ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৬৫+৬৬

0
1011

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৫|
ভোর রাত থেকে ঝুম বৃষ্টি। আজ সারাটা দিন বৃষ্টির জলে ভেজা৷ এই বৃষ্টিস্নাত পরিবেশেই সম্পন্ন হলো সৌধ, সিনুর বউভাতের আনুষ্ঠান৷ অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শেষে সিমরানকে তার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। ভারি পোশাক ছেড়ে হালকা পোশাকে তৈরি হতে বলেছে সবাই৷ সৌধ আত্মীয়, স্বজন বন্ধু, বান্ধবীদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। তাদের বিদায় দিয়ে তবেই উপরে আসবে। ততক্ষণে সিমরান পোশাক ছেড়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। সৌধ এলো পঁচিশ মিনিট পর। সুট ছেড়ে টি-শার্ট, প্যান্ট পরবে। তাই কাভার্ডের কপাট খুলে সেগুলো বের করতে উদ্যত হতেই কল এলো আইয়াজের।
অমনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।
প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে সিমরানকে বলে গেল,

‘ সিনু, একটা টি-শার্ট আর তার সাথে মিলিয়ে জিন্স বের করে রাখ তো। আমি জাস্ট দু’মিনিটে আসছি। ‘

সৌধ বেরিয়ে গেল। সিমরান ত্বরিত কাভার্ডের সামনে গিয়ে নিজের পছন্দ সই টিশার্ট, প্যান্ট বের করে যত্ন সহকারে রেখে দিল বিছানায়। এরপর কী যেন ভেবে টি-শার্টটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। এ ঘরের সবকিছুতে আলাদা সৌন্দর্য বিরাজমান। এই যেমন এই টিশার্ট, প্যান্টের মাঝেও অন্যরকম সৌন্দর্য আর সুবাসে ভরপুর। হাত বাড়িয়ে টি-শার্টে ছুঁয়ে দিল সিমরান। খেয়াল করল, টি-শার্ট, প্যান্ট দু’টোই হুগো বস ব্র্যান্ডের। আনমনে হাসল মেয়েটা। সৌধ ভাইয়ের মাঝে বস বস একটা ব্যাপার পূর্ব থেকেই লক্ষণীয়। এজন্যই বোধহয় তাদের বন্ধু মহল নিয়ে গড়ে তোলা ক্লাবটির নামও দিয়েছে বিগ বস। একটুক্ষণ পরই সৌধ ফিরে এলো। হাতে একটি ফাইল নিয়ে। নিখুঁতভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে ওগুলো কারো প্রেসক্রিপশন। সৌধ কোনো ভণিতা ছাড়াই ওগুলো সিমরানকে এগিয়ে দিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বিছানায় রেখে দেয়া পোশাক গুলো নিয়ে বলল,

‘ ভেতরে কী আছে এখন দেখার দরকার নেই। লাগেজে রেখে দে। ও বাড়িতে গিয়ে দেখব৷’

ভ্রু কুঁচকে গেল সিমরানের। অন্তঃকোণে জাগ্রত হলো কৌতূহল। হাতে থাকা জিনিসটির দিকে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে ঢোক গিলে বলল,

‘ কী আছে? ‘

বাথরুমে ঢোকার পথে ফিরে তাকাল সৌধ। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ কী বললাম আমি? ‘

চকিতে তাকাল সিমরান। সচেতন হয়ে মিহি স্বরে বলল,

‘ আচ্ছা বাড়ি গিয়েই দেখব। ‘

মৃদু আওয়াজে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল সৌধ। সিমরান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে লাগেজে ওঠিয়ে রাখল অদম্য কৌতূহল জাগ্রত করা বস্তুটি৷ তার মাথায় এখন অন্য আরো একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কাল তাদের বিয়ে হলো। আজ সম্পন্ন হলো বউভাত। দুটো অনুষ্ঠানের কোনোটাতেই নিধি আপু উপস্থিত নেই৷ এত বন্ধু, বান্ধবের ভীড়ে নিধি আপু নেই৷ অথচ এটা নিয়ে কেউ টু শব্দটিও করল না৷ মুখ ফস্কেও কেউ উচ্চারণ করল না, ‘ নিধি আসেনি! ‘ বিষয়টা কেমন যেন লাগছে সিমরানের। সবাই কি ইচ্ছে করেই চুপচাপ আছে?
.
.
খন্দকার বাড়ি :

নতুন জামাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত সিমরানের মামিরা৷ কাজিনরা ঘিরে ধরেছে সৌধকে৷ এত আনন্দ, হৈচৈ ভালো লাগছে না সৌধর৷ বিরক্ত হচ্ছে। সুহাসের মামাত ভাই, বোন গুলা পাখির মতো কিচিরমিচির করছে। নতুন জামাই ট্যাগ লেগে যাওয়াতে ওঠতে পারছে না, আর না পারছে স্বস্তি নিয়ে বসে থাকতে। মনের ভেতর চলছে তীব্র উত্তেজনা। বন্ধু সুহাসকে নিয়ে মারাত্মক টেনশন ফিল করছে৷ তীব্র দুঃশ্চিন্তা মনে পুষে পারিপার্শ্বিক উল্লাসে মেতে থাকার সাধ্য হচ্ছে না৷ আইয়াজ আশপাশেই ছিল। দুঃশ্চিতার ছাপ পড়েছে ওর চোখেমুখেও। কী দুর্ধর্ষ এক মুহুর্ত আসতে চলেছে ওরা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। আইয়াজের ছুটি শেষ। ফারাহকে নিয়ে আগামীকালই চলে যাবে সে। বিয়ে উপলক্ষে সৌধ গুটিকয়েক দিন বেশি ছুটি পেয়েছে। ছুটি শেষ হলে সেও চলে যাবে। এরপর সুহাস কী করবে? সব সত্যি জানার পর সে কি পারবে প্রকৃতির নিয়মে জীবন অতিবাহিত করতে? কাজে মন যোগাতে? ভাবতে পারল না আর। সৌধ, আইয়াজ, ফারাহ তিনজনই রুদ্ধশ্বাস এক মুহুর্ত কাটাতে লাগল।

বান্ধবী লুনা চলে যাবে৷ তাই তাকে এগিয়ে দিতে গেল সিমরান। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানেই লুনা সৌধকে নিয়ে ভূরিভূরি বদনাম শুরু করল। আর সিমরানের কানের বারোটা বাজানোর পাশাপাশি মাথা গরম করে, মনটা দিল বিগড়ে।
***
‘ তোর জামাই রসিক না রে সিনু। ‘

‘ কী একটা কর্কশ ছেলে বিয়ে করলি রে, হাসি তামাশাও করতে পারছি না। গাল দুইটা শক্ত করে কেমন করে জানি তাকায় থাকে। ‘

‘ এমন জামাই নিয়ে ক্যামনে সংসার করবি? ‘

‘ আহারে বেরসিক, আনরোমান্টিক জামাই জুটল তোর কপালে। ‘

‘ কী দেখে এমন ছেলের প্রতি দিওয়ানা হইছিলিরে বোন। ‘
***
এ রূপ নানারকম কথা বলে অকস্মাৎ আলতো হাতে সিমরানের গাল চেপে ধরল। এদিক, সেদিক মুখ ঘুরিয়ে গ্রীবাদেশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ কীইইরে ভাউ, তোর শরীরে কোনো চিহ্নই তো দেখি না। হারিকেন আনা লাগব নাকি দোস্ত? ‘

সিমরান গম্ভীর গলায় বলল,

‘ আমাদের মাঝে ওসব কিছু হয়নি। চিহ্ন আসবে কী করে। ‘

‘ হোয়াট! তোরা বাসরটাসর করিসনি? ‘

সরল উত্তর সিমরানের,

‘ না। ‘

প্রিয় বান্ধবী তাতে কী? ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে এত এত বদনাম সহ্য হয়? সিমরান মোটেই অবলা মেয়ে নয়। তার যত নমনীয়তা সব এক ঐ সৌধ ভাইয়ের জন্যই। বাকিদের সামনে সে মোটেই পুরোদস্তুর নরম নয়। সোহান খন্দকারের মেয়ে হিসেবে যেমন কোমলতা, নীতিবোধ রয়েছে তেমনি ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে হিসেবে আছে ক্রোধ, জেদ। আর আছে সুহাস খন্দকারের বোন হিসেবে লাগাম ছাড়া সব পাগলামি। লুনা ঠাওর করে ওঠতে পারেনি তার বান্ধবীটি হৃদয় গভীরে ডক্টর সৌধ চৌধুরীর জন্য কী ভয়ানক প্রেম, প্রগাঢ় ভালোবাসা, সীমাহীন শ্রদ্ধা পোষণ করে। তাই তো সে যখন তাদের প্রথম রাতে স্বাভাবিক যে সম্পর্কটি গড়ে ওঠে তা হয়নি বলে পিঞ্চ করে বলল,

‘ সর্বনাশ দোস্ত। তোর জামাই মানে তোর গ্রেট সৌধ ভাই ইমপোট্যান্ট নয়তো? ‘

নিমেষে মাথায় রক্ত ছলকে ওঠল সিমরানের। সৌধ ভাই পুরুষত্বহীন নয়তো! এমন একটি সন্দেহজনক প্রশ্ন লুনা কী করে করতে পারল! শরীর রিরি করে ওঠল রাগে। ইচ্ছে করল লুনাকে কষিয়ে দু’টো থাপ্পড় লাগাতে৷ পরোক্ষণেই দমে গেল এত বছরের বন্ধুত্বের খাতিরে৷ কেবল অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ লুনা! সৌধ ভাইকে নিয়ে এত বড়ো কথা তুই কোন সাহসে বললি? ‘

কথাটা বলেই মৃদু ধাক্কা দিয়ে লুনাকে নিজের অনেকটা দূরে সরিয়ে দিল। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফের বলল,

‘ তুই লাগাম ছাড়া জানতাম। তাই বলে আমার হাজব্যন্ডের ব্যাপারেও এটা দেখাবি সেটা জানতাম না৷ আই হেট ইউ লুনা, আমার সৌধ ভাইকে নিয়ে এমন একটা শব্দ তুই বলবি কখনো ভাবিনি। আই জাস্ট হেট ইউ। ‘

কথাগুলো বলেই প্রায় ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল সিমরান। লুনা হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কী এমন বলল সে? যে সিনু তাকে আই হেট ইউ বলল। আশ্চর্য! একটা ছেলেকে এত স্ট্রাগল করে বিয়ে করলি। অথচ বাসর রাতে সে তোর সাথে বাসরই করল না। কেন করল না? পাশে একটা যুবতী মেয়ে শুয়ে থাকলে অটোমেটিকলি যুবক ছেলেদের দেহে সুড়সুড়ি জাগে৷ তোর বরের সুড়সুড়ি নেই বলেই তো তোকে কিছু করেনি৷ করলে নিশ্চয়ই আমি এভাবে বলতাম না। ঢং। প্রেমে পড়ে মাথা তো গেছেই। শখ, আহ্লাদও বিসর্জন দিয়ে দিছে। মুখ বাঁকালো লুনা৷ বুঝে গেল এই মেয়ে এখন আর তার সঙ্গে কথা বলবে না। যতক্ষণ না রাগ কমবে৷ তাই মিটিমিটি হাসতে হাসতে রিকশা ডাকল। রিকশায় ওঠার পর হঠাৎ মনে পড়ল সিনুকে আসল কথাটাই বলা হয়নি। সে যে তার ড্যাম কেয়ার চাচা শশুরের প্রেমে পড়েছে। এ খবর জানানো হয়নি। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল লুনা। তাহানীকে পটিয়ে ওর আব্বুর পার্সোনাল ফোন নম্বর কালেক্ট করে নিয়েছে। আগে পটাবে পরে বান্ধবীকে জানাবে৷ সে পর্যন্ত ওর মন থেকে তার প্রতি ঘৃণা কমে আসুক। রিকশা চলতে লাগল। লুনা ভাসতে লাগল নব্য প্রণয়ের বাতাসে। বরাবরই তার অল্প বয়সী ছেলেদের প্রতি বিতৃষ্ণা। সেই যে প্রথম এক অল্পবয়সের তরুণ থেকে ধোঁকা পেল, খেল প্রেমে কঠিন এক ছ্যাঁকা। এরপর আর প্রেমে পড়া হয়নি। সে সব সময় খুঁজেছে ডিফ্রেন্ট কাউকে। যার হৃদয় ভেঙেছে। প্রিয়জন হারিয়ে যে গভীর শোকাহত। সুলল চৌধুরীই সেই মানুষ। যাকে দেখে তার হৃদয়ে টান পড়েছে। ভারিক্কি দেহের, গম্ভীর মুখের আড়ালে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক ওই মনটাকে ভীষণ ভালো বেসে ফেলেছে। পরিহিত শার্টের কলার ঠিক করতে করতে লুনা ভাবল, সবই ঠিক আছে৷ হবু শশুর বাড়ির সবাইকে পছন্দ হয়েছে তার। অপছন্দ শুধু, হবু ভাতিজা সৌধ, আর বুড়িটা! আচমকা জিভ কাটল লুনা। শব্দটা শুধরে নিয়ে বলল, হবু শাশুড়ি আম্মাটা।
.
.
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবিরাম বৃষ্টি ঝরল। সন্ধ্যার পর থেকে সে বৃষ্টি রূপ নিল তুমুল বর্ষণে। রাত বাড়তে বাড়তে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে প্রকট বজ্রপাতের শব্দও শোনা গেল। দীর্ঘমাস উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কাটানোর পর হঠাৎ এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশ, হিম ধরা আবহাওয়ায় সকলের দেহ, মনে আর্দ্র আরাম বোধ হলো৷ রাতের খাবার খেয়ে যে যার মতো চলে গেল উষ্ণ, নরম বিছানায়। প্রশান্তিময় একটি ঘুম দেবে বলে। কেবল ঘুমাতে গেল না, আইয়াজ, ফারাহ, সৌধ, সিনু আর সুহাস৷ তারা সকলে মিলে গোপন বৈঠক বসাল সুহাসের ঘরে। আকস্মিক বন্ধুদের এমন গোপন আসর বসানোর মানে টের পেল না সুহাস৷ যেহেতু ফারাহ, আর সিনুও উপস্থিত সেহেতু গভীর করে কিছু ভাবলও না৷ সে ভীষণ আয়েশ করে ডিভানে বসে ফোন হাতে নিল। দেখল, প্রাচীর ম্যাসেজ – ‘ দোস্ত পৌঁছে গেছিরে। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়েই ঘুম দিব৷ ‘ প্রাচীর ম্যাসেজটা নিজে পড়ে সকলকে জানালো,

‘ প্রাচী পৌঁছে গেছে। ‘

কথাটা বলে তাকাল সবার দিকে। কেউ যেন এ বিষয়ে আগ্রহই দেখালো না। তার মনে হলো সবাই অন্য জগতে বিভোর। নিমেষে কপালে ভাঁজ পড়ল সুহাসের। তার ছোটো ছোটো ধূসর রাঙা চোখ জোড়া আরো ছোটো হয়ে গেল। ফারাহ স্তব্ধ মুখে তার বিছানায় বসে আছে। পাশে সিনু। বোনের মুখটাও ভীষণ থমথমে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে এমন একটি ভাব। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে সুহাসের। বলে,

‘ কী হয়েছে রে সিনু? কোনো সমস্যা। ‘

সিনুকে প্রশ্নটি করলেও তাকায় টি টেবিলের ওপর বসে থাকা আইয়াজের দিকে। মুখ ভাড় আইয়াজের। টের পেল ওর ভীষণ মন খারাপ। পাশাপাশি মারাত্মক দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে। আইয়াজকে কিছু প্রশ্ন করতে উদ্যত হবে অমনি কাঁধে বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেল। মৃদু চমকে তাকাতেই সৌধর গুরুগম্ভীর মুখটা ভেসে ওঠে। এ পর্যায়ে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে সুহাস৷ কেন যেন তার অবচেতন মনে ভয়ের সঞ্চার হয়৷ আমতা আমতা করে বলে,

‘ কী হয়েছে বল তো? ‘

সৌধ ছোট্ট একটি ফাইল উঁচিয়ে ধরে। তাকায় সিমরানের দিকে। মেয়েটা বহু কষ্টে নিজের ইমোশন ধরে রেখেছে। সুহাসের ঘরে আসার আগে সিমরানের ঘরে মিটিং হয়েছে একঘন্টা। সব শুনে, নিজ চক্ষে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় সিমরান৷ উত্তেজনায় দেহ কাঁপতে শুরু করে ওর। অবিশ্বাসে, বিস্ময়ে একাকার হয়ে রয়৷ রাগ, দুঃখ, আফসোস ঘিরে ধরে। তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলেছে! তার ভাবিপু প্র্যাগনেন্ট! ভাইয়া বাবা হবে, সে ফুপি হবে, আব্বু দাদান আর আম্মু দাদুনি। নিমেষে মুখে ওড়না চেপে ডুকরে ওঠে সিমরান। তাকে সামলায় সৌধ, ফারাহ। বুঝিয়ে, শুনিয়ে কান্না থামায়। কারণ এখন তাদের কাঁদলে চলবে না৷ এতবড়ো একটি খুশির খবর থেকে সুহাস বঞ্চিত। বঞ্চিত নিজের অধিকার থেকেও। সুহাসকে খুশির খবর জানাতে হবে। ওর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আর এর জন্য তাদের সবাইকে এখন সুহাসের পাশে থাকতে হবে, সাপোর্ট দিতে হবে৷ সিনু যেমন অবুঝ তেমন বুঝদারও। সৌধ যখন তাকে শান্ত ভাবে শীতল কণ্ঠে বুঝাচ্ছিল। মাথায় দিয়েছিল ভরসা ভরা একটা হাত। কান্না থামিয়ে অনুভূতি লুকিয়ে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল সে৷

সৌধ যখন তাকায় সিমরান ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেবে প্রায়। ত্বরিত সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তর্জনী উঁচিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে তাকে চুপ থাকতে বলে। ইশারায় বোঝায়, সুহাসের পাশে এসে বোস। কিয়ৎক্ষণ পেরিয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সিমরান গুটিগুটি পায়ে এসে বসে ভাইয়ের পাশে। সুহাস অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বোনের দিকে। পরোক্ষণেই খেয়াল যায় সৌধর হাতে থাকা ফাইলটায়৷ সৌধ মৃদুস্বরে বলে,

‘ মাথা ঠান্ডা রেখে, মন শান্ত করে এটা দেখ। ‘

সৌধ কথাটা বলতেই পাশ থেকে কাঁপা স্বরে সিমরান বলে,

‘ আমি ফুপি হতে চলেছি ব্রো। আর তুমি পাপা! ‘

আচম্বিতে বৈদ্যুতিক ঝটকা লাগে সুহাসের বুকে। তার ছোটো ছোটো চোখ দু’টোর আকার বড়ো হয়ে যায়। সিমরানের মুখ নত৷ কাঁপছে সে। সুক্ষ্ম চোখে বোঝা গেল মেয়েটা কাঁদছে। বারকয়েক পলক ফেলে সুহাস৷ নিঃশ্বাসে উদ্যেগ নেই। চোখে শুধু কিঞ্চিৎ বিস্ময়৷ সে অল্প বিস্ময়ই বিস্তর হয় যখন এপাশ থেকে সৌধ বলে,

‘ কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত, বাবা হচ্ছিস৷ কংগ্রাচুলেশনস টু মি একসঙ্গে চাচা, ফুপা দু’টোই হচ্ছি। ‘

টি টেবিল সহ এগিয়ে এলো আইয়াজ। সুহাসের মুখোমুখি হয়ে বসে বলল,

‘ কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত। ‘

এরপর স্মিত হেসে সৌধকে বলল,

‘ আমিও চাচা হওয়ার পাশাপাশি খালু হচ্ছি। ফারাহ তো সম্পর্কে খালাই হবে, না? ‘

আইয়াজের কথা শুনে চোখে জল এসে গেল ফারাহর৷ নিরবে সে জলটুকু মুছে নিয়ে তাকাল সুহাস ভাইয়ের দিকে। বোন এবং বন্ধুদের কথা শুনে বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল সুহাসের৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শেষ আশ্রয় হিসেবে তাকাল ফারাহর দিকে। ফারাহ মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। অর্থাৎ সবাই যা বলছে সব সত্যি। মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠল সুহাসের৷ অনুভব করল তার বুকের ভেতর কিছু একটা কাঁপছে। কণ্ঠনালী শুঁকিয়ে রুক্ষ। বহু কষ্টে একবার ঢোক গিলল। হাতে থাকা ফাইল ঘেঁটে দেখতে শুরু করল তৎক্ষনাৎ। এতক্ষণ ধরে দু’কানে যা সব শুনছিল তার সত্যতা মিললে তীব্র উত্তেজনায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করল ছেলেটার৷ বুকজুড়ে কী ভীষণ সুখ সুখ সুবাস! অদ্ভুত এক আনন্দানুভূতিতে ডুবে গেল মন৷ বাবা, শব্দটি ছোট্ট। অথচ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবী সমান সব গভীরতা। বাবার ছায়াতলে থাকা ছেলেরাও একসময় বাবা হয়ে যায়। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরশিরানি অনুভব করল সুহাস। দীর্ঘসময় একটা ঘোরে থেকে তীব্র উত্তেজনায় ভোগার পর যখন রিপোর্টে থাকা তারিখে চোখ পড়ে নিমেষে থমকে যায় । নামী প্র্যাগনেন্ট, মা হতে চলেছে নামী আর সে বাবা। এই রিপোর্ট গুলো সেদিনের। যেদিন নামী আর তার মাঝে তুমুল ঝগড়া হয়। নামী সারাদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলে সেই ঝগড়া বিধ্বস্ততায় রূপ নেয়। সে রাগের বশে গায়ে হাত তুলে নামীর! মস্তিষ্কে রক্ত ছলকে উঠে সুহাসের। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয় তীব্র। স্তম্ভিত মুখাবয়ব নিয়ে তাকায় সৌধর পানে৷ সৌধ দেখে সুহাসের চোখ দু’টো রক্তিম আভায় ভরে ওঠেছে৷

গুমোট একটা পরিস্থিতি। নিজেকে কোনোমতেই স্থির করতে পারছে না সুহাস৷ বারবার, বারবার নামীর প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট গুলো দেখছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট দেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বন্ধুর দিকে। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না নামী তার সন্তানের মা হতে চলেছে। এরচেয়েও বেশি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এমন একটা সময় নামী তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে। একটা মেয়ে কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? প্রশ্নটি মাথায় আসতেই ঘেমে ওঠে সুহাস। আকস্মিক ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে,

‘ এটা কোথায় পেলি তোরা? ‘

তার এক চিৎকারে সিমরান, ফারাহ দু’জনেরই রূহ কেঁপে ওঠে৷ সৌধ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আইয়াজ খুলে বলে কীভাবে ফারাহ রিপোর্টটা পেল। অসহনীয় হয়ে ওঠে সুহাস। রিপোর্ট গুলো সিমরানের দিকে ঠেলে দিয়ে দু-হাত মুঠো করে নিজেকেই আঘাত করতে শুরু করে আর বলতে থাকে,

‘ আমার সাথে এটা কেন হলো! ও কেন এটা করল আমার সাথে। নামীইইই! ‘

আইয়াজ এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। সৌধ উত্তেজিত গলায় বলে,

‘ সুহাস শান্ত হো। সব সময় মাথা গরম করে উল্টাপাল্টা কাজ করিস বলে তোকে ভুগতে হয়। প্লিজ দোস্ত এবার অন্তত মাথা ঠান্ডা রাখ। মাথা গরম করলে কিচ্ছু সমাধান হবে না। ‘

আইয়াজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে সুহাস৷ ভাইয়ের করুণ অবস্থা। অসহায় আর্তনাদ শুনে সিমরানের চোখ বেয়ে অবিরত জল গড়াচ্ছে। চোখ, মুখ ভয়াবহ লাল। সৌধ খেয়াল করে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ সিনু, ঘরে যা৷ আমরা সুহাসকে সামলাচ্ছি। ‘

কথা শুনল না সিমরান। সৌধ এবার ফারাহর দিকে তাকাল। বলল,

‘ সিনুকে নিয়ে বাইরে যাও ফারাহ। আমরা সুহাসকে সামলে নিব৷ ‘

ফারাহ বুঝতে পারল৷ তাই তাদের স্পেস দিয়ে জোরপূর্বক সিমরানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সৌধ হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। দুই, ভাই বোন এত বেশি ইমোশনাল। একজন আরেকজন সামলাবে তো দূরের কথা। দু’জন দু’জনের গলা জড়িয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল! মনে মনে কথাগুলো বলেই সুহাসের দিকে তাকাল। সিমরান চলে যাওয়ার পর আইয়াজ বসেছে ওপাশে। সুহাস একটু থামলেও উদ্ভ্রান্তের মতো কী সব বিলাপ করছে। সৌধ ডাকতেই সে চিৎকার করে ওঠল,

‘ নামী এত বড়ো বেইমানি কী করে করল আমার সাথে? মানছি সেদিন আমার আচরণ উগ্র ছিল৷ মা মারা যাওয়ার পর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না আমাকে নিয়ে মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়নি বলে। আর এর জন্য নামী দায়ী৷ ও কি অস্বীকার করতে পারবে ওর কোনো ভুল নেই? সবকিছুর পরও আমি ওকে ভালোবেসেছি সৌধ৷ আমি ওকে কতটা ভালোবেসেছি ও বুঝল না৷ ও শুধু আমার উগ্রতাটুকুই দেখল৷ ভালোবাসা, যন্ত্রণা কিচ্ছু দেখল না। আর শেষ পর্যন্ত দিয়ে গেল এতবড়ো একটা শাস্তি! ‘

কথাটা বলেই তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। প্রলাপ করতে লাগল,

‘ আমি নামীর কাছে যাব। আমি আমার বাচ্চার কাছে যাব৷ নামী এতবড়ো শাস্তি আমাকে দিতে পারে না। আমি এতটা আঘাত পেতে পারি না। নামী আমার সাথে স্বার্থপরতা করতে পারে না৷ ও এতটা পাষাণ হতে পারে না। ‘

সুহাসের অবস্থা দেখে সৌধ আইয়াজ দু’জনি দুদিক থেকে কাঁধ চেপে ধরে বসিয়ে দিল ওকে। আইয়াজ থমথমে স্বরে বলল,

‘ কীভাবে যাবি নামীর কাছে? ও তো দেশেই নেই। ‘

সৌধ দৃঢ় গলায় বলল,

‘ সুহাস মাথা ঠান্ডা কর। নামী এখন অ্যামরিকায় আছে। চাইলেই এই মুহুর্তে সেখানে যাওয়া সম্ভব না৷’

আচমকা সামনে থাকা টি টেবিলটায় ভয়ংকর এক লাত্থি বসিয়ে দিল সুহাস৷ টেবিল ছিটকে বিছানার সাথে ধাক্কা খেয়ে শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে রইল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,

‘ কী করে মাথা ঠান্ডা রাখব আমি? নামী আমার সন্তানে মা হতে চলেছে। আর সেটা আমাকে না জানিয়ে চোরের মতো এদেশ থেকে পালিয়ে গেছে। ছাড়ব না ওকে আমি, জাস্ট ছাড়ব না। আমার ভালোবাসা, ইমোশন সব নিয়ে খেলেছে ও। কিন্তু আমার সন্তানকে নিয়ে খেলা করতে দিব না৷ ‘

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সৌধর। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত কোমরে রাখল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিয়ে আইয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ ডাফারটাকে তুই বোঝা। আমার হাত নিশপিশ করছে ওর মুখে ইচ্ছে রকম কয়টা ঘু ষি দিতে। ‘

হকচকিয়ে গেল আইয়াজ। চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

‘ আহা তুই মাথা গরম করলে চলবে? ‘

সৌধকে প্রশ্নটা করেই সুহাসের পিঠে হাত বুলাতে শুরু করল আইয়াজ। বলল,

‘ দোস্ত যা সিচুয়েশন মাথা গরম করে লাভ হবে না৷ একটু ঠান্ডা হো প্লিজ। ‘

সৌধ রাগান্বিত হয়েই সুহাসকে পিঞ্চ করল,

‘ ঠিক সময় নামীর কাছে পৌঁছাতে না পারলে তোর সন্তান নিয়ে নামীই আগে খেলা করবে। মুখে বড়ো বড়ো কথা আর তেজটাই আছে৷ তুই আমার বন্ধু, পেশায় ডাক্তার এসব ভাবতেই লজ্জা করছে। কী পরিমাণ অকর্মণ্য হলে একজন পুরুষের বউ গর্ভবতী হয়ে বাচ্চা নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে অ্যামরিকায় চলে যায়। আর সে সেটা জানতেই পারে না। আশ্চর্য! দোষ তো নামীর না, দোষ তোর৷ তুই কেমন পুরুষ যে বউকে কন্ট্রোল করতে পারিস না? কই আয়াজের বউ তো গেল না। তোর বউ কেন গেল? ‘

মাথা দপদপ করছে সুহাসের। সৌধ থেমে গেল। আইয়াজ হতভম্ব মুখে বসে। অনেক সময় পিনপতন নীরবতা চলার পর সুহাস মুখ খুলল,

‘ নামীর জেদ বেশি সৌধ৷ আমারো খামখেয়ালিপনা আছে। সেটা স্বীকার করছি৷ তাই বলে ও এভাবে ঠকাবে আমায়? ওই সন্তানটা তো ওর একার না। ‘

কথাটা বলেই আকস্মিক কেঁপে ওঠল সুহাস। ভীত গলায় বলল,

‘ এক মিনিট! নামী বাচ্চাটাকে রেখেছে তো? এমন তো নয় ও আমার ওপর জেদ করে মিসকারেজ করিয়ে তারপর অ্যামরিকায় চলে গেছে! ‘

ধমকে ওঠল সৌধ। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

‘ ইম্পসিবল। নামীর দ্বারা এটা সম্ভব না। ‘

তীব্র ক্ষোভ আর তাচ্ছিল্য সহকারে সুহাস বলল,

‘ ওর মতো নিষ্ঠুর, পাষাণ চরিত্রের মহিলার পক্ষে সবই সম্ভব। ‘

ক্ষুব্ধ হয়ে এ কথা বললেও মনে আশার আলো ঠিকই রয়ে গেল সুহাসের৷ ঝাপসা চোখে তাকাল সৌধর পানে। অনুনয়ের স্বরে বলল,

‘ দোস্ত আমার নামীকে চাই, ওর গর্ভের বেবিকে চাই আমার। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৬|
বৃষ্টি থেমেছে। জানালার থাই গ্লাসে বৃষ্টিফোঁটাদের চিহ্ন রয়ে গেছে। সেদিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে অজস্র চিন্তায় নিমজ্জিত সিমরান। এ পৃথিবীতে আগত সবকিছুই বিদায়বেলা চিহ্ন রেখে যায়। পৃথিবীতে বৃষ্টি নেমেছিল। সে বৃষ্টি থেমেও গেছে। রেখে গেছে জানালার থাই গ্লাসে চিহ্ন। ঠিক তেমনি নামী এসেছিল সুহাসের জীবনে। চলেও গেছে। চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে এক গুচ্ছ ভালোবাসাময় স্মৃতি। শুধু কি চিহ্ন রেখেই গেছে নিয়ে যায়নি? সুহাসের ভালোবাসা, রাগ, জেদ, অভিমান, অপমানের পাশাপাশি আরো অনেক বড়ো একটি চিহ্ন নিজের ভেতর নিয়ে যায়নি? গিয়েছে তো। এ পৃথিবীতে এখন তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যা ঠিক তাই চিহ্ন হিসেবে নিয়ে গেছে নামীপু। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান৷ শান্ত দৃষ্টিতে দরজার পানে তাকাল। খোলা দরজা। দৃষ্টি যতটুকু যায় ততটুকুই দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। সৌধ ভাই বোধহয় আসবে না৷ তার ভাইটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি পাগলামি করছে? প্রিয় বন্ধুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সৌধ আর আইয়াজ ভাই৷ বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল সিমরান৷ হাই তুলতে তুলতে ভাবল, সে ঘুমিয়ে পড়বে। মনটা ভারাক্রান্ত, দেহটাও আর সায় দিচ্ছে না। চোখ দু’টো খুলে রাখা দায় হয়ে পড়ছে। ধীরস্থির ভাবে হেঁটে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল৷ ফিরে আসার পথে বাঁধা পেল মনে। রাত এখনো শেষ হয়নি। কেবল মাঝরাত। যদি সৌধ ভাই তার ঘরে আসে? আকস্মিক সিমরান অনুভব করল, তার বুকে শীতল শিহরণ বইছে। সময় কী নিদারুণ ভাবেই না বদলে যায়৷ এতদিন সে এ বাড়িতে এ ঘরে রাজত্ব করে বেরিয়েছে। এ বাড়ির মেয়ে সে৷ এ ঘরটা তার একদম নিজস্ব। অথচ আজ ঘুমাতে গেলেও ভাবতে হচ্ছে। দরজা আটকাতে গেলেও বোধ করছে দ্বিধা। এটাকেই কি বলে দায়বদ্ধতা? ভালোবাসা থাকলে সব ধরনের দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেও শান্তি। সহসা ঘুরে গিয়ে দরজা খুলে ত্বরিত বিছানায় চলে এলো। সে এখন ঘুমাবে। যদি সৌধ ভাই আসে তাহলেও সমস্যা নেই। সে দরজা খোলাই রেখেছে। ওই মানুষটার জন্য তার মনের দরজা, ঘরের দরজা সব সময় খোলা। ভাবতে ভাবতে মনের কোণে মৃদু সুখ ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি বজায় রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
.
.
সুহাসের বিছানাটা আলিশান৷ হাত, পা মেলে দিয়ে তিনজন অনায়াসে ঘুমাতে পারবে৷ তাই তিন বন্ধুর পাশাপাশি শোয়াতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। দীর্ঘ একটা সময় পর শান্ত হয়েছে ছেলেটা৷ বলা যায় সৌধ আর আইয়াজ মিলে শান্ত করেছে ওকে। রাত গভীর হতে হতে এক পর্যায়ে শান্ত হয় উন্মাদ সুহাস৷ কিন্তু দু-চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে নোনাপানির ধারা। তিন বন্ধুর মাঝে সুহাস সবচেয়ে ডানপিটে স্বভাবের হলেও মনের দিকে প্রচণ্ড দুর্বল। এই দুষ্টুমি, অবুঝ রাগ আর দুর্বলতা গুলো আজ যেন ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখের সামনে সুহাস এভাবে ভেঙে পড়বে আর সৌধ, আইয়াজ সেটা দেখে চুপ থাকবে? এমনটা হতেই পারে না৷ তাই তো দু’জনই অর্ধাঙ্গিনীর কাছে না ফিরে বন্ধুর কাছে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল। সুহাসও লম্বা একটা সময় স্থবির হয়ে শুয়ে থাকার পর অকস্মাৎ মুখ খুলল। সেদিন তার আর নামীর মাঝে কী কী ঘটেছিল বিবৃতি করল সবটা। সৌধ পুরো ঘটনাটিই জানত। তাই ওর মাঝে নতুন করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কিন্তু আইয়াজ ঘেমে ওঠল। মৃদু ক্রোধ প্রকাশ করে বলল,

‘ এই রাগটাই তোর সব খাচ্ছে! আর গায়ে হাত তুলতে গেছিস কোন দুঃখে? কার গায়ে হাত তুলেছিস! তোর বউ নামী। ভাই, মেয়েটাকে এখনো চিনতে পারিসনি তুই। নামী কোন ধরনের মেয়ে এটা যদি এখনো না বুঝিস তবে তো ওর তোকে ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো। শোন সুহাস, মুখ থাকলেই সব বলা যায় না৷ গায়ে জোর থাকলেই সবকিছু করা যায় না। তুই ভুল করেছিস। বউ হচ্ছে আদরের জিনিস। তাকে আদরে রাখতে হয়। নারীদের কোমলপ্রাণ। তাদেরকে সব সময় কোমল আচরণই দিতে হয়। রাগ, দেখিয়ে ব কাব কি করে, মারধর করে বউকে না ধরে রাখা যায় আর না বউয়ের মন পাওয়া যায়। আর তোর বউ এমনিতে শান্তশিষ্ট হলেও প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে। যেমন একরোখা, তেমন জেদি। তাই এগুলো মাথায় রেখে বিবেচনা করে চলা উচিত ছিল। ‘

এক নিঃশ্বাসে বলা আইয়াজের কথা গুলো শুনে
সহমত পোষণ করল সৌধ। আইয়াজ ক্রোধান্বিত হয়ে কথাগুলো বললেও ওর কণ্ঠস্বর নিচে ছিল বলে সেগুলো স্বাভাবিকই শোনালো। সুহাস মন দিয়েই শুনল ওর কথা। এরপর সৌধ বলল,

‘ আমি সম্পূর্ণ দোষ আমার বন্ধুকে দিব না। কারণ এই পৃথিবীতে সব মানুষ সমান বোঝদার হয় না। সুহাসের উচিত হয়নি নামীর ক্যারেক্টার নিয়ে প্রশ্ন তোলার। নিঃসন্দেহে এটা ভুল। গায়ে হাত তুলেও অপরাধ করেছে। তাই নামীর অ্যাকশন এভাবে না নিয়ে অন্যভাবে নেয়া উচিত ছিল। যাইহোক এখন অনেক উচিত, অনুচিত কথা আমরা বলবই। কাল সকালে যখন বাড়ির সবাই এসব জানতে পারবে তারাও নানারকম মন্তব্য করবে৷ তবে সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়ালে আমরা নিজেরা কতটুকু উচিত কাজ করতে পারতাম তা অবশ্য জানা নেই। ‘

এ পর্যন্ত বলেই থামল সৌধ। সময় নিয়ে ফের বলল,

‘ নামীকে আমি বোন বলি। সে হিসেবে আমার বোনের গায়ে হাত তোলার জন্য, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য তোকে আমার মা রা উচিত সুহাস। আটকে গেছি দু’টো জায়গাতে, এক, বন্ধু আমার তুই, অপরাধ করে এতগুলো মাস ভুগছিস আজ থেকে ভুগান্তি আরো বেড়ে গেল। এতদিন বউয়ের জন্য মন কেঁদেছে এখন যোগ হলো বাচ্চার জন্য কান্না। মানসিক যন্ত্রণার উপর আর কোনো বড়ো শাস্তি আছে বলে জানা নাই। দুই নাম্বার হচ্ছে, তুই এখন সম্পর্কে সিনিয়র হয়ে গেছিস। ‘

তীব্র বিষাদ অনুভূতিও এক টুকরো হাসি দেখা দিল ওদের মাঝে৷ হঠাৎ তড়াক করে ওঠে বসল সুহাস৷ সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে সৌধ, সিনুর৷ আজ বিয়ের দ্বিতীয় দিন, দ্বিতীয় রাত। অথচ সৌধ কিনা তার বোনের কাছে না গিয়ে তার কাছে পড়ে আছে। ওরা দু’জন কাছাকাছি না থাকলে সম্পর্কটা এগুবে কী করে? নিজের জীবনে সমস্যা বলে সেই সমস্যায় সবাইকে জড়ানোর মানে হয় না। আইয়াজটাও বউ ছেড়ে তার কাছে পড়ে আছে। সে অনিচ্ছায় বউ ছেড়ে হাপিত্যেশে ম রে যাচ্ছে। আর এরা স্বেচ্ছায় বউ ছাড়া রয়েছে। ভেবেই সৌধর দিকে বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ সিনুর ঘরে যা সৌধ। ‘

থতমত খেয়ে গেল তিনজনই। নিমেষে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক করে ফেলল সৌধ৷ ওঠে বসে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ সিনু এখনো জেগে নেই। নিজের ঘরে, একান্ত বিছানায় নিজের মতো ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আপাতত তোর ঘর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না৷ তুই খুব একটা সুবিধার ছেলে না। এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ‘

সৌধর কথা শুনে আইয়াজের দিকে তাকাল সুহাস। আইয়াজও ওঠে বসতে বসতে বলল,

‘ আমিও আজ ফারাহকে ফ্রি করে দিয়েছি। তোকে ফ্রি করে আপাতত যাওয়া সম্ভব না৷ যা ক্ষ্যাপাটে তুই। উল্টাপাল্টা করে বসলে নামী বিধবা হবে। আর হবু ভাতিজা/ ভাতিজি বাপ হারাবে। ‘

স্তব্ধ হয়ে গেল সুহাস। ওরা মজার সুরে কথাগুলো বললেও ওর ভেতরটা তোলপাড় শুরু হলো। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, নামী মা হতে চলেছে। আর এমন একটা সুখবর, রক্ত শীতল করা সংবাদ না জানিয়েই নামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে সুদূর অ্যামেরিকায়! সন্তর্পণে চোখ দুটো বুঁজে ফেলল সুহাস। নিশ্বাস ছাড়ল বড়ো বড়ো করে। অনুভব করল কাঁধে হাত রেখেছে সৌধ। আচমকা দৃষ্টি মেলে তাকাতেই ভরসার সঙ্গে সৌধ বলল,

‘ আমি জানি ভুল তুই করেছিস। সম্পূর্ণ দোষ তোর। কিন্তু নামীকে আমি সেভ সাইটে রাখতে পারছি না৷ তুই কেমন জানে ও। তাছাড়া সবকিছুর পরও তুই বাবা হতে যাচ্ছিস। তোরা স্বামী-স্ত্রী। তোর সন্তান ওর গর্ভে৷ ওর উচিত ছিল এটা তোকে জানানো৷ কী একটা কাণ্ড ঘটাল বলত। গর্ভের বাচ্চাকে মা একাই ক্যারি করে। নামীও করছে৷ কিন্তু সাপোর্ট হিসেবে তো স্বামীকে লাগে। পরিবারকেও প্রয়োজন হয়। ‘

নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাস বলল,

‘ বেবি কনসিভ করলে মেয়েদের মুড সুইং হয় সৌধ। নামীরও হচ্ছিল বোধহয়। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি। ওর মধ্যে অনেকরকম সিমটমস দেখা দিয়েছে। যা তখন খেয়াল না করলেও এখন করতে পারছি। হয়তো এজন্যই তখন ওর মাঝে রাগ, অভিমানটাই বেশি কাজ করেছে। ‘

‘ গ্রেট ইম্প্রুভমেন্ট! ‘

শব্দ দু’টো উচ্চারণ করেই পাশ থেকে আইয়াজ জাপ্টে ধরল সুহাসকে। সৌধর চোখ দু’টোও চকচক করতে লাগল। অনুভব করল, সুহাসের মাঝে এখন কোনো রাগ কাজ করছে না৷ এখন ওর মাঝে শুধু আবেগ, আর অনুতপ্ততা কাজ করছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সুহাস এখন বাবা হতে চলেছে। বাবারা উদার হয়৷ উদার হতেই হয় তাদের। প্রশান্তি ভরে শ্বাস নিয়ে মৃদু হাসল সৌধ। শুনতে পেল নিজে থেকেই সুহাস বলছে,

‘ আসলে কী বলব আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি আসলেই অমানুষ হয়ে গেছি সৌধ? আইয়াজ,
নামী নিশ্চয়ই আমাকে অমানুষ ভেবে কিছু জানায়নি। সেদিনের সেই আচরণ উফফ। ভাবতে পারছি না, আমাদের সন্তানও ছিল আমাদের মাঝে। মাই বেবি! ‘

তীব্র কষ্টে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল সুহাস। বলল,

‘ আচ্ছা ওর মায়ের মতো অও কি আমাকে খারাপ ছেলে ভাবল? অমানুষ ভাবল? ‘

পরোক্ষণেই চমকে গেল। বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে পলক ফেলল বারকয়েক। থেমে থেমে বলল,

‘ আমি সেদিন নামীর সাথে প্রচণ্ড চ্যাঁচামেচি করেছি। আচ্ছা ও কি ভয় পেয়েছে? পায়নি নারে। ওর মা তো খুব সাহসী। ও ওর মায়ের মতোই সাহসী হবে দেখিস। ‘

সুহাসের বুক কাঁপছে। চোয়াল দু’টোও কম্পমান। ঠোঁট দু’টো বার বার শুষ্ক হয়ে ওঠছে। যা ভিজিয়ে নিচ্ছে জিভ দ্বারা। বন্ধুর আবেগঘন কথা শুনে
আইয়াজের চোখ চিকচিক করে ওঠে। সৌধ ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শক্ত হাতে সুহাসের কাঁধ চেপে ধরে বলে,

‘ এত দুর্বল হলে চলবে না সুহাস। তোকে শক্ত থাকতে হবে। নিজের ভুলগুলো শুধরে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা এখন তোকে নামী অবধি পৌঁছাতে হবে, এট এনি কস্ট! ‘

‘ আমার মাথা কাজ করছে না। আমি ভুল করে ফেলেছি সৌধ। আমি আমার স্ত্রী, সন্তান দু’জনকেই কষ্ট দিয়েছি। নামী আমাকে ক্ষমা করবে না বলেই এভাবে দূরে চলে গিয়েছে। ও আমাকে অনেক বড়ো শাস্তি দিতে চায় সৌধ। ও আমাকে একেবারে নিঃশ্ব করে দিতে চায়। আমি নিঃশ্ব হতে চাই না। প্লিজ নামীকে বোঝা। ‘

মাথা নিচু করে কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলতেই হঠাৎ সৌধ বলল,

‘ কাল সকালে তোর শশুরের সাথে যোগাযোগ করবি। যতদ্রুত সম্ভব ভিসা রেডি করে চলে যা অ্যামরিকায়। ফিরে আয়, নামী আর বাচ্চা দু’জন নিয়ে। ‘

চোখ দু’টো জ্বলে ওঠল সুহাসের৷ দপ করে মাথা তুলে টলমল দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল।
.
.
স্বভাবসুলভ ভোরবেলা বিছানা ছাড়ল সৌধ৷ সারারাত তিনজনের কারোরি ঘুম হয়নি। শেষরাতে চোখ বুঁজলেও প্রকৃতপক্ষে কেউ ঘুমাতে পারেনি। শরীরচর্চা আজ করা হবে না৷ তাই ঘরের বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় হাঁটাহাঁটি করল সৌধ। এরপর ধীর পায়ে চলে এলো সিমরানের ঘরে। ভেবেছিল দরজা বন্ধ। নক করতে হবে। কিন্তু না বুঝতে পারল, দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছে। তবে কী সিনু অপেক্ষায় ছিল তার জন্য? এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের বাতি জ্বালানো। দরজাটাও খোলা। যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল সৌধর। ঘরে ঢুকতেই দৃষ্টি চলে গেল বিছানায়। নিমেষে দৃষ্টি সরিয়ে বিব্রত ভাবে বেলকনির দিকে চলে গেল৷ শুধুমাত্র একটি টিশার্ট আর ঢিলে পাজামা পরিহিত সিমরানের। আরামদায়ক এই পোশাকটা পরেই ঘুমিয়েছে সে। ঘুমের ঘোরে পাজামা উপরে ওঠে গেছে, ঢিলেঢালা টি-শার্টের লম্বা গলার জন্য বুকের কিঞ্চিৎ অংশ দৃশ্যমান৷ প্রথম দফায় স্ত্রীর ঘরে ঢুকছি এমন মনোভাব নিয়ে ঢুকলেও পরবর্তীতে সিনুকে এমন এলেমেলো দেখে, ঘুমন্ত অবস্থায় দেহশ্রীর আকর্ষিক অংশ গুলোয় চোখ পড়তেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। এক মন বলল, উচিত হয়নি ঘরে ঢোকা। আরেক মন বলল, সিনু আমার বউ, অনুচিতই বা হবে কেন? নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেকটা সময় লাগল সৌধর৷ পুবাকাশে সূর্যের দেখা মিলেছে। চারপাশে ফিকে কমলা বর্ণটা ধীরেধীরে গাঢ় কমলায় পরিণত হচ্ছে। প্রকৃতিতে দৃষ্টি বুলিয়ে অকস্মাৎ সমস্ত আড়ষ্টতা ত্যাগ করে ঘরে গেল সৌধ। তাকাল সিমরানের দিকে। গতকাল কেমন গুটিশুটি মেরে শুয়েছিল তার ঘরে আজ নিজের ঘর, নিজের বিছানা পেয়েই সমস্ত জড়তা ভুলে নিজ ছন্দে ঘুমুচ্ছে। বাঁকা হাসল সৌধ। ধীরপায়ে এগুলো বিছানার দিকে। সিনু নিঃসন্দেহে সুন্দরী আর অনেক বেশি আদুরে। কিন্তু ঘুমুন্ত অবস্থায় ওর সেই সৌন্দর্যের মাত্রা এতবেশি বেড়ে যায় জানা ছিল না। পিচ্চি পিচ্চি আদলের এই ঘুমন্ত মেয়েটা এখন তার বউ৷ ভাবতেই বুকের ভেতর অচেনা তরঙ্গ বইতে লাগল। বিছানার একপাশে থাকা পাতলা চাদরটা টেনে ত্বরিত জড়িয়ে দিল সিমরানের শরীরে। না হলে পরিপূর্ণ ভাবে তাকাতে পারছে না। শত হোক আবেদনময়ী তরুণী দেহশ্রী। তার মতো প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবকের চোখ সেখানে পড়লে শরীরের রক্তকণিকা ছুটোছুটি করবেই। বউয়ের শরীর ঢেকে দিয়ে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সৌধ৷ এরপর দৃঢ় গলায় ডাকতে আরম্ভ করল,

‘ সিনু, অ্যাঁই মেয়ে। ওঠ, সকাল হয়ে গেছে৷ বেলা করে ঘুমানো শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। ‘

নড়েচড়ে ওঠল সিমরান৷ হালকা সজাগ হয়েছে বুঝতেই গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করল সৌধ। বলল,

‘ ওঠে যা। এখন থেকে রোজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠবি৷ নামাজের অভ্যেস করতে হবে, শরীরচর্চা করতে হবে। বেলা বাড়িয়ে ঘুমিয়ে জীবন কাটানো যাবে না। ‘

চোখমুখ কুঁচকে ওঠে বসল সিমরান৷ ঘুম ছাড়িয়ে হাত, পা ছেড়ে বিরক্ত মুখে চোখ খুলতেই চোখের সামনে সৌধকে আবিষ্কার করল। নিমেষে কপালের সবগুলো ভাঁজ মিলিয়ে, ঘুম উড়ে গেল। শরীর ঝাড়া দিয়ে বসে স্তম্ভিত মুখে তাকিয়ে রইল। সৌধ ওর দিকেই তাকিয়ে। তাই টের পেল ওর ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি। মৃদু কেশে ওঠল সে। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,

‘ কফি ছাড়া সকাল শুরু হয় না আমার। তার ওপর সারারাত ঘুম হয়নি। মাথাটা ধরে আছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবি৷ কফি তো বানাতে পারিস? ‘

ত্বরিত মাথা ঝাঁকাল সিমরান। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওঠে দাঁড়াল সৌধ। বলল,

‘ অকে, দু মগ কফি নিয়ে আয়। বেলকনিতে বসে খাব। আর প্রাথমিক কিছু ব্যয়াম দেখাব ইউটিউবে। কাল থেকে এগুলো ফলো করবি। আমি যতদিন ছুটিতে আছি একসঙ্গে শরীরচর্চা করব। ‘
.
.
আইয়াজ আর ফারাহ ব্যাগপত্র রেডি করে বাড়ির সকলের থেকে বিদায় নিল। ওদের গাড়িতে ওঠিয়ে দিতে এগিয়ে এলো, বিষণ্ণ মুখের সুহাস৷ সৌধ আর সিমরানও এলো। ফারাহ সুহাস আর সৌধ ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে সিমরানের সামনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। কানে কানে বলল,

‘ নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা বনু। ধৈর্য রেখে শুধু ভালোবেসে যাও। আজ যতটুকু সেক্রিফাইস করছ কাল তারচে চারগুণ বেশি পাবে৷ কারণ তোমার নীতি ঠিক আর চয়েজটা মারাত্মক। ‘

আরক্ত মুখে হাসল সিমরান। বলল,

‘ দোয়া করো আপু। ‘

ফারাহ গাড়িতে ওঠে বসল। সৌধ আইয়াজকে বিদায় দেয়ার সময় বলল,

‘ টেনশন নিস না। আল্লাহ তায়ালা যখন চাইবে তোদের কোলজুড়েও ফেরেশতা আসবে। আর শোন, বউকে দূরে রাখিস না৷ চেষ্টা কর এক হসপিটালে থাকার। ‘

‘ করছিরে। টাকা, পয়সাও দিয়ে রাখছি। দু’জন এক জায়গায় থাকলে সুবিধা হয়। দূরে দূরে থেকে টাকা, পয়সার জন্য ছুটে জীবনে সংসার, পরিবার হয়ে ওঠে না৷ ‘

বুকে বুক মেলালো আইয়াজ, সৌধ। এরপর সুহাসের কাছে এসে সুহাসকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আইয়াজ বলল,

‘ চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘

বন্ধু, আর বন্ধুর বউ চলে গেলে সৌধ সিমরানকে বলল বাড়ির ভেতরে যেতে। সিমরান সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল। সৌধ সুহাসের মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘ ভেতরে গিয়ে আংকেলকে জানা বিষয়টা। আমি একটু বেরুচ্ছি। ‘

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুহাস ভেতরে চলে গেল। সৌধ তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে সেলফোন বের করে কল করল নিধিকে।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে