#দখিনের_জানলা (পর্ব-১৯)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৮.
চমচম চুপচাপ, শান্ত হয়ে বসে আছে। কিন্তু উপরে চুপচাপ, শান্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে হাসফাস করছে। তীব্র, অসহনীয় পর্যায়ের রা’গে ফে’টে পড়ছে। অথচ কিছুই করতে পারছে না। রা’গটাও হজম হচ্ছে না। এই যে আব্রাহাম একটু পর পরই তাকে আড়চোখে দেখছে ব্যাপারটা সে বেশ ভালোই ধরতে পারছে। আর এতে তার গা জ্ব’লে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি আব্রাহামকে ধরে চ’ড় মা’র’তে ইচ্ছে করছে। আরে গাড়ি চালাবি তো চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে এক মনে গাড়ি চালা। তুই বারবার এদিকে তাকিয়ে হাসছিস কি কারণে? মনে সুখ খুব তাই না? সেই সুখ সকলকে দেখিয়ে বেড়াতে চাইছিস? অ’ভ’দ্র কোথাকার!
রাস্তার পাশে ভ্যানে ভেলপুরি দেখে পারিজাত চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘আপু ভেলপুরি খাব!’
তারিনও মুখ উচিয়ে দেখে বলল,
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভেলপুরি খাব।’
চমচম পেছন ফিরে কটমট দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘একদমই না। এখন ভেলপুরি খাওয়া ঠিক হবে না। এটা ভাত খাওয়ার সময়।’
-‘ধুর! আমরা কলেজে কত এমন ভেলপুরি খাই এই টাইমে। কি যে বলো! ভাইয়া গাড়িটা একটু থামান না? ভেলপুরি খেতে যাব।’
পারিজাতের কথা মতো আব্রাহাম এক পাশে গাড়ি থামায়। সবাই টপাটপ নেমে পড়লেও চমচম নামল না। আব্রাহাম পারিজাত আর তারিনের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘তোমাদের আপুকে ডাকছ না যে?’
তারিন বলল,
-‘আপু খায় না এসব। ডেকে লাভ নেই আসবে না।’
আব্রাহাম গাড়ির মধ্যে বসে থাকা চমচমের দিকে তাকালো। সিটে হেলান দিয়ে সামনের দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে। আব্রাহামের মনে পড়ে গেল চমচম যখন তারিন আর পারিজাতের বয়সের ছিল তখন ফুচকা, ভেলপুরি, চটপটি কত পছন্দ করত! মেয়েলি স্বভাবের মধ্যে তার এই সব খাওয়ার অভ্যাসটাই ছিল কেবল। আজ আর সেটাও নেই। অথচ সে এখন পুরোদস্তর নারীর মতোই তো চলছে।
ভেলপুরি আব্রাহাম তিন প্লেট অর্ডার দিল। পারিজাত আর তারিন ভাবল হয়তো আব্রাহাম খাবে। কিন্তু না! সে প্লেট নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গ্লাসে টোকা দিতেই চমচম বি’র’ক্ত চোখে তাকায়। আব্রাহাম ইশারায় গ্লাস নামাতে বললে গ্লাস নামালো। আব্রাহাম হেসে প্লেটটা চমচমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘আমার তরফ থেকে। ছোট্ট একটা ট্রিট।’
চমচম বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘তোর ট্রিটরে গু’ল্লি মা’রি।’
আব্রাহাম বলল,
-‘শুনতে পাইনি কথাটা। একটু পরিষ্কার করে বললে ভালো হতো।’
চমচম শ’ক্ত গলায় জবাব দিল,
-‘খাব না আমি।’
আব্রাহাম মৃদু হেসে পারিজাত আর তারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ওরা দুজন খুব মজা করেই খাচ্ছে। আই থিঙ্ক ইটস্ রিয়েলি টেস্ট গুড।’
-‘তাতে আমার কী!’
-‘সেটাই! মেয়ে মানুষ হলেই তো এসবে আগ্রহ থাকত। চমচম যে ভিন্ন কিছু সেটা তো আমি ভুলেই গিয়েছি।’
-‘মানে কী? বোঝাতে কি চাইছ তুমি? আমি কি! মেয়ে না?’
-‘তুই মেয়ে?’
-‘আব্রাহাম ভাইয়া! এটা কিন্তু খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে।’
-‘হলে হোক। সত্যি বলতে আমি ভ’য় পাই না।’
-‘তাই তো! তুমি নিজেই তো এখন ভ’য়’ঙ্ক’র জিনিস অন্য কিছুকে আর কী ভ’য় পাবে!’
-‘আমি ভ’য়’ঙ্কর?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘তুই আমাকে ভ’য় পাস?’
-‘হ্যাঁ।’
আব্রাহাম হেসে বলল,
-‘সত্যি বলছিস?’
চমচম থতমত খেয়ে বলল,
-‘না। আমি কেন ভ’য় পাবো?’
-‘সেটাই তো। মানুষ নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভ’য় পায় না। তা সে যতই কু’ৎসি’ত হোক না কেন!’
চমচমের মুখটা এত বড় হা হয়ে গেল। নড়েচড়ে বসে বলল,
-‘আশ্চর্য! ভালোবাসার মানুষ মানে? তুমি কি ভাবছ আমি তোমাকে ভালোবাসি?’
-‘আমি কি সেটা বলেছি?’
-‘তোমার কথা থেকে এটাই তো বোঝা গেল।’
-‘চমচম! তুই বেশিই ভেবে নিয়েছিস। তাছাড়া কথায় আছে, চো’রের মনে পু’লিশ পু’লিশ। তোর মনের মধ্যে আবার কি চলছে?’
বিস্ময়ে চমচমের চোখ গুলো এবার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বলল,
-‘তুমি কি পা’গ’ল? কি যা তা বলছ?’
আব্রাহাম হাসে কিন্তু কিছু বলে না। চমচম রা’গে ফুঁ’সতে ফুঁ’সতে পারিজাত আর তারিনের দিকে তাকালো। দুজনে খিলখিল করে হাসছে আর টপাটপ ভেলপুরি পু’ড়ে দিচ্ছে মুখের মধ্যে। এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে খেতে অনেক মজা হয়েছে। চমচমের নিজের কলেজ লাইফের কথা মনে পড়ে গেল। সেও তো কত খেয়েছে এসব ফুচকা, চটপটি। একবার আব্রাহামের হাতে ধরে রাখা প্লেটের দিকে তাকালো তারপর আব্রাহামের মুখের দিকে তাকালো। সে ভাবুক হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। চমচম বলল,
-‘দেখি প্লেটটা একটু এদিকে দাও তো!’
আব্রাহাম চমচমের দিকে তাকায় কথাটা শুনে। তারপর কিছু না বলে চমচমের হাতে প্লেটটা ধরিয়ে দিয়ে ভ্যানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চমচম একটা ভেলপুরি মুখে দিয়েই চোখটা বন্ধ করে ফেলে। উফ! এসবের স্বাদের সাথে আর অন্য কোনো খাবারের তুলনা হয় না। ঝা’ল ঝা’ল মশলার সাথে মিষ্টি টকের সংমিশ্রণে ভেলপুরিটা খেতে খুবই ভালো লাগছিল।
তারিন গাড়ির কাছে এসে চমচমকে খেতে দেখে অবাক হয়ে বলল,
-‘এই! তুমি নাকি খাও না?’
চমচম আপনমনে খেতে খেতেই বলল,
-‘খাই না কে বলল? এক কালে এসব খাওয়ায় ওস্তাদ ছিলামা আমি। এখন আর কি তেমন খাওয়া হয় না।’
তারিন হ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ চমচমের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে ধরলেই চমচম ডেকে প্লেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল রেখে আসতে। তারিন মহা বি’র’ক্ত হলো কাজটায়। খাওয়ার ছিল যখন তাদের সাথে গিয়ে খেলেই তো হতো!
আব্রাহাম ভেলপুরির বিল মিটিয়ে দিয়ে আইস্ক্রিমও কিনে দিলো সবার জন্য। এবার আর চমচম কিছু বলল না। বলে কি লাভ? তার বলাতে তো কিছুই হচ্ছে না। আব্রাহাম যা বলছে তাই হচ্ছে।
৩৯.
হলুদের আয়োজন করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। প্রথমে কথা হয়েছিল বাড়ির ছাদে হবে সব। কিন্তু পরে আশফাকদের বাড়ি থেকে জানালো সবাই একসাথে হলুদ অনুষ্ঠান করবে কমিউনিটি সেন্টারে। বরের বাড়ির লোকদের কোনো চাহিদা আবার অপূর্ণ রাখা চলে না। তাই চমচমের বাবা তাতে রাজি হয়ে গেলেন।
সন্ধ্যার দিকে চমচম শাড়ি পরে তৈরি হয়েছিল। তখন তার চাচাতো বোন রাইসা এসে বলল,
-‘আপু? পার্লারে যাবে না? চলো, সবাই গাড়িতে উঠছে।’
-‘না না। আমি ঘরেই নিজের মতো সেজে নিব।’
-‘চিনি আপু ডাকছে তো। বলেছে তুমি না গেলে সেও যাবে না।’
-‘উফ! আপুটাও না!’
অগত্যা চমচম সবার সাথে বের হয়ে পড়ে পার্লারের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে তার মাথায় র’ক্ত উঠে গেল। সে সবার সাজ দেখে নিজের সাজার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। পার্লারের মেয়েটাকে অনুরোধ করে বলল,
-‘আপু, নরমাল সাজ দিবেন। একদম সাদাসিধে। এত ভারী সাজ আমি এফোর্ট করতে পারব না।’
-‘আচ্ছা আপু। আপনার অল্প সাজ হলেই চলবে। আপনি যা সুন্দর! মা শা আল্লাহ্!’
প্রশংসা জিনিসটা চমচমের হজম হয় না। সে ল’জ্জা পায় বলতে গেলে। বেশি ল’জ্জা পায় তখন, যখন কেউ তার চেহারার প্রশংসা করে।
পুরোপুরি ভাবে সাজ কমপ্লিট হওয়ার পর আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হলো চমচম। চিনি বলল,
-‘কি সুন্দর লাগছে! এই শাড়িতে তোকে খুব মানিয়েছে। আয় আমরা দুই বোন ছবি তুলি!’
চিনি আর চমচম বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। চমচম বোনের দিকে তাকায়। বোনটার হাসিখুশি মুখটা দেখে তার যে কি শান্তি লাগছিল! মনে মনে দোয়া করে দিল, তার আপু সবসময় ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, এমনই হাসি খুশি থাকুক। চিনির হাসি তার বেশি ভালো লাগে কারণ চিনিকে হাসতে খুব কমই দেখেছে সে। তাই যখনই চিনি হাসে সে প্রাণ ভরে দেখে।
পার্লার থেকে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে চলে গেল সবাই। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে তো চমচমের আরেক দফা মে’জা’জ খা’রা’প হলো। বরের বাড়ির সবাই ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তারই সাথে হাবিজাবি নাঁচাগানা করেছে। সেই সাথে তাদের পক্ষের মেয়ে ছেলে গুলোও নেঁচেছে। চমচম এসব থেকে বাঁ’চ’তে এক পাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক মিনিট পরেই নিজের পাশে একজনের অস্তিত্ব অনুভব করল, একটা মা’তা’ল করা পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগল। পাশ ফিরতেই দেখল আব্রাহাম দাঁড়িয়ে আছি। শ’ক্ত পো’ক্ত, সুঠাম দেহে পাঞ্জাবী জড়িয়েছে সে। পাঞ্জাবীর হাতাটা গুটিয়ে রেখেছে। ফর্সা হাতের রগ গুলো ফুলে রয়েছে। চমচম বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। চোখ সরিয়ে নিলো।
আব্রাহাম মৃদু হেসে বলল,
-‘এখানে একা একা কি করা হচ্ছে?’
বিরস মুখে চমচম জবাব দিল,
-‘ক’চু করা হচ্ছে।’
আব্রাহাম অবাক হয়ে বলল,
-‘কোথায়?’
চমচম চোখ তুলে আব্রাহামের দিকে তাকালো। তারপর চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
-‘কি কোথায়?’
-‘ক’চুটা কোথায়?’
চমচমের ইচ্ছে করছিল সামনের ফ্লাওয়ার ভাসটা তুলে ধরে আব্রাহামের মা’থায় ভা’ঙ’তে। অ’ভ’দ্রটা তার সাথে মশকরা করছে?
সে হেঁটে গিয়ে সামনে বিছিয়ে রাখা গোল টেবিলগুলোর একটির সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। আব্রাহামও পেছন পেছন এসে তার পাশে বসল। চমচম তার দিকে অ’গ্নি দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করে বলল,
-‘কি? পেছন পেছন আসছ কেন? স’ম’স্যা কোথায়?’
-‘সম’স্যাটা মনে। তুই তো কচুর ব্যাপারটা ক্লিয়ার করলি না।’
চমচম ‘ধ্যাত’ বলে সামনে তাকালো। হঠাৎ করেই পাত্রপক্ষের মাঝে একজনকে দেখে চমকে উঠল। সাথে সাথে আব্রাহামের দিকে মুখ করে বসল। আব্রাহাম ব্যাপারটা ল’ক্ষ্য করে বলল,
-‘কি হয়েছে?’
-‘কিছু না।’
-‘কিছু না হলে এভাবে মুখ লুকাবি কেন?’
-‘কোথায় মুখ লুকিয়েছি? বেশি দ্যাখো চোখে।’
আব্রাহাম সেদিকে তাকালো যেদিক থেকে একটো আগে হুড়মুড় করে চমচম চোখ সরালো। তাকিয়ে দেখল বেশ কয়েকজন নিজেদের মধ্যে মজা মস্তি করছে। আব্রাহাম ঠিক ধরতে পারল না কাকে দেখে চমচম এমন করল। আয়মান এসে আব্রাহামকে বলল,
-‘মা ডাকছে! জলদি চলো।’
আব্রাহাম উঠে দাঁড়ায়। তবে যাওয়ার সময় আরেকবার সেদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো।
আব্রাহাম চলে যেতেই চমচম হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু এখনও পুরোপুরি শান্তি কিংবা স্ব’স্তি কিছুই মেলেনি। সে একটু আগে তার অফিসের বসকে দেখতে পেয়েছে। চমচম এই লোকের কাছ থেকে যথা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায়। অথচ ঘুরে ফিরেই ব্যাটা সামনে এসে পড়ে! চমচম খুব ভ’য়ে আছে এই না তাকে দেখে ফেলে! সে বসা থেকে উঠে বড় বড় কদম ফেলে দোতলায় গিয়ে উঠল।
তারিন, রাইসা, পারিজাত সবাই দোতলায় ছিল। ছবি তুলছে। চমচম স্ব’স্তির শ্বাস ফেলে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে ধরলেই পেছন থেকে তাকে কেউ ডেকে ওঠে,
-‘আজরা?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পেছন ফিরে চমচম দেখল তার বস ওয়াসিম মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে। যা ভেবেছিল তা-ই! আজরা আর কে ডাকবে এখানে তাকে?
#চলবে।