ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮১

0
647

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮১|
সুজা চৌধুরী অফিস ঘরে। আকস্মিক খবরটা শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ছোটো ভাইকে আগে পাঠিয়ে নিজেকে তৈরি করলেন ঝটপট৷ এরপর বডিগার্ড নিয়ে গাড়িতে চড়ে ফোন করলেন স্ত্রীকে। আদেশ দিলেন, ‘ ড্রাইভার রেডি। ছোটো বউমাকে নিয়ে চটজলদি বেরিয়ে পড়ো। ‘

তানজিম চৌধুরী বোরখা পড়ে অপেক্ষা করছিলেন। সিমরান চুরিদার, গাউনের সঙ্গে উলের চাদর জড়িয়ে নিল গায়ে। মুখে সানস্ক্রিন মাখিয়ে ঠোঁটে জাস্ট ন্যুড লিপস্টিক লাগাল। আয়নাতে বারকয়েক নিজেকে দেখে নিয়ে হাতঘড়ি, হ্যান্ডপার্স আর মোবাইল ফোন নিয়ে ত্বরিত নিচে চলে এলো। দেখতে পেল ঝুমায়না ভাবি, তাহানী, আম্মা তৈরি। সে মৃদু হেসে সিঁড়ি পেরুতে পেরুতে হঠাৎ ঝুমায়না ভাবিকে খেয়াল করল। কী ব্যাপার! ভাবি এত শান্ত, শীতল চোখে তাকিয়ে আছে কেন, ঘটনা কী? সব সময় তো তাকে দেখে অগ্নিশিখার মতো জ্বলতে থাকে, লুচির মতো ফুলতে থাকে। আজ এত ইনোসেন্ট লাগছে কেন?

মনের প্রশ্ন মনেই রয়ে গেল। সবার সঙ্গে সে গিয়ে বসল গাড়িতে। এ বাড়ির সবচেয়ে বড়ো গাড়িতে করে বেড়াতে যাচ্ছে তারা৷ ড্রাইভারের পাশের সিটে তাহানী বসেছে। ঝুমায়না ভাবি সুরকে নিয়ে পেছনে। সে আর শাশুড়ি আম্মা মাঝখানের সিটে। সব কেমন শান্ত, স্নিগ্ধ। ঠিক ঘুমের ঘোরো ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখার মতো।

শীতের সকাল। সূর্যের মিষ্টি আলোতে মনটা ফুরফুরে লাগছে সিমরানের৷ জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল সে। বাইরে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,

‘ আমরা কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি আম্মা? ‘

‘ তোমার বাবার বাড়িতে। ‘

চকিতে তাকাল সিমরান। অল্পসময়ের জন্য মুখ থেকে হাসি উধাও হলেও সে হাসি পুনরায় ফিরিয়ে আনল। মনে মনে ভাবতে লাগল, আশ্চর্য তো! সে তার বাড়িতে যাচ্ছে? তাও আবার শাশুড়ি, ঝুমায়না ভাবি, তাহানীকে নিয়ে? আজ কি কোনো স্পেশাল ডে আছে? সে কি ভুলে গেছে কোনো স্পেশাল দিনের কথা? ভাইয়ার জন্মদিন, আব্বু, আম্মুর জন্মদিন, তার জন্মদিন সব তারিখ মনে করল। অকস্মাৎ থরথর করে হাত, পা কেঁপে উঠল তার। এতজন নিয়ে বাবার বাড়িতে যাচ্ছে। তার তো আম্মু নেই। ভাইয়ের বউটাও নেই। আব্বু আছে কিনা সেটাও প্রশ্ন। আজ সেলিনা আপা এসেছে তো? ওহ-হো! গতকাল রাতে আব্বুকে ফোন করা হয়নি। সেই যে দুপুরে কথা হলো। সে না হয় করেনি। আব্বুও তো একবার ফোন করল না। তবে কী ভীষণ ব্যস্ত ছিল? এখন একবার ফোন করে জানিয়ে দেবে কি?
ভাবতে ভাবতেই মোবাইল ফোনটা বের করল সিমরান। আব্বুর নাম্বারে ডায়াল করতে উদ্যত হতেই অনুভব করল, আম্মা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। যা টের পেয়ে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল কেমন। স্তব্ধ হয়ে গেল নিমিষে। সে স্তব্ধ ভাবেই কল করল আব্বুর নাম্বারে৷ রিসিভ হলো না ফোনটা৷ কিঞ্চিৎ অস্থিরতা অনুভব করল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, শাশুড়ি আম্মা নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছেন। দৃষ্টি ছলছল। সে সচেতন ভাবে নিঃশ্বাস ফেলল। খচখচিয়ে উঠল মন। ফের কল করল আব্বুর নাম্বারে। রিসিভ হলো না। রাগ হলো ভীষণ, অভিমান করে, মেজাজ খারাপ করে ফোন পার্সে ঢুকিয়ে চুপটি মেরে বসে রইল। নির্বোধ মেয়েটা এখনো টের পায়নি। আজকের পর তার আব্বু আর কখনো ফোন রিসিভ করবে না।

গাড়ি যত এগুচ্ছে। পরিবেশ তত থমথমে হচ্ছে। সিমরান কিছু জানে না৷ তবু রক্তের টান, আত্মার টান বলেও পৃথিবীতে অদৃশ্য এক শক্তি বিরাজমান। তাই তো অস্থির অস্থির করছে মেয়েটা। কেন যেন রাগ হচ্ছে ভীষণ। সবকিছু ভাঙচুর করতে মন চাচ্ছে। এত হাসফাস কেন লাগছে? বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়। তানজিম চৌধুরী তাকালেন পুত্রবধূর পানে। তার ছলছল দৃষ্টি দেখে সিমরান কেমন যেন হয়ে গেল। বুকের ভেতর কী যেন একটা ভয়ংকর কথা জানান দিল। নিমেষে গা থেকে চাদর ফেলে দিল সে। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ কী হয়েছে আম্মা? ‘

হাত বাড়ালেন তানজিম চৌধুরী। পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁপা স্বরে বললেন,

‘ আমাদের জীবনে মৃত্যু এক অনিবার্য সত্যি মা। সব অস্বীকার করা যায় কিন্তু মৃত্যুকে অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই। সিনু মা.. ‘

বাকিটুকু বলতে দিল না সিমরান। ভ্রু কুঁচকে অস্থির হয়ে মোবাইল ফোন বের করল। আব্বুর নাম্বারে কল করল আবারো। রিসিভ হলো না। অবচেতন মন সম্পূর্ণ স্থিরতা হারাল এবার। গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মোবাইল ফোনটা আছড়ে ফেলল। তানজিম চৌধুরী হতভম্ব হয়ে সিমরানকে জাপ্টে ধরতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। সিমরান সরিয়ে দিল উনাকে। হতাশ হয়ে মাথা মেলে দিল সিটে। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল শাশুড়ির পানে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

‘ আমার কী আবার কোনো সর্বনাশ ঘটল আম্মা? ‘
.
পৃথিবীর দু’প্রান্তে দু’জন মানুষ। আলাদা শরীর, আলাদা দু’টো মন। তবু একজনের যন্ত্রণায় ক্রমশ আরেকজন কাতর হচ্ছে। উথাল-পাতাল করছে ভিনদেশে। এদিকের কোনো আপডেট আপাতত নিতে পারছে না সৌধ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে হাসফাস করে যাচ্ছে ক্রমাগত। মন, মস্তিষ্ক, সর্বস্ব জুড়ে শুধুই সিনু, সিনু আর সিনু। নিজেকে কোনোভাবেই ঠিক রাখতে পারছে না। যদি কোনো দৈবশক্তি থাকত তার। তাহলে এক্ষুনি চলে আসত বাংলাদেশে। সিনুর কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরত মেয়েটাকে। বুকের গহিন বনে লুকিয়ে রাখত। কোনো দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাকে ছুঁতে দিত না। একদমই না।
.
.
বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স আর মানুষের ভীড় দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সিমরান। অনড় দৃষ্টিতে একবার তাকাল শাশুড়ির পানে। তানজিম চৌধুরী তাকে ধরতে গেলে সে সুযোগ দিল না৷ হাতের পার্স, গায়ে জড়ানো চাদর সবকিছু ফেলে একছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। দেখতে পেল, সুহাস ভাইয়ার কাছের কয়েকজন বন্ধু, অর্পণ স্যার আর সুলল কাকুকে। শরীর ঘামছিল সিমরানের৷ সেই ঘাম ঝড়া থেমে গেল, পরিচিত একটি দৃশ্য দেখে। যে দৃশ্যটা দেড় বছর আগে দেখেছিল। পার্থক্য এতটুকুই সেদিন এই জায়গায় তার আম্মু ছিল। আজ আব্বু। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল মুহুর্তে। অবিশ্বাস্য, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটি দেখে অসাড় হয়ে গেল পা দু’টো। চোখ গলে রক্তের ফোয়ারা বেরুনোর অপেক্ষা। বুক ফেটে বেরুনোর অপেক্ষা বীভৎস আর্তনাদ। অসাড় হয়ে উঠা পা দু’টো আগাতে উদ্যত হলো সিমরান৷ তক্ষুনি
কাঁধে অনুভব করল পরিচিত কারো স্পর্শ। চকিতে তাকাতেই দেখতে পেল নিধি আপু! নিজেকে এবার ধরে রাখা দায় হয়ে পড়ল। বীভৎস এক চিৎকার করে আব্বুর নিথর দেহে আঙুল তুলে ইশারা করে বলল,

‘ নিধি আপুউউ, আব্বুর কী হয়েছে? ‘

কান্না উপচে এলো নিধির। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে সিমরানের কাঁধ চেপে ধরে বলল,

‘ নিজেকে শক্ত কর সিনু। আংকেল মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। ‘

ঝটকায় নিধির হাত সরিয়ে দিয়ে ছুটে আব্বুর কাছে চলে এলো সিমরান। দু-হাত বাড়িয়ে আব্বুর শরীর ছুলো। কখনো মাথায়, কখনো মুখে বা বুকে বুলিয়ে দিতে দিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল,

‘ আব্বু, ও আব্বু তুমি উঠো। উঠে বসো। কিচ্ছু হয়নি তোমার। কোথ্থাও যেতে পারো না তুমি। আমি এটা মেনে নিব না আব্বু। না, না, না। ‘

বলতে বলতে আব্বুর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সিমরান। তানজিম চৌধুরী এলেন। নিধি এসে ধরল ওকে। বলল,

‘ সিনু আংকেলের কষ্ট হচ্ছে। সিনু.. ‘

তানজিম চৌধুরীও ওকে সামলানোর চেষ্টা করলেন।
কারো কথা শুনল না সিমরান। সবাইকে তুচ্ছ করে নিজের মতো আব্বুকে ডেকে গেল। উঠে বসত বলল। তাকে বুকে নিতে বলল। মাথায় হাত রেখে আদর করতে বলল৷ কতশত আবদার করল আর কাঁদল লিখে প্রকাশ করা যাবে না৷ সোহান খন্দকার উঠলেন না। দিলেন না সাড়া। চিরতরে নিথর হয়ে গেছে মানুষটা। হাত, পা ছুঁড়ে কাঁদল সিমরান৷ ভাঙা কণ্ঠে বারবার বলল,

‘ তুমিও, তুমিও চলে গেলে আব্বু? আমার ভাই, আমার ভাইটা কোথায়! ‘

আকস্মিক সুহাসের কথা মনে পড়তেই বাবার মুখপানে বড়ো বড়ো করে তাকাল। হাত বাড়িয়ে দাঁড়ি ভর্তি গাল দু’টো অঞ্জলিতে নিয়ে বলল,

‘ ও আব্বু, তোমার সুহাস তো নেই এখানে। মরে যাব আমি, মরে যাবে ভাইয়া৷ প্লিইজ একবার উঠো আব্বুউউ। ‘

এরপর হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে বলল,

‘ ওও আব্বুউউ তোমার সুহৃদ আসবে। কত প্ল্যান আমাদের! উঠো না আব্বু প্লিইজ উঠো। ‘

আব্বু কথা শোনে না। নড়ে না, শ্বাস নেয় না৷ আম্মুর মতো পাথর হয়ে আছে৷ ইশ হাত, পা কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তোমার কি শীত লাগছে আব্বু? নাকে লালচে হয়ে আছে কেন? কী এটা রক্ত? নাকে স্পর্শ করল। রক্তের দাগ লাগল হাতে। টের পেল আব্বুর শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। হৃৎস্পন্দন থমকে গেল সিমরানের। এক টানা হুহু করে কাঁদল। আশপাশে তাকাল বিধ্বস্ত মুখে। কেউ নেই, কেউ রইল না। আম্মি নেই, সুহাস নেই, সৌধ নেই। আব্বুও থাকবে না। আপন বলতে আর কেউ নেই। এখানে যারা দর্শক হয়ে এখন আছে। সবাই দায়িত্বশীল। কর্তব্য পালনে তৎপর। তার বলতে কেউ নেই, কেউ না। কান্না থেমে গেল সহসা। পাশে নিধিকে পেয়ে একটু শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ নিধি আপু, তোমরা তো সবাই ডাক্তার। এতগুলো ডাক্তার থাকতে আমি এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এতিম হয়ে গেলাম? ‘

নিধি কাছে এলো আরোও। জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে শক্ত করে। একটা বুক সত্যি প্রয়োজন ছিল ওর। নিধি পেতে দিল তার বুক৷ সিমরানের নিঃশ্বাস আঁটকে এলো। নিধি আপুর বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদল আর বলল,

‘ ভাইয়া আর সৌধভাইকে একবার ফোন করো নিধি আপুউউ। ওরা এলে ঠিক আব্বুকে সারিয়ে তুলবে। আমরা একেবারে এতিম হবো না। ‘

কথাটা বলতে বলতেই জ্ঞান হারাল মেয়েটা। নিধি টের পেয়ে চ্যাঁচিয়ে উঠল৷ তানজিম চৌধুরীকে বলল,

‘ আন্টি, আন্টি! সিনু জ্ঞান হারিয়েছে। মাথায় পানি দিতে হবে৷ হেল্প মি. ‘
.
আত্মীয়, স্বজনে ভরপুর বাড়ি৷ চারিদিকে কান্নার রোল। আইয়াজ, আজিজ এলো তখন৷ সোহান আংকেলকে শেষ গোসল করানোর প্রস্তুতি চলছে। তার জন্য গ্রামের বাড়িতে, গোরস্থানে উদয়িনীর কবরের পাশে কোবর কাটা হয়েছে। সিমরান এখন আব্বুর কাছে নেই৷ সে ঘরে স্তব্ধ মুখে বসে আছে। পাশে নিধি, তানজিম চৌধুরী। ওর বান্ধবীরা এসেছে। দরজার পাশে কান্নারত মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কারো দিকে ফিরেও তাকাল না সিমরান৷ ওর মামার বাড়ির লোকজন এলো, সোহান খন্দকারের গোসল শেষে৷ কাফনের কাপড় পরানো হয়েছে সুহাস, সিনুর আব্বুকে। শেষ দেখার জন্য সিমরানকে নিয়ে আসতে বলল ওর মামা। সিমরান এলো। তানজিম চৌধুরী আর নিধি ধরে আনল ওকে। একা হাঁটার শক্তি নেই মেয়েটার। আব্বুকে শেষ দেখা দেখল সিমরান৷ এখন আর কাঁদছে না৷ ওর বৃদ্ধা নানুমনিও এসেছেন। বসে আছেন একটু দূরে হুইলচেয়ারে। বৃদ্ধা এখন ঠিকঠাক হাঁটতে পারে না। লাঠি ভর করেও হাঁটতে কষ্ট হয় তার। সিমরান নানুমনির দিকে একবার তাকাল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল আব্বুর পানে। মুখ বাড়িয়ে চুমো খেল আব্বুর কপালে। এরপর সারা গায়ে একটু হাত বুলিয়ে চারপাশে তাকাল। দৃষ্টি অসহায়। অকস্মাৎ মনে পড়ল ভাইয়াকে, সুহৃদকে। সবশেষে স্বামী সৌধকে। বুকের বা পাশটায় কেমন করে যেন মুচড়ে উঠল একবার৷ এরপর নিঃশ্বাস আঁটকে পুরো পৃথিবী অন্ধকার করে জ্ঞান হারাল। পুরোপুরি জ্ঞানশূন্যের পূর্বে নিধি ওকে অস্পষ্ট স্বরে বলতে শুনল,

‘ নি-ধি আ-পু আমার দ-ম বেরিয়ে যাচ্ ‘

সোহান খন্দকারকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। জানাজা পড়ে তার খাটিয়ার সামনে দাঁড়াল, আইয়াজ আর অর্পণ স্যার। সুলল কাকু আর সিমরানের মামারা পেছনে ধরলেন। এরপর সবাই চিরবিদায় দিল সোহান খন্দকারকে। এদিকে আধাঘন্টার মতো সিমরানের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো নিধি৷ তানজিম চৌধুরী সমানে হাত, পা ডলে দিলেন। মামিরা মাথায় পানি দিলেন৷ নিধি হার্টবিট চেক করে সুবিধা না পেয়ে কল করল অর্পণকে। অর্পণ স্যার ইমিডিয়েটলি হসপিটাল এডমিট করতে বলল ওকে। সবাই মিলে সিমরানকে হসপিটালে ভর্তি করাল। অর্পণ আর আইয়াজ বাইকে করে চলে এলো হসপিটালে। জ্ঞান ফিরলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে দেখে চটজলদি সিমরানকে অক্সিজেন দিল অর্পণ স্যার৷ মেয়েটা হা করে বড়ো বড়ো শ্বাস নিল৷ দু-চোখের পাতায় ভেসে উঠল কাফনের কাপড়ে জড়ানো বাবার ফ্যাকাশে মুখ। নিমেষে কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ল। অর্পণ স্যার খেয়াল করলেন। কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,

‘ বি স্ট্রং সিমরান। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। সবচেয়ে বড়ো কথা সৌধ চৌধুরী মতো হাজব্যন্ড তোমার পাশে আছে। তার সঙ্গে বাঁচতে হবে তোমাকে। তাকে পাশে রেখে আর পাশে থেকে সুন্দর একটা জীবন কাটাতে হবে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? ‘

একটুক্ষণ থামল অর্পণ। সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে কিছু একটা পরোখ করল। এরপর ডাকল, নিধিকে। এরপর পুনরায় সিমরানকে বলল,

‘ আমাদের জীবন থেকে সৃষ্টিকর্তা যদি একটা প্রাণ নিয়ে নেয় তাহলে একাধিক প্রাণ দানও করেন। আমি বাবা হারিয়েছি বহু বছর আগে। আজ এত বছর পর আল্লাহ তায়ালা অনির মাধ্যমে আমার বাবা হারানোর যন্ত্রণা মলিন করে দিয়েছে। সিমরান, আজ তুমি যা হারালে একদিন সৃষ্টিকর্তা দু-হাত ভরে তা ফিরিয়েও দেবেন। ‘

নিধি এলো ভেতরে। অর্পণ স্যার বললেন,

‘ সৌধর মা আর তুমি ওর পাশে থাকতে পারবে। দুজন ছাড়া ভেতরে আর কাউকে এলাউ করা যাবে না। ‘

নিধি মাথা নাড়লো। মুহুর্তেই বেজে উঠল ফোন। স্ক্রিনে বাইরের দেশের নাম্বার! তবে কি সৌধ? কিছুতেই রিসিভ করা যাবে না৷ সিমরানের এই অবস্থা কিছুতেই জানানো যাবে না। ভেবেই ফোন সাইলেন্ট করে দিল। সৌধ নিধিকে না পেয়ে ছটফট করতে করতে আইয়াজকে কল করল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সোহান আংকেলের দাফন হয়ে গেছে?

শোকের বশে সিমরানের অবস্থা দেখে আবেগি হয়ে সৌধকে সবটা বলে দিল আইয়াজ। সিমরান ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়েছে! দীর্ঘক্ষণ জ্ঞান হারা ছিল৷ কোনোভাবেই জ্ঞান ফিরছিল না৷ তাই হসপিটালাইজড করে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

আইয়াজের এই বোকামি, ও দেশে সৌধর অবস্থা কতটা বিধ্বস্ত করে তুলল সে এক উপরওয়ালা আর সৌধই জানে৷ এদিকে নিধি সবটা শুনে আইয়াজকে কম বকাঝকা করল না। আইয়াজও বুঝতে পারল, এভাবে সৌধকে আতঙ্কিত করে দিয়ে সে একদম ঠিক করেনি। তারা এতজন ডাক্তার থাকতে ভরসাদায়ক কিছু না বলে ভয় দেখানো একদম উচিত হয়নি। এবার সৌধকে কে সামলাবে? কে? সে কতক্ষণই বা টিকতে পারবে ও দেশে? আর সুহাস!

চলবে!
‌®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে