দখিনা প্রেম পর্ব-২+৩

0
1728

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০২ +০৩||

—“বসন্তী সুন্দর সকালে ফুল হয়ে নিজের অস্তিত্বের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়েছিলি তুই সেহের। তাইতো তোর নাম রেখেছিলাম ‘সেহের’! সেহের শব্দের অর্থ সুন্দর সকাল ঠিক যেমন তুই। এভাবে সুন্দর সকালের মতো মিষ্টি আলো ছড়িয়ে দে মা। আমার দোয়া তোর সাথে সবসময় থাকবে। আসি রে…!”

বলেই সেহেরের মা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আর সেহের অন্ধকারে হাঁতড়ে হাঁতড়ে তার মাকে ডাকছে আর কান্না করে যাচ্ছে।
একসময় “মা” বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠলো সেহের। সেহেরের পুরো শরীর ঘেমে একাকার। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে বারংবার। চোখের কোণও অশ্রুতে ভিজে গেছে। সেহেরের চিৎকার শুনে দাদীমাও হুড়মুড় করে শোয়া থেকে উঠে বসলো আর উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“কী হইলো ফুল এভাবে চিৎকার দিলি ক্যান? দুস্বপ্ন দেখছিস? থাক কিছু হইবো না আয় ঘুমানোর চেষ্টা কর আমি ঘুম পাড়ায় দেই।”

সেহের মাথা নেড়ে দাদীমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো আর তার দাদীমা পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। একসময় দাদীমা বালিশের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেলো কিন্তু সেহেরের ঘুম আসলো না। এক অজানা ব্যথায় ভেতরে ভেতরে কাতর হয়ে যাচ্ছে না। ব্যথাটা অচেনা নয় অবশ্যই চেনা কিন্তু বারংবার তার কাছে নতুন হয়ে ফিরে আসে। তার মায়ের সাথে কাটানোর সময়গুলো স্বপ্ন আকারে চলে আসে। হয়তোবা এটা সারাদিন এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ফল। সেহের মাথা উঠিয়ে দাদীমার দিকে তাকালো। তখনই চারপাশের আজানের ধ্বনি কানে আসলো। সেহের চোখ মুছে নিজের মাথা থেকে আলতো করে দাদীমার হাত সরিয়ে উঠে বসলো। অতঃপর অতি সাবধানে দাদীকে শুইয়ে কাঁথা টেনে দিলো। বসন্তকাল চললেও শেষরাতে ঠান্ডাকে আবরণ করে এই কাঁথা অথবা ল্যাপ। বেলার গড়িয়ে গেলে কাঁকফাটা রোদ আর আঁধার নামলেই গাঁয়ের লোম দাঁড়ানো শীতল হাওয়া।
সেহের দরকার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরলো। বড় জেঠুর বাসায় এই একটাই বাথরুম।
ওযু করে বেরিয়ে দেখলো তা চাচী গাঁয়ে শাল জড়িয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
সেহেরকে দেখতে পেতেই চাচী এগিয়ে এসে বললো,

—“নামাজ পড়বি মা?”

—“হ্যাঁ চাচী। তুমি বসে আছো কেন?”

—“ওযু করার অপেক্ষায় ছিলাম। আর শুন ঘরে গিয়ে ওয়ারড্রবের উপরের ২য় ড্রয়ার খুললেই জায়নামাজ পাবি।”

—“আচ্ছা চাচী।”

বলেই সেহের ঘরে চলে এলো। চাচীর কথামতো জায়নামাজ নিয়ে নামাজ পড়া শুরু করলো। মোনাজাতে বসে নিজের মায়ের জন্য খুব কাঁদলো সেহের। মোনাজাত শেষে জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সেহেরের সারা শরীরের যন্ত্রণা একসাথে হামলা করলো। এতক্ষণ অনেক কষ্ট করে সহ্য করেছে এখন আর পারছে না। জায়নামাজ ভাঁজ করে সঠিক জায়গায় রেখে কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। আজ ভোরবেলা হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যথায় ছটফট করতে করতেই সেহের ঘুমিয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠলো সকাল দশটায়। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কখনোই সে এতো দেরী করে ঘুম থেকে উঠেনি। চাচী তখন হাতে শুকনো মরিচের ডালা নিয়ে উঠোনে যাচ্ছে। সেহের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কী মনে করে সেহেরের ঘরে উঁকি দিলো। উঁকি দিয়ে দেখলো সেহের জলদি উঠে দাঁড়াচ্ছে। চাচী ডালাটা রেখে রুমে ঢুকে বললো,

—“আরে আরে এভাবে তাড়াহুড়োর কী আছে চুপচাপ বস!”

—“না চাচী কী বলো? দশটা বেজে গেলো আর আমি পরে পরে ঘুমোচ্ছিলাম, কেমন দেখায় বলো তো? আর আমাকেও তো ডেকে দিতে পারতে।”

—“ডাকিনি কারণ আমি জানি তুই অকারণে দেরী করে ঘুম থেকে উঠিস না। এভাবে ঘুমোচ্ছিস তার মানে নিশ্চয়ই তোর শরীর খারাপ। তাইতো আমি বা মা তোরে ডাকি নাই। যাহোক আবিদ কলেজ যাওয়ার আগে তোর জন্য ব্যথার ওষুধ আর মলম কিনে দিয়ে গেছে। হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়, খেয়ে তারপর ওষুধ নিবি।”

—“ওহ চাচী সামান্য বিষয় নিয়ে টাকা খরচের কি দরকার ছিলো?”

—“এই চুপ কর। এসব বলবি তো চড় খাবি যা নিয়ে হাতমুখ ধুঁয়ে আয়, আমি উঠানে যাচ্ছি।”

বলেই চাচী বেরিয়ে গেলো। সেহের কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বেরিয়ে গেলো। চাচী তাকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো সাথে পরম যত্নে মলমও মালিশ করে দিলো। সেহেরের অবস্থার কারণে দাদীমা সেহেরকে কলেজ যেতে দেয়নি। ১২টা নাগাদ উঠোনে মোড়া দিয়ে বসে দাদীমা সেহেরের মাথায় তেল মালিশ করছে আর সেহের আরামে চোখ বুজে শান্তি উপভোগ করছে। দাদীমা তেল দিতে দিতে বলে,

—“হ্যাঁ রে ফুল! তুই আসলেই আমাগো ফুল রে, ফুলের মতো চেহারা আবার দীঘল রেশমি চুল। তোর নাম ফুল রাইক্ষা ভুল করি নাই।”

—“আচ্ছা দাদী আমার নাম ফুল রাখলে কেন?”

দাদীমা হেসে বলা শুরু করে,
—“আমার একখান গোলাপের চাড়া আছিলো। বছরখানেক যত্ন কইরাও ফুল ফুটাইতে পারি নাই। শেষে অনেক হতাশায় ভুগলাম কিন্তু যখন শুনলাম আমার ছোট নাতনি আইসে হেইদিন দৌড়ায় যাওয়ার সময়ই হঠাৎ গাছের দিকে চোখ যায় আর তা দেইখা আমি সেখানে থম মেরে দাঁড়াইয়া কাইন্দা দেই। দীর্ঘ কয়েকবছর পরে হেইদিনই প্রথম কই হইসিলো রে ফুল। সেই সুখে দুলতে দুলতে হাসপাতাল যাইয়া আরেক ফুল পাইলাম মানে তোরে। কী নিষ্পাপ এবং মাহশাল্লাহ চেহারা। তোর চেহারার লাল আভাটা যেন আমার লাল গোলাপের সংকেত ছিলো। গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ছিলো তোর ঠোঁটজোড়া, সেই ঠোঁটের মৃদ্যু নড়াচড়া, ঠোঁটের কোণ বেয়ে লালা ঝড়া সব যেন আমারে আরও প্রাণোচ্ছল করে দিসিলো৷ তাইতো তো তোর নাম রাখলাম ফুল! জানোস না তোর সেই অবস্থায় তোর দাদারে দিয়া আঁকাআঁকির মাস্টার আনাইয়া তোর ছবি আঁকাইসিলাম। হেই ছবি এহনো আমার কাছে আছে।”

—“তোমার ওই গোলাপ চাড়া কই দাদী?”

—“তোর বাপের বাগানে কবেই তো মইরা পইরা আছে।” বলেই মুখ গোমড়া করে ফেললো দাদীমা। সেহের হতাশ হয়ে চুপ করে রইলো। তার বাবা সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে না সে। কী বলবে সে? বলার মতো কি-ই বা আছে।

দুপুরের দিকে সেহের কিছুটা সুস্থ অনুভব করতেই সে রান্নাঘরে চলে গেলো তার চাচীকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে। চাচী করতে দেয়নি, কিন্তু সেহের জোর করেই রান্না শুরু করে দিয়েছে। চাচী মাছ কাটছে আর সেহের মাছ ভাঁজছে। আজ ইলিশ ভাঁজা আর আলুর ভর্তা হবে। সেহের অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে খাবে আজ। সেহেরের ইলিশ বড্ড পছন্দের তাইতো দাদীমা সক্কাল সক্কাল বড় জেঠুকে পাঠিয়েছে তাজা দেখে ইলিশমাছ আনাতে। বড় জেঠুও কোনোরকম কথা না বলে তার সেহের মায়ের জন্য বাজারে ছুটেছে। জেঠু আর চাচী সেহেরকে বড্ড ভালোবাসে নিজের মেয়ের মতোই। সেহেরের বাবাও এতোটা ভালোবাসেনি যতোটা ওনারা ভালোবেসেছে।
মাছ ভেঁজে ভাত বসাতেই দেখলো উঠোন দিয়ে রান্নাঘরের দিকেই আসছে আবিদ আর সেহেরের সখি একমাত্র প্রাণের বান্ধুবি মানজু। মানজুকে দেখে সেহের জলদি হাত ধুঁয়ে বেরিয়ে এলো। মানজুর কাছে এসে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। মানজি তো কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলো,

—“এ তোর কি হলো সখি! ঠোঁটের আশেপাশে এমন কালো দাগ কেন? কী বিভৎস!”

সেহের ম্লান হেসে বলে, “আরে তেমন কিছু না। ভেতরে আয়, হঠাৎ আবিদ ভাইয়ের সাথে এখানে হাজির হলি?”

—“তো কী করতাম? কলেজ যাসনি তাই আবিদ ভাইয়ের সাথে দেখা করি। ওনার মুখে সব শুনে না এসে পারলাম না।”

পাশ থেকে আবিদ বলে উঠলো,”হ্যাঁ। আর তোর নাকি সামনে পরীক্ষা আসছে তাই কলেজের পড়ার জন্য হলেও নিয়ে আসলাম। মানজু আমার বোনকে সব দিয়ে দিস আমি একটু বাইরে গেলাম কাজ আছে।”

মানজু মুখ ভেঙচিয়ে বললো, “তোমার কাজ তো শুধু বখাটেগিরি করা!”

মানজুর কথায় আবিদ থেমে মানজুর দিকে তেড়ে আসলে মানজু চট করে সেহেরের পিছে দাঁড়িয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,

—“ফুল বাঁচা আমায়৷ তোর ওই বখাটে ভাই আমার সাথে বখাটেগিরি করতে আসছে! ”

—“ফুল তোর এই বাঁচাল বান্ধুবিকে চুপ থাকতে বল ওরে কিন্তু আমি বেলমাথা করে বাড়ি থেকে বের করে দিবো!”

—“এএহ! টাকমাথা করলে আপনার মাথায় বুঝি ডুগডুগি বাজাবো!”

—“আহ তোরা থামবি! আবিদ ভাই তুমি যাও তো আর মানজু থাম তুই! সারাক্ষণ লাগিস কেন? তোর মা আর চাচীর কানে গেলে দুটোকেই দেবে ধরে কেলানি!”

তখনই চাচী এসে হাজির হলো। কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রুজোড়া কুচকে বলে উঠলো,
—“কে কাকে মারবে রে? আর পুঁত এই ভরদুপুরে তুমি কই যাও? খাওয়া-দাওয়ার কী হবে শুনি?”

—“বাবা যেতে বলেছে মা আমি যাবো আর আসবো। কিসের কাগজপত্র দিয়ে দিবে নাকি আমার কাছে।”

—“ও আচ্ছা তাহলে যা। জলদি ফিরিস আমি ভাত বাড়ছি। আর ফুল মানজুকে নিয়ে ভেতরে যা এই কাঁকফাটা রোদে দাঁড়ানোর মানে হয় না।”

—“আচ্ছা চাচী।”

বলেই সেহের মানজুকে নিয়ে ভেতরে চলে আসলো। ভেতরে এসে দেখলো দাদী পানে চুন, সুপারি দিয়ে মশলা করছে। মানজু দাদীকে ডাকলো তখনই যখন দাদীমা মুখে পান পুরলো। পান চিবুতে চিবুতে ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

—“কী মানজি আজ কী মতলবে আসছোস হু?”

—“তোমার নাতনিরে আজকের পড়া বুঝাইতে গো দাদী!”

—“ও আচ্ছা। তাহলে তোরা গল্প কর আমি দেহি যাইয়া বড় বউর রান্দোন কদ্দুর!”

বলেই আস্তে ধীরে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। এবাড়ির রান্নাঘরটা বাড়ির ভেতরে না বাহিরে করা হয়েছে। উঠোন পেরুলেই রান্নাঘর, যদিও বেশি দূরে না, অল্প। সেহের কী কাজে বাইরে এসেছিলো তখন একটা গাছ থেকে ছোট্ট বরই পরলো ঠিক সেহেরের সামনেই। সেহের ভ্রু কুচকে উপরে তাকালো। পাতাও কয়েকটা ঝরছে এর মানে নিশ্চয়ই কেউ বরইতে ঢিল মেরেছে। সেহের ছোট্ট বরই হাতে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে গেলো। কারণ, বাড়ির সামনে উঁচু উঁচু দেয়াল হলেও বাড়ির পেছন দিকে লারকি আর লম্বা লম্বা গাছে ডাল দিয়ে বাঁধানো। যদিও বেশি উঁচু নয় তবে ঢিল মারার জন্য যথেষ্ট। সেহের পেছনে এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতেই দেখলো তার ভাই রিমন হাতে একটা খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই খেলনা দিয়েই রিমন ঢিল ছুঁড়েছে সেটা সেহের বেশ বুঝলো কারণ, এই ঢিল মারায় তার এই ছোট্ট ভাই খুব অভিজ্ঞ। সেহেরকে দেখতে পেতেই রিমনের চেহারা আনন্দে চিকচিক করে উঠলো। সে ঢিলের খেলনা তার প্যান্টের পকেটে ঝুলিয়ে পায়ের সামনে থাকা একটা প্লাস্টিকের ডিব্বাটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
সেহের কিছু বলার আগেই রিমন বলে উঠলো,

—“আপু আজ জানিস বাসায় বিরিয়ানি রান্না হয়েছে কারণ আমি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছি। আম্মু আমার ভাগে যেটুকু দিয়েছিলো সেগুলো তোমার জন্য লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। এখন জলদি এই বক্সটা নেও তো!”

—“এ তুই কী করলি ভাই! কে বলেছে তোকে এগুলো আনতে। তোর খাবার তুই খাবি, এখন এগুলো নিয়ে যা বলছি। মা জানলে রক্ষা থাকবে না।”

রিমন মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে বলে,”উহু! তোমার জন্য এনেছি তুমি খাবা ব্যাস! ছোট থেকে নিজের চোখে দেখেছি আমার ওই কেলেঙ্কারি মা আর বোন কি পরিমাণ অত্যাচার করেছে।”

—“এসব বলে না ভাই আমার। ওনারা আমাএ গুরুজন, গুরুজনদের এসব বলতে হয় না সোনা!”

—“গুরুজন বলে কী ঠিক-বেঠিক বুঝবে না? দেখো আপু আমি ওনাদের সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই না। এখন তুমি এগুলা নিবে নাকি আমি না খেয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকবো? জানো আজ সকাল থেকে কিছু খাইনি। মা ঘুমিয়ে ছিলো এতো ডাকার পরেও উঠেনি। তাই না খেয়েই স্কুল গিয়েছি। এখন তুমি কী চাও আমার পেটে আরও কয়েকশো ইঁদুর দৌড়াক?”

সেহের হতাশ হলো। সে নেই দেখেই তার ভাইকে এমন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেহের খুবই লজ্জিত। আর ক্ষুধার্ত ভাইকে কষ্ট না দিয়ে সে বক্সটি নিয়ে বললো,

—“দেখ নিয়েছি এবার খুশি? এখন যা গিয়ে খেয়ে নে।”

—“আচ্ছা আপু!” অনেকটা খুশি হয়ে বললো রিমন। যেতে গিয়েও থেমে বলে,

—“বুবু তুমি আমার কাছে কবে আসবে?”

রিমনের এই কথায় যেন সেহেরের ভেতরটা মেঘের গর্জনের তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। করুণ চোখে অসহায় ভাইটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

অভিনেত্রী সিনথিয়া বারংবার নিজের স্টেপ ভুল করছে সা’দের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। আর সা’দ এতে চরম রেগে বারবার “কাট” “কাট” বলে উঠছে। এবার যেন সা’দের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো!

—“মিস সিনথিয়া আপনি কী এখানে আমাকে দেখতে আসছেন নাকি কাজ করতে? নিজের কাজটার দিকে ফুল ফোকাস করুন! আপনার জন্য আমাদের নেক্সট শিডিউল মিস যাচ্ছে। আপনি একজন অভিনেত্রী বলে বারবার ভুল করবেন আর আমরা দেখে যাবো এমন কিছু ভাবার চেষ্টাও করবেন না। সকলের কাছেই সময়ের মূল্য আছে স্পেশালি মাইন! সো গো ফাস্ট আদারওয়াইজ আই উইল টেক একশন!”

সা’দ আরও কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না তার এসিস্ট্যান্ট কারীবের জন্য। অভিনেত্রী সিনথিয়া মুখটা কাচুমাচু করে মিনুতির সুরে বললো,

—“সরি স্যার। আমি আগে থেকে ফুল ফোকাস করবো প্রমিস!”

—“তো এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে গো এন্ড ডু ইউর ওয়ার্ক!”

বলেই সা’দ কিছু না বলে নিজের ডাইরেক্টর চেয়ারে বসলো। এখানের একটা কথাও সা’দ ঝাড়ি দিয়ে বলেনি পুরোটাই শান্ত এবং কড়া কন্ঠে কথাগুলো বলেছে। সা’দ কখনোই কারো সাথে দুর্ব্যবহার করে না সে যতো খামখেয়ালি-ই করুক না কেন। যা বলার শান্ত সুরেই বলবে। তাও সা’দকে সবাই বাঘের মতো ভয় পায়। সা’দ এমন একজন মানুষ তার মাঝে কখন কী চলে তা কেউই বুঝে উঠতে পারে না। তবে সা’দ ঠান্ডা ভাষায়ও মান-সম্মান খুয়ানোর মতো কড়া ধাঁচের কথা বলতেও জানে। তাই হয়তো সকলে ভয় পায়। আজ সা’দই শিডিউল নিচ্ছে কিন্তু এই সিনথিয়ার খামখেয়ালি তার একদমই সহ্য হচ্ছিলো না। সা’দ তার মতো কখনো গম্ভীর, কখনো রসিক মানুষ আবার কখনো নরম মানুষ। তবে আজ অবধি কেউ তার নামের সাথে “বদমেজাজি” ট্যাগ লাগাতে পারেনি ইনফেক্ট নিজের পরিবারের মানুষরাও না। সা’দের ভাষ্যমতে, “তুমি যা-ই করো তোমার রাগের বহিঃপ্রকাশ কখনোই তোমার জন্য সুফল নয়।”
হয়তো এই জন্যেই সা’দ এতো কম সময়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পেরেছে। তার টিমের ওয়ার্কাররা যথেষ্ট সম্মান এবং ভালোবাসে সা’দকে। সা’দ দেখতে সুঠামদেহি, লম্বা এবং দুপুরুষ। অনেক অভিনেত্রী তো বলেই দেয় তাদের হিরো সা’দকেই হওয়া উচিত। কিন্তু সা’দ কোনোদিন অভিনয় করেনি। সে এই সিনেমা এবং নাট্য পরিচারলনাতেই সন্তুষ্ট। যদি তার পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করতো তাহলে হয়তো তার আয় আরও বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু ওইযে সা’দ বিন সাবরান তার ইচ্ছেকেই বেশি প্রায়োরিটি দেয়। তার ইচ্ছের উপর আজ অবধি কেউই উঠতে পারেনি। তবে একজন পারে, সে আর কেউ নয় তার একমাত্রে মা জননী আসিয়া খাতুন।

সা’দের কড়া কথায় এবার সিনথিয়া বেশ ভালো এক্ট করলো! সকলে মুগ্ধ নয়নে দেখেছে তার নিখুঁত অভিনয়। এই শিডিউল শেষ হতেই কারীব এসে সা’দের সামনে দাঁড়ালো! সা’দ বোতল থেকে পানি খেতে খেতে বললো,

—“কী বলবে বলো!”

—“স্যার আপনি বুঝেন কী করে আমি কখন কিছু বলতে আসি আর কখন কাজে।”

সা’দ আরেক ঢক পানি খেয়ে বললো,

—“তোমাকে আমি আজ থেকে চিনি না। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনি।”

—“বুঝলাম। তবে বলতে আসলাম, আপনি সিনথিয়া ম্যামকে ভালোই ডোজ দিয়েছেন।”

—“আরও আগে দেয়া উচিত ছিলো। তাহলে আজকের সেকেন্ড শিডিউলটার সময় বদলাতে হতো না।”

—“স্যার আমার কী মনে হয় জানেন?”

—“কী?”

—“সিনথিয়া ম্যাম আপনাকে পছন্দ করে!”

সা’দ এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই শুনতে পেলো না। আপাতত কিছুক্ষণ আগের রেকর্ডটা মনোযোগ সহকারে দেখছে৷ আর কারীব হতাশার দৃষ্টি নিয়ে তার স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রেম-ভালোবাসা আর পছন্দের কথা বললেই যেন সা’দের কানে যেন অটোমেটিক সুপারগ্লু লেগে থাকে। বরাবরই সা’দ এইসব প্রেম-ভালোবাসা খুব নিখুঁতভাবেই ইগনোর করে যেমনটা এখন করলো। কারীবকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সা’দ মিনি টিভিটার দিকে তাকিয়েই বললো,

—“ব্ল্যাক কফি!”

—“আনছি স্যার।”

বলেই কারীব চললো কফির ব্যবস্থা করতে। সে আজ আবারও ভালোভাবে বুঝলো তার স্যারকে প্রেম করাতে খুব একটা সক্ষম হবে না।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৩ ||

—“পাগল নাকি তুই? তোরে আমি নরকে তোরে পাঠামু তুই চিন্তা করলি কি কইরা? কোনোদিনও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না!” অত্যন্ত রেগে কথাগুলো বললো দাদীমা। সেহের দাদীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো।

—“দাদী! আমার বই-খাতা সব ওই বাড়িতে দয়া করে বোঝার চেষ্টা করো। আর রিমনটাও ভালো নেই গো, আমার যে ওর এই অবস্থা একদমই ভালো লাগছে না।”

—“তো আমি কি করমু? আর তোর বই-খাতা আমি আবিদরে দিয়া আইন্না নিমু তাও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না।”

—“ফুল দেখ বোঝার চেষ্টা কর। এবার তোর বাবা তোরে পাইলে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবে! তোর কী একটুও প্রাণের ভয় নেই?”

—“দুইদিনের দুনিয়ায় প্রাণের ভয় করে কী লাভ ভাইয়া? এরচেয়ে ভালো নয় কী উপর যিনি আছেন তার উপর ভরসা করে চলতে?”

আবিদ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো। সেহেরের চোখে মিনুতি। আজ অবধি কোনোদিন তারা সেহেরকে এই বাড়িতে রাখতে পারেনি এক অথবা দুইদিনের বেশি। কিসের টানে যে সেহের বারবার ওই বাড়িতে চলে যায় তা তাদের অজানা। কিন্তু কেউ-ই চায় না এই অসহায় মেয়েটাকে ওখানে রাখতে। সকলেই জানে সেহেরকে কতো অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আবিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। দাদীমা হাজার তর্ক, বকাবকি করেও সেহেরের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারলো না। তাই সেও আর কিছু বলতে পারলো না। সেহের রাতের খাবার খেয়েই চাচীর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে সেহের সেই বাড়িতে চলে গেলো। দরজায় নক করার মিনিটখানেক পর সৎমা দরজা খুলে দিলো। সেহেরকে দেখে সে কোনোরকম রিয়েকশন করলো না, সৎমা যেন আগেই জানতো সেহের আসবে। সেহের ম্লান হেসে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,

—“রিমন কোথায় মা?”

—“ঘুমিয়েছে।”

—“কোনো কাজ আছে? আর বাবা আসেনি?”

—“না আসেনি। থালাবাসনগুলো আছে সেগুলো পরিষ্কার কর গিয়ে। আমি গেলাম শুতে।”

বলেই হাত পা টানতে টানতে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলো। সেহের কিছু না ভেবে উপরে রিমনের ঘরে চলে গেলো। গাঁয়ে কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে তার প্রিয় ভাই। সকালে উঠে বোনকে দেখতে পেয়ে রিমন কেমন রিয়েকশন করতে সেটাই ভাবছে সেহের। মুচকি হেসে ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইয়ের মাথার পাশে বসলো। কিছুক্ষণ পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সৎমায়ের কথানুযায়ী চলে গেলো কাজ করতে৷ যদিও সেহের এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয় তবুও কিছু বলেনি। গ্রামের প্রায় সকলেই জানে সেহের কী পরিমাণ অত্যাচারিত হয়। কিন্তু সেহের মুখে স্বীকার করে না দেখে কেউ কিছু করতে পারে না। সেহের স্বীকার করলে হয়তো তার বাবা এবং সৎমায়ের সকল কাড়সাজি একদিনেই ঘুঁচে যেতো৷ থালাবাসন মেজে ধুয়ে উঠতেই কিছু ভাঙার শব্দ পেতেই সেহেরের টনক নড়লো। ওড়না দিয়ে ভেজা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো তার বাবা মাতাল হয়ে এদিক সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে নিজের মাঝে নেই। সেহেরের দিকে চোখ যেতেই কবির বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,

—“কিরে ফইন্নির ঝি! এতদিন কোন নাগরের লগে ছিলি হ্যাঁ? তোর আবুল না কী জানি নাম, ও হ্যাঁ আবিদ। ওর তো তোর লেইজ্ঞা দরদ এক্কেবারে উতলায় পরে। তা আর কতো নাগর আছে রে? মা** বাসায় যে কাজ পইরা ছিলো হেইডি দেখসিলি! আমার বউডা কত্তো কষ্ট করসে দুইডাদিন! তোর এই আবুইল্লা কারণে আমার বউডা কতহানি পালসে আমার পুলারে। খবরদার যদি আমার পুলার গাঁয়ে একটা আঁচড়ও কাডোস তোরে আমি এবার ছাদ থেইক্কা লাত্থি মাইরা ফেইলা দিম!” এমন নানান বিলাপ বকছে কবির। সেহের চুপচাপ শুনছে কিছু বলছে না। বাবার এসব কথায় কষ্ট লাগলেও কেন জানি কান্না পায় না। কান্নারাও ক্লান্ত এইসব শুনতে শুনতে। একসময় এসব বকর বকর থেমে গেলো। কবির সেখানেই লুটিয়ে পরে ঘুমে কাত। সেহের লাইট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে সে চেয়ারে বসে গেলো পড়তে। সারাদিন কাজ করে সেহের এই রাতেই নিজের পড়ালেখা শেষ করতে পারে। সৎমা কখনোই চায় না সেহের পড়ুক তাই সে সারাদিন নানা কাজে সেহেরকে ব্যস্ত রাখে কিন্তু সেহের যে রাতে পড়ে সেটা তার অজানা। পড়াশোনার জন্য সেহের অনেক কষ্ট ভোগ করেছে কিন্তু কেউ তার লেখাপড়া দমাতে পারেনি। জেঠু সেহেরের পড়াশোনার খরচ বহন করে তাই কবির এই বিষয়ে কিছু বলে না। বলা যায়, প্রয়োজনবোধ করে না। সৎমা নানানভাবে সেহেরের পড়াশোনা বন্ধ করতে বললে কবির সবসময় এক কথাই বলে,
—“ওর লেহাপড়া দিয়া আমার কোনো কাম নাই। আমি তো ওর পড়ার খরচ দিতাসি না ভাই দিতাসে! তো খাক স্যারগো জুতার বাড়ি!”

এক কথা শুনতে শুনতে সেহেরের মা ক্লান্ত। তাই সে আর তার স্বামীকে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে না। নিজে আর তার মেয়ে মিলে দমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

—“উফফ মা বলো না তোমার কী হয়েছে? এভাবে মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে বসে আছো কেন?”। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে সা’দ। সা’দের কথা পাত্তা না দিয়ে মা চোখ বুজে আগের মতোই মাথায় আইসব্যাগ ধরে বসে আছেন। রুবাই হাতে ফাইল নিয়ে ক্যারিডোরে পায়চারি করছে আর ফাইল দেখে দেখে ফোনে কাউকে কিছু বলেই চলেছে। সা’দ ফোনে যখন শুনলো তার মার এই অবস্থা তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছে। এদিকে তার মাও কিছু বলছে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পরেছে সা’দ৷ সা’দ লম্বা শ্বাস ফেলে খুবই দৃঢ় গলায় বললো,

—“মা তুমি বলবে নাকি আমি যাবো? আমার শিডিউল আছে মা প্লিজ চুপ করে থেকো না।”

এবার উনি চোখ মেলে তাকালেন আর কড়া কন্ঠে বলে উঠলেন,

—“সারাদিন এত শিডিউল শিডিউল করে তো ফ্যামিলিকেই ভুলে যাস! মনে থাকে না ফ্যামিলিকেও তোর সময় দিতে হয়?”

—“দেখো মা! আমি যথেষ্ট সময় দেই তোমাদের। কিন্তু হঠাৎ এসব বলছো কেন তুমি? নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে!” ভ্রু কুচকে প্রশ্নটা করলো সা’দ। মা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

—“সামনে কুরবানির ইদ। কতোদিন হলো গ্রামে যাই না, শাশুড়ীর সাথে আলাপ করতে পারি না। তোদের ব্যস্ততা কী এই জীবনে শেষ হবে না?”

—“আহ মা! ইদ আসতে আরও দেড় মাসের মতো বাকি। আর তুমি এই দেড় মাস আগে এসে বলছো ইদ করতে যাবে। এসব চিন্তা ছাড়া আর কিছু কী নেই?”

—“এই তুই চুপ কর। সারাদিন আজারে বসে থাকলে এসব চিন্তা আসবেই। এখন আমায় বল এবার গ্রামে ইদ করবি? বল!”

—” তুমি তাহলে জাস্ট এই কথাটা বলার জন্য আমায় ডেকে পাঠিয়েছো? পাক্কা ১ ঘন্টার জ্যাম সহ্য করে আমি এখানে আসছি তোমার এইসব কথা শোনার জন্য? হায় আল্লাহ!”

—“তাহলে তুই কী বলতে চাস? আমি তোকে ডিস্টার্ব করেছি? হায় আল্লাহ তুমি আমাকে এই দিন দেখালে! সন্তান তার মায়ের জন্য বিরক্ত!”

—“মা প্লিজ বাজে বকিও না। আমি অনেক টায়ার্ড রুমে যাচ্ছি।”

বলেই উঠে যেতে নিলো তখনই মা বলে উঠে,

—“খেয়েছিস?”

সা’দ থেমে পিছে ফিরে বলে,
—“নাহ খাইনি। তবে আপনার যদি এই অবলা পুত্রের উপর দয়া হয় তাহলে অতি দ্রুত আমার কক্ষে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমায় ক্ষুদামুক্ত করতে পারেন।”

সা’দের কথায় মা আইসব্যাগ নামিয়ে হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। সা’দও মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো সেন্টার টেবিলে খাবার এবং কফি রাখা। সা’দ আগে গিয়ে কফিটাই নিয়ে নিলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে কারীবকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ আর সে বেরোবে না। একেবারে কাল ১১টা নাগাদ যেন সে চলে আসে। সা’দের কথায় ওকে বলে কারীবও কল রেখে দিলো। সা’দ কাজের সময় বেশি কথা পছন্দ করে না তাই কারীব কিছু বলে নি। কারণ সে তার স্যারকে ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনে। সা’দের থেকে ৩ বছরের জুনিয়র সে। একবার সা’দের ব্যবহারে কারীব তাকে বেশ পছন্দ করেছিলো। তাই সে দিনরাত লেগে থাকতো সা’দের মন জয় করার জন্য। একবার সা’দ বেখেয়ালিভাবে ফোন চালাতে চালাতে হাঁটছিলো। সেদিন কারীবের জন্যই আরেকটুর জন্যই ট্রাকের নিচে যায়নি সে। সেই থেকে সা’দের আলাদা মমতাবোধ জম্মায় কারীবের প্রতি। সা’দ এবার লক্ষ করলো কারীব তার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে তাই সা’দ কারীবের সাথেই মিশলো। সা’দের বন্ধু-বান্ধব ছিলো না বললেই চলে। যতো বন্ধু আছে কেউই তার ক্লোজ না। কিন্তু কারীব হয়ে উঠলো তার ভালো বন্ধু এবং ছোট ভাই। সা’দ তার প্রফেশনে কারীবকে নিয়েই শুরু করেছিলো। কেন জানি না সা’দ তাকে বড্ড ভালোবাসে, আর হয়তো এও জানে তার প্রফেশনে কারীবই তার প্রকৃত বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে।

প্রতিদিনের মতো সেহেরের আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বাম হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সে বই হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলো। সেহের অসুস্থ বিধায় বেশিক্ষণ চেয়ারে বসে পড়তে পারেনি। তাই সে বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই পড়ছিলো। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার জানা নেই। নামাজ পড়ে সে নাস্তা বানাতে চলে গেলো। নাস্তা বানানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে নিলো। এতে যেন তার মন ফুরফুরে এবং সতেজ হয়ে গেলো। শরীরের ম্যাজম্যাজ ভাবটাও কেটে গেলো। রুটি ভেজে বেরিয়ে এসে দেখলো কবির মেঝেতে নেই। নিশ্চয়ই উঠে গেছে সে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছুটলো তার প্রিয় ভাই রিমনের কাছে। এখন বাজে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট। রিমনকে হালকা ডাকতেই সে পিটপিট করে তাকালো। সেহেরের হাসিমুখটা দেখে রিমন লাফ দিয়ে উঠে বসলো। যখন দেখলো সত্যি সত্যিই সেহের বসে আছে তখন জাপটে ধরলো সেহেরকে। সেহেরও পরম সুখে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।

—“বুবু তুমি এসেছো! তুমি এসেছো আমার কাছে?”

—“হ্যাঁ ভাই আমার এসেছি। এখন উঠ দেখি ৮টায় স্কুল আছে তো। খাবে কে শুনি?”

স্কুলের কথা শুনে রিমন বিরক্তের সাথে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর নাক ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,

—“আমার খুশির সময় কেন স্কুলটা নামটা টেনে আনো বলো তো? যাও কথা নেই!”

সেহের হেসে দিলো রিমনের কথায়। এরপর রিমনের নাক টেনে মুচকি হেসে বলে,

—“ওরে আমার ভাইটা! বাস্তবজীবনে পড়াশোনা অনেক জরুরি সোনা, তাই এসব বলতে নেই। এখন উঠুন খেতে হবে তো নাকি?”

রিমন মাথা নেড়ে উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমে। সেহের নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়তে থাকলো। কিছুক্ষণ পর রিমন স্কুলের ইউনিফর্ম পরে নিচে নামলো। রিমন চেয়ার টেনে বসতেই সেহের অতি যত্নে ভাইকে খাওয়াতে শুরু করলো। রিমনও মজার সাথে খাচ্ছে। রিমনের খাওয়ার মাঝেই সৎমা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ডাইনিং এ আসলো। জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে রিমনের দিকে না তাকিয়েই আবার ঘরে চলে গেলো। তার চোখে এখনো ঘুম আছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সেহেরকে বললো,

—“আমার ঘরের পানির জগটায় পানি নেই। পানি ভরে দিয়ে যাস তো!”

সেহের উত্তরে শুধু “আচ্ছা” বললো। কিন্তু সৎমা উত্তর শোনার আগেই রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। তার যেন প্রয়োজনবোধ নেই সেহেরের উত্তর শোনার।

চলবে!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে