#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২২ ||
সা’দ সেহেরকে বুকে জড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরের শহর দেখছে। সেহেরের মাথায় ব্যান্ডেজ, তার কোনো জ্ঞান নেই। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন যে দিয়েছে এখনো তার ঘুম ভাঙ্গেনি। সেহেরের অপরপাশে রুবাই ফোন চাপছে আর ড্রাইভারের পাশের সিটে তানজীল বসে আছে। আজ তারা ঢাকায় ব্যাক করছে। সেখানের ঝামেলা মিটিয়ে সা’দসহ পুরো পরিবার সেহেরকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সা’দ এবং সেহেরের বিয়ের খবর এখন সকলেই জেনে ফেলেছে। সা’দ চুপ করে ঘন্টাখানেক আগের ঘটনাগুলো ভাবতে শুরু করলো।
,
সেহেরের জায়গায় তপাকে দেখে জোহরা সেখানেই ধপ করে বসে পরলো মাথায় হাত দিয়ে। তপা তো এক চিৎকার দিয়ে কেঁদে দেয়। আশরাব রেগেমেগে তপার দিকে এগোতে যেতেই পেছন থেকে অন্যরা তাকে ধরে ফেলে। কামালের ১ম স্ত্রী আঁচলে মুখ গুঁজে বিলাপ করতে করতে বললো,
—“এ আমার কী সর্বনাশ হলো গো মাবুদ! জীবনে কোন পাপ করসিলাম যার ল্যাইগা তুমি আমারে এরম একখান দিন দেহাইলা। আমার পতি যে আবার একখান বিয়া করলো গো, আমি এহন কী করমু গো!”
এদিকে মুরব্বীসহ চেয়ারম্যানও কিছু বলতে পারলো না। যেহেতু বিয়ে হয়েই গিয়েছে সেহেতু তাদের আর কী বলার আছে? তবে সকলেই যা-তা বলে অপমান করলো তপা, কামাল, জোহরা এবং কবিরকে। একজন তো বলেই উঠলো,
—“এই বিবাহিত বুড়োর সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে লজ্জা করলো না! এখন মেয়েটার জীবন নষ্টের দায়ভার কী আপনি নিবেন? এক সংসার পুরো তছনছ করে দিলেন!”
কবির নিজের রাগ দমাতে না পেরে হুংকার ছেড়ে বলে,
—“আমি তপারে না সেহেররে বিয়া দিতে চাইসিলাম, কিন্তু এইহানে হিসাব গোলমেলে হয়ে গেছে!”
তখনই পুরো পরিবার এসে হাজির হলো। তারা পাশের গ্রাম থেকে শুনেছে সেহের নাকি বিয়ে করেছে তাদের গ্রামে। এই কথা শুনেই সকলে ছুটে এসেছে সেহেরের থেকে জবাবদিহিতার নেয়ার জন্য। দাদীমা সেহেরের বিয়ের কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো! পরে যখন শুনলো সেহের নয় বরং তপার বিয়ে হয়েছে তার কান্না থেমে গেলো৷ আবিদ রেগে গিয়ে কবিরের কলার ধরে দিলো টান। অতঃপর চেঁচিয়ে বললো,
—“সেহের কী আপনার মেয়ে নয়? কী করে পারলেন আমার বোনকে নিয়ে এতো বড় খেলা খেলতে! আপনি বাবা নাকি অন্যকিছু!”
কবিরও রেগে আবিদের থেকে নিজের কলার ছেড়ে আবিদকে ধাক্কা দিয়ে আরও উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললো,
—“না আমি কোনো বাবা না কারণ, সেহের আমার মাইয়া না! আমার রক্তের সন্তান তপা! আমি তো এক লাখ টাকার বিনিময়ে সেহেররে বিয়া দিতাসিলাম এই ফকিন্নি সব লন্ডভন্ড কইরা দিলো।”
কবিরের কথায় উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো। এমন একটা কথা কেউ-ই আশা করেনি। সকলের নিরবতায় কবির আবার বলে উঠলো,
—“জোহরার বিয়ার পরেও আমাগো ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একবার ভুল কইরা অঘটন ঘইটা যায় কিন্তু আমি জানতাম না আমার আরেকটা মাইয়া আছে।”
—“তাহলে সেহের আপনার মাইয়া কেমনে হয় না? আপনার প্রথম বউয়ের তো মাইয়া হইসিলো!”
—“হ হইসিলো! কিন্তু মাইয়া দেইখা আমার রাগ উইঠা গেছিলো। এই নিয়া জোহরার লগেও আমার কথা কাডাকাডি হয় যার কারণে ওইদিন রাইতে মাতাল হইয়া মাইয়ারে বালিশ চাপা দিয়া মাইরা ফেলি। কিন্তু জানি না এই মাইয়া কইত্তে আইলো। জোহরার লগে ঘনিষ্ঠ ছিলাম ওর বাপের সম্পত্তির ল্যাইগা। তাই তপারেও আজ পর্যন্ত কিচু কইতে পারি নাই। আর সেহের, ওয় তো ভিখারির বাচ্চা। ওরে দিয়া আমি কয় টাকা পামু? জোহরা আমারে সুখ দিসে, আমার বংশের বাতিও দিসে!”
তখনই দাদীমা হুংকার ছেড়ে বলে,
—“তুই কী জানোছ গজব এই মাইয়ার সম্পত্তি বলতে কিষু নাই সব তার ভাইরা লাইট্টা লইয়া গেছে?”
কবির জোহরার দিকে রক্তচক্ষু নজরে তাকালো। জোহরা মেঝেতে বসে এমনিতেই মেয়ের জন্য কেঁদেই চলেছে। তখনই আরেকজন বলে উঠে,
—“এর মানে আপনিই আপনার প্রথম স্ত্রীকে মেরেছেন?”
—“হ, হ, হ! আমিই মারসি, ওই মা** বাইচ্চা থাকার কোনো অধিকার নাই। মরতে তো গেছিলোই আবার আমার ঘাড়ে বইতে আইসিলো। তাই দিসি…”
আর বলতে পারলো না তার আগেই দাদীমা গুণে গুণে ৪টা চড় দিলো কবিরকে। কবিরের এতক্ষণে হুঁশ হলো যে সে রাগের মাথায় কী কী বলে ফেলেছে। তখনই পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করলো। পুলিশকে দেখে কবির দাদীমাকে ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে গিয়ে পালালো। পুলিশও কবিরের পিছে ধাঁওয়া করলো। পুলিশ সব শুনেছে বাইরে থেকে। এদিকে দাদীমা পড়ার আগেই জুবায়ের এবং আবিদ এসে তাকে ধরে ফেললো। দাদীমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আবার। হঠাৎ কী মনে হতেই দাদীমা চোখ মুছে বললো,
—“আমার ফুলরে বাঁচাইতে হইবো। আমার ফুল কই! আমার ফুলরে এরা আমার নাতনি আর বউমার মতো আবার মেরে ফেলবে। কোথায় আমার ফুল! আবিদদা যা না আমার ফুলরে আমার কাছে আইনা দে৷ এরা মানুষ না! অমানুষ! ফাউ খাইতে এমন গজব জম্ম দিসি আমি! আল্লাহ! তুমি আমার পোলারে জাহান্নামের আগুনে পোড়াও! এ যে মহা খুনি, আমার নিষ্পাপ নাতনিডারেও ছাড়লো না!”
সকলে দাদীমাকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু দাদীমার এক কথা তার ফুলকে লাগবে। কামাল তপাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো। তপা বারবার বলেছে,”মা আমি যাবো না, এই বুড়োটা আমার বর হতেই পারে না।” কিন্তু না বাবার সাথে আশরাবও তাল মেলালো। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে মুরব্বীরা আর কিছু না বলে চলে গেলো। দুইদিন পর আবার বিচার বসবে। কামাল দাঁতে দাঁত চেপে ভাবছে,
—“তোর বাপ আমার লগে এতো বড়ো চিটারি করসে তার শোধ তো আমি তোরে দিয়াই মিটামু!”
এদিকে আশরাবের না চাইতেও বারবার চোখ ভিঁজে আসছে কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেই চলেছে। তপাকে সে সত্যিই ভালোবাসতো, তপা যদি বিয়ে করতে না চায় সেই ভয়ে সে তপার সাথে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু করেছিলো। কিন্তু শেষমেষ কী হলো? তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ কতোবড় শাস্তি আল্লাহ তায়ালা তাকে দিলো। নিজের বাবার বউ এখন তপা। যদি সে এসব পাপ না করে আগে থেকে তার বাবাকে বলে এই বাসায় তপাকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতো হয়তো তাদের জীবনটা সুন্দর হতো। আর তপা! তার অতিরিক্ত অহংকার, নোংরামী চিন্তা-ভাবনা এবং হিংসার জন্য আজ তার এই পরিণতি। জোহরা মেয়ের জন্য মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
এদিকে জোহরাকে গিয়ে ধরলো আসিয়া এবং বড়ো চাচী। এতো বড়ো ঝড়ের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। দাদীমা এদিকে ফুল বলে বিলাপ করেই চলেছে। একসময় আবিদ বাধ্য হয়ে বললো,
—“ফুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছে। ওর মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে তাই সা’দ ভাই তারে নিয়ে সেখানে গেছে।”
দাদীমা তখনই থেমে জলদি করে বললো,
—“ফুল নাকি বিয়া করসে?”
আবিদ চুপ হয়ে গেলো। আবিদকে চুপ হতে দেখে জেঠু বলে উঠলো,
—“কী হলো আবিদ চুপ করে গেলি কেন? তুই কী বিয়ের কথা জানিস? কার সাথে বিয়ে হয়েছে? আর ফুল আমাদের না জানিয়ে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত কী করে নিলো?” শেষের কথাটা বেশ শক্ত গলায় বললেন তিনি! জেঠুর কথায় রুবাই আমতা আমতা করে বলে,
—“আসলে জেঠু, সেহেরের বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। আর বিয়েটা,(কিছুক্ষণ থামলো) বিয়েটা আমার ভাই সা’দের সাথে হয়েছে।”
বলেই সেদিনের সকল ঘটনা খুলে বললো জেঠুকে। জেঠুসহ উপস্থিত সকলে আবারও শক খেলো। এতো কিছু ঘটে গেলো আর সেহের বা সা’দ কেউ কিছুই বললো না। সব শুনে জেঠু অত্যন্ত রাগ করলেন। তিনি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন। সব শুনে দাদীমা মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগলো। মিনমিন করে বললো,
—“সব আমার দোষ! হেইদিন আমার ল্যাইগা ফুল বাইর হইসিলো। আর আমার ল্যাইগাই তার উপ্রে দিয়া এতো ঝড় গেছে।”
আসিয়া এবং জুবায়ের এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। তাদের কথাগুলো যেন হারিয়ে গেছে। বারবার একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনেই মনে মনে ভাবছে তাই তো বলি সা’দ হুট করে কেন সেহেরের চারপাশে ঘুরঘুর করে। দাদীমার কথা শুনে রুবাই দাদীমার মাথা উঁচু করে তার চোখ মুছে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
—“না দাদী। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন, তাইতো উনি আমার ভাইয়ের মতো একজনকে স্বামী হিসেবে দিয়ে সেহেরের দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে এসেছে।তুমি চিন্তা করিও না দাদী, তোমার ফুলকে কেউ কিছু বলতে পারবে না, করতেও পারবে না। আমার ভাই যে আছে তার পাশে।”
তখনই রুবাইয়ের ফোনে কল আসে! রুবাই ফোনে তাকিয়ে দেখে সা’দ কল করেছে। রুবাই কল রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই সা’দ অপরপাশ থেকে বলে উঠে,
—“জলদি সব প্যাক করে নে। ঢাকার উদ্দেশ্যে দাদীমা সহ সবাই আজই রওনা হবো আমরা। সেহেরকে আমি আর এই বিপদে রাখতে পারবো না, অনেক সহ্য করেছে আর না। আমি ড্রাইভার নিয়ে মেইনরোডে উঠছি। বাবার ড্রাইভারকে অলরেডি কল করে দিয়েছি সে গাড়ি নিয়ে আসছে!”
বলেই সা’দ কল কেটে দিলো।
গোছগাছ করে সকলে বেরিয়ে গেলো। মেইন রোডে এসে সেহেরকে দেখতেই জুবায়ের বা আসিয়া সা’দকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। সেহেরের অবস্থা দেখে তাদের আরও মায়া লাগলো। হয়তো তাদের ছেলেটা সেহেরকে মেনে নিয়েছে, ভেবেই তার আর কোনোরকম কথা বাড়ালো না। দাদীমা আসেনি তাদের সাথে তবে সেহেরকে শেষবারের মতো দেখার জন্য মেইন রোডে সকলের সাথে ছুটে এসেছিলো। সেহেরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সা’দকে বললো,
—“আমার ফুলটা এখন তোর দায়িত্বে নাতি, আমার ফুলডার যত্ন নিস। জীবনে অনেক কষ্ট সইয্য করসে আমার ফুলে, এহন ওরে আর কষ্ট পাইতে দিস না, মাইয়াটার সুখের যে বড়ই অভাব। এই গেরাম থেইকা ওরে নিয়া যা বাপ, ওরা ওরে কোনোদিন ভালো থাকতে দিবে না, কোনোদিন না!”
★
সব ভাবতেই সা’দ একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললো এবং সেহেরকে নিজের সাথে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। সেহের পরম আবেশে চুপটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। সে তো জানেই না তার অগোচরে কি-সব ঘটে গেছে। তার জীবন যে কোনদিকে মোড় নিলো সবটাই তার অজানা রয়ে গেলো। সা’দ গভীর দৃষ্টিতে সেহেরের মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেহের আনমনে নিজের ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করলো। তা দেখে সা’দ কিছুটা অবাক হলো। হয়তো সুন্দর স্বপ্ন দেখছে সেহের, তাইতো ঘুমের মধ্যেও মুচকি মুচকি হাসছে। সা’দ পাশে তাকালো। রুবাই কানে হেডফোন লাগিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সা’দ হেসে সেহেরের মাথায় ডিপলি একটা কিস করে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভাবতে লাগলো,
—“তোমায় আমার রাজ্যের রাণী করবো মায়াবীনি, যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখের এক চুল পরিমাণ চিহ্ন। তোমার সুখের সময়ের জন্য নিজেকে তৈরি করে নাও। আর আমিও তৈরি হবো তোমার হাসিমাখা মুখটা দেখার জন্য। তুমি যে আমার “দখিনা প্রেম”। যেখানে নেই কোনো কৃত্রিম হাওয়া, প্রেম। আছে শুধু আমাদের পবিত্রতার ভালোবাসা। ভালোবাসি, মায়াবীনি।”
রাত প্রায় সাড়ে আট’টা নাগাদ সকলে বাড়ি ফিরলো। সেহের এখনো ঘুমোচ্ছে। সেহেরকে ঘুমোতে দেখে আসিয়া কিছু বলবে তার আগেই সা’দ গাড়ি থেকে নেমে সেহেরকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। সার্ভেন্টরা বাড়ির সকল লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে এবং সা’দের রুমও পরিষ্কার করে রেখেছে। সা’দ আগেই ফোন করে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। একজন রাঁধুনীও এনেছে যিনি এখন রান্না করতে ব্যস্ত। অলরেডি কয়েক ধরণের ডিশ বানিয়েও ফেলেছে। সা’দ সেহেরকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রুমের দিকে চলে গেলো। নিচে আসিয়া এবং জুবায়ের হা করে সা’দের কান্ড দেখছে। রুবাই তাদের কান্ডে মুচকি হেসে বলে,
—“দেখেছো মা, বাবা! এই ছেলেটা কতো বউ পাগল! এতদিনে তোমাদের সখ মিটে গেলো সাথে মায়ের শান্তশিষ্ট বউমাও মিললো। দেখিও মা সেহের সুস্থ হলেই তোমার আগে পিছে সব সময় ছায়ার মতো থাকবে।”
রুবাইয়ের কথায় আসিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনো কথা না বলে সে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। আসিয়া যেতেই জুবায়ের বললো,
—“তোর মা মনে হয় বিয়েটা মানতে পারছে না। সা’দও আজ অবধি কখনো তোর মার থেকে কিছু লুকায়নি, কিন্তু এত বড়ো ঘটনায় নিশ্চয়ই তার অভিমান হয়েছে। চিন্তা করিস না, তোরা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর আমি তোর মায়ের কাছে যাচ্ছি।”
বলে জুবায়েরও নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলো। রুবাই এবং তানজীলও কিছু না বলে উপরে নিজেদের রুমে চলে গেলো। সা’দ সেহেরকে শুইয়ে দিতেই সার্ভেন্টকে ডেকে পাঠালো। সার্ভেন্ট ডেকে তাকে সেহেরের পাশে রেখে সে গেলো রুবাইয়ের ঘরে, সেহেরের জন্য রুবাইয়ের একটা ড্রেস নেয়ার জন্য। রুবাইকে বলতেই রুবাই কামিজ সেট দিয়ে দিলো আর সা’দকে এও বলেছে তাদের বিয়ের কথা না জানানোর কারণে তাদের মা বেশ অভিমান করেছে। সা’দ মুচকি হেসে বলে,
—“অভিমান করাটা স্বাভাবিক আপু, তোরা রেস্ট কর আমি সার্ভেন্টকে কাপড় দিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছি।”
বলেই সা’দ বেরিয়ে গেলো। সার্ভেন্টকে কামিজ সেট দিয়ে বলে দিলো যেন সেহেরের ড্রেস চেঞ্জ করে দেয়। অতঃপর আর দেরী না করে নিচে চলে গেলো তার মায়ের অভিমান ভাঙ্গাতে।
আধঘন্টা ধরে আসিয়া অন্যদিকে ফিরে আছে। সা’দ এতোকিছু বললো কিন্তু আসিয়া একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না। দূরের সোফায় বসে চা খেতে খেতে মা-ছেলের কান্ড দেখছে জুবায়ের। সা’দ আসিয়ার হাঁটুর সামনে বসেই আবার বললো,
—“তুমি যদি এবার কথা না বলো তাহলে আমি কিন্তু রাতে কিছু খাবো না আম্মা!”
এবার আসিয়ার টনক নড়লো। তিনি সা’দের দিকে না তাকিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে রাগাম্বিত স্বরে বলে উঠলো,
—“তাকে বলে দিন রুবাইয়ের বাবা, রাতে সে না খেলে তার এই বাড়িতে থাকার কোনো অধিকার নেই। কষ্ট করে আমার বাড়িতে রাঁধুনি বয়ে এনেছে, তার টাকা কী তার বাবা দিবে?”
শেষের কথা শুনে জুবায়েরের চা গলায় আটকে গেলো যার ফলস্বরূপ তিনি খুক খুক করে কাশতে শুরু করলো। সেন্টার টেবিল থেকে পানি ঢকঢক করে খেয়ে তবেই সে শান্ত হলো।
—“সেটা আমাকে বলছো তো বলছোই আবার তার বাপকে কেন টানছো হ্যাঁ?”
—“তো আপনাকে না টেনে কী আমার বাবাকে টানবো? আমার বাবা তো তাঁহার নানা হয় নানা!”
জুবায়ের করুণ দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো। আসিয়া যখন রেগে থাকে তখন সে এই ধরণের অদ্ভুত কথাবার্তা বলে জুবায়ের এর অবস্থা খারাপ করে দেয়। সা’দ নিজের হাসি চেপে রেখে বাবাকে বললো,
—“বাবা ওনাকে বলে দিও আমি খাবো তখনই যখন তিনি আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে!”
আসিয়া শুনেও না শোনার ভান ধরে বসে রইলো। সা’দ জানে তার মা তার প্রস্তাবে রাজি হবে না তাও সে বলেছে। তখনই সার্ভেন্ট এসে বললো,
—“ম্যাম খাবার তৈরি, আপনারা আসতে পারেন।”
বলেই সার্ভেন্ট চলে গেলো। সার্ভেন্ট চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই সকলে বেরিয়ে এলো।
খাবার টেবিলে সা’দ খেতে খেতে রুবাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকালো। রুবাই চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো। সা’দ সেই ইশারা বুঝতে পারলো। আসিয়া গম্ভীর হয়েই খাবার খাচ্ছে। সা’দ খেতে খেতেই বলে উঠলো,
—“যার কষ্টের জন্য রাঁধুনি আনলাম, বাসায় আসার আগে সার্ভেন্টদের খবর দিয়ে সব ব্যবস্থা করলাম, সে-ই কেমন অভিমান করে বসে আছে। কার জন্য করলাম এতসব? ঠিক আছে ব্যাপার না সে যেহেতু বিয়েটা মানছেই না আমার আর কী করার!”
বলেই হাত ধুঁয়ে অন্য রুমের দিকে যেতে লাগলো। রুবাই সা’দের পিছু ডেকে বললো,
—“কই যাচ্ছিস ভাই? তোর ঘর তো উপরে!”
সা’দ থেমে গিয়ে উত্তর দিলো,
—“আম্মা তো বিয়ে মানেনি তাহলে সেহেরের সাথে এক ঘরে থাকার প্রশ্নই উঠে না!”
সা’দের কথায় আসিয়া খাওয়া থামিয়ে হুংকার ছেড়ে জুবায়েরকে বললো,
—“তাকে বলে দেন, বিয়ে করে এখন বউ ছাড়া আলাদা কেন থাকবে? মেয়েটা যে অসুস্থ সেদিকে খেয়াল আছে? কখন বললাম আমি বিয়ে মানিনি? শুধু তো অভিমান করেছি, আর সে আমার অভিমান না ভাঙ্গিয়ে অসহায় মেয়েটাকে কষ্ট দেয়ার ফন্দি আঁটছে। তাকে কান খুলে শুনতে বলুন, আমার বউমাকে নিয়ে যদি কোনোরকম হেয়ালি করে, তার এই ২৯ বছর বয়সেও তাকে আমি ঝাটা পেটা করবো!”
আসিয়ার শেষের কথা শুনে সা’দ চোখগুলো বড় বড় করে আশেপাশে তাকালো। নাহ কোনো সার্ভেন্ট নেই। তার মায়ের এই ধরণের কথাবার্তা কেউ শুনলে তার এতদিনের গড়া সম্মান সব লাটে যাবে। সা’দ দ্রুত মায়ের দিকে এগিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে বাচ্চা কন্ঠে বলে উঠে,
—“সরি আম্মা, মাফ করে দেও। সত্যিই তখন এমন পরিস্থিতি ছিলো না, কাউকে বলার মতো। ইভেন আমি নিজেও প্রথমে মানতে পারিনি বিয়েটা, পরে কী হলো আমি নিজেও জানি না। তবে তোমাকে বলবো বলবো করে আর বলতে পারিনি। যদি তুমি রিয়েক্ট করো সেই ভয়ে। প্লিজ আর অভিমান করে থেকো না, সকাল থেকে অনেক চাপে আছি এখন তুমিও যদি এমন করো তাহলে কীভাবে হবে বলো তো? এখন আবার তোমার বউমার সেবা করতে হবে।”
—“হুম। আমার বউমার সেবা করাটাই তোর শাস্তি। এখন বেশি পকপক না করে ফলের রস আর স্যুপ নিয়ে যা। ওরে উঠিয়ে খাইয়ে মেডিসিন দে। নয়তো মাথার চোটটা ভালো হবে কী করে?” আসিয়ার কথার মাঝে রুবাই বলে উঠলো,
—“আচ্ছা সেহের এমন গুরুতর আঘাত পেলো কী করে?”
—“সেহের প্রতিবাদ করেছে তাই জোহরা চাচী তার কপালে দেয়াল বরাবর আঘাত করেছে।”
অতি শান্ত সুরেই বললো সা’দ। সা’দের এই শান্ত স্বভাব সকলকেই অবাক করলো। এখন এমন এক পরিস্থিতি যেখানে কেউ-ই নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। আর এই সা’দ কি সুন্দর ঠান্ডা মাথায় সবটা গুছিয়ে হ্যান্ডেল করছে। এই সা’দের জন্যই রুবাই আবার নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছে, যদিও তার সন্তান হারানোর ব্যথা এখনো হয় তবে সেটা স্বল্প সময়ের ব্যথা। তার ভরসা আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নিশ্চয়ই তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। সকল প্রসংশা শুধু তারই নামে।
সা’দ শুধু স্যুপ নিলো। ফলের রস এখন খাওয়াটা মোটেই উচিত হবে না তার উপর এখন বাসায় ফ্রেশ ফলও নেই। সা’দ স্যুপ নিয়ে উপরে চলে গেলো। উপরে গিয়ে দেখলো সেহের এখনো ঘুমাচ্ছে। সা’দ স্যুপের ট্রে-টা বেডবক্সে রেখে দরজা লক করে দিলো। এরপর সেহেরের পাশে বসে সেহেরকে ডাকতে লাগে। সেহের অল্প অল্প তাকিয়ে উঠে বসলো। মাথা এখনো তার প্রচুর ব্যথা করছে। সেহের মাথায় দু’হাত চেপে ধরলো ব্যথার। সেহের আধো আধো কন্ঠে বলে উঠে,
—“পা..পানি!”
সা’দ জলদি সেহেরকে পানি খাইয়ে দিলো। পানি খাইয়ে কোনোরকমে স্যুপটা খাইয়ে মেডিসিনও দিয়ে দিলো। সেহের এখনো ঘুমে ঢুলছে তাই সে ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সেহেরকে খাইয়ে আবার শুইয়ে দিয়ে সা’দ উঠে কাবার্ড থেকে টাউজার এবং টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আসার পর থেকে ফ্রেশ হওয়ার সময়টা অবধি সে পায়নি। ফ্রেশ হয়ে তাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখলো সেহের ঘুমে কাত! সা’দ মুচকি হেসে সেহের অপরপাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে সেহেরকে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো। বিয়ের পর এই প্রথম দুজন একই ঘরে, একই বিছানায়। এভাবে সেহেরকে দেখতে দেখতেই সা’দ সেহেরের পাশে ঘুমিয়ে গেলো। মাঝরাতে হঠাৎ সা’দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো এবং দেখলো সেহের কেমন যেন কাঁপছে। সা’দ চটজলদি উঠে বসলো এবং সেহেরের কপালে হাত দিয়ে তার তাপমাত্রা চেক করলো। একি! জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে। সা’দ এখন কী করবে ভেবে পায় না। জলদি বিছানা থেকে নেমে সে ওয়াশরুমে গেলো কাপড় আর বাটি আনতে। বাটিতে পানি ভরে আর একটা কাপড় এনে বেডবক্সে রাখলো। অতঃপর সেহের ব্যান্ডেজটা কিছুটা উঁচু করে জলপট্টি দিতে থাকলো। এসির টেম্পারেচারও কমিয়ে দিলো একদম। সা’দের ঘর যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। তবুও সেহের কাঁপছেই। সা’দ উঠে কাবার্ড খুলে একদম শেষের তাক থেকে দুটো কম্বল এনে সেহেরকে জড়িয়ে দিলো। নাহ তাতেও সেহের কাঁপছে। হুট করে এতো জ্বরের মানে বুঝলো না সা’দ। এমন জ্বর তো হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে সে নিজেও কম্বলের ভেতর ঢুকে সেহেরকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। সেহের জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। সা’দ নিজের কান কিছুটা এগিয়ে দিতেই শুনতে পেলো সেহেরের কথা,
—“ওরা আমার মাকে মেরেছে, আমাকেও মারতে চায়। প্লিজ বাঁচান আমাকে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমার মাকে খুব কষ্ট দিয়েছে ওরা, খুব!”
এরকম নানান বিলাপ বকছে সেহের। সা’দ সেহেরকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট সুরে বলে,
—“তুমি এখন আমার কাছে মায়াবীনি। আমি থাকতে কারো সাহস নেই তোমার ক্ষতি করার। আমি সর্বদা তোমার পাশে আছি বউ, ভালোবাসি।”
বলেই সেহেরের কপাল থেকে ভেঁজা কাপড়টা সরিয়ে ভালোবাসার পরশ দিলো। সেহের অনেকক্ষণ পর গিয়ে স্বাভাবিক হয় এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সেহেরকে ঘুমাতে দেখে সা’দও ঘুমিয়ে যায়। বেচারা অনেক ক্লান্ত আজ।
চলবে!!