ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮৬

0
1036

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৬|
ঠিক যেন সন্ধ্যাদ্বীপ জ্বলছে৷ পাশাপাশি বসে আছে সৌধ, নিধি৷ নিধির গায়ে কাশ্মীরি শাল জড়ানো। হাত দু’টো হিম ধরে যাচ্ছিল বলে আগুনের তাপ নিল। সৌধর পরনে জিন্স প্যান্ট আর চকোলেট কালার ফুল স্লিভ টি-শার্ট। দৃষ্টি নত। ওরা কেউ একে অপরের দিকে তাকিয়ে নেই। নিধির দৃষ্টি সম্মুখে পুড়তে থাকা কাঠগুলোতে। সৌধর দৃষ্টি নত। গভীর কিছু ভাবছে সে। প্রকৃতির এই সময়টা কী অভিশপ্ত? কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরকে যতটা স্নিগ্ধ, পুতঃপবিত্র লাগে। পূর্ণ সন্ধ্যাকে তেমন লাগে না কেন? দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণ একটু নয় অনেক বেশিই রহস্যময়। যেন এক টুকরো কলঙ্ক লেগেছে সন্ধ্যার গায়ে। একটা চাপা আর্তনাদ দুলে বেড়ায় এই প্রকৃতিতে। অনেকটা সময় নীরবতা পালন করল ওরা৷ নীরবতাটুকু ভাঙল সৌধ নিজেই। শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল নিধির পানে। এরপর খুব সহজ, স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ সুখে আছিস? ‘

‘ ডেফিনিটলি সৌধ, তুই এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছিস? ‘

কপাল কুঁচকে গেল সৌধর। কিঞ্চিৎ বিরক্তি স্বরে বলল,

‘ ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে। সব সময় বাড়িয়ে বলা লাগবে? কেন ডেকেছি কারণটা অবশ্যই বলব। সেটার জন্য ধৈর্য্য লাগবে। তোর যদি আমার কথা শোনার ধৈর্য্য না থাকে, চলে যা। ‘

আচমকা হেসে ফেলল নিধি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,

‘ আহ হা রাগ করছিস কেন? সব মেয়ে তো আর তোর বউয়ের মতো ধৈর্য্যশীল হবে না তাই না। ‘

‘ কথাটা মন্দ বা মিথ্যে নয়। হোয়াটেভার, মূল প্রসঙ্গে আসি৷ ‘

‘ তোরও কি মনে হয় রূপের বাবার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত? ‘

সহসা সৌধর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নিধি। ওর বাদামি মণির স্বচ্ছ চোখ দু’টোয় একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব এসে ভর করেছে। নিমেষে চোখ সরিয়ে নিল সৌধ। জ্বলন্ত আগুনে নির্নিমেষে তাকিয়ে হাসল একপেশে। বলল,

‘ ক্ষমা আমি চাইব না নিধি। আমার হয়ে, আমাদের হয়ে তুই নিশ্চয়ই অসংখ্যবার ক্ষমা চেয়েছিস রাইট? ঘটনা চুকে গেছে বহু আগেই৷ সেই চুকানো বিষয় আর সামনে না আনাই ভালো। পৃথিবী, জীবন, ভালোবাসা, অনুভূতি এসবের কোনোটাই সুহাস, আইয়াজ আমার মতো করে ভাবে না। আমার মতো করে ধাক্কা খায়নি বলেই হয়তো ভাবে না। বা তোর প্রতি আমার যে অনুভূতিটা ছিল তা ওদের ছিল না বলেই বুঝতে পারে না। ওরা শুধু তোকে বন্ধুর নজরে দেখেছে। তাই সেদিনের করা কাজটার জন্য খুব সহজে তোর স্বামীকে সরি বলেও দিয়েছে। কিন্তু আমি? ‘

এক মুহুর্ত থামল সৌধ। এক পলক তাকাল নিধির পানে। এরপর এক ঢোক গিলে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ অতীতে তোর প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল। তা আজ নেই৷ এটা যেমন সত্যি ঠিক তেমনি এক বড়ো সত্যি হলো। অতীতের ওই অনুভূতি মিথ্যা ছিল না। আমি আজো মাথা উঁচু করে তীব্র বিশ্বাসী গলায় বলতে পারি ওই অনুভূতি মিথ্যা ছিল না। সেদিন অর্পণ স্যার হয়তো অল্প সময়ের জন্য অসম্মানিত হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য শরীরে ক্ষত পেয়েছে। কিন্তু আমি? আমার প্রথম অনুভূতি আর ভালোবাসার মৃত্যু তো ওইদিনই ঘটেছে। এই ক্ষত কি কোনোদিন সেরে উঠবে? কোনোদিন ভুলতে পারব? আজ তুই যুক্তি দাঁড় করাতে পারিস তুই কোনোদিন আমাকে একসেপ্টই করিসনি৷ কিন্তু দূর্ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার আগের কিছু মুহুর্ত কি আমি ভুলতে পারি? তুই নিজেও কি অস্বীকার করতে পারবি শেষদিকে তুই মুখে স্বীকার না করলেও আমাকে আশকারা দিস নি। আশা, ভরসার ইঙ্গিত তো অবশ্যই পেয়েছিলাম। তবে কেন আমি অর্পণ স্যারকে সরি বলব? এ পৃথিবীতে কোন পুরুষ সহ্য করবে তার প্রিয় নারীতে অন্য পুরুষের স্পর্শ? তোরা ম্যারেড ছিলি জানতাম না তো আমি। তোর প্রতি বন্ধুত্ব, ভালোবাসার প্রগাঢ়তায় মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেও তোকে একফোঁটা আঘাত করতে পারিনি৷ কিন্তু আমার ওই বিভীষিকাময় অনুভূতিটুকু তুই বা তোরা কেউ বুঝবি না, কেউ না। আজ অবশ্য বোঝার দরকারও নেই। শুধু তোদের কাছে আমার রিকোয়েস্ট, কখনো ভুলেও আর কেউ উচ্চারণ করবি না, অর্পণ স্যারকে সরি বল। তুই আমার বন্ধু নিধি। কিছু অনুভূতিতে যে বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিল আজ অনুভূতির সাথে সাথে সেই ফাটলও ফিঁকে হয়ে গেছে। তাই বলব, আমার ওই অনুভূতি গ্রহণ করিসনি ইট’স ওকে। তোর হাজব্যন্ডকে সরি বলিয়ে অসম্মান বা অপমান করিস না। হতে পারে আমার প্রথম প্রেম ভুল মানুষকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। তাই সৃষ্টিকর্তা আমার কপালে তাকে রাখেনি। এর মানে এই না ওই সময়ের অনুভূতি, ওই সৌধ মিথ্যা ছিল। আমি আমার সব অনুভূতিকে রেসপেক্ট করি। শুধু তাই নয় আমি আমার পুরো ব্যক্তিজীবনটাকেই প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। এই রেসপেক্টের জায়গাকে তোরা ডিসরেসপেক্ট করিস না। আশা করি তুই আইয়াজ আর সুহাসকে এ ব্যাপারে এলার্ট করে দিবি৷ আমি করতে গেলে ওরা ভুল বুঝতে পারে৷ স্পেশালি সুহাস। ও ভাববে আমি আজো তোর প্রতি দুর্বল৷ কিন্তু না, তোর প্রতি এখন বন্ধুত্বের বাইরে বাকিসব অনুভূতি ফিঁকে হয়ে গেছে। বিস্ময়কর এই ঘটনাটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছিস? ‘
.
ছাদে সবাই মিলে গল্প করবে। আড্ডা জমাবে। তাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ করেই নামী শাড়ি পরে সিমরানকেও জোর করে ল্যাভেন্ডার রঙের একটি শাড়ি পরিয়ে দিল। আর কোনো সাজগোজ নয়। শাড়ির সঙ্গে শুধু গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল। আজিজ আর আইয়াজ বাইরে গিয়েছিল। দু-হাত ভর্তি ফাস্টফুড নিয়ে ফিরেছে। হাঁকডাক করে ডাকছে সুহাস আর সৌধকে। শাড়ি পরার পর সিমরান নিজেও সৌধকে খুঁজছিল। স্বামীকে খুঁজতে গিয়েই আচমকা খেয়াল করল আশপাশে নিধি আপুও নেই। নিমেষে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজের মাথায় নিজেই একটা টোকা দিয়ে ভাবল,

‘ ধুরর! অযথা ভয় পেয়ে যাই। ‘

মনকে সান্ত্বনা দিলেও ভেতরে একটা খচখচ অনুভূতি হচ্ছিল। শত হোক নারী মন বলে কথা! আনমনে সবাইকে রেখে সে একা একাই ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। যেন অদৃশ্য এক সুতো টানছিল তাকে। সিঁড়ি পেরিয়ে যখন ছাদের দরজা পর্যন্ত গেল পা দু’টো থমকে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেল সৌধ আর নিধি পাশাপাশি বসে আছে। আচমকা মস্তিষ্কে এসে হানা দিল সেদিনের সেই মুহুর্তটুকু। স্মৃতি আপুর বিয়ের আগের রাত৷ যেদিন সে প্রথম জানতে পারে সৌধভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে। আহ, কী নিদারুণ এক যন্ত্রণাময় মুহুর্ত। শ্বাস বন্ধ করে দেওয়া সেই দৃশ্য। আর ভাবতে পারল না সিমরান। দরজাটা শক্ত করে ধরে দুচোখ বন্ধ করে নিল। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। নিজেকে বুঝাল,

‘ শান্ত হো সিনু। জাস্ট শান্ত থাক। সৌধ বা নিধি আপু কেউই তোর শত্রু নয়। একজন অর্ধাঙ্গ অপরজন বড়ো আপু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী। ‘

মনকে কথাগুলো বুঝিয়ে কানটা সজাগ রাখল। শুনতে পেল নিধির বলা কঠিন কঠিন কথা আর সৌধর বলা আবেগঘন কথা।
.
বিস্ময়কর ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে জানে নিধি৷ সিমরানের নিঃস্বার্থ, নিগূঢ় ভালোবাসা আর যত্নে। তাই বলল,

‘ সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য বেস্টটাই দেয় সৌধ। আমি কখনো সিনুর মতো স্বার্থহীনভাবে তোকে ভালোবাসতে পারতাম না। এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে। যারা বাস্তবতার ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে জানে। সিনু হলো ওই ধরনের মানুষ, মেয়ে৷ দেখ, আমার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল পড়াশোনা করে ডাক্তার হওয়া৷ এরজন্য বাবা, মায়ের সাথে লড়াই করেছি। আমি তোকে ইগনোর করেছি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে। আবার আমি যে বিয়েটা করলাম। এটাও আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে যারা আমাকে সাহায্য করল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। এরপর নানারকম দ্বন্দ্ব, জটিলতার শেষে আমি স্যারকে ভালোবেসেছি৷ কেন বল তো? কারণ ওই মানুষটা আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হয়েছে। আমার সব ভুল, খারাপ আচরণ, অবাধ্যতা সহ্য করেও ওই মানুষটা এত বেশি সাপোর্ট দিয়েছে। পাশে থেকে ভালোবেসে যত্ন নিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত আমি ভালো না বেসে থাকতে পারিনি। আমার মনে হয়, আমার পেছনে সময় ব্যয় করে জীবনে আঘাত ছাড়া কিছু তো পাসনি। আর সিনুর পেছনে কোনোকিছু ব্যয় না করেই পেয়েছিস নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আমাদের হৃদয় খুব চতুর হয় বুঝলি? একটু দেরি হলেও তারা ঠিক তাদেরটা বুঝে নিতে পারে। তোর হৃদয়ও বুঝে নিয়েছে সিনুর হৃদয়কে৷ আর সিনুও পৌঁছে গেছে তার লক্ষ্যতে। ‘

বাঁকা হাসল সৌধ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ ভালোবাসা ব্যাপারটা একেকজন আসলে একেকরকম ভাবে এক্সপ্লেইন করে। আর সবাই স্ব স্ব জায়গায় একদম সঠিকটাই ব্যাখ্যা দেয়৷ এই যেমন তুই তোর অভিজ্ঞতা থেকে দিচ্ছিস। আর আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দিব৷ ‘

স্মিত হাসল নিধি। সৌধ ফের বলল,

‘ আমার দেখা পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী নারী ছিল আম্মা৷ এরপর এই জায়গাতে আরো একজন দখল নিল। কে জানিস? যে আমার জীবনে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটাল। অনেক সময় আমাদের সঙ্গে এমন কিছু ঘটে যায়, যেগুলোতে আমাদের হাত থাকে না৷ এমনই ঘটনা পরপর ঘটে গেল আমার সাথে। এক. তোকে হারালাম, দুই. সিনুকে পেলাম। আমার প্রথম প্রেম আমার হৃদয়ে ঠিক কতটুকু শক্তি নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল আমি তো জানি? সেই ঘাঁটিটা নড়বড়ে করে করে একদম উপড়ে ফেলল মানুষটা। অবশ্য তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমিও চেয়েছিলাম৷ আমি আসলে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলাম ওর ভালোবাসার শক্তির কাছে। এ জেনারেশনে এসে সিনুর মতো আধুনিকা মেয়ে এভাবেও ভালোবাসতে পারে? এই যে প্রশ্ন, এটাই মুগ্ধতা এনে দিল। সেই মুগ্ধতার রেশ আজ বিয়ের এতদিন পরও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ‘

নিধির দৃষ্টি নিষ্পলকে দেখছে সৌধর মুগ্ধ দৃষ্টিজোড়া। ওই মুগ্ধতা সিনুর জন্য৷ বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এই দিনটার বোধহয় খুব বেশি প্রয়োজন ছিল খুব৷ অন্তত তাদের বন্ধুত্বে স্বাভাবিকতা আনার ক্ষেত্রে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। মৃদু হাসল নিধি। সহসা সৌধ রহস্যময় এক হাসি দিল। বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ নিধি, তুই প্রুফ চাস সিনুকে আমি কতটা ভালোবাসি? ‘

অদ্ভুত করে হাসে নিধি৷ বলে,

‘ প্রমাণে কী আসে যায়? তুই মুখ দিয়ে বলেছিস, তোর চোখে আমি যা দেখেছি এটাই তো যথেষ্ট। ‘

সৌধ এবার গলা উঁচু করে বলল,

‘ আই রিয়েলি লাভ হার। যে এখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে! ‘

চমকে উঠল নিধি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দরজার ওখানে৷ একটা আবছা ছায়া নিমেষে সরে গেল৷ পরমুহূর্তেই হৈচৈ করতে করতে ছাদে এলো আজিজ, সুহাস, নামী আর আইয়াজ, ফারাহ। ওদের ফাঁকি দিয়ে নিধি ফিসফিস করে বলল,

‘ সত্যি সিমরান ছিল? ‘

অধর কামড়ে হাসল সৌধ। মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল,

‘ ইয়েস। ‘

‘ কী করে বুঝলি? ‘

সৌধ হাসতে হাসতে চোখ টিপ মেরে বলল,

‘ এটাত বলা যাবে না৷ ইট’স সিক্রেট। ‘

নিধি আচমকা হেসে ফেলল। সৌধর কাঁধে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বলল,

‘ আই থিংক ভুল বুঝল। আর দোষী হতে ভালো লাগে না ভাই। যা ওকে নিয়ে আয়। ‘

‘ এক ছেলের মাকে ছাদে প্রেম করার জন্য নিয়ে আসিনি বুঝবে ও৷ সো চিল। ‘

এবার অট্টস্বরে হাসল নিধি। সৌধ আড়চোখে তাকিয়ে দেখল তা৷ কিয়ৎক্ষণ পর বলল,

‘ সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমরা খুব ভালো বন্ধু নিধি৷ এই সত্যিটা না তুই অস্বীকার করতে পারবি না আমি আর না ও। বাকি যা সব আমরা আমরাই মিটিয়ে নেব। ‘

কথা এ পর্যন্ত হতেই সুহাস এসে আচমকা ওদের দু’জনের মাঝখানে বসে পড়ল। নিধির মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

‘ আগেভাগে এসে তোরা সব কাঠ পুড়িয়ে ফেলছিস। কী চক্কর চলছে? ‘

সৌধ কিঞ্চিৎ সরে গিয়ে সুহাসকে ভালোভাবে জায়গা করে দিল। নিধি হাসতে হাসতে বলল,

‘ আমাদের তো আর চক্কর চলার চান্স নেই ভাই। তাই সৌধকে পরামর্শ দিচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি মেয়ের বাপ হওয়ার ব্যবস্থা কর৷ ছেলে, মেয়েদের চক্করের ব্যবস্থা করে দিই। ‘

সবাই সবার মতো জায়গা দখল করে বসছিল। নিধির কথা শুনে আচমকা আজিজ বলল,

‘ এই নিধি সাবধান, বাঁশ খাবি। সৌধর মাইয়া জীবনেও তোর পোলারে বিয়ে করব না৷ মেয়ে মানুষ যে কী জিনিস ভাই। অগো প্রতিশোধে মাথা টলে আমার। দেখা গেল বাপের হইয়া মেয়ে প্রতিশোধ নিল। মাঝখান থিকা তোর চান্দের টুকরা পোলাডা ফাঁসব। ‘

আজিজের এহেন কথায় চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল নিধির৷ সৌধ মোটেই পছন্দ করল না নিধির বলা কথাটি। আজিজের কথা তো ওর কোনোকালেই পছন্দ না৷ তবে বাকিরা বেশ মজা পেল। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেল ফারাহ নামী৷ সুহাস তখন বলে উঠল,

‘ আমার ভাগ্না হলে তো হলোই। কিন্তু ভাগ্নি হলে ওকে স্পেশাল গার্ড দিব আমি৷ তোদের কারো ছেলেরই চান্স নেই। ‘

এবারে মুচকি হাসল সৌধ। নামী বলল,

‘ আচ্ছা, আচ্ছা যার ভবিষ্যত ছানাপোনা নিয়ে কথা হচ্ছে। সেই রাজকুমারীটি কোথায়? ‘

সবারই যেন সংবিৎ ফিরল। কেবল সৌধ ছাড়া। মন বলছে, তার বউপাখি এই আয়োজনে আসবে না। হলোও তাই৷ নামী নিচে গিয়ে সিনুকে ডাকল ছাদে আসার জন্য৷ শরীর খারাপ লাগছে বলে সে আসবে না জানালো। এই যে না করল সে না আর হ্যাঁ হলো না। সুহাস বলল,

‘ সৌধ তুই চুপচাপ বসে আছিস কেন? যা ওকে নিয়ে আয় তুই ডাকলেই আসবে৷ ‘

সৌধ গেল না। অতএব সবাই ধারণা করে নিল সৌধ, সিমরানের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হওয়া দরকার। এতে সম্পর্ক আরো মিষ্টি এণ্ড মজবুত হয়৷

বন্ধুরা মিলে জমিয়ে আড্ডা দিল। পুরোনো কিছু স্মৃতিচারণ আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা শেয়ার। সবমিলিয়ে মিষ্টি, বিষণ্ন সুন্দর একটা মুহুর্ত। হঠাৎ আজিজ বলল,

‘ একটা গান ধর তো সৌধ। ‘

আজিজকে প্রশ্রয় দিল সবাই৷ এরপর শীত শীত নির্মল, আর জ্বলন্ত আগুনের উষ্ণ তাপে বসে কোনো প্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান ধরল সৌধ। ওর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গাইল সুহাস, আইয়াজ এবং সবাই। সঙ্গে ছিল মৃদু মৃদু হাতে তালির শব্দ। যা গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে রইল।

” পুরো পৃথিবী এক দিকে আর আমি অন্য দিক,
সবাই বলে করছ ভুল আর তোরা বলিস ঠিক
তোরা ছিলি, তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি

বন্ধু…. বোঝে আমাকে,
বন্ধু আছে… আর কি লাগে?

সুসম্পর্ক দুঃসম্পর্ক আত্মিয় অনাত্মিয়
শ্ত্রু মিত্র রক্ত
সম্পর্কে কেউ বা দ্বিতীয়
শর্ত সব দূরে কাছে বৈধ অবৈধ
হাজারো এসব সম্পর্ক ভাঙ্গে থাকে বন্ধুত্ব
তোরা ছিলি তোরা আছিস জানি তোরাই থাকবি

বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কি লাগে?

কিছু কথা যা যায় না বলা কাউকে
কিছু কাজ যা যায় না করা সহজে
কিছু আচরন মানে না কেউ সামনে
কিছু জায়গা যায় না যাওয়া চাইলেই
সবই হয় যদি তোরা থাকিস সেখানে

বন্ধু…. বোঝে আমাকে,
বন্ধু আছে…. আর কি লাগে?”
.
.
বিছানার একপাশে নিভৃতে শুয়ে আছে সিমরান। সে ভেবেছিল সৌধ তাকে ডাকতে আসবে। এরপরই যাবে ছাদে। এতে সবাই বুঝবে সৌধর লাইফে তার গুরুত্ব। অবচেতন মন বুঝি একটু চেয়েছিল নিধি আপু সৌধর মুখে আজ যে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি পেল। তার প্রমাণও মিলুক। কিন্তু মিলল না। সৌধ এলো না। এতক্ষণ অভিমান না হলেও এবার তীব্র অভিমানে বুক ভার হয়ে রইল। কান্না পেল খুব৷ চোখ গলে অশ্রুপাত হতে শুরু করল৷ এদিকে ওরা আড্ডা দিয়ে ক্লান্ত তখন৷ নিচ থেকে সেলিনা আপাও খবর দিল বাচ্চারা উঠে পড়েছে৷ নিধি, নামী দু’জনই নিচে নেমে গেল৷ ফারাহরও বিশ্রাম প্রয়োজন। আইয়াজ ওকে নিয়ে ধীরেসুস্থে নিচে গেল। এরপর আজিজ সিগারেট খাওয়ার বায়না করলে, বকাঝকা করল সৌধ। শেষে অনুমতিও দিয়ে দিল। আজিজ সাধল ওদের। সৌধ একবার ভাবল একটা ধরানো যাক। পরোক্ষণেই মত পাল্টালো। কারণ তার উদ্দেশ্য আজ অন্যরকম।

রাতের খাবার আয়োজন চলছে। সৌধ পা বাড়াল সিমরানের ঘরে৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার রুম৷ অবাক হলো সে৷ ভ্রু কুঁচকে ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালালো। দৃষ্টি চলে গেল বিছানায়। শাড়ি পরিহিত রমণীর পানে। নিমেষে চোখ দু’টো জ্বলে উঠল। হৃদয়ে অনুভব করল ধুকপুক। চোখ বুজে একবার কী যেন একটা ভাবল। এরপর ধীরগতিতে পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেল অর্ধাঙ্গিনীর কাছে। পাশে বসে কাঁধে স্পর্শ করে বলল,

‘ নিচে চলো৷ ডিনার করতে হবে। ‘

কান্নারত থমথমে মুখটা নত করে উঠে বসল সিমরান। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ আমার খিদে নেই। তুমি খেয়ে নাও গিয়ে। ‘

এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল সৌধ। মিটিমিটি হাসতে হাসতে বউকে ফেরাল নিজের দিকে। গাল বেয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে দিয়ে বলল,

‘ এটা খুব খারাপ হলো সিনু। আমি ইচ্ছে করে তোমাকে ডাকিনি৷ তাই বলে কান্না করার কিছু হয়নি। ‘

নিমেষে নিঃশ্বাসের বেগ বাড়ল সিমরানের। সৌধ থেকে সরে গিয়ে নেমে দাঁড়াল। ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,

‘ ডাকোনি বলে কাঁদছি না৷ আমার আব্বুর কথা মনে পড়েছে তাই কাঁদছি। ‘

উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সিমরান। দ্রুত কন্ট্রোলে আনতে হবে৷ যদিও সৌধর সামনে কখনো সে বিশৃঙ্খলা করে না৷ তবু সিচুয়েশন সব সময় এক রকম থাকে না। তাছাড়া নারীরা ঈর্ষান্বিতা হলে ভয়ংকর হয়ে যায়। ত্বরিত উঠে দাঁড়াল সৌধ। সিমরানের কাছে এসে আপাদমস্তক তাকিয়ে বলল,

‘ গ্রেট! শাড়ি পড়েছ? ‘

এ যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা! সেই কখন শাড়ি পরেছে সে। ভেবেছিল বরকে দেখাবে৷ নাহ সে বান্ধবী নিয়ে ছাদে বসে গল্প করছে৷ তার এই ঈর্ষা ভাব অবশ্যই প্রাইভেট। শুধু বর ছাড়া কাউকে দেখানো যায় না৷ তাই বরকেই দেখাল। জ্বলে উঠার মতো করে বলল,

‘ না কিচ্ছু পরিনি। ‘

চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল সৌধর। বলল,

‘ হোয়াট! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি শাড়ি পড়েছ! ‘

রাগে দুঃখে সিমরান ধপাধপ্ পা ফেলে জামা, পাজামা বের করে বাথরুমে যেতে উদ্যত হলো। আচমকা ওর হাত টেনে ধরল সৌধ। শান্ত গলায় বলল,

‘ এত রাগ করছ কেন সিনু? আমার কথা শোনো, রাখো এসব। ‘

বলেই কাপড়গুলো নিয়ে রেখে দিল সে। এরপর ওর গাল দু’টোয় আলতো হাত রেখে গভীর চাউনিতে বলল,

‘ কী মারাত্মক লাগছে এই শাড়িতে! পরে থাকো। আমি দেখি কিছুক্ষণ। ‘

সিমরান ওর হাত সরিয়ে বলল,

‘ আমি শাড়িটা খুলবই সৌধ। পরব না শাড়ি আমি। আর কক্ষনো শাড়ি পরব না৷ ‘

এত জেদ করছে কেন সিনু?

‘ উমমহ, গলা উঁচু হচ্ছে কেন? সাইলেন্ট! ‘

শান্ত মুখ, গম্ভীর চোখ আর মৃদু ধমক। কেঁপে উঠল সিমরান৷ অহেতুক অভিমান যেন এবার হেতু খুঁজে পেল৷ কেঁদে ফেলল আচমকা। বলল,

‘ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, মজা করে এসে আমার সঙ্গে মেজাজ দেখাচ্ছ? আমি এখন তোমার সামনেই থাকব না।’

বলেই বাইরে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হলো। ত্বরিত শক্ত হাতে ওর হাত টেনে ধরল সৌধ। একদম কৌশলে ভেতরে টেনে এনে দরজা আঁটকে দিল। সিমরানের পিঠ ঠেকে আছে তার বুকে। আর তার মুখ ওর কানের কাছাকাছি। সৌধ দরজা আঁটকে বউকে একহাতে জড়িয়ে রইল৷ সিমরানের নিঃশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম। কারণ সৌধ শুধু ওকে জড়িয়েই রাখেনি৷ শাড়ির ফাঁক গলে উন্মুক্ত কোমরে শক্ত হাতে চেপে ধরেছে। অপরহাতে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কল দিয়েছে নামীকে। নামী ফোন রিসিভ করতেই সৌধ শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ তোমরা খেয়ে নিও। সিনুর খিদে নেই। আমারও খাওয়ার মুড নেই এখন৷ আমাদের খাবার রেখে দিও। খিদে পেলে গরম করে খেয়ে নিব৷ ‘

নামীকে কথাগুলো বলেই ফোন কেটে পকেটে রাখল৷ এরপর শীতল চোখে তাকাল সিনুর পানে৷ সিলকি, খোলা চুলগুলোতে নাক ডুবিয়ে বড়ো করে শ্বাস নিল কয়েকবার। সিমরান ওর বন্ধন থেকে ছুটার চেষ্টা করছিল। ও আরো শক্ত করে চেপে ধরল তাকে৷ ক্লান্ত হয়ে ছুটোছুটি বন্ধ করল মেয়েটা। ফেলল হতাশাভরে নিঃশ্বাস। সৌধ একপেশে হাসল তখন৷ কানের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দুল খুলে রাখল টি-শার্টের পকেটে। এরপর লাল হয়ে আসা তুলতুলে নরম কানের লতিতে আলতোভাবে কামড় বসাল। পুরুষালি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, স্পর্শে সিমরান ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। মুখ দিয়ে বেরোয় মৃদু স্বর। সে স্বর শুনে সৌধর চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে আরোও। মোহঘোর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে ,

‘ শাড়ি খুলবে? নো প্রবলেম ডিয়ার, সবই খুলে দিব৷ ‘

সহসা হৃৎস্পন্দন থমকে গেল সিমরানের। একবার চোখ বড়ো বড়ো করে ফিরে তাকাল সৌধর পানে৷ নিমেষে আবার ঢোক গিলল। একটু ভয়, সীমাহীন লজ্জায় টালমাটাল হয়ে রইল রমণীর মন, মস্তিষ্ক আর সর্বাঙ্গ।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে