#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭১|
কেউ নতুন প্রণয়ানুভূতিতে সিক্ত৷ কেউ বিরহে নিবৃত্ত। সব ভুল চুকিয়ে কেউ ব্যস্ত সঠিক পথে চলতে। আবার কেউ পেশাগত ও সাংসারিক জটিলতার সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত৷ এমনই ভাবে কেটে গেল কয়েকটি মাস। আইয়াজ, ফারাহর জীবনে বহুমুখী সমস্যা এসেছে। আবার একটু সময় লাগলেও সক্ষম হয়েছে সমস্যা গুলোর সমাধান দিতে। দীর্ঘদিন তারা চেষ্টায় ছিল দু’জন মিলে একই হসপিটালে কর্মরত থাকার৷ অবশেষে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও ভিসা জটিলতার জন্য তাদের অ্যামেরিকায় যাওয়া আঁটকে ছিল। অবশেষে আইয়াজ, ফারাহ এবং সুহাস৷ তিনজনেরই ভিসা এসে গেছে। ওদের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও কেউ ঠিকঠাক খুশি হতে পারছে না৷ কারণ, হিসেবে অনুযায়ী নামীর ডেলিভারি হয়ে যাওয়ার কথা। আর বাচ্চার বয়স এখন দেড় থেকে দু’মাস। সহ্য হয়? কোনো বাবা পারে সহ্য করতে? পারে না। সুহাসও পারছে না৷ যদি শুধু আইয়াজ, ফারাহর ভিসা জটিলতা তৈরি হতো তাহলে সমস্যা ছিল না৷ ভিসা আঁটকে ছিল সুহাসেরও। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের বহু সংখ্যক মানুষও এই সমস্যার কবলে পড়েছিল। এবার সব ঝামেলা শেষ। বাকি যা করণীয় আছে তা সম্পন্ন হলেই নির্দিষ্ট সময়ে উড়াল দেবে তারা।
.
আইয়াজের বাসা ঢাকা মোহাম্মদ পুরে৷ গতকালই সে তার বউকে নিয়ে বাসায় এসেছে। তিনতলা বাড়ির পুরোটাই ভাড়া দেওয়া৷ শুধু দ্বিতীয় তলার তিনটা ফ্ল্যাট বাদে৷ দ্বিতীয় তলার সবচেয়ে বড়ো ফ্ল্যাটটাতেই ওর পরিবার থাকে৷ বাকি দু’টো ফ্ল্যাট ফাঁকা। কারণ ওগুলো তাদের দু’ভাইয়ের সংসার গুছানোর জন্য বাবার তরফ থেকে উপহার পেয়েছে। বড়ো ভাই প্রবাসী৷ তাই তার বউ আর সন্তান শশুর, শাশুড়ির সাথেই থাকে। ছোটো বোনকে বিয়ে দিয়েছে বনেদি পরিবারে। বাবার বাড়িতে আসার সময় হয়ে ওঠে না তার৷ আর রইল সে আর ফারাহ। তারা দু’জন পেশাগত কারণে নিজ বাসা ছেড়ে দূরে থাকে।
রাত প্রায় এগারোটা। রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের ব্যাগপ্যাক গুছানো শুরু করে দিয়েছে আইয়াজ। ফারাহ ডাইনিং রুমে শাশুড়ির সঙ্গে বসে আছে চুপচাপ। আইয়াজের মায়ের নাম রমেছা বেগম৷ অল্প শিক্ষিত হলেও বুদ্ধি ধারালো। ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে এ নিয়ে তার আপত্তি নেই। কারণ বাকি দুই ছেলে মেয়েও একই পথের পথিক৷ কিন্তু আইয়াজ একা একা বিয়ে করে নিয়েছে বাবা-মা হীন এক এতিম মেয়েকে। এই নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তুষ্টি না জানালেও ভেতরে ভেতরে পীড়িত হয়েছে। সেই পীড়ন ভাব গাঢ় হচ্ছে ছোটো ছেলের ঘরে এখনো সন্তানাদি আসছে না বলে৷ বাড়ির বউ চাকরি করুক চায় না রমেছা বেগম। তার সংসারে কীসের অভাব যে ছেলে বউদের চাকরি করতে হবে? বড়ো বউ নিয়ে চিন্তা নেই। একদম ঘরকুনো, সংসারী মেয়ে। যত চিন্তা এই ছোটো বউ নিয়ে৷ মেয়ে মানুষ এমন বাইর মুখী হলে সংসার চলে? স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু ছেলে বউ ডাক্তারনি হবে। এমন স্বপ্ন তো সে কখনো দেখেনি। যাক গে এসব পুরোনো কথা, মলিন ব্যথা। আজ রমেছা বেগমের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। ছেলে বউকে নিয়ে অ্যামেরিকায় ঘুরতে যাবে শুনে। ছোটো থেকেই এই ছেলেটা তার ভীষণ বোকা৷ যা জ্ঞান ওই পড়াশোনাতেই৷ নারী লোকের ছল বিষয়ে একেবারে মূর্খ। তা না হলে কি আর এমন মেয়ে বিয়ে করে? গায়ে সাদা চামড়া আর পড়াশোনা করে ডাক্তার হলেই তো কোনো মেয়ে তাদের পরিবারের যোগ্য হয়ে যায় না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমেছা। পাশে বসা ফারাহর দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যাবড্যাব করে। শুরু থেকেই ফারাহর ভারিক্কি শরীর তার পছন্দ নয়। এখন এই মোটা স্বাস্থ্যই চক্ষুশূল হয়েছে। তার ধারণা অতিরিক্ত স্বাস্থ্যের কারণে পেটে তেল ধরেছে ফারাহ। এজন্যই বাচ্চা ধরে না৷ তাই প্রথমে যে কথাটা বলল তা হলো,
‘ ফারা, খাবারদাবার হিসেব কইরে খাইয়ো৷ দিনদিন চেহারার কী হাল হইতাছে দেখছ? আর কয়দিন পর তো আমার ছেলের ডাবল হইয়া যাবা। হিমারে দেখো এক পোলার মাও হইয়াও ফিনফিনা দেহ। ‘
হিমা ফারাহর জা৷ শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে তীব্র লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল মেয়েটার৷ শঙ্কিত হলো, এসব কথা আবার আইয়াজ না শুনে ফেলে৷ আইয়াজের কাছে মা ফেরেশতার মতো। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ি মায়ের অনেক তীক্ষ্ণ কথার শিকার সে। শশুর বাড়ি সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা আছে বলে এসব মালুম করে না। এতিম মেয়ে। বোনের সংসারে কাটিয়েছে দীর্ঘকাল। তাই পূর্বের তুলনায় এটা তার কাছে খুবই নগণ্য। নিজের বোন, বান্ধবী নামী সবার শাশুড়ি সম্পর্কেই টুকিটাকি জানা আছে৷ তাই নিজের শাশুড়ির এহেন আচরণে খুব একটা কষ্ট পায় না৷ এই মানুষটা তার প্রিয় স্বামী, ভালোবাসার মানুষ আইয়াজের জন্মদাত্রী। এতেই যেন তার সাতখু ন মাফ করে দেয় সে৷ চারপাশে সচেতনতার দৃষ্টি বুলিয়ে স্মিত হাসে ফারাহ৷ মৃদু স্বরে শাশুড়িকে বলে,
‘ জি মা, ভাবছি ডায়েট করব। ‘
এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে রমেছা বেগম বলল,
‘ কয়দিন ছুটি কাটাবা দুইজন মিলা বাসাতেই কাটাইতা৷ বিদেশ যাওন লাগব ক্যান বুঝি না৷ বাচ্চা, কাচ্চা হইতাছে না ঘরে বসে আল্লাহরে ডাকবা। দুইজন তার দরবারে হাত তুইলা কান্নাকাটি করবা৷ তা না যাইতাছ আমেরিকাত৷ ‘
ফারাহ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। বলল না কিছুই৷ রমেছা বেগম নিজে থেকেই বকবক করল। হতাশার সুরে বলল,
‘ শুনো, জামাই বউ মিলা চাকরি করার কী দরকার? লাভটা কী আমারে বুঝাও৷ হইছ তো শিশু বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তোমারি একটা শিশু নাই৷ লাভ আছে কোনো? আর হিমারে দেখো। উচ্চ মাধ্যমিক পইড়া পড়ার ক্ষ্যান্ত দিছে। স্বামী সন্তান নিয়া তার সুখের সংসার৷ ‘
এবারেও হাসি উপহার দিল ফারাহ৷ ভেতরে কতখানি যন্ত্রণা হলো, হৃদয় কতটুকু ছিন্নভিন্ন হলো বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। শাশুড়ি মায়ের মুখ চলতেই থাকল,
‘ শুনলাম দুইজন এখন এক সাথেই থাকবা। ঘুইরা আসো দোয়া করি আল্লাহর রহমতে শিগগিরই কোল ভরুক। ‘
এ পর্যায়ে একটু স্বস্তি পেল ফারাহ। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাশুড়ির দিকে। রমেছা বেগম সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আপন মনেই বলল,
‘ আমার কথা শুইনা রাগ হইয়ো না। ভালার জন্যই বলতাছি৷ এখন তো ভেজাল নাই৷ একটা, দুইটা হোক তখন বুঝবা চাকরি করন কী কঠিন৷ একসাথে সব সামলানো যায় না। আমিও তো অনেক ভালো স্টুডেন্ট আছিলাম। পড়তে কি পারছি? বিরাট বড়ো সংসার৷ স্বামী, শশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর আবার তিনটা পোলাপান। এই ভীড়ে মেট্রিকেই পড়া ক্ষ্যান্ত দিছি৷ তোমারো ভেজাল বাড়ুক তুমিও বুঝবা৷ যাও ঘরে যাও। বিদেশ যাবা, ঘুরবা ফিরবা গোছগাছ করো গা। ‘
কথা শেষ করে উঠে পড়ল রমেছা বেগম। ফারাহ কিয়ৎক্ষণ চুপ করে বসে থেকে গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে নিয়ে ঘরে চলে এলো৷ এসে দেখল, আইয়াজ নিজের কাপড় গুছিয়ে এখন তার জামা-কাপড় গোছাচ্ছে। সে কোনোকিছু না ভেবে আইয়াজের কাছে গিয়ে পাশে বসে বলল,
‘ কাল থেকে আমি ডায়েট করব আয়াজ। ‘
জামা ভাঁজ করছিল আইয়াজ হঠাৎ ফারাহর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আবার ডায়েটের ভূত চাপল মাথায়? তোমাকে বলেছি না আমার এই তুমিটাকেই পারফেক্ট লাগে। তুমি সারাদিন পেট ভরে, মন ভরে খেয়ে যেমন থাকবে আমার এমনটাই চাই। এটাই আমার সুখ শান্তি। ‘
মুখ ঘুরিয়ে রইল ফারাহ। সে জানে তাকে নিয়ে তার আইয়াজের একবিন্দু সমস্যাও নেই৷ তবু শাশুড়ির কথা শুনে তীব্র খারাপ লাগা আর অভিমান থেকেই এসব বলছে। আইয়াজ ফের কাজে মন দিলে সে আবারো বলল,
‘ কেমন ডাক্তার আমি? কীসের চাইল্ড স্পেশালিস্ট, যার নিজেরই একটা চাইল্ড নেই। ‘
সহসা হাত থেমে গেল আইয়াজের। স্তব্ধ মুখে তাকাল ফারাহর দিকে। ত্বরিত জামাকাপড় গুলো এক সাইটে রেখে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল বউকে। চোখে চোখ রেখে নরম গলায় শুধাল,
‘ কার মুখের কথা এগুলো? ‘
কণ্ঠ নরম হলেও চোখ দু’টো দৃঢ়। ফারাহ ত্বরিত নিজেকে সামলে নিল। ঢোক গিলে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আসলে আমারি খারাপ লাগছিল। তাই পাগলামি করছি। ‘
‘ তুমি মিথ্যা বলতে পারো না ফারাহ। সত্যি বলো।’
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আকস্মিক আইয়াজকে জড়িয়ে ধরল ফারাহ। শক্ত করে। সে চায় না যে মাকে আইয়াজ ফেরেশতা ভেবে ভক্তি করে। বউয়ের জন্য সে মা সম্পর্কে তার নেতিবাচক ধারণা হোক। তাই স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে৷ আর বুঝালো সে নিজের আবেগ থেকে এসব বলছে। তীব্র খারাপ লাগা থেকেই তার বুকে আশ্রয় নিয়ে কাঁদছে। ব্যস আর কিছুই না। কিন্তু আইয়াজ বিশ্বাস করল না। ভালোবাসে তো এই নরম মনের মেয়েটাকে। এই মেয়েটার শরীরে শিরা, উপশিরা থেকে শুরু সমস্ত কিছু ওর চেনা। তাই এক মুহুর্ত স্তম্ভিত মুখে বসে রইল৷ বুকের গভীরে সুক্ষ্ম এক ব্যথা অনুভব করল। অর্ধাঙ্গিনীর যন্ত্রণায় সেও কাতর হয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ।
.
.
আগামী মাসের দশ তারিখ ফ্লাইট ওদের৷ তিন বন্ধুর যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। সৌধ ছুটি নেয়ার তোরজোর করছে। এমতাবস্থায় একদিন ভোরবেলা নিধির কল পেল সৌধ। জানতে পারল, নামী তাকে মেইল করেছে! জানিয়েছে, নেক্সট মন্থে সে তার বাচ্চাকে নিয়ে দীর্ঘ কিছু মাসের জন্য সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। নিধির ফোনকল পেয়ে নামী সম্পর্কে এসব শুনে মাথা হ্যাং হয়ে যায় সৌধর। এ কোন খেলা খেলছে নামী? এ কোন লীলায় জড়িয়ে পড়ছে সুহাস? ভাগ্য কোনদিকে মোড় নেবে? সুহাস, নামীর ভবিষ্যত কী? আর নিষ্পাপ ওই বাচ্চাটা? আর কিছু ভাবতে পারে না সৌধ। তীব্র উত্তেজিত হয়ে কল করে আইয়াজকে। বলে,
‘ সুহাসের অ্যামেরিকায় যাওয়া হচ্ছে না দোস্ত। ওকে সুইজারল্যান্ড যেতে হবে। তুই আর ফারাহই যা অ্যামেরিকায়। ‘
‘ হোয়াট! কী বলছিস? ‘
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আইয়াজ। সৌধ পুরো বিষয়টা খুলে বলে ওকে। মস্তিষ্ক স্থির হয়ে যায় আইয়াজেরও৷ এসব কী হচ্ছে! দাঁড়ানো ছেলেটা বসে পড়ে। এরপর সৌধ ফোন কেটে কল করে সিমরানকে। এদিকে আইয়াজের মুখে সবটা শুনে ঘামতে শুরু করে ফারাহ। এত স্ট্রাগল, জল্পনা কল্পনা শেষে ফলাফল দেখে মাথা ঘুরে যায় ওরও। ভেবে পায় না নামী এতটা পাষণ্ডতা কেন করছে? অতিরিক্ত দুঃশ্চিতায় শ্বাসনালি আঁটকে যায় ফারাহর। নিমেষে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে বিছানার কোণায়। ভাগ্যিস আইয়াজ খেয়াল করে তৎক্ষনাৎ আগলে ধরেছে। নয়তো এক্ষুনি বিপদ ঘটত। ফ্লোরে পড়ে আঘাত পেত খুব৷
‘ ফারাহ, এই ফারাহ, চোখ খুলো, ফারাহ! ‘
অকস্মাৎ ফারাহ জ্ঞান হারাতে ঘাবড়ে গেল আইয়াজ। গলা উঁচু করে ডাকতে লাগল, মা আর ভাবিকে।
.
.
মাস পেরুতে পেরুতে বছরটা ঘুরে গেল৷ সুহাস অ্যামেরিকায় যায়নি৷ যায়নি আইয়াজ, ফারাহও৷ অদৃষ্টের চমৎকার পালাবদল ঘটেছে৷ ফারাহ এখন সন্তান সম্ভবা। বর্তমানে তার গর্ভাবস্থার চার মাস চলছে৷ সেদিন নামীর সুইজারল্যান্ড চলে যাবার খবর আর নিজের গর্ভে আইয়াজের সন্তানের অস্তিত্ব আছে জানার পর তারা আর অ্যামেরিকায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি৷ কিন্তু সৌধ আর সুহাস প্রস্তুতি নিচ্ছে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার। ইতিমধ্যে তারা খবর পেয়েছে নামীর সঙ্গে তার সৎ মা আর বাবার সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের দুই জমজ ছেলের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই অবহেলা করেছে মেয়েকে৷ সেই অভিমানেই নামী বাবার ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সরাসরি ওরা কেউ জানতে পারেনি৷ নিধিকে পাঠানো নামীর মেইল পড়ে এতটুকু আন্দাজ করেছে ওরা৷ নামীর মতো মেয়েদের জীবনে ভালোবাসা ঠিক পান করা পানির মতো। যে পানিতে এক বিন্দু ময়লা পড়ে থাকে সে পানি কি আমরা পান করি? করি না। মানুষ যেমন পরিষ্কার, স্বচ্ছ পানি পান করে জীবন বাঁচায় ঠিক তেমনি তারা ভালোবাসাতেও স্বচ্ছতা চায়৷ নামী মেয়েটা ভালোবাসার কাঙালিনী। তাই বলে ভেজাল যুক্ত ভালোবাসা সে গ্রহণ করতে পারে না৷ পানি এবং ভালোবাসা দু’টোর ক্ষেত্রেই সে মারাত্মক সেনসেটিভ। পর্যাপ্ত সম্মান বিহীন সে যেমন ভালোবাসা মেনে নিতে পারে না। ঠিক তেমনি অস্বচ্ছ ভালোবাসাও সহ্য করতে পারে না৷ কথায় বলে না অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায়? নামীর জীবনটা বুঝি এমনই হয়ে গেল।
.
.
বিয়ের পর অনেক গুলো মাস পেরিয়ে গেছে। বিস্তর পরিবর্তন এসেছে সিমরানের জীবনে। সৌধর সঙ্গে একটি মিষ্টি সম্পর্ক, পড়াশোনা, টুকিটাকি সংসার, শাশুড়ির অগাধ স্নেহ আর দাদুনির অকারণ অল্পস্বল্প ক্ষোভ। ওদিকে আবার ভাই, ভাবিকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা।
সব মিলিয়ে তার জীবনটা ঠিক টক, ঝাল, মিষ্টিত্বে ভরপুর। বাপের বাড়ি ছিল সে। হঠাৎ ফোন পেল সৌধর। শুনতে পেল তার শীতল কণ্ঠস্বর,
‘ সিনু, পরশু বাড়ি ফিরছি। তুই বিকেলেই চলে যা৷ ‘
নিমেষে বুক ধক করে ওঠে সিমরানের। ইদানীং যে তার পাশাপাশি সৌধও মিস করা নামক শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে টের পায় সে৷ তাকে মিস করে মানুষটা৷ এইতো ক’দিন আগে এসে ভিসার আবদেন করে গেল। আবার এত তাড়াতাড়ি কেন আসছে? অজান্তেই নেচে ওঠে মন৷ আবার আকস্মিক মনে পড়ে যায় কাঙ্ক্ষিত একটি দিনের কথা। গত বছর এই দিনেই তো সে পার্বতী হতে হতেও হয়নি। আর সৌধ ভাই হয়নি দেবদাস৷ হৃৎস্পন্দন দ্রুত চলতে শুরু করে। সে বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি চলে আসে৷ রাত পেরিয়ে একটা দিন একটা রাত কেটে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়। সারারাত কাটে নির্ঘুমে। বিছানায় ছটফট করে। ভোরের দিকে চোখ লেগে এলেই আকস্মিক কর্ণে বেজে ওঠে দরজার ঠকঠক শব্দ। তড়াক করে ওঠে বসে সিমরান। একছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই ক্লান্ত মুখে দাঁড়ানো সৌধকে দেখতে পায়৷ তার ঘুম জড়ানো চোখ আর ভোরের স্নিগ্ধ শীতলতায় টকটকে হয়ে থাকা ঠোঁটের পানে তাকিয়ে সৌধ মিটিমিটি হাসে। গাঢ় স্বরে বলে,
‘ গুড মর্নিং ডিয়ার। ‘
নিমেষে সরে দাঁড়ায় সিমরান৷ গলা ভিজিয়ে উত্তর করে,
‘ গুড মর্নিং। ‘
সৌধ খেয়াল করল ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে সিমরান। নিজের ভেতরে চলা উত্তেজনাটুকু লুকানোর চেষ্টা করেও লুকাতে পারছে না৷ ধরা পড়ে গেল। মনে মনে প্রচণ্ড হাসল সৌধ। এগিয়ে গিয়ে হাতের ব্যাগটা রেখে ফের সিমরানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত ডুবিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে। সিমরান কিছু বলতে উদ্যত হবে তার আগেই সে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গভীর গলায় বলল,
‘ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শার্টটা খুলে দিবি? ‘
চমকে ওঠে সিমরান৷ তীব্র মায়া হয়৷ ভাবে আহারে লম্বা জার্নি করে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার বরটার। তাই হাত বাড়িয়ে শার্টের বোতাম স্পর্শ করতেই আচমকা বুকে ধুকপুক শুরু হয়৷ ফিরিয়ে নেয় হাত দু’টো। এতে সৌধর গাঢ় চোখদ্বয় আরো বেশি গাঢ় হয়৷ লজ্জায় গাল দু’টো রক্তাভ হয়ে ওঠে সিমরানের। নিঃশ্বাস হয় ভারিক্কি। ইতস্তত করতে করতে আবারো হাত বাড়িয়ে বোতামে স্পর্শ করে৷ এক পা এগিয়ে একদম কাছাকাছি দাঁড়ায়। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সৌধ। যার পুরোটায় ছড়িয়ে পড়ে সিমরানের মুখশ্রীতে। সে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধ মুখের তরুণীটির পানে। দু’টো বোতাম খুলতেই সিমরানের হাত, পায়ে কম্পণ ধরে যায়। ঠোঁট দু’টো আপনাআপনি কাঁপতে শুরু করে। সৌধর মুখের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, উষ্ণ, শুভ্র বলিষ্ঠ বুকের কুচকুচে লোম গুলো ওর সমস্ত শিরা, উপশিরায় হিম ধরিয়ে দেয়। ভীষণ নাজেহাল হয়ে অবশেষে সবকটা বোতাম খুলতে সক্ষম হয়। গা থেকে পুরোপুরি শার্ট ছাড়াতে সাহায্য করে সৌধ নিজেই। সিমরান সেটা নিয়ে বাথরুমে জমিয়ে রাখা কাপড় গুলোর সঙ্গে রেখে আসে। এরপর দেখতে পায় শরীরে থাকা স্যান্ডো গেঞ্জিটাও খুলে ফেলেছে সৌধ ভাই। নিমেষে চোখ সরিয়ে নেয়। বলিষ্ঠ বুকটা দেখে এত বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে যে নড়ার শক্তিটুকুও পায় না। সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি সৌধ ভাই এসেছে? নিশ্চিত হতে নিজের বা’হাতে চিমটি কাটে। ব্যথা পেতেই ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ চৌকা হয়ে যায়৷ সৌধ খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। হুঁশ ফেরে সিমরানের। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ সত্যিই তো সৌধ ভাই এসেছে। ঢোক গিলে ত্বরিত। ধড়ফড় করা বুকে এসে কাঁপা স্বরে বলে,
‘ সৌধ..’
ভাই টুকু বলার আগেই ওর ঠোঁটে তর্জনী চেপে ধরে সৌধ। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ভারী গলায় বলে,
‘ ডোন্ট কল ব্রো। ‘
স্তব্ধিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিমরান। সৌধ কথাটা বলেই তর্জনী সরায়। দু’হাত বাড়িয়ে চনমনে কণ্ঠে বলে,
‘ জাস্ট হাগ…। ‘
সৌধ কথাটা বললেও সিমরান জড়িয়ে ধরল না তাকে৷ বরং চিন্তায় পড়ে গেল ভীষণ। বিয়ের পর তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা হয়নি তেমন। এক বিছানায় থাকার সুবাধে যতটুকু কাছাকাছি গেছে ততটুকুকে ঘনিষ্ঠতা বলে না। ঘুমের ঘোরে বহুবার সে সৌধ ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে৷ বিনিময়ে অবহেলা পায়নি৷ সৌধ ভাই ঠিক প্রশ্রয় দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। বুকে আগলে ধরে ঘুমিয়েছে। সেটাতে আলাদা কোনো চাওয়া, পাওয়া ছিল না। তবে আজ কেন অন্যরকম লাগছে? এই সুগভীর চোখ দু’টো যেন অন্য সুরে তাকাচ্ছে আজ। এই যে হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে তারও অন্যরকম চাহিদা৷ ওই প্রশস্ত বুকটাও যেন অন্যরকম আলিঙ্গনে ডাকছে। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর দেহশ্রী। ঠিক কয়েক সেকেণ্ড ব্যবধানে সহসা সৌধ নিজেই ওকে টেনে ধরে বুকের ভেতর ভরে নেয়। উষ্ণ আলিঙ্গনে ডুবিয়ে রাখে দীর্ঘক্ষণ। দরজা খোলা আছে সেদিকে ওদের কারোরি হুঁশ নেই। সিমরান চোখ বুঁজে অনুভব করতে ব্যস্ত তার প্রণয় পুরুষটার বুকের বা’পাশের ধুকপুক শব্দ। আর সৌধ বিভোর অর্ধাঙ্গিনীকে গভীর আলিঙ্গনে…।
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭২|
উত্তরে হাওয়া নিয়ে আসছে শীতকাল৷ প্রকৃতি জুড়ে হিমহিম ঠান্ডা গায়ে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। সেই শিহরণ আজ দ্বিগুণ হলো, প্রণয় পুরুষটির প্রগাঢ় আর উষ্ণ আলিঙ্গনে। যে আলিঙ্গনে অন্তঃকরণ শত সহস্রবার প্রার্থনা করে, সময়টা থেমে যাক। এই নিরাপদ বুকটায় কেটে যাক যুগের পর যুগ। শেষতক এই বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিদায় নিক পৃথিবী ছেড়ে। প্রশান্তির ঘুম ঘুমাক চিরতরে। আজ যেন দু’টো শরীর, দু’টো হৃদয় এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে৷ এক উষ্ণ অনুভূতিতে শিহরিত হচ্ছে দু’জন। একে অপরকে অনুভব করছে নিখুঁতভাবে৷ সৌধর বুকে একদম মিলিয়ে আছে মেয়েটা৷ ছোট্ট দেহশ্রীটুকু বিড়ালছানার মতো ঘাপটি মেরে আছে। এদিকে রোজকার নিয়মে তাহানী আসছে তার ভাবিপাকে ডাকতে। বিয়ের আগে সিমরানকে আপু, আপাই ডাকত তাহানী। তাই বিয়ের পর ভাই বউ হওয়ার সুবাদে ভাবি, আপা মিলিয়ে ভাবিপা ডাকে।
সিমরান মেয়েটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। সৌধ যখন কাছে থাকে তখন সৌধর আদুরে ডাকেই তার ভোরবেলা ঘুম ছুটে যায়৷ আর দূরে থাকলে নিয়ম করে ভোরবেলা ওঠতে পারে না। তার এই ব্যাধি সারাতেই সৌধ সাত বছরের তাহানীকে একদম রায় বাঘিনী ননদিনী হতে আদেশ করে। যত ভালোবাসাই থাকুক তার ভাবিপার প্রতি। কোনোক্রমেই যেন বেলা করে ঘুমাতে না দেয়। চৌধুরী বাড়িতে সবাই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে৷ বেলা করে ঘুমানোর স্বভাব এক ঝুমায়না ভাবিরই আছে৷ ছোট্ট তাহানীকেও তার বাবা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠতে শিখিয়েছে। বাবা যখন বাড়িতে থাকে তার সঙ্গে রোজ সকালে হাঁটতে বেরোয় সে। আর ব্যবসায়ীক কাজে বাবা ঢাকা চলে গেলে বড়ো মার সঙ্গেই সময় কাটায়। সৌধ তার পরিবারের সকলের গতিবিধি সম্পর্কে জানে৷ তাই তাহানীকেই বেছে নেয় সিমরানের প্রভাতের সঙ্গী হিসেবে। ছোটো ভাইয়ার আদেশ অনুযায়ী তাহানীও রোজ চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে, দরজা ধাক্কিয়ে ভাবিপাকে জাগিয়ে তুলে। এরপর ওরা ছাদে গিয়ে শরীর চর্চা করে বা বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, ফুল তুলে। কখনো কখনো সৌধ ওদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে সঙ্গও দেয়। নিয়ম মেনে আজো তাহানী ডাকতে এলো। এসে দরজা খোলা দেখে খুশি হলো ভীষণ। ভাবল, ‘ বাহ আজ তো ভাবিপা গুড গার্ল হয়ে গেছে।’ এসব ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে যেই না ঘরে ঢুকল বুকের ভেতর অল্পখানি ভয়ে ছ্যাঁত করে ওঠে। আকস্মিক দু’হাতে চোখ দু’টো ঢেকে ভয়ে ভয়ে বলে,
‘ সরি সরি, আমি জানতাম না, ট্রাস্ট মি। ‘
মিহি, ভীত স্বরটি কর্ণে পৌঁছাতেই একে অপরের থেকে ছিটকে সরে যায় সৌধ, সিমরান। তীব্র লজ্জায় সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে সিমরানের। গাল দু’টো হয়ে যায় রক্তাভ। তাহানী আর এক মুহুর্ত দেরি করে না। সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে ভাবতেই চোখ দু’টো টলমল হয়ে যায়। মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো সিঁড়ি বেয়ে বড়ো মায়ের ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোটোবেলা থেকে তাকে শেখানো হয়েছে কারো ঘরে গেলে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে যাবে। সাত বছর বয়স তার৷ বর্তমান জেনারেশনের বাচ্চারা অনেক বেশি স্মার্ট হয়। তাহানীর মাঝে সেই স্মার্টনেস পরিপূর্ণ ভাবে রয়েছে। এর পেছনে তার পরিবার এবং সুললের মতো কঠিন ব্যক্তিত্বধারী বাবার অবদান অপরিসীম। যে শিক্ষা তাকে দেয়া হয়েছে তাতে আজ যে ঘটনা ঘটে গেছে এই নিয়ে যেমন লজ্জিত তেমন ভীতও। স্মৃতি আপু তাকে বলেছিল, ‘ কারো ঘরে নক ছাড়া তো যাবেই না, ম্যারেড কাপলদের বেলায় আরো বেশি সতর্ক থাকবা। ‘ সে জানত ছোটো ভাইয়া আজ আসবে। তাই বলে এত সকালে এসে যাবে তা তো জানত না। ভাই, ভাবির ভালোবাসার সময় সে গিয়ে ডিস্টার্ব করল! ছোট্ট হৃদয়টুকু অস্বস্তি, লজ্জায় বিচলিত হয়ে রইল।
সিমরান লজ্জায় সেই যে মাথা নুইয়েছে আর তুলেনি। সৌধকে তেমন বিচলিত দেখাল না। সে শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে একহাত পকেটে গুঁজে দিল। এরপর অপর হাতে নিজের এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলল,
‘ সিনু সারারাত ঘুম হয়নি। আমি একটু ঘুমাব। তুই তাহানীর কাছে যা৷ ও ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। ভয়, লজ্জা দুটোই পেয়েছে। তুই গিয়ে ওকে স্বাভাবিক কর৷ বল, আমরা একটুও মাইন্ড করিনি। উই নো ইট’স আ স্মল মিস্টেক। ‘
.
.
সুজা এমপির বাড়িতে শুক্রবার মানেই আলাদা আমেজ৷ সেই আমেজে গাঢ় হয়ে ওঠল সুজা, সুলল দুই ভাই। সৌরভ, সৌধ দু’ভাই। আর সিমরান, ঝুমায়না দুই পুত্রবধূর উপস্থিতিতে। আজ তারা সবাই মিলে দুপুরের আহার একসঙ্গে গ্রহণ করবে৷ এত মানুষের ভীড়ে তাহানী মিস করছিল স্মৃতি আপুকে। যে বরের সাথে ফের কানাডায় পারি জমিয়েছে। রান্নাঘরে আজ এলাহি আয়োজন। কাজের মেয়েরা কা’টাকুটি, থালাবাসন ধোঁয়া এসবে ব্যস্ত। আর বউরা ব্যস্ত সুস্বাদু খাবার তৈরিতে। তাহানী ভিডিয়ো কলে তার স্মৃতি আপার সাথে গল্প করছে। পাশাপাশি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে আর বড়ো মা আর ভাবিপা মিলে কী দারুণ দারুণ রান্না করছে। দাদুনি ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছে আর ছোটো ছেলে সুললের বকুনি শুনছে৷ সুলল কাকু পান খাওয়া একদম পছন্দ করে না৷ তার ভাষ্যে পান খায় রুচিহীন মানুষেরা। এটা রুচির দুর্ভিক্ষ। ছেলে আর নাতিদের বেলায় দাদুনি যেন নতুন বউ৷ একদম মুখে কুলুপ এঁটে বকুনি খায়, জ্ঞান বাক্য শুনে৷ ঝুমায়না নীরব দর্শক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো দাদুনির কাছে এসে বসছে তো কখনো শাশুড়ি, জায়ের রান্নার ঘ্রাণ শুঁকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলে সুরের দুষ্টুমি গুলো ক্যামেরা বন্দি করে ফেসবুকে আপলোডও দিচ্ছে। এমন সময় আজান ধ্বনি শুনতে পেয়ে সিমরান তড়িঘড়ি করে উপরে ছুটল। সৌধ ভাইকে জাগিয়ে দিতে হবে এখন। বাবা, চাচা আর ভাইয়ের সঙ্গে নামাজে যাবে সে।
সৌধর ঘুম ছুটেছে আরো মিনিট, পাঁচেক আগে৷ ঘুমের ঘোরে আকস্মিক সিমরানের ফোনের রিংটোন শুনতে পায় সে। অমনি ত্বরিত ওঠে বসে ফোন হাতে নেয়৷ নাম্বার সেভ করা নেই বিধায় ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করে কানে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায় একটি পুরুষালী কণ্ঠের উত্তেজিত কিছু বাক্য,
‘ সিমরান! ফোন ধরছ না কেন? আরে বাবা আমি সরি বলেছি তো৷ আই এম এক্সট্রিমলি সরি ইয়ার। তুমি প্লিজ বিকেলে বেরোও। লুনা, দিলারা ওরাও বেরুবে। উদ্যানে আসো প্লিজ। কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু দাও। আমার আসলেই বোঝা উচিত ছিল, যে মেয়ে বিয়ের আগেই আমাকে একসেপ্ট করেনি সে বিয়ের পর কীভাবে করবে? তুমি ঠিক বলেছ বন্ধুত্বের মাঝে প্রেম শব্দটা আনাই মারাত্মক ভুল হয়েছে। ট্রাস্ট মি আমি তোমার বন্ধু হয়েই থাকব৷ প্রেম শব্দটা আনব না৷ তবু প্লিজ ব্লক লিস্ট থেকে আমার আইডি ছাড়াও। আমার নাম্বার গুলোও ব্ল্যাক লিস্ট থেকে মুক্ত করো। প্লিজ, প্লিজ। ‘
সদ্য ঘুম ভেঙে ছিল সৌধর৷ ঠিকঠাক মস্তিষ্ক সজাগ হতে না হতেই বউয়ের ফোন রিসিভ করে বসেছে৷ কিন্তু এমন একটা বিষয়ের সম্মুখীন হবে ভাবতেও পারেনি৷ সহসা মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ল ওর। বুকের ভেতর সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুভূতির সৃষ্টি হলো। এই অনুভূতিটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এক বালতি তীব্র গরম পানিতে কেউ মুখ ঠেশে ধরলে যেমন লাগে অমন নাকি সম্পূর্ণ অন্ধকার, বায়ু চলাচল ছাড়া গুমোট ঘরে বন্দি করে রাখলে যে অনুভূতি হয় তেমন বোধগম্য হলো না। তবে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে ভয়াবহ এক ক্রোধ। এই পৃথিবীতে কার এত স্পর্ধা? যে সৌধ চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনীকে প্রেম নিবেদন করবে। যে মেয়েটাকে এত যত্ন করে আগলে ধরে জীবনে জড়িয়েছে। যে মেয়েটাকে সম্পূর্ণ হালাল রূপে নিজের করে পেয়েছে। অথচ একবারটি গভীর করে ছুঁয়ে দেখেনি। তীব্র পৌরুষ চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য্য ধরে সময় গুনেছে। বিয়ের পর থেকে কত রাত সে না ঘুমিয়ে বিছানায় ছটফট করে কাটিয়েছে৷ পাশের মানুষটির থেকে সম্পূর্ণ আশকারা পেয়েও ভুলেও নিয়ন্ত্রণহারা হয়নি। তিলে তিলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি বুকের ভেতর গড়ে তুলেছে মেয়েটার জন্য প্রগাঢ় প্রণয়, দৃঢ় ভালোবাসার মহাসিন্ধু। যার জন্য জীবনের খেই হারিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে, শূন্য দু হাত আর শূন্য এক বুকে যে আকাশসম পূর্ণতা নিয়ে কাছে এসেছে। সেই তাকেই কিনা অন্য একটা পুরুষ প্রেম নিবেদন করেছে! চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল সৌধর। চোয়াল দু’টো দৃঢ় হতে হতে হাড় ফুলে ফেঁপে ওঠল। অত্যধিক ক্রোধে কান দু’টো গরম হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করল যেন। শ্বাসনালি আঁটকে রইল এক মুহুর্ত। ফোনের ওপাশে ছেলেটা বলেই যাচ্ছে,
‘ সিমরান, কথা বলছ না কেন? তুমি তো জানো হঠাৎ করে তোমার বিয়ের খবর শুনে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি। তাই পরবর্তী যা করেছি সব আবেগে পড়েই৷ কিন্তু তুমি আমাকে ব্লক করার পর আমার বিবেক জেগে ওঠেছে৷ প্লিজ ক্ষমা করো, আমাদের বন্ধুত্ব টুকু শেষ করে দিও না। ‘
আর নিতে পারল না সৌধ। বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে দাঁড়িয়ে কানে ফোন চেপে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘ স্ক’উন্ড্রেল, বাস্টা’র্ড তোর সাহস কী করে হয়? ‘
ক্রোধে জর্জরিত সৌধ উচ্চ কণ্ঠে এ পর্যন্ত বলতেই দরজার সামনে দাঁড়ানো সিমরান হতভম্ব হয়ে গেল। পায়ের গতি বাড়িয়ে ত্বরিত ঘরে ঢুকে বিচলিত কণ্ঠে বলল,
‘ কী হয়েছে সৌধ… ‘
ভাই টুকু উচ্চারণের পূর্বেই ফোন কানে ধরে ক্রোধে ভয়ানক রূপ ধরা সৌধ এমন করে তাকাল যে অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠল মেয়েটার৷ নিমেষে ঢোক গিলে স্তম্ভিত মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি ততক্ষণে ফোন কেটে বিপদের ভয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছে। সৌধ সিমরানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফোনের দিকে রাখল। নিজেকে শান্ত করতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগল ওর৷ এরপর বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল কতক্ষণ। সিমরান সরাসরি দৃষ্টি না দিয়ে আড়চোখে দেখল ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে সৌধ ভাই। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল ওর। মেরুদণ্ড দিয়ে বেয়ে গেল শীতল স্রোত। নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে দীর্ঘ সময় নিল সৌধ। এরপর ধীরেসুস্থে এসে দাঁড়াল সিমরানের মুখোমুখি। হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে ধরে চোয়াল কাঁপিয়ে দৃঢ় স্বরে শুধাল,
‘ নাম্বারটা কার? ‘
নাম্বারটা অচেনা। মন দিয়ে দেখল সিমরান৷ এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বুঝাল সে চিনে না। সৌধর দৃষ্টি কঠিন হলো। তপ্ত মেজাজে ধমকে বলল,
‘ কে বিরক্ত করে তোকে? ম্যারেড জেনেও কে তোকে প্রপোজাল দেয়? কতবার বলেছি এসব ছেলেমেয়ে সাথে মিশবি না। ‘
আকস্মিক বীভৎস ধমক খেয়ে কাঁধজোড়া কেঁপে ওঠে সিমরানের। নিমেষে ভোরের স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশের উষ্ণ আদরটুকু ভুলে গিয়ে একরাশ ভয় আর দুঃখে কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে। দমে যায় সৌধ। সরে যায় ওর সম্মুখ থেকে৷ তবে হাতে ধরিয়ে দেয় ফোনটা। সিমরান ফোন হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখে। ব্ল্যাক লিস্টে ঢুকে দেখতে পায় পরশের অগণিত ফোন আর ম্যাসেজ। তাহলে পরশই কল করেছিল? নিজের ক্রোধ টুকু সামলে নিয়েছে সৌধ৷ নিশ্চুপ বসে আছে বিছানায়। দু পা ফ্লোরে রাখা। হাঁটুতে কনুই ভর করে দু-হাত মুঠো করে কপালে মৃদু মৃদু ঘু ষি দিচ্ছে। সিমরানের বুক কাঁপতে শুরু করে। সৌধ ভাইকে পরশ কী বলেছে? ভুলভাল কিছু বলেনি তো? সৌধ ভাই তাকে ভুল বুঝল কী? সন্দেহ করল কী? এত রেগে গেছে কেন? কী বলেছে পরশ? না চাইতেও শব্দ করে কান্না চলে এলো মেয়েটার৷ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো সৌধর সামনে। এরপর ধপ করে বসে পড়ে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো। তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোনো পুরুষ আসেনি আর আসবেও না। ‘
সৌধর মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না৷ সিমরান যেন পাগলপ্রায় হয়ে গেল এবার। ওর সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল পরশের ওপর৷ পরশকে পড়ে দেখে নেবে। আপাতত বরকে শান্ত করা চাই। সৌধ ভাই নিজ মুখে স্বীকারোক্তি না দিলেও সে টের পেয়েছে মানুষটা ধীরেধীরে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালোবাসাটাও তৈরি হয়ে গেছে। এবার শুধু গভীর প্রণয়ে সিক্ত হবার পালা। এত ফাইট করে, সেক্রিফাইস করে অবশেষে মানুষটাকে আপন করে পেতে চলেছে সে। আর আজ কিনা সেখানে সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝি আসবে? তাও কিনা পরশের কারণে? নিমেষে ফুঁসে ওঠে সিমরান৷ ত্বরিত কল করে পরশের নাম্বারে। নাম্বার বন্ধ দেখায়। হতাশ হয় সে। অশ্রুসিক্ত চোখ আর অসহায় মুখে তাকায় স্বামীর পানে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
‘ সৌধ ভাই, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না৷ এত রেগে থেকো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘
অকস্মাৎ ভ্রু কুঁচকে তাকায় সৌধ। দেখতে পায় অশ্রুতে ভেজা লাল টকটকে মুখশ্রী। ঢোক গিলে ত্বরিত। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
‘ কেউ ডিস্টার্ব করলে আমাকে জানানো উচিত। ‘
‘ আসলে ও আমার বন্ধু ছিল। বন্ধু থেকে প্রেমিক হওয়ার আবদার করার পর থেকে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। আর সেদিন যখন আমি ম্যারেড জানার পরও পাগলামি করে এরপর থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিই। ‘
সৌধর চোখ দু’টো থমকে আছে৷ সিমরান সে চোখে তাকিয়ে ভাষা গুলো বুঝতে পারল না। বোঝার কথাও নয়। সৌধর মস্তিষ্ক জুড়ে যে আকস্মিক হানা দিয়েছে নিধি আর অর্পণ। সে যেন তার আর সিমরানের মাঝে আজ ওই দু’জনকে দেখে নিল। কিন্তু ওই ছেলেটার মাঝে সে নেই৷ কারণ নিধির প্রতি তীব্র অনুভূতি থাকার পরও সে অন্যের বউ জানার পর একবারো ভালোবাসার দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়নি, ফোন করেনি। বরং সব সময় চেয়েছে নিধি ভালো থাকুক। মন দিয়ে সংসার করুক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সৌধ। মনে প্রশ্ন জাগে আজ তার যে অনুভূতি হচ্ছে অর্পণেরও কি একই অনুভূতি হয়েছিল? নাহ তা কী করে হবে? সে তো কখনো ওদের জীবনে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। পরোক্ষণেই মনে পড়ল, ঝোঁকের বশে হলেও নিধি তো চেয়েছিল। একজন পুরুষের কাছে এটা কতখানি যন্ত্রণার সে আজ টের পেল। সিমরান অমন কিছু চায়নি। তাকে শুধু একটা ছেলে প্রপোজ করেছে ব্যস এতেই তার সবটা কেমন উথাল-পাতাল হয়ে যাচ্ছিল! স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌধ। সিমরানের চোখ গলে পানি পড়ছেই। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দু-চোখের পানি মুছে দিল সে। সিমরান ওর মন বুঝে ওঠে দাঁড়ালে সৌধ ওকে নিজের পাশে বসিয়ে শান্ত ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ নাম কী ছেলেটার? ‘
‘ পরশ। ‘
‘ থাকে কোথায়? ‘
সিমরান লোকেশন বলল ভয়ে ভয়ে। সৌধ ফের প্রশ্ন করল,
‘ কেমন বন্ধু?
ভীত হয় সিমরান৷ ক্ষীণ গলায় বলে,
‘ কী বলেছে পরশ? ‘
‘ ক্ষমা চেয়েছে। বিকেলে মিট করতে বলেছে।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সিমরান বলল,
‘ আমি মিট করব না। ওকে ক্ষমা করে দিলাম। পরেরবার যদি এমন ভুল করে তোমাকে জানাব। ‘
সৌধ শান্তি পেলো না। মনের ভেতর অদ্ভুত অশান্তি বিরাজ করতে লাগল। পরশ ছেলেটার খোঁজ নিতে হবে। এরপর যদি মনে হয় শায়েস্তা করা উচিত করবে নয়তো না। রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখল। এরপর সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ভয় পেয়েছিস? ‘
সিমরান ঠোঁট কামড়াল। সৌধ স্মিত হেসে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘ তোর তো খুশি হওয়া উচিত সিনু। আমি আজ নিজের প্রতি নিজেই অবাক হয়েছি। পাশাপাশি অনেক বড়ো দু’টো সত্যি অনুভব করেছি। প্রথম সত্যিটা আগামীকাল ভোরবেলা বলব। দ্বিতীয় সত্যিটা কী জানিস? ‘
সিমরান কিছু বলল না। দু’হাতে সৌধর পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা চেপে রইল। সৌধ ওর মস্তকে গাঢ় চুম্বন করে বলল,
‘ পরশ আমার চোখে যেমন আমিও অর্পণের চোখে তেমনি বোধহয়। তবে পরশের মতো ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিত্ব আমার নয়। যে পরের বউকে প্রেম নিবেদন করব। ‘
.
.
চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শুনতেই চট করে চোখ খুলল সৌধ। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সিমরান। বাঁকা হাসল আচমকা। বরাবরের মতো তার ঘুম প্রেয়সীর উষ্ণ, নরম ঠোঁটে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে ত্বরিত ওঠে বসল৷ ঘুম কাতুরে সিমরান জানতেও পারল না এই নিয়ে ছ’বার তার অর্ধাঙ্গ তার অগোচরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল৷ রয়েসয়ে শীতল কণ্ঠে ডাকতে শুরু করল সৌধ৷ শীত মৌসুমে এই সময়টায় ওঠা তীব্র কষ্টের সিমরানের জন্য। তবু ওঠতে হবে। তাই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ওঠে বসল৷ এরপর ওরা দু’জন মিলে ফজরের নামাজটা সেরে নেওয়ার পর সৌধ বলল, জলদি পোশাক পরিবর্তন করতে। তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে সে। সিমরান প্রথমে বুঝতে না পরক্ষোণেই বুঝতে পারল জন্মদিন উপলক্ষেই তার বর তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে। বারোটায় উইশ করে ঘুমিয়েছিল সে৷ ফের এখন উইশ করে কাভার্ডের দিকে এগুলো। সৌধ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আজ সারাদিনটা যেমন স্মরণীয় হবে। তেমনি দিনশেষে যে রাতটা আসবে ওটাও তোর সমস্ত সত্তায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘
একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেলকনিতে গেল সৌধ৷ সিমরান গাঢ় সবুজ রঙের একটি স্কার্ট আর লাল রঙের লেডিস শার্ট বের করে বিছানায় রাখল৷ মনে পড়ল রুমটা ঝাড় দেয়া হয়নি৷ নিজের ঘর এখন নিজেই ঝাড়ু দেয় সে। তাই চটজলদি রুম ঝাড়ু দিয়েই বাথরুম ঢুকে পড়ল। অল্প পরিসরে গোসল সেরে নিলেও চুল ভেজাল না৷ ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরতে উদ্যত হতেই আচমকা খেয়াল হলো, সে রুম ঝাড়ু দিয়ে কাপড় না নিয়েই বাথরুমে ঢুকেছে!
বেলকনিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সুহাসের টেক্সট নজরে আসে সৌধর। রাত দু’টোয় টেক্সট এসেছে।
‘ দোস্ত দুই তারিখ ভিসা আসার কথা না? আর নয়দিন তাই না? সময় এত স্লো যাচ্ছে মেজাজটাই খারাপ লাগতাছে। ‘
টেক্সটটা পড়তে পড়তে ঘরের ভেতর এলো সে। সহসা নজড়ে পড়ল বিছানায় সিমরানের কাপড় আর বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভ্রু কুঁচকে ফেলল অমনি। গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ সিনু, কাপড় নিস নি কেন? ‘
প্রশ্নটা করেই মনে মনে ভাবল,
‘ আমার বোধহয় তুই ডাকটা শুধরানো উচিত। ‘
সিমরান ভেতর থেকে বলল,
‘ সৌধ ভাই, তাড়াহুড়োয় কাপড় রেখেই চলে আসছি। একটু দাও না।। ‘
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে এঁটে কাপড় গুলো নিয়ে সিমরানকে দিয়ে এসে বিছানায় বসল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে সহসা ডানপাশে চোখ যেতেই থমকে গেল হৃৎস্পন্দন। কাপড় গুলোর সাথে সাদা রঙের একটি অধোবস্ত্র ছিল। যা বিছানাতেই রয়ে গেছে। নিমেষে মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠল সৌধ৷ হালকা কাশিও ওঠল বেচারার৷ এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দু আঙুলে ছোট্ট বস্ত্রটা তুলে ধরে নিয়ে গেল বাথরুমের সামনে। সে নিশ্চিত এখন এটা দেয়া মানে আজ সারাদিন মেয়েটা লজ্জায় টইটম্বুর হয়ে থাকা। তবু পিছুপা হলো না৷ অনেক তো হলো জড়তা, ভীরুতা। অনেক হলো দূরত্ব। এবার সম্পর্কে পূর্ণতা দেয়ার পালা৷ তাছাড়া দিন পেরিয়ে রাত ঘনালেই আজ মেয়েটাকে সম্পূর্ণরূপে নিজের করে নেবে। উজার করে দেবে নিজের সবটুকু। এ মুহুর্তে হয়তো সিমরান অতি লজ্জায় কয়েকশতবার কোমা পেশেন্টদের মতো আচরণ করবে। ব্যাপার না, এখন থেকে বউয়ের সব লজ্জা শুষে নেয়ার দায়িত্ব তার৷
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা