ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৩

0
1018

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৩|
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর৷ অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে পরিপাটি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সৌধ। ড্রাইভিং সিটে বসেছে সে। পাশে সিমরান৷ সৌধর চোখে স্টাইলিশ সানগ্লাস। পরনে ধূসর বর্ণের শার্ট, কালো প্যান্ট এবং শার্টের ওপর কালো রঙের কোটি ব্লেজার। সেই কিশোরী বয়স থেকে সৌধর স্মার্টনেস, গেটআপ আর ব্যক্তিত্বে ভীষণ দুর্বল সিমরান৷ সেই দুর্বলতা আজ গাঢ় হলো। কারণ মানুষটাকে আজ নতুন লাগছে। সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঠিক যেমনটা সে চেয়ে এসেছে। যেভাবে পাওয়ার জন্য দিন গুনেছে। খুব বেশি দূরের পথ নয়৷ জায়গাটা পরিচিত সিমরানের। সাত্তার চাচার চা স্টলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সৌধ। চৌধুরী বাড়ির গাড়ি দেখতে পেয়েও বৃদ্ধ সাত্তার চাচা এগিয়ে এলো। কুঁজো হয়ে হাঁটে লোকটা। গাড়ির কাছাকাছি এলে সৌধ কুশল বিনিময় করল৷ সিমরান একটু মাথা উঁচিয়ে এগিয়ে এসে শুধাল,

‘ ভালো আছেন? ‘

সাত্তার চাচা অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ আম্মাজান। আপনি ভালো আছেন? ‘

সিমরান খুশিমনে মাথা দোলাল। সৌধ সাত্তার চাচাকে দু’টো দুধ চা, দু’টো ভাপা পিঠে আর দু’টো ডিম সিদ্ধ পাঠাতে বলে গাড়ি নিয়ে চলল বাংলোর দিকে। সিমরান বুঝল, আজ বাংলোতেই তাদের ব্রেকফাস্ট সারতে হবে৷ অল্প সময়ের জন্য যে আসা হয়নি এও বুঝল৷ পরিচিত জায়গাটিতে দ্বিতীয়বার এসে বুক ধুকপুক শুরু হলো সিমরানের। বুকের গভীরে প্রথমবারের সেই তিক্ত স্মৃতি হানা দিতে শুরু করল৷ ক্রমশ শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হতে শুরু করলে সৌধর দিকে তাকাল অসহায় দৃষ্টিতে।

এক বছরে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে বাংলোটার। ভেতরে গাড়ি পার্ক করার জায়গা করা হয়েছে। পুকুরের কাছটায় ছন দিয়ে ছাউনি তোলা হয়েছে। ছাউনির ভেতর পাশাপাশি ইট, সিমেন্টে তৈরি দুটো বসার জায়গা। সামনে ইট, সিমেন্টের গোলাকৃতির ছোট্ট টেবিল। দূর থেকে এসব আপ্লুত হয়ে গেল সিমরান৷ একদিকে সেদিনের প্রত্যাখ্যান মুহুর্ত, ম্রিয়মাণ হওয়া যন্ত্রণা অপরদিকে ভালোলাগা দুইয়ে মিলে মিশ্রিত অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে রইল। শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে মৃদু পায়ে হেঁটে চলেছে সিমরান৷ ওর পেছনে সৌধ। লং স্কার্টের সঙ্গে লেডিস শার্ট পরনে সিমরানের। গলায় পাতলা একটা স্কার্ফ ঝুলানো। পিঠ জুড়ে ব্রাউন কালার সিল্কি চুল কোমর অব্দি ছুঁয়ে যাচ্ছে। একপেশে হেসে পকেটে দু-হাত গুঁজে হাঁটছে সৌধ। একমনে অবলোকন করছে তার রৌদ্রময়ীকে। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে নেশাময়ীকে নেশাতুর প্রেম নিবেদনে।

ছাউনির নিচে গিয়ে বসতে বসতেই সাত্তার চাচা ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির হলো। সৌধ বাড়ি থেকে একটি ফ্রেশ ওয়াটার বোতল নিয়ে এসেছিল৷ তাই এখান থেকে আলাদা পানির প্রয়োজন পড়ল না। সিমরান চুপচাপ বসে আছে৷ সম্মুখের টেবিলে থাকা গরম গরম ভাপা পিঠে, ডিম সিদ্ধ, আর চা থেকে ধোঁয়া উড়ছে৷ সৌধ ইশারায় খেতে বললে সিমরান মৃদু হেসে আগে ডিম খেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। সৌধ ততক্ষণে ডিম সিদ্ধটা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ফেলেছে৷ সিমরানও এবার চায়ে চুমুক দিল। ফাঁকে আকস্মিক বলল,

‘ আমি এখানে পুরোপুরি কমফোর্ট ফিল করছি না সৌধ ভাই। ‘

‘ মি ঠুয়্যু। ‘

চমকে ওঠল সিমরান৷ সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সৌধর পানে৷ সৌধ ভ্রু বাঁকিয়ে শাসনি সুরে স্পষ্ট বাক্যে বলল,

‘ বউয়ের মুখে ভাই শুনতে ভালো লাগে না৷ আম্মা কতবার নিষেধ করেছে? আমিও তো কম শুধরে দিই নি৷ তবু সৌধ ভাই, সৌধ ভাই করে গলা শুঁকিয়ে ফেলিস কেন? এটার জন্যই কি বিয়ে করেছিস? আমাকে ভাই ভাই ডাকার জন্য তোর সঙ্গে আমি কোনো চুক্তি করিনি রাইট? ‘

কিঞ্চিৎ লজ্জা আর সীমাহীন বিস্ময় ভর করল সিমরানের মুখে। নিঃসন্দেহে এটা তার জন্য আনন্দদায়ক। মন থেকে বউ না মানলে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে বারবার নিষেধাজ্ঞা দিত না৷ এ বিষয়টা নিয়ে সে দাদুনির তোপের মুখে পড়েছে বহুবার৷ শাশুড়িও বুঝিয়েছে অনেক। তবু মন থেকে শুধু সৌধ ডাকটা আসেনি৷ কিছুটা অভিমান থেকেই৷ কারণ সৌধ এখনো তাকে তার পূর্ণ অধিকার দেয়নি। অবশ্য কথা ছিল এমনই। যতদিন না মানুষটা তাকে ভালোবাসতে পারবে, মনের দখলদারি দিতে পারবে। ততদিনে দৈহিক কোনো সম্পর্কে এগুবে না৷ আগে মনের সম্পর্ক গড়বে পরে দেহের মিলন। সিমরানের অভিমান একটা জায়গাতেই। তার এত ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, বিয়ের এতগুলো দিন একসঙ্গে কাটানো। তবু মানুষটার মনে সে জায়গা নিতে পারেনি? শুধু মুগ্ধতা আর ভালোলাগা ছাড়া বিশেষ কোনো জায়গা করতে পারেনি? তীব্র ভালোবাসা থাকলেও না পাওয়ার বেদনায় তীব্র অভিমানী হয়ে পড়ে সে। কিন্তু বুঝতে দেয় না কাউকেই৷ কারণ, সে সব জেনে-বুঝে আকাশসম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই সম্পর্কে জড়িয়েছে।
মনে মনে অনেক হিসেবনিকেশ করল সিমরান। এরপর অকপটে মিহি স্বরে জবাব দিল,

‘ আম্মা নিষেধ করেছে। কিন্তু সে তো জানে না আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক কোনো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। যে কারণে পুরোনো অভ্যেস ইজিলি বদলে ফেলা যাবে। আর তুমিও এখন পর্যন্ত আমাকে সেভাবে ট্রিট করোনি৷ যাতে আমার মনে হবে এবার বরকে বরের মতো ট্রিট করা যাবে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমি পরিপূর্ণ ভাবে স্ত্রীর অধিকার পাইনি। বয়সে সিনিয়র তুমি৷ নাম ধরে ডাকার সেই লাইসেন্সটা নেই। যে লাইসেন্স পেলে আমার কাছে আমি বেয়াদব হবো না। ‘

সিমরানের মুখে জড়তা-সংকোচ ছাড়া স্পষ্ট বাক্য গুলো শুনে থতমত খেয়ে গেল সৌধ। বিস্ময়ে টালমাটাল অবস্থা হলেও এক টুকরো সুখ এসে ভরে ওঠল হৃদয় কোণে৷ আবার প্রশ্ন জাগল, সিনু কি তার অপারগতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল? সে বউয়ের সম্পূর্ণ নিডস পূরণ করতে অপারগ? মুহুর্তেই চায়ের কাপটা ঠুশ শব্দ করে টেবিলে রাখল সৌধ। কেন যেন অস্থিরতা অনুভব করল নিজের ভেতর৷ চা খেয়ে নাকি বউয়ের সুপ্ত ব্যথাসূচক কথা শুনে বোধগম্য হলো না। এদিকে তার আচরণ দেখে সিমরান কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। ভাবল, রেগে গেল কী? পরোক্ষণেই সৌধর কথা শুনে স্বাভাবিক হলো,

‘ তুই কেন কমফোর্ট ফিল করছিস না? ‘

এবার আর সৌধর দিকে দৃষ্টি রাখল না সিমরান। নত মস্তকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ তোমার তো বোঝা উচিত। দায়ী তো তুমিই। ‘

আকস্মিক সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যান বাক্য, স্মৃতি মনে পড়ল সৌধর৷ কিছু বলল না আর। ভাপা পিঠে ঠান্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না। তাই এগিয়ে দিল বউকে। পাশাপাশি নিজেও খেয়ে পানি পান করল। অপেক্ষা করল সিমরানের খাওয়া শেষ হবার৷ এরপর সে পানি এগিয়ে দিল। সিমরান পানি পান করে সুস্থির হলে বলল,

‘ আজ আমার ত্রিশতম জন্মদিন। কী গিফট করবি আমায়? ‘

সৌধ জানত সিনু তার জন্য অনলাইন ঘেঁটে ঘুঁটে অনেক কিছু কিনেছে। পাশাপাশি এতদিন আম্মার থেকে শেখা রান্না গুলোও আজ সম্পূর্ণ একা করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবু জিজ্ঞেস করল প্রশ্নটা। প্রশ্নটি শুনে নিমেষে চোখ তুলে তাকাল সিমরান। চোখেমুখে ফুটে ওঠল দীপ্তি। মৃদু হেসে বলল,

‘ তোমার পছন্দের কিছু খাবার রান্না করে খাওয়াব৷ এছাড়া আরো গিফট আছে সেগুলো তো এখানে নিয়ে আসিনি৷ বাসায় গিয়ে দেখাব৷ ‘

চঞ্চলিত পাখির ন্যায় বলল সিমরান৷ মুখ ভরে হাসল সৌধ। অনেকটুকু দুষ্টুমি খেলা করল সে হাসিতে। বলল,

‘ আমার আরো স্পেশাল কিছু চাই। ‘

কথাটা বলে সিমরানকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে ফের ভরাট কণ্ঠে গভীরতা মিশিয়ে বলল,

‘ আজ এখানে কেন নিয়ে এসেছি জানো বউপাখি? ‘

জীবনে প্রথমবারের মতো সৌধর মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠল সিমরানের। তুমি, বউ আবার তার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে পাখি সম্বোধনে শরীরের শিরা-উপশিরায় বয়ে গেল অচীন তরঙ্গ। চকিতে তাকাল সুপুরুষটির পানে। তাকাল সৌধও। দু’জনার দৃষ্টি মিলন হতেই চোখ নামিয়ে নিল সিমরান। সৌধ স্মিত হেসে বলল,

‘ আমি হেরে গেছি এক মহিয়সী প্রণয়ীর কাছে। আমি হেরে গেছি গভীর সংযমী, তীক্ষ্ণ ভালোবাসা প্রবণ বউটির কাছে। হেরে গিয়েও নিখুঁত ভাবে জেতা যায়, অনুভব করা যায় স্বর্গীয় সুখ। বাঁধা পড়া যায় চিরতরে। আমি তোমাতে হেরেছি, তোমাতেই জিতেছি। তোমাতে পেয়েছি সুখ, বাঁধা পড়েছি চিরতরে। ‘

দম ছাড়ে সৌধ৷ ঢোক গিলে স্থিরনেত্রে তাকানো মুখশ্রীতে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় বলে,

‘ সিনু পাকনি? অনেক বছর আগে তোমার পাকা পাকা কথা, স্মার্টলি চলাফেরা আর প্রচণ্ড দাম্ভিকতা দেখে আমি বলেছিলাম মেয়েটা খুব পাকনি। একদম পাকা বুড়ি। সুহাসকে বহুবার বলেছি, তোর বোন ইঁচড়েপাকা। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি ভবিষ্যতে এই ইঁচড়েপাকা, পাকনি বুড়িটার পাকা ভালোবাসার জোরে আমার গভীর শোক সুখে পরিণত হবে৷ ‘

ফের একটুক্ষণ থামে সৌধ। শ্বাস নেয় লম্বা করে৷ সিমরান তখনো স্থির চোখে তাকিয়ে বাকহারা হয়ে বসে। সৌধ হাত বাড়ায়৷ একটুখানি গাল ছুঁয়ে নরম স্বরে বলে,

‘ সেদিন তুমি বলেছিলে আমি একজনের স্বার্থপরতা যেমন ভুলতে পারিনি৷ তেমন তুমিও আমার প্রত্যাখান ভুলতে পারবে না৷ বিলিভ মি. আমার মন মস্তিষ্ক চেয়েছে বলেই আমি নিজের জীবনের সঙ্গে তোমাকে জড়িয়েছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো হুট করে প্রেমে পড়ে ভালোবাসায় জড়াতে চাইনি৷ সেদিন যখন আমি তোমার এই দু-চোখে তাকাই, গভীর মায়াময় ভালোবাসা খুঁজে পাই, ট্রাস্ট হারিয়ে যাই৷ অতল মায়া গহ্বরে হারিয়ে যাই আমি৷ কিন্তু যাকে কিছুক্ষণ পূর্বে প্রত্যাখ্যান করি তার মায়ায় হারিয়ে যাওয়ার স্বীকারোক্তি কোন মুখে দিই? সেদিন তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তুমি ফিরে গেলে আর আমি ফিরে গেলাম গভীর সমুদ্রে ডুবে মরতে মরতে বাঁচার নিশানা পেয়ে। এরপর কতগুলো দিন আমার ঘোরেই চলে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। কী করা উচিত আমার? সবচেয়ে বেশি বিব্রত বোধ করছিলাম এটা ভেবে যে আমি একজন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া পুরুষ। আর তুমি স্বচ্ছ, পবিত্র মনের সেই নারী যার হৃদয়ের প্রথম পুরুষটি আমি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল এটা অন্যায়, এটা ঠকানো। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ লাগছিল। বাচ্চা একটা মেয়ে। আমাকে হারিয়ে দিল, তুচ্ছ করে দিল। ভালোবাসা নামক অনুভূতিটাতে আমার চেয়ে হাজার গুণ এগিয়ে গেল। এত এত চিন্তার ভীড়ে হঠাৎ যখন শুনলাম তুমি অন্য কারো হয়ে যাবে। ঠিক তক্ষুনি নিজের প্রতি ধিক্কার এলো। আমার ভেতরের সত্তায় জানান দিল, আমার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথমবার যেটা হারাই তার আভাস পাইনি। দ্বিতীয়বার যেটা হারাতে যাচ্ছি তার আভাস পেয়ে চুপ করে বসে থাকা নিজের প্রতি নিজের অন্যায়। কারো গভীর ভালোবাসাকে অসম্মান। এক নিষ্পাপ হৃদয় যে আমার সবটা জেনে আমাকে ভালোবাসতে চায় তাকে সেই অধিকার না দেয়া, নিজের করে না নেওয়া জঘন্যতম অপরাধ। আমি নিষ্ঠুরতার যন্ত্রণা জানি বলেই সেই যন্ত্রণায় তোমাকে ভুগাতে পারিনি। তোমার যন্ত্রণা হবে, তুমি অসুখী হবে। আমায় ভালোবাসতে না পেরে, আমার ভালোবাসা না পেয়ে তুমি দগ্ধীভূত হবে আমি জাস্ট এটাই মেনে নিতে পারিনি। এই যে মেনে নিতে না পারা। এটাই আমাকে ইশারা দিয়েছিল ওঠে দাঁড়ানোর, আলোর পথ আর দ্বিতীয়বার ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতিতে জড়িয়ে পড়ার৷ ‘

সৌধর নরম স্পর্শ, ঘন শীতল কণ্ঠের সুখী সুখী কথাগুলো শুনে আবেশে চোখ দু’টো বন্ধ করল সিমরান। যেখানে সেদিনের কথাটায় সে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি৷ প্রিয়জনকে পাওয়া মাত্র লুফে নিয়েছে। সেখানে সৌধ মনে রেখেছে তার কথা৷ এক জীবনে আর চাই? আবেগান্বিত হৃদয় থেকে কান্না উপচে এলো। টুপ করে গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে সৌধর হাতের পিঠে পড়ল৷ সৌধ যত্ন নিয়ে সে অশ্রুজল মুছে দিয়ে গাঢ় দৃষ্টি অটল রেখে বলল,

‘ সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যান তোমায় ভুলতে বলব না। কিন্তু ওই প্রত্যাখ্যানের পরও তোমাকে নিজের করে নেয়া থেকে শুরু করে আজকের মুহুর্তটুকুও তুমি ভুলো না। দেখবে ওই সময়টা মলিন হয়ে যাবে৷ আর আজকের পর ওই কষ্টগুলো আমার ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেব৷ ‘

চট করে তাকাল সিমরান। অবাকান্বিত সে চোখ দেখে দৃঢ়তার সঙ্গে সৌধ বলল,

‘ ইয়েস ডিয়ার, ফাইনালি আই গট টু লাভ ইউ। ‘

মোহাবিষ্ট চোখে তাকিয়ে সৌধ কথাটা বলতেই বুকের ভেতর উথাল-পাতাল তরঙ্গ বয়ে গেল সিমরানের। পরিপূর্ণতায় বুক ভার হয়ে ওঠল৷ চোখের পানি হলো ছন্নছাড়া। সৌধ বিগলিত হলো ওর কান্না দেখে। যতটা কাছাকাছি ছিল তার চেয়েও অধিক কাছে এসে কপালে কপাল ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বলল,

‘ সিনু পাকনি? অনেক অপেক্ষা করিয়েছি, অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়েছ। ধৈর্য্যের পরীক্ষা আমিও দিয়েছি। আমি পারতাম তোমাকে আরো আগে কাছে টানতে৷ শুধুমাত্র মনের রানি হিসেবে তোমাকে পূর্ণ সম্মান, অধিকার দিতে চাই বলেই শারীরিক সব উত্তেজনাকে বেঁধে রেখেছি। বিয়ে মানেই আমার কাছে দৈহিক প্রয়োজন মেটানো নয়৷ বিয়ে মানে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের সব প্রয়োজনের পাশাপাশি মনের খোরাক মেটানোরও কারিগর। সব মানুষ সমান নয়৷ কেউ আগে শারীরিক মিলনের মাধ্যমে মনের মিলন ঘটায়৷ কেউ মনের মিলন ঘটিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আমি দ্বিতীয় জন। আমি জানি সবটা বুঝবে। তবু যদি এ বিষয়টা নিয়ে মনের ভেতর কষ্ট, চাপা অভিমান থাকে ক্ষমা করো। কারণ তুমি ক্ষমা না করলে পরপারে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছেও ক্ষমা পাব না৷ ‘

আচম্বিতে ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে ফেলল সিমরান। একজন কঠিন, শক্তিশালী হৃদয়ের মানুষ যখন এত আবেগ, ভালোবাসা, আদর মিশিয়ে আকুল স্বরে আত্মনিবেদন করে তখন নিঃসন্দেহে আপনি তার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। সিমরান অনুভব করতে পারল সে সৌধর হৃদয়ে ঠিক কতখানি দখল করে নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে আনন্দানুভূতিতে সিক্তও হলো। সৌধ ওর কান্না থামাতে বুকে টেনে ভরসা যোগাল৷ এবার একটু দৃঢ় হয়ে বলল,

‘ প্রাপ্তির দিনে এভাবে কেউ কাঁদে? খুউব বোকামি এটা। ‘

ছাউনির সামনে একফালি রোদের দেখা মিলেছিল। হঠাৎ সে রোদ মিলিয়ে গেল। চারদিক আঁধার হতেও শুরু করল। সিমরানের কান্না থামলেও সৌধর বুকপকেট থেকে মাথা তুলল না৷ নীরবে, নিভৃতে শুধু অনুভব করতে লাগল মানুষটার ভালোবাসার গভীরতা। কয়েক মিনিট ব্যবধানে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। শীতের বৃষ্টি। সৌধ বলল ঘনীভূত গলায় বলল,

‘ উইন্টার রেইন। ‘

এবারে মাথা তুলল সিমরান৷ কিছুটা দূরে সরে গিয়ে নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করল। সৌধ নেশাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ দাদুনি বলে বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার রহমত। তাই বৃষ্টি এলে মন খারাপ বা বিরক্ত হতে নেই। উপভোগ করতে হয়।’

মৃদু হেসে সিমরান তাকাল ছাউনির বাইরে৷ হালকা শীতটা গাঢ় হলো হিম ধরা হাওয়া আর বৃষ্টিপাতে। সৌধ চেপে বসল সিমরানে দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘ ঠান্ডা লাগছে? ‘

সিমরান মাথা দুলিয়ে না করল। সৌধ থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ লাগছে। দেখতে পারছি আমি। ‘

চমকে তাকায় সিমরান৷ সৌধ নির্নিমেষে তাকিয়ে। সিমরান তাকালে আলতো হেসে বলে,

‘ একদিন যেখানে প্রত্যাখ্যান হলে আজ সেখানেই প্রিয়তম পুরুষ, স্বামী সৌধর প্রপোজাল পেলে অনুভূতি কেমন? ‘

সহসা চোখ সরিয়ে নিল সিমরান৷ শীত শীত বোধে ঠোঁট দু’টো রক্তিম হয়ে আছে তার। সৌধর কথায় এবার তীব্র উত্তেজনা আর লজ্জায় গাল দুটোও আরক্ত হয়ে ওঠল। ওরা একে অপরের এতটা কাছাকাছি বসা, যে দুজনই দুজনার ভারিক্কি শ্বাস, প্রশ্বাস গুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সিমরানের যুবতী হৃদয় ঝনঝনিয়ে ওঠছে ক্ষণে ক্ষণে। এমতাবস্থায়
হঠাৎ কানের কাছে উষ্ণ হাওয়া ছড়িয়ে পড়লেই থরথর করে কেঁপে ওঠে সে। বুকের ভেতর ছটফটানির তরঙ্গে দিশেহারা হয়। চট করে ওঠে দাঁড়ায়। চলে যায় ছাউনির কিনারায়। বৃষ্টি বাড়ে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এবার ঝমঝম শব্দে মুখরিত। উত্তেজনা দ্বিগুণ হয় সিমরানের। পেছন ঘুরে তাকাতে পারে না লজ্জায়। ছাউনি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিপাতে দৃষ্টি স্থির রেখেছে সে। কিয়ৎক্ষণ পর বুঝতে পারে সৌধও ওঠে দাঁড়িয়েছে। অচেনা ভয়, শিহরণে বুক ধক করে। অনুভূতির দাবানল ঠেকাতে সৌধর সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হতে বলে,

‘ যদি বৃষ্টি না থামে? কী করে বাড়ি ফিরব?’

আকস্মিক সিমরান ওঠে যাওয়ায় বুকে মৃদু ধাক্কা খেয়েছে সৌধ। বলা যায় এক টুকরো ছ্যাঁকা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সিমরানের প্রশ্ন কানে এলেও উত্তর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না৷ মৃদ্যুপায়ে এগিয়ে এসে একদম পেছনে, গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তার লম্বা, বলিষ্ঠ শরীরটা এমন ভাবে সিমরানের পিছনে দাঁড় করাল যে বেচারি আর চাইলেও কোনো পাশে সরে যেতে পারবে না৷ সিমরান নিজের প্রশ্নটুকুর উত্তর না পেয়ে ফের কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ বাড়ি যাব আমি৷ আজ কত রান্না করব ভেবেছি। আমি তো পাকা রাঁধুনি নই। আমার সময় লাগবে অনেক৷ তাই দুপুর থেকেই শুরু করব৷ চলো না বাড়ি যাই। ‘

কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াতেই হাত বাড়িয়ে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরে সৌধ। দুষ্টু হেসে বলে,

‘ কী সাংঘাতিক আচরণ হু? বাড়ি তো নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু এই জায়গাটায় মেমোরেবল কিছু না রেখে যাব ভাবলে কী করে? সেবারেরটা ভুলোনি আশা করি এবারেরটা আরো ভুলবে না। একদম প্রতিটা লোমকূপে, রক্তে রক্তে মিশিয়ে দিয়ে যাব৷ ‘

পোক্ত হাতের বাঁধন ছাড়ানো সম্ভব না৷ ছাড়াতে ব্যগ্রও হলো না। একে তো পুরুষ মানুষ। তারওপর মানুষটা সৌধ চৌধুরী। পৃথিবীতে কার সাধ্য তার থেকে তার বউকে ছাড়ানো? স্বয়ং বউটিরও যে নেই।
লজ্জায়, অস্বাভাবিক অনুভূতিতে মূর্ছা ধরল সিমরান। সৌধ ওর দেহশ্রী আগলে নিয়ে ডানহাতে থুতনী তুলে ধরল। এরপর আকস্মিক নিজের পুরো ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিল টকটকে গোলাপি রাঙা অধর জুড়ে৷ নিমেষে চোখ দুটো খিঁচিয়ে নিল সিমরান৷ দু’টো হাতের শক্ত খামচি পড়ল সৌধর পৃষ্ঠদেশে এবং বাহুতে৷ ঝুম বৃষ্টির সুরে বউয়ের কোমল অধরে নেশা ধরে গেল সৌধর। বৃষ্টির শব্দ যত তীক্ষ্ণ হয় ওর অধর চুম্বন ততই গাঢ়ত্বে রূপ নেয়। এদিকে প্রথমবার ‘ লিপ কিস ‘ নামক অনুভূতিটায় সিমরানের নড়বড়ে অবস্থা। পরিচিত মানুষটির অচেনা উন্মাদনায় দিশেহারা।

অকস্মাৎ ফোনের রিংটোনে থেমে যায় সৌধ। ছাড় পেয়ে হাঁপাতে শুরু করে সিমরান৷ একদিকে প্রথম পুরুষালি ঠোঁটের আক্রমণ, অপরদিকে গাল, থুতনীতে খোঁচা খোঁচা ঘন দাঁড়ির প্রবল ঘর্ষণ আর তীব্র লজ্জা। মুখশ্রীর শুভ্র রঙটা বিলীন হয়ে রক্তাম্বরে পরিণত হয়। নিজের ভারসাম্য টুকু ধরে রাখার শক্তি পায় না৷ সৌধ বারকয়েক ঢোক গিলে, বড়ো বড়ো করে শ্বাস নেয়। একহাতে সিমরানকে টেনে বসার জায়গায় বসিয়ে এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে। সুহাসের নামটা জ্বলজ্বল করছে। মুহুর্তেই মেজাজ সপ্ত আকাশে উঠে যায়। সিমরানের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘোরায়। ফোন রিসিভ করে চাপা মেজাজে বলে,

‘ এই শালা ফোন করার আর সময় পাস না? ‘

সুহাস বন্ধুকে ত্রিশতম বার্থডে উইশ করার জন্য ফোন করেছিল। তার খুশি খুশি মুডটা নষ্ট করে দেয়ায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ কেন বোন জামাই, আপনি কি টয়লেটে? ‘

‘ নাহ, বেড রুমে। বউয়ের সাথে রোমান্স করি। ‘

ব্যস। এক বাক্যেই সুহাসের সমস্ত দুষ্টুমি, রসিকতা বন্ধ হয়ে গেল। সৌধ সত্যি বলুক বা মিথ্যা। সে লজ্জা পেল। কারণ, সৌধর বউটা যে তারই আদরের বোন।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৩| ‘ বর্ধিত অংশ ‘

সুহাসের সঙ্গে কথা বলা শেষ করার পর থেকে সৌধ সিমরানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু মেয়েটা কোনোভাবেই তার দিকে তাকাচ্ছে না। আর না একটি শব্দও উচ্চারণ করছে৷ টুকটাক যা উত্তর দেবার মাথা নেড়েই দিয়েছে। এভাবে ওদের ঠিক কতক্ষণ কেটে গেছে জানা নেই। এরপর বৃষ্টি থামলে সৌধ ছাউনি থেকে বেরিয়ে বলল,

‘ বাড়ি যাবেন? নাকি এখানেই লাল, নীল হয়ে বসে থাকবেন? ‘

আকস্মিক এমন প্রশ্নবাক্যে লজ্জায় এবার বেগুনি হওয়ার উপক্রম যেন। নিজের মুখটুকু দেখানো দায় হয়ে পড়েছে। তবু কোনোরকমে ওঠে দাঁড়িয়ে, লজ্জায় আরক্ত মুখে এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে৷ সৌধ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির দরজা খুলে রেখেছিল। সিমরান গিয়ে ওঠে বসলে আকস্মিক ওর মুখশ্রীতে চোখ পড়লে আঁতকে ওঠল। মুখটা মারাত্মক পর্যায়ে রক্তিম হয়ে আছে। টকটক করছে ঠোঁটজোড়া৷ ঢোক গিলল সৌধ। ত্বরিত পানির বোতল এগিয়ে ধরে বলল,

‘ চোখে, মুখে পানি দাও কুইক। ‘

চোখে মুখে পানি দিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিল সিমরান। গাড়ি স্টার্ট দিল সৌধ৷ ওরা বাড়ি পৌঁছালে সবাই ওদের দেখে অবাক হলো। প্রশ্ন পেল দাদুনির থেকে ‘সাতসকালে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল?’ সিমরান কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। সৌধ সুখী সুখী চেহেরা নিয়ে দাদুনির পাশে বসল গিয়ে। ফিসফিস করে বলল,

‘ রোমান্টিক ওয়েদার৷ প্রেম করতে বেরিয়েছিলাম দাদুনি। ‘

চোখ, মুখ কুঁচকে এলেও কুঁচকালো না দাদুনি। গলা বাড়িয়ে তাহানীকে ডাকল,

‘ আমার পানের বাটা নিয়া আসো তো দাদুন। ‘

সৌধর রসিকতা দূর হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ এই ঘাসপাতি খেয়ে খেয়েই চেহেরার বারোটা বাজাচ্ছেন৷ ‘

বলেই উঠে দাঁড়াল। তানজিম চৌধুরী এসে বললেন,

‘ নাস্তা করবা না তোমরা? ‘

‘ করে আসছি আম্মা। আপনারা নাস্তা করেছেন? ‘

‘ হ্যাঁ করলাম মাত্র। আজ সিনু মা রান্নাবান্না করবে তোমার জন্য। তাই সব কিছু রেডি করে দিচ্ছি। কাটাকুটি শেষ প্রায়। মশলাও তৈরি, মাংস ভিজিয়েছি। ও এসে শুধু রাঁধবে। শুভ জন্মদিন আব্বা।’

আলতো হাসল সৌধ৷ ধন্যবাদ জানালো শ্রদ্ধেয় আম্মাকে। এরপর উপরে যেতে উদ্যত হতেই শুনতে পেল দাদুনির টিপ্পনী,

‘ সব যখন তোমরাই রেডি করছ চুলায় তোমরই তুলে দাও। ওর বউয়ের জন্য ওটুকু বাদ রাখবা কেন? এইগুলা তো কাজকাম না এইগুলা হলো নাম। ‘

হাঁটা পা থেমে গেল সৌধর। পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল তানজিম চৌধুরী ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলছে, চলে যেতে বলছে ঘরে৷ সৌধ ইশারায় তানজিম চৌধুরীকে বোঝালেন ধারালো কিছু নয় সুন্দর আর নরম একটি কথা বলবে। এরপর দাদুনি বলল,

‘ দাদুনি, বিয়ের আগে সিনুকে বলেই দিয়েছিলাম একদম রান্নাবান্না করা যাবে না। হাতে কাটাকুটির দাগ, এবড়া, থ্যাবড়া নখ আমার পছন্দ না। তবু সে রান্নাবান্না শিখেছে টুকটাক রাঁধেও। আজ নাকি আবার অনেক আইটেম রাঁধবে। কেমন লাগে বলো তো? কাজই হোক বা নাম৷ সবই তো নিষেধ তার জন্য। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল দাদুনি। বলতে ইচ্ছা করল,

‘ সারাজীবন কি কাজের লোক আর আম্মাকে দিয়ে রান্না করাবা নাকি? বউ কি শোপিস! ‘

কিন্তু বলল না। ছেলে আর নাতিদের ওপর সে খুব বেশি তীক্ষ্ণ কথা বলতে পারে না৷ এরা তার ভীষণ ভালোবাসার। সৌধও আর দাঁড়াল না। চনমনে চিত্তে উপরে চলে গেল।
.
.
সারাদিন প্রচুর রান্নাবান্না হলো। সব সৌধর পছন্দ অনুযায়ী। বেশ আয়েশ করেই লাঞ্চ করল সৌধ। সঙ্গে ছিল বাবা আর বড়ো ভাই৷ আজ ঝুমায়নার মুখেও সিমরানের রান্নার প্রশংসা শোনা গেল। সৌধর হুশিয়ারীতে আর সিমরানের পিছু লাগতে পারেনি ঝুমায়না। খুব একটা পছন্দ করে না বলে এড়িয়েও চলেছে। সিমরানও ঝুমায়নাকে পছন্দ করে না। সেদিনের পর না ঝুমায়নার প্রতি আগ্রহী হয়েছে আর না কথা বলেছে। তবে সুরকে সুযোগ পেলেই আদর করে দিয়েছে। আজ তার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে মুচকি হেসে থ্যাংকস জানালো সিমরান। শশুর, ভাসুর, ভাবি আর বরের খাওয়া শেষে সিমরান যখন দাদুনি, শাশুড়ি আর তাহানীর সঙ্গে খেতে বসবে আকস্মিক তাহানী চমকিত কণ্ঠে বলল,

‘ ভাবিপা কীভাবে ব্যথা পেয়েছ এখানে? ‘

প্রশ্নটি করেই তর্জনী এগিয়ে সিমরানের নিচের ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করল সিমরান। তানজিম চৌধুরী, দাদুনি দু’জনই বিস্ময় ভরে তাকাল। দেখতে পেল সত্যিই কালশিটে দাগ বসেছে অধর কোণে। সিমরান নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই তো সে কীভাবে ব্যথা পেল? তানজিম চৌধুরী কিছু প্রশ্ন করতে যেয়েও হঠাৎ কী যেন ভেবে থেমে গেলেন৷ সবাই সিমরানের দিকে তাকিয়ে। তাই সবাইকে খেতে মন দিতে বলে নিজেও খেতে শুরু করলেন। সিমরান আর চিন্তায় খেতে পারল না। বেশ তাড়া নিয়ে খাওয়া শেষ করে ঘরে গিয়ে ত্বরিত আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আঁতকে ওঠল।

সৌধ প্রাচীর সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলছিল। সময়ের ব্যবধানে সবার জীবনেই বেশ পরিবর্তন এসেছে। বিয়ের ছয় মাস চলছে প্রাচীর। এ মুহুর্তে স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে রয়েছে সে। এছাড়াও আরো একটি শুভ সংবাদ হলো, প্রাচী তিন মাসের গর্ভবতী। সৌধকে বার্থডে উইশ করার পাশাপাশি নিজের এ সুখবরও জানালো। সিমরানকে চাইল কথা বলার জন্য। সৌধ ডাকল,

‘ সিনু এদিকে আসো। ‘

সিমরান মুখটা ব্যথাতুর করে এগিয়ে এলো৷ ফোন নিয়ে কুশল বিনিময় করলে প্রাচী বলল,

‘ মন খারাপ কেন বনু? ‘

‘ কীভাবে যেন ব্যথা পেয়েছি। ঠোঁটে জখম হয়ে গেছে একদম! ‘

নিমেষে বুকের ভেতর ধক করে ওঠল সোধর৷ তড়াক করে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে চোখ গরম করে তাকাল। এরপর ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখতে পেল প্রাচী কাশছে আর মিটিমিটি হাসছে। উপায়ন্তর না পেয়ে কলটা কেটে দিল সে। সিমরান হতভম্ব। কী হলো এটা! সৌধ ছোটো ছোটো দৃষ্টিতে তাকাল এবার৷ দেখল কতখানি দাগ বসেছে। এরপর দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ মাথা পুরোপুরি গেছে না? সকালবেলা কী হয়েছে? লিপে কিস করেছি না? এটা আমার বান্ধবীকে বুঝিয়ে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করছ! ‘

থতমত খেয়ে গেল সিমরান৷ সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। চুমুর সাথে এই দাগের কী সম্পর্ক? মনের প্রশ্ন মুখে করতেই সৌধ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আরে ইডিয়ট, লিপ কিস করেছি না? সেজন্য এমন হয়েছে। ‘

‘ সে জন্য কেন হবে? লিপ কিস করলেই এমন রক্ত জমাট ধরে যাবে? দুনিয়াতে আর কেউ এসব করে না। আমি মনে হয় কিছুই জানি না, বুঝি না। ‘

মুখ ফস্কে কথাগুলো বলেই বিছানা থেকে চট করে ওঠে দাঁড়াল সিমরান। এরপর পিছ মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে লজ্জায় আরক্ত হয়ে রইল। কী বলে ফেলল এসব। ছিঃ! ওর আনাড়ি কথা শুনে সৌধর চোখ দু’টো বড়ো হয়ে গেছে৷ কয়েক পল সময় নিয়ে হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘ আমার বউয়ের ঠোঁট অতিরিক্ত নরম তাই এমন হয়েছে। আর হ্যাঁ, অন্যরা একে অপরকে মিলেমিশে চুমু খায় তাই জখম হয় না। আমাদেরটা একতরফা হয়েছে। মিলেমিশে হলে এমন স্পট পড়বে না। আশা করি রাতে এ বিষয়টা মাথায় থাকবে। ‘

শেষ বাক্যটি শুনে নিজেকে আর ঠাঁই রাখতে পারল না মেয়েটা৷ এক নিমেষে ছুটে পালালো। থামল একদম তাহানীর ঘরে গিয়ে। যদিও তাহানী এখনো একা থাকার অভ্যেস করেনি৷ তবু তার জন্য আলাদা ঘর আর প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে। তাই দ্রুত গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওর লিপস্টিক বাক্স ঘেঁটে একটি লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে তারপর বের হলো। মনে মনে ভাবল, বিপদে লিপস্টিকও রক্ষা করে, বন্ধু হয়ে পাশে থাকে।

এরপর দিনটা ওর তীব্র লজ্জা, শিহরণ আর ঘোরে কাটল৷ ঘোরটা ভাঙল সন্ধ্যার পর। যখন সৌধ ডেকে নিয়ে কালো রঙের একটি শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ পরে নাও ঝটপট। ‘

শাশুড়ি মায়ের কাছে শাড়ি পরাটা কব্জা করে নিলেও কুঁচি করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল সিমরান৷ জর্জেট শাড়ির কুঁচি করা খুবই কঠিন ব্যাপার৷ সৌধকে ডাকবে কি ডাকবে না এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে হঠাৎ ডাকতে যাবে তক্ষুনি মনে পড়ল, কোনোভাবেই ভাই সম্বোধন করা যাবে না৷ আবার শুধু সৌধ বলতেও মনটা কেমন কষ্ট কষ্ট পাচ্ছে। বয়সে প্রায় সাত বছরের বড়ো। মানুষটা তার এত সম্মানের, ভালোবাসার, যত্নের৷ কীভাবে নাম ধরে ডাকে? আচমকা একটি সম্বোধন মনে পড়াতে বেলকনির দিকে গলা বাড়িয়ে বলল,

‘ হ্যালো ডক্টর, শুনছ? ‘

সৌধ ফোনে কথা বলছিল আইয়াজের সাথে। ঘরের ভেতর থেকে মিহি স্বরের ডাকটায় হৃদয় শিহরিত হলো৷ কান পেতে রইল ফের কিছু শোনার। শুনতেও পেল,

‘ হ্যালো ডক্টর? ‘

সৌধ নীরব। কান দু’টো সজাগ। সিমরান এবার গলার স্বর খানিকটা উঁচিয়ে ডাক দিল,

‘ চৌধুরী সাহেব? ‘

এবারে আর চুপ রইল না সৌধ। আইয়াজকে বিদায় জানিয়ে বউকে বলল,

‘ মিসেস চৌধুরী, ডক্টর চৌধুরী ইজ কামিং…’

খুব মন দিয়ে যত্ন নিয়ে বউয়ের কুঁচি ধরে পিন আঁটকে দিল সৌধ৷ শাড়ি পড়া শেষে চুল ছেড়ে বেশ অনেক গুলো সেলফি নিল দু’জন। পার্সনাল ক্যামেরা দিয়েও বউয়ের অগণিত ছবি তুলতে ভুলল না সৌধ। এরপর সুহাস এলো বাড়িতে। পরিবারের সবাই মিলে ছোট্ট পরিসরে বার্থডে সেলিব্রেশন করা হলো। রাতে একদম ডিনার সেরে ফিরে গেল সুহাস৷ তবে যাওয়ার আগে সৌধকে বুকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল,

‘ আমার বোনের মুখে আজ সত্যিকারের সুখ দেখতে পাচ্ছি সৌধ। ওয়েল ডান। ‘
.
সুহাসকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরতে রাত এগারটা বাজল। সিমরান বসে বসে তখন চিকেন পেটিস খাচ্ছিল। সৌধ এলে ওকে সাধল। সৌধ খাবে না বলে পোশাক চেঞ্জ করে শুধু একটি শর্ট প্যান্ট আর টিশার্ট পরে নিল৷ কেক কাটার সময় সিমরান বায়না ধরেছিল একটি গান শোনানোর জন্য। সৌধ তখন কোনোমতেই রাজি হয়নি৷ তুলেনি কোনো প্রকার সুর। কারণ আজ সে এমন এক মুডে আছে। যে মুডটা সিমরান ব্যতীত অন্যকারো সামনে প্রকাশ করা সম্ভব না৷ বায়না ধরেও গান শুনতে পারেনি বলে অভিমান হয়েছে সিমরানের। পণ করেছে আর কক্ষনো গান শুনাতে বলবে না৷ এদিকে সৌধ পণ করেছে আজ ওকে গান শোনাবেই। তবু যে সে গান নয়৷ মোস্ট হটেস্ট সং!

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এসে বাথরুমে যাওয়ার পায়তারা করছে সিমরান৷ টিশার্ট আর প্লাজো বের করেছে মাত্র। অমনি সৌধ সম্মুখে এসে দাঁড়াল ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ এগুলো কী হবে? ‘

‘ পরব, ঘুমাতে যাব যে। ‘

সৌধ ওর হাত থেকে কাপড়গুলো ছিনিয়ে নিয়ে বলল,

‘ এসব পরতে হবে না। ‘

‘ কী বলছ? এই শাড়ি পরে ঘুমাব? উফফ আর পরে থাকা যাচ্ছে না৷ ক্লান্ত লাগছে। ‘

থম মেরে তাকিয়ে রইল সৌধ। আকস্মিক আদেশ সূচকে বলল,

‘ জাস্ট মুখটা ক্লিন করে এসো। জুয়েলারি গুলোও খুলতে পারো। আর যদি শাড়িতে লাগানো পিন গুলো খুলো তবে উপকার হয়। ‘

স্তব্ধীভূত হয়ে গেল সিমরান। বুকের ভেতর কেমন কেমন করেও ওঠল। ঢোক গিলল সচেতন ভাবে। জোরপূর্বক হেসে বলল,

‘ আমার কিছু বলার ছিল। ‘

‘ হু? ‘

‘ আমার কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়ার গল্প। ‘

সিনু পাকনির পাকনামো ধরে ফেলল সৌধ। এক চোখ টিপ দিয়ে অমায়িক হেসে বলল,

‘ আজ নয় আরেকদিন শুনব। ‘

শরীরের রক্তকণিকায় অসহ্য শিহরণ হলো। কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে চুপসে গেল মুখটা। মৃদু কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘরে এসে দেখল, সৌধ গিটার নিয়ে বসে আছে ডিভানে। তাকে দেখে বেলকনিতে চলে গেল। ইশারা করল তাকে আসতে। সিমরান ধাতস্থ হয়ে তোয়ালে তে মুখ মুছে যেতে যেতেই গিটারে সুর তুলল সৌধ। বেচারী গিয়ে বসতেও পারল না। তার আগেই সৌধর গভীর আবেদনীয় কণ্ঠে বলা গানটি শুনতেই চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল তার অতি সুদর্শন, শক্ত ব্যক্তিত্বধারী বরটার পানে। টের পেল পৃথিবীর সমস্ত কঠিন ব্যক্তিত্বধারী পুরুষরাই একটা জায়গাতে গিয়ে চরম নির্লজ্জ, বেহায়া আর লাগামছাড়া। এটা তো একদিন হওয়ারই ছিল। লুনার ভাষায় সৌধ চৌধুরী তো আর সত্যি সত্যি ইমপোট্যান্ট নয়।

ছোটোবেলা থেকেই হিন্দি, ইংলিশ ভাষাটা খুব বুঝে সিমরান৷ হিন্দি সিরিয়াল, মুভি, ইংলিশ মুভি দেখতে দেখতেই এসবে পটু হয়ে গেছে। তাই সৌধর গাওয়া গানের মিনিং বুঝতে তার এক মিনিটও সময় লাগল না৷ কানটা ঝাঁঝাঁ করে ওঠল ওই সুর, ওই গান শুনে,

***
আ ইস্ রাত কি লামহে
সাং মেরে সাথ কাট লে
নিন্দকো ছেড়কে তু
সাং মেরে জাগলে

ইন লবোকো তুভি আপনে হি লাবোপে জাগাহ দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
আপনি নাযদিক মুঝে আনে দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
তুঝে খুদকি কারিব লানে দে

ধিমি ধিমি আঁচ পে তেরে তান কি
থোরা থোরা ইউ জ্বালুন ম্যায়
জো ভি হ্যায় য়েআহান মেরে মন কি
আ সপুন আজ তুঝ হে হি ম্যায়

ইন লবোকো তুভি আপনে হি লাবোপে জাগাহ দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
আপনি নাযদিক মুঝে আনে দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
তুঝে খুদকি কারিব লানে দে

লজ্জায় দিশেহারা সিমরান। কাঁদো কাঁদো হৃদয়ে ভাবল, দুনিয়ায় আর কোনো গান ছিল না? রাত দুপুরে এসব কী গান? কান দিয়ে উষ্ণ হাওয়া বইছে তার। বর রূপে ধরা দেবে, প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠবে ঠিক আছে৷ এমন লাগামছাড়া প্রমিক হতে কে বলল? সে তো বলেনি। আকস্মিক সচেতন হয়। বারকয়েক ঢোক গিলে ভাবে সে পালাবে। ত্বরিত গিয়ে শাড়ি পাল্টে বিছানায় শুয়ে ঘুম দেবে৷ কঠিন ঘুম৷ যদি ঘুম না আসে তবে অভিনয় করবে ঘুমের।
ভীষণ ভয় লাগছে। অস্থিরতায় শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। এ কী নাজেহাল অবস্থা হচ্ছে তার? না না সে এই লোকটাকে সামলাতে পারবে না৷ এরচেয়ে পালানোই শ্রেয়। নিজের মনের সঙ্গে বোঝাশোনা করে যেই না এক পা পিছিয়েছে অমনি তার শাড়ির আঁচল টেনে ওকে পুরোটাই নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল সৌধ। এরপর অতি কৌশলে ওর দেহশ্রী পাঁজা কোলে তুলে নেশাভরা গলায় বলল,

‘ কী হচ্ছিল? সব তো বুঝেই ফেলেছ রাইট? তবে কেন পালানো হচ্ছে? ‘

লজ্জায় ভয়ে মূর্ছা ধরার উপক্রম সিমরান৷ সৌধ মিটিমিটি হাসল। আজ লজ্জা না ভাঙালে এ জীবনে আর তাদের মধ্যে স্বামী, স্ত্রীর সহজ, স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠবে না। তাছাড়া ক’দিন বাদে পাড়ি দেবে দূরান্তে। আর কতকাল নিজেকে আঁটকে রাখবে? আর কতকালই বা অপেক্ষা করাবে মেয়েটাকে। এখন যতই ভয় পাক, লজ্জিত হোক। দিনশেষে ঠিকি খুশি হবে। সে যদি এই লজ্জা, ভয় কে কেয়ার করে পিছিয়ে যায়, কাল সকালে ওঠে আফসোস করতেও ভুলবে না। আর কোনো আফসোস, অভিমান নয়৷ এবার শুধু প্রণয় আর পরিণয়ের পালা।

ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে শাড়িতে লাগানো পিন গুলো খুলতে বেগ পেতে হলো সৌধর। ভরাট কন্ঠে একবার বললও,

‘ সব সময় পাকামি, বলেছিলাম পিন গুলো খুলতে। ‘

তীব্র অনুভূতিতে লুটোপুটি দু’টো হৃদয়। এমতাবস্থায় শাড়ির পিন খুলতে গিয়ে মেজাজি খারাপ করল৷ তবু রয়েসয়ে অবশেষে সক্ষম হলো।নিস্তব্ধ রাত আর বদ্ধ ঘর। গভীর প্রণয়াস্পর্শে সিক্ত স্বামী, স্ত্রী। প্রথমবার পুরুষালি দেহের উত্তাপ ধারণে অবস্থা শোচনীয় সিমরানের। সৌধর অতি যত্নময় স্পর্শ গুলোতে ভূবন ভুলানো যন্ত্রণার পাশাপাশি সুখানুভূতিতেও সিক্ত হয়ে রইল। মেয়েদের শরীর প্রকৃতিগত ভাবেই পুরুষদের তুলনায় নরম হয়৷ এটাই জানত সৌধ৷ তাই বলে সিমরান এত বেশি নরম? থেকে থেকে ভয়ও কাজ করছিল বেচারার। দু ধাপ পেছালেও সাহস করে এগিয়েছে এক ধাপ।

প্রথম ঘনিষ্ঠ হওয়ার রাতটা পেরিয়ে গেল। এঁটে দিল কিঞ্চিৎ যন্ত্রণা আর সীমাহীন সুখ। চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শুনতে পেয়ে চোখ খুলল সৌধ। ত্বরিত বিছানা ছেড়ে শাওয়ার নিয়ে নিল সে। এরপর এসে ঘুমন্ত সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে শুরু করল। ঘুম ভাঙলেও সিমরান ওঠল না। সৌধ বুঝতে পারে ওর অবস্থা। তাই কোনোকিছু না ভেবে এলোমেলো বেডশিট সহ সিমরানকে মুড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। বলে,

‘ গোসল সেরে নাও। ভালো লাগবে। তারপর ঘুমিও।’

সিমরানকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে সে ঝটপট নতুন বেডশিট পাতে৷ গোসল সেরে শুধু একটা টিশার্ট আর প্লাজো পরে বেরিয়ে আসে সিমরান। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার৷ দুর্বলতায় চোখে দেখছে না একদম। সৌধ ঠোঁট টিপে হেসে কাছে গিয়ে ধরে আনল ওকে। বিছানার কাছে আনতেই ও বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজল। তক্ষুনি সৌধর চোখ পড়ল ওর বাম হাতে৷ সাদা রঙের নেইলপালিশ দেয়া নখ গুলোতে। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড়ো। নখ গুলো দেখে নিজের দেহের অনেকাংশে জ্বলন অনুভব করল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ একটু স্বাভাবিক হও এরপর এই পাঁচ আঙুলের ব্লেড গুলোকে শায়েস্তা করব। ‘
.
.
.
গুটিগুটি পায়ে কিছুদিন কেটে গেল। চারদিন পর সৌধ, সুহাসের ফ্লাইট। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত সময়টা ঘনিয়ে এলো। সুহাসের বুকের ভেতরটাও ছলকে উঠতে শুরু করল সময়ে, অসময়ে৷ এরই মধ্যে গোপন একটি বিষয় কব্জা করেছে সুহাস। তার এত বছরের জীবনে এ প্রথম বোধহয় একটি জ্ঞানমূলক কাজ করেছে। সেটি হলো, সে টের পেয়ে গেছে নামীর সঙ্গে এখন তার বাবার যোগাযোগ আছে! পূর্বে ছিল কিনা জানে না৷ তবে গত একমাস ধরে বাবার কিছু সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডেই সে ধরে ফেলেছে সব। শুধু তাই নয় বিষয়টা নিয়ে একদিন সরাসরি বাবাকে চেপে ধরেছিল। সোহান খন্দকার স্বীকার করেনি। শেষ পর্যায়ে বদ্ধ পাগলের মতো বাবার দু পা আঁকড়ে ধরে। হাউমাউ করে কান্না করে ভিক্ষা চায় বউ, বাচ্চাকে। তখন একটু নরম হয় মানুষটা। তবে কিছু চাপা রাগ আর অভিমান থেকে বলে,

‘ নামীর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে ঠিক। তবে সে যোগাযোগ পুত্রবধূ হিসেবে হয়নি৷ হয়েছে প্রাক্তন আর প্রিয় বন্ধুর মেয়ে হিসেবে। সুহাস, তুই যদি পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে থাকিস। আমার যোগ্য ছেলে আর নামীর যোগ্য স্বামী হয়ে থাকিস আর ওই নিষ্পাপ শিশুর জন্মদাতা হয়ে থাকিস। তাহলে নিজ ক্ষমতা, যোগ্যতা দিয়ে বউ বাচ্চাকে ঘরে নিয়ে আসবি। মনে রাখিস, এটা শুধু তোর বাবার উপদেশ নয়৷ ওই অসহায় মেয়েটার রাগ, জেদ, তীব্র অভিমানের ঊর্ধ্বে গিয়েও সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা। ‘

সেদিন সুহাস একদম স্থির হয়ে যায়। থমকানো সুরে শুধায়,

‘ ও কোথায় আছে? ‘

‘ আমি নিজেও জানি না৷ সুইজারল্যান্ড আছে এটুকুই জানি। বাকি কিছুই বলেনি। ‘

‘ বাচ্চাটা? ‘

‘ তাকে দেখতে চেয়েছিলাম। বলেছে দেখাবে। এরপর আর যোগাযোগ করেনি। শুধু জানি তুই এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছিস। আমার বংশধর। তোর অপকর্মের জন্য তার ওপর সব অধিকার হারিয়েছি আমরা৷ চোখের দেখা টুকুর জন্যও অবিরাম সাধনা করতে হচ্ছে। ‘

সুহাস আর কিছু বলার সাহস করেনি। বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তার একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে! আর কিছু ভাবতে পারেনি৷ নামীর কাছে পৌঁছাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিল শুধু। বাবা সত্যি বলেছে কি মিথ্যা বলেছে এসব নিয়ে ভাবেনি আর। তবে মনে জেদ চেপেছিল নিজের যোগ্যতা দেখানোর। তাছাড়া নিধির থেকে যতটুকু তথ্য পেয়েছে এতে নামীকে খুঁজে পেতে আহামরি কঠিন হবে না। তাছাড়া তার মন বলছে রাগ, জেদ অভিমান শেষে নামীও অপেক্ষা করছে। নামীর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে আত্মসম্মান রক্ষার্থে ক্ষণিকের জন্য তাকে আর তার বাচ্চাকে আলাদা করলেও চিরজীবনের মতো করতে পারবে না৷ এটুকু বিশ্বাস রইল সুহাসের মনে।
হয়তো কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। ভয়াবহ যুদ্ধে নামতে হবে। দিনশেষে নামীদামিকে জয় করার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত সুহাস।
.
.
এরপর কাঙ্ক্ষিত দিন এবং সময়টা এসে গেল। ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়ার পূর্বে কিছুক্ষণ একান্ত মুহুর্ত কাটাল সৌধ, সিমরান। বেরুবার পূর্বে সিমরানের হাতে একটি ধূসর রঙের ডায়ারি তুলে দিয়ে সৌধ বলল,

‘ সেদিন তোমার কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প কেন শুনিনি জানো? এটার জন্য। আমি যতদিন দূরে থাকব ততদিন এই ডায়ারিতে তোমার শুরু থেকে অনুভূতি গুলো নিংড়ে লিখবে। ফিরে এসে যেন পড়তে পারি। ‘

কান্না মিশ্রিত চোখ দু’টো হেসে ওঠে সিমরানের। তার বরের বুদ্ধি কতটা তীক্ষ্ণ। দূরে চলে যাচ্ছে তাতে কী? বউকে সারাক্ষণই নিজের জন্য ব্যস্ত রেখে যাওয়ার মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছে। এক টুকরো সুখানুভূতিতে ছেয়ে গেল হৃদয়। ডায়ারিটা হাতে নিয়ে দু’হাতে সৌধকে জড়িয়ে ধরে বুকের বা’পাশে গাঢ় করে চুমু এঁটে বলল,
‘ ভালোবাসি। ‘

সৌধর ওর সমস্ত মুখশ্রীতে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ সাবধানে থেকো বউপাখি। ‘

আর এক মুহুর্ত দেরি না করে চোখ বুঁজে ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল সৌধ। সিমরান ডাকল,

‘ হ্যালো ডক্টর? ‘

সৌধ ঘুরে তাকাল না। এত্ত বেশি খারাপ লাগছে। এত বেশি মায়ায় পড়ে গেছে। যে ঘুরে তাকালে আর যাওয়া হবে না৷ শুধু থেমে দাঁড়াল মাত্র। সিমরান স্মিত হেসে বলল,

‘ তোমার বউপাখি তোমায় ভীষণ মিস করবে। ‘

~ অতীত শেষ ~

| চলবে |
®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে