দখিনের জানলা পর্ব-০২

0
902

#দখিনের_জানলা (পর্ব-২)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩.
সন্ধ্যায় নামাজ শেষ করে চমচম পড়তে বসেছে। তার সামনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বই। সে বিরস মুখে কলম দিয়ে খাতায় সাইন করছে। যদিও তার এখন গেইট করার কথা। কিন্তু সে করছে না। কারণ অংক বা অংকজাতীয় কিছু চমচমের মাথায় ঢোকে না যার ফলে মানবিক বিভাগ নিয়েছিল সে। এসএসসিতেও সাধারণ গণিত ছিল, ভেবেছে এইতো কষ্ট করে দুইটা বছর সহ্য করলেই হবে। তবে তা আর হলো কোথায়? নতুন করে যোগ হলো এখন আবার আইসিটির প্যারা।

চমচম যখন নাইনে ওঠে তখন সে অর্ধ-বার্ষিকে খাতায় তিন পেয়ে আর এমসিকিউতে পাঁচ পেয়ে একদম বাজে ভাবে ফেইল করে। মেয়ের এই করুন অবস্থা দেখে তো তার বাসায় টিউটর এনে বাবা-মা দুজনেই হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল। এমনকি আব্রাহামকে পর্যন্ত বলেছিল পড়ানোর জন্য। কিন্তু আব্রাহাম তাকে পড়াতে নাকোচ করে দেয়। এত অবাধ্য আর দুষ্ট প্রকৃতির মেয়েকে পড়ানোর ক্ষমতা নাকি তার নেই! চমচমের নিজেরও আব্রাহামের কাছে পড়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্রাহাম যেভাবে নাকোচ করেছিল চমচমের ইগোতে খুব লেগেছিল। তারপরই তো এক দুপুরে আব্রাহামদের ছাদে গিয়ে আব্রাহামের একটা প্রিয় শার্টের হাতা কে’টে নিয়ে এসেছে। বাসায় এনে সেটা আরো কু’চি’কু’চি করেছে। সেই কা’টা শার্ট নিয়ে আব্রাহাম যা হাঙ্গামা করেছিল! চমচমকেই সে বারবার দো’ষারপ করল। যথাযথ প্রমাণ না থাকায় কিছু করতেও পারেনি। চমচম ভেবেছিল আরো করবে এমন কিন্তু আর হলো না! আব্রাহাম ততদিনে ছাদে, লিফটে এবং সিঁড়িতে সিসিটিভির ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। তাই চমচমও আর শুধু শুধু রি’স্ক নিল না।

চমচমের মা তার প্রিয় দুধ চা নিয়ে রুমে ঢুকে দেখেন তার কন্যা পড়ছেও না, লিখছেও না। একমনে কেবল খাতার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি একটু সামনে এসে দেখলেন গোটা পেইজে চমচম নিজের নাম ‘আজরা মুকাররামা’ ইংরেজীতে লিখে সাইন দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। চায়ের কাপটা ধপ করে টেবিলে রেখে চমচমের গালে দুই আঙুল এক করে গুতো মারলেন। ব্যথায় চমচমের মুখ দিয়ে ‘আহ’ বেরিয়ে এলো। চমচম বিরক্ত চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা সবসময় এভাবে তার গালে ব্যথা দেয়।

-‘মা! এমন করো কেন সবসময়? ব্যথা পাইনা!’

-‘তুমি পড়তে বসার নাম করে এসব হাবিজাবি কাজ করো কেন? আমরা ক’ষ্ট পাইনা? আমাদের পরিশ্রম সব ন’ষ্ট হয় না?’

-‘ধুর! ভাল লাগে না।’

চমচম চা নিয়ে বসা থেকে উঠে পড়ল। ফাতেমা বেগম তা দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন।

-‘এই! কোথায় যাচ্ছিস তুই! একটা ঘন্টা একটু মন দিয়ে পড়তে পারিস না!’

-‘পারব না কেন? পারব তো। আগে মন দিয়ে চা খাই। তারপর মন দিয়ে পড়ব।’

ফাতেমা বেগম হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। চমচম আদৌ পড়বে কিনা সেটা কারো জানা নেই। চমচম নিজেও হয়তো জানেনা সে কি করবে! পড়বে নাকি পড়বে না?

চমচম তার রুমের দক্ষিণ দিকের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকে আব্রাহামের রুমের বারান্দাটা স্পষ্ট। এবং অনেকটা কাছাকাছি। আব্রাহামদের বিল্ডিং এর নিচের তলায় গ্যারেজ পুরোটা। আব্রাহামরা চার তলা আর পাঁচ তলা ডুপ্লেক্স রেখেছে। বাকি সব সিঙ্গেল আর এক ফ্লোরে দুইটা অথবা তিনটা করে ফ্ল্যাট রয়েছে। আর ডুপ্লেক্স করার ফলে আব্রাহামদের পাঁচ তলা চমচমদের ছয় তলার পাশাপাশিই বলা চলে। দেড় হাত তফাৎ কেবল! চমচমের রুমের এই জানালা দিয়ে যদিও শুধু আব্রাহামের রুমের বারান্দাটা দেখা যায় কিন্তু আব্রাহামের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে ওই বিশাল জানালা দিয়ে চমচমের রুমের একটা বড় অংশ দেখা যায়। বাথরুমের দরজা থেকে ড্রেসিংটেবিল পর্যন্ত সবটা স্পষ্ট দেখা যায়।

চমচম একদিন আব্রাহামের অনুপস্থিতি তার বারান্দায় এসে এই জিনিসটা খেয়াল করেছে। তারপর থেকে ল’জ্জা আর অ’স্বস্তি থেকেই চমচম এই জানলাটা বন্ধ রাখে। অবশ্য আব্রাহাম যখন হলে থাকে তখনিই খোলে। আব্রাহাম বাড়িতে থাকলে চমচম তার প্রিয় দখিনের জানলা বন্ধ করে রাখে। এই জায়গাটা চমচমের এত প্রিয়! সামনে মস্ত বড় বিল্ডিং তারপরেও কত বাতাস! যদিও মেহেদীরা ছয় তলায় কিন্তু মেহেদীদের এই পাশে কোনো জানালা নেই। বদ্ধ দেয়াল। চমচমদের ড্রয়িং রুমের সাথে মেহেদীর রুমের বারান্দা রয়েছে। বদমায়েশটা সেখানে বসে তাদের বাসায় আড়িপাতে। চমচম ঠিক করল এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। একবার কেউ চমচমের অপছন্দের লিস্টে চলে গেলে সেখান থেকে তার নাম সরানো শুধু মু’শ’কি’ল নয় অসম্ভবও বটে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতেই চমচম খেয়াল করল আব্রাহামের রুমের লাইট জ্বালানো হয়েছে মাত্র। আর ক্ষণিকের ব্যবধানেই বারান্দার থাই গ্লাস সরিয়ে আব্রাহাম বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আর সেখানে এসেই তার দৃষ্টি প্রথমেই চমচমের জানালার দিকে পড়ল। চমচমকে চায়ের কাপ হাতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও তাকিয়েই রইল একদৃষ্টিতে। চমচমের তখনকার কথাগুলো মনে পড়ে গেল আব্রাহামকে দেখে। সে চায়ের কাপটা রেখে একেবারে ঠাস করে আব্রাহামের মুখের উপর জানালাটা বন্ধ করে দিল। আকস্মিক তার এহেন কান্ডে আব্রাহাম তব্দা খেয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বিড়বিড় করে বলল,

-‘বে’য়া’দ’ব!’

৪.
চমচম পড়তে বসল আবার। এক ঘন্টা মন দিয়ে পড়ল। আরো পড়ত কিন্তু নিগার আন্টির গলা শুনতে পেল ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসছে। সে তড়িগড়ি করে উঠে যেতেই দেখল কতরকমের খাবার নিয়ে তিনি হাজির। চমচম অবাক হয়ে বলল,

-‘কখন এসেছ আন্টি?’

-‘আধাঘন্টা হবে হয়তো!’

-‘এতক্ষণ হয়ে গেছে আর আমি টেরও পেলাম না! কলিং বেলের শব্দও তো শুনিনি!’

-‘তোদের দরজা খোলা ছিল। তাই সোজা চলে এসেছি বেল না বাজিয়ে। আর তুই পড়ছিলি শুনে তোর আম্মা সহ তার রুমে বসেছিলাম। পড়া হয়েছে?’

-‘হুম অনেকটা হয়েছে।’

-‘তবে আয় খেয়ে নে। তখন তো খেলিনা কিছুই। দুই লোকমা খেয়ে চলে এসেছিস। তোর আয়মান ভাইয়া আর অনামিকা আপু এগুলো এনেছে তোর জন্য। আমিও বিরিয়ানি নিয়ে এসেছি। গরম করে খেয়ে নিবি কিন্তু!’

ফাতেমা বেগম চমকে উঠলেন কথাটা শুনে। বললেন,
-‘ও তখন খায়নি?’

-‘না। কই আর খেয়েছে! একটু মুখে দিয়ে বলল ভালো লাগছে না। চলে এসেছে।’

-‘অ’স’ভ্য মেয়েটা সেই দুপুর থেকে না খাওয়া। ঘরে এসেও কিছু খায়নি। এখন চা খেল শুধু।’

-‘তাই নাকি রে চমচম! তুই তো আমাকে ভীষণ ল’জ্জায় ফেলে দিলি রে!’

-‘তুমি ল’জ্জায় পড়বে কেন?’

-‘তো আমি তোকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। আমার ঘরে তুই খেতে পারিস নি। ঘরে এসেও তো কিছু হলে খাবি! তারপর বাটিতে করে চিনিদের জন্যও দিব ভেবেছিলাম তুই চলে এলি দৌঁড়ে। ঠিক করলি কি তুই? তোর মা জানে তার মেয়ে ভরপেট খেয়ে এসেছে। আর এখন এসব শুনে আমার উপর রা’গবেনা?’

চমচম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল নিগার খানমের দিকে। এসব জটিলতা সে বোঝে না। চমচম কিছু বলার আগেই চমচমের মা জবাব দিলেন,

-‘ছিঃ ছিঃ ভাবী কি যে বলেন! আমি কি জানিনা আপনি এটারে কত ভালোবাসেন! দো’ষ তো এর নিজের। একটা অবাধ্য মেয়ে। দিন দিন তার খাম খেয়ালীপনা বাড়ছে।’

নিগার খানম কথাটা শুনে ঠোঁট টিপে হেসে বলেন,
-‘বিয়ে দিয়ে দেন তবে!’

-‘হ্যাঁ। ভাবছি সেটাই করব। পড়ালেখাও করে না। লাভ কী ঘরে রেখে? তার থেকে ভালো বিয়ে শাদি করুক। স্বামীর ভাত রান্না করুক।’

চমচম ভীষণ রে’গে গেল। বিয়ে সংক্রান্ত কথা শুনলে তা গা জ্ব’লে যায়। সে চিৎকার করে বলল,

-‘আর একবার বিয়ে বিয়ে করলে বেশি ভালো হবে না কিন্তু! তোমাদেরকেই বিয়ে দিয়ে দিব বলে দিলাম।’

চমচম খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে চিনির রুমে ঢুকল। চিনি তখন প্রজেক্ট তৈরি করছিল। চমচমকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো। বলল,

-‘আহ চমচি! এখানে এসে তোর খাওয়ার কি দরকার? আর জায়গা নেই।’

-‘আমি তো এসেছি দুজন মিলে একসাথে বসে খাব বলে। আচ্ছা তুমি যখন খাবে না তখন আমি এগুলো নিয়ে চলে যাই। একাই খেয়ে ফেলতে পারব।’

-‘এই রা’ক্ষু’সী দাঁড়া! আমিও খাব। যাবি না একদম।’

চমচম প্লেট সাজিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। চিনি বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। আসলে কাজ করতে করতে তার কখন ক্ষিধে পেয়ে গেছে টেরই পায়নি। চমচম খাবারের কথা বলতেই তার যে ক্ষুধা পেয়েছে সে বুঝল।

————————
পরদিন সকালে চমচমের কলেজ যাওয়ার সময় আব্রাহামের সাথে মোড়ের মাথায় দেখা হলো। আব্রাহাম নিজের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। চমচম রিকশা পায়নি তাই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। ভেবেছিল আব্রাহাম লিফ্ট দেবে। কিন্তু আব্রাহাম ফিরেও তাকায়নি। চমচম ভীষণ ক’ষ্ট পেলো। তবে ভেতরে ভেতরে তার মনে প্র’তি’শো’ধের আ’গু’নও জ্ব’ল’জ্ব’ল করছিল। সে কলেজ হেঁটেই গেল। তবে যেতে যেতেই বিরাট বড় পরিকল্পনা করে ফেলল। আব্রাহামের এই কাজের জন্য তাকে একটু টাইট সে দিবেই। আব্রাহাম তাকে না দেখার ভান করেছে! চমচমকে না দেখার ভান করেছে! হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়বে সে আব্রাহামকে যে চমচমকে উপেক্ষা করলে কি হয়!

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে