালা মে’রেই বের হবো।’
-‘গাড়ি তো নেই এখন আর।’
-‘সমস্যা নেই। বাবাকে কল করে বলে দিব তার গাড়িটা পাঠাতে। নয়তো উবার আছে তো। উবার ডেকেই চলে যাব। তোমরা যাও। অনেক দেরি হয়ে গেছে এমনিতেও।’
-‘তোকে একা রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছি না।’
-‘আরে যাও। আমি আসছি।’
ফুফু চলে যেতেই বাসা পুরো খালি হয়ে গেল। চমচম হাঁপ ছেড়ে বাঁ’চল যেন। আহা! কত ঘন্টা পর যেন বাসাটা আগের মতো অনুভব হচ্ছে। তার তো ইচ্ছে করছে এখন একটা শান্তির ঘুম দিতে। কিন্তু ঘুমালে চলবে না। বোনের বিয়ে বলে কথা!
শাড়ি পরে নিজের দৈনন্দিন ব্যবহার করা প্রসাধনী সামগ্রী দিয়ে হালকা সাজল। একেবারেও না সাজলে তো চলে না আবার। সাজতেই হয়। পারফিউম হাতে আর গলার কাছটায় স্প্রে করে নিয়ে পুরো বাসা ভালোভাবে দেখে নিয়ে বের হলো। তা’লা মে’রে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই তার মায়ের কল এলো। রিসিভ করতেই বললেন,
-‘তোর ফুফুদের সাথে বের হলি না কেন?’
-‘রেডি হইনি তখনও। তাই!’
-‘আচ্ছা। এখন গাড়ি বাসার নিচে অপেক্ষা করছে। দ্রুত চলে আয়। চিনি রা’গা’রা’গি করছে।’
-‘এত দ্রুত গাড়ি চলে এলো?’
-‘তুই লেটলতিফ বলে সবাই তো আর তোর মতো হবে তা না!’
মা কলটা কে’টে দিলেন। চমচমও লিফটে উঠল। নিচে এসে দেখল তাদের গাড়ি নয় বরং অন্য একটা গাড়ি। ভালো করে খুটিয়ে দেখল সে গাড়িটা। বাম্পাকে পরশু সে এমন একটা গাড়ির ছবি দেখিয়ে কথা বলতে শুনেছে। মার্সিডিজ বেঞ্জ এস ক্লাস, অবসিডিয়ান ব্ল্যাক গাড়িটি চিনতে তার বেগ পেতে হলো না। এই গাড়িটার ছবি বাম্পা তাকে ভালো করে দেখিয়েছে, বুঝিয়েছে এটার মার্কেট প্রাইজ কত। দাম শুনে চমচমের মাথায় হাত উঠে। কিন্তু বাম্পার মুখে যখন শুনল এমন গাড়ি আব্রাহাম নিচ্ছে তখন তো তার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চমচম চকিতে আব্রাহামকে খুঁজল আশেপাশে। গাড়িতে যে বসে নেই তা সে নিশ্চিত। আব্রাহাম গাড়িটা রেখে বাসায় গিয়েছিল একটা দরকারে। ফিরে আসতেই দেখতে পায় চমচম তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে মুগ্ধ চোখে চমচমকে দেখল। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! গতকালকের চেয়ে আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। চমচম আব্রাহামকে দেখে গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। আব্রাহাম এগিয়ে এসে দরজা খুলে তাকে ইশারা করল উঠে বসতে। চমচম উঠল না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আব্রাহামের মুখের দিকে। আব্রাহাম চমচমের এই ব্যবহারটা নিতে পারল না। চমচমের মুখের দিকে তাকিয়েই ভরাট গলায় বলল,
-‘আন্টি বলেছেন সাথে করে নিয়ে যেতে।’
চমচম অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আন্টিকে বলে দেওয়া হোক, আমি একা যেতে পারব। বিকল্প ব্যবস্থা আছে আমার কাছে।’
আব্রাহাম রে’গে গেল। রগচটা মানুষ তো! আর যখন তখন, যেকোনো অবস্থায় রে’গে যাওয়া তাদের স্বভাব। চমচমকে বলল,
-‘জো’র করে নিয়ে যেতে হবে তাহলে?’
চমচম আব্রাহামের দিকে তাকালো। বলল,
-‘জো’র জ’ব’রদ’স্তি করা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না?
আব্রাহাম এতক্ষণ তুই বলবে নাকি তুমি তা নিয়ে দ্বিধায় ছিল। তাই কোনো সম্মোধন করেনি সরাসরি। এখন চমচমের মুখে আপনি শুনে সে হাসল। ঠোঁটের কোণে দু’ষ্টু হাসি নিয়েই বলল,
-‘তুমি তো জানোই! স্বভাবে মিশে গেছে।’
তারপর হেঁচকা টা’ন মে’রে চমচমকে গাড়িতে বসিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। চমচম এমন কাজের জন্য প্রস্তুত ছিল না। নিজেকে সামলে বের হওয়ার আগেই আব্রাহাম তাড়াতাড়ি চালকের আসনে বসে গাড়ি লক করে দিলো। বলল,
-‘সিটবেল্টটাও কি আমাকেই লাগিয়ে দিতে হবে?’
#চলবে।