ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৬৭+৬৮

0
997

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৭|
দীর্ঘদিন পর সৌধর কল পায় নিধি৷ যে ছেলেটা এক সময় তার সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলত৷ আজ সে যেন প্রাণ বেঁধে উচ্চারণ করল এক একটা শব্দ। একদিন যার কণ্ঠস্বরের প্রগাঢ় নমনীয়তার স্পর্শ সে পেয়েছে। আজ তার প্রকট রুক্ষতা পেয়ে মনটা কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল। স্পষ্টভাষী সৌধ কণ্ঠে কাঠিন্য ধরে বলল,

‘ হ্যালো নিধি? ‘

ওপাশ থেকে তীব্র উত্তেজিত স্বর নিধির,

‘ হ্যাঁ সৌধ! ‘

ব্যস নিধিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে সৌধ বলল,

‘ আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে চাই। চাই মানে চাই’ই। কখন দেখা করতে পারবি? আজ সন্ধ্যা বা আগামীকাল সকাল দশটা। কুইকলি জানিয়ে দিবি। রাখছি। ‘

যে ছেলে এত গুলো দিন তাকে ফোন করেনি। সে হঠাৎ আজ কী মনে করে ফোন করল? অগণিত চিন্তা এসে ভর করে নিধির মাথায়৷ মন হয়ে ওঠে চঞ্চল। সাধারণ বা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নিয়ে সৌধ তাকে এভাবে ডাকবে না৷ নিশ্চয়ই বড়ো ধরনের কোনে সমস্যা হয়েছে। তবে কি সৌধ কোনোভাবে নামীর ব্যাপারে জেনে গেছে? আকস্মিক চমকে ওঠে নিধি৷ সে ভুলে গিয়েছিল, সৌধর প্রখর দৃষ্টিসীমা, শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষমতা আর প্রকট বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে। মনে মনে ঢোক গিলল নিধি। এমনিতেই তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে তৈরি হয়েছে দেয়াল।
যে দেয়াল ভাঙা সম্ভব। কিন্তু সৌধ, সুহাস বা আইয়াজ যদি কোনোভাবে নামীর ব্যাপার নিয়ে তাকে ভুল বুঝে তাহলে সে দেয়াল আর কোনোদিন ভাঙবে না৷ সচেতন হয় নিধি৷ সেদিন সে নামীকে স্রেফ বড়ো বোন, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সাহায্য করেছিল। একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল৷ সেই মুহূর্তে নামী যেমন নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি৷ ঠিক তেমনি সে নিজেও সুহাসের প্রতি বন্ধুত্বের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি৷ তার এই অনুভূতি সুহাস না বুঝলেও সৌধ, আইয়াজ ঠিক বুঝবে৷ কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সে ওই ঘটনা চেপে গেছে সব বলবে। তবু যেন ওরা কেউ বিশেষত সৌধ তাকে ভুল না বুঝে। যে কঠিন বোঝা নিয়ে, আত্মগ্লানি নিয়ে সে বেঁচে আছে। তার ভারই সহ্য হয় না৷ এর ওপর আরো একটি বোঝা যদি সৌধ এবং বাকি বন্ধুদের থেকে আসে সে সত্যি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি৷ যদি সম্ভব হয় আগামীকাল সন্ধার পর দেখা করতে বলেছে সৌধ। আর নয়তো পরশু সকাল দশটায়। কী কারণে দেখা করবে সৌধ? সে যা ভাবছে এটা ছাড়া আর কোনো কারণ থাকার কথা নয়৷ মনে মনে তীব্র সংশয় হয়। ত্বরিত টেক্সট করে সৌধকে জানিয়ে দেয়, সে আগামীকাল সন্ধ্যার পরই দেখা করবে। পরশুও করা যেত৷ কিন্তু গোটা এক রাত এক দিন তীব্র দুঃশ্চিন্তা নিয়ে কাটানোই অসম্ভব হয়ে ওঠবে৷ সেখানে বাকি আরেকটা রাত বাড়াতে চাইল না। তাই এক্ষুনি টেক্সট করে দিল, সে আগামীকাল সন্ধ্যার পরই দেখা করবে। সঙ্গে সঙ্গে সৌধও ফিরতি বার্তা পাঠিয়ে, ঠিকানা বলে দিল।
.
.
ড্রয়িং রুমে বসে আছে সোহান খন্দকার। পাশে সুহাস আর সিমরান৷ সম্মুখে সুহাসের নানুমনি আর মামা, মামিরা। সকলেই স্তম্ভিত সুহাসের বক্তব্য শুনে৷ সোহান খন্দকার কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। নামী গর্ভবতী অবস্থায় তাদের বাড়ি ছেড়েছে? সে দাদু হতে চলেছে! তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসবে! তার বংশধর! শরীরে মৃদু কম্পন অনুভব করল মানুষটা। নামীর ওপর রাগ, অভিমান দৃঢ় হলো৷ পাশে বসে থাকা ছেলের ওপর ক্ষুব্ধ হলো ভীষণ। ইচ্ছে করল, আচ্ছামত ধোলাই দিতে। পারল না শুধু এটা ভেবেই যে তার ছেলেটাও বাবা হতে চলেছে। তার ছোট্ট সুহাস। ডানপিটে স্বভাবের ছেলেটা কিনা ক’দিন পর বাবা হবে? চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে ওঠল৷ আকস্মিক মনে পড়ে গেল উদয়িনীর মুখটা। উদয়িনী বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয়ই তাদের বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে ওঠত?

কিছুদিন আগে নামীর বাবা আখতারুজ্জামান সোহান খন্দকারকে মেইল করেছিল৷ যেখানে লেখা ছিল, সুহাস কী করবে সে জানে না৷ কিন্তু নামী বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে পারে। সুহাস যদি একমত না হয় তবে এই সম্পর্কটা ভাঙতে দেয়া যাবে না৷ প্রয়োজনে সে বাংলাদেশে আসবে, ঘরোয়া ভাবে বসবে দুই পরিবার মিলে। সমস্যা যখন আছে সমাধানও পাওয়া যাবে। এরূপ কথাবার্তার শেষে আরো একটি বিশেষ লেখা ছিল এমন ” সোহান, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফ্রি হয়ে নে৷ এরপর তোর সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। সন্তানরা ভুল করবে৷ যা বাবা মাকে সংশোধন করে দিতে হবে৷ আমি মনে করি আবেগের বশে নামীও একটি ভুল করেছে। যা বাবা হিসেবে আমি সংশোধন করে দিতে চাই৷ এত সমস্যা, জটিলতার ভীড়ে তোর জন্য একটি শুভ সংবাদও রয়েছে। এটা জানার পর হয়তো আমার মেয়ের ওপর রাগ হবে৷ অভিমান বাড়বে। আমি এও জানি দিনশেষে এ খবর পেয়ে তুই’ই বেশি খুশি হবি৷ ”

আখতারুজ্জামানের সেই মেইলের কথা স্মরণ হতেই মনটা পুলকিত হলো সোহানের। পকেট হাতড়ে দেখল, সেলফোনটা নেই। তাই ত্বরিত উপরে চলে গেল বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সুহাসকে বলে গেল,

‘ টেনশন করিস না৷ আমি তোর শশুরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি৷ ‘

সোহান খন্দকার উপরে ওঠে গেলে মুখ খুলল নানুমনি। হতাশার সুরে বলল,

‘ এ কেমন মেয়ে কপালে জুটল তোর? এখন তো মনে হচ্ছে উদিই ঠিক বলছিল। এই মেয়ের খুব তেজ। কেমন পাষাণ হলে এমন একটা কাণ্ড করা যায় ছিঃ ছিঃ। ‘

সিমরান মুখ ছোটো করে তাকিয়ে রইল। সদর দরজায় তখন সৌধর পা পড়েছে৷ সে স্পষ্টই শুনতে পেল নানুমনির কথা। যত এগুতে লাগল ততই যেন বেড়ে গেল নামীকে নিয়ে নানুমনি আর সুহাসের মামিদের সমালোচনা। সবাই মুখে একই কথা,

‘ এ কেমন মেয়ে সুহাসের বউ হলো? স্বামী, স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া, বিবাদ হবেই৷ তাই বলে পেটে বাচ্চা নিয়ে দেশান্তরি হতে হবে! আহারে বেচারা সুহাস। বিয়ে করে সংসার করতে পারল না৷ প্রথম বাচ্চা হবে তাও কিনা বউ বাচ্চা নিয়ে ফুড়ুৎ! ‘

অন্যের সমালোচনা পছন্দ নয় সৌধর৷ নামী সুহাসের বউ৷ তার ছোটো বোনের মতো৷ মেয়েটাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছে সে৷ দীর্ঘদিন। এই পৃথিবীতে কেউই ভুকের ঊর্ধ্বে নয়৷ আর নামী যা করেছে এমনি এমনি করেনি। তার বন্ধু কতখানি সাধু তাও জানে সে। তাই মেজাজ কিঞ্চিৎ খারাপ হলো। ধীর পদক্ষেপে এসে দাঁড়াল ড্রয়িংরুমে। দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাসের স্তব্ধ মুখাবয়বে। সে মুহুর্তে সুহাসের বড়ো মামি অকস্মাৎ বলে ফেলল,

‘ আমার তো মনে হচ্ছে সুহাসের বউয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে। ভদ্র মেয়ে, চরিত্র ভালো মেয়েরা কোনোদিন এই সাহস করবে না। যতই বাপের টাকা থাকুক, নিজের টাকা থাকুক, চাকরিবাকরি করুক। তাই বলে পেটে প্রথম সন্তান আসছে সেটা কাউকে না জানিয়ে গোপনে চলে যাবে? আমি নিশ্চিত এই মেয়ের পরকীয়া আছে! ‘

উপস্থিত যারা নামীকে চেনে৷ অর্থাৎ, সুহাস, সিমরান, সৌধ প্রত্যেকেরই কর্ণদ্বয় উত্যক্ত হয়ে ওঠল। সৌধর চোয়াল দু’টো শক্ত হয়ে গেল আচমকা। নামী সুহাসের বউ। সুহাসের বউ সম্পর্কে এমন একটি কথা শুনতে তারই গায়ে কাঁ টা দিচ্ছে। সুহাস কী করে সহ্য করছে? তীব্র ক্রোধে ফুঁসে ওঠল সৌধ। সহসা কিছু বলতে উদ্যত হতেই শুনতে পেল, সুহাসের প্রতিবাদী, অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর,

‘ ব্যস! অনেক বলেছ তোমরা। নামীকে জড়িয়ে আর একটা অসম্মানজনক কথা আমি শুনতে চাই না। ‘

নাক, কান, মুখ লাল হয়ে ওঠেছে সুহাসের৷ কপালের নীল রগ ভাসমান। চোখ দু’টো কঠিন করে তাকিয়ে। মামিরা দমে গেল। ভাই রেগে গেছে বুঝতে পেরে সিমরান বলল,

‘ ভাবিপু অমন মেয়ে নয় মামি৷ সে একটু বেশি জেদি, তার ব্যক্তিত্ব অনেক বেশিই কঠিন৷ ভাইয়ার সাথে বনিবনা হয়নি তাই এই কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে। আর কিছুই নয়। তোমরা প্লিজ এসব কথা বলে ভাইয়ার মন ভেঙে দিও না। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সৌধকে দেখে। ত্বরিত ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ সৌধ ভাই, এসে বসো এখানে। ‘

নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিল সিমরান। সৌধ ইশারায় বলল, সে বসবে না উপরে তার ঘরে যাবে। ইশারায় কথা বলে পুনরায় সুহাসের দিকে তাকাল। যেন সে চায় নামীকে সাপোর্ট দিয়ে আরো কিছু বলুক সুহাস। ঘরে বাইরে উভয় স্থানে নিজ স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করা প্রকৃত স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। যারা স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে পারে না তারা কাপুরুষ। সৌধর চোখে তাদের মন হীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হোক সুহাস তার বন্ধু। চারদেয়ালে সে তার স্ত্রীকে যাই বলুক যাই করুক। চারদেয়ালের বাইরে লোক সম্মুখে স্ত্রীকে কতটুকু সম্মান দিতে পারে সে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। সৌধর অপেক্ষার অবসান অতি দ্রুতই ঘটল৷ সুহাসের অশান্ত হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো কিছু শান্ত বক্তব্য। সে তার নানুমনিকে বলল,

‘ নানুমনি, মা তোমাকে যখন নামীকে নিয়ে বলেছিল তখন নামীর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না। মা আমাদের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। নামী সম্পর্কে সে অবগতও ছিল না৷ তাই হয়তো রাগ করে নেগেটিভ কিছু বলেছে। তার মানে সেগুলো ধরে পরবর্তীকালের কথা তুমি ভুলে যাবে। নামী সম্পূর্ণ আমার বিপরীত একটা মেয়ে। বিয়ের আগে আমার একাধিক সম্পর্ক থাকলেও নামীর ছিল না৷ বর্তমান জেনারেশনে থেকে যে মেয়ে বিয়ের আগেই কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়নি সে মেয়ে বিয়ের পর আমার সঙ্গে স্টিল ছয় বছর বিবাহিত জীবন পার করে, আমার সন্তান গর্ভে নিয়ে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াবে এটা আমি না ভাবতে পারি আর না বিশ্বাস করি। তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা বলাতে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। ওঠছি আমি। ‘

ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে অন্যের মুখে বদনাম সহ্য করা যায় না৷ মনের মানুষের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে৷ চোখ বুজল সুহাস৷ মনে পড়ে গেল, সেদিন চারদেয়ালের ভেতরে সে নামীকে কী কী বলেছিল। সেই বিধ্বংসী ঝগড়াগুলো স্মরণ করে কেঁপে ওঠে হৃদয়। চোখ খুলে সুহাস। নামী তার বউ। তাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া হয়েছিল। সে জানত নামী কী ধরনের মেয়ে৷ তবু ইচ্ছে করে জব্দ করতে ওসব বলেছিল। যাতে রেগে গিয়ে অন্তত সত্যিটা বলে। নামী স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী। এই বিশ্বাস মনে থাকলেও মুখে উচ্চারণ করেছিল বিপরীত কিছু। তাই বলে অন্য কারো মুখে নামীকে নিয়ে সেসব শুনার শক্তি, আগ্রহ বা মানসিকতা কোনোটাই তার নেই৷ তারা একে অপরকে যাই বলুক, যাই করুক। সেগুলো একান্তই তাদের দুজনের ব্যক্তিগত বিষয়। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস৷ নানুমনি চুপসে গেল একদম৷ মামিরা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে ঢোক গিলল। সুহাস বড়ো বড়ো করে বারকয়েক শ্বাস নিয়ে চলে গেল ড্রয়িং রুম ছেড়ে।

সুহাসের যাওয়ার পথে তাকিয়ে সৌধ৷ এতক্ষণে যেন দম ছাড়ল সে৷ মনে মনে হাসল ভীষণ। বাহবা দিল প্রিয় বন্ধুটিকে। পাশাপাশি নিশ্চিতও হলো, নামীর প্রতি সুহাসের অনুভূতি সম্পর্কে। প্রকৃতপক্ষে সুহাস, নামীর সম্পর্ক নিয়ে তারও কিঞ্চিৎ সন্দেহ জেগেছিল। আর যাইহোক ভালোবাসা, সম্মান ব্যতীত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না৷ এবার স্বস্তি পেল। সেই সঙ্গে মনে মনে করা পণটিও দৃঢ় হলো। সুহাস, নামীকে এক করতেই হবে। সিমরান মামিদের দিকে এক পলক স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সৌধর কাছে এসে বলল,

‘ চলো উপরে যাই। ‘
.
.
লাঞ্চ টাইম শেষে সৌধ বলে বসল নিজের বাড়ি ফিরবে। সিমরানকে একঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে বলা হলো। দ্বিতীয়বারের মতো শশুর বাড়ি যেতে তৈরি হলো সিমরান৷ প্রথমবারের মতোই মন ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। সৌধর ইচ্ছে ছিল বিকেল করে
বাড়ি ফিরবে। তার আম্মা এমনটাই বলে দিয়েছিল।
কিন্তু তখন নানুমনি আর মামিদের করা সমালোচনা গুলো মাথা থেকে যাচ্ছে না। এই মানুষ গুলোকে পছন্দ হচ্ছে না একদমই। তার একটি বদঅভ্যেস হলো, যে তার অপছন্দীয় কাজ করবে তার মুখ দর্শন করতে মন ভরে ওঠবে তীব্র বিতৃষ্ণায়। শুধুমাত্র দু’জনের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতীক্রম। সে দু’জন হলো তার দাদুনি আর সুহাস।

প্রথম বিদায়ে বোনের সঙ্গে সঙ্গ দেয়নি সুহাস। দ্বিতীয় বিদায়ে দিল। নিজ দায়িত্বে বোন এবং বোন জামাইকে পৌঁছে দিল চৌধুরী বাড়ি। ফলশ্রুতিতে সিমরানের কান্নাকাটি খুব বেশি দীর্ঘ হলো না৷ আজ তার প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সৌধর আদেশে বই, খাতাও বাদ যায়নি৷ নতুন বউ বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাড়ি জুড়ে খুশির আমেজে ভরে ওঠল। সবচেয়ে খুশি হলো তাহানী। সিমরানকে দেখা মাত্র ছুটে এসে কোমর জড়িয়ে ধরল৷ সিমরানও মৃদু হেসে জড়িয়ে নিল ওকে। আদর করে চুমু খেল গালে৷ দু’জন কাজের মেয়ে এসে লাগেজ দু’টো নিয়ে উপরের ঘরে দিয়ে এলো৷ সিমরান এসে বসল শাশুড়ির পাশে। সবাই মিলে গল্প গুজব করল অনেকক্ষণ। হালকা নাস্তাপানি দেয়া হলো সুহাসকে। মাগরিবের আজানের আগ মুহুর্তে সুহাস বিদায় নিল। তার সঙ্গে সৌধও বেরুলো। আম্মা আর বউ দু’জনকেই জানিয়ে গেল ফিরতে দেরি হবে।

পূর্বে থেকেই সিমরান সকলের খুব আদরের৷ যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বলা যায় আগের তুলনায় প্রকটও হয়েছে। এ বাড়ির বড়ো বউ ঝুমায়না। সেও বাবা, মায়ের একমাত্র মেয়ে। তিন ভাইয়ের অতি আদুরে ছোটো বোন৷ কানাডায় বিরাট বড়ো বিজনেস আছে তার বাবার৷ ছোটোবেলা থেকে অনেক বেশি আদরে, আর জমকালো ভাবে বড়ো হয়েছে। যা তার মন, মানসিকতাকে বিগড়ে দিয়েছে বীভৎসভাবে। নিজের সমকক্ষ কাউকে একদমই পছন্দ করে না ঝুমায়না। আর যদি নিজের সমকক্ষ মানুষকে তার চেয়ে অধিক প্রাধান্য দেয়া হয় তাহলে তো সে তার চোখের বিষ৷ বিয়ের পর থেকে সে যতবার এ বাড়িতে এসেছে। ততবারই প্রত্যেকের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। দাদুনি তাকে পছন্দ করে না বলে সে নিজেই সব সময় দাদুনিকে এড়িয়ে চলেছে। এছাড়া বাকি সবার চোখের মণি হিসেবেই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এবার তার আদর, গুরুত্ব, সম্মান সবই যেন কম পড়ে গেল৷ কারণ ওসবের ভাগিদার এখন সৌধর বউ সিমরানও। ওর কেবল মনে হতে থাকল, এ বাড়ির সবাই ওর চেয়ে সিমরানকে বেশি ভালোবাসে। যা একেবারেই সহ্য করার মতো ছিল না৷ ওর বিরাগটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল। কাল থেকে শাশুড়ি থেকে শুরু করে ননদ, কাজিন দেবর, ননদ সকলের মুখে এক সিমরানকে নিয়ে প্রশংসা। আজ যখন সিমরান এলো এরপর থেকে যে নাটক শুরু হলো তা আর দেখার মতো না৷ সে তাহানীকে কাছ ঘেঁষতে দেয় না। অথচ সিমরান তাহানীকে কেমন জড়িয়ে ধরে বসে আছে৷ সে কখনো শাশুড়ির সঙ্গে বসে অপ্রয়োজনীয় বকবক করে না৷ অথচ সিমরান একের পর এক অহেতুক গল্প করেই যাচ্ছে। মেয়েটাকে এতদিন শান্ত ভেবেছিল৷ এখন দেখছে, এই মেয়ে মারাত্মক চঞ্চল। কাজিন ননদ, আর দেবররাও কেমন গোল করে বসে আড্ডা জমাচ্ছে। কই সে তো কখনো এভাবে আড্ডা জমায়নি। সবচেয়ে বেশি আক্রোশ জন্মালো সিমরানের পরনে কামিজের সাথে জিন্স প্যান্ট দেখে৷ সৌধ বিয়ের দ্বিতীয় দিনই বউকে জিন্স প্যান্ট পরিয়ে এনেছে? অথচ তার বর এ বাড়িতে যখন তাকে প্রথম নিয়ে আসে। ওইসব ওয়েস্টার্ন ড্রেস বর্জন করতে বলেছিল৷ ঢাকা থেকে গাউন পরিয়ে লাগেজ ভর্তি সেলোয়ার-কামিজ আর গাউন নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। অর্থাৎ সৌধর বউয়ের বেলায় সব মাফ। যত খবরদারি তার ওপর? তীব্র ঈর্ষান্বিত হয়ে দাদুনির ঘরে হাঁটা দিল ঝুমায়না৷ যদিও দাদুনির সাথে তার সম্পর্ক ভালো না৷ তবুও শুনেছে দাদুনি সিমরানকে পছন্দ করে না৷ তাই তার কাছেই এই মেয়ের বিরুদ্ধে কথা লাগাতে হবে।

ঝুমায়না যতক্ষণে দাদুনিকে পড়িয়ে, ফুঁসিয়ে ফাঁসিয়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত করল। ততক্ষণে তানজিম চৌধুরী পোশাক পরিবর্তন করতে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে সিমরানকে। দাদুনি আসার পর তানজিম চৌধুরী হাসিমুখে বললেন,

‘ সিনু মা এসেছে আম্মা। পোশাক পাল্টাতে উপরে পাঠালাম। নিচে এলে রান্নাঘরে যাব৷ মেয়েটা নিজে থেকেই রান্না শেখার আবদার করল। ‘

চিকন ফ্রেমের দুইশ পাওয়ারের চশমাটা ঠিক করতে করতে দাদুনি গিয়ে সোফায় বসলেন৷ পান চিবুতে চিবুতে বললেন,

‘ শুনলাম সে নাকি জিন্স প্যান্ট পড়ে বাড়িতে ঢুকেছে! এই কি নতুন বউয়ের নমুনা? ‘

চমকে ওঠল তানজিম চৌধুরী। বিস্মিত চোখে তাকাল বড়ো বউ ঝুমায়নার দিকে। অবিশ্বাস্য ঠেকল, ঝুমায়না কথা লাগিয়েছে তার শাশুড়িকে। এ বাড়ির নিয়ম তো এটা নয়। হতভম্ব মুখে তানজিম চৌধুরী বললেন,

‘ আমি সিনুকে এ ব্যাপারে সচেতন করে দিব আম্মা৷ এ নিয়ে আর কথা বাড়াবেন না। ‘

তানজিম চৌধুরী জানেন, শাশুড়ি এ নিয়ে আর কথা বাড়াবে না৷ কিন্তু সিমরানকে যে অপছন্দের শীর্ষে রেখে দেবে তা ভালো মতোই বুঝতে পারল৷ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল ঝুমায়নার দিকে। এ কোন ঝুমায়নার সম্মুখীন হলো আজ সে? কোনোভাবে সিনুর প্রতি হিংসা থেকে এটা করল ঝুমায়না? বুক কেঁপে ওঠল তানজিম চৌধুরীর। চোয়াল দৃঢ় হলো কিঞ্চিৎ। প্রথমবার বলে চুপ রইল। দ্বিতীয়বার এমন কিছু দেখলে অবশ্যই সাবধান করবে৷ এ বাড়ির প্রতিটি ছেলেমেয়ের মন পানির মতো স্বচ্ছ। সে আশা করবে তাদেরকে ঘিরে যারাই এ পরিবারের অংশ হবে তাদের হৃদয়কেও বরফের মতো শীতল, বৃষ্টির পানির মতো স্বচ্ছ, তুলোর মতো নমনীয় হতে হবে৷

রান্নাবান্না পারে না সিমরান। ঝুমায়নাও পারত না৷ টুকটাক শিখেছে শাশুড়ির থেকে৷ শেখা টুকুই৷ শখ করে কখনো কাউকে রান্না করে খাওয়াতে দেখা যায়নি৷ সিমরানের আজ রান্নাবান্নার হাতেখড়ি হলো। শাশুড়ি মায়ের কাছে। আজ রাতের খাবারে যা যা রান্না হলো। সবকিছুই মন দিয়ে দেখল সিমরান৷ মনে রাখতে পারল না। তবু দেখল৷ শাশুড়ি বলেছেন,

‘ একবারে হবে না। প্রতিদিন দেখতে দেখতে টুকটাক করতে করতেই শেখা হয়ে যাবে। ‘

রান্না শেষে শশুরমশাই খেতে এলেন। আজ সিমরানই খাবার বেড়ে দিল তাকে। বিয়ের পর থেকেই সুজা চৌধুরীর অভ্যাস, মা এবং বউকে পাশে বসিয়ে একসঙ্গে খাওয়া। আজো তার ব্যতীক্রম হলো না। সিমরান জানতে পারল, তার শাশুড়ি মাও স্বামী বাড়িতে থাকলে তাকে ছাড়া খেতে বসেন না। দূরে থাকলে আগে ফোন করে জেনে নেন, স্বামী খেয়েছে কিনা। সে খেলেই উনি তিনবেলা মুখে ভাত তুলেন। এটা কারো বলে দেয়া বা লিখে রাখা নিয়ম হিসেবে উনি করেন না৷ উনি এটা করেন স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা বোধ থেকে। শশুর, শাশুড়ির এই গল্প শুনতে শুনতে ঝুমায়না পেট ভরে খেয়ে ওঠল৷ কিন্তু সিমরান খেতে পারল না। সে মুখ ফস্কে বলে ফেলল,

‘ আন্টি, আমি সৌধ ভাই এলে খাব। ‘

সুজা চৌধুরী মুচকি হাসলেন। সিমরান লজ্জায় মাথা নত করল। তানজিম চৌধুরী বললেন,

‘ ওর তো আরো দেরি হবে সিনু৷ এতক্ষণ থাকতে পারবে? ‘

‘ পারব। ‘

মাথা নেড়ে বলল সিমরান। তানজিম চৌধুরী মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন,

‘ আচ্ছা। তা আমরা কবে আম্মা, আব্বা ডাক শুনব তোমার থেকে? ‘

আরক্ত মুখে সিমরান জবাব দিল,

‘ ধীরেধীরে অভ্যেস করে নিব। ‘

ঝুমায়না উপরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। শাশুড়ি আর সিমরানের কথা শুনে মুখ ভেঙচি দিয়ে বিরবির করল,

‘ যত্তসব ন্যাকামি! ডিজগাস্টিং। ‘
.
.
ঘরে বসে তাহানীর সঙ্গে গল্প করছে সিমরান৷ পাশাপাশি নিজের বই, খাতা গুছিয়ে রাখছে। সৌধ ভাই আসতে আসতে সব গুছিয়ে ফেলবে সে। এমন সময় ঝুমায়নার ঘর থেকে সুরের কান্নার শব্দ পেল। তাহানী গিয়ে দেখে এলো, বড়ো ভাবি ঘুমাবে কিন্তু সুর ঘুমাবে না৷ তাই মায়ের ধমক খেয়ে ভয় পেয়ে কাঁদছে সুর৷ তাহানীর মুখে এসব শুনে মায়া হলো সিমরানের। সুরের মুখ মনে করতে করতে সহসা মনে পড়ে গেল নামীপুর কথা। সে ফুপি হবে স্মরণ করে পুলকিত হলো মন। ভাবল, তার ভাতিজা বা ভাতিজি যাইহোক না কেন। সে যদি নামীপুকে ঘুমাতে না দেয় নামীপুও কি এভাবে ধমক দিয়ে কান্না করাবে? উঁহু সে থাকতে তার ছোট্ট সোনামুনিকে কেউ ধমক দিতে পারবে না৷ নামীপুও না৷ যখন নামীপুর ঘুম পাবে তখন সে বেবিকে নিজের কাছে রাখবে। কত আদর আর যত্নের বেবি হবে তাদের পরিবারে। মুহুর্তেই নামীর দূরে চলে যাওয়ার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে তারা ঠিক সময় কাছে পাবে তো? বুক ভাড় হলো ভীষণ। ভাইয়ের কথা ভেবেও মনে ভীষণ মেঘ জমে গেল। ওদিকে সুরের কান্নার শব্দ বেড়েছে। সৌধ ভাইয়ের বড়ো ভাইয়ের সন্তান সুর৷ অর্থাৎ তারও বড়ো ভাই। সুর তারও ভাতিজা৷ কখনো বাচ্চাদের সামলায়নি সে৷ সেভাবে কোনো বাচ্চার সংস্পর্শে যাওয়াও হয়নি৷ এই এক তাহানীকেই পেয়েছে শুধু৷ তাই সুহাস ভাইয়ার বেবির কথা স্মরণ করে সুরের প্রতি গভীর আকর্ষণ বোধ করল। বইগুলো দ্রুত গুছিয়ে বাকি কাজ বাদ রেখে পা বাড়াল ঝুমায়না ভাবির ঘরে৷ অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,

‘ ভাবি সুরকে আমার কাছে দাও। আমি ওকে রাখি কিছুক্ষণ। ‘

চোখমুখ কুঁচকে ফেলল ঝুমায়না৷ কঠিন গলায় বলল,

‘ তুমি করে বলছ যে? সম্পর্কে আমি তোমার বড়ো জা৷ বয়সেও বছর, পাঁচেক বড়ো। ‘

থতমত খেয়ে গেল সিমরান। আমতাআমতা করে বলল,

‘ সরি ভাবি। ‘

মনটা যেন মরেই গেল মেয়েটার। তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে গেল৷ অপমানবোধও করল ভীষণ। ঝুমায়না ভাবি যে এতটা রাফ সে কল্পনাও করেনি। তবু এসে ফেঁসে গেছে বিধায় আর চলে গেল না। সুরের প্রতি আকর্ষণ তো ছিলই৷ তাই বলল,

‘ সুরকে কোলে নিতে পারি? ‘

ছেলের কান্না অসহ্য লাগছে ঝুমায়নার৷ সে সাধারণত ছেলেকে কারো কোলে দেয় না। শুচিবায়ু সমস্যাও আছে৷ বাড়ির কাজের লোকদের তো ধরতেই দেয় না বাচ্চাকে। হাঁটি হাঁটি করে যদিও সুর তাদের কাছে চলে যায় ঝুমায়না জোর কের নিয়ে আসে৷ সিমরানকে নিয়ে তার এসব সমস্যা নেই। তাই অনুমতি দিল। সিমরানও সুরকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে ঘরে থেকে যেন ভয়াবহ বিরক্ত সুর৷ কাঁদতে কাঁদতে কপাল কুঁচকে ছিল ওর৷ আলাদা ঘর আলাদা মানুষ পেয়ে সে কুঁচকে থাকা কপাল ধীরেধীরে সোজা হয়৷ সিমরান অবাক হয়ে দেখে বাচ্চা ছেলেটার কী মুড৷ সে প্রথমে মিষ্টি হেসে ওর সঙ্গে ভাব জমায়। তারপর ধীরেধীরে পরিচিত হয়৷ বলে,

‘ বলো তো বাবান আমি তোমার কী হই? ‘

তাহানী উল্লসিত গলায় বলল,

‘ ছোটো মা। ‘

সুর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। সিমরান ওর গাল টিপে দিয়ে কপালে চুমু খেল। বলল,

‘ হ্যাঁ। আমি তোমার ছোটো বাবার বউ হই৷ তাই ছোটো মা বলবে। ‘

এভাবে দীর্ঘ কিছু সময় কাটিয়ে দিলে ওদের ভাব হয়ে গেল। ঘরময় ছুটোছুটি করে দু’টো বাচ্চার সাথে খেলতে শুরু করল সিমরান৷ লুকোচুরি খেলা। ওদের খেলাটা যখন জমে ওঠেছে তখন তাহানীর পায়ের ঠেলা লেগে টি টেবিলের ওপর থাকা একটি গ্লাস পড়ে যায়। গ্লাস ভাঙার দৃশ্য দেখে শব্দ শুনে ভয় পেয়ে কাভার্ডের সাইটে লুকিয়ে থাকা সুর গুটিগুটি পায়ে ছুটে এলে পায়ে ছোট্ট একটি কাঁচ ফুটে যায়। নিমেষে পরিস্থিতি বিধ্বস্ত হয়ে ওঠে৷ সুরের গগনবিদারী চিৎকার, কান্নায় ভয় পেয়ে যায় সিমরান৷ বেলকনিতে থেকে ছুটে এসে দেখে কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে৷ সুরের পায়ের তলায় কাঁচ ফুটে কিঞ্চিৎ রক্তও বেরিয়েছে। ভয়ে তাহানী ছুটে গেছে ঝুমায়না ভাবিকে ডাকতে।

রক্ত দেখে ভীষণ ভয় পায় সিমরান৷ কাঁ টা ছেঁ ড়া দেখলেও মস্তিষ্ক আর মনে মারাত্মক সমস্যা হয়৷ তবু সুর বাচ্চা ছেলে৷ আর সে বড়ো মেয়ে৷ এ বাড়ির বউ৷ সুরের ছোটো মা৷ এই সম্পর্ক গুলোই যেন সাহসী করে তুলল ওকে। ছুটে এসে সুরকে কোলে তুলে বিছানায় বসল৷ এরপর কাঁপা হাতে পায়ের তলা থেকে ছোট্ট কাঁচটা বের করে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। ঝুমায়না দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল সেই দৃশ্য। নিমেষে মাথায় রক্ত চড়ে গেল যেন৷ বীভৎস মুখোভঙ্গিতে এগিয়ে এসে ছেলেকে ছিনিয়ে নিল। বলল,

‘ কী করেছ তুমি আমার ছেলেকে? ‘

সিমরান কোনো উত্তর না দিয়ে সৌধর ছোট্ট চিকিৎসা বাক্স নিয়ে এসে সুরের পা ড্রেসিং করে দিল৷ খুব বেশি ক্ষত নয়। ঝুমায়না বুঝতে পেরে ব্যান্ডেজ করে দিল। ততক্ষণে ছেলেটা শান্ত হয়েছে। কিন্তু সে শান্ত হতে পারল না৷ এমনিতেই মেয়েটার ওপর রাগ ছিল। সেই রাগ চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে এবার৷ খাতির করে তার বাচ্চাকে নিয়ে এসে ব্যথা দিয়েছে কত বড়ো সাহস৷ ইচ্ছে করছে চিবিয়ে খেতে তা তো সম্ভব না তাই আপাতত কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরেই বুক শীতল করবে। ভাবামাত্র ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিজের ঘরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ফিরে এলো পুনরায় । সিমরান বেরুচ্ছিলই তার ঘরে যাওয়ার জন্য৷ সুর ব্যথা পেল, বাচ্চা একটা ছেলে। মন কাঁদছে তার। এমন মুহুর্তে ঝুমায়না ভাবি ফের আসায় সে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘ সরি ভাবি। কীভাবে হলো বুঝতে পারছি না৷ এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। ‘

দাঁতে দাঁত পিষে, ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ঝুমায়না বলল,

‘ এক্সিডেন্ট? পাজি মেয়ে কোথাকার! ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আমার ছেলেকে ব্যথা দিয়ে বলছ এক্সিডেন্ট। এজন্যই এত প্রেম দেখিয়ে ওকে নিয়ে এলে? ক্রিমিনাল কোথাকার। কার সাথে ক্রিমিনালি করেছ জানো তুমি? আমি ঝুমায়না আমার কলিজার ছেলে সুর। তোমার মতো ক্রিমিনালকে সাইজ করতে ঝুমায়নার এই হাতের একটা চড় ই যথেষ্ট। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিল সিমরানের ডান গালে। যে থাপ্পড়ে একপাশে মাথা বেঁকে গেল সিমরানের। ঝিমঝিম করে ওঠল মাথাটা৷ থরথর করে কেঁপে ওঠল শরীর। চোখের সামনে ভেসে ওঠল মা উদয়িনীর মুখশ্রী আর সৌধ ভাইয়ের মুখাবয়ব। নিমেষে বুজে থাকা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনাপানির ধারা। বুকের ভেতর কী অসহ্য ব্যথা জেগে ওঠল৷ গালে অনুভব করল টনটনে যন্ত্রণা। ধীরে ধীরে একটি হাত দিয়ে টনটনে ব্যথা অনুভব করা গালে স্পর্শ করতেই কর্ণকুহরে শুনতে পেল কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ভারিক্কি কণ্ঠস্বর। যাকে ভালোবেসে, যাকে কেন্দ্র করে এ বাড়িতে সসম্মানে বউ হয়ে এসেছে সে। আজ এ বাড়িতে তার দ্বিতীয় রাত!

‘ ভাবি! ‘

বিমূঢ় দৃষ্টির, দৃঢ় চোয়ালের ভয়ংকর সে ধমকে কেঁপে ওঠল ঝুমায়না, সিমরান। কাঁদতে শুরু করল তাহানী। সৌধ বড়ো বড়ো পা ফেলে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে ঝুমায়নার মুখোমুখি হলো। এ বাড়িতে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। কোনো জুনিয়র সদস্য সিনিয়রকে ধমক তো দূরে থাকুক চোখ তুলে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলে না৷ সৌধ এই নিয়মে বরাবরই নিজের দৃঢ়তা বজায় রেখেছে। আজ সেই সৌধই কঠিন, শাসালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে দ্বিতীয় ধমকটি দিল বড়ো ভাইয়ের বউকে,

‘ হাউ ডেয়ার ইউ ঝুমায়না ভাবি! ‘

ডুকরে ওঠল সিমরান। ব্যথা, অপমান, রাগ, জেদ, ক্ষোভ সব মিলিয়ে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের ভেতরে চলে গেল৷ ক্রোধান্বিত লাল হয়ে আসা চোখ দু’টি দিয়ে এক পলক সিমরানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফের ঝুমায়নার দিকে তাকাল সৌধ। তাহানী কাঁদতে কাঁদতে বিবৃতি দিল ঠিক কী ঘটেছে। তাহানীর বিবৃতি শুনে ঘামতে শুরু করল ঝুমায়না। আর সৌধ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল ভাবির দিকে। মস্তিষ্ক এতটাই বিগড়ে গেল যে বড়ো ভাইয়ের বউ না হলে বয়স বিবেচনা করত না। কষিয়ে চার পাঁচটা থাপ্পড় দিয়ে বুঝিয়ে দিত, সৌধ চৌধুরীর বউয়ের গায়ে হাত তোলার যন্ত্রণা কী বীভৎস হতে পারে।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৮|
পরিস্থিতি গুমোট। রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে সৌধ৷ ওর দৃঢ় চোয়াল আরো বেশি দৃঢ় হলো। পেশিবহুল দু’টো হাত চনমনে। যা তীব্র কষ্টে মুঠোবন্দি করল৷ ফুলে ফেঁপে ওঠল হাতের প্রতিটি নিল রগ৷ ঝুমায়নার দেহশ্রী কেঁপে ওঠল এ দৃশ্য দেখে। তীব্র ভয়ে সংকীর্ণ হয়ে গেল মুখশ্রী। অনুভব করল কণ্ঠনালী নীরস হয়ে আসছে। সৌধ সম্পর্কে কম ধারণা নেই ঝুমায়নার। তার স্বামী সৌরভ ছোটো ভাইকে প্রচণ্ড স্নেহ করে। বরাবরই ভাইকে নিয়ে গর্ব করতে দেখেছে সৌরভকে। শুনেছিল, খুব ছোটোবেলায় সৌধকে তার এক স্কুল ফ্রেন্ড গালে ঘুষি মেরেছিল। সৌধ বাড়িতে এসে কাউকে জানায়নি৷ কারণ এক টিচার তার বিচার করেছে৷ তবু সৌরভ অন্য একজন থেকে এ খবর পেয়ে সেই ফ্রেন্ডকে যে হাতে ঘুষি দিয়েছিল সে হাতে গোটা, দশেক কঞ্চি আঘাত করে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুজা চৌধুরীর বড়ো ছেলে বলে সৌরভ ছোটো থেকেই আলাদা দাপট নিয়ে চলে। ভাই, বোনকে ভীষণ ভালোও বাসে। সবচেয়ে বেশি দুর্বল ভাইয়ের প্রতি। কোনো একদিন কথার ছলে শুনেছিল, ভাই যদি তার প্রাণটুকুও আবদার করে সেটুকু দিতেও দ্বিধা করবে না৷ যদিও কথাটা গভীরভাবে ভালোবেসে আবেগান্বিত হয়ে বলে থাকে৷ তবু ক’জন পারে বড়ো মুখ করে এতটুকু বলতে? ঢোক গিলে ঝুমায়না। সৌরভ তাকেও কম ভালোবাসে না৷ কিন্তু এ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের মতো সৌরভও অন্যায় সহ্য করতে পারে না। বাবার আদর্শে, চৌধুরী পরিবারের প্রতিটি নিয়মনীতি বুকে লালন করে বড়ো হয়েছে সৌরভ, সৌধ৷ আজ যা ঘটল এসব যদি সৌরভের কানে যায় তাকে আর আস্ত রাখবে না।

সৌধর বলিষ্ঠ হাত দু’টো কাঁপছে। যা সে সচেতনতার সাথে ধীরে ধীরে পিছনে নিয়ে নিল। এরপর বা হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জিটা প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরল। ঝুমায়নার নিঃশ্বাস আঁটকে গেল এটুকু দেখেই৷ সে টের পেল সৌধর তাকে মারতে ইচ্ছে করছে। শুধুমাত্র বাড়ির বউ, বড়ো ভাইয়ের বউ বলে নিজেকে তীব্র কষ্টে সামলে নিল। দু’ভাইয়ের অনেক স্বভাবই মিলে যায়। সৌরভ যখন প্রচণ্ড রেগে যায় দোষী ব্যক্তিকে মারতে হাত নিশপিশ করে৷ অথচ মারতে পারবে না এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে এভাবেই এক হাত দিয়ে অপর হাত বেঁধে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। কানাডার বাসায় থাকাকালীন তাদের মধ্যে কঠিন ঝগড়া হয়েছিল। তার বড়ো ভাই এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে৷ ঘোষণা দিয়েছিল, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে৷ সেদিন বড়ো ভাইয়ের সামনে সৌরভ ঠিক এভাবে দাঁড়িয়েই তর্ক করেছিল। যাতে শুধু মুখ টুকুই চলে, হাত নয়। সিনিয়র সদস্যদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম৷ জুনিয়র হলে হাতটাই বেশি চলে দু ভাইয়ের। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল ঝুমায়না৷ কাঁপা গলায় কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ আকস্মিক পাশে দাঁড়ানো কান্নারত তাহানীর দিকে তাকিয়ে আদেশ করে,

‘ তাহানী, আম্মার কাছে যাও। ঘুমাও গিয়ে। ‘

মাথা নিচু করে চলে গেল তাহানী। ঝুমায়নার বুক ধক করে ওঠল। দু’পায়ের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল সমান তালে। সৌধ তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। যে হাতে সিমরানের গালে কষিয়ে থা প্পড় দিয়েছে সে। সহসা গমগমে কণ্ঠে বলল,

‘ এ বাড়ির বউদের হাত এতবেশি লম্বা হতে নেই। কারণ বাড়ির পুরুষরা সে লম্বা হাত খাটো করে দেয়!’

চমকে ওঠল ঝুমায়না। নিজের দোষ স্বীকার করে আরো বড়ো বিপদে পড়ার ভয়ে বলল,

‘ তোমার বউ সুরকে ব্যথা দিয়েছে। আমি ওর কোলে দিতেই চাইনি৷ প্ল্যান করে সুরকে এ ঘরে নিয়ে এসে ব্যথা দিল। ‘

কান্নাধরা গলায় বলল ঝুমায়না। অবিশ্বাস, ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে সৌধ বলল,

‘ আপনাকে ভাবি বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। এ বাড়ির কেউ মিথ্যা বলে না, আর না সহ্য করে। তাহানী যতটুকু বলেছে ততটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য।’

কেঁপে ওঠল ঝুমায়না৷ সৌধ কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে ওয়ার্নিং করে বলল,

‘ আমার সামনে থেকে দূর হন। আপনাকে আমার বা সিনুর ত্রিসীমানায়ও যেন না দেখি। ‘

সৌধ বাক্যটির সমাপ্তি দিতেই ঝুমায়না চলে যেতে উদ্যত হয়৷ তৎক্ষনাৎ আবার থেমে যায়। সৌধ তুড়ি বাজিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে,

‘ আজ যা ঘটল আপনার থেকে এটা অকল্পনীয় ছিল। তবু যখন ঘটেছে এরজন্য সিনুকে অবশ্যই সরি বলবেন। ‘

বিস্ময় নিয়ে তাকাল ঝুমায়না। সে সিনুকে সরি বলবে? তার মানে বাড়ির সবাই জেনে যাবে এই ঘটনা! আর সৌরভ, তার কানে গেলে কী হবে? ঘামতে শুরু করে সে। ভয়ে ভয়ে সৌধকে বলে,

‘ প্লিজ সৌধ বিষয়টা জানাজানি করো না। ‘

ফিচেল হাসে সৌধ। সে মোটেও চায় না আজকের ঘটনা আর কেউ জানুক। ঝুমায়না এ বাড়ির বড়ো বউ৷ তার বিকৃত রূপ আর সিনুর অসম্মান কোনোটাই প্রকাশ পাক সে চায় না৷ তাই সীনা টান টান করে দাঁড়িয়ে দাম্ভিকতা নিয়ে বলল,

‘ অকে, তাহলে এক্ষুনি গিয়ে সিনুকে সরি বলে বিদায় হন। ‘

ঝুমায়নার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল সে অসন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে গেল। এর একটুক্ষণ পরই আবার বেরিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। হয়তো দায়সারা ভাবে নিজের অহংবোধে আঘাত করে সরি বলেছে। মন থেকে যে বলেনি এতে কোনো সংশয় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। আকস্মিক স্মরণ হলো, সিমরানের কথা। সে কাকে, কোন বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে তার থেকে ভালো কেউ জানে না৷ ওই মেয়েটা কতটুকু সহ্য করতে পারে, কতটুকু নিতে পারে এ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ ধারণা আছে সৌধর। তাই তো বুকের গভীরে মুচড়ে ওঠল আচমকা। তীব্র লজ্জায় দুমড়ে মুচড়ে গেল মন। সিনু তার বউ। যাকে বিয়ের তৃতীয় রাতে সমাজের নিম্নশ্রেণীর কিছু পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো ছিঃ! এই দায় আর কারো নয় সম্পূর্ণ সৌধ চৌধুরীর।
.
.
বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে ভাবতে পারেনি সৌধ। এমনিতেই দুঃশ্চিতার শেষ নেই৷ লম্বা একটি সময় নিজের জীবন নিয়ে ভোগান্তি পোহালো। অন্ধকার শেষে আলোর দেখা পেল, তুখোড় ঝড়, বৃষ্টি শেষে দেখা হলো ঝলমলে রোদের সঙ্গে। নিজের জীবন যখন একটু সুনিশ্চয়তা পেল তক্ষুনি শুরু হলো সুহাসের জীবনের টানাপোড়েন। এতক্ষণ সুহাসের সঙ্গেই ছিল সে। সোহান আংকেল নামীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছে না৷ মেইল করেছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুক কোনোটাই বাদ রাখেনি। ভয় হচ্ছে এখন। নামীর মতো সেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল না তো? সুহাসকে সান্ত্বনা দিয়ে, ভরসা জুগিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরল সে। এসেই আরেক দফা অশান্তির সম্মুখীন হলো৷ তার জীবনে এই অশান্তি টুকু ছিল অত্যন্ত লেইম৷ তপ্ত মেজাজে নিজের ঘরে প্রবেশ করল সৌধ। দেখতে পেল এক পাশে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরালেই চোখ পড়ল ফ্লোরে। সিমরানের ওড়না পড়ে আছে। বিছানার বালিশ দু’টোও পড়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। নিমেষে একবার চোখ বুঁজল সে। ঠিক কী ঘটতে পারে আঁচ করে ফেলল। ঝুমায়না ভাবির থেকে অকারণে, বিনাদোষে থা প্পড় খেয়ে দুঃখের পাশাপাশি নিশ্চয়ই মাথা গরম হয়েছে? তীব্র ক্রোধে জর্জরিত হয়ে সমস্ত ক্ষোভ ঢেলেছে এসবের ওপর। সবকিছুর ওপর রাগ ঝেড়ে বিছানায় বসে কাঁদছে সিমরান। সৌধর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ কিঞ্চিৎ ঠিক হলেও সিমরানকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু হলো। ত্বরিত কাছে গিয়ে পাশে বসতেই বউ তার ফুঁসতে শুরু করল। কিছু বলবে বলবে ভাব৷ কিন্তু বলতে পারছে না৷ কান্নার হিড়িকে কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ সময় নিল সৌধ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রক্তিম বর্ণীয় ডান গালটায়। কতখানি জোর খাঁটিয়ে চ ড়টা মে রেছে! ভেবেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল আবারো। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল হঠাৎ। শুনতে পেল ফিকড়ে কাঁদতে কাঁদতে সিমরানের কণ্ঠস্বর,

‘ আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম। কীভাবে গ্লাস পড়ে ভেঙেছে জানি না আমি। সুর কীভাবে ব্যথা পেল তাও দেখিনি৷ কান্না শুনে ছুটে এসে দেখি এই অবস্থা। আর ভাবি আমাকে মিথ্যা দোষ দিল! আমি সুরকে ভালোবেসেই কাছে এনেছিলাম। ‘

শেষ বাক্য দু’টো প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল সিমরান। কী ভয়ংকর দুঃখ পেয়েছে মেয়েটা! কী ভয়ানক রেগেও গেছে। স্বাভাবিক। ওর জায়গায় যে কেউ থাকলে রেগে যেত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। তার পুরুষালি পোক্ত হাতটা বাড়িয়ে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিল সিনুর ডান গালে। টনটনে ব্যথায় পুরুষালি উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে ঠোঁট ভাঙিয়ে কাঁদতে লাগল সিমরান। সৌধ শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ তাহানী বলেছে আমাকে। যদি ও নাও বলত, ঝুমায়না ভাবির কথা আমার বিশ্বাস হতো না। বিকজ, ঝুমায়না ভাবিকে চিনি মাত্র পাঁচ বছর, তোকে চিনি প্রায় পনেরো বছর৷ ডোন্ট অওরি, আই ট্রাস্ট ইউ। ‘

কান্নার বেগ কিছুটা কমলেও কিছুতেই ওই থাপ্প ড়টা ভুলতে পারল না সিমরান। কেন জানি প্রচণ্ড অভিমান হলো৷ কার ওপর হলো সে নিজেও জানে না। তাই নিজের মোবাইল খুঁজল। খুঁজে পেলে সুহাসের নাম্বার ডায়াল করতে উদ্যত হলে সৌধ কেঁড়ে নিল ফোনটা। বলল,

‘ উহুম, সুহাসকে কল করছিস কেন? ‘

দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে সিমরান বলল,

‘ আমি চলে যাব৷ থাকব না এ বাড়িতে। ‘

কথাটা বলেই আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ চোখ, গাল, নাক, ঠোঁট সর্বত্রই ভয়াবহ লালচে হয়ে আছে। সৌধ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর সিমরানের ফোন অফ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ধৈর্য সহকারে বলল,

‘ বাচ্চাদের মতো করিস না সিনু। সুহাসের মতো ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্তও নিস না। আমার কথা শোন, যা হয়েছে এরজন্য আমি সত্যি দুঃখীত! ‘

‘ ঐ মহিলার এতবড়ো সাহস কী করে হয় সৌধ ভাই?’

আকস্মিক চ্যাঁচিয়ে ওঠে সিমরান। চোখ বেয়ে পড়তে থাকে নোনাপানির ধারা৷ চমকে যায় সৌধ। সিনুর মুখের ভাষায় বিস্মিতও হয়। ফলে তার চোখ গরম হয় কিঞ্চিৎ। দৃঢ়, শীতল কণ্ঠে সতর্ক করে,

‘ মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ সিনু! উনি ভুল করেছে৷ অন্যায় করেছে। আমি এর প্রতিবাদ করেছি। উনার সঙ্গে যা বোঝাপড়া সব আমার হবে৷ তুই কিছু বলবি না৷ না উনার সামনে আর না আড়ালে। কারণ আমার বউকে এসব মানায় না। ‘

সহসা চুপ হয়ে গেল সিমরান। ক্রোধের বশে মাথা বিগড়ে গেছে তার৷ নিজেকে কেন জানি সামলাতে পারছে না৷ সৌধ ভাই এমন উগ্রতা পছন্দ করে না৷ জানে সে৷ তবু করে ফেলল৷ লজ্জায়, দুঃখে মাটির সঙ্গে যেন মিশে গেল মেয়েটা। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,

‘ সরি। ‘

সৌধ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এবারে তার দৃষ্টি সহজ হলো। সিমরান কাঁদছে। এবার নীরবে অশ্রু ঝড়ছে তার৷ ঢোক গিলল সৌধ। চোখ বুঁজে নিজেকে শান্ত করে পুনরায় তাকাল সিনুর দিকে। হাত বাড়ালো। মাথায় আলতো বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ আমি নিজেও সরি সিনু৷ যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। কথা দিচ্ছি, এটাই প্রথম এটাই শেষ এ বাড়িতে তোকে আর অসম্মানিত হতে হবে না। যদি হতে হয় তবে সেদিনই এ বাড়িতে তোর আর আমার শেষ দিন৷ ‘

একটু থেমে আবারো বলল,

‘ আমার স্ত্রীর অসম্মান মানে আমারো অসম্মান সিনু৷ আর সৌধ চৌধুরী অপমানিত, অসম্মানিত স্থানে নিজের ছায়াও মাড়ায় না। ‘

শিউরে ওঠল সিমরান। চট করে মাথা তুলতেই ওর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে দিল সৌধ। বলল,

‘ কাঁদিস না। আমি কেন জানি তোর কান্নাটা সহ্য করতে পারছি না৷ বিলিভ মি, ‘

আকস্মিক গলায় কান্না আঁটকে গেল সিমরানের৷ বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে, বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সৌধ উঠে গিয়ে টিস্যু বক্স নিয়ে এসে বসল সম্মুখে। এরপর সযত্নে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

‘ তুই আমার জীবনের সেই দ্যুতি সিনু। ঘন অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে থাকতে আচমকা যার দেখা পেয়েছি আমি। আমার সানশাইন রূপে ধরা দিয়েছিস তুই। ‘

থামল সৌধ। এরপর চোখের পানি মুছা শেষে মুখের ওপর এলোমেলো হয়ে থাকা ছোটো-ছোটো চুলগুলো ঠিকঠাক করে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

‘ আমার জীবনে দীর্ঘ বর্ষণ শেষে এক চিলতে ঝলমলে রোদ তুই। চৈত্রের খরা শেষে বৈশাখের অঝোরে বৃষ্টি তুই। যাই হয়ে যাক না কেন, আর কক্ষণো বলবি না, চলে যাবি৷ তোর শেষ ঠিকানা আমি৷ মহাপ্রলয় ঘটে গেলেও এই কথা যেন মুখ দিয়ে আর না বেরোয়৷ মনে থাকবে? ‘

মৃদু চমকে মাথা নাড়ল সিমরাম। অমোঘ এক ঘোরে চলে গেল যেন৷ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। সৌধ দেখল অশ্রুতে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া পাপড়িতে আবৃত কৃষ্ণকালো হরিণী চোখ দু’টো বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। যা তার হৃদয়ে শিহরণ জাগালো। মনে মনে হাসল একটু৷ এরপর ওই চোখে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় বলল,

‘ চলে যাবি? ‘

সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার ভঙ্গিতে চোখের পলক ফেলে মাথা নেড়ে না করল, সিমরান। সৌধ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে লেপ্টে দু-হাত বাড়িয়ে বক্ষগহ্বর উন্মুক্ত করে আহ্বান করল,

‘ আয়, বুকে আয়। ‘

বুকের বা’পাশে ইশারা করে বলল,

‘ এখানটায় মাথা রেখে দেখ তো কিছু শুনতে পাস কিনা? ‘

সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল সিমরানের। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল ভীষণ। সাহস করে ওঠতে পারল না ওই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার। মেয়েটা যে কঠিন পর্যায়ের নাজুক। সৌধই যে তার জীবনের প্রথম প্রণয় পুরুষ। সিমরান সাহস করে ওঠল না বলেই হয়তো সৌধর ইন্দ্রিয়শক্তি আন্দোলন শুরু করল। হৃদয় তৃষ্ণার্ত হলো, একবারটি মেয়েটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়ার। মনটা চনমনে হলো, যে গালে ঝুমায়না ভাবি আঘাত করেছে সে গালে এক টুকরো আদুরে শীতল স্পর্শ দেয়ার। নাজুক মেয়েটা যে নিজে থেকে আগাবে না বুঝে ফেলল সৌধ। বউ একটু বেশি জুনিয়র হলে এটাই সমস্যা। তাদেরকে নিজের অনুভূতি, চাওয়া পাওয়া গুলো পড়াশোনার মতো করে বুঝাতে হয়, মুখস্থ, টুটস্থ করাতে হয়। আপাতত সৌধর কোনো চাওয়া, পাওয়া নেই। আছে এক টুকরো অনুভূতি। যে এক টুকরো অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে সে অনুভূতির সাগরেই ডুব দিতে চায় অল্প পরিসরে।

বউকে কষ্ট পেতে দেখে যে স্বামীর বুকে অশান্তি জাগে না পৃথিবীর বুকে সে স্বামী, সে পুরুষ কলঙ্কিত। সৌধ কলঙ্কিত স্বামী, পুরুষ কোনোটাই নয়। তাই তো নিজ উদ্যেগেই কাছে টেনে নিল সিনুকে। দু-হাতের অঞ্জলিতে কোমল গালদুটো ধরে টকটকে লাল বর্ণীয় গালটায় প্রগাঢ় ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। গভীর সে চুম্বন গালে দিলেও সিমরানের বুকের গহীনে থাকা হৃদয়টুকু স্বর্গীয় সুখে ছটফটিয়ে ওঠল। টের পেয়ে চুম্বন আর দীর্ঘ করল না সৌধ। সযত্নে বউয়ের দেহাশ্রী বুকের ভেতর জড়িয়ে নিল। মৃদুস্বরে বলল,

‘ চলে গেলে এই আদরটা মিস হয়ে যেত না? ‘
.
.
রোজকার নিয়মেই ভোরবেলা ঘুম ভাঙল সৌধর। তার অনেকটা কাছেই গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সিমরান। ওর সে ঘুমন্ত মুখশ্রীতে তাকিয়ে গতকাল রাতের কথা স্মরণ হয়ে গেল। মৃদু হাসল সে। গতরাতে কত বুঝিয়ে আদর দিয়ে শান্ত করতে হলো মেয়েটাকে। সহসা টের পেল ধীরে ধীরে সিনু তার সর্বস্ব জুড়ে রাজ করে বেড়াবে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে ডাকতে উদ্যত হলো সিমরানকে। নামাজের সময় শেষ হয়নি৷ ভাবল, দু’জন মিলে নামাজ পড়ে, শরীর চর্চা করবে৷ এমন সময় মনে পড়ে গেল নিধির কথা। আজ তো নিধির সঙ্গে দেখা করতে যাবে সে। এ ব্যাপারে কি সিনুকে বলা উচিত? একবার ভাবল, কী দরকার। মুখে যতই প্রকাশ না করুক মনে মনে ঠিকই কষ্ট পাবে৷ পরোক্ষণেই আবার চিন্তা করল, কষ্ট পাবে ভেবে না জানিয়ে দেখাসাক্ষাৎ করে এলে পরবর্তীতে জেনে আরো বেশি কষ্ট পাবে। ভুলও বুঝতে পারে৷ উন্মাদের মতো ভালোবাসে বলে এই মেয়ে একদমই দুর্বল নয়৷ যেখানে বিয়ের প্রথম রাতে তারা একে অপরকে কথা দিয়েছে। কেউ কারো থেকে কিচ্ছু লুকাবে না। সেখানে আজ এটা লুকালে কথা ভঙ্গ করা হবে। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে তাই সিদ্ধান্ত নিল, সিমরানকে জানিয়ে তবেই যাবে নিধির সঙ্গে মিট করতে। সুহাস আর নামীকে এক করতে নিধির সাহায্য তার লাগবেই লাগবে। এটাও বোঝাতে হবে সিনুকে৷

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে