#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬২|
‘ বর এসেছে, বর এসেছে। ‘
চারিদিকে এহেন বাক্যে উচ্চরোল ভেসে এলো। ধক করে ওঠল তীব্র কষ্টে জর্জরিত কনের বুকখানি। তাকে ঘিরে রয়েছে সকলে। প্রাচী, ফারাহ আর কাজিনরা গেছে বরের গেট ধরতে৷ এমপি পুত্র, তার ওপর পেশায় একজন ডক্টর। কনে পক্ষের দাবি দেড় লাখ টাকা। তর্কবিতর্ক শেষে ছাড় দিতে পারে৷ তবে এক লাখের নিচে নামবে না। বর এসেছে ধ্বনি বাজতেই কনেকে ঘিরে থাকা সদস্যদের ভীড় কমতে শুরু করল। সিমরানও যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে পারল এবার। ভীড় কমাতে স্বস্তি পেল ভীষণ। আশপাশে শুধু ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের পেল। খুঁজছিল সে লুনাকে। পেল না। সে দুলাভাই আর বেয়াইদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সৌধ লুনাকে পছন্দ করে না৷ কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয় সিমরান। কাল থেকে লুনাকে অনেক বুঝিয়েছে। সৌধ ভাই যেমন তার ভালোবাসার মানুষ। লুনাও প্রিয় বান্ধবী। বাজে স্বভাব আছে মেয়েটার৷ সেসবের পেছনেও রয়েছে তিক্ত অতীত। সবই জানে সে। তাই তো মেয়েটাকে ভালোবাসে। শত খারাপ অভ্যাস দেখেও দূরত্ব তৈরি করতে পারে না৷ সৌধর আদেশ অমান্য করা যেমন তার পক্ষে সম্ভব না। তেমনি লুনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাও অসম্ভব। তাই দু’দিক ঠিক রাখতে লুনাকে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। লুনা কথা দিয়েছে মেনে চলবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো পারবে না। তবে আগে যা জন সম্মুখে দ্বিধাহীন করে বেড়াতো। এখন তা করবে না৷ বন্ধুত্বের শক্তিতে দৃঢ় বিশ্বাস সিমরানের।
বধূ সাজে তরুণী। বুক ধুকপুক করছে। নিঃশ্বাসে বাড়ছে ক্রমশ অস্থিরতা। ধীরেধীরে চোখ দু’টো যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠল। লোভাতুর হলো মন৷ একরাশ লজ্জায় আরক্ত মুখে হঠাৎ ওঠে দাঁড়াল সে। লেহেঙ্গার দু’পাশ কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে ধরে মৃদু পায়ে চলে গেল বেলকনিতে। যেখান থেকে স্পষ্ট দৃশ্যমান বাড়ির প্রধান গেট। যেটা চমৎকার ডেকোরেশন করে বরের গেট বানানো হয়েছে। মধ্যস্থে ফুল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রশি। যে রশির ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বরপক্ষ। এপারে কনে পক্ষ। বের বেশে সৌধ ভাইকে প্রথম দেখাতেই হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখতে লাগল সেই সুপুরুষকে। সগর্বে আজ যার নামে নিজেকে লিখে দেবে সে। ভেবেই সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠল এক চিলতে হাসি। অনুভব করল, বুকের ভেতরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। এই কম্পন ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনায় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো। অন্তঃকোণে প্রশ্ন জাগল, ‘ বিয়েতে কি প্রতিটা মেয়েই এমন নার্ভাস ফিল করে? নিজের মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার তীব্র অনুভূতিতে তারই মতো ব্যাকুল হয়? ‘
.
.
সুজা এমপিকে আলাদাভাবে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হলো। তার সঙ্গে দু’জন দেহরক্ষী আর ছোটো ভাই সুললও আগেভাগে প্রবেশ করলেন। দু’জন পুলিশকে সর্বক্ষণ বাড়ির আশপাশে নজরদারির জন্য রাখা হয়েছে। যতক্ষণ না এমপি সাহেবের ছোটো পুত্র বিয়ে সম্পন্ন করে বউ নিয়ে স্মৃতিসৌধ নামে বাড়িতে পৌঁছায়৷ ততক্ষণ তারা তাদের দায়িত্ব থেকে এক চুলও নড়বে না। বর পক্ষের সঙ্গে কনে পক্ষের বাকবিতণ্ডা চলছে। আইয়াজ তালে আছে তার সুন্দরী বউকে নিজের দলে নিয়ে নেয়ার। কিন্তু ফারাহ যেন আটঘাট বেঁধেই হাজির হয়েছে। ওর মুখের ভাব, কথার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সে আইয়াজকে চেনেই না৷ আজই নতুন দেখা। সুন্দর করে সাজুগুজু করার ফলে ফারাহকে দেখতে অত্যাশ্চর্য সুন্দরী লাগছে। আইয়াজের চোখে এমনিতেই সে বিশ্ব সুন্দরী। আজ তার ব্রাইডাল লুক আইয়াজের মাথাই ঘুরিয়ে দিল। তার বউ বোকাসোকা হলেও মারাত্মক রূপবতী জানত সে। কিন্তু আজকে কেন এত চালাক হয়ে গেল? কেন তার চোখের ইশারায় কাবু হচ্ছে না? ফারাহর পাশে থাকা প্রাচী আইয়াজের মনোভাব বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসল। আজিজকে বলল,
‘ এই আজিজ এখানে কি কেউ বউ নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েছে? ‘
ফারাহ লজ্জা পাচ্ছিল। তবু নিজের স্বামী আর তার বন্ধুদের নাস্তানাবুদ করতে পিছপা হলো না। প্রাচীর কথা শুনে এদিকে আজিজ চোখ বড়ো বড়ো করে, ঝগড়ার সুরে বলল,
‘ তোদের মেয়েলোকেদের এই গুণ হেভি। তোরা মুহুর্তেই গিরগিটির মতো পাল্টে যাস। ‘
এ পর্যন্ত বলেই আইয়াজের কাঁধ জড়িয়ে ধরল৷ কণ্ঠে মায়া মিশিয়ে বলল,
‘ আহারে আমার ইনোসেন্ট বন্ধুটার কত বড়ো সর্বনাশ হলো। বউও রঙ বদলালো। ‘
ফারাহর মুখ হা হয়ে গেল। আইয়াজ অসহায় চোখে তাকিয়ে। প্রাচী ত্বরিত ফারাহ কানে কানে বলল,
‘ এই এই একদম গলবে না। তোমাকে দুর্বল করতে এসব বলছে৷ আর তোমার বরটা কিন্তু কম সেয়ানা না বুঝছ? পাক্কা ধুরন্ধর। ইনোসেন্ট লুক দিচ্ছে তোমাকে কাবু করার জন্য। আমাদের দলের প্রত্যেককে শক্ত থাকতে হবে ফারাহ। বি কেয়ারফুল। তুমি আয়াজের দিকে তাকিয়োই না। ‘
প্রাচীর সতর্কবার্তা পেয়ে ফারাহ সত্যি সত্যি আর আইয়াজের দিকে তাকাল না। এরপর শুরু হলো তর্ক। সৌধ জানে বিয়ে বাড়িতে এসব খুবই সাধারণ ঘটনা৷ তবু কেন জানি বিরক্ত লাগছে। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ ঠেকছে। যেন ভেতরে গেলেই বাঁচে। তার পাশে স্মৃতি আপু, ভাবি দাঁড়িয়ে। তর্কবিতর্কে কান ধরে গেছে সবার৷ সৌধ অতিষ্ঠ হয়ে নিচু কণ্ঠে স্মৃতিকে বলল,
‘ আপা এদের থামা। ‘
স্মৃতি ভাইয়ের অবস্থা দেখে পার্স থেকে টিস্যু বের করল। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
‘ ভাই মুখটা এত গম্ভীর করে রাখছিস কেন? একটু হাসি হাসি রাখ। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। আশপাশে তাকিয়ে সচেতন কণ্ঠে বলল,
‘ বরাবর যেমন থাকি তেমনি আছি আপা। ‘
‘ আরে ভাই বিয়ের দিনও এমন থাকতে হবে? ‘
সৌধ জবাব দিল না আর৷ স্মৃতি আপুও দমে গেল। তার হাজব্যান্ডকে বলল তর্ক থামিয়ে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। সৌধর দুলাভাই রায়ান আহম্মেদ মুক্ত এগিয়ে এলো। কনে পক্ষকে জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনাদের ডিমান্ড বলুন। ‘
দাঁত ক্যালিয়ে হাসল লুনা। প্রাচী খোঁচা দিল তাকে। লুনা বলল,
‘ এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। ‘
নিমেষে চটে গেল আজিজ। বলল,
‘ মামা বাড়ির আবদার? টাকা কি গাছে ধরে? ‘
লুনা বলল,
‘ আপনার বন্ধুর শালিকার আবদার। এখন টাকা গাছে ধরে নাকি মাটিতে গজায় তা আমার ডাক্তার দুলাভাই’ই বলতে পারবেন। ‘
হো হো করে হেসে ওঠল প্রাচী, ফারাহ, লুনা। বাকবিতণ্ডা চলল আরো কিছু সময়৷ এরপর সৌধর মুক্ত দুলাভাই চেক সাইন করে এগিয়ে দিলে কনে পক্ষ এবং পরিবেশ সবটাই ঠান্ডা হয়ে গেল৷ যদিও লুনাকে পছন্দ করে না সৌধ। তবু বউয়ের বান্ধবী হিসেবে তার হাতেই মিষ্টি মুখ করে ভেতরে প্রবেশ করতে হলো।
.
.
বর পক্ষদের আপ্যায়নে কোনো কমতি ছিল না। খানাপিনা শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল সকলে৷ উপরে কনের ফটোশুট চলছে। এছাড়া বিয়ের প্রায় প্রতিটি মুহুর্ত ভিডিয়ো করে রাখা হচ্ছে। এভাবে সময় গড়াল বেশ। এরপরই চলে এলো কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তটি। সকলের অনুমতি নিয়ে সিমরানকে নিচে নিয়ে আসা হলো। আকাশি নীল রঙা লেহেঙ্গা পরিহিত, ব্রাইডাল সাজে সিমরান যখন সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামছিল। দু’পাশে তার লেহেঙ্গা উঁচিয়ে ধরে সাপোর্ট দিচ্ছিল প্রাচী, ফারাহ৷ ক্যামেরা ম্যানও ছবি তুলতে তুলতে মুগ্ধ হয়ে গেল৷ উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সিঁড়ির পানে। সৌধ বসে আছে তার জন্য বরাদ্দকৃত রাজকীয় সোফায়৷ যেখান থেকে অনায়াসে সিমরানকে দেখতে পাচ্ছে সে৷ বাকিদের মতো মুগ্ধতা নিয়ে সে প্রথমে না তাকালেও ধীরে ধীরে তার চোখ দু’টোয় মুগ্ধতা এসে ভীড় জমালো। বুকের ভেতর ছুঁইয়ে গেল শীতল স্পর্শ। সাধারণত বিয়েতে সবাই লাল টুকটুকে বউ সাজে। সিমরাম ডিফরেন্ট। সৌধর মনে হলো সারাজীবন নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে আলাদা ট্যাগ ধরে রাখাটা আজ সার্থক। কারণ তার বউ আর সবার মতো লাল টুকটুকে বউ হয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়নি। তার বউ যেমন হৃদয়ে তার জন্য আকাশসম ভালোবাসা পুষে রেখেছে। তেমনি আজ সর্বাঙ্গে ধারণ করেছে গোটা আকাশকে। আকাশি নীল পোশাকটাকে সৌধর কাছে ঠিক আকাশের মতোই মনে হলো। লেহেঙ্গা ছাড়া সিমরানের দেহের যে অংশ গুলো দৃশ্যমান সেগুলোকে মনে হলো শুভ্র মেঘ৷ আকাশের বিশালতা, প্রশান্তি, স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা সর্বস্বই যেন আজ আপাদমস্তক সিমরানে আবদ্ধ। বুকের গহিনে তীক্ষ্ণ এক স্পর্শ পেল সৌধ। মুগ্ধ চোখ দু’টো সন্তর্পণে নিচে নামিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল শব্দহীন। সিমরানকে ততক্ষণে তার মুখোমুখি এনে বসানো হয়েছে। দু’জনের মাঝখানে স্বল্প দূরত্ব রেখে সাদা রঙের একটি পাতলা পর্দা টানালো হলো চটপট। এরপর পরিবেশটা শান্ত আর সুস্থির হয়ে ওঠল। সুহাস স্তব্ধ মুখে এসে দাঁড়াল সৌধর পাশে। সৌধ বা’দিকে তাকিয়ে যখন সুহাসের অসহায়, রক্তিম চোখ দু’টো দেখল ভেতরটা নড়ে ওঠল ওর। মনে পড়ে গেল তার স্মৃতি আপার বিদায় মুহুর্ত। সুহাসের অনুভূতি তার চেয়েও গাঢ়। সবচেয়ে বড়ো কথা ছেলেটা একের পর এক ধাক্কা খেতে খেতে আজ আরো একটি ধাক্কার সম্মুখীন হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। হাত বাড়িয়ে সুহাসের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। স্মিত হেসে বলল,
‘ স্টে স্ট্রং দোস্ত। ‘
সহসা মৃদু কেঁপে ওঠল সুহাস। অনেকদিন পর প্রিয় বন্ধুর ভরসা মাখা বাণী, স্পর্শে অশান্ত মনটা শান্ত হলো কিঞ্চিৎ। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে ওঠল নিমেষে। ক্ষীণ গলায় বলল,
‘ কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছেরে। আমি জানি সিনুকে তুই অনেক সুখে রাখবি। তবু কোথাও একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। ‘
আলতো হাসল সৌধ। তার মতো করেই ক্ষীণ গলায় বলল,
‘ স্বাভাবিক। নিজেকে শক্ত রাখ। আর ভাব, নিজের খুব মূল্যবান সম্পদ, অতি যত্নের মানুষটাকে যার তার হাতে নয় তোরই প্রিয় বন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছিস।’
সৌধর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নাড়ল সুহাস৷ এমন সময় সুজা চৌধুরী এলেন। ছেলের পাশে বসলেন। এগিয়ে এলো সোহান খন্দকারও। কাজি তৈরি৷ সবকিছু প্রস্তুত। এবার বিয়ে পড়ানো হবে। প্রথমে কনের তরফ থেকে কনের মামা গলার স্বর উঁচু করলেন৷ যাতে উপস্থিত সবাই শুনতে পায়। বললেন,
‘ তেরো লক্ষ তেরো টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া…আপনি, এমপি সুজা চৌধুরীর ছোট পুত্র ড.সৌধ চৌধুরী সোহান খন্দকারের একমাত্র কন্যা সাইয়্যারা সিমরান খন্দকারকে বিবাহ করিতে রাজি থাকিলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ‘
চারপাশ নীরবতায় আচ্ছন্ন। উপস্থিত প্রত্যেকে কান দু’টো সজাগ রেখে, উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পর্দার এপাশে বসে সিমরান৷ এতক্ষণ শুধু তার বুক ধুকপুক করছিল৷ এবারে সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। চোখ দু’টো নিচে নামিয়ে কান দু’টো সজাগ রাখল প্রিয়তম পুরুষটির মুখে তাকে কবুল করে নেয়ার শব্দটি শুনতে। সৌধ ক্ষণকাল সময় নিল। অনুভব করল গলা শুঁকিয়ে ওঠেছে৷ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ৷ সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতিতে হৃদয় সিক্ত। সুজা চৌধুরী ছেলেকে মৃদু ধাক্কা দিলেন৷ চমকে ওঠে পাতলা পর্দার দেয়ালে তাকাল সৌধ। নত দৃষ্টিতে ভীত মুখে সিমরানকে এক পলক দেখে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে, সুস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ‘
নিমেষে দু’চোখ উপচে নোনাপানির ধারা নামল সিমরানের গাল বেয়ে। পরপর তিনবার কবুল পড়ল সৌধ৷ কান পেতে শুনে প্রতিবারই অঝোরে কাঁদল সিমরান৷ এই কান্নায় ব্যথা নেই, দুঃখ নেই আছে শুধু প্রাপ্তির সুখ। সিমরান যখন কান্নায় ডুবে তখন তার এক পাশে এসে দাঁড়াল সোহান। অপর পাশে সুহাস। আব্বু আর ভাইয়াকে দু’পাশে অনুভব করে কিছুক্ষণের জন্য কান্না থামে। এরপর যখন বরের পক্ষ থেকে একজন এসে বলতে শুরু করে,
‘ তেরো লক্ষ তেরো টাকা মোহরানা ধার্য করিয়া…আপনি, সোহান খন্দকারের একমাত্র কন্যা সাইয়্যারা সিমরান খন্দকার এমপি সুজা চৌধুরীর ছোট পুত্র ড.সৌধ চৌধুরীকে বিবাহ করিতে রাজি থাকিলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ‘
পর্দার ওপাশে বর বেশে বসা সৌধর সুক্ষ্ম দৃষ্টিজোড়া তাকিয়ে আছে স্থিরভাবে। কান দু’টো আশপাশের কোনো শব্দই নিচ্ছে না। কেবল অপেক্ষা করছে সিমরানের থেকে পাওয়া সম্মতিটুকুর। এরপরই তারা দু’জন বিয়ে, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে। একে একে প্রত্যেকেরই অপেক্ষা শুরু হলো। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা সিমরানের দিকে। সোহান খন্দকার টের পেলেন মেয়ে কাঁদছে। তীব্র কষ্টে তার শ্বাস নিতে বেগ পেতে হলো। সুহাস যেন শরীর ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারাজীবন দেখেছে বিয়ে মানেই আনন্দ, ফূর্তি। কনে বিদায়ে কান্না দেখেছে। কিন্তু সেগুলো এভাবে এত নিগূঢ় ভাবে স্পর্শ করেনি। স্মরণ হলো নিজের বিয়ের কথাও। নামীকে কাঁদতে দেখেছে সে। কিন্তু বুঝতে পারেনি, অনুভব করেনি ওর ভেতরকার তীব্র কষ্টটুকু। আজ নিজের বোনের বেলায় যে অনুভূতিটা হচ্ছে তা যেন প্রকৃতিরই এক চরম শিক্ষা। এত ভালোবাসার জিনিসটা অন্যকারো হাতে তুলে দিতে হবে? আজকের পর সিনুর ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকারবোধ কেবল সৌধরই। আহা, বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল যেন। তবু হজম করতে হলো সব যন্ত্রণা। হাসি মুখে এসে বোনের সামনে বসতে হলো। মাথায় হাত রেখে বলতে হলো,
‘ কিরে বোনু সৌধকে স্বামী হিসেবে কবুল করে নিবি না? ও অপেক্ষায় আছে… ‘
সহসা নড়ে ওঠল সিমরান। স্মৃতি আপু, প্রাচী, ফারাহ সকলেই তাকে বোঝাতে শুরু করল। এ এক শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে এলো। মাথা ঘরতে থাকল বিশ্রীভাবে। বুকের ভেতর কী যেন একটা দুমড়েমুচড়ে গেল। এরপর! এরপর! সকলের লাগাতার অনুরোধে দু-চোখ বুজে নোনাপানির ধারা ছেড়ে, নিঃশ্বাস আঁটকে, কাঁপা কণ্ঠে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিল ড. সৌধ চৌধুরীকে। অর্জন করে নিল তার কিশোরী বয়সের ভয়ংকর প্রণয়কে। সিমরানের কান্নামিশ্রিত মিহি সুরে উচ্চারিত,
‘ আলহামদুলিল্লাহ কবুল ‘ শব্দ দুটোয় কী ছিল কে জানে। যা একেবারে সৌধ চৌধুরীর বুক ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে মিশে গেল।
.
.
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই আজিজ আর শান বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য চৌধুরী বাড়ি গিয়ে সৌধর জমকালো বাসর ঘরটা দখল করা। গুণে গুণে ষাট হাজার উশুল না করে ঘর ছাড়বে না৷
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৩|
কন্যাকে পাত্রস্থ করার পর বিদায়বেলা।হৃদয়বিদারক এক মুহুর্ত। প্রতিটি নারীর জীবনে এ মুহুর্তটি অত্যন্ত মর্মভেদী৷ সোহান খন্দকার একহাতে সৌধর হাত ধরে আছে। অপর হাতে সিমরানের হাত৷ নিজের আবেগ, মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ সমস্ত কিছু বুকের ভেতর চাপা দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল সে। তীব্র কষ্টে আব্বুর শোচনীয় অবস্থা, অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিজোড়া দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না সিমরান। গা কাঁপিয়ে ফুঁপাতে শুরু করল। মেয়ের কান্না দেখে সোহান খন্দকার নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করে৷ তার একপাশে তীব যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সুহাস দাঁড়িয়ে। অন্য পাশে সুহাসের মামা। সিমরানের এক পাশে সৌধ অন্য পাশে ফারাহ। যে সিমরানকে থরথর করে কাঁপতে দেখে কাঁধ চেপে ধরেছে। সোহান খন্দকার সৌধের হাতে সিমরানের হাত তুলে দিল। আবেগমথিত হয়ে বলল,
‘ বাবা সৌধ, এই যে আজ সিনুকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। সিনু কে বলো তো? আমার মেয়ে? না বাবা ও শুধু আমার মেয়ে না, ও আমার কলিজার টুকরা। সারাজীবন মনে রেখো, আজ এক বাবার শরীর ভেদ করে কলিজার টুকরাকে বউ করে নিয়ে গেলে তুমি। ‘
আশ্বস্ত দৃষ্টিতে তাকাল সৌধ। কাঁপতে থাকা সিমরানের হাতটা যত্নসহকারে আগলে ধরল ৷ ধীরে ধীরে স্তম্ভিত হতে বাধ্য হলো সে। এক বাবার অসহায় মুখ তার হৃদয়ে বিরাট এক জায়গা দখল করে নিল৷
সোহান খন্দকার আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না৷ চোখের সামনে মেয়েকে শশুর ঘরে চলে যেতে দেখতে পারবে না৷ মেয়ের সামনে ভেঙে পড়তেও চায় না সে৷ তাই ত্বরিত সরে গেল। তার পেছন পেছন গেল সুহাসের মামা। বাবা সরে গেলে নত মাথা উঁচু করল সুহাস৷ সৌধ দেখল, তার ভঙ্গুর এক বন্ধুকে। যে আজ সর্বস্ব খুইয়ে স্তম্ভিত মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্ধশ্বাস একটি মুহুর্ত। তবু সৌধর মস্তিষ্ক ঠান্ডা। তাই তো সে মনে মনে পণ করল, একটু সময় লাগলেও প্রিয় বন্ধু সুহাসের জীবনে সবকিছু গুছিয়ে দেবে৷ ফিরিয়ে আনবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। ঘুচিয়ে দেবে সকল দুঃখ, কষ্ট একাকীত্বের ভয়ংকর যন্ত্রণা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সুহাস এগিয়ে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। সৌধ খেয়াল করল, সুহাসের চোয়াল কাঁপছে, নাকের ডগা লালচে। পানি টলমল করছে চোখ দু’টোতে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেদের মন অনেক নরম হয়। কিছু মানুষ আছে না? যত গর্জে তত বর্ষে না। সুহাস হলো সেই ধারার মানুষ। এই ছেলেটাকে আর কেউ চিনুক বা না চিনুক সৌধ খুব ভালো করে চেনে। সহসা কম্পিত চোয়ালে শাসানোর সুরে সুহাস বলল,
‘ আমার বোনকে সবসময় হাসিখুশি রাখবি৷ একটুও দুঃখ দিতে পারবি না। মনে রাখবি অন্য কেউ নয় তোর বউ সুহাসের বোন। ‘
এত দুঃখের ভীড়েও সুহাসের বাচ্চামো দেখে হাসি পেল সৌধর৷ কিন্তু পাশের জনের হৃদয় নাড়ানো কান্না দেখে আর নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার অজুহাতে হাসতে পারল না। বন্ধুকে বলতেও পারল না,
‘ তুই কি ডাক্তারি পেশা ছেড়ে গুণ্ডামি পেশায় যোগ দিলি নাকি৷ দ্য গ্রেট গ্যাংস্টার সুহাসের বোন বিয়ে করে তাহলে মুসিবত হয়ে গেল আমার! ‘
মনের কথা মনেই রয়ে গেল। বোনের বিদায় শোকে সুহাস আরো অনেক শাসানো বাক্য আওড়াল।সেসব আমলে নিল না সৌধ। এরই মধ্যে তার ছোটো কাকু সুলল এসে তাড়া দিল। সন্ধ্যার আগেই নতুন বউ ঘরে তোলার নিয়ম তাদের। রাত হলেই সৌধর দাদুনি আর বাড়ির বউ বরণ করবেন না। সৌধকে শাসিয়ে বোনের মাথায় হাত রাখল সুহাস। অকস্মাৎ শব্দ করে কেঁদে ফেলল সিমরান। ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল৷ বোনকে সামলাতে পারল না সুহাস৷ সৌধ হতভম্ব হয়ে গেল দুই ভাই, বোনের কাণ্ড দেখে। সুহাসও কাঁদছে! এ প্রথম সুহাসকে এভাবে কাঁদতে দেখল সে। এমতাবস্থায় হঠাৎ আইয়াজকে নজরে পড়ল ওর। তৎক্ষনাৎ ইশারায় বলল,
‘ আয়াজ, এই বেআক্কলটাকে দ্রুত সরা। ‘
ফারাহ সিমরানকে সামলে নিচ্ছিল। আইয়াজ গিয়ে সুহাসকে ধরায় সুবিধা হলো। জোরপূর্বক টেনে সুহাসকে সরিয়ে নিল আইয়াজ। ক্রন্দনরত অবস্থায় সিমরান অনুভব করল, যে হাত সৌধ ধরে ছিল তাতে শক্ত টান পড়েছে। অশ্রু ভেজা চোখে চকিতে তাকাতেই দেখল সৌধ তার হাত টেনে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে। ঠোঁট ভাঙিয়ে কেঁদে ফেলল ফের। হাতে টান পেয়ে আপনাআপনিই পা এগুলো। অনুভব করল বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে হচ্ছে তীব্র কষ্ট। এত কষ্ট হচ্ছে কেন তার? চারপাশের সবাইকে এত নিষ্ঠুরই বা মনে হচ্ছে কেন? যেন সবাই তাকে জোর করে শশুর ঘরে পাঠাচ্ছে। অথচ সে সৌধ ভাইকে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় তার বউ হয়ে নিজের বাড়ি, আপনজন ছেড়ে বিদায় নিচ্ছে।
গাড়িতে ওঠার পর হঠাৎ সুহাস ছুটে এলো। সৌধকে ডাকতে লাগল সমানতালে,
‘ সৌধ, সৌধ এই সৌধ? ‘
শেষ ডাক দিল উচ্চ গলায়। কপাল কুঁচকে জানালার কাঁচ নামালো সৌধ। মুখাবয়ব প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে আছে তার। সত্যি বলতে সুহাসকে এভাবে কাঁদিয়ে সিমরানকে নিয়ে যেতে তারও অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু এটাই তো জগতের নিয়ম৷ এ নিয়ম না মানলে বাড়াবাড়ি হবে। আজকের দিন থেকে গেলে দৃষ্টিকটুও লাগবে। লোকে আবার ঘরজামাই ট্যাগও দিয়ে দিতে পারে৷ তার মতো ছেলে আর যাইহোক এই ট্যাগ বয়ে বেড়াতে পারবে না৷ সুহাস এত বেশি অবুঝতা কেন করছে? মাথা ধরে গেল সৌধর। ভারিক্কি কণ্ঠে বলল,
‘ বল। ‘
‘ তুই কিন্তু রাগটা একটু কমাবি। সিনুর ওপর রাগ ঝাড়বি না কিছু নিয়ে। ‘
সুহাসের কণ্ঠে মিনতি। সৌধ পেছনে তাকিয়ে দেখল আইয়াজ, ফারাহ ওঠেছে কিনা। এরপর ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। সুহাস এবার সিমরানের দিকে তাকাল। আদুরে গলায় বলল,
‘ কাঁদিস না বোন। আমি, বাবা সব সময় তোর পাশে আছি৷ ‘
বলেই হাত বাড়িয়ে বোনের গালের পানি মুছে দিল। সিমরান ভাঙা কণ্ঠে বলল,
‘ আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না৷ আব্বুর কাছে যাও এক্ষুনি। ‘
সিমরানের কণ্ঠে ভয়। মাকে হারিয়েছে আচমকা। মায়ের পাশে তারা কেউ ছিল না৷ না আব্বু আর না তারা দুই ভাইবোন। তাই এই কঠিন মুহুর্তে ভয় জেঁকে ধরল ওকে। বোনের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাস৷ সত্যিই তো! তাকে এখন বাবার পাশে থাকতে হবে। গাড়ি স্টার্ট দিলে হাত ফিরিয়ে নিল সুহাস। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল বোনের কথায়। সহসা শব্দ করে সামনে থেকে গাড়িটা সরে গেল। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠল সুহাসের৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে পায়ের গতি বাড়াল বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। মনে মনে বলল,
‘ সিনুকে সামলাতে সৌধ আছে, বাবাকে সামলাতে আমি আছি, আর আমাকে সামলাতে? কে আছে? কেউ নেই!’
বুকচিরে তার হতাশাগ্রস্ত নিঃশ্বাস বেরুলো। যা মিশেমিশে একাকার হয়ে গেল প্রকৃতির সাথে।
.
.
স্মৃতিসৌধ। চৌধুরী বাড়ি। বরের গাড়ি ছাড়া সব গাড়ি এসে পড়েছে। গাড়ি ভর্তি মানুষজন তাড়াহুড়ো নিয়ে ঢুকছে বাড়িতে। নতুন বউ বরণ দেখবে তারা৷ স্মৃতি আর তার হাজব্যন্ড মুক্ত বাড়িতে প্রবেশ করতেই দাদুনির প্রশ্নের মুখোমুখি হলো,
‘ মেয়ের সাথে ক’জন এসেছে? ‘
ক্লান্ত গলায় স্মৃতি বলল,
‘ নানুমনি আর সিনুর এক বান্ধবী লুনা মাত্র দু’জন। ‘
চোখ ফিরিয়ে নিল দাদুনি। স্মৃতিও চলে গেল উপরে৷ নিজের ঘরে গিয়ে ভারি পোশাক ছেড়ে হালকা, পাতলা সেলোয়ার-কামিজ পরে নিল। তার স্বামী মুক্ত বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘ জান, আমার আর কাজ নেই তো। এবার তোমাদের মেয়েলি কাজটাজ শুধু৷ আমি ফ্রেস হয়ে রেস্ট করব। ডিনারের সময় ছাড়া ডাকাডাকি করো না। ‘
‘ ওকে ফাইন, যখন নিচে যেতে বলব এসে পড়ো। ‘
‘ ওকে। ‘
স্মৃতি আপু ঝটপট চুল গুলো পেছনে ঝুঁটি করে নিচে নেমে এলো। এমন সময় দাদুনি ফের তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল,
‘ তাহানী কোথায় স্মৃতি? তোমাকে বলেছিলাম, ওর খেয়াল রাখতে? ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল স্মৃতি। তাহানীকে তো ঝুমায়না ভাবির সাথে বসিয়েছিল। কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,
‘ ভাবি আসেনি? ‘
‘ সে তো ছেলেকে ঘুম পাড়াতে মাত্রই নিজের ঘরে গেল। ‘
আঁতকে ওঠল স্মৃতি।
‘ তাহানীকে তো ভাবির সাথে বসিয়েছিলাম! ‘
দাদুনি কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘ তোমাদের ওপর ভরসা করাই ভুল। কোন আক্কেলে ঝুমায়নার কাছে তাহানীকে রাখো। সে ছেলে সামলাতে গিয়ে হাপিত্যেশে মরে যায়। ‘
ঢোক গিলল স্মৃতি। আমতা আমতা করে বলল,
‘ দেখছি। আপনি টেনশন করবেন না। কারো না কারো সাথে আছেই। ‘
কথাগুলো বলে বাইরে যেতে উদ্যত হতেই দেখতে পেল, সিমরানের বান্ধবী লুনার হাত ধরে হাসিখুশি তাহানী সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল স্মৃতি। হাসিমুখে দাদুনির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এইতো আমার বনু এসে গেছে। ‘
.
.
সদর দরজার বাইরে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৌধ। বাড়ির অর্ধেক সদস্য ভেতরে। বাকি অর্ধেক বাইরে সৌধ, সিমরানকে ঘিরে৷ সৌধর মা, দাদুনি, আপু আর ভাবি ঝুমায়না তাদের বরণ করার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একটি বিশাল আকৃতির নোড়া রাখা বর,বউয়ের সামনে৷ তানজিম চৌধুরী ছেলেকে নোড়া দেখিয়ে বললেন,
‘ বাবা ওঠো এখানে। ‘
এরপর সিমরানকে বলল,
‘ ছোটো আম্মা, তুমিও ওঠো। ছোটো আব্বার বাম পাশে দাঁড়াও। ‘
আম্মার আদেশ চির ধার্য। যদিও এসব নিয়মকানুন ইসলামে নেই৷ কিন্তু প্রাচীন যুগ থেকে তাদের পূর্ব পুরুষরা মেনে আসছে৷ বংশপরম্পরায় মুরুব্বিরা এভাবেই নিয়ম মেনে নতুন বউ ঘরে তুলে। নিয়ম গুলো না মানলে কিছুই হবে না৷ কিন্তু মানলে বাড়ির মুরুব্বিরা সন্তুষ্ট হবে৷ তাদের নতুন জীবনের শুরুতে কেউ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হোক চায় না সৌধ। সংস্কৃতির প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই৷ তবে হ্যাঁ যেসব সংস্কৃতি তার ব্যক্তিত্বে আঘাত করে বা যেসব সংস্কৃতি অসম্মান বয়ে আনে সেসবের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। নোড়ার ওপর তারা স্বামী, স্ত্রী ওঠে দাঁড়ালে স্মৃতি একগ্লাস হালকা গরম দুধ এগিয়ে দেয় মাকে। তানজিম চৌধুরী দুধের গ্লাস মুখে ধরেন সৌধর৷ সৌধ এক চুমুক খেয়ে ফিরিয়ে দিলে বাকি দুধ সিমরানের মুখে ধরে। মাথা ঘুরছে সিমরানের। শরীরটা দুর্বল লাগছে খুব৷ দুধের গ্লাস দেখে গা গুলিয়ে ওঠল৷ তানজিম চৌধুরী স্নেহময় গলায় বলল,
‘ একটু মুখে দেও। ‘
তানজিম আন্টি আজ থেকে তার শাশুড়ি মা৷ বুকের ভেতর ধক করে ওঠল৷ এক পলক তাকিয়ে দেখল, চৌধুরী গিন্নিকে। এরপর চোখ নামিয়ে দুধের গ্লাসে ঠোঁট ছুঁয়ালো। এক ঢোক খেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলে তানজিম চৌধুরী মৃদু হাসলেন। সে সরে গেলে এগিয়ে এলেন দাদুনি। পাশে কাজের মেয়ে মিষ্টি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান থেকে কাঁটাচামচে মিষ্টি তুলে প্রথমে নাতির মুখে ধরলেন৷ সৌধ মুখ বাড়িয়ে এক কামড় নিল। দাদুনি মৃদু হেসে একই মিষ্টি সিমরানের মুখে ধরলেন। শাশুড়ির বেলায় একবার দ্বিমত করলেও দাদুনির বেলায় ঝটপট মিষ্টি মুখে নিল সিমরান। এমনিতেই দাদুনি তাকে পছন্দ করেন না৷ মিষ্টি খেতে একদমই ভালো লাগবে না এখন৷ তবু দাদুনির তোপের মুখে পড়তে চায় না বলেই খেলো। এতক্ষণ এমন ভদ্র সুলভ থেকে তার বেলায় চটপট করার মানে কী? বোধগম্য হলো না দাদুনির৷ অসন্তোষ মুখে ঘাড় বাঁকিয়ে বড়ো নাত বউ ঝুমায়নার দিকে তাকালেন। ঝুমায়না পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলে পানি খাইয়ে দিলেন দু’জনকে। এরপর বড়ো বউকে ডাকলেন। তানজিম চৌধুরী এসে ছেলে আর ছেলে বউয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাতে দু’জনের হাত ধরলেন৷ এরপর এগিয়ে নিয়ে গেলেন চৌধুরী বাড়ির অন্দরমহলে। দৃশ্যটি সৌধর কাজিনরা ক্যামেরা বন্দি করে ফেলল। ভিডিয়োশুট চলল দীর্ঘ সময় ধরে৷
বর, বউ ভেতরে প্রবেশ করতেই বাকি সবাই যে যার মতো ভেতরে ঢুকল। লুনা তাহানীর সঙ্গে খেলা করছিল আর উশখুশ চোখে তাকাচ্ছিল বাড়ির সদর দরজার দিকে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে তার বান্ধবীর অপেক্ষায় ছিল৷ কিন্তু বান্ধবী আসার পরও যখন উশখুশ করতে লাগল তখন সন্দেহ হলো, ফারাহর। সে আইয়াজকে আড়ালে ডেকে বলল,
‘ সিনুর বান্ধবীর মতিগতি ঠিক লাগছে না। ‘
চোখের চশমা ঠিক করতে করতে আইয়াজ বলল,
‘ কেন কিছু বলেছে তোমায়? ‘
‘ আমাকে কী বলবে আজব! ‘
‘ তাহলে বেঠিকের কী দেখলে? ‘
ঠোঁট ফুলালো ফারাহ৷ কারো সম্পর্কে পুরোপুরি না বুঝে আন্দাজে কিছু বলা ঠিক হবে না। কিন্তু সিনুদের বাড়িতে খাওয়ার সময় থেকে খেয়াল করছে, লুনা সুলল কাকুর দিকে কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল৷ বিষয়টা দৃষ্টিকটু লেগেছে তার। সুলল চৌধুরী সৌধ ভাইয়ের কাকা। সে হিসেবে তাদেরও কাকা। সুলল কাকু নিঃসন্দেহে হ্যান্ডসাম। সৌধ ভাইয়ের ছোটো কাকা কোনো অংশে সৌধ ভাইয়ের থেকে কম কিছু নয়৷ লম্বা, চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী সুলল কাকু। তার আকর্ষণীয় চেহেরা, ব্যক্তিত্ব যে কোনো মেয়েকেই ঘায়েল করতে যথেষ্ট। আফসোস অল্পবয়সে বিপত্নীক হয়েছে মানুষটা৷ লুনা খ্রিস্টান ধর্মের মেয়ে। তার সাথে সুলল কাকুর বয়সের ফারাকও অনেক। তিতকুটে অনুভূতি হলো ফারাহর৷
ভাবল, লুনা হয়তো বাচবিচার না করেই যে কারো প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। তাছাড়া ওর স্বভাব সম্পর্কে টুকটাক শুনেছিল। সৌধ ভাই বোধহয় মেয়েটাকে পছন্দ করে না৷ নিশ্চয়ই এসব দোষ জানে বলেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারাহ৷ লুনা তাহানীর সঙ্গেও ভাব জমিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা সত্যি গুড মাইন্ডের নয়৷ আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া দরকার লুনার ব্যাপারে। তারপর আইয়াজকে জানাবে। এবং বড়ো বোন হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে লুনাকে সাবধান করবে। এ পর্যন্ত ভেবে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ফারাহ। চশমা ঠিক করতে করতে আইয়াজকে বলল,
‘ কিছু না। ‘
চেপে গেল তার মনে চলা কথাগুলো। লুনার হাবভাব পুরোপুরি না জেনে কিছু বলা উচিত হবে না৷ আইয়াজ বলল,
‘ রাগ করছ কেন? বলো না কী হয়েছে? ‘
‘ রাগ করছি না। কথাগুলো সঠিক সময়ে বলব। এবার চলো সিনুর কাছে যাই। ‘
কথাটা বলেই চলে আসতে উদ্যত হয় ফারাহ৷ সহসা আইয়াজ হাত টেনে ধরে ওর৷ একদম নিজের কাছে টেনে এনে বলে,
‘ এমন দূরে দূরে থাকো কেন? যেন আমি অচেনা কেউ। ‘
‘ ধূরর হাত ছাড়ো কত মানুষ! কেউ দেখে ফেলবে। ‘
বিরক্ত হলো আইয়াজ। যতটুকু কাছে টেনেছিল তার চেয়েও অধিক কাছে টেনে নিল। দূরত্ব কমিয়ে নিতে নিতে দুজনের মাঝে এক চুল ফাঁকও রাখল না৷ শাড়ি পরিহিত ফারাহ। একদম সাধারণ, হালকা সাজ। চুলগুলো পেছনে খোঁপা করা। ওর ফরসা গলায় রয়েছে পরপর তিনটে ভাঁজ। সেই ভাঁজে ঘাম জমেছে। আইয়াজ নেশাতুর দৃষ্টিতে সেখানে তাকিয়ে বলল,
‘ ঘেমে গেছ। চলো ঠান্ডা কোথাও গিয়ে বসি। মানুষের ভীড়ে গরম বেশি লাগছে। ‘
ওরা যখন একে অপরের সন্নিকটে। ঠিক সে মুহুর্তে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে ঝুমায়না ভাবি ছুটে আসছিল রান্না ঘরের দিকে। আচমকা একপাশে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আইয়াজ, ফারাহকে দেখে একহাতে চোখ ঢেকে ‘ সরি, সরি ‘ ধ্বনি তুলে পিছিয়ে গেল। তীব্র লজ্জায় পড়ে গিয়ে লাফিয়ে ওঠল ওরা স্বামী, স্ত্রী। ফারাহ ঈষৎ ক্রোধে কটমট করে তাকাল আইয়াজের দিকে। বুকে দু’টো কিল বসিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
‘ বলেছিলাম আমি কেউ এসে পড়বে। ‘
আইয়াজ ওর হাত চেপে ধরে মার খাওয়া আঁটকে নরম স্বরে বোঝালো,
‘ ডোন্ট ওউরি জান। আমরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড নই। এত ভয়, লজ্জা পাওয়ার কিছু হয়নি। ‘
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠল ফারাহ ‘ ধ্যাৎ! ‘ বলেই মুখ ফুলিয়ে চলে গেল আইয়াজের সামনে থেকে। সহসা লাজুক হাসল আইয়াজ নিজেও। মাথা চুলকে ভাবল, সেও কি কম লজ্জা পেয়েছে নাকি? ঝুমায়না ভাবির সামনে আর পড়া যাবে না।
.
.
বসার ঘরে নববধূকে ঘিরে রয়েছে প্রত্যেকে। চেনা মুখগুলোর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করানো হচ্ছে। আছে অচেনা মুখও। যাদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব চলছে। সৌধ বসে ছিল সিমরানের পাশেই। এবার ওঠার প্রয়োজন বোধ করল। আশপাশে তাকিয়ে বন্ধুদের মধ্যে আইয়াজকেই পেল শুধু৷ আইয়াজ ঠোঁট টিপে হাসছে৷ যে হাসি কপালে ভাঁজ ফেলল ওর। ওঠতে উদ্যত হতেই আচমকা চোখ পড়ল পাশে। সিমরানের মুখশ্রীতে। যা উঠতে দিল না ওকে। থেমে গেল। আশপাশে এত মানুষ। কীভাবে প্রশ্নটা করবে ভাবতেই মনে মনে বিরবির করল, ‘ ধূরর কে কী ভাবল এটা ভেবে এ জীবনে যখন কিছু করেনি। আজ করবে কেন? ‘ তাই ছোট্ট করে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে শীতল গলায় প্রশ্ন করল,
‘ সমস্যা হচ্ছে? রেস্ট করবি উপরে গিয়ে? ‘
মৃদু চমকাল সিমরান। আড়চোখে তাকাল সৌধর ভারিক্কি চোয়ালে। সরাসরি তাকাতে লজ্জা লাগছিল। সামনে এত মানুষ তাই৷ মনে মনে অনুভূতির ফোয়ারা ছুটল। সত্যি বলতে তার শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে৷ মাথায় কিলবিল করছে এত মানুষ আর তাদের কথোপকথন। তীব্র অস্বস্তি, শারীরিক দুর্বলতা, মানিসক ভারাক্রান্ত সব মিলিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ সৌধ ভাই কি খেয়াল করেছে এসব? আবেগান্বিত হয়ে পড়ল সিমরান। নিজের সমস্যা হলেও মুখ ফুটে বলতে পারল না। মাথা নেড়ে বোঝাল তার সমস্যা হচ্ছে না। সৌধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল৷ স্পষ্টই বুঝল, মিথ্যা বলল সিমরান। প্রথমদিনই মিথ্যা? দাঁতে দাঁত পিষে বাড়ির লোকজনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দেখতে পেল স্মৃতি আপু লুনার সাথে গল্পে মশগুল। তার মুখ দিয়ে রেডিওর মতো ছোটো কাকুর প্রশংসা বেরুচ্ছে। আর লুনা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেসব কথা গিলছে৷ বিরক্ত হলো সৌধ। মেয়েটাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে ওর। শান্ত কণ্ঠ কিঞ্চিৎ উঁচু করল সৌধ৷ বলল,
‘ আপা, এদিকে শোন তো। ‘
গল্পে বাঁধা পেয়ে থেমে গেল স্মৃতি। লুনাকে বসিয়ে রেখে সে ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। শুধাল,
‘ কী হয়েছে? ‘
‘ আম্মাকে জিজ্ঞেস কর সব ফর্মালিটি শেষ হয়েছে কিনা। ‘
একটু ভেবে স্মৃতি আপু বলল,
‘ শেষ তো। কেন? ওঠবি তুই ওঠ না৷ সমস্যা কী? ‘
শীতল দৃষ্টিতে তাকাল সৌধ। স্মৃতি আপার চঞ্চলতা ফুঁস হয়ে গেল। নরম সুরে বলল,
‘ কী হয়েছে? ‘
এবারে সিমরানকে ইশারা করল সৌধ। বলল,
‘ ওর মেবি সমস্যা হচ্ছে। ভারি পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বল। ‘
চমকে ওঠল স্মৃতি। সত্যিই তো এ ব্যাপারটা তো সে খেয়ালই করেনি। ইশ নিজের বিয়ের কথা স্মরণ হতেই সিমরানের জন্য মায়া হলো। আহারে বেচারি। নতুন বউদের যে কত জ্বালা! হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে জিভ কামড়ে ভাইকে বলল,
‘ ইশ ভাই, আমারি ভুল। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল৷ আহারে সারাদিনের ধকলে সিনুটা মিইয়ে গেছে। ‘
বলেই মায়ের কাছে গিয়ে বলে এলো,
‘ আম্মা সিনুকে নিয়ে উপরে গেলাম। বিয়ের সাজ ছেড়ে ফ্রেস হয়ে নিক। ‘
তানজিম চৌধুরী বললেন,
‘ হ্যাঁ তাই কর। ‘
পরোক্ষণেই হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে বললেন,
‘ এই শোন, সৌধর রুম তো লক। পোলাপান দরজা আঁটকে বসে আছে৷ সৌধকে পাঠা আগে তারপর তোরা যা। ‘
মায়ের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল স্মৃতি। সৌধর কাছে এসে বলল,
‘ অ্যাঁই ভাইই। তোর ঘর তো আজিজ, শান ওদের দখলে। তুই গিয়ে ওদিকটা সামলা। তারপর আমরা আসছি। ‘
সৌধ আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ আমার ঘর ওদের দখলে মানে? ‘
স্মৃতি আপু বুঝিয়ে দিল বিষয়টা৷ সৌধর মেজাজ খারাপ করল ভীষণ। এরা শুরু করেছেটা কী? টাকা দিয়ে লোক লাগিয়ে ঘর সাজালো তার দুলাভাই। আর বন্ধু আর কাজিনরা সে টাকা উশুল করতে তাকে জব্দ করার পরিকল্পনা করল! চরম বিরক্তি নিয়ে উপরে ওঠল সৌধ। নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় দু’টো থাবা দিয়ে গমগমে কণ্ঠে বলল,
‘ আজিজ, শান, বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে বেরিয়ে আয়। ঘর ফাঁকা করে দে। নয়তো লাভের পরিবর্তে লোকসান হবে। ‘
সৌধর এই এক বাক্যে কী এমন ছিল কে জানে? সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো, দু’জন। আজিজ মিনমিন করে বলল,
‘ দোস্ত এইটা কিন্তু ঠিক না। ডর দেখাইয়া লস কইরা দিলি৷ ‘
বাঁকা হাসল সৌধ। বলল,
‘ কথা যখন শুনেছিস৷ লস হবে না। আপাতত রিলাক্স হতে দে। ‘
বলতে বলতে ঘরে ঢুকল সে। বেশ তাড়া নিয়ে একটি টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ঢুকে পড়ল বাথরুমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনু এসে যাবে রুমে। বাথরুম প্রয়োজন পড়বে তারও৷ তাই অল্প সময় নিয়ে আগে নিজে ফ্রেস হয়ে নিল৷ এই ঘর এখন আর তার একার দখলে থাকবে না৷ শুধু ঘর কেন? বাথরুম থেকে শুরু করে ঘরে থাকা প্রতিটি আসবাবে সে ছাড়া একজন রমণীর দখলে চলে যাবে। মনে মনে হাসল কিঞ্চিৎ। সময়ের স্রোতে মানুষের জীবনের গতিবিধি কী নিদারুণ ভাবেই না পরিবর্তন হয়ে যায়।
সদ্য স্নান করে বেরিয়েছে সৌধ। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে৷ এমন সময় সিমরানকে নিয়ে ঘরে এলো স্মৃতি আপু। তার পেছন পেছন এলো প্রাচী, ফারাহ, লুনা৷ ঘরে ঢুকেই প্রাচী প্রায় এক চিৎকার দিল,
‘ ওররে বাস এত্ত সুন্দর সাজিয়েছে! হাউ সুইট! তোরা যেমন কাপল ঠিক তেমনি বাসর সাজিয়েছে। তোদের জুটির সঙ্গে একেবারে মেইড ফর ইচ আদার। ‘
বাসরঘরে হৈ-হুল্লোড় লেগে গেল। সিমরানের মাঝে কোনো খেয়াল নেই। তার শারীরিক অবস্থা শোচনীয়। নিজের শরীরটা ধরে রাখাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি আপু, ফারাহ দু’জনই বুঝতে পারল তার অবস্থা। যারা এসব ফেইস করে আসে তারাই কেবল বুঝে৷ বিয়ের দিন একটা মেয়ের ওপর দিয়ে কত ধকল যায়। শারীরিক, মানসিক দু’দিকেই চাপ পড়ে ভীষণ। প্রাচী আর লুনা গিয়ে বিছানায় বসে তাজা বেলি, গাঁধা আর গোলাপ ফুল গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে৷ বিছানার মাঝ বরাবর, তিন ফুলের পাপড়ির সমাহারে লেখা সৌধ লাভ সিনু৷ লুনা ছবি তুলছে সেটার৷ সৌধ এসে প্রাচীকে বলল,
‘ প্রাচী চল নিচে যাই। ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল প্রাচী। সৌধ ইশারায় কিছু বোঝাতে লুনাকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়েই বেরিয়ে গেল সে। বলল,
‘ যত আড্ডা, গল্প নিচে হবে। উপরে এখন সৌধর বউ রেস্ট করবে রেস্ট৷ বাব্বাহ কী কেয়ারিং! জিউ সৌধ জিউ৷ ‘
প্রাচী বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই সৌধও বেরিয়ে এলো। সিমরান ভারি পোশাক ছেড়ে মেকআপ তুলে
লম্বা একটি শাওয়ার নিল। এরপর স্মৃতি আপু গাঢ় নীল রঙের একটি সুতি তাঁতের শাড়ি পরিয়ে দিল সুন্দর করে৷ হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুখিয়ে বিনুনি গেঁথেও দিল। এরপর জিজ্ঞেস করল,
‘ এখন আরাম লাগছে? ‘
‘ আগের চেয়ে হালকা লাগছে। ‘
মিষ্টি করে হাসল স্মৃতি। সিমরানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আচ্ছা একটু শুয়ে থাক। একদম ডিনারের সময় ডাকতে আসব৷ রেস্ট কর কেমন? ‘
মাথা নাড়ল সিমরাম৷ সত্যি একটু আরাম করা উচিত। আর কুলাচ্ছে না। ফুলে সজ্জিত বিছানা৷ শুতে ইতস্তত করছিল সে৷ স্মৃতি আপু বলল,
‘ একপাশে শুয়ে পড়। ভাই না আসা পর্যন্ত এগুলো সরানো যাবে না। ‘
নিমেষে বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করে ওঠল মেয়েটার৷ লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল মুখটা৷ অনুভূতিরা বুকের ভেতর ছুটোছুটি করতে লাগল। স্মৃতি আপু ওর গাল টিপে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ থাক, সুযোগ পেলে খাবার আগেই ভাইকে পাঠাব৷ ‘
আর দেরি না করে বেরিয়ে গেল সে। কিন্তু নিচে গিয়ে সৌধকে পেল না৷ জানতে পারল বন্ধুদের নিয়ে বাইরে গেছে সে। আজিজ নাকি বিয়ারের আবদার করেছে। এই নিয়ে গাল ফুলিয়েছে ফারাহ৷ মুখটা প্রায় কাঁদো কাঁদো। আইয়াজ কেন গেল ওদের সঙ্গে? সে জানে আইয়াজের সব বন্ধুরাই এসব খায়৷ সৌধ ভাইও বাদ যায়নি। তার ইনোসেন্ট জামাই এসব ভুলেও ছুঁয়ে দেখে না৷ আজ যে বন্ধুদের সঙ্গে গেল৷ যদি ঝোঁকের বশে ছুঁয়ে ফেলে? এক আতঙ্ক স্পর্শ করে রইল ফারাহর বুক।
সময় গড়াল ঘন্টাখানেক। ডিনারের সময় হয়ে এলে রেগেমেগে আইয়াজকে কল করল ফারাহ৷ আইয়াজ জানালো তারা বাড়ির সামনেই। এতগুলো বের হলো ফিরল কেবল দু’জন। আইয়াজ আর সৌধ। ডাইনিং টেবিলে দু’টো চেয়ারই ফাঁকা। একটা ফারাহর পাশে আরেকটা সিমরানের পাশে। নেভী ব্লু শাড়ি পরিহিত সিমরান। মাথায় অমায়িক ভঙ্গিতে ঘোমটা টানা। নব বধূ নব বধূ ছাপটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। একটু থামল সৌধ। হকচকিয়ে গেল কিঞ্চিৎ। ধীরপায়ে এসে বসল সিমরানের পাশে। মৃদু হেসে বলল,
‘ কী ব্যাপার আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে নাকি সবাই? শুরু করো, শুরু করো। ‘
সবাই খাওয়া শুরু করল। সিমরান এক দুইবার খাবার মুখে তুলে আর খেতে পারল না৷ বার বার পানি খেতে লাগল। ফারাহ বলল,
‘ সিনু, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। ‘
স্মিত হাসল সিমরান৷ সৌধ খাওয়ার ফাঁকে একবার তাকাল ওর দিকে। দৃষ্টি খাবারে রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ পরিচিত ঘর, পরিচিত মানুষ। এত হেজিটেড ফিল কেন করছিস বুঝতে পারছি না। টেইক ইজি সিনু। ‘
.
.
রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। নিজের ঘরে এলো সৌধ। অন্যদিনের চেয়ে আজকে ঘরে ফেরার ব্যাপারটা আলাদা৷ এতদিন রাতবিরেতে ফিরলে শূন্য ঘরে ফিরত৷ কিন্তু আজ তার ঘরটা পূর্ণ। ঘরে ঢোকার পূর্বে মৃদু কেশে নিল সৌধ। হোক নিজের বউ৷ তাতে কী? তবু সরাসরি ঢুকতে দ্বিধা বোধ করল। চাইল না সিনু কোনোভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ুক৷ তাদের মাঝে আবছা এক দেয়াল রয়েছে। সিমরান যতই তাকে ভালোবাসুক৷ কঠিন এক জড়তা আছে ওর মাঝে৷ জড়তা তার মাঝেও আছে। দু’দিক থেকেই যে জড়তা, যে দ্বিধা আছে। সব কাটিয়ে ওঠা না পর্যন্ত এভাবে বুঝে শুনে চলতে হবে। বিয়ে মানেই দুজন দু’জনের প্রতি সমস্ত অধিকার পেয়ে যাওয়া নয়। সৌধ মনে করে তারা কেউই এখনো তাদের প্রতি পূর্ণ অধিকার পেয়ে যায়নি৷ পরিপূর্ণ ভাবে অধিকার পেতে আগে পরিপূর্ণ ভাবে একে অপরের হতে হবে। দু’জন, যখন দু’জনার হয়ে যাবে তখনি আসবে একে অপরের প্রতি অধিকার, প্রেমত্ববোধ। আর ভালোবাসা, মায়া? ধীরে ধীরে সেসবও তৈরি হয়ে যাবে।
সৌধর কাশির আওয়াজ পেয়ে ধাতস্থ হয়ে ওঠে বসল সিমরান। শাড়ির অবস্থা করুণ৷ হাসফাস লাগছে ওর৷ শাড়ি পরে ঘুমাতে অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেলেই শরীর থেকে শাড়ি সরে যাবে। সৌধ ভাই এসে ওভাবে দেখে ভাববে,
‘ কী নির্লজ্জ সিনু। প্রথমদিনই কেমন অর্ধন গ্ন হয়ে শুয়ে আছে! ‘
এসব চিন্তায় আর ঘুমাতে পারছে না সে। এমন সময় সৌধ এলে ঝট করে ওঠে বসে। দরজা আঁটকে সৌধ ঘুরে তাকাতেই বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। সৌধ দেখতে পায় সবই। কিন্তু বুঝতে না দিয়ে মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বেড সাইট টেবিলে ওয়ালেট, সেলফোন রাখে। সিমরান ইতস্তত করতে করতে বিছানার একপাশে সরে যায়৷ সৌধ তাকায়। ফুলে সজ্জিত বিছানায়৷ তার আর সিনুর নামে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
‘ ফুলগুলো সরানো দরকার। ‘
মাথা নাড়ে সিমরান৷ লজ্জা লাগছে তার৷ এত বেশি লজ্জা কেন লাগছে? এই প্রথম কোনো পুরুষের সাথে এক ঘরে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন করবে বলে? পুরুষটি আর কেউ নয়, স্বয়ং সৌধ ভাই। তার কিশোরী বয়সের প্রণয় পুরুষ। চিরকালের সঙ্গী। তার স্বামী ডক্টর. সৌধ চৌধুরী। বুকে কাঁপন ধরে মেয়েটার। সৌধ হাত বাড়িয়ে ফুল গুলো সরাতে থাকে। বলে,
‘ বিছানার ঝাড়ুটা নিয়ে আয়। ‘
মৃদু চমকায় সিমরান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়৷ সৌধ ‘ওহহো’ বলে। সিমরান জানবে কী করে তার বিছানা ঝাড়ু কোথায়? আনমনে হাসে সে। বলে দেয় ঝাড়ু কোথায় আছে। সিমরান নিঃশব্দে গিয়ে ঝাড়ু নিয়ে আসে। সৌধ হাত পাতলে দেয় না। মিহি গলায় বলে,
‘ আমি দিয়ে দিচ্ছি। ‘
আলতো হাসে সৌধ। বলে,
‘ ব্যাপার না। কাল থেকে তুই’ই ঝাড়বি। আজ আমি শিখিয়ে দিই। ‘
‘ আমি পারি। ‘
‘ জানি। তবু শিখাচ্ছি এনি প্রবলেম? ‘
ত্বরিত মাথা নাড়ে সিমরান।
‘ নো প্রবলেম। ‘
বিছানা ঝেড়ে ফুল গুলো ঘরের এক কোণে জমিয়ে রাখে। সিমরান বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে। সৌধর সুক্ষ্ম চোখে কোনো কিছুই এড়ায় না। তাই দেখতে পেল তার বউ মৃদু মৃদু কাঁপছে। অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে মেয়েদের কাঁপাকাঁপি হয়৷ সিমরানের মাঝে অতিরিক্ত লজ্জা, উত্তেজনা দু’টোই কাজ করছে৷ টের পায় সে। ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর পেছনে। একটুক্ষণ চোখ বুজে ভাবে, আজ তাদের বিয়ের প্রথম রাত৷ এটাকে শুধু প্রথম নয় বিশেষ রাতও বলে। ওর মনের অনুভূতি বুঝতে একটুও সময় নেয় না সৌধ। না চাইতেও তারও বুকের ভেতর মৃদু শিহরণ জাগে৷ এই শিহরণের নাম কী দেবে সে? ভালোবাসা নয় তবে কী? পৌরুষত্ব? নাহ নিজের ব্যক্তিত্ব এতটুকু নিচে সে নামাতে পারে না৷ এই শিহরণের নাম সে দেবে, ভালোলাগা, অপরিমেয় মুগ্ধতা। যা সময়ের স্রোতে একদিন ভয়ংকর ভালোবাসায় রূপ নেবে। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ে সৌধ। দু’হাতে সিমরানের কাঁধ স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়৷ নিমিষেই ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে সিমরানের৷ আঁতকে ওঠে তাকায় সৌধর মুখপানে৷ তৎক্ষনাৎ আবার চোখ সরিয়ে নেয়৷ সৌধ মৃদুস্বরে বলে,
‘ আজ আমাদের নতুন জীবন শুরু সিনু। আমাদের মাঝে অজানা কোনো বিষয় নেই। আমি চাইও না থাকুক। সিনু, তাকা আমার দিকে। ‘
সহসা তাকায় সিমরান৷ সৌধ ওর চোখ দু’টোতে নিজের শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
‘ আমি মনের ওপর জোর দিয়ে কিছুই করতে পারি না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনো এক পা ও নড়ি না৷ তুই আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আমার কাছে তোর চাওয়া, পাওয়া থাকবে স্বাভাবিক। কিন্তু আমি নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে কিছুই দিতে পারব না৷ ‘
‘ এভাবে বলছ কেন? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু দিতে বলেছি আমি? ‘
‘ সেটাই বলছি। আমার মনের তীব্র ইচ্ছে থেকে যেমন তোকে আমি বউ করেছি ঠিক তেমনি ভয়ংকর আকাঙ্ক্ষা থেকেই তোকে সম্পূর্ণরূপে আমার করে নেব। ‘
শিউরে ওঠল সিমরান। চোখ দু’টো সরিয়ে নিল আচমকা। কাঁধ থেকে এক হাত সরিয়ে এনে সিমরানের নরম গালে আলতো ছুঁয়ে দিয়ে সৌধ পুনরায় বলল,
‘ তুই অনেক বুঝিস। এটা আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড়ো অর্জন। বিলিভ মি, আজ যদি তুই আমাকে না বুঝে নিজের চাওয়া, পাওয়া গুলো বুঝে নিতি। আমার কিছু করার থাকত না। আমার মন সায় না দিলেও পৌরুষ চাহিদা ঠিক সায় দিয়ে দিত৷ এই যে সাপোর্ট দিলি এরজন্য আমি বেঁচে গেলাম। ‘
তীব্র লজ্জায় অস্বস্তি লাগছে সিমরানের। সৌধ টের পেল। আসলে তার মাথা কাজ করছিল না৷ বিবেকের কাছে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। তাই এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল। নিঃশ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে সৌধ। তার অন্য হাতও এসে সিমরানের গাল ছুঁয়েছে। দু’হাতে অতিযত্নে শুভ্র, নরম গাল দুটো চেপে ধরে হঠাৎ সে বলল,
‘ আমার ভালোবাসার বীজ বপন আজ থেকেই হোক সিনু। ‘
কথাটা বলেই আকস্মিক তার পুরুষালি ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল সিমরানের ছোট্ট ললাটে। নিমেষে চোখ দুটো বুজে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান। সৌধ খেয়াল করল ওর চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মৃদু হেসে দু’হাতের তর্জনী দিয়ে জল মুছে দিল সে। এরপর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানায়। শীতল গলায় বলল,
‘ আজ এই বিশেষ রাতে তুই আমার কাছে কী চাস বল? ‘
চোখ মেলে তাকাল সিমরান। এতক্ষণ হওয়া সমস্ত খারাপ লাগা পালিয়ে গেছে সৌধর থেকে পাওয়া এই এক টুকরো পরশে। সৌধ ভাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই না৷ ভেতর থেকে টান না এলে কারো প্রতি এক বিন্দু মায়া, ভালোবাসাও দেখায় না। তাই যতটুকু পেয়েছে এটুকুর জন্যই নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হলো। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল নিজের ভালোবাসার প্রতি। সৌধ ভাইয়ের যে ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে, যে সৌধ ভাইকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে তার প্রতি। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান। ইতস্ততা, লজ্জাবোধ দূরে ঠেলে মিহি স্বরে বলল,
‘ আমি তোমার কাছে তিনটে জিনিস চাই সৌধ ভাই।’
নিমেষে স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ। সিমরান তাকে আগে থেকেই ভাই ডাকে৷ এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে বাসর রাতে এমন করে বলে ফেলবে বুঝতে পারেনি৷ কেন জানি অস্বস্তি ঠেকল। লজ্জাও পেল। কিন্তু পূর্বের সম্পর্কের কথা ভেবে কিছু বলতে পারল না। হতভম্ব মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বল কী কী চাই। ‘
বিছানায় ওঠে বসল সিমরান। আশপাশে তাকিয়ে ত্বরিত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার গিটার কোথায়? আমি চাই আজ এই বিশেষ রাতে তুমি আমাকে উৎসর্গ করে একটি গান গাও। গান গাওয়ার আগে চোখ বন্ধ করে কেবল আমাকেই ভাবো। আমাকে ভেবে, শুধুমাত্র আমার জন্য তোমার মনের ভেতর যে গান আসবে সে গানটি শুনতে চাই আমি৷ ‘
বিস্ময়ান্বিত হয়ে গেল সৌধ। সে ভেবেছিল নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু, দামী কিছু চাইবে। পরোক্ষণেই ভাবল, মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া ছোটোখাটো বিষয়ই অনেক বিশেষ আর মূল্যবান হয়। সিমরানের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল সৌধর। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ভেতর থেকে কি একটু আফসোস হলো? এই গভীর ভালোবাসা আগে খুঁজে পায়নি কেন? নাহ, জীবনে কোনোকিছু নিয়ে আফসোস করতে নেই। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সঠিক সময়েই সঠিক জিনিস দেয়। কেবল আমরাই ভুল সময়ে, ভুলটা বাছাই করে কষ্ট পাই। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাত বাড়িয়ে সিমরানের দুটো হাত নিজের কাছে টেনে নিল সৌধ। শুভ্ররঙা, মেহেদি রাঙা নরম দু’হাতের উল্টো পিঠে গাঢ় করে দু’টো চুম্বন এঁকে দিল। সর্বাঙ্গে ঝংকার তুলে দিল যেন এই চুম্বন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিমরান। সৌধ সে দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে গিটার বের করে আনল। ফিরে এসে পাশে বসতে বসতে বলল,
‘ আর দু’টো চাওয়া কী? ‘
‘ আগে গান শুনাও পরে বলব। ‘
আর কিছু বলল না সৌধ৷ সিমরানের কথা মতো গিটারে আঙুল গুলো সেট করে চোখ বুজল। আচমকা স্মরণ হলো সেই ক্ষণ৷ যে ক্ষণে সিনুকে সে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যে ক্ষণে অশ্রুসিক্ত সিনু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘ আমাকে ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হতো সৌধ ভাই? ‘
যে ক্ষণে সিনু আবদার করেছিল,
‘ কিশোরী বয়স থেকে যে তোমাকে ভালোবাসে তার চোখে একবার তাকাবে? গভীরভাবে। ‘
অতঃপর সে তাকাল। তার ভগ্ন হৃদয় দেখা পেল সেই দু’টো চোখের যে চোখে তার জন্য সমুদ্রের অতল গভীরে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা জমে ছিল। যা খুঁজে পাওয়ার যন্ত্রণাই হোক বা আনন্দ। দীর্ঘকাল নির্বাক হয়ে ছিল সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সৌধ। আচমকা চোখ খুলে তাকায় সিমরানের দিকে। বুক ধক করে ওঠে সিমরানের। ভয় হয় কোনোভাবে নিধি আপুর কথা মনে পড়ে যায়নি তো? সে যখন সৌধর প্রথম ভালোবাসা নিয়ে ভয়ে জর্জরিত। সৌধ তখন নিজের শেষ ভালোবাসা আঁকড়ে ধরার সুখে বিমোহিত,
” আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই,
আমায় কতটা ভালোবাসো সে কথাটা জানতে চাই।
ভালোবাসার যতকথা, হৃদয়ে দিয়ে শুনতে চাই।
তুমি শুধু আমার হবে, পৃথিবীকে বলতে চাই।
এ হৃদয়ে জ্বলছে এক যাতন মোমবাতি,
তুমি আগুন হয়ে পুড়ছো আমায় সারা দিবা রাতি।(২)
এ হৃদয়ে ফুটছে ফুল প্রেমের বারমাস,
তুমি ফাগুন হয়ে রঙ ছোয়ালে মনেরো নীল আকাশ।
আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই,
আমায় কতটা ভালোবাসো সে কথাটা জানতে চাই।
এ প্রনয়ে অন্ধ হলাম, প্রানের আলো তুমি।
দঃখ এলে ভুলে যেওনা, বাঁচবোনাতো আমি।(২)
এ প্রনয়ে কথা দিলাম সূর্য চন্দ্র তারা,
সাক্ষী থেকো মরন যেনো হয়না তোমায় ছাড়া।
আমি তোমার মনের ভিতর একবার ঘরে আসতে চাই,
আমায় কতোটা ভালোবাসে সে কথাটা জানতে চাই।
ভালোবাসার যতোকথা, হৃদয়ে শুনতে চাই।
তুমি শুধু আমার হবে, পৃথিবীকে বলতে চাই।
চলবে।
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৪|
নিধি চমৎকার একটি মেয়ে৷ প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন নারী৷ ওর সম্পর্কে বিয়ের আগে এমনই ধারণা ছিল অর্পণের৷ বিয়ের পর সেই ধারণায় চিড় ধরতে শুরু করলেও ধারণাটি পুরোপুরি
মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি৷ কিছু ভুল, মানসিক দ্বন্দ্ব মেয়েটাকে গুলিয়ে ফেলেছিল৷ আঘাত এনেছিল ব্যক্তিত্বে৷ যা নিয়ে সংশয়ে ছিল অর্পণ। আজ সে সংশয় পুরোপুরি কেটে গেছে৷ বিয়ের পর তারা দু’জন সুখী দম্পতি হতে পারেনি৷ কিন্তু আজ তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে ছেলে এবং ছেলের মাকে নিয়ে সুখের একটি পরিবার গড়ে তুলতে পারবে৷
সকালবেলা নিধির আবদারে ওকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল অর্পণ। রাত হয়ে যাওয়াতে আর বাসায় ফেরেনি৷ কাছাকাছি একটি রিসোর্টে ওঠেছে৷ রাতের খাবার খেয়ে ওরা এখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।অনেকক্ষণ ধরে কান্না করছে অনিরূপ৷ বুকে আগলে ঘরজুড়ে পায়চারি করেও ছেলের কান্না থামাতে পারছে না নিধি। অর্পণ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। মোবাইলের স্ক্রিনে গভীর মনোযোগ রেখেছে সে। আধঘন্টা আগে সৌধ চৌধুরীর আইডি থেকে গট ম্যারেড স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। সাইয়্যারা সিমরান আইডিতে ট্যাগ করার ফলশ্রুতিতে স্ট্যাটাসটি তার নিউজফিডেও ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ সিমরান তার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে রয়েছে। বুকভরে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছাড়ল অর্পণ। ঠিক কতদিন পর এমন একটি নিঃশ্বাস বেরুলো তার বুক চিড়ে? জানা নেই। সে শুধু জানে, অনেকটা রিলিফ ফিল করছে আজ৷ ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে ফোন রেখে নিধির দিকে তাকাল সে। নিধি বাচ্চার কান্না থামাতে মহাব্যস্ত৷ যেন জগতের অন্য কিছুতে এখন ধ্যান নেই তার। যা অর্পণের অনুভূতিকে দ্বিগুণ আনন্দিত করল। আজ সৌধ বিয়ে করে নিজেকে সম্পূর্ণ লিখে দিয়েছে অন্য কারো নামে৷ সেই অন্য কারো সাথেই হয়তো এখন বাসরে বিভোর রয়েছে। তার জীবনে নিধির কোনো অস্তিত্ব নেই। পরোক্ষণেই শুধরালো। যদিও থাকে তা শুধুই বন্ধুত্ব৷ বন্ধুত্বের বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না৷ সৌধ যে ধরনের ছেলে তাতে করে বউ ব্যতীত অন্য কোনো, স্পেশালি পরের বউ নিয়ে সে এর বাইরে কিছু মনে রাখার কথা নয়৷ আর নিধি? স্বামী, সন্তান নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে রাতে সন্তান নিয়ে ব্যস্ততায় কাটাচ্ছে। ওর মনে কি সৌধর চিন্তা একবারো এসেছে? যদিও বা আসে এ মুহুর্তে সেটা কি ধোঁয়াশা নয়? বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল অর্পণ। এগিয়ে গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ আমি দেখছি। ‘
নিধি যেন একটু স্বস্তি পেল। বাবার কোলে দীর্ঘক্ষণ থাকার পর ঘুমিয়ে গেল অনিরূপ৷ নিধি ছেলে ঘুমানোর বিছানা করে দিয়ে বলল,
‘ ঘুমিয়ে গেছে। নিয়ে আসুন। ‘
ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বুকে আলতো চাপড় দিতে লাগল অর্পণ। এরপর অপলকে ছেলের নিষ্পাপ মুখে তাকিয়ে কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিল। বাবা, ছেলের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল নিধি৷ খেয়াল করে স্মিত হাসল অর্পণ। বলল,
‘ ও কার মতো দেখতে হয়েছে বলো তো? ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল নিধি। ছেলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বলল,
‘ পেটে রেখেছি আমি৷ কিন্তু হয়েছে আপনার মতো। ‘
বিস্তৃত এক হাসি দিল অর্পণ। বলল,
‘ ডেফিনেটলি, আমারি তো ছেলে। এছাড়া ও আরো একজনের মতো দেখতে জানো সে কে? ‘
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল নিধি। অর্পণ পূর্বের হাসি অব্যাহত রেখে বলল,
‘ আমার বাবার মতো। খুব ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। অনিকে পেয়ে আমার সেই শূন্যতা পূরণ হয়ে গেছে৷ স্পেশাল থ্যাংকস টু ইউ নিধি। ‘
কথাটা বলেই ছেলের বাম পাশে শুয়ে পড়ল৷ নিধি শুয়েছে ডান পাশে৷ হঠাৎ তার মনে হলো, আজকের জন্য অর্পণকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি৷ এত সুন্দর দিন উপহার দেয়ার জন্য একটা ধন্যবাদ উনার প্রাপ্য। ভেবেই সহজ, স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ ধন্যবাদ আজকের সুন্দর দিনটার জন্য। ‘
সহসা তাকাল অর্পণ। পুলকিত হৃদয়ে বলল,
‘ থ্যাংকসের প্রয়োজন নেই। অনির মা হ্যাপি থাকলেই আমি হ্যাপি। ‘
চকিতে তাকাল নিধি। ঠোঁটে আঁকল মৃদুময় হাসি৷ যে তাকানো আর হাসিতে বিমুগ্ধ হয়ে অর্পণ ইশারা করল, কাছে আসতে৷ নিধি অবাক হয়ে মুখ এগুতেই সন্তর্পণে ওর ললাটে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো অর্পণ। শীতল গলায় বলল,
‘ আজ থেকে আমাদের নতুনভাবে পথচলা শুরু। ‘
দৃষ্টি সরিয়ে নিল নিধি৷ চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করল অর্পণকে। পারল না বোধহয়। টলমল দৃষ্টিতে চোখ খুলল ফের। অর্পণ সে দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি নিধি। আর আমি জানি একটু দেরি হলেও তুমি সে ভালোবাসা অনুভব করতে পারবে৷ আমাদের বন্ধন ঠুনকো নয়। আমরা সৃষ্টিকর্তার ইশারাতে এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। একটু সবুর করো। ধৈর্য্যহারা হইয়ো না৷ নিজেকে তো ঘৃণা করোই না৷ তুমি ঠিক আছো প্রপারলি ঠিক আছো। আমরা সবাই মানুষ। আমাদের মন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে যায়৷ খুবই স্বাভাবিক। আই রেসপেক্ট ইউ এণ্ড ইউর ফিলিংস। ‘
জড়সড় হয়ে শুয়ে রইল নিধি৷ অর্পণ ওকে মানসিক সাপোর্ট দিতে কাছে টেনে নিল৷ সন্তান এবং স্ত্রীকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে রাখল। নিধি অনুভব করল, অর্পণের একটি হাত নিগূঢ় ভরসার সাথে ওর মাথায় বুলিয়ে চলেছে। নিমেষে তার বিবেক বলে ওঠল, যে পুরুষ বুকে টেনে আশ্রয় দিচ্ছে, মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোদদান করছে সে পুরুষকে অনুভব না করা অন্যায়। ভালো না বাসা পাপ৷ দু-চোখ বেয়ে নোনাপানির ধারা নামল নিধির৷ যা বুঝতে দিল না অর্পণকে। দীর্ঘ একটা সময় পেরিয়ে অর্পণ অনুভব করল, নিধি হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। যা তার সমস্ত সত্তায় শিহরণ জাগিয়ে তুলল।
.
.
দু’দিনের আনুষ্ঠানিকতায় এত বেশি চাপ গেছে যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ফারাহ৷ অথচ আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটেনি৷ সমাপ্তি ঘটবে আগামীকাল। তারা ফিরে যাবে পরশুদিন। স্বামী, স্ত্রী হিসেবে আইয়াজ, ফারাহ একদম নিখুঁত। পৃথিবীতে এমন দম্পতি বিরল৷ দু’জন ভীষণ মেধাবী আর এস্টাব্লিশড
হলেও খুবই সহজ ব্যক্তিত্ব পোষণ করে। ওদের দু’জনের মানসিকতা এত বেশি ইতিবাচক যে দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকা সহজ হয়ে গেছে। যদিও ফারাহ অনেক বেশি অভিমানি৷ তবে সে অভিমান আইয়াজের গভীর প্রণয়ে গলে যেতে বাধ্য। কোনো বিষয় নিয়ে সাময়িক অভিমান করলেও খুব সহজে মেনে যায় ফারাহ। আর আইয়াজ তাকে মাঝেসাঝে রাগতে দেখা গেলেও কঠিন রাগ দেখেনি ফারাহ। যা দেখেছে টুকটাক। সবচেয়ে বেশি দেখেছে মাথাভর্তি জ্ঞানবুদ্ধি আর বুকভর্তি আকাশের মতো বিশাল ভালোবাসা। আর চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটোতে নিজের প্রতি ভয়াবহ আসক্তি। ভীষণ ভালোবাসাময় আর যত্নশীল স্বামী পেয়ে নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে সৌভাগ্যবতী অনুভব করে ফারাহ৷ আর সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা জানায়, তার এই সুখে, এই প্রেমে, ভালোবাসায় কারো নজর না লাগুক।
পা দু’টোতে ভীষণ ব্যথা করছিল ফারাহ৷ যা নিয়ে একটু আগে কেঁদেছেও৷ তার কান্না সহ্য করার মতো শক্তি আইয়াজের নেই৷ তাই তো চোখ দু’টো লাল করে, মুখ ভার নিয়ে পায়ে মলম লাগিয়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে আরাম পেল ফারাহ৷ গোমরা হয়ে থাকা বরটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ শুনছ ব্যথা কমে গেছে৷ কাছে এসো এখন। ‘
আইয়াজের মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না৷ সে তার কাজেই মগ্ন এমন সময় ফারাহ জোরপূর্বক পা দু’টো সরিয়ে নিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘ কেমন স্বামী তুমি? শুধু পা ব্যথাই সারাচ্ছ। এদিকে যে বুকে ব্যথা মনে যন্ত্রণা সেগুলোর কী হবে? ‘
হতভম্ব হয়ে গেল আইয়াজ। কাছে এসে বলল,
‘ এত দুষ্টুমি কে শেখালো তোমাকে? ‘
চট করে আইয়াজের গলা জড়িয়ে ধরে ফারাহ বলল,
‘ যাদের বর অনেক বেশি ইনোসেন্ট তাদের একটু দুষ্টু হতেই হয়। ‘
ঠোঁট কামড়ে হাসল আইয়াজ৷ ফারাহ যত্ন সহকারে ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিল। আইয়াজ ততক্ষণে গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়েছে বউকে। ভালোবাসার গভীর ছোঁয়াতে টালমাটাল হতে শুরু করেছে ফারাহ। একটি উষ্ণ রাত। দেহশ্রীতে অজস্র উন্মত্ত স্পর্শ। দু’টি হৃদয়ে প্রবল প্রেম তরঙ্গ সৃষ্টিতে বিভোর।
.
.
সৌধর কণ্ঠে গান শুনতে ভালোবাসে সিমরান। আজ তাদের বিশেষ রাতে বিশেষ মুহুর্ত উপহার দিল সৌধ। যা সিমরান তার গভীর ভালোবাসা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দ্বারা অর্জন করে নিয়েছে। গান শেষে যথাস্থানে গিটার রেখে ফিরে এলো সৌধ। সিমরান মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে তার স্বপ্ন পুরুষকে। যে সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে জীবনে৷ যার সাথে আজ তার প্রথমবার এক ঘরে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন৷ বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক বেদনা অনুভব করল। এই বেদনায় কষ্ট নয় মিশে আছে অজস্র সুখ। পলক তাকিয়ে থাকা সিমরানের চোখে তাকাল সৌধ। মৃদু কেশে ভারিক্কি গলায় বলল,
‘ রাত বাড়ছে। বাকি দু’টো চাওয়া ঝটপট বলে ফেল।’
চমকে দৃষ্টি ঘোর কাটাল সিমরান৷ ত্বরিত আরক্ত মুখশ্রী ঘুরিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল। সৌধ ভড়কে গেল ওর লজ্জা দেখে। এত অল্পতে লজ্জা পাওয়া রমণী দেখে অভ্যস্ত নয় সে। দেখবেই বা কাকে? তেমন কোনো নারীর সংস্পর্শে যাওয়াই তো হয়নি। বন্ধু, বান্ধব ছাড়া জুনিয়র কারো সঙ্গে স্পেশালি জুনিয়র মেয়েদের সঙ্গে তার কোনোকালেই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। এসবে পটু ছিল সুহাস৷ সে নয়৷ বান্ধবীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ছিল ওই প্রাচী, নিধিই। যারা এত অল্পতে লজ্জা পেতো না। নিধি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ছুঁয়ে দিলেই ওর লাজুক মুখ দেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। কিঞ্চিৎ মেজাজ খারাপ হলো। সে এখন বউয়ের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাচ্ছে। আজকের রাত, এই সময় এবং সে এখন পুরোপুরিই সিনুর৷ নাহ ভুল হলো শুধু আজকের রাত, আজকের সময় নয়। আজকের পর থেকে তার জীবনের প্রতিটি সময়ই সিনুর জন্য বরাদ্দ। নেভি ব্লু রঙের শাড়ি পরিহিত সিমরানের পানে এবার সে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ওর এই লজ্জাশীলতা তার কাছে নতুন। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর আরক্ত মুখ, তীব্র লজ্জায় ভারিক্কি নিঃশ্বাস সবকিছুতেই নতুনত্বের স্বাদ৷ যা তার পৌরুষেয় অনুভূতিতে শিহরণ জাগালো। টের পেল, সিমরানের প্রতি সে অন্যরকম টান অনুভব করছে৷ প্রকৃতপক্ষে এই টান স্বাভাবিক। কিন্তু সে মানতে নারাজ। কারণ তার ভেতরের শক্তিশালী এক সত্তা জানে এই টানে ভালোবাসা নেই। আছে সুপ্ত থাকা সেই পৌরুষ চাহিদা। সহসা মৃদু কেঁপে ওঠল সৌধ। নিজেকে কঠিন খোলসে আবৃত করে নিল ত্বরিত। ভাবল চুম্বকের ধর্মই আকর্ষণ করা। সিনু তার বউ হয়ে চুম্বকের ধর্ম পালন করছে। সে কোনো সাধারণ লোহা নয় যে এত সহজেই বিকর্ষণ করবে। সে সেই লোহা যে শুধু দৈহিক নয় হৃদয়গত ভাবে টান অনুভব না করা পর্যন্ত বউয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে না। অর্থাৎ সিমরান নামক চুম্বকে সে নামক লোহা ততক্ষণ আটকাবে না যতক্ষণ না মনের গহিন বন থেকে প্রগাঢ় ভালোবাসা অনুভব করছে। যা তার প্রথম ভালোবাসাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে। সিমরানের পানে দৃষ্টি অটল রেখেই একপেশে হাসল সৌধ। বিরবির করে বলল,
‘ পরাস্ত তো হয়েই গেছে। মেয়েটা আমাকে জয় করে নিয়েছে। সৃষ্টিকর্তার লিখিত নিয়মের ঊর্ধ্বে যেতে পারিনি আমি। কঠিন বন্ধনে, ভয়াবহ মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গেছি। ‘
ঘার ফেরালো সিমরান। এখন অনেকটায় শান্ত। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। যেন বিরবির করে বলা কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। সত্যি শুনেছে কিনা নিশ্চিত হতে পারল না সৌধ। ঘড়ির কাঁটায় সময় একটা ছুঁই ছুঁই। বেশ রাত হয়ে গেছে। তারা উভয়ই যথেষ্ট ক্লান্ত। তবু প্রথম রাত বলে ঘুমানোর জোর দিতে পারছে না৷ তাদের কথা তো শেষ হয়নি। ঢোক গিলল সৌধ। বলল,
‘ বাকি দু’টো চাওয়া কী? ‘
স্পষ্ট কণ্ঠের সে বাক্যে হুঁশ ফিরল সিমরানের। নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে নিয়ে বলল,
‘ শুয়ে শুয়ে বলি? আর বসে থাকতে পারছি না৷ মেরুদণ্ড দিয়ে ব্যথা করছে। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। সারাদিন কম ধকল যায়নি৷ আগে থেকেই ঠিকভাবে খাওয়া, দাওয়া করে না সিমরান৷ গত দু’দিনে যে আরো বেশি অনিয়ম হয়েছে ঢের বুঝতে পারল। সে খুবই নিয়ম মেনে জীবনযাপন করে। প্রচণ্ড স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তার বউকেও এসব মেইনটেইন করে চলতে হবে। কোনোকিছুতে অবহেলা করা যাবে না। মনে মনে ভাবল, সিমরান খুব একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে থেকে বড়ো হয়নি৷ ওর সবকিছুতে অনিয়মের ছাপ রয়েছে। এই যেমন বাইশ বছর বয়সেও ওকে দেখতে ষোল বছরের কিশোরীর মতো। একেবারে ছিপছিপে গড়ন। ওজন কত হবে? আন্দাজ করা যায়, বিয়াল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের ওপরে যাবে না৷ তার বউকে তো এমন থাকলে চলবে না৷ কঠিন নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। রাত জাগা, বেলা করে ঘুমোনোর অভ্যাস, এলোমেলো ঘুরাঘুরি। সব বাদ দিতে হবে৷ মন দিয়ে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে৷ নিজের আলাদা একটা পরিচয় গড়ে তুলতে হবে৷ একটানা কথাগুলো ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সে। তার আদর্শ গুলোকে আচমকা আয়ত্ত করতে পারবে না সিনু৷ তাই এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করতে হবে৷
‘ কী হলো শুবো না? ‘
চমকাল সৌধ। সম্বিৎ ফিরে পেল এমনভাবে বলল,
‘ হ্যাঁ সিয়র। ‘
ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল সিমরান৷ শাড়ি পরে শুঁতে ভীষণ সমস্যা হলো। পায়ের দিক থেকে শাড়ি, পেটিকোট উপরে চলে আসতে চাইলে ত্বরিত সে নিচে নামিয়ে সচেতন ভাবে শুয়ে রইল। আঁচল যেন ঠিক থাকে সেজন্য আগেই সেফটিপিনের সাহায্য নিয়েছে। সৌধর নিজের শরীরটারও বিশ্রাম প্রয়োজন তাই সিমরান শুয়ে পড়লে সেও বেশ ব্যবধান রেখে পাশেই গা এলিয়ে দিল। নিমেষে বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠল সিমরানের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় সর্বাঙ্গ শিহরিত হলো। বুকের ভেতর তরঙ্গ বইলো ছলাৎছলাৎ। ফরসা গাল দু’টোয় গোলাপি আভায় ভরে ওঠল। সৌধ ওর দিকে ঘুরে শুয়েছে৷ তাই সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেয়ে বলল,
‘ আর কত লজ্জা পাবি? এবার দু’টো চাওয়া বল৷ ঘুমাব আমি। ‘
অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে গিয়েও সহসা ফিরে এলো সিমরান৷ টালমাটাল হৃদয়টুকুতে স্থিরতা দিয়ে বলল,
‘ আমি জানি না তুমি আমার দ্বিতীয় চাওয়াটুকু সমর্থন করবে কিনা৷ কিন্তু আম্মু চলে যাওয়ার পর আমি সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশনে কাটিয়েছি আমার এই দ্বিতীয় চাওয়া কখনো পূর্ণ হবে কিনা তাই নিয়ে। কারণ আমার যে পরিবার সে পরিবারে এসব ভাবা মূর্খতা। আর আব্বু আমাকে যার সাথে বিয়ে দিচ্ছিল তার পরিবারে গিয়েও এই চাওয়াটুকু প্রাধান্য পেতো না৷ কারণ তাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড এত বেশি হাই ছিল যে আমার চাওয়াটুকু সেখানে গ্রহণযোগ্য হতো না। ‘
থামল সিমরান। সৌধ চুপচাপ কথাগুলো শুনছিল। সে থামতেই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
‘ সরাসরি কথা বলা পছন্দ করি আমি। ‘
বুক কেঁপে ওঠল সিমরানের। সৌধর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিছানার সাদা চাদরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থমথমে গলায় বলল,
‘ আমি কখনো চাকরিবাকরি করতে চাই না সৌধ ভাই। পড়াশোনা শেষ করে শুধু তুমি আর এই সংসারে পূর্ণ মনোযোগ দিতে চাই৷ আমি আমার অবিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারিনি৷ বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে চাই পরিপূর্ণ ভাবে।
আমি একজন বঞ্চিত সন্তান। যে ঠিকঠাক পরিবার পাইনি। বাবা, মাকে সেভাবে কাছে পাইনি। তাই শশুর, শাশুড়ি আর স্বামীর সংস্পর্শে থেকে বাকি জীবন কাটাতে চাই৷ স্বামী, সন্তান ঘিরে পূর্ণ সুখ চাই। আমি জানি না কখনো আমার সন্তান হবে কিনা৷ সেই সৌভাগ্য কখনো তুমি দান করতে পারবে কিনা। ‘
সৌধর স্বাভাবিক চোখ, মুখ নিমেষে রুক্ষতায় রূপ নিল৷ আকস্মিক তোপের মুখে পড়ল সিমরান।
‘ ওয়েট আ মিনিট, সন্তান হবে কিনা মানে? আমাকে নিয়ে তোর সংশয় আছে! ‘
চমকে ওঠল সিমরান৷ কাঁপা স্বরে আমতা আমতা করে বলল,
‘ আমি ওটা বলতে চাইনি। আসলে আমাদের মাঝে যদি.. না মানে তুমি যদি কোনোদিন আমাকে মন থেকে আপন করে নিতে না পারো তাহলে বেবি আসবে কী করে? এটা ভেবে বলেছি৷ এছাড়া তোমাকে নিয়ে কোনো প্রকার সংশয় নেই ট্রাস্ট মি। ‘
মুখটা চুপসে গেছে সিমরানের। বুক ধড়ফড় করছে খুব৷ ওর কথা শুনে একটু যেন শান্ত হলো সৌধ। বারকয়েক নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ বাকি কথা শেষ কর। ‘
ভয়ে জমে গিয়েছিল প্রায় সিমরান৷ এবার স্বস্তি মিলল। আল্লাহ! একটি সামান্য কথা কী ভয়ংকর দিকে মোড় নিচ্ছিল। সৌধ ভাই কি ভেবেছিল, সে তার পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ করেছে? ছিঃ ছিঃ এমন কিছু সে কল্পনাই করতে পারে না৷ এই ভয়ানক ভাবনাটা কেন এলো সৌধর ভাইয়ের মাথায়? আর কিছু ভাবতে পারল না সিমরান৷ সৌধ ভাই অপেক্ষায় আছে তার পুরো কথা শোনার জন্য৷ তাই ত্বরিত বলল,
‘ আমি জানি আজকাল মেয়েরা এস্টাব্লিশড হওয়ার জন্য অনেক স্ট্রাগল করছে। কত মেয়ে সুযোগের অভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না হিসেব নেই। আমার কাছে সুযোগ আছে। আমার নিজের পরিবার, শশুর বাড়ির প্রতিটি লোকের সাপোর্টও পাবো। তবু আমি এস্টাব্লিশড হতে চাই না। আমি জাস্ট পড়াশোনা শেষ করে সংসারে মন দিতে চাই৷ নিজের ক্যারিয়ারের জন্য পরিবার, সন্তানকে সেক্রিফাইস করতে চাই না আমি যেটা আম্মু করেছিল। শেষ পর্যায়ে পুরো জীবন ক্যারিয়ারের পিছনে খাঁটিয়ে অল্প কিছু সময় পরিবারের জন্য, স্বামী সন্তানের জন্য না রেখে বিদায় নিতে চাই না আমি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সৌধ ভাই। আমি তোমার সাথেই আমার প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহুর্ত কাটাতে চাই। তোমার বউ গৃহিণী হলে কি খুব অসুবিধা হবে? সম্মানে আঘাত লাগবে? আমি যদি ঘর, সংসার সামলাই তুমি কি বউ হিসেবে আমাকে মেনে নিতে পারবে না? প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে কী? ‘
কিয়ৎকাল চারপাশে থমথমে নীরবতা বিরাজ করল। সিমরান অসহায় মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল সৌধর পানে। সৌধ স্তব্ধ মুখে শুয়ে আছে। সত্যি বলতে তার জীবনবোধ আলাদা। সে কখনো ভাবেনি তার ওয়াইফ একজন সাধারণ গৃহিণী থাকবে। পরোক্ষণেই নিজের আম্মার কথা মনে পড়ল। কেঁপে ওঠল নিমেষে। তবে কী সৃষ্টিকর্তা তার মায়ের মতো ব্যক্তিত্বধারী একজনকেই তার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাঠালো? আচমকাই ভেতর থেকে আলহামদুলিল্লাহ বেরিয়ে এলো তার। সিমরান চাতকিনীর মতো তাকিয়ে। চোখে কী অসহায়বোধ। কিন্তু তার মায়ের চোখে তো এমন অসহায়ত্ব কখনো দেখতে পায়নি৷ সে একজন দৃঢ় চিত্তের অধিকারী। চোয়াল দুটো শক্ত সৌধর। চোখ দু’টো স্থির সিমরানের মুখে৷ হঠাৎ কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বলল,
‘ তোর কেন মনে হচ্ছে হাউস ওয়াইফ হওয়া অতি সাধারণ ব্যাপার? গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন দেখিস অথচ আর দশজনের মতোই গৃহিণী শব্দটাকে হেয় করে উচ্চারণ করিস। যেখানে এ শব্দটাকে সম্মানই করতে পারছিস না সেখানে এটা হওয়ার আবদার করিস কীভাবে? শুধুমাত্র আবেগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত? ‘
হতভম্ব হয়ে গেল সিমরান। সৌধ কিছুক্ষণ থেমে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে পুনরায় বলল,
‘ তুই কি আমার আম্মাকে দেখিস না? সাধারণের মাঝে এক অসাধারণ মানুষ আমার আম্মা। যে শিক্ষিত হলেও সার্টিফিকেটের পাওয়ার নিয়ে কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়নি৷ অথচ এ পরিবারের প্রত্যেকটা উচ্চশিক্ষিত সদস্য সার্টিফিকেট অর্জন করে সম্মানিত পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা তার হাতের মুঠোয় রয়েছে। উদাহরণ , আব্বা, আমি ভাইয়া, স্মৃতি আপা এণ্ড সুলল কাকুও। সো, তুই এভাবে অনুনয় না করে, মুখে অসহায়ত্ব না ফুটিয়ে প্রপারলি হাউজওয়াইফ হওয়ার এপ্লিকেশনটা রেসপেক্ট এণ্ড প্রাইডের সাথে দিতে পারতি৷ ‘
আকস্মিক ঘামতে শুরু করল সিমরান৷ তার সব কথাতেই ভুল! যা বলছে সবেতেই একটা করে ভুল ধরছে সৌধ ভাই। কান্না পেয়ে গেল এবার৷ কিন্তু কাঁদা যাবে না৷ ধমক খাওয়ার আশঙ্কা আছে। সৌধ ভাই সম্পর্কে ছোটো থেকে কম জানাশোনা হয়নি। সতর্ক হয় সিমরান। সৌধ একবার থেমে সিমরানকে দৃষ্টিপাত করে। এরপর দম্ভের সঙ্গে বলে,
‘ গ্রো আপ সিনু। ভীষণ ইমম্যাচিওর তুই। আগে তোকে ম্যাচিওর হতে হবে৷ আবেগের বশে এতবড়ো সিদ্ধান্ত নিতে নেই৷ পরে পস্তাতে হয়। ‘
‘ আমি বুঝেই নিয়েছি সিদ্ধান্ত। তুমি চাও তোমার বউ চাকরি করুক। এস্টাব্লিশড থাকুক। এজন্য মানছ না জানি আমি। ‘
‘ জানাটা বেশি হয়ে গেছে। এস্টাব্লিশড বলতে কী বুঝিস তুই? হাউসওয়াইফ মানে কি এস্টাব্লিশড নয়?’
চোখ দুটো চকচক করে ওঠল সিমরানের। আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘ একটু বুঝিয়ে বলো না? ‘
দমে গেল সৌধ৷ কণ্ঠ নির্মল করে বলল,
‘ আমার বউ চাকরি করবে কি না করবে এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বউ দিয়ে চাকরি করিয়ে তার টাকাপয়সা হাতানোর কোনো শখ নেই আমার। তোর সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি৷ একজন শিক্ষিত, আত্মসম্মান সম্পন্ন, সৎ চরিত্রবান মানুষকেই আমার স্ত্রী হিসেবে চাই৷ সে ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করল কি না করল এটা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে না৷ আমার আম্মা বাইরে চাকরি করতে বেরোয় না। সে গৃহিণী জীবন যাপন করে তার মানে কি সে প্রতিষ্ঠিত নয়? এই উত্তর আমি দিব না। বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজেই উত্তর বের কর। আর রইল তোর গৃহিণী হয়ে থাকার বিষয়। এটা আমার সৌভাগ্য যে একজন সুন্দরী, শিক্ষিত, স্মার্ট গর্জিয়াস রমণী শুধুমাত্র আমাকে ভালোবেসে আমার সংসার সামলেই তার বাকি জীবন কাটাতে চায়। নিঃসন্দেহে আমার হৃদয় এটা শুনে পুলকিত হয়েছে। ‘
নিজেকে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলা সৌধর প্রতিটি কথা হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল সিমরানের। ভয়াবহ লজ্জায় আক্রান্ত হলো সে। চোখ তুলে তাকাতে অব্দি পারল না। সে সুন্দরী, স্মার্ট, গর্জিয়াস, শিক্ষিত তাকে পেয়ে সৌভাগ্যবান সৌধ ভাই! কথাগুলো শুধু কর্ণে নয় বক্ষগহ্বরেও প্রতিধ্বনি হতে শুরু করল। শিউরে ওঠল শরীরের প্রতিটি লোমকূপও। কিছু সময় পর শুনতে পেল সৌধর সুস্পষ্ট ভাষায় বলা দু’টো শব্দ,
‘ তৃতীয় চাওয়াটা কি? ‘
কোনোকিছু না ভেবেই সিমরান বলে দিল,
‘ আমাদের মাঝে কখনো কোনোকিছু নিয়ে গোপনীয়তা থাকবে না৷ সবকিছু জেনে শুনেই আমি তোমার বউ হয়েছি। ভালোবাসি তোমাকে। তাই পরবর্তীতে অজানা কিছু তৈরি না হোক। ‘
বাঁকা হাসল সৌধ। এতক্ষণ সিমরানের দিকে ঘুরে শুয়েছিল৷ এবার চিত হলো। দৃষ্টি উপরে রেখে মৃদুস্বরে বলল,
‘ একজন পুরুষের জীবনে স্ত্রী কী জানিস? তার অর্ধেক অঙ্গ। আমার অর্ধেক অঙ্গ হয়ে জীবনে এসেছিস তুই৷ এখন থেকে আমার জীবনে কিছু ঘটা মানে তোর জীবনেও ঘটা। তোর জীবনে কিছু ঘটেছে মানে সেটা আমার জীবনেও ঘটেছে। আমি অবুঝ নই আর না অমানুষ। আমার জীবনে এখন তোর চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু নেই। তুই ছাড়া বড়ো কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীও নেই। সেম টু ইউরস। আশা করি বোঝাতে পেরেছি৷ ‘
কয়েক পল চুপ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফের বলল,
‘ঘুমো এবার। ঘুম পেয়েছে আমার। ‘
কথাটা বলেই পাশ ফিরল সৌধ৷ পরোক্ষণেই হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে ঘুরে শুয়ে সিমরানের বিস্মিত দৃষ্টিতে নিজের শান্ত দৃষ্টির মিলন ঘটাল। হাত বাড়িয়ে আলতো স্পর্শ করল ওর নরম গালে। বিনয়ের সুরে বলল,
‘ গুরুত্বপূর্ণ টপিকটাই মিস করে গেছি! তোর মোহরানার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। দু’তিনের মধ্যেই একাউন্টে পৌঁছে যাবে৷ সুহাসের থেকে তোর একাউন্ট নাম্বার নিয়েছিলাম গতকাল। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা