ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0
926

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৯|
হসপিটাল কোয়াটার৷ নিজের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ডক্টর. অর্পণ শিকদার। অবসর সময় গুলো বই পড়ে কাটায় সে৷ বাবা হওয়ার পর থেকে বই পড়ার সময় হয়ে ওঠে না তেমন৷ অবসর পেলেই ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ ছেলে এবং ছেলের মা। কেউই বাসায় নেই। বেড়াতে গিয়েছে। সেও কর্মহীন। তাই বই নিয়ে বসেছে। তার মা অপরূপা শিকদার। এক কাপ দুধ চা নিয়ে ছেলের কাছে এলেন৷ পাশে বসে চা হাতে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

‘ বউ মা কখন আসবে? ‘

এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে অপর হাতে চোখের চশমা খুলল অর্পণ। কোলের ওপর রাখা বইয়ের ওপর চশমা রেখে মৃদু হেসে বলল,

‘ অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে৷ একটু দেরি হবে বোধহয়। ‘

অপরূপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলের দিকে থম মেরে তাকিয়ে থেকে ওঠে গেলেন নির্লিপ্ত ভাবে। এ জীবন ভালো লাগে না তার৷ বেঁচে থাকতে ছেলের সুখ দেখে যেতে পারবে কিনা জানে না। সন্তান হয়ে গেল। তবু ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলো না। বিয়ে করল, সন্তান হলো। অথচ সংসার হয়ে ওঠল না। সংসারটা যেন ভাসমান পানা। ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে যতটা সংশয় তার চেয়েও অধিক সংশয় এখন নাতিকে নিয়ে৷ অর্পণ চুপচাপ চা পান করছে। তার মা নিজের ঘরে গিয়ে সব সময়ের মতো দুঃশ্চিন্তা করছে তার পরিবার নিয়ে। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠল৷ মৃদু চমকে ওঠে দাঁড়াল অর্পণ। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই নিধির ফ্যাকাশে মুখের দেখা মিলল। ঘুমন্ত অনিরূপকে জড়িয়ে ধরে বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। সহসা হাত বাড়াল সে। বিনাবাক্যে অনিরূপকে কোলে তুলে দিল নিধি। অর্পণ ছেলেকে বুকে আগলে নিয়ে সরে দাঁড়াল। নিধি নিশ্চুপ ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে চলে গেল নিজের ঘরে৷ বরাবরই মুখে আঁধার নামিয়ে থাকে নিধি। কালেভদ্রে যদিও হাসি দেখা যায়। তা শুধু অনিরূপের সঙ্গেই। আজ বন্ধুদের সাথে দেখা করে এলো। সেখানে নিশ্চয়ই সৌধ ছিল। নিশ্চয়ই তাকে দেখে মনের মধ্যে থাকা অপরাধবোধ গাঢ় হয়েছে? মনে মনে ধারণা করে ছেলেকে নিয়ে বেডরুমে গেল অর্পণ। দেখতে পেল বিছানার একপাশে মলিন মুখে বসে নিধি। সে ঘরে যেতেই ত্বরিত ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছল৷ এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনিরূপের বিছানা গুছাতে। বিছানা গুছানো শেষ হলে অর্পণ শুইয়ে দিল অনিকে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে অনিরূপ। তাকে সামলাতে বাইরের পোশাকেই শুয়ে পড়ে নিধি। ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে ফের ঘুমের দেশে ফিরে যায় অনি৷ অর্পণ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় ড্রয়িংরুমে। আধঘন্টা পর যখন নিজের ঘরে ফিরে দেখতে পায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিধি। যে কান্না তাকে দেখে থেমে যায়। ধাতস্থ হয়ে ওঠে নিজের কাপড়, তোয়ালে নিয়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্পণ। ছেলের পাশে গিয়ে বসে। হাত বাড়িয়ে নিষ্পাপ বাচ্চাটার মাথায় আলতো করে স্পর্শ করে। বিরবিরিয়ে বলে,

‘ তোর বাবা, মায়ের সংসারটা আর হলো না অনি৷ তোর মুখ চেয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না৷ জোর করে সংসার নামক মায়াজালে আর আঁটকে থাকতে ইচ্ছে করে না। ‘
.
.
মাগরিবের আজান দিয়েছে। প্রকৃতির আবছা আলোয় সৌধর গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষা করছে সে। অভিমানী তরুণীর অপেক্ষা। গাড়ি পর্যন্ত কাজিনরা এগিয়ে দিল সিমরানকে। হবু দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপও করে গেল। গাড়ির দরজা খুলে বসে ছিল সৌধ। সিমরান ওঠে এসে বসল তার পাশে৷ দরজা লক করে সম্মুখে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসে রইল। সৌধ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। এরপর লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে ড্রাইভারকে বলল,

‘ চলুন। ‘

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলে নড়েচড়ে বসল সিমরান। তার পরনে হালকা গোলাপি রঙের ঢিলেঢালা জর্জেটের সেলোয়ার-কামিজ। বাদামি বর্ণ চুলগুলো পেছন দিকে উঁচু করে তুলে ঝুঁটি বাঁধা। মুখে কোনো প্রসাধনী মাখেনি। আর না ঠোঁটে ছুঁইয়েছে লিপস্টিক।
দু’কাধে ওড়নার দুই কোণা তুলে বুক ঢেকে রেখেছে। খুব সাধারণ, শালীন বেশ। সবই ঠিকঠাক। ঠিক নেই শুধু সিমরানের মুখ। এত ব্যস্ততার ভীড়ে সময় দিচ্ছে এই হাঁড়ির মতো মুখ দেখার জন্য? ভ্রু কুঁচকে রইল সৌধ। গাড়ি চলছে। সিমরান তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। এসি চলছে। তাই কাঁচ নামানো নেই। সৌধ জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যাবি? ‘

সিমরান সব সময় যেখান থেকে কেনাকাটা করে সেখানের নাম বলতেই ড্রাইভার সেদিকে গাড়ি ঘুরালো। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই সৌধ পুনরায় প্রশ্ন করল,

‘ আমি আজ তোকে বকিনি। একটা সাধারণ বিষয়, সাধারণ একটা কথা। এরজন্য এভাবে মুখ ভাড় করে রাখলে বিষয়টা আমার জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তুই বাইরের কোনো মানুষ না। খুব তাড়াতাড়ি আমার ব্যক্তিগত মানুষ হতে যাচ্ছিস। তোর সঙ্গে আমার সব ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে। প্রয়োজনে বকতে পারি৷ চার, পাঁচটা ধমক দিতে পারি। প্রয়োজনে মানুষ সবকিছুই করে। আর আমি মানুষটা অপ্রয়োজনে থুথুও ফেলি না। তখন যদি রাগ দেখিয়েও থাকি, চোখ রাঙিয়েও থাকি। সেটা প্রয়োজনীয় ছিল। এরজন্য মুখ ভাড় করে কী বোঝাতে চাইছিস? কী চাচ্ছিস? আমি সরি হই এটা চাচ্ছিস? যদি এটা তোর উদ্দেশ্য হয় তাহলে এক্ষুনি তুই আমার প্রতি সরি হবি। কারণ, আমি ভুল করিনি। অযথা, অন্যায় ভাবেও কিছু বলিনি। ‘

অভিমান হয়েছিল। এখনো ছিল৷ কিন্তু সৌধ ভাইয়ের কথাগুলো শুনে ধুকপুক করে ওঠল বুক। সে কি সত্যি সৌধ ভাই দুঃখীত হোক চাচ্ছিল? একদমই না৷ কিন্তু তার খুব অভিমান হয়েছিল। এখনো হচ্ছে। তাই বলল,

‘ তুমি সরি হও চাইনি আমি। ‘

‘ তাহলে কী চাচ্ছিস? ‘

‘ কিছু না৷ একটু মন খারাপ হয়েছিল। ‘

‘ কেন? ‘

মনে মনে সিমরান বলল,

‘ বলব না৷ বললে তুমি আমায় ভুল বুঝবে। নিধি আপুর প্রতি তোমার চোখে অদ্ভুত মায়া আমায় তীব্র কষ্ট দিচ্ছিল৷ ‘

মুখে বলল,

‘ তখনকার প্রশ্নের উত্তর পাইনি বলে। ‘

‘ কেন দেইনি? ‘

দৃঢ় কণ্ঠ সৌধর৷ সিমরান ঢোক গিলে বলল,

‘ বেডরুমে ছিলাম না তাই। ‘

অকস্মাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সৌধ। সিরিয়াসলি? পরোক্ষণেই আবার ভাবল, হ্যাঁ সিরিয়াসলি। সুহাসের বোন বলে কথা। হালকা কেশে ওঠল সৌধ। গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘ তোর প্রশ্নটা কী ছিল? ‘

সহসা সৌধর পানে তাকাল সিমরান। মৃদু আলোয় সৌধর ভারিক্কি চোয়াল, সুগভীর দৃষ্টিদ্বয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ তুমি এখনো নিধি আপুকে ভালোবাসো? ‘

‘ যদি না বলি মিথ্যা হবে। যদি হ্যাঁ বলি তুই কষ্ট পাবি। আমি তোকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। ‘

বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল সিমরানের। সৌধ ভাই বলল, তাকে কষ্ট দিতে চায় না। তাই উত্তরটা বুঝতে পেরেও সুপ্ত ক্লেশপূর্ণ অনুভূতিটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সচেতন ভাবে। যেন পাশের মানুষটা টের না পায় ভালোবাসার মানুষটি অন্য কাউকে এখনো ভালোবাসে কিনা প্রশ্নটি করেই নিঃশ্বাস আঁটকে ছিল সে। এত সচেতন হয়েও লাভ হলো না। সৌধ স্পষ্ট শুনতে পেল সেই নিঃশ্বাসের শব্দ। তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি যে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি প্রখর। তা বোধহয় পাশের রমণীটি জানে না৷ ভেবেই মনে মনে হাসল কিঞ্চিৎ।

শপিংমলের সামনে গাড়ি থেমেছে। সৌধ ড্রাইভারকে নেমে দাঁড়াতে বলে। ড্রাইভার নেমে গেলে সিমরানও দরজা খুলতে উদ্যত হয়। সৌধ বাঁধা দেয়। তার পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতের বাঁধা পেয়ে চমকে যায় সিমরান। হকচকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। সৌধ একপেশে হেসে তার ফরসা নরম হাতটা টেনে কাছে নেয়। বা’হাতের অনামিকায় পরিয়ে দেয়া রিংটাতে দৃষ্টি স্থির রেখে শীতল কণ্ঠে বলে,

‘ হবু স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা মেনে নেয়া যন্ত্রণার৷ এটুকু যন্ত্রণা তোর প্রাপ্য ছিল সিনু। জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিস। একটু তো পুড়তেই হবে। ‘

এ পর্যন্ত বলেই নিজের দু’টো উষ্ণ হাতে সিমরানের বা’হাত জড়িয়ে রাখল। একটুখানি গা ঘেঁষেও বসল। সিমরান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা নিয়ে বসে। সৌধ ওর নরম হাতটা নিজের হাত দ্বারা জড়িয়ে। গভীর দৃষ্টিতে সেখানেই তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগল,

‘ একটি সত্যি কথা শুনবি? ‘

‘ হু? ‘

‘ আমি আমার প্রথম প্রেম হারিয়ে যে যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। সেই যন্ত্রণা ক্ষীণ হয়ে এসেছে তোর যন্ত্রণা অনুভব করে। এই যে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছিস, একটু একটু করে পুড়ছিস। এরজন্য ভিতর থেকে আমি খুব সরি হচ্ছি তোর প্রতি। ‘

একটুখানি চমকাল সিমরান। দু-চোখে ভর করল কিঞ্চিৎ বিস্ময়। সৌধ একটু থেমে পুনরায় বলল,

‘ সিনু, ভালোবাসা অন্যরকম এক অনুভূতি। এই অনুভূতি সহজে কারো প্রতি আসে না। আর যদি সহজে এসে যায়। তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না৷ যদি সম্ভব হয় তাহলে ওটা ভালোবাসা না ক্ষনিকের মোহ। নিধি আমার মোহ ছিল না। ওকে আমি খুব সহজেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। একদম হুট করে। সবচেয়ে বড়ো কথা ভালোবাসার ঊর্ধ্বে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। অনেক ঘনিষ্ঠ মুহুর্তও ছিল আমাদের! রাগ করি, যাই বলি ওকে ভুলা ওকে ভালো না বাসা আমার পক্ষে সম্ভব না। তার মানে এই না আমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব না। ‘

এ পর্যায়ে সিমরানের চোখের দিকে তাকাল সৌধ। ধীরে ধীরে মেয়েটার চোখ ঝাপসা হয়ে এলে ত্বরিত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধরে রাখা হাতটা আরো গভীর করে ধরল। একটু শক্তভাবে। এরপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ আমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব এই বিশ্বাস টা কবে থেকে হয়েছে জানিস? যেদিন ছোটো কাকুর বাংলোতো তোকে প্রত্যাখ্যান করে এলাম, সেদিন থেকে। তোর চোখ দু’টোতে তাকিয়ে যখন আমার বুক কেঁপে ওঠল। আমি বুঝে গেলাম, তুই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসিস। তুই ব্যতীত আর কেউ আমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে না। যুক্তি, তর্কের বাইরে গিয়ে বলছি, একটা মানুষ যদি ভেতর থেকে অনুভব করতে পারে অপর মানুষটি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ তাকে এতবেশি ভালোবাসতে পারবে না। তাহলে নিঃসন্দেহে ওই মানুষটাই তার যোগ্য। বিকজ, সবাই এটা অনুভব করাতে পারে না। সে ছাড়া কেউ তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারবে না। এই অনুভূতি যাকে ঘিরে তৈরি হয়৷ মানুষের উচিত তাকে আঁকড়ে ধরা। হারাতে না দেয়া। ‘

সিমরানের ধরে রাখা হাত দু’টো থেকে একটা হাত সরিয়ে নিল সৌধ। এরপর সে হাত নিজের বুকের বা’পাশে চেপে ধরে সিমরানের ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

‘ ট্রাস্ট মি. নিধির চোখে আমি সেই ভালোবাসা দেখিনি। এত বছর ওর সঙ্গে মিশেও আমি অনুভব করিনি ওর মতো কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। বরং ও সব সময় আমার প্রতি নির্লিপ্ত ছিল। কখনো কখনো মনে হতো গোপনে ভালোবাসে। বিয়ে করলেই পুরোপুরি প্রকাশ করবে। কখনো মনে হতো স্রেফ বন্ধুত্বটুকুই। আজ আমার জীবনে নিধির অস্তিত্ব ধোঁয়ার মতো। দীর্ঘসময় আগুন জ্বলার পর আগুন নেভালে যে ধোঁয়া ওঠে সেই ধোঁয়ার মতো। তুই সেই পানি যা আমার হৃদয়ে নিধি নামক আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছে। বাকি রয়েছে ধোঁয়া। এই ধোঁয়াটুকু যতদিন থাকবে। তোর কষ্ট ঠিক ততদিনই। এরপর হয়তো আর কষ্ট পাওয়ার সুযোগ পাবি না৷ সিনু, আমার তোকে চাই। তোর ভালোবাসা চাই আমার। বিনিময়ে আজন্ম সুখ দেব। অভিযোগ করার সুযোগ দিব না। আমি জানি না দ্বিতীয় বার হাঁকডাক করে বলতে পারব কিনা আমি ভালোবাসি। শুধু জানি আমি ভালোবাসতে পারব। কারণ প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ সব রহস্যই ভেদ করেছি আমি। ‘

দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল সিমরানের। কয়েক ফোঁটা অশ্রু পড়ল সৌধর হাতের পিঠে। অশ্রু স্পর্শে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হলো সৌধর। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সিমরানে অশ্রুসিক্ত রক্তিম মুখশ্রীতে। ওভাবে কত সময় কাটল তা বেহিসেবী। ঘোর কাটল ফোনের রিংটোনে। সৌধর ফোন বাজছে। নাক টেনে মুখ ঘুরিয়ে রইল সিমরান৷ সৌধকে বিচলিত দেখাল না৷ যেন ফোনের আওয়াজ সে শুনতেই পায়নি৷ এমন ভঙ্গিতে বলল,

‘ এদিকে ঘোর। ‘

সিমরান মুখ ফেরায়। সৌধ একহাতে ওর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু মুছে পকেট থেকে টিস্যু বের করে দেয়। এরপর ধরে রাখা হাতটা একটু উঁচু করে ধরে প্রশ্ন করে

‘ এখনো ব্যথা আছে? ‘

সিমরান দু’দিকে মাথা নেড়ে না বোঝাল। দুপুরে যেখানটায় ব্যথা পেয়েছিল ওখানটায় বার বার আঙুল বুলাচ্ছে সৌধ। আকস্মিক উষ্ণ স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাতেই সৌধ মাথা তুলে। হাত ছেড়ে দিয়ে বাঁকা হেসে ভারিক্কি গলায় বলে,

‘ এনি প্রবলেম? ‘

ঢোক গিলে সিমরান৷ লজ্জায় আরক্ত মুখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়৷ বুকের গহীনে দ্রিমদ্রিম শব্দে তরঙ্গ বইতে শুরু করে। মনে মনে বলে,

‘ তুমি একজন পারফেক্ট হার্ট সার্জন সৌধ ভাই। আমার বুকের ব্যথা সারতে তোমার থেকে পাওয়া এই মেডিসিন টুকুই যথেষ্ট। ‘

আবেগে টইটম্বুর হয়ে রইল সিমরান। নিঃশ্বাস ফেলল ঘনঘন৷ সমস্তই অনুভব করল সৌধ। অদ্ভুত অনুভূতি হলো বুকজুড়ে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ সজাগ হলো আচমকা। কান বেয়ে গেল এক উষ্ণ নরম হাওয়া। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিজোড়ার হাসি কত সুন্দর হয় কেউ কি জানে? সৌধ জানে। এই তো সিমরানের অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো কী সুন্দর হাসছে৷ তার বুকের ভেতর চেপে থাকা বিশাল পাথরটাও সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যাকে পায়নি তার জন্য যাকে পেয়েছে তাকে কষ্ট পেতে দেয়া অসম্ভব তার পক্ষে। পুরোপুরি অসম্ভব।

লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারছে না সিমরান। সৌধ বলল,

‘ আর কতক্ষণ লজ্জা পাবি? ‘

নিমেষে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা। সৌধ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ আর কতক্ষণ? ‘

লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সিমরান বলল,

‘ তুমি বাইরে যাও। আমি পাঁচ মিনিট পর বেরুবো। ‘

‘ আরো পাঁচ মিনিট লজ্জা পাবি? ‘

ইশ! মুখ ঘুরিয়ে নিল সিমরান। সৌধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল সে। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলল,

‘ কী হলো এটা? একটু কষ্টের বিনিময়ে যদি এতটুকু সুখ পাওয়া যায়। আমি কষ্টগুলোকে হাসিমুখে বরণ করে নিব। ‘
.
.
নিধির হাবভাব ভালো ঠেকছে না। সন্দেহ করল অর্পণ। মন দেয়া-নেয়া না হলেও দাম্পত্য জীবনের বহুদিন একসাথে কাটানোর ফলে একটু, আধটু বুঝতে পারে নিধিকে৷ খেতে বসে নিধি বার বার তার দিকে তাকিয়েছে। ঘরে আসার পর টের পেল কিছু একটা বলতে এসেও বারবার থেমে যাচ্ছে অনির মা। অনিরূপকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে নিধি। অর্পণ ডিভানে বসতে বসতে ভাবল, ছেলে ঘুমাক তারপর কথা বলবে। জিজ্ঞেস করবে সে কিছু বলতে চায় কিনা।

আইয়াজের কথাগুলো বারবার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাসায় ফেরার পর থেকে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করছে নিধি। তবু অর্পণের সাথে একটি শব্দও বিনিময় করতে পারেনি৷ অদ্ভুত জড়তা কাজ করে। সে প্রচণ্ড ইগোয়েস্টিক একজন নারী। জীবনের এ পর্যায়ে এসে খুব করে অনুভব করল তা। এতদিন সৌধর জন্য নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করত। সেই অশান্তি, সেই যন্ত্রণায় শান্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়তে পারত না৷ আজ আইয়াজের পরামর্শে অর্পণের সাথে সব ঠিক করে নেয়ার চেষ্টায় শ্বাস নিতে পারছে না। কীভাবে শুরু করবে? কী বলবে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না একদম। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে নিজের পারিপার্শ্বিক সবকিছুর প্রতি। অভিযোগ তুলতে ইচ্ছে করছে গোটা পৃথিবীর দিকে। কী দোষ তার? কী অপরাধ তার? তার কি শান্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়ার অধিকার নেই? তার কি অধিকার নেই সুখী জীবনযাপন করার? ভালোবাসা নামক সুখটা কি সে আঁকড়ে ধরতে পারে না? নিমেষে বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল যেন। অনিরূপ ঘুমিয়েছে বুঝতে পেরে বালিশের পাশে থাকা ফোনটা নিয়ে ছুটে গেল বাথরুমে। অকস্মাৎ নিধির এহেন কাণ্ড দেখে অর্পণ ওঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল বাথরুমের সামনে। আড়ি পাতার স্বভাব নেই তার। আজ স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে আড়ি পাতল শুনতে পেল নিধির কথা…।

সৌধর সঙ্গে ডিনার করে বাড়ি ফিরেছে সিমরান৷ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়েছে মাত্র। মামাত বোন তার সাথে ঘুমাতে চেয়েছিল। কারো সঙ্গে বেড শেয়ার করতে পারে না সে। ঘুম হয় না। সামনে অনুষ্ঠান। ঠিকঠাক ঘুম না হলে সমস্যা হবে। তাই বুঝিয়ে বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার ঘুমাবে সে৷
ঘুমানোর পূর্বে বা’হাত উঁচু করে যেখানটায় সৌধ চুমু খেয়েছে ঠিক সেখানটায় পরপর নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল। অনুভব করল বুকের ভেতর শিরশির করছে। অচেনা সুখে হৃদয় টালমাটাল। এমন মুহুর্তে আকস্মিক ফোনটা বেজে ওঠল। চমকে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেল, নিধিপু৷ নিমেষে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অস্বীকার করার জোর নেই। নিধি আপুকে হিংসে হয় তার। কারণ ওই মানুষটাই সৌধ ভাইয়ের প্রথম প্রেম। সৌধ ভাই এখনো মাথা উঁচু করে বলতে পারে নিধিকে ভালোবাসি। অথচ তোকে ভালোবাসি সিনু এটা বলতে পারে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান৷ হঠাৎ নিধি আপু কল করছে কেন তাকে? কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে ওঠে বসে ফোন রিসিভ করল।

‘ নিধি আপু! হঠাৎ? ‘

‘ কী করছিস? ‘

শুয়ে আছি বলতে পারত সিমরান৷ কিন্তু তার আগে কী করেছে সেটা জানানোর ইচ্ছে হলো খুব৷ কেন হলো? জানে না। তবে এটা না বললে তার কোথাও কোনোকিছু কম পড়বে অনুভূতি থেকে বলল,

‘ শপিংয়ে গিয়েছিলাম সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে। একসঙ্গে ডিনার করে মাত্র ফিরেছি। ঘুমাব ভাবছিলাম। তুমি কী করছ আপু? ‘

মুখটা দৃঢ় হয়ে গেল নিধির। নিজেকে বড্ড ছোটো অনুভব করল। কারণ সে টের পেয়ে গেছে সিমরান তাকে জানাতে চাইছে সে সৌধর সঙ্গে টাইম স্পেন্ট করেছে। বোঝাতে চাইছে সৌধ এখন শুধুই তার। তাচ্ছিল্য ভরে হাসল সে। কথা না বাড়িয়ে যে উদ্দেশ্যে ফোন করেছে সেদিকে মন দিল। রয়েসয়ে বলল,

‘ তুই সৌধকে বিয়ে করিস না সিনু। ‘

বুক ধড়াস করে ওঠল সিমরানের। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,

‘ কেন! কী বলছ নিধি আপু? তুমি এ কথা কেন বলছ! তুমিই তো সেদিন অনুরোধ করেছিলে আমি যেন সৌধ ভাইকে না ছাড়ি তাহলে? তুমি কি সৌধকে ভাইয়ের লাইফে ফিরতে চাও? ‘

কণ্ঠ কাঁপছিল সিমরানের। বাঁকা হেসে নিধি বলল,

‘ আমার খুব পরিচিত একজন সৌধকে ভালোবাসে। ওকে না পেলে মেয়েটা ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে। তুই যদি সরে দাঁড়াস মেয়েটার লাইফ বেঁচে যায়। ‘

মাথা ঘুরে গেল সিমরানের। থমকানো স্বরে বলল,

‘ কে মেয়েটা? ‘

‘ ধরে নে আমার আপন কেউ। ‘

চমকে ওঠল সিমরান। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইল। চোখ দু’টো বন্ধ করে অনুভব করল কেবল সৌধকে। আর তার বলা সেই কথা, সেই স্পর্শ। নিজের বা’হাত মুখের সামনে নিল। ঠোঁট বাড়িয়ে আবারো চুমু খেল সেখানটায় যেখানে সৌধ তার পুরুষালি ঠোঁটের উষ্ণ পরশ এঁকেছে আজ। এরপর গলায় মৃদু ক্রোধ মিশিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলল,

‘ তুমি খুব স্বার্থপর নিধিপু। নিজের সুখের জন্য তুমি সবাইকে কষ্ট দিতে পারো সবাইকে। বিলিভ মি তুমি যদি বলতে তুমি সৌধ ভাইয়ের জীবনে ফিরে আসবে। আমি যদি দেখতাম সৌধভাই সবকিছু ভুলে তোমাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী। তাহলে সব স্বার্থ ত্যাগ করে, আমার আবেগ, ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে ঠিক কোনো নাটকীয় চরিত্রের মতোই বিয়েটা ভেঙে দিতাম। কিন্তু না তুমি নিজের সুখের জন্য সৌধ ভাইকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ আজ এসেছ আমাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে৷ আ’ ম সরি নিধিপু। সৌধ ভাইকে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে দান করার মতো শক্তি আমার নেই। আম্মু ঠিক বলত জানো? আমি অতিরিক্ত সরল বলে সবাই এই সরলতার সুযোগ নেয়। আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে আপু। তোমাকে আমি দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ ভেবেছিলাম। সৌধ ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষ নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ হবে না৷ আজ বুঝতে পারলাম, তুমি সৌধ ভাইয়ের জীবনের বিগ মিস্টেক! ইয়েসস, ইউ আর অ্যা বিগ মিস্টেক ইন সৌধ ভাই’স লাইফ! ‘

নিজের বক্তব্য শেষ করে তীব্র ক্রোধ আর চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে দিল। সিমরান ফোন কেটে দিয়েছে বুঝতে পেরে চোখ দু’টি সন্তর্পণে বুজে ফেলল নিধি৷ ফিরে গেল সে দিনটায়। যেদিন দুর্বল হৃদয়ের অধিকারিনী সিমরান নিজের ভালোবাসার কথা ভুলে গিয়ে তার দুপা ধরে অনুরোধ করেছিল। সৌধর ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়ে। সময়ের স্রোতে আজ সব বদলে গেছে। ওই মেয়েটা এখন নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছে। সিনু বুঝে গেছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কারো সাথেই আপোষ করতে নেই। নিধির চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বিরবির করে বলল,

‘ আমি সৌধর লাইফে মিস্টেক হয়েই থাকতে চাই। আজ যে কথা তুই বলেছিস ভবিষ্যতে একই কথা সৌধর মুখে শুনতে চাই। যদি না শুনি তাহলে তুই হেরে যাবি সিনু। ‘
.
.
বাথরুমের দরজা খুলতেই অর্পণের মুখোমুখি হলো নিধি৷ স্তব্ধ মুখে তাকিয়ে অর্পণ। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার কোন আপনজন সৌধকে ভালোবাসে? ‘

‘ আড়ি পাতছিলেন? ‘

রাগান্বিত কণ্ঠ নিধির৷ আজ অর্পণের ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেল। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ পাতছিলাম। বলো কোন আপনজন সৌধকে ভালোবাসে? আপনজনটা তোমার হৃদয় না তো? ‘

সহসা কেঁপে ওঠল নিধি। দৃষ্টি জোড়া ঝাপসা হয়ে গেল তার। ধরা গলায় বলল,

‘ আপনি আমাকে অপমান করছেন। ‘

‘ না করছি না। সত্যিটা বলছি। এভাবে আর নয় নিধি। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স! ‘

‘ হোয়াট! ‘

‘ ইয়েস। ‘

‘ অনির কী হবে? ‘

‘ সেই চিন্তা তোমার থাকলে আজ তুমি এখানে এভাবে থাকতে না৷ ‘

ক্রোধে ফুঁসছে অর্পণ। নিধির সামনে এক মুহুর্ত দাঁড়াতে চাইল না সে। সরে যেতে উদ্যত হলো। মাথা ঘুরতে শুরু করল নিধির। কী করবে? কী বলবে কিচ্ছু ভেবে না পেয়ে আচমকা অর্পণের হাত টেনে ধরে বলল,

‘ প্লিজ আপনি মাথা ঠান্ডা করুন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন। ‘

ফুঁসে ওঠা আগুন নিভে গেল আচমকা। নিধির থেকে এই অনুনয় নতুন তার জন্য। তাই নিভল। চুপচাপ গিয়ে ডিভানে বসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,

‘ বলো কী বলার আছে? ‘

নিধি দাঁড়িয়ে ছিল। অর্পণ এ কথা বলায় গিয়ে পাশে বসল। যা অর্পণকে অনেক বেশিই অবাক করে। নিধি হঠাৎ মাথা নিচু করে কান্নারত কণ্ঠে বলল,

‘ আমি মিথ্যা বলেছি সিনুকে। ‘

‘ কেন? ‘

‘ যাচাই করে নিলাম সৌধর জন্য ও কতটুকু যোগ্য। কারণ একদিন ও অনায়াসে সৌধর থেকে সরে যেতে চেয়েছিল। ‘

‘ তোমার লাভ? ‘

‘ সৌধ আমার বন্ধু। মিথ্যা বলব না৷ অতীতে অনুভব না করলেও এখন করি, ও আমার জীবনে বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু ছিল। তাই ওর জীবনে সত্যি কারের ভালোবাসা আসুক। তাকে নিয়ে ও সুখী হোক। এটুকুই চাই এখন। ‘

‘ পরীক্ষা করছিলে সৌধর হবু ওয়াইফকে? ‘

বুদ্ধিমান অর্পণ। তাই বুঝে নিল সবটাই। নিধি মাথা তুলে ঘুরে তাকাল। অর্পণ তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে তার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ আমি সুখ চাই অর্পণ। আমি শান্তি চাই। আমি ডিভোর্স চাই না। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাই আপনার কাছে। ‘

চোখ দিয়ে নোনাপানির ধারা নামল নিধির। অর্পণ চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করল। মনটা তার বিধ্বস্ত। সুখ কী জিনিস ভুলেই গেছে। শান্তি! সেটা কী? ডিভোর্স? রাগের মাথায় উচ্চারণ করেছে। তাই বলে কি দিতে পারবে? বহুদিনের পছন্দের মানুষ ছিল নিধি। ভাগ্যক্রমে বউ হিসেবে পেয়ে ভালোবাসতে শুরু করেছিল গভীরভাবে। সেই ভালোবাসায় ভাঁটা পড়ল মেয়েটার থেকে দিনের পর দিন অপমান আর অসম্মান পেয়ে। আজো তার হৃদয়ে কোথাও না কোথাও নিধির গভীর অস্তিত্ব রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা তারা স্বামী, স্ত্রী। তাদের ফুটফুটে একটি সন্তান রয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পণ। নম্র স্বরে বলল,

‘ সরি। রাগের মাথার ডিভোর্সের কথা বলেছি। মন থেকে না। ‘

অবাক হয়ে তাকাল নিধি। নিজের প্রতি ঘৃণা হলো তার। এই মানুষটা কত বিনয়ী। সৎচরিত্রের অধিকারী। অথচ এর সাথে সে দিনের পর দিন অন্যায় করে যাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো নিধি। অর্পণ ওঠে দাঁড়ালে সেও আচমকা ওঠে দাঁড়াল। বার বার স্মরণ করতে লাগল আইয়াজের বলা কথাগুলো। তারও মন বলছে সব ইগো দূরে সরিয়ে, সবকিছু ভুলে গিয়ে যে মানুষটার সঙ্গে সে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই সব সমস্যার সমাধান। সব যন্ত্রণার অবসান।

প্রচণ্ড জড়তা, মানসিক টানাপোড়েন পেরিয়ে আচমকা অর্পণের সামনে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিধি। ভুলে গেল সে একজন ডক্টর, কারো মা। আটাশ বছর বয়সী এক নারী। একদম বাচ্চাদের মতো করে স্বামীর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কান্নারত কণ্ঠে কী বলল কিচ্ছু বুঝল না অর্পণ। শুধু থেকে থেকে সরি শব্দটি শুনতে পেল। এরপর? এরপর আর কী? অর্পণ কী পারে নিজেকে ধরে রাখতে? দীর্ঘদিন গুমোট হয়ে থাকা অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ উগরে বেরুলো। স্ত্রীকে জড়িয়ে নিল বুকের মধ্যিখানে। এভাবে কতক্ষণ সময় পেরুলো তাদের জানা নেই।

নিধির কান্না কমে এলে অর্পণ দু’হাতের তালুতে ওর গোলাকৃতি মুখটা আলতো করে চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ অনির আব্বু অনির আম্মুকে ভীষণ ভালোবাসে। আফসোস অনির আম্মুর সে ভালোবাসা চোখে পড়ে না। ফেলে আসা ভালোবাসায় বিভোর হয়ে সামনের ভালোবাসা দেখতে বড্ড অনীহা তার। ‘

অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল নিধি। ধীরেধীরে আবারো জড়িয়ে ধরল অর্পণকে। বুকে মাথা রেখে বিরবির করে বলল,

‘ আমায় ভালোবাসুন অনির আব্বু৷ প্রমিজ করছি আর অনীহা দেখাব না। শুধু ভালোবাসুন আমায়। প্লিজ আমি মরে যাব, ভালোবাসার অভাবে মরে যাব আমি৷ ভালোবাসুন আমায়। ‘

নিধি কথাগুলো বলতে বলতে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অর্পণকে। অর্পণ অনুভব করল তার বুকের ভেতর যেন ঢুকে যাবে নিধি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। নিধির সম্পূর্ণ অনুভূতি টের পাচ্ছে অর্পণ। তাই কিছু সময় শান্ত করার চেষ্টা করল ওকে। এরপর ভালোবাসার কাঙালিনীকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়াল বিছানার দিকে। নিধির চোখ দু’টো বন্ধ। পুরো মুখশ্রীতে অশ্রুজল লেপ্টে আঠালো হয়ে আছে। সন্তর্পণে স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। এরপর ঘরের ডানপাশে গিয়ে দোলনায় সযত্নে শুইয়ে দিল অনিকে ৷ দু’পাশে দু’টো কোল বালিশ রাখল আপাতত বাবা, মায়ের প্রক্সি হিসেবে। এরপর রুমের বাতি নিভিয়ে সে চলে গেল বউয়ের কাছে। দীর্ঘদিন এক ঘরে এক বিছানায় থেকেও কাছাকাছি আসা হয়নি। আজ অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েও অর্পণ সৎ ব্যবহার করল না। নিধির মন বিধ্বস্ত। দেহের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাদের। হয়নি কেবল মনের। তাই বুকে আগলে নিয়ে কপালে চুমু খেল। একে একে আদুরে স্পর্শে ভরিয়ে তুলল পুরো মুখশ্রীতে। এরবেশি এগুলো না। নিধি না চাইলে এরবেশি আগাবেও না। সময় গড়াল বেশ। হঠাৎ নিধির সম্পূর্ণ দেহশ্রী আগলে নিয়ে ওর কানের কাছে মুখ রাখল অর্পণ। মৃদুস্বরে বলল,

‘ পৃথিবীতে সব মানুষ এক নয়। এক নয় সব মানুষের ভালোবাসার নিয়মও। সৌধ তোমাকে কীভাবে ভালোবেসেছে জানি না৷ জানতেও চাই না। আমি সৌধ নই৷ আমি অর্পণ। আমি আলাদা। আমি তোমার স্বামী৷ তোমার সন্তানের বাবা৷ আমি যেমন আলাদা একজন মানুষ তেমনি আমার ভালোবাসাও আলাদা। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিধি। তুমি যদি আমার ভালোবাসা অনুভব করতে না পারো তাহলে শুধু একটা কথা মনে রেখো, সৌধ তোমার জন্য হারাম। আমি হালাল। আমাদের এই পবিত্র সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কোনোকিছুই হতে পারে না৷ শুনতে খারাপ লাগলেও বলছি তোমাদের বন্ধুত্বও আমাদের সম্পর্কে ঠুনকো। নিধি, ফোকাস করো আমার স্পর্শে, আমার কথায়। দেখো শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই আর কিচ্ছু নেই। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬০|
আজ সৌধ, সিমরানের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। সকাল থেকে তোড়জোড় চলছে৷ দু পরিবারে আলাদা আলাদা আয়োজন। চৌধুরী বাড়ি থেকে সৌধর কিছু কাজিন এসেছে খন্দকার বাড়িতে৷ তারা সিমরানের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের ফটোশুট, ভিডিয়োশুট করতে ব্যস্ত। পছন্দের মানুষটাকে বর হিসেবে পেতে চলেছে সিমরান। চারপাশে সুখ, সুখ সুবাস৷ কত মানুষ, কত আনন্দ ঘিরে রয়েছে তাকে৷ আব্বু, ভাইয়া, বন্ধু, বান্ধব এছাড়াও পরিচিত, অপরিচিত অনেক আত্মীয়-স্বজন বাড়ি জুড়ে। তার আশপাশে সর্বক্ষণ মানুষের ভীড়। এত সুখ, আনন্দ, মানুষের ভীড়ে একটিমাত্র শূন্যতা মনকে বিষাদে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এত আয়োজন, সীমাহীন সুখ প্রাপ্তি, ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেয়ার পথে জন্মদাত্রীকে ভীষণ মিস করছে মেয়েটা। যখনই সুযোগ পাচ্ছে বারবার টলমল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আব্বু, আর ভাইয়ার দিকে। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। বেঁচে থাকাকালীন মাকে খুব বেশি কাছে পাওয়া হয়নি৷ জীবনের বিশেষ সময় গুলোতেও খুব কম পাওয়া হয়েছে মানুষটাকে। তবু মা আছে। এই মনোবলটাই সামনের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে৷ আগে কখনো পৃথিবীটাকে নিঃসঙ্গ লাগেনি। প্রতিষ্ঠিত মা এবং মায়ের সন্তানদের জীবনে প্রচুর সেক্রিফাইস করতে হয়৷ যার নিদারুণ উদাহরণ উদয়িনী আর সুহাস, সিমরান। শত ব্যস্ততায়ও বেলা শেষে একটিবার ফোন করে মেয়ের খোঁজ নিত উদয়িনী। আজ কতগুলো দিন হয়ে এলো। দূরান্ত থেকে কেউ ফোন করে খুঁজ নেয় না৷ বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে সিমরানের৷ আম্মুর পাশাপাশি নামীকেও ভীষণ মনে পড়ছে। আজ ভাবি হিসেবে নামী তার পাশে থাকতে পারত! তীব্র অভিমান হয় নামীর প্রতি। প্রচণ্ড স্বার্থপর মনে হয় ভাইয়ের বউটাকে। তাদের খারাপ সময়, ভালো সময় কোনোটাতেই নামী থাকল না। পৃথিবীতে সব মানুষ একরকম হয় না৷ তার ভাইটা না হয় একটু বেখেয়ালি। তাই বলে ভয়াবহ কোনো অপরাধী নয়৷ সুহাস কেমন ছেলে প্রত্যেকেই জানে৷ নামীও নিশ্চয়ই এতবছরে কম চেনেনি নিজের স্বামীকে। দু’জনের মাঝে মনোমালিন্য হয়েছে। হতেই পারে। তাই বলে এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আলাদা দেশে পাড়ি জমাতে হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান৷ মনে মনে পণ করল, ভাবি হিসেবে, বড়ো বোন এবং বন্ধু হিসেবে হৃদয়ের যে স্থানে নামী ছিল। আজকের পর সে স্থান শূন্য করে দেবে। আম্মু নেই, ভাবি থেকেও নেই৷ তার জীবনে বাবা, ভাইয়া আর স্বামী সৌধ চৌধুরী ছাড়া আর কোনো আপনজন নেই। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই
দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ে। চারপাশে মিউজিক, গানের সুর, হৈচৈয়ে মুখরিত। বিয়ের পরিপূর্ণ আমেজ। দুপুর হওয়ার পূর্বেই কাঁচা হলুদ বাঁটা নিয়ে প্রাচী আর ফারাহ সিমরানের কাছে এলো। ড্রয়িং রুমের একপাশে ছোট্ট স্টেজ ডেকোরেট করা হয়েছে। স্টেজের মধ্যমণি গাঢ় হলুদ রঙের সারারা ড্রেস পরিহিত সিমরান৷ ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে হালকা জুয়েলারি পরেছে। ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক, চোখে কাজল, মাথায় টিকলি সবমিলিয়ে একদম চোখ ধাঁধিয়ে ওঠা সৌন্দর্য ফুটে ওঠেছে সর্বাঙ্গে। প্রাচী, ফারাহ ঝটপট সিমরানের সাথে কিছু ফটোশুট করে নিল। এরপর শুরু করল গায়ে হলুদ লাগানো।

সৌধর বিয়েতে বরপক্ষ হিসেবে থাকার কথা ছিল সুহাসের। প্রাচী, ফারাহ এদেরও বরপক্ষ হবার কথা৷ ভাগ্যচক্রে এখন সবাই কনে পক্ষ। কারণ কনে সুহাসের ছোটো বোন৷ সুহাস বোন রেখে বন্ধুর তরফে চলে যেতে পারে না। ছোটোবোনের বিয়ে। কাঁধে তার বিরাট দায়িত্ব। মা নেই, বউ নেই৷ বাবাকে পাশে নিয়ে তাকে যেন সিমরানের মা, ভাবির সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় তাকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে প্রাচী, ফারাহ। আইয়াজ, আজিজ বাকি বন্ধুরা বর পক্ষ হিসেবে উপস্থিত আছে চৌধুরী বাড়িতে।

কনের মনে বিষাদ, চোখ দ্বয়ে মেঘ৷ ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি ঝড়ছে। ছবি তুলতে গিয়ে খেয়াল করল, শান। একদিকে সে ফটো তুলছে অপরদিকে সুযোগ বুঝে সেসব সৌধকেও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছে।

গায়ে হলুদ নিয়ে সৌধর কোনো মাথা ব্যথা নেই। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী যতটুকু করলেই নয় ততটুকু করছে। দাদুনির বকবক বেড়েছে খুব৷ কারো থেকে সে খবর পেয়েছে সিনু সকালবেলা পার্লার থেকে সেজে এসেছে। এই নিয়ে যত অভিযোগ তার। নতুন বউ বিয়ের আগে কোনো কাজ করতে পারবে না। এটা তাদের বাড়ির নিয়ম। যদিও সিমরান কাজে অপটু। এমনিতেও সে কাজ পারে না। তার নিষেধ ছিল, বাইরে টাইরে যাওয়া নিয়ে। তাহলে সে কেন গেল? গজগজ করছে দাদুনি। শাশুড়িকে থামাতে পারে না তানজিম চৌধুরী। সৌধ মহাবিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে দৃঢ় চোখে তাকায়। তানজিম চৌধুরী চোখের ইশারায় ছেলেকে শান্ত থাকতে বলে নিজের কাজ সেরে কাছে আসে। আড়ালে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,

‘ সিনুকে কল করে বলে দে আমরা পার্লারের লোক পাঠাব। মেহেদির সাজ, বিয়ে, বউভাতের সাজ সব বাড়িতেই সাজাবে। বাইরে যেতে হবে না। ‘

দাদুনির ওপর বিরক্ত হলেও আম্মার বলা কথায় সমর্থন দিল সৌধ। নিজের রুমে গিয়ে ফোন করল সিমরানকে। ইতিমধ্যেই ছোটো ভাই শানের পাঠানো ছবি গুলো দেখেছে সে। তাই প্রস্তুতি নিল হালকাপাতলা শাসন করার। বিয়ের আগের দিন বউ শাসন৷ এতদিন বন্ধুর বোন হিসেবে শাসন করেছে এখন করবে বউ হিসেবে। ভেবেই মনে মনে মুচকি হাসল। সবাই মিলে হলুদ লাগাচ্ছিল সিমরানকে। এমন সময় সৌধর কল। ফোন রিসিভ করে কাঁপা গলায় হ্যালো বলল সিমরান। দৃঢ় কণ্ঠে মৃদু ধমক মিশিয়ে সৌধ বলল,

‘ খুব বাজে দেখতে লাগছে সিনু। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ধরে বেঁধে বিয়ে ঠিক করেছে তোর বাপ, ভাই। চোখ ভর্তি নোনাজলে প্রকাশ পাচ্ছে, পছন্দের হিরো নয় অপছন্দের ভিলেনের বউ হতে যাচ্ছিস তুই। ‘

তীব্র বিষাদ অনুভূতিতে এক টুকরো প্রশান্তি ছিল সৌধর ফোন কল। আর মৃদু ধমকে, শাসনের সুরে ছিল সুখ সুখ অনুভূতি। সমস্ত যন্ত্রণা এক নিমেষে ভুলে গেল মেয়েটা। চোখের পানি মুছে, নাক টানতে টানতে বলল,

‘ সরি। ‘

‘ বিরহিণীর মা সেজে বসে থাকার দরকার নেই। রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমা। যদি প্রণয়ী হতে পারিস তবে যাওয়ার দরকার নেই। আমি প্রণয়ী সিনু চাই বিরহিণী না। ‘

এ পর্যন্ত বলে থামল সৌধ৷ একটু ভাবুক হয়ে পরোক্ষণেই বলল,

‘ আর পার্লারে যাওয়ার দরকার নেই। আমি লোক পাঠিয়ে দিব৷ বাড়ি গিয়ে সাজিয়ে দেবে। ‘

সিমরানকে কিছু বলার সুযোগ দিল না সৌধ৷ ফোন রেখে বেরিয়ে গেল রুম থেকে৷ নিচে তার জন্য হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুরা মিলে ফটোশুটে ব্যস্ত। দাদুনি গলা ছেড়ে ডাকছে তাকে। এত আয়োজন, এত নিয়মকানুন ভালো লাগছে না তার৷ বেশি অসহ্য লাগছে দাদুনির হাঁকডাক। স্বস্তি ভরে রুমে বসতেই পারছে না৷ বিয়ে করছে নাকি সদ্য জন্ম নিচ্ছে বুঝা মুশকিল। বাড়ির সব ক’টা যেন চোখে হারায়৷ সবচেয়ে বেশি চোখে হারাচ্ছে দাদুনি৷ এ মুহুর্তে দাদুভাইয়ের অভাব বোধ করছে সে। দাদুভাই থাকলে নিশ্চয়ই দাদুনিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত।

সৌধর ইচ্ছে ছিল সাদাসিধে ভাবে বিয়ে করবে। কিন্তু পারিবারিক ধারাবাহিকতা আর সিমরানের স্বপ্ন দু’টোয় বাঁধা পড়ে সবকিছু মেনে নিতে হচ্ছে। সিমরানের স্বপ্ন বিরাট আয়োজন করে বিয়ে করবে। ধুমধাম করে যাবে শশুর ঘরে। প্রতিটি অনুষ্ঠানই হবে ধুমধাম করে৷ কোনোকিছুতে কমতি থাকা যাবে না। বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা স্বপ্ন থাকে। সিমরানের স্বপ্ন আর চৌধুরী বাড়ির ধারাবাহিকতা মিলে যাওয়াতে সৌধ হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সব। কিন্তু নিজেকে নিয়ে টানাহেঁচড়া পছন্দ হচ্ছে না৷ জাস্ট তিন কবুল পড়ে বিয়েটা সম্পন্ন হোক। এরপর বউভাত ব্যস। পরবর্তীতে আর কারো নিয়মে বাঁধা পড়া যাবে না। কারো নিয়মে বাঁধা পড়া মানেই নিজের স্বস্তির বারোটা বাজানো। রুদ্ধশ্বাস ফেলল সৌধ। দাদুনির বাড়াবাড়ি দেখে আন্দাজ করল, সিনুকে বড্ড জ্বালাবে মানুষটা৷ মনে মনে কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ‘ প্রিয় দাদুভাই এর বেগম তুমি যদি অগ্নিশিখা হও তোমার প্রিয় নাতির বেগম তবে বরফ টুকরো। লাভ নেই ডিয়ার লোকসান আছে প্রচুর। ‘
.
.
মেহেদি অনুষ্ঠান। সবাই তৈরি হয়ে যার যার মতো করে স্টেজে উপস্থিত হচ্ছে। সিমরান তৈরি। নিচে যায়নি এখনো৷ কারণ ফারাহ তার লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছে৷ সে বলে বলে দিচ্ছে কোনটা নিয়ে যাবে কোনটা রেখে যাবে। মেয়েটা শাড়ি পরতে পারে না। ও বাড়িতে শাড়ি পরা নিয়ে চাপ নেই। তাই সেলোয়ার-কামিজ ওঠাল শুধু। সেলোয়ার-কামিজ পরার অভ্যাসও কম সিমরানের৷ শশুর বাড়িতে গিয়ে পরতে হবেই। ফারাহ কম দিন দেখছে না ওকে। তাই সব গুছিয়ে বলল,

‘ টিশার্ট আর প্লাজো ওঠাই? ‘

চমকাল সিমরান। বলল,

‘ ও বাড়িতে তো এসব পড়া যাবে না আপু। ‘

নাকের ডগায় এসে পড়া চশমা ঠেকে ঠিকঠাক করে ফারাহ বলল,

‘ বাড়িতে পড়বে না তো। বেডরুমে পরবে। যখন শুধু তুমি আর তোমার বর থাকবে। আর কেউ থাকবে না। বর ছাড়া আর কেউ দেখবে না। ‘

সহসা লজ্জা পেল সিমরান। রক্তিম হয়ে ওঠা গালদুটো আড়াল করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

‘ থাক দরকার নেই। ‘

ফারাহ মানলো না কথাটি। দু’টো টিশার্ট আর প্লাজো ওঠিয়ে দিয়ে বলল,

‘ দুটো ওঠিয়ে দিলাম৷ প্রয়োজন হলে পরো। পরবর্তীতে না হয় নাইট ড্রেস কিনে নেবে। ‘

কিছু বলল না সিমরান৷ উশখুশ চিত্তে ভাবতে শুরু করল, কাল তার আর সৌধ ভাইয়ের বিয়ে। রাতে বাসর! হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠল অকস্মাৎ। তাদের কি কাল বাসর জাতীয় কিছু হবে? কী জানি!বাসরটাসর না হলেও তারা তো একসঙ্গে এক বিছানাতে ঘুমাবে। শরীরের লোমকূপ সজাগ হলো সিমরানের। দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগল, কাল থেকে তার জীবনটাই বদলে যাবে। সে ডক্টর. সৌধ চৌধুরীর বউ হবে৷ একসঙ্গে এক ঘরে, এক বিছানাতে ঘুমাবে। সৌধ ভাই কি একটুও আদর করবে না তাকে? কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসা দিতে লোকটা কি অনেক বেশি সময় নেবে? তার কী ধৈর্য্য হবে? সে কী পারবে ধীরে ধীরে মানুষটার হৃদয়ের সমস্তটা জুড়ে আধিপত্য করতে? একটু ভয় সীমাহীন লজ্জা, টালমাটাল হৃদয় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করল সিমরান।

সবাই মেহেদি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেছে। ফারাহ এখনো তৈরি হতে পারেনি৷ সিমরানকে নিচে পাঠিয়ে সে চলে গেল নামীর আলাদা ঘরটায়৷ এ ঘরে সে আর প্রাচীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সব জিনিসপত্রও এখানে রাখা। পোশাক বদলে ঝটপট তৈরি হয়ে নিল ফারাহ৷ অনেকদিন পর শাড়ি পরেছে সে৷ ভাবল নিচে গিয়ে আইয়াজকে ভিডিয়ো কল করবে একবার। ভীষণ মিস করছে আইয়াজকে। কনে পক্ষ হয়ে নিজের বরের থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। আইয়াজ বলেছে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সিনুর সাথে তাকে আর প্রাচীকেও ও বাড়িতে নিয়ে যাবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগপত্র একপাশে রেখে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ খেয়াল করল, নামীর ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার একটু খোলা। তাই এগিয়ে এসে ড্রয়ারে ধাক্কা দিতে উদ্যত হয়৷ হঠাৎ হালকার ওপর ঝাপসা দৃষ্টি পড়ে নীল রঙের কভারের ওপর মা এবং শিশুর ছবির মতো কিছু দেখে। অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে ড্রয়ার খুলে সে। দেখতে পায় রিপোর্ট পেপার। বুক ধক করে ওঠে তার। এটা কার রিপোর্ট? দেখে তো মনে হচ্ছে প্র্যাগ্নেসির। ভেতরে দেখা প্রয়োজন। সহসা বুক কাঁপতে শুরু করল ফারাহর৷ ভেতরে চোখ বুলাতেই আঁতকে ওঠল! স্পষ্ট দেখতে পেল নামীর প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট। দু’মাসের প্র্যাগ্নেসির সময় করা হয়েছে টেস্ট গুলো। অর্থাৎ আরো তিন মাস আগেকার রিপোর্ট এটা৷ নামী তাহলে বর্তমানে পাঁচ মাসের প্র্যাগনেন্ট! সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল ফারাহর৷ বিস্ময়, উত্তেজনা, খুশি, ভয় সবমিলিয়ে যাচ্ছেতাই হয়ে গেল যেন। মনে পড়ে গেল, সে আর আইয়াজ দীর্ঘদিন যাবৎ বেবি নেয়ার ট্রাই করছে। দু’জনের কারোরি সমস্যা নেই। তবু আল্লাহ তায়ালা মুখ তুলে তাকাচ্ছে না৷ আর এদিকে তার প্রিয় বান্ধবী মা হতে চলেছে। আইয়াজের প্রিয় বন্ধু বাবা হচ্ছে। অথচ তারা কেউ জানেই না৷ এত বড়ো সুসংবাদ কীভাবে চেপে গেল নামী? নামী মা হচ্ছে… খুশিতে পাগলপ্রায় হয়ে গেল ফারাহ। পরোক্ষণেই আবার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল। নামী কেন রাগ করে চলে গেল? কেন তাদের কাউকেই খুশির খবরটা জানালো না। সুহাস ভাই! সে তো বাবা হতে যাচ্ছে। তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে ফারাহ। মেহেদী অনুষ্ঠানের কথা ভুলে গেল সে। এক হাতে রিপোর্ট গুলো ধরে অন্যহাতে ফোন নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কল করল আইয়াজকে। আইয়াজ ফোন রিসিভ করতেই হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আয়াজ, নামী প্র্যাগনেন্ট! আমি ওর ঘর থেকে প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট পেয়েছি। মেয়েটা কী বোকামি করল বলো তো? এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল। আমার নামী, আমার বান্ধবী মা হতে চলেছে আমি এত দেরিতে জানলাম। হায় আল্লাহ, সুহাস ভাই জানলে কী খুশি হবে!’

আকস্মিক ফারাহর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আইয়াজ৷ রয়েসয়ে বলল,

‘ ফারাহ কান্না থামাও। শান্ত হয়ে বলো কী পেয়েছ তুমি৷ কী বলছ এসব? ‘

শান্ত হতে সময় নিল ফারাহ। কিন্তু নিজের খুশি, উত্তেজনা চেপে রাখতে পারল না৷ সবটা বুঝিয়ে বলল আইয়াজকে৷ সঙ্গে সঙ্গে আইয়াজ সমস্ত কথা জানালো সৌধকে। সৌধ সবটা শুনেই ফারাহকে বলল রিপোর্ট গুলোর ছবি পাঠাতে। ফারাহ ছবি পাঠালে তৎক্ষণাৎ সৌধ কল করল তাকে। রিসিভ করতেই বলল,

‘ ফারাহ বিষয়টা প্লিজ কষ্ট করে চেপে রাখো। আর এ মুহুর্তে কাউকে জানতে দিও না৷ পারলে রিপোর্ট গুলো তোমার কাছে লুকিয়ে রাখো। সুহাস কেমন জানোই তো? আপাতত বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। তারপর আমরা সুহাসকে জানাব৷ ‘

ফারাহকে বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল সৌধ। তার বিচক্ষণ মাথায় প্রশ্ন জাগল, এদেশে শেষ সময় নিধির সাথে কাটিয়েছে নামী। নিধি কি জানত সুহাস বাবা হতে চলেছে? বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। নিধি তার বিয়েতে আসবে কিনা জানা নেই। কিন্তু নামীর ব্যাপারে নিধির সঙ্গে তার যোগাযোগ করতেই হবে৷ সুহাস জানে নামী তার বাবার কাছে রয়েছে। জানে না শুধু নামী নয় নামীর গর্ভে তার সন্তানও রয়েছে। যখন জানবে তখন ঠিক কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে আর ভাবতে পারছে না সৌধ। যা ক্ষ্যাপাটে সুহাস৷ বান্ধবী, পরের বউ এক বাচ্চার মা বলে ছেড়ে দেবে না৷ যে তার বউকেই ছাড় দেয় না সে বান্ধবীকে ছাড় দেবে আশা করা বোকামি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। সুহাসের জায়গায় সে কখনো যাবে না৷ তবু একবার নিখুঁত ভাবে ভাবার চেষ্টা করল, তার স্ত্রী গর্ভবতী।
অথচ তার স্ত্রী সেসব তাকে না জানিয়ে ভীনদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কেমন অনুভূতি হবে? আর ভাবতে পারল না সৌধ। আচমকা সিনুর মুখটা ভেসে ওঠল চোখের সামনে। অনুভব করল, বউয়ের ভাবনা মাথায় এলেই এখন সিনুর মুখ দেখতে পায় সে। কী আশ্চর্য গতিবিধি। মানব হৃদয়ের এ কেমন লীলা? বুকের ভেতর মৃদু স্পন্দন হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠেছে মৃদু হাসি। পাশে আাইয়াজ। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ সে হঠাৎ নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ কতশত বছর আগে আমাদের আলাদা দু’টো জীবন এক হওয়ার পরোয়ানা জারি হয়েছে রে? এত অল্প সময়ে ডিরেক্ট বউ হয়ে চোখের পাতায়, মনের কোণায় ধরা দিচ্ছে? ‘

চলবে..
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬১|
.
.
ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় নিধির৷ ক্ষণকাল ব্যয় করে মস্তিষ্ক সজাগ করে। পাশে তাকিয়ে দেখে অর্পণ ঘুমিয়ে৷ বুকের মাঝে অনিরূপকে আগলে নিয়ে। নিষ্পাপ শিশুটি বাবার বক্ষদেশে কী নির্ভার, প্রশান্তিময় ঘুম ঘুমাচ্ছে৷ দৃষ্টিজোড়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। স্মিত হেসে মুগ্ধ দৃষ্টিদ্বয় ফিরিয়ে নেয় নিধি৷ ত্বরিত খোলা চুলে হাত চালায়। দৃঢ় করে খোঁপা বাঁধে। বিছানা ছাড়তে উদ্যত হলে আচমকা থেমে যায়। সেলফোন খুঁজে সময় দেখে৷ লক ছাড়িয়ে ঢুকে ফেসবুক অ্যাপে। নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে চোখ আঁটকে গভীর রাতে সৌধর আইডি থেকে পোস্ট করা একটি ভিডিয়োতে। সৌধর রুম৷ ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে ওর কাজিন মহল আর বন্ধুরা৷ সকলের মাঝখানে গিটার হাতে সৌধ৷ পাশে কফির মগ হাতে আইয়াজ বসে। সৌধর মুখে হাসি নেই৷ চোয়াল দ্বয় দৃঢ়, চোখ দু’টো এক মনে গিটারে স্থির। দেখে কেউ বলবে না রাত পেরুলে তার শুভবিবাহ। পুরু ঠোঁটজোড়া নড়ছে বিরতিহীন। কী তীক্ষ্ণ সুর, কী গভীর ছন্দ!

কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না..
কবিতা,
এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।

দেখবে আমাদের ভালবাসা,
হয়ে গেছে কখন যেন
পদ্ম পাতার জল, পদ্ম পাতার জল।

কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না
কবিতা,
এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।

বেদনা সিক্ত অশান্ত এই মন
খুঁজে ফেরে মেটায় প্রয়োজন,
যতদূর জানে এ ব্যাকুল হৃদয়
নীল বিষের পেয়ালা মনের বাঁধন।

দেখবে আমাদের ভালবাসা,
হয়ে গেছে কখন যেন
পদ্ম.. পাতার জল,
পদ্ম.. পাতার জল।

কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না…।
.
.
ভিডিয়োর সমাপ্তিতে সকলের হাততালি। সৌধর অধরে বাঁকা হাসি৷ নিমেষে নিধির বুক ধক করে ওঠে। থম মেরে বসে রয় দীর্ঘক্ষণ৷ পরোক্ষণেই হৃৎস্পন্দন কেঁপে ওঠে। আজ যে সৌধ, সিনুর বিয়ে! সে সহ তার পুরো পরিবার আমন্ত্রিত। এই আমন্ত্রণ এসেছে চৌধুরী বাড়ি থেকে৷ সুহাসের তরফ থেকেও এসেছে। সৌধ বা সিনু দু’জনের কারো থেকেই আলাদা ভাবে আমন্ত্রণ বাক্য পায়নি। এক টুকরো দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে। বেলাশেষে সৌধর প্রতি যাই অনুভব করুক না কেন৷ আজ তার কোনো মূল্য নেই৷ কিন্তু বেলা ওঠতে যে অনুভূতি নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসেছে তাদের জীবনে? সেই বন্ধুত্ব। সেটাও কি ঠুনকো হয়ে গেছে? নিঃশ্বাসে অস্থিরতা বাড়ে নিধির। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে মনে মনে বলে, তার প্রতি সৌধর অনুভূতি মিথ্যে ছিল না৷ যতই নিজেকে সামলে নিক। গুছাতে উদ্যত হোক। পুরোনো স্মৃতি, অতীতে পাওয়া আঘাত কোনোটাই মুছে যায়নি৷ ভুলে যায়নি সৌধ। আর এই যে আজ সে বেলাশেষে নিজের অনুভূতিকে পুরোপুরি জেনে গেল৷ সেটাও মিথ্যা না৷ সব চন্দ্র, সূর্যের মতোই সত্য আর দৃশ্যমান। সৌধ তার জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ডের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। যা সময় থাকতে সে বুঝতে পারেনি। অনেক সময় হয়তো বুঝেও অবহেলা করেছে। সবশেষে সে সবার কাছে অপরাধী। নিজের কাছেও। সময় থাকতে নিজের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেওয়া, সময় চলে গেলে আপনাআপনিই অনুভূতিদের টের পাওয়া অপরাধই বটে। এই দায় আসলে নিজেরই। অন্য কারো নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি। ঘুরে তাকায় স্বামী, পুত্রের দিকে। ভাবে, ভালোই হয়েছে। সৌধ বা সিনু তাকে আমন্ত্রণ করেনি। ওদের বিয়েতে তার উপস্থিতি কারো জন্যই স্বস্তিকর হবে না। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে পড়বে অর্পণ, সে, সৌধ আর সিনু। কী দরকার এক সঙ্গে দুই দম্পতিকে অস্বস্তিতে ফেলার? ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও চোখের কার্ণিশে জল গড়াল। টের পেয়ে আঁতকে ওঠল নিধি৷ গতরাতে অর্পণের বলা কথাগুলো স্মরণ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনল। দু’টো চোখ উপর দিকে নিয়ে শ্বাস আঁটকে মনে মনে আওড়াল,

‘ এ পৃথিবীতে অগণিত নারী অনুভূতির দাবানলে জ্বলে। একদিন সব ঠিক হবে। সবাই সবার মানুষটাকে নিয়ে সুখী হবে৷ সে বা সৌধ কেউই এর ব্যতীক্রম নয়৷ তবু দিনশেষে সৌধর হৃদয়ে নিধি নামক নারী নৈরাশ্য হয়ে ধরা দেবে। আর তার হৃদয়ে সৌধ কেবলই আফসোস। ‘

ঘোরের ভেতরে থাকা মনো ভাবনা গুলোর সমাপ্তি টানল নিধি৷ চোখ বুঁজে ঘনঘন কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে অর্পণের গায়ে হাত রাখল৷ ডাকল বারকয়েক। স্বামীর ঘুম ভাঙলে সে বলল,

‘ আজো অফ ডে। চলুন না কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসি। ‘

ঘুম ছুটিয়ে ওঠে বসে অর্পণ। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘ আজ না তোমার বন্ধুর বিয়ে? ‘

‘ আপনি যাবেন? ‘

সহসা চুপ মেরে যায় অর্পণ। সেদিন একটা ভুলকে কেন্দ্র করে ওরা যা ঘটিয়েছে। এরজন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারত সবাইকে। শুধুমাত্র না জেনে বুঝার ভুল, নিধির খুব ভালো বন্ধু আর সৌধ সুজা এমপির ছেলে
বলে ক্ষমা করে দিয়েছে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল অর্পণ।
কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বলল,

‘ সরি, আমার কাজ আছে। ‘

মুখ ফুলিয়ে নিধি বলল,

‘ আপনার সঙ্গে ঘুরতে যাব বলে বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ের দাওয়াত ইগনোর করছি। আর আপনি আমাকে কাজ দেখাচ্ছেন? ‘

ছোটো ছোটো করে তাকায় অর্পণ। পাশ থেকে চশমা তুলে দেয় নিধি। বলে,

‘ চশমাটা পড়ুন৷ এরপর দেখুন। ‘

‘ ভেবে বলছ? বিয়েতে যাবে না ‘

‘ একদম। ‘

বুকের ওপর থেকে যেন বিশাল পাথর সরে গেল অর্পণের। সে বোঝে নিধিকে। কেন যেন অনায়াসেই এই মেয়েটার মন বুঝে। চোখের ভাষাগুলো পড়তে পারে। একজন স্বামীর জন্য এই সত্যিটা খুবই নির্মম। তার স্ত্রী অন্য এক পুরুষের গভীর প্রণয়কে ভুলবশত উপেক্ষা করার দহনে জ্বলছে। তার প্রতি এক সময় নিধির মুগ্ধতা ছিল৷ যা ভালোবাসায় রূপ নেবার পূর্বেই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। গতরাতে নতুন করে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। নিধি প্রাণপণে চাইছে নিজেকে সুস্থির করার৷ তাকে আপন করে নেয়ার। স্বামী হিসেবে সম্মানের সঙ্গে সাপোর্ট দেবে সে৷ দৃঢ় বিশ্বাস উপরওয়ালা নিরাশ করবে না৷ সে তার ধৈর্য্য, সম্মান, কর্তব্যবোধ আর ভালোবাসা দিয়ে নিধিকে জয় করে নেবে। এতদিন নিধি তাকে সুযোগ দেয়নি৷ এবার যখন দিচ্ছে পূর্ণ সৎ ব্যবহার করবে৷ দু’দিক থেকেই যখন আঁকড়ে ধরার পায়তারা চলে কার সাধ্য ছিন্ন করার?
.
.
আজ আদরের বোনটার বিয়ে৷ সারা বাড়ি ফুল আর ঝিলিক বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাত হলেই বিয়ে বাড়ির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ফুটে ওঠবে৷ এলাহি আয়োজন, বিয়ে বাড়ির উৎফুল্লতা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এতসবের ভীড়ে সকাল থেকে বুক ভার সুহাসের। কারো দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আর না কেউ তার মুখের দিকে তাকাতে পারছে। সোহান খন্দকারের অবস্থাও কাতর৷ মানুষটা সকাল থেকে কিছু মুখে তুলেনি৷ আজ ভীষণ মনে পড়ছে উদয়িনীকে। শত তিক্ততার ভীড়ে উদয়িনী তার হৃদয়ের কতটুকু দখল করে ছিল। সময়ের স্রোতে তা দৃঢ়ভাবে অনুভব করছে। আজ যদি উদয়িনী বেঁচে থাকত তাহলে বোধহয় এতটা নিঃসঙ্গ লাগত না৷ ছেলের বিয়েতে যত সুখ মেয়ের বিয়েতে ততই শোক৷ বুকে কম্পন ধরে সোহানের৷ মেয়েটা চলে গেলে তার পুরো বাড়িটাই শূন্য। এমতাবস্থায় পুত্রবধূ, প্রিয় নিলুর মেয়েকে স্মরণ হয়৷ আফসোসে ডুবে যায়। নামীকে তো সে মেয়ের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি৷ তবে কেন আজ তার বাবা সত্তার অসহায়ত্বে নামী কাঁধে হাত রাখল না? তবে কী সে ভুল করেছে সুহাসের সাথে নামীর জীবন গেঁথে দিয়ে? তীব্র অসহায় বোধে ভুগে সোহান খন্দকার। বুকের পাঁজরে ব্যথায় বিষিয়ে ওঠে। কলিজাটা ভীষণ ছটফট করছে। যেন আর কিছু সময় এরপরই তার শরীর ভেদ করে কলিজা ছিঁড়ে নেয়া হবে৷ মেয়ের বিয়েতে প্রতিটি বাবার হৃদয়ে হওয়া রক্তক্ষরণ কেউ কি দেখতে পায়? শুনতে পায় কি কেউ মেয়ে বিদায়ে বুকের ভেতর চলা বাবাদের আর্তনাদ গুলো?

আব্বু আর ভাইয়ার অবস্থা দেখে সিমরানের চোখের পানি বাঁধ মানে না৷ বিয়ে নিয়ে এতদিন যে চঞ্চল অনুভূতিটা ছিল৷ প্রিয়জনকে নিজের করে পাওয়ার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবই যেন থমকে যায়। অন্তঃকোণে বাবার বিষণ্ণ মুখ, ভাইয়ের আঁধারে নিমজ্জিত চোখ তার সমস্ত সত্তা নাড়িয়ে দেয়৷ আম্মুকে মনে পড়ে খুব৷ বুকের ভেতর বিশাল একটা জায়গা জুড়ে কেবল শূন্য শূন্য লাগে। বিয়ে শব্দটা সহজ হলেও এর ভাবার্থ কত কঠিন৷ বিয়ে শব্দে দুটো অক্ষর থাকলেও, বিয়ে দুই নর নারীর মধ্যে সংঘটিত হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা। বিয়ে শুধু ছেলে, মেয়ের মাঝেই সম্পর্ক স্থাপন করে না৷ দু’টো পরিবারকেও এক সুতোয় গেঁথে দেয়। ঘরের দেয়ালে টাঙানো পারিবারিক ছবির দিকে তাকায় সিমরান৷ জ্বলজ্বল করছে মায়ের মুখটা। কী সুন্দর হাসি! মায়ের ডানপাশে মায়ের আদলের লম্বাটে ভাই সুহাস৷ বাম পাশে গম্ভীর মুখে বাবা দাঁড়িয়ে। তার বুকের অতিনিকটে মিষ্টি হাসিতে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজে। নিঃশ্বাস আঁটকে যায় মেয়েটার। এই ছবিটা আর কখনো জীবন্ত হবে না। আম্মু কখনো ফিরে আসবে না। আজ তার বিশেষ দিনেও না। তৃষ্ণা পায় তার। বীভৎস তৃষ্ণা। মায়ের বুকে একবারটি মাথা রেখে রুদ্ধশ্বাস ছাড়তে আকুল হয় হৃদয়। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বলে,

‘ আজ আমার বিয়ে। আব্বু, ভাইয়ার মতো আম্মু পাশে থাকলে বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত না। সেই ছোট্ট থেকে নিজের কোনো বিশেষ দিনেই ওই মানুষটাকে পাশে পেলাম না৷ আজো না। ‘

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সিমরান৷ একদিকে সাজানো হয়। অন্যদিকে কেঁদে গাল ভাসায়। ইতিমধ্যেই সে মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ রাতে, বাসরঘরে একান্ত মুহুর্তে সেই সিদ্ধান্তটি জানাবে সৌধকে। নিজের জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা গুলোই এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে বাধ্য করল।

সাজ প্রায় কমপ্লিট। বাকি রয়ে গেছে শুধু চুল। চুল বাঁধা শেষ হলেই লেহেঙ্গা পরবে। আকাশি নীল রঙের গর্জিয়াস, ব্রাইডাল ল্যাহেঙ্গা। এই রঙটা সৌধর ভীষণ পছন্দের। পছন্দ সিমরানেরও। সবচেয়ে বড়ো কথা সিমরান চেয়েছিল তার বিয়ের সবকিছু ডিফারেন্ট টাচে থাকবে। আর সৌধ তার পুরো ব্যক্তিত্বেই ডিফারেন্ট টাচ রাখে৷ তাই বিয়ের সাজে, পোশাকে দু’জনের পছন্দ খাপে খাপ মিলে গেল।

চুল বাঁধা শেষে লেহেঙ্গা আর জুয়েলারি পরার পূর্বে মেয়ের ঘরে সোহান খন্দকারের আগমন ঘটে। পেছন পেছন আসে সুহাস। পার্লার থেকে আসা মেয়েদের নিয়ে বাইরে চলে যায় প্রাচী৷ ফারাহ আর সিমরানের মামি আসে গরম গরম খাবার নিয়ে৷ তারা খাবার গুছিয়ে চলে গেলে সুহাস দরজা আঁটকে দেয়৷ সৌধদের আসার সময় হয়ে এসেছে। বরপক্ষ আসার পূর্বে তারা বাবা, ছেলে সিমরানের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চায়৷ একসঙ্গে খাবার খেতে বসল ওরা৷ তিনজনের কারো পেটেই দানাপানি নেই। সুহাসের নানুমনিই তাই বুদ্ধি করে মেয়ের জামাই আর নাতিকে সিমরানের ঘরে পাঠালো। নিজের হাতে তুলে খাবে না সিমরান৷ বাবা, আর ভাইয়ের হাতেই খাবে। সোহান খন্দকার ঝাপসা দৃষ্টিতে হাসিমুখে মেয়ের মুখে খাবার তুলতে উদ্যত হলে হঠাৎ সিমরান বাঁধা দেয়। ছলছল চোখে মৃদু হেসে বলে,

‘ ওয়েট আব্বু। আম্মুকে নিয়ে আসি। আমার কোনো বিশেষ দিনেই আম্মু পাশে থাকেনি৷ ছুটি নেই, কাজের ব্যস্ততা এই সেই৷ আজ যখন কাজ নেই, ছুটি আছে৷ তখনও আম্মু নেই৷ এসব কেমন নিষ্ঠুরতা বলো তো? ‘

কথাগুলো বলতে বলতে ওঠে দাঁড়ায় সিমরান। বিছানার পাশের টেবিলে মায়ের একটি সিঙ্গেল ছবি রয়েছে। দু’দিন আগেই রেখেছে৷ সেটা নিয়ে এসে কোলে রেখে আব্বু আর ভাইয়ের দিকে তাকায়। কান্নারত মিষ্টি হেসে বলে,

‘ আমাদের পরিবার কমপ্লিট। ‘

কথাটা বলেই হা করে। সোহান খন্দকার চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। সুহাস ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকায়। টলমল দৃষ্টিতে একবার বোন আরেকবার মায়ের ছবি দেখে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে বলে,

‘ না বোন। আমাদের পরিবার কমপ্লিট সেদিন হবে যেদিন আমার পাশে নামী বসবে। ‘
.
.
বরপক্ষের এগারোটা গাড়ি, তেত্রিশটা বাইক তৈরি। তৈরি চৌধুরী বাড়ির সদস্যরাও। শোনা যাচ্ছে বরও তৈরি। শুধু রাজকীয় পাগড়ি আর নাগরা জুতো পরা বাকি। যা আইয়াজ, আজিজ এসে ঝটপট পরিয়ে দিল৷ আয়নার সামনে স্তম্ভিত মুখে দাঁড়িয়ে সৌধ। এ প্রথম নিজেকে ট্রাডিশনাল লুকে দেখতে পাচ্ছে সে। পরনে অফ হোয়াইট কালার শেরওয়ানি, মাথায় আকাশি নীল রঙের কারুকাজখচিত, শুভ্র পালকশোভিত পাগড়ি, পায়ে আকাশি নীল রঙা নকশা করা নাগরা জুতা। দাঁড়িমোচ ছেঁটেছে বিধায় মুখবায়বেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঠেকছে। সব মিলিয়ে নিজেকে পুরোনো দিনের কোনো এক রাজ্যের যুবরাজ মনে হচ্ছে। যেন আজ তার অভিষেক। মৃদু হাসল সৌধ। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুক টান টান করে শ্বাস নিল দীর্ঘ৷ আইয়াজকে বলল,

‘ তোরা যেতে থাক আমি আসছি। ‘

সঙ্গে সঙ্গে আইয়াজ বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। সবাই বেরিয়ে গেলে একটু স্বস্তি পেল সৌধ। ত্বরিত পা বাড়িয়ে দরজা আঁটকে দিল৷ এরপর ধীর পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজল সন্তর্পণে। আবেগ স্মরণ করল নিধিকে। বিবেক স্মরণ করল সিমরানকে। জীবনে চলার পথে আবেগ ক্ষতিকর হলেও বিবেক ক্ষতিকর হয় না৷ বিশেষ দিন, বিশেষ মুহুর্ত আচমকা সৌধর ভেতরের সত্তায় কম্পন সৃষ্টি হলো। এই দিনটা নিয়ে একদিন সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নের নারীটি ছিল নিধি৷ স্বপ্নের দিন সত্যি হতে যাচ্ছে। কেবল দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে নারীটি৷ চোখ খুলল সৌধ। বিরবির করে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল,

‘ প্রথম জীবনের শোক দ্বিতীয় জীবনের সুখে বিলীন হোক। আজ থেকে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু। আমার জীবনে সিনু দ্বিতীয় নারী হয়ে নয় শেষ নারী হয়ে থাকুক। আমার সবটুকু আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ওকে ঘিরে তৈরি হোক। যে আমাকে অনুভব করিয়েছে সে ছাড়া কেউ আমাকে ভালো রাখতে পারবে না। তার প্রতি আমার অন্তহীন ভালোবাসা জন্মাক। হে প্রভু, ভাঙা হৃদয় গড়িয়ে নেয়ার যুদ্ধে আমি বা সিনু কেউ যেন না হারি। ‘

|চলবে|

®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে