#দখিনের_জানলা (পর্ব-২০)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৪০.
আব্রাহাম বসে আছে তার মা আর তার মায়ের সমবয়সী মহিলাদের ভীড়ে। অবশ্য বেশ কিছু রূপসী, সুন্দরী, যুবতী, কিশোরীও সেই বৈঠকের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আব্রাহাম লক্ষ্য করেছে, তারা একটু পর পরই আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে মুঁচকি মুঁচকি হাসছে। চুল ঠিক করছে, ঢং করে ঠোঁট নাড়ছে। গলার স্বরে মধু ঢেলে দিয়ে জোরে জোরে কথা বলছে যেন আব্রাহাম শুনতে পায়। এসবের জন্যে আব্রাহাম মেয়েগুলোর উপর চরম বি’র’ক্ত হচ্ছে। কিন্তু চুপ করে মুখ বুজে সব সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। সে অসহায় চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। নিগার খানম সেই মহিলাদের সাথে গল্প করছে আর ছেলের প্রশংসা করতে করতে সব ভাসিয়ে দিচ্ছেন। মহিলারাও কম না, আব্রাহামের এই এত সৌন্দর্যের পেছনের কারণ কী! তার ব্যাংক ব্যালেন্সের কি খবর! সব জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আব্রাহাম উঠে যেতে চাইছে কিন্তু এমন ভাবে সবাই আটকে রেখেছে যে তার নড়াচড়া করার সুযোগ নেই। তার মাও বলছেন বসতে আরো কিছুক্ষণ। আব্রাহামের অবস্থা এখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি!’ দশ মিনিটেই এই হাল, আরো কিছুক্ষণ থাকলে না জানি কি হয়ে যায়!
আব্রাহামের আয়মানের উপর রাগ হচ্ছে ভীষণ। বে’য়া’দ’ব ছেলেটা তাকে মা ডাকছে বলে নিয়ে এসে বড় ধরনের ভে’জা’লের মুখে ফেলে দিয়েছে। ব্যাটা নিশ্চয়ই জানত আগে থেকে এখানে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে তারপরেও তাকে না জানিয়ে নিয়ে এলো। এখন এই ফ্যাসাদ থেকে তার সহজে কি মুক্তি মিলবে? ওদিকে চমচমটাকে একা ফেলে এসেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই একা বসে নেই। কিন্তু তারপরেও! আব্রাহাম তার সান্নিধ্য চাইছে। খুব করে! আর সইতে না পারে অবশেষে আয়মানকে টেক্সট করে বলল,
-‘এক মিনিট সময় দিলাম, আমাকে এখান থেকে বের করার দায়িত্ব তোর! নাহলে আমি তোর কি অবস্থা করব তা তুই ভালোই জানিস।’
আয়মান মেসেজ সিন করে এক মিনিটেই হাজির হলো। এসে এমন ভান করল খুব আর্জেন্ট কাজ পড়েছে। আব্রাহামকে যেতেই হবে। সবাই ডাকছে। তারপর টেনে নিয়ে গেল সেখান থেকে। মহিলাদের মহল ছেড়ে বের হতেই আব্রাহাম ধুম করে আয়মানের পেছনে একটা কি’ল বসিয়ে দিলো। আয়মান ‘আহ্ ভাই!’ করে চিৎকার করে উঠল। আব্রাহাম আয়মানের আ’র্ত’না’দ শোনার কিংবা দেখার ইচ্ছে পোষণ করল না। সে হম্বিতম্বি হয়ে ছুটে চলল যেখানে চমচমকে রেখে গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু অনেক খুঁজেও চমচমকে আশেপাশে পায়নি। তারিনকে দেখতেই জিজ্ঞেস করল,
-‘তোমার আপু কোথায়?’
-‘কোন আপু?’
-‘চমচমের কথা বলছি।’
-‘ওহ্! আপুকে দেখলাম সেকেন্ড ফ্লোরে যেতে। কেন ভাইয়া? কিছু লাগবে!’
-‘না না। তেমন কিছু না। একটু কথা ছিল।’
আব্রাহাম সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য প্রসন্ন হলো না তার। বাম্পা আর চয়ন তাকে দেখতে পেয়ে নিয়ে গেল ছেলেদের গ্রুপ ফটো তোলার জায়গায়। এলাকার ভাই ব্রাদার সব একসাথে ছবি তুলছে। সেখানে আব্রাহামের মতো সিনিয়র একজন না থাকলে চলে!
ছবি তোলার পর্ব শেষ হতেই আব্রাহাম পুনরায় চমচমকে খুঁজতে লাগল।
৪১.
ওয়াসিম আর চমচম গার্ডেনে বের হয়ে এসেছে। ভেতরে হৈ হুল্লোড়, গান বাজনায় ওয়াসিমের কথা বলতে নাকি ভালো লাগছিল না। তাই চমচমকে বলল বাহিরে একটু হাঁটাহাঁটি করতে চায় সে। চমচম সঙ্গ দিলে তার ভালো লাগবে। চমচম কি আর বসকে মুখের উপর না বলতে পারে?
ওয়াসিম কোনো ডিপার্টমেন্ট হেড নয়। সে পুরো কোম্পানির হেড। তাদের কোম্পানিটা তার দাদার আমল থেকে এখন পর্যন্ত মর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে আছে। বংশীয় ধারা অব্যাহত রেখে ওয়াসিম বর্তমানে কোম্পানির ভার গ্রহণ করেছে। তার বাবা হাশেম মাহমুদ দুই বছর আগেই সবকিছু থেকে অবসর নিয়েছেন। ওয়াসিমের কোম্পানির সাতটা বিভাগেই শাখা আছে। বড়, মাঝারি ধরনের অফিস আছে সবখানে। এই সবগুলো কোম্পানিতে হাজার হাজার কর্মী আছে তার চমচমের মতো। কিন্তু চমচম একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। এই এত কর্মীদের নিয়ে ওয়াসিম কখনো মাথা ঘামায়নি। অথচ চমচমকে নিয়ে তার বেশ চিন্তা। চট্টগ্রামে প্রথম যখন দেখা হলো তখন ওয়াসিম সেখানকার অফিস পরিদর্শন করতে গিয়েছিল। চমচমের সাথে তার তেমন একটা কথা হয়নি। চমচম নিজের কাজ কর্মের জন্যই তার নজরে উঠে এসেছিল। একটা দারুন প্রেজেন্টেশন দিয়েছিল সে। তারপর ওয়াসিম ঢাকা ফিরে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই চমচমের প্রোমোশন আর তারই সাথে ট্রান্সফার সার্টিফিকেটও হাতে আসে। সবকিছুই খুব জলদি হয়ে গেছে বলে চমচম মনে করে। ঢাকা হেড অফিসে সচরাচর এমন পর্যায়ের কোনো কর্মীকে ট্রান্সফার করা হয় না। করা হলেও একটু বড় পদের কাউকেই করা হয়। সেখানে চমচম সাধারণ সদ্য চাকরীতে ঢোকা কম বেতনের একজন কর্মী। ব্যাপারটা স’ন্দে’হজনক লাগা তো অস্বাভাবিক নয়! তাছাড়া এভাবে তার প্রোমোশন আর ট্রান্সফার হওয়াতে কলিগ এবং সিনিয়র অনেকেই তাকে আর ওয়াসিম মাহমুদকে নিয়ে নানান কু’ৎ’সা রটায়। চমচম আগের মতো থাকলে হয়তো সবকয়টাকে উচিত জবাব দিতো। কিন্তু ওই যে! চমচম এখন আর চমচম নেই। পুরোপুরি আজরা হয়ে গেছে। যে এক নতুন মানুষ। যার আচরণ, স্বভাব, কথা বার্তা, চাল চলন সবই চমচমের থেকে ভিন্ন। যে মুখ বুজে তিক্ত কথা হজম করতে জানে।
চমচমের সাথে তখন দেখা হওয়ার পর চমচম তো আর তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। এগিয়ে এসে সালাম দিলো। ওয়াসিম অবাক হয়ে শুধায়,
-‘তুমি কোন পক্ষ? ছেলে পক্ষ তো মনে হচ্ছে না। মেয়ে পক্ষ তাই না!’
-‘জ্বি স্যার। আপনি ছেলেপক্ষ?’
-‘হুম। আশফাক আই মিন গ্রুম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’
-‘ওহ আচ্ছা।’
-‘তুমি? মানে ভাবীর কি হও!’
এই প্রশ্নটা চমচম এড়িয়ে যেতে চাইছিল। বস তার দুলাভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড শুনেই তো তার মাথায় হাত। বসকে কেন তার দুলাভাইয়ের পরিচিত হতে হলো! তাও আবার যে সে পরিচয় তো না তাদের। একেবারে বেস্ট ফ্রেন্ড। আশফাক ভাইয়া সবসময় তার একটা ফ্রেন্ডের কথা বলতো। যে তার সুখ, দুঃখের সাথী ছিল সবসময় এবং এখনও আছে। বলেছে বিয়েতে দেখা করিয়ে দিবে। নিশ্চয়ই ওয়াসিমের কথা-ই বলেছিল!
-‘কি হলো? আজরা!’
ভাবনার সাগর থেকে বেরিয়ে আসে চমচম। আমতা আমতা করে বলল,
-‘আমার বোন হয়। বড় বোন।’
ওয়াসিম চমচমের জবাব পেয়ে অবাক হয়। বিস্ময়ের সুরে বলে,
-‘আপন বোন?’
চমচম মাথা নাড়ে উপর নিচ। ওয়াসিম তা দেখে হেসে বলে,
-‘তবে তুমিই চমচম? ওহ গড!’
চমচম ফট করেই ওয়াসিমের মুখের দিকে তাকালো। লোকটা তার নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করছে নাকি তাকে নিয়ে? সঠিক বুঝতে পেলো না। ওয়াসিম বলতে থাকল,
-‘দ্যাটস্ গ্রেট! সুপার গ্রেট! এত কাছের একটা সম্পর্ক হতে চলেছে আমাদের। ভাবতেই খুব ভালো লাগছে। বেয়াই, বেয়ানের সম্পর্কটা দারুন। কি বলো আজরা?’
চমচম কি বলবে! করুন মুখে না চাইতে একটু মেকি হাসি ফুঁটিয়ে তোলে কেবল। ওয়াসিম যতটা উচ্ছাসিত এই সম্পর্কের ব্যাপারে অবগত হয়ে চমচম ততটাই বিরক্ত!
বর্তমানে দুজনে গার্ডেন এড়িয়াতে একটা বেঞ্চে বসে আছে। ওয়াসিম তার আর আশফাকের বন্ধুত্ব কয় বছরের, কেমন করে হলো সব আলোচনা করছে। চমচম এক কান দিয়ে শুনছে আবার আরেক কান দিয়ে বের করে ফেলছে সেসব।
আব্রাহাম পুরো কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরটা তন্য তন্য করে খুঁজল। কোথাও চমচমকে খুঁজে পেলো না। শেষে গার্ডেনে বের হয়ে আসে। এসেই দেখতে পায় একটা লোকের সাথে চমচম কথা বলছে। আব্রাহাম দূর থেকেই সেটা দেখে রে’গে গেল। কে লোকটা? চমচমের তার সাথে এত কথা কীসের! সে দ্রুত কদম ফেলে চমচমদের সামনে এসে দাঁড়ালো। চমচম হঠাৎ আব্রাহামের উপস্থিতিতে একটু ঘাবড়ে গিয়ে উঁঠে দাঁড়ায়। চমচমকে উঠতে দেখে ওয়াসিমও বসা ছেড়ে ওঠে। আব্রাহাম নিজেকে যথেষ্ট শান্ত করে বলল,
-‘তুই এখানে কি করছিস?’
-‘দেখতে পারছ না কি করছি?’
আব্রাহামের ইচ্ছে করছিল ঠাস করে একটা চ’ড় মে’রে দিতে চমচমের সুন্দর গালটায়। কিন্তু সে তো তা আর কখনোই করতে পারবে না। একবার করেই জীবনের শিক্ষা হয়ে গেছে। চমচমও বা কেন তাকে রা’গিয়ে দিচ্ছে? মেয়েটার সমস্যা কোথায়? ত্যাড়া ভাবে কথা না বললেই হয় না!
-‘তোকে সবাই ডাকছে।’
-‘কোন সবাই?’
আব্রাহাম চমচমের এমন গা ছাড়া ভাব সইতে পারল না। ওয়াসিমকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চমচমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
-‘গেলেই দেখতে পাবি। আগে চল তো!’
চমচম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আব্রাহামের শক্ত পোক্ত হাতের সাথে তার নরম হাতটা পেরে উঠল না। ওয়াসিম পেছন থেকে এগিয়ে এসে চমচমের অন্য হাতটা চেপে ধরতেই দুদিক থেকে টান পড়ায় চমচম ‘আহ্’ করে চেঁচিয়ে উঠল। আব্রাহাম সাথে সাথেই ছেড়ে দিলো তার হাত। ওয়াসিমের দিকে তেড়ে এলো রীতিমত। বলল,
-‘হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ্ হার!’
ওয়াসিম ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,
-‘হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?’
আব্রাহাম ওয়াসিমের ব্যবহারে আরো বেশি তেঁতে উঠল। কিছু বলতে চাইলেই চমচম বলে উঠল,
-‘আব্রাহাম ভাইয়া সিনক্রিয়েট করবেন না। এটা আপনার বাড়ি না।’
তারপর ওয়াসিমকে বলল,
-‘আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিত এবার। আপু নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে না পেয়ে রে’গে আছে।’
ওয়াসিম মাথা নাড়ল। বলল,
-‘হ্যাঁ। চলো।’
চমচম আব্রাহামকে পাশ কাটিয়ে ওয়াসিমকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আব্রাহাম শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। এই চমচমটাকে সে বুঝতেই পারে না। এর হাব ভাব, মতি গতি কিছুই তার বোধগম্য হয় না। এর চেয়ে আগের চমচমই বোধ হয় ভালো ছিল। আব্রাহামের হুট করেই মনে হলো আগের চমচমকেও সে বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি।
আব্রাহামের ভালো লাগল না আর ভেতরে যেতে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে সে গাড়ি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। যেখানে তার মনে আনন্দ নেই সেখানে এসব আনন্দ উৎসব তার কাছে বিলাসিতা ছাড়া কিছু না। তাছাড়া এমনিতেও এখন চোখের সামনে চমচমকে দেখলেই তার তালগোল পাকিয়ে যাবে। চমচম তার সকল অশান্তির মূল। দুঃখের কথা, জীবনে যতবার চমচম নামক অশান্তির থেকে সে দূরে থাকতে চেয়েছে ততবারই তাকে এই অশান্তির কাছেই ঘুরে ফিরে ফিরতে হয়েছে।
#চলবে