ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৫৪+৫৫+৫৬

0
920

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৪|
গোধূলি বিকেল৷ দু’কাপ চা বানালো ফারাহ৷ সুহাসের ঘরের বেলকনিতে আইয়াজ, সুহাস বসে আছে নিশ্চুপ। চায়ের কাপ দু’টো নিয়ে সেখানেই উপস্থিত হলো সে৷ ভীষণ মাথা ধরেছে সুহাসের৷ আইয়াজের মুখটা এখনো হতভম্ব। চোখের পলকে কতকিছু ঘটে গেল৷ সে নীরব দর্শক হয়েও দোষের ভাগিদার। কেবলমাত্র বন্ধু সৌধর চোখে৷ ফারাহ চা নিয়ে এসেছে দেখে মৃদু হেসে চা নিল৷ সুহাসকে নিতে ইশারা করলে সুহাস চিন্তিত মুখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ সিনু কী করছে? কিছু বলেছে ও? ‘

ফারাহ চা এগিয়ে দিল। সুহাস কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল ধীরস্থির ভাবে। ফারাহ বসল আইয়াজের পাশে। বিনয়ের সুরে বলল,

‘ পোশাক পাল্টে, সাজ ধুয়ে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়েছে। ঘুমিয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় ওর একটু সময় দরকার। যা কিছু ঘটে গেল এর জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না ঠিকই৷ কিন্তু সিনু এতে একটুও অখুশি হয়নি। কারণ ওর চোখেমুখে গতকাল থেকে যে বেদনার সুর ভাসছিল সেটা এখন আর নেই। ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস৷ আইয়াজকে বলল,

‘ সৌধকে ফোন কর তো। ‘

আইয়াজ চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

‘ সরি দোস্ত। আমি ফোন করতে পারব না। তুই কর। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুহাস। চাপা ক্রোধ প্রকাশে বলল,

‘ আমি করব মানে? ও আমার কথা শুনবে? কোনো কোশ্চেন করলে আনসার দেবে? রাগ দেখাবে, জেদ দেখাবে। আর কিছু বড়োলোকি গালি ছুঁড়বে। ‘

‘ তোর কি মনে হয় আমি সৌধর গুরু? ফোন দিলেই ভক্তির সাথে রিসিভ করবে। কোনো প্রশ্ন করলে গড়গড় করে উত্তর দেবে? ‘

আইয়াজও চটে গেল৷ ওদের দু’জনকে থামালো ফারাহ৷ আইয়াজের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ উফফ চুপ করবে? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা পাকাচ্ছ কেন? ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করো সব। ‘

এরপর সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ সুহাস ভাইয়া, আমার মনে হয় সৌধ ভাই হুটহাট ডিসিশন নেয়ার মানুষ নন। উনি যখন সিনুকে বিয়ে করার কথা জানিয়েছে। নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই জানিয়েছে। সুজা আংকেল যখন ইনভলভ আমাদের চিন্তা করার কী দরকার? তাছাড়া যেখানে সিনু সৌধ ভাইয়াকে ভালোবাসে। সৌধ ভাইয়াও রাজি হয়েছে। বেশ জোরালো ভাবেই৷ সেখানে এত দুঃশ্চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। এবার যা করার দু বাড়ির সিনিয়র পার্সনরাই করুক।’

ফারাহর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সুহাস। ফারাহ কথার সমাপ্তি দিতেই সে বলল,

‘ ও আমার বোনকে ভালোবাসতে পারবে? ‘

ফারাহ বলল,

‘ কেন পারবে না? সিনু অবশ্যই সৌধ ভাইয়ার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে। ‘

‘ আমি মেনে নিতে পারছি না। সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। চোখের সামনে ওসব দেখে বোনের স্বামী হিসেবে… ‘

আইয়াজ বিস্মিত গলায় বলল,

‘ ওসব মানে কোন সব দেখেছিস? কী বলছিস তুই? ‘

চমকাল সুহাস। আমতা আমতা করে বলল,

‘ তুই গভীরে নিয়ে গেলি কথাটা৷ আমি সিম্পল ভাবে বলেছি। ‘

আসক্তিহীন কথাটা বলেই ফের তীব্র উত্তেজনা নিয়ে বলল,

‘ সৌধ আর সিনু! ব্যাপারটা কেমন লাগছে না? আমার ছোটো বোনের স্বামী হবে সৌধ৷ আমার শরীর খারাপ করছে ভাবতেই। ‘

আচমকা আইয়াজ দু-হাত বাড়িয়ে সুহাসের দুগাল ধরল। এদিক, ওদিক ঘুরিয়ে ভাবুক কণ্ঠে বলল,

‘ কীরে দোস্ত তুই কি আরো একটা ছ্যাঁকা খেতে চলেছিস? ‘

‘ মানে? ‘

চাপা হাসল আইয়াজ৷ ফারাহ টের পেয়ে মুখ লুকিয়ে হাসল৷ আইয়াজ বলল,

‘ ভাবি সাহেবা ভ্যানিশ হওয়ায় বড়ো মাপের ছ্যাঁকার পাশাপাশি বন্ধুর বউ তোর বোন হবে এটা কি কম ছ্যাঁকা নাকি?’

‘ আইয়াজ! ‘

চোখ রাঙালো সুহাস৷ আইয়াজ কিঞ্চিৎ দূরে সরে গিয়ে হাসতে থাকল। সুহাস রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘ মজা নেস? ফারাহ তুমি জানো তোমার সাথে প্রেম হবার আগে আইয়াজ কী করেছে? ‘

‘ কী করেছে? ‘

তীব্র উৎসুকভাব ফারাহর। সুহাস যেন তারই সুযোগ নিল৷ আইয়াজের বিরুদ্ধে নারী ক্যালেঙ্কারির বিস্তর এক বর্ণনা দিল সে৷ ফারাহ চুপচাপ শুনল। এরপর শীতল দৃষ্টিতে তাকালো আইয়াজের দিকে। দু’জোড়া চশমা এক হতেই আইয়াজ থমথমে গলায় বলল,

‘ আমি জানি তুমি বিশ্বাস করোনি ওর কথা। ‘

ফারাহ দৃঢ় গলায় বলল,

‘ তুমি ভুল জানো। আমি সুহাস ভাইকেই বিশ্বাস করেছি। ‘

নিমেষে আইয়াজের মুখটা চুপসে গেল। সুহাস এবার হো হো করে হাসতে লাগল। ফারাহ গোপনে গোপনে হাসলেও গম্ভীর হয়ে রইল প্রকাশ্যে। যা আইজারের বুকের ভেতর বাজনা বাজালো দ্রিমদ্রিম! সে শান্তশিষ্ট, ঝকঝকে হৃদয়ের অধিকারী। কোনো মানে হয় বউয়ের কাছে এভাবে ফাঁসিয়ে দেয়ার? ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে রইল নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। সুহাস ওর দৃষ্টি খেয়াল করে দাঁত ক্যালিয়ে বলল,

‘ কী মাম্মা তাকাই থাকো ক্যান টাকা পাও নাকি? ‘

আইয়াজ বিরবির করে বলল,

‘ হিটলার কোথাকার! পারবি শুধু আমার সাথে। বউ আর বোন যে বাঁশ দিতেছে ওটা ঠেকাতে পারবি না। ‘
.
.
সন্ধ্যার পর। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল সিমরানের৷ ঘুম ভাঙতেই সে আশ্চর্য ভঙ্গিতে ওঠে বসল। অবিশ্বাস্য মনে বলল, ‘ আমি কখন ঘুমিয়েছি? ‘ দেহ সচল হওয়ার পাশাপাশি মস্তিষ্কও সচল হয়ে ওঠল। মনে পড়ে গেল দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। সৌধ ভাই! নামটা স্মরণ হতেই শিউরে ওঠল দেহ। ত্বরিত বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিঁটাল৷ এরপর বেরিয়েই সর্ব প্রথম ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিজের বন্ধ ফোন বের করে চার্জে ঢুকাল। সন্ধ্যা হয়েছে। সোহান খন্দকার ফারাহকে পাঠিয়েছে সিমরানকে ডাকতে। ফারাহ দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পেল সিমরান ওঠেছে। তাই মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। বলল,

‘ আংকেল ডাকছে তোমায়। ‘

মৃদুভাবে চমকে ওঠল সিমরান। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল পলকহীন। অনুভব করল, খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে৷ নিমেষে মুখটা করুণ হয়ে গেল। অনুভব করল কতকাল সে কিছু খায় না। ঠিক যেমন বিছানায় শোয়ার আগে অনুভব হচ্ছিল কতকাল সে ঘুমায় না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। অদ্ভুত গলায় ফারাহকে বলল,

‘ মানুষ একটা কিছু পাওয়ার জন্য কত স্ট্রাগল করেও পায় না৷ হতাশ হয়ে যেই স্ট্রাগল করা বাদ দেয় তখনি সফল হয়। এটা কেমন নিয়ম ফারাহ আপু? ‘

‘ কেমন নিয়ম তা জানি না। শুধু জানি ভালোবাসার স্ট্রাগলে তুমি জিতেছ মেয়ে। সৌধ ভাই তোমার মতো হীরের টুকরো চিনতে ভুল করেনি। ‘

সহসা লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল সিমরান। সে লজ্জাটুকু আবার নিমেষে হারিয়ে গেল মুখশ্রী থেকে। নরম গলায় বলল,

‘ মোটেই হীরের টুকরো না আপু। আমি নিধি আপুর মতো গুণী মেয়ে নই। সৌধ ভাইয়ের ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য আমার হবে কিনা জানি না৷ কিন্তু এই যে হঠাৎ চমকটা পেলাম। এটার পেছনের কারণ জানা না পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। ‘

‘ আচ্ছা বুঝলাম চলো এবার আংকেল অপেক্ষায় আছে। ‘

নিচে নেমে আসার পর দেখতে পেল সোফায় বসে আছে বাবা, ভাই আর আইয়াজ ভাই। সিমরান বুঝতে পারল তারা কী নিয়ে কথা বলবে। তাই ফারাহকে জিজ্ঞেস করল,

‘ সেলিনা আপা এসেছে? ‘

ফারাহ হ্যাঁ বলতেই বলল,

‘ আমার খুব খিদে পেয়েছে আপু। সেলিনা আপাকে খাবার দিয়ে যেতে বলো এখানেই বসে খাই৷ খেতে খেতে কথা বলি আব্বুর সাথে। ‘

সেলিনা আপাকে বলল না ফারাহ। এমন একটি পরিস্থিতিতে নামীকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। নামী নেই। সে দু’দিনের অতিথি হয়ে এসেছে। তাতে কী? তার দ্বারা যতটুকু সম্ভব হচ্ছে ততটুকুই করবে। ভেবেই নিজেই খাবার বেড়ে আনল। ভাইয়ের পাশে সোফায় দু পা ওঠিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসল সিমরান৷ কোলের ওপর কুশল রেখে তার ওপর ভাতের প্লেট রেখে খেতে আরম্ভ করল। দৃশ্যটা সোহান খন্দকারের এত ভালো লাগল। মায়াও হলো ভীষণ। কতদিন পর মেয়েটা তার আগ্রহের সাথে খেতে বসছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল সে৷ এরপর বলল,

‘ মামনি, তোমার আন্টি কল করেছিল। সুজা ভাইয়ের ওয়াইফ। তোমার ফোন নাকি বন্ধ? কথা বলতে চান উনি। খেয়ে কল দিও। ‘

মাথা কাত করল সিমরান। সুহাস ভেবেচিন্তে কথা বলে না। আর না তার কথাগুলো গুছাল হয়। তাই সে ফটাফট প্রশ্ন করল,

‘ তুই এখনো সৌধকে বিয়ে করতে চাস? ভেবে উত্তর দিবি। ‘

সুহাস বোনকে ভীষণ আদর করে। অন্যান্য ভাই বোনের মতো তারা সব সময় তুই তুকারি করে না। বেশিরভাগ তুমি করেই বলে। কেবল রেগে বা সিরিয়াস মুহুর্তে তুই বলে। অর্থাৎ সুসাহ এখন হয় রেগে আছে নয়তো সিরিয়াস আছে৷ টের পেল সিমরান। সোহান খন্দকার বলল,

‘ আহ হা এ আবার কেমন প্রশ্ন সুহাস। উত্তরটা কি তুমি জানো না? ‘

সিমরান ভাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে খেতে খেতেই বাবার দিকে তাকাল। শান্ত দৃষ্টি। সোহান খন্দকারও মেয়ের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল আবার। সিমরান বলল,

‘ আমার উত্তর না হবে না। পারিবারিক ভাবে তোমরা কথা আগাও। আমি সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে বাকি কথা পার্সনালি বলে নিব। ‘

বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুহাস৷ তার বোনকে বড়ো বড়ো লাগছে৷ এই যে কথাগুলো বলল, মনে হলো কত জ্ঞানী একটা মেয়ে। অথচ বোন তার ছোটো। কত ছোটো? অনার্স তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। বয়স বাইশ চলছে। সে এমন উত্তর দিতেই পারে। কিন্তু সুহাস মেনে নিতে হিমশিম খেলো। পরোক্ষণেই ভাবল, বোন আসলে বড়ো হচ্ছে। ধীরেধীরে আরো হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম যা তাকে মেনে নিতে হবে৷ কিন্তু সৌধকে কীভাবে মানবে? ও বন্ধু হিসেবেই ঠিক। বোন জামাই হিসেবে কি ঠিক? সৌধ ভীষণ রাগি। ওর চলন বলন আর সিমরানের চলনবলনে পার্থক্য অনেক। সহজ কথায় দু’জন ঠিক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মনের গভীর ভাবনা গুলো প্রকাশ করল সুহাস বলল,

‘ সৌধর সঙ্গে তুই মানিয়ে নিতে পারবি না সিনু। ও আর তুই সম্পূর্ণ আলাদা। তোদের ভাবনা, চিন্তা, চলাফেরা সব আলাদা। ও অনেক ম্যাচিওরড। তুই ওর পর্যায়ে ম্যাচিওর না। ভয়টা আমার এখানেই। তোদের দু’জনের মিলবে না। নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হবে। ‘

সুহাসের এহেন বক্তব্যে প্রথম বিরোধীতা করল সোহান খন্দকার,

‘ ও কী পারবে না পারবে তা তুমি কী করে বলে দিতে পারো? ‘

‘ ও আমার বোন। আর সৌধ আমার বন্ধু। আমি দু’জন সম্পর্কেই জানি বাবা। ‘

‘ আমি তোমার সম্পর্কেও জানি। সিনু অন্তত তোমার মতো গর্দভ নয়। ‘

সহসা চুপ হয়ে গেল সুহাস। তখন আইয়াজ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ আমি যদি বলি ওরা মুদ্রার এমপি ওপিঠ বলেই ওদের কম্বিনেশন দারুণ হবে। যা নিধির সাথে হয়ে ওঠত না। ‘

সুহাস হঠাৎ রেগে গেল। সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। বহু বছর একটা মেয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল সিনু। আজ তোর এসব গায়ে লাগছে না৷ বিয়ের যে লাগবে না তার গ্যারান্টি কী? আমি তোকে কোনোভাবেই কষ্টে দেখতে পারব না৷ তোর হাজব্যন্ড তোকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে এটা দেখে শান্তি পেতে চাই আমি। ‘

সিমরান চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ। তাকাল বাবার দিকে। সোহান খন্দকার ভরসার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তবু কথাগুলো বলতে লজ্জা পেল সে। না বলে উপায়ও নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ তোমার বন্ধু যখন চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসে তোমার বোনের এনগেজমেন্ট বরবাদ করেছে। তখন বিয়ের পর তোমার বোনকে ভালোবাসতেও পারবে৷ আর বললে নিধি আপুর কথা? আমি নিধি আপুর বিষয়ে জানার বহু আগে থেকে সৌধ ভাইকে ভালোবাসি। আমার পছন্দ, আমার ভালোবাসা, আমার সিদ্ধান্ত ঠুনকো নয়। এটার প্রমাণ এতদিন না পেলেও আজ পেয়েছি। যদি এক্সিডেন্টলি, আমি আমার হাজব্যন্ডের ভালোবাসা না পাই তাহলেও কখনো কষ্ট পাবো না। সারাজীবন তো আমি এটা নিয়েই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমাকে আজ জীবিত মৃত হওয়া থেকে উদ্ধার করেছে সে। ‘

একদমে কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ছাড়ল সিমরান। সোহান খন্দকার মেয়ের কথা শুনে আপ্লুত চোখে তাকিয়ে রইল। সুহাস বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। আইয়াজ মনে মনে বলল,

‘ পারফেক্ট। সৌধ তো এমন কাউকেই ডিজার্ভ করে। কে বলেছে সৌধ সিনুকে ভালোবাসতে পারবে না? আমি কাগজে লিখে দিতে পারি একদিন সৌধ সিনুকে এতটাই ভালোবেসে ফেলবে যে ও নিজের প্রতিই নিজে অবাক হয়ে থাকবে! ‘

সিমরানের খাওয়া শেষ হলো ইতিমধ্যেই। সোহান খন্দকার সুহাসকে বলল,

‘ আগামী বাইশ সেপ্টেম্বর সৌধর জন্মদিন। দু’দিন ছুটিও আছে শুনলাম। হুট করে এসেছে তাই চলে যেতে হবে ওকে। একুশ তারিখ আসবে আবার। বাইশ তারিখ ওদের এনগেজমেন্ট হবে। এর পরের মাসে বিয়ে। আমাদের সিদ্ধান্ত এটাই। তোমার কিছু বলার আছে? ‘

‘ আমার বলার থাকলেই শুনছে কে? ‘

কপট রাগ দেখিয়ে সুহাস এ কথা বলতেই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে সিমরান বলল,

‘ সুহাস খন্দকারের অনুমতি না পেলে বিয়েই করব না৷ ‘

সুহাস অদ্ভুত ভাবে ভেঙচি কাটল বোনকে। বলল,

‘ আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না। বোন খুশি থাকলেই সুহাস খুশি। ‘

ঠোঁট টিপে হাসল সিমরান৷ সুহাস বোনের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আইয়াজকে বলল,

‘ তোর বন্ধুকে বলে দিস, আমার বোনকে খুশি রাখতে হবে, সুখী করতে হবে। এর হেরফের হলে দেখে নিব আমি। ‘

আইয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ সে কী! সৌধ আমার একার বন্ধু? ‘

ফারাহ খোঁচা দিল আইয়াজকে। ফিসফিস করে বলল,

‘ আহ বলুক না। তুমি তর্ক দিও না। ‘

সোহান খন্দকার প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ কথা তাহলে ঠিকঠাক। সৌধ কাল চলে যাবে। বাকি কথা সেরে ফেলি সুজা ভাইয়ের সাথে। কী বলো সুহাস? ‘

নিচু কণ্ঠে সুহাস উত্তর দিল,

‘ ওকে। ‘
.
.
ন’টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে মাত্র ওঠল সৌধ। ফোন বাজছে তার৷ স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল, ‘সিনু’। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ওঠে ফোন কেটে দিল সে। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে গেল বাথরুমে। হাতমুখ ধুয়ে খিদে খিদে টের পেল। রুম ছেড়ে বেরুতেই দেখল তার কাজিনরা নিচে মিটিং করছে। কিসের মিটিং হতে পারে বুঝেই বিরক্ত হলো। যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই মতোন অবস্থা। দূর সম্পর্কের দু’জন কাকাত ভাই। আর ফুপাত ভাই, বোন রয়েছে সেখানে। ছোট্ট তাহানীও আছে। সে ধীর পায়ে নিচে নামতেই সবার কণ্ঠ নিচু হলো। মুখে লেপ্টে রইল মৃদু মৃদু হাসি। দূর সম্পর্কের কাকাত দুই ভাইয়ের নাম, শেখ সাদি ছোটো করে সবাই সাদি নামে ডাকে। আরেকজনের নাম, সালমান। ফুপাত ভাই শান আর ফুপাত বোন উর্মিও রয়েছে। সবাই বয়সে ছোটো। সাদি অনার্স ফোর্থ ইয়ার। সালমান ফার্স্ট ইয়ার। শানও ফোর্থ ইয়ার শুধু উর্মি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। সামনে সৌধ ভাইয়ের এনগেজমেন্ট এরপর বিয়ে৷ সেই নিয়েই তাদের উত্তেজনা এবং পরিকল্পনা চলছিল। যা সৌধ আসাতে ক্ষ্যান্ত দিল। সৌধ তার আম্মাকে ডাকল,

‘ আম্মা খেতে দিন৷ খিদে পেয়েছে। ‘

তাহানী ছুটে গেল বড়ো মায়ের কাছে। এরপর আম্মা এসে ছেলেকে খেতে দিল৷ খাওয়া শেষে সৌধ ভাই, বোনদের সাথে বসল কিছুক্ষণ। সবার পড়াশোনা কেমন চলছে? সাদি আর সালমান রাজনীতিতে যুক্ত৷ মূলত এজন্যই এ বাড়িতে তাদের আনাগোনা বেশি। চাচা এমপি কিনা…। তাই তাদের থেকে রাজনীতির খবরাখবরও নিল। এরপর আম্মাকে বলল, কাজের মেয়েকে দিয়ে তার ঘরে এক মগ কফি পাঠাতে৷ কাল ভোরে চলে যেতে হবে তাকে। তাই যতটুকু পারা যায় বিশ্রামে থাকবে এখন। নিজের ঘরে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কাজের মেয়েটা কফি দিয়ে গেলে কফির মগ হাতে চলে গেল বেলকনিতে। পকেটে ফোন ছিল। ফোন বের করে কফি খেতে খেতে কল করল সিমরানের ফোনে। রিসিভ হতে সময় নিল না। শুনতে পেল মিহি কণ্ঠের রমণীর চার শব্দের বাক্যটি,

‘ তুমি ব্যস্ত সৌধ ভাই? ‘

তখন ফোন কেটে দিয়েছে বলেই শুরুতে এমন প্রশ্ন। সৌধ সে উত্তর না দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ ফোন অন না করলেও সমস্যা ছিল না। ফোন বন্ধ করাতে আমার বিন্দু পরিমাণও সমস্যা হয়নি। ‘

নিমেষে বুকের ভেতর মৃদু এক চাপ অনুভব করল সিমরান। সৌধ ভাই ফোন করেছিল তাকে?কতবার করেছিল? ইশ! মনটা খচখচ করে ওঠে। বলে,

‘ রাতে হঠাৎ ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর মন এত খারাপ ছিল যে চার্জ দেয়ার আগ্রহ পাইনি। সরি আমি। ‘

কফির মগে চুমুক দিল সৌধ। এরপর উত্তর দিল,

‘ ফোনের চার্জ কখনো হঠাৎ শেষ হয় না। আস্তেধীরেই হয়। যাক সে কথা, কী জন্য ফোন করেছিস সেটা বল। ‘

ঠোঁট কামড়াল সিমরান৷ একটু ভাবুক হলো যেন। এরপর বলল,

‘ তুমি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে? ‘

‘ জানি না। ‘

হতভম্ব হয়ে গেল মেয়েটা। এ আবার কেমন উত্তর? কেন জানো না আর জিজ্ঞেস করল না। যদি বেয়াদবি ধরে নেয়? তাই বলল,

‘ আচ্ছা। মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ‘

‘ অভিনয় আমি জানি না। মনে না এলে কিছু করা সম্ভব হয় না আমাকে দিয়ে। ‘

আচমকা চোখ দু’টোয় ঝলমলে হাসি খেলা করল সিমরানের। নরম গলায় ফের প্রশ্ন করল,

‘ আমাকে তো ভালোবাসো না তাই না? ‘

‘ না। ‘

‘ পছন্দ করো? ‘

‘ হু। ‘

‘ পারিবারিক বিয়ে তো পছন্দতেই হয় তাই না? ‘

‘ হ্যাঁ। ‘

এ পর্যায়ে সিমরান একটু রয়েসয়ে প্রশ্ন করল। এগুলোকে অবশ্য প্রশ্ন বলা যায় না৷ পরীক্ষা বলা চলে। সেই সঙ্গে নিজের ব্যাপারে সবটাই প্রকাশ করা বলে। কারণ সে নিধি আপুর মতো পারফেক্ট গার্ল না। সৌধ যেমন সঙ্গিনী চাইত সে তেমনও না। দু’টো মানুষ একসঙ্গে থাকতে হলে নিজেদের পছন্দ, অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই বলল,

‘ তোমার বউ হলে তার মাঝে কী কী গুণ থাকতে হবে বলবে? ‘

‘ কেন? ‘

‘ আসলে আমি তো অনেক কিছুই বুঝি না, পারি না। শুধু এটুকু বুঝে গেছি শুধু ভালোবাসতে পারলেই কারো বউ হয়ে ওঠা সম্ভব না৷ ‘

‘ তোর বেলায় আমার বউ হওয়া সম্ভব। ভালোবাসাটাই যথেষ্ট। ‘

সহসা বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল সিমরানের। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে বলল,

‘ আমি এতটাই গুণহীন যে মেয়ে হয়েও শাড়ি পরা শিখিনি। ‘

‘ দরকার নেই তো। খুব দরকার পড়লে আমি শিখে নিব। ‘

বিস্ময়ে টালমাটাল সিমরান। নিঃশ্বাস আঁটকে ফের বলল,

‘ রান্নাবান্না পারি না আমি। ‘

‘ পৃথিবীর সব পুরুষকে রাঁধতে জানা মেয়ে বিয়ে করতে হবে। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ‘

‘ ঠিকঠাক কোনো কাজই পারি না। ‘

‘ আমার বউ কাজ না পারলেও চলবে। আমাকে ভালোবাসাই তার একমাত্র কাজ। ‘

‘ জামাকাপড়ও পরিষ্কার করতে পারি না। ‘

‘ ঘর ভর্তি মেইড এনে দিব। তবু এসব ভেল্যুলেস টপিক নিয়ে মাথা ঘামাস না। রাখছি। ‘

চমকে ওঠল সিমরান৷ ত্বরিত শুধাল,

‘ তোমার কোনো প্রশ্ন নেই? ‘

‘ কেন থাকবে? তোর সম্পর্কে কী জানি না আমি? ‘

মিইয়ে গেল সিমরান। নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা রাখি। ‘

বলেই ফোন কটে দিয়ে মনে মনে বলল,

‘ আমি সব শিখে নিব সৌধ ভাই। শাড়ি পরা, রান্নাবান্না সব। বিনিময়ে সারাজীবন তোমার বুকে ঠাঁই চাই৷ আমি ভালোবাসি তোমাকে, ভীষণ ভালোবাসি। যতখানি ভালোবাসলে তোমাকে হারানোর বেদনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ততখানি ভালোবাসি। ‘
.
.
সিমরান ফোন রাখার পর। সৌধ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে ম্যাসেন্জারে ঢুকতেই দেখতে পেল তার এক বন্ধু কিছু ম্যাসেজ এবং ফটো পাঠিয়েছে। বন্ধুটির এয়ার লাইনে নতুন জব হয়েছে। ছবিতে দেখতে পেল, নিধি আর নামীকে। নিধির কোলে তার ছোট্ট ছেলে। কয়েকটা ছবি দিয়ে বন্ধু লিখেছে,

‘ নিধি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না? দেখা হয়েছিল একবার তোদের সাথে। তাই দ্বিতীয় দেখায় চিনে ফেলেছি। বিয়ে হয়ে গেছে ওর। বেবিটা কী কিউটরে। ‘

সৌধর কপালে ভাঁজ পড়ল তৎক্ষনাৎ। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ দিল,

‘ ওদের কোথায় পেলি? ‘

‘ নিধির পাশের মেয়েটার নাম নামী৷ নিধির ফ্রেন্ড বলল। আমেরিকার পারি দিল গতকাল। ওকেই বিদায় দিতে এসেছিল। পিএইচডি করতে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফ্লাইটে ওঠার আগে রেষ্টুরেন্টে বসেছিল কিছুক্ষণ। সেখানেই দেখা। ‘

উত্তর পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ। নামী চলে গেছে দেশ ছেড়ে? সুহাসকে ছেড়ে? এতবড়ো ঘটনা কীভাবে ঘটাল মেয়েটা? সত্যি মেয়েটার দম আছে। কিন্তু কাজটা কতটুকু সঠিক হলো বুঝতে পারল না সৌধ। আর নিধি? মেজাজ বিগড়ে গেল নিমেষে। নিধি তাকে না জানাক অন্তত সুহাস, আইয়াজকে জানাতে পারত ব্যাপারটা। বিতৃষ্ণায় বুকটা ভার হয়ে ওঠল। ভাবল সুহাসকে ফোন করে বিষয়টা জানাবে। পরোক্ষণেই মত ঘুরালো। সে দেখতে চায় নিধি নিজে থেকে সুহাসকে জানায় কিনা। নামী তো চলেই গেছে। সুহাস জানতই যাবে। আলাদা করে এখনি জানানোর দরকার নেই। আপাতত অপেক্ষা নিধির মধ্যে বন্ধুত্ব কতটুকু বেঁচে আছে৷ সেটা দেখার। আবার ভাবল,
নামী কি নিধিকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে গেছে? তাহলে তো হয়েই গেল। নীতিবাদী নিধি মরে গেলেও মুখ খুলবে না। পারলে চোখ দু’টোও বুজে থাকবে। বন্ধুত্ব রসাতলে যাক। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। প্রকৃতি চন্দ্রিমায় ভরা। হাসছে যেন প্রকৃতি৷ এত হাসছে কেন চাঁদের মেয়ে চন্দ্রিমা? মুহুর্তেই সিমরানের কথা মনে পড়ল ওর। সিমরানের মুখটি এই চন্দ্রিমার মতোই স্নিগ্ধ, আদুরে৷ আজ বুঝি চন্দ্রিমার মতোই হাসছে সে? হাসবে না? মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনায় এভাবেই তো হাসে৷ সে হাসি হয় স্নিগ্ধ, নরম রাতের আকাশে চন্দ্রিমার মতোই নিগূঢ় আদুরে।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৫|
মোবাইল হাতে বসে আছে সিমরান৷ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে সময়ের দিকে৷ আর মাত্র একঘন্টা। সৌধ ভাইয়ের ঊনত্রিশতম জন্মদিন। বুক ধুকপুক করছে। প্রতি বছরই এমন সময় পাড় করে সে৷ হৃৎপিণ্ডের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়। জন্মদিনের ছোট্ট একটা উইশ। বিনিময়ে সৌধর থেকে ছোট্ট একটি থ্যাংকস পায়। এতেই যেন এক জীবনের সকল সার্থকতা পেয়ে যায় মেয়েটা৷ অতীতে পেড়িয়ে আসা বছর গুলোর চেয়ে এ বছরের ধুকপুকানি সম্পূর্ণ আলাদা। এত বছর সৌধ জানত না সে তাকে ভালোবাসে৷ তার জন্য ওর হৃদয়ে প্রণয়ানুভূতি আছে৷ আজ জানে। হয়তো বুঝতেও পারবে এত বছর কেন বাইশ সেপ্টেম্বর এলে রাত বারোটার সময় অন্য সবার মতো সিমরানও তাকে উইশ করে। মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একবার বিছানায় শুয়ে থাকছে। আরেকবার ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগদান উপলক্ষে সিমরানের বেস্ট ফ্রেন্ড লুনা এসেছে। মা বেঁচে নেই। ভাবি থেকেও নেই। সে বার ফারাহ ছিল। আজ ফারাহও নেই। তাই বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। দিনের আলো ফুটতেই তার দুই মামা আসবে। আর চৌধুরী বাড়ির লোকজন আসবে৷ সৌধ ভাই, সুজা আংকেল, অর্থাৎ পুরুষ সদস্যরা আসবে দেরিতে। শুনেছে পারিবারিক কয়েকজন আত্মীয়, স্বজন উপস্থিত থাকবে। বন্ধু, বান্ধব কেউ এ মুহুর্তে ফ্রি নেই। ঘনিষ্ঠ যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, বিয়েতে আসবে। সৌধও আর জোরাজোরি করেনি৷ সবাই এখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। একটা সময় পর ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন দু ক্ষেত্রেই ব্যাপক ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যা মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে আমাদের চলতে হয়।

লুনা খ্রিস্টান ধর্মের মেয়ে। সিমরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে। যার সঙ্গে নিজের সুখ, দুঃখ অনায়াসে ভাগাভাগি করতে পারে সিমরান। মানুষ সব ক্ষেত্রে নিজের সুবিধাজনক একটি স্থান খুঁজে বেড়ায়। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে লুনাই হতে পেরেছে সিমরানের কমফোর্ট জোন। এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট৷ বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল লুনা৷ সময় দেখতেই লাফিয়ে ওঠে বলল,

‘ সিনু সিনু, ঊনষাট ঊনষাট। ‘

সিমরান ম্যাসেজ লিখে রেখেছে। শুধু পাঠানোর অপেক্ষা। তাই লুনাকে শান্ত করতে বেলকনি থেকে ঘরে এসে বলল,

‘ জাস্ট সেন্ট করব। ‘

হলিউড মুভি দেখছিল সৌধ। ঘড়ির কাঁটা কখন বারোটায় এসে ঠেকেছে খেয়াল করেনি৷ যখন খেয়াল করল একটু চমকাল৷ পরোক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আজ বাইশ সেপ্টেম্বর। সময় রাত বারোটা। তার জন্মদিন। জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে গেল। উহুম শুধু বছর নয়। এর সঙ্গে হারিয়েছে অনেক কিছু। চেনা এক মুখ অচেনা হয়েছে। চেনা আরো এক মুখ আরো চেনা হয়ে ওঠছে। সবই সময়ের ব্যবধান৷ ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে আলতো হাসির রেখা ফুটল সৌধর৷ সে হাসিতে অল্প ব্যথা, অল্প সুখের সংমিশ্রণ ছিল। আজ দিনের আলো ফুটে দুপুর গড়ালে বাগদান অনুষ্ঠান। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মুভি দেখায় বিরতি টেনে প্রস্তুতি নিল ঘুমানোর। গা এলিয়ে দিল নরম বিছানায়। অভ্যেস অনুযায়ী একবার মেবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াতেই দেখতে পেল, ফেসবুক নোটিফিকেশন, ম্যাসেন্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রাম মিলে হাজার খানেক ফ্যান, ফলোয়ারের উইশেষ ভীড় জমাচ্ছে। কিন্তু সৌধ সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পরপর দু’জনের ম্যাসেজে মন দিল। প্রথম ম্যাসেজটা নিধির। ছোট্ট করে লিখেছে,
‘ হ্যাপি বার্থডে সৌধ। গড ব্লেস ইউ। ‘

দ্বিতীয় ম্যাসেজ সিমরানের। সে ইংরেজিতে গুছিয়ে লিখেছে,

‘ Happy Birthday Soudh Bhai. Only one prayer to the creator that I can make you happy and make you smile. ‘

যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ” শুভ জন্মদিন সৌধ ভাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি আমি যেন তোমায় সুখী করতে পারি এবং তোমার হাসি মুখের কারণ হতে পারি। ”

প্রতি বছর সিমরান জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় তাকে। সেখানে শুধু লেখা থাকে ‘ হ্যাপি বার্থডে সৌধ ভাই ‘ সে উত্তরে ধন্যবাদ জানিয়ে দেয় সৌধ। এ বছরের শুভেচ্ছায় আলাদা কিছু রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার৷ এই আলাদা কিছুর বিনিময়ে শুঁকনো ধন্যবাদ দিতে আগ্রহ বোধ করল না। তাই লিখল,

‘ ঘুমিয়ে পড়। ‘

সিমরানকে ম্যাসেজটা দিয়েই নিধির কনভার্সেশনে
ঢুকল। শুভেচ্ছার প্রতিত্তোরে লিখল,

‘ আজ আমার আর সিনুর এনগেজমেন্ট। তুই না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস। শেষ পর্যন্ত আমি এনগেজমেন্টের কথা না জানিয়ে পারলাম না। লুকোচুরি খেলাটা আমি ঠিক পারি না। ‘

ম্যাসেজটি দেয়ার ছ’মিনিট পর নিধির রিপ্লাই এলো,

‘ শুনেছিলাম…। তবে সিয়র ছিলাম না। আমার ওপর জেদ করে সিনুর জীবন নষ্ট করছিস না তো? বিয়েটাকে নিজের জেদে রূপান্তর করিস না। ‘

শুয়ে ছিল সৌধ। ম্যাসেজটি দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না৷ ওঠে বসল। ত্বরিত আঙুল চালিয়ে লিখে পাঠালো,

‘ সিনু আমার জেদ না। ‘

‘ ভালোবাসা? ‘

বাঁকা হেসে সৌধ লিখল,

‘ না। তবে আমার হৃদয়ের তৃতীয় নারী সিনু। আম্মা, আপার পর যার চোখে আমার জন্য স্বার্থহীন, নিখুঁত ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি আমি। ‘

লাইক ইমোজি দিল নিধি। বহু বছরের বন্ধুত্ব থেকে পুরোপুরি নিধিকে না চিনলেও এটুকু বুঝল তার কথাকে অবজ্ঞা করল নিধি। করাটা বোধহয় স্বাভাবিক। তাই বর্তমানে সিনুর প্রতি তার প্রকৃত অনুভূতিটুকু বোঝাতে সেই সঙ্গে নিধির প্রতিও তার এ মুহুর্তের অনুভূতি জানাতে লিখল,

‘ ঘুরিয়ে, প্যাঁচিয়ে কথা বলি না আমি। তুই সেই নারী যাকে ইহকালে পাওয়ার যুদ্ধে হেরে গেছি। সিনু সেই নারী যে পরকালে আমাকে পাওয়ার যুদ্ধে জিতে গেছে। সিনু আমার বউ হবে৷ সিদ্ধান্তটি আমি দেরিতে নিলেও সৃষ্টিকর্তা অনেক আগেই লিখে রেখেছেন। স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখী হো। তোর বিয়ের কার্ড পাইনি তো কী হয়েছে? আমারটা ঠিক সময় পৌঁছে যাবে। আল্লাহ হাফেজ। ‘

ম্যাসেজটি দিয়েই মৃদুভাবে ফোনটি বিছানার একপাশে ছুঁড়ে ফেলল৷ অনুভব করল বুকের বা’পাশে সেরে ওঠা ঘা’তে জ্বলছে। এ জ্বালায় আর কতদিন জ্বলতে হবে? নিধি নামক আগুনপোকার হাত থেকে কবে রেহাই পাবে? বিধ্বস্ত হৃদয়ের উত্তপ্ত, ভারিক্কি নিঃশ্বাসে ঘরময় ছন্দ তুলল। যে ছন্দে তাল হারিয়ে দু’ চোখের পাতা এক করল সৌধ৷ নিভৃতে ডান চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ল। অতীত পিছু ছাড়ে না। সৌধর এই অতীত কখনোই পিছু ছাড়বে না৷ সে নিজেও পারবে না পুরোপুরি ছাড়তে। এজন্যই বোধহয় বলা হয় বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রণয়ানুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে নেই। পরিণয় না পেলে জ্বলতে হয় পুরো জনম ভরে৷ সময়ের স্রোতে অগ্নি জ্বালা ফিকে হয় অবশ্য কিন্তু পুরোপুরি নিঃশেষিত হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই সুপ্ত কিছু ব্যথা থাকে। থাকে ব্যর্থতা। না পাওয়ার গ্লানিতে ভুগে আজন্মকাল। পৃথিবীতে সব মানুষ এক রকম হয় না৷ কেউ প্রথমবার ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার ওঠে দাঁড়ায়। ভুলে যায় প্রথমবার না পাওয়ার বেদনাটুকু। আবার কেউ ওঠে দাঁড়ালেও ভুলতে পারে না। জীবনে দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হলেও প্রথম জনের থেকে পাওয়া আঘাত ভুলা সম্ভব হয় না৷ দীর্ঘদিন একটি আশা নিয়ে বেঁচে থাকার পর ব্যর্থ হলে কি ভুলা যায়? নিধি আজ অন্য কারো বউ। কাল সে অন্য কারো বর হবে। তাই বলে কি পুরোনো দিন গুলো মুছে যাবে? মুছবে না বলেই নতুন করে বাঁচার লড়াই করতে হয়৷
.
.
বাড়ি ভর্তি মানুষ। জাঁকজমক আমেজে পরিপূর্ণ। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মৃদু সুখ লেপ্টে আছে৷ প্রতিটি সদস্যের মুখে ঝলমল করছে খুশিরা৷ রান্নার জন্য বাবুর্চি আনা হয়েছে। তাদের তদারকি করছে সুহাসের দুই মামা৷ সোহান খন্দকার সুজা চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। সৌধর বাড়ি থেকে কাজিন ঊর্মি আর তাহানী এসেছে। সিমরান তৈরি হচ্ছে। ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখল সুহাস। প্রত্যেকের খবরাখবর নিল। এরপর নিজের ঘরে পা বাড়াতেই হঠাৎ পা দু’টো থমকে গেল একটি ঘরের সামনে৷ যে ঘরটায় এক সময় নামী থাকত। হ্যাঁ এ বাড়িতে এই ঘরটা নামীর ব্যক্তিগত৷ সেদিন সন্ধ্যার পর তাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হলে সে বেরিয়ে যায়। যখন ফিরে আসে নামীকে আর নিজের ঘরে পায় না। এরপর খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখতে পায় নামী এই ঘরে শুয়ে আছে। যা দেখে নিজের ঘরে ফিরে আসে। অনুভব করে নামীর মতো তারও একা থাকা প্রয়োজন। সেই যে একা থাকতে চেয়েছিল তা ক্ষণিকের জন্য। যা নামী দীর্ঘ করে পরেরদিন সকালে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। আকস্মিক বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণা অনুভব করে সুহাস৷ নিজের ঘরে না গিয়ে নামীর ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রয়৷ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর শরীরটা অবশ হয়ে আসতে শুরু করে। ইচ্ছে করে নামীর একান্ত ব্যক্তিগত বিছানায় গা এলিয়ে আরামদায়ক একটি ঘুম দিতে। চমকে ওঠে নিমেষে। ইচ্ছেটা এ মুহুর্তে অবাঞ্ছিত। একটু পর সৌধরা আসবে৷ সিমরান সৌধ দু’জনের জীবনেরই বিশেষ একটি দিন আজ। বোন আজ কত খুশি। চোখ, মুখে কী প্রসন্নতা! এত দীপ্তি, এত খুশিতে আঁধার নামাতে চায় না সে৷ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ দৃষ্টি আটকালো একটু দূরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ওয়ারড্রবের দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল নিমেষে। কী ব্যাপার ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার হালকা ফাঁক কেন? এ ঘরে তো কেউ আসে না৷ তাহলে কী নামীই এভাবে রেখে গিয়েছে? বড্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই? মুখটা বিষণ্ন হয়ে ওঠল। ধীরপায়ে এগুলো ওয়ারড্রবের দিকে। যেই নিচু হতে যাবে অমনি সেলিনা আপা ডাক দিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ তাড়া নিয়ে বলল,

‘ সুহাস ভাই, মেহমানরা এসে পড়েছে। আপনারে খুঁজতেছে, তাড়াতাড়ি আসুন। ‘
.
.
চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা বসে আছে৷ তাদের আপ্যায়ন করছে সুহাসের দুই মামা, সুহাস আর সোহান খন্দকার। এরই মধ্যে সৌধর বড়ো ভাইয়ের ছেলে সুর কান্না শুরু করল। সৌধর বড়ো ভাই সৌরভ এখন দেশে নেই। তার স্ত্রী ঝুমায়না আর তাদের একমাত্র ছেলে সুরকে দেশে রেখে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে গেছে সে। সুরের জন্ম কানাডায়। তার মাতুলালয়ে। ঝুমায়না জন্মসূত্রে কানাডিয়ান৷ বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশি। বাংলাদেশের গরমের সঙ্গে অভ্যস্ত না তারা৷ দু, একমাসের জন্য শশুর বাড়িতে বেড়াতে আসে তবু বেছে বেছে শীতকালে। এবার গরমে আসা হয়েছে একমাত্র দেবরের বিয়ে উপলক্ষে। তীব্র গরমে ঝুমায়নার সমস্যা হলেও মানিয়ে নিচ্ছিল৷ কিন্তু ছেলের কান্নায় আর সম্ভব হলো না। সৌধও ভাতিজা আর ভাবির অসুবিধা বুঝতে পেরে সুহাসকে বলল, তার ভাবিকে উপরে নিয়ে যেতে৷ উপরে তিনটে ঘরে এসি আছে৷ এর মধ্যে সুহাস বা সিমরান যে কারো ঘরে নিয়ে বসাতে বলল। সুহাস মাথা নেড়ে ঝুমায়না ভাবিকে নিয়ে উপরে যেতে উদ্যত হতেই সকলের দৃষ্টি আঁটকে গেল সিমরানের দিকে। সিঁড়ি পেরিয়ে কি এক হুরপরী আসছে? যাকে দেখে উপস্থিত সকলের চোখ ধাঁধিয়ে ওঠল? কাজিন ব্রাদার্সরা শুরু করে দিল ফটোগ্রাফি। হঠাৎ সকলকে থমকে যেতে দেখে সৌধও তাকাল সিঁড়ির দিকে। লাইট অরেঞ্জ কালার গর্জিয়াস গাউন পরিহিত একটি বারবি ডল যেন সিমরান। আজ তাকে দেখে বাংলাদশি তরুণী মনে হচ্ছে না। ঝুমায়না দেখতেও মারাত্মক সুন্দরী। চেহেরায় বাঙালিয়ানা নেই। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা। চুল গুলো বাদামি বর্ণ। ঝুমায়নার মুখে শোনা যায়, এক বলিউড প্রডিউসার নায়িকা হওয়ার জন্য অফার করেছিল তাকে। সৌরভের সঙ্গে সম্পর্কে না জড়ালে সে ওই জীবনটাই বেছে নিত বোধহয়। সেই ঝুমায়নার সৌন্দর্যও যেন সিমরানের পাশে ক্ষীণ হয়ে গেল আজ। একপাশে বান্ধবী লুনা আরেক পাশে ছয় বছরের তাহানী৷ মাঝখানে সিমরাম৷ গাউনের দু’পাশে ধরে এক এক করে সিঁড়ি পেরুচ্ছে। মাথায় ফ্লোরাল হেডপিস। পেছন দিয়ে লাইট অরেঞ্জ কালার লম্বা দোপাট্টা একদম পা ছুঁই ছুঁই। মুখে প্রসাধনী ব্যবহার করেছে ঠিক৷ কিন্তু সেগুলোর এত সুন্দর ফিনিশিং টেনেছে যে একদমই ন্যাচারাল লাগছে। লুনা যেন মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়েছে বান্ধবীকে। এছাড়া মনের মানুষের জন্য সাজতে পারলে ভেতরে যে উৎফুল্লতা থাকে। তাও যেন সিমরানের চোখে মুখে উপচে পড়ছে। যা তার সৌন্দর্যকে গগনচুম্বী তুলে দিয়েছে। ঝুমায়না উপরে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল। সিমরান নিচে নেমে এসে সকলকে সালাম দিতেই হুঁশ ফিরল তার। আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করল নিজের দিকে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। না নেই। সবার নজর এখন সিমরানের প্রতি। যা তার ভেতরে ঈর্ষার আবির্ভাব ঘটাল। তিন বছরের ছেলেটাকে কোলের বা পাশ থেকে ডান পাশে নিয়ে সুহাসকে বলল,

‘ আমার ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ উপরে নিয়ে চলুন৷ এসি ছাড়া এক মিনিট থাকা ওর জন্য যন্ত্রণার। আপনাদের ড্রয়িংরুমে এসি নেই কেন বুঝতে পারছি না! ‘

ঈষৎ বিস্ময় ঝুমায়নার কণ্ঠে। সুহাস সহজ বুদ্ধির ছেলে। সে না টিটকারি বুঝল আর না ঈর্ষা বুঝল। সে মৃদু হেসে সহজ গলায় উত্তর দিল,

‘ আপনাদের বাড়ির মতো যৌথ পরিবার নয় আমাদের। আমরা বাড়িতেই থাকি না। কালেভদ্রে আসা হয়। সিনু ওর রুমেই সর্বক্ষণ কাটায়। তাই প্রয়োজন পড়েনি। যখন প্রয়োজন মনে হবে অবশ্যই ড্রয়িংরুমে এসি লাগাব। ‘

কথা গুলো বলতে বলতে ঝুমায়নাকে নিয়ে উপরে চলে গেল। তানজিম চৌধুরী সিমরানকে নিজের পাশে বসালেন৷ সৌধর দাদুনি তীব্র অসন্তুষ্টির চোখে তাকিয়ে। সে শিক্ষিত নারী হলেও খাঁটি বাঙালি। পারিবারিক নিয়ম রীতিও মান্য করে খুব। তাই শাড়ির পরিবর্তে এসব গোলগাল চমকওয়ালা পোশাকে সিমরানকে দেখে পছন্দ করলেন না। তবু আনুষ্ঠানিকতার জন্য চুপ থাকলেন। সুজা চৌধুরী স্ত্রীকে ইশারা করলেন পারিবারিক ধারা বজায় রেখে বাগদান সেরে ফেলতে। তানজিম চৌধুরী মুচকি হেসে নিজের হ্যান্ড পার্স থেকে একটি গোল্ডের নেকলেস বের করে পরিয়ে দিলেন সিমরানকে। এরপর দাদুনিকে ইশারা করা হলো। দাদুনি হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,

‘ নাকে তো ফোঁড়া নাই৷ নাকফুল পরাব কী করে? ‘

সহসা দাদুনির কথায় সকলের মাথায় ছোটোখাটো বিস্মরণ ঘটল। দাদুনি যে কঠিন মানুষ। ঝুমায়নার মতো মেয়েকে বিয়ের দেড় বছর পর নাক ফোঁড়া করিয়ে ছেড়েছে৷ সেখানে সিমরান! ঢোক গিলল সকলেই। শান্ত রইল কেবল সুজা চৌধুরী আর সৌধ। সোহান খন্দকার এগিয়ে এসে বললেন,

‘ চাচি আমি খেয়াল করিনি বিষয়টা৷ বুঝেনই তো মা নেই। বউ মাও পড়াশোনার জন্য দূরে থাকে। সবমিলিয়ে ভুল হয়ে গেছে। ‘

সিমরান ভীত চোখে বাবার দিকে তাকাল। তার এই ট্রাডিশন একদম পছন্দ নয়। বিয়ে করে দু’হাতে চুড়ি পরে ঘুরো, নাকফুল দিয়ে ঘুরো। তবু শখ করে চুড়ি পরা যায়৷ কিন্তু নাক সুঁই দিয়ে ফুটো করে সেখানে গহনা অসম্ভব। কান ফুটো কবে কখন করিয়েছে। মনে নেই। নাক সে ফুটো করবে না । গা শিউরে ওঠল ভয়ে। এদিকে দাদুনি তীব্র রোষানলে ফেটে পড়ছে। এমনিতেই সিমরানকে পছন্দ না তার। এর ওপর এসেই দু দু’টো ভুল চোখে পড়েছে৷ মুখে আঁধার নামিয়ে বসে রইল দাদুনি৷ তানজিম চৌধুরী ছেলের দিকে তাকাল৷

শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত সৌধ। পাঞ্জাবির ওপর লাইট অরেঞ্জ কালার কটি৷ গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি। দৃঢ় চোয়ালে লেপে আছে৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য ছেঁটেছে দাঁড়ি গুলো। সিমরানের বান্ধবী লুনা সুক্ষ্ম নজরে দেখছে সৌধকে। বান্ধবীর হবু বরের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ করল তিনটে জিনিস। এক হিরোদের মতো ফুটনেস৷ দুই স্বচ্ছ গভীর একজোড়া দৃষ্টি। আর তিন হলো ওষ্ঠজোড়ার উপরে চৌকা নাকের নিচে কিঞ্চিৎ রাজকীয় স্টাইলে রাখা মোচ। এর আগে বহুবার দূর থেকে দেখেছে। ছবিতেও দেখেছে। কিন্তু আজ এত কাছ থেকে দেখে মনে মনে বলল,
‘ বান্ধবী এত্ত হট একটা জামাই পাইতেছিস!জিতছস জান জিতছস! ‘

দাদুনির কথায় সৌধ বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু সিমরান নাক ফুটো করেনি বিষয়েটা সে জানত না৷ কেউই বোধহয় খেয়াল করেনি। নাই করতে পারে৷ বিষয়টা এত জরুরি নয়৷ ভেবেই সিমরানের দিকে তাকাল। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাবার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ছেলের ঠান্ডা চোখের ভাষা বুঝতে পেরে গজগজ করতে থাকা মায়ের দিকে তাকালেন সুজা চৌধুরী। শীতল গলায় বললেন,

‘ আম্মা নাক তো ফুটা নাই। তাহলে বাকি কাজ সেরে ফেলা যাক। ‘

দাদুনি মানতে নারাজ হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুজা চৌধুরী মাকে চোখের ভাষায় নিয়ন্ত্রণ করে ফেললেন। এরপর মুচকি হেসে মধুর স্বরে বললেন,

‘ সৌধ আংটি পরিয়ে ফেলুক। অনুমতি দিন আম্মা। ‘

দাদুনি গম্ভীর হয়ে তাকালেন সৌধর দিকে। সৌধ একপেশে হেসে ভ্রু উঁচালে বললেন,

‘ আচ্ছা পরাও। ‘

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। সৌধর কাজিন সাদি, সালমান দু’জনই ভিডিয়ো আর ফটোশুটে ব্যস্ত। শান ব্যস্ত লুনার সাথে লাইন মারার চেষ্টায়। ঊর্মি সৌধর বড়ো আপু স্মৃতিকে ভিডিয়ো কল করেছে। আদরের ভাই, প্রিয় সিনুর বাগদানে উপস্থিত থাকতে না পেরে মন খারাপ তার। হাজব্যন্ডের ছুটি না হওয়াতে আসতে পারেনি। দেশের বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আসা সম্ভব হয় না৷ তাকে ছাড়া এনগেজমেন্ট হলেও বিয়েটা হবে সে আসার পরই। তাই ভাইয়ের এনগেজমেন্ট ভিডিও কলেই উপভোগ করল সে।

পাশাপাশি বসে সৌধ, সিমরান। সৌধ যখন আলতো হাতে সিমরানের বা’হাত ধরে ডায়মন্ডের আংটি পরাচ্ছিল৷ সে সময় আপনাআপনিই সুহাসের চোখ দু’টো মুগ্ধতায় ভরে ওঠে। তার মনে হতে থাকে এত সুন্দর দৃশ্য এ পৃথিবীতে আর দু’টি দেখেনি। আর সৌধ যখন সিমরানকে স্পর্শ করল। আংটি পরাল অনুভব করল সিমরানের হাত কাঁপছে। এতে একটু বিস্মিত হয় সে। তাকায় সিমরানের মুখশ্রীতে। দেখতে পায়, কমলার কোষের মতো ঠোঁট দু’টি তিরতির করে কাঁপছে। নিমেষে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,

‘ ভয় পাচ্ছিস? ‘

ওই স্বর সিমরান ব্যতীত কেউ শুনতে পায় না। মুখে কিছু উত্তর দিতে পারে না সিমরান। আবেগান্বিত হয়ে পড়েছে। মাথা দিয়ে না বুঝাতে গিয়েও কেঁদে ফেলে৷ তানজিম চৌধুরী কাঁধ চেপে ধরে ওর। আদরে, আহ্লাদে ভরিয়ে তুলে। সুহাস এসে সম্মুখে বসে। আদুরে কণ্ঠে বলে,

‘ কাঁদছিস কেন? একটুও কাঁদবি না৷ চুপ। ‘

ভাই কাছে আসাতে কান্না গুলো বাঁধ ভাঙে। মনে পড়ে আম্মুকে। কী অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয় হৃদয়। বোঝাতে পারবে না কাউকেই। শুধু অনুভব করে এত সুখেও কিছু একটা নেই। মা ছাড়া যে প্রতিটি সন্তানই অসম্পূর্ণ। সৌধর খারাপ লাগে। এত মানুষের ভীড়ে স্বান্তনা দেয়ার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। তবু কান্না থামাতে শান্ত চোখে তাকায়। শীতল গলায় শুধায়,

‘ কাঁদতেই থাকবি, আমাকে রিং পরাবি না ? ‘

আচমকা চুপ হয়ে যায় সিমরান। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় সৌধর পানে। সৌধ নিজের বা’হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ জলদি বাগদান সম্পন্ন কর সিনু। খিদে পেয়েছে আমার। খেতে দিবি না? ‘

চলবে..
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৬|
সময় গড়াল ঢালু রাস্তায় নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ার মতো৷ বিয়ের ছুটিতে বাড়ি এসেছে সৌধ। একমাসের জন্য স্মৃতি আপু আর দুলাভাইও এসেছে৷ বড়ো ভাই সৌরভ এসেছে এক সপ্তাহ আগে। চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে মানেই বিরাট ব্যাপার। একমাস আগে থেকেই তোরজোড় শুরু হয়৷ স্মৃতিসৌধ নামক আলিশান বাড়িটা আত্মীয়স্বজনে ভরে ওঠে।

বিয়ের কেনাকাটা বাকি নেই খুব একটা। সৌধর ছুটি পেতে দেরি হয়েছে। তাই স্মৃতি আপু আর দুলাভাই মিলে সিমরানকে নিয়ে শপিং করেছে। আজ সৌধ এসেছে। তাই স্মৃতি আপু সৌধকে আদেশ করল, আগামীকাল সিমরানকে নিয়ে বেরুতে। বাকি যা কেনাকাটা আছে দু’জন মিলে সেরে নিতে বলল। স্মৃতি আপুর খুব আদরের সিমরান। সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। জানত স্মৃতি আপু। বড়ো বোন হিসেবে সব সময় সাপোর্ট করত ভাইকে৷ কিন্তু নিধির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যখন জানতে পারল সিমরান সৌধকে ভালোবাসে। তখন থেকে মনে প্রাণে সিমরানকে ভাই বউ হিসেবে চাইত৷ আজ সে চাওয়া পূরণ হতে যাচ্ছে। সিনুর কাছে শুনেছে সৌধর সঙ্গে খুব একটা কথা হয় না। এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। তবু প্রয়োজন ব্যতীত তাদের মধ্যে ফোনালাপ হয়নি। সৌধকে ভালোবাসার পাশাপাশি ভীষণ শ্রদ্ধা করে সিমরান। ভয়ও পায়। সবমিলিয়ে নিজে থেকেও ফোন করেনি৷ এই যে দূরত্ব, একে অপরের মধ্যকার জড়তা। এসব তো কাটাতে হবে? এর জন্য অবশ্যই তাদের একে অপরকে সময় দিতে হবে। বোঝাপড়া, ভাব বিনিময়, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, গভীর প্রণয়ানুভূতি সব কিছুর মিশ্রণেই তো স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে। বিয়ের আর মাত্র চারদিন বাকি। তবে কেন এত দূরত্ব? স্মৃতি আপু একদম মানতে পারল না। সিমরানকে কল করে জানিয়ে দিল, আগামীকাল সৌধর সঙ্গে বেরুতে হবে৷ স্মৃতি আপুর কথা শুনে সন্ধ্যাবেলা সৌধকে কল করল সিমরান। সৌধ তখন গিটার নিয়ে বসেছে মাত্র। ফোন বেজে ওঠতেই রিসিভ করে বলল,

‘ ভালো আছিস? ‘

‘ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ‘

‘ এই তো..। ‘

‘ কাল বেরুচ্ছি আমরা? ‘

‘ হু। ‘

একটুক্ষণ চুপ রইল সিমরান৷ বুকের ভেতর অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ কী করছ? ‘

‘ নাথিং। গিটার নাড়াচাড়া করছিলাম। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

ফোন কেটে দিল সিমরান। সৌধ আলতো হেসে ভাবল, সম্পর্কটা আগের মতো থাকলে সিনু এখন গান শোনার আবদার করত। আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে মেয়েটা। সেই সঙ্গে অনেক বেশি জড়তা কাজ করছে ওর মধ্যে। সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। মেপে মেপে কথা বলে। না জানি কী বলে আর ভুল হয়ে যায়। ওই মেয়েটা এত যত্ন নিয়ে ভালোবাসতে জানে? অনেক বেশিই আশ্চর্য হয় সৌধ। বিরবির করে বলে,

‘ নারীর ছলনা পুরুষকে নরকে ধাবিত করে। আর
ভালোবাসা স্বর্গে ভাসায়। ‘

নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে সুহাস৷ মনের বিষণ্নতা দেহে উপচে পড়ছে তার। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়। ক’দিন পর বোনের বিয়ে। কোথায় সে হাসি মুখে সকল দায়দায়িত্ব পালন করবে। বোনকে শশুর বাড়িতে পাঠাবে। তা না। সারাক্ষণ বিষণ্ন চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে সে জানতে পেরেছে নামী আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। জানিয়েছে তার শশুর। শশুরের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছে, তাদের মধ্যেকার ঝামেলার কথা বাবাকে জানায়নি নামী। কারণ, বাবা তাকে প্রশ্ন করেছিল,

‘ তোমারও বেড়াতে আসার কথা ছিল বাবা। নামী বলল কাজ পড়ে গেছে। কবে নাগাদ আসতে পারবে জানিও। ‘

সুহাস হাসিমুখে উত্তর দিয়েছে,

‘ সময় সুযোগ করে জানাব। ‘

খুব ইচ্ছে করছিল নামীর সঙ্গে একবার কথা বলতে। মুখ ফুটে বলতে পারেনি৷ নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। এ জীবনে কতশত ভুল করল সে। যখন ভুলগুলো করে তখন একবারের জন্যও অনুভব করে না, ভুল হচ্ছে। ভুলের প্রতুত্তরে মাশুল দিতে গিয়েই টের পায় মস্তবড়ো ভুল হয়ে গেছে। ভুলটা কি এতই বেশি ছিল যে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে নামী? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। সিমরাম এলো সে সময়। ভাইয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল,

‘ ভাবিপুকে মিস করছ? ‘

কপাল থেকে হাত সরিয়ে বোনের দিকে সরল চোখে তাকাল সুহাস। স্মিত হেসে ওঠে বসতে বসতে বলল,

‘ সিনু, বিয়ে নিয়ে, দাম্পত্য জীবন নিয়ে ভালো কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমার। খুব ভয় হচ্ছে তোকে নিয়ে। এতকিছুর পর তোর কোনো প্রকার কষ্ট দেখলে আমি সহ্য করতে পারব না। শোন, কক্ষনো কোনোকিছু লুকাবি না আমাকে। যে কোনো সমস্যায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবি। সৌধ আমার বন্ধু তাতে কী? তোর চেয়ে বেশি প্রাধান্য আমি সৌধকে দিব না।’

সিমরানের চোখ দু’টো টলমল হয়ে ওঠল। আস্তে করে মাথা রাখল ভাইয়ের কাঁধে। একহাত নরম করে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমাকে নিয়ে টেনশন করো না তো। সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে মাত্রই কথা হলো। কাল আমাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বের হবে।’

‘ সৌধ কল করেছিল! ‘

একটু মিথ্যার আশ্রয় নিল সিমরান। কারণ এতে তার ভাইয়া খুশি হবে। বলল,

‘ হ্যাঁ। বলল কাল বেরুবে আমার সঙ্গে। ‘

বিষণ্ন, হতাশাগ্রস্ত মুখে এক মুঠো রোদ পড়ল যেন। সিমরান প্রসঙ্গ বদলে বলল,

‘ ভাবিপুকে মিস করছি খুব। ভাবিপুও কতকিছু মিস করে গেল বলো? এক কাজ করো ভাইয়া, বিয়ের কাজ মিটে গেলে তুমি ভাবিপুর কাছে যাও। ‘

শ্বাস আঁটকে এলো সুহাসের। বলল,

‘ আমি গেলে নামী খুশি মনে স্বাগত জানাবে না। আর না ফিরে আসবে। ও যে কাজে গেছে তা শেষ করুক। যদি না ফেরে তখন দেখা যাবে। একটা সম্পর্ক তো এভাবে চলে না তাই না? শুরু থেকেই ছিন্নভিন্ন সম্পর্ক আমাদের। ও পিএইচডি শেষ করুক। এরপর সরাসরি প্রশ্ন করব, আমার সাথে থাকতে চাও কি না? ‘

মাথা তুলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সিমরান। বলল,

‘ যদি না করে? ‘

‘ ডিভোর্স করে দিব! ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। ভাই রেগে গেছে টের পেয়ে বলল,

‘ কুল ব্রো। রাগের মাথায় এসব বলছ। ঠান্ডা হয়ে কথা বলো। ভাবিপু তোমার সাথে থাকতে না চাইলে ডিভোর্স করে দেয়া অনুচিত হবে। সে রাগের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তাই বলে তুমিও রাগ করে মেনে নিবে? তোমরা তো দু’জন দু’জনকে ভালোবাসো! ‘

‘ ভালোবাসাটাই আজ পর্যন্ত বুঝে ওঠতে পারলাম না সিনু। ‘

নিজের প্রতি তীব্র তাচ্ছিল্য ভরে কথাটা বলল সুহাস৷ সিমরানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার ভাই এত কষ্ট পাচ্ছে। তীব্র অসুখে দিন কাটাচ্ছে। আর সে সুখের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানব জীবনের এ কেমন চক্র?
.
.
সৌধর ছোটো থেকে বড়ো বেলা যত বন্ধু, বান্ধবী আছে৷ সকলকেই বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড পাঠানো হয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বান্ধবরা দু-তিন আগেই এসে পড়েছে৷ নিধির ঠিকানায়ও বিয়ের কার্ড পাঠানো হয়েছে। সবার ধারণা সে আসবে না। সৌধর আরেক বন্ধু আজিজ। সে আজ সাতসকালে এসে উপস্থিত হলো৷ এসেই হৈচৈ লাগালো। প্রাচী, আইয়াজ, আর আজিজ মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আজ পুরোনো বন্ধুরা মিলে তাদের ক্লাব অর্থাৎ বিগবস ক্লাবে মিট করবে। আজকে সৌধর পরিকল্পনা অন্যকিছু। সিমরানকে নিয়ে বেরুবে সে। সেই পরিকল্পনা বরবাদ হলো আজিজের কলকলানিতে। সে জোঁকের মতো সবাইকে চেপে ধরল৷ কেনাকাটা কালও করা যাবে। বা সন্ধ্যায়। কিন্তু সব বন্ধুদের সন্ধ্যার পর ভাগে নাও পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে নিধি! সে তো আর বাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যার পর বের হবে না। হাজব্যান্ডকেই বা কী জবাবদিহি করবে? সৌধ জানে না বিয়েতে নিধি আসবে কিনা। তবে আজ প্রাচীরা মিলে বিগবস ক্লাবে আসতে বলল আসার সম্ভাবনা নিরানব্বই পার্সেন্ট। তাই ভাবুক হয়ে পড়ল সৌধ। ভাবনায় বিভোর সৌধকে দেখে আজিজ বলল,

‘ কী দোস্ত, হবু ভাবিকে ম্যানেজ দিতে পারবি না? নাম্বারটা দে আমি পরিয়ে ফেলি। তাছাড়া সুহাস থাকতে চিন্তা কী? সুহাসকে কল কর। ‘

সৌধ বিরক্ত হলো। কঠিন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল। কল দিল সিমরানকে। বুকের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে তার। দোটানা অনুভূতি হচ্ছে। এক মন বলছে বন্ধুদের সময় দিতে। আরেক মন প্রশ্ন তুলছে, সিনুর প্রতি অন্যায় হবে না? অবহেলা হয়ে যাবে না? সে দোটানা কাটাতেই সিমরান কল ধরলে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,

‘ আজ যদি বেরুতে না পারি? ‘

ফোনের ওপাশে চঞ্চলিত হৃদয়টা দপ করে স্থির হয়ে গেল। আশাহত স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ কোনো কাজ পড়ে গেছে? তাহলে কাল যাই… ‘

‘ হ্যাঁ, কাজ পড়ে গেছে। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

সিমরান সহজে মেনে নিল। যা সৌধর ভেতরে আরো বেশি জটলা পাকালো। নিজের প্রতি নিজেই অসন্তুষ্ট হলো কিছুটা। সিনু কি মন খারাপ করল? কাজ আছে শুনে মেনে নিল ঠিক। কিন্তু কী কাজ জানতে পারলে কষ্ট পাবে? ভাববে কি বন্ধু নয় আসলে নিধিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি আমি? আচমকা বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল। এই মুচড়টা কেন ওঠল? সিনুর চেয়ে নিধির গুরুত্ব বেশি হোক। সৌধর ভেতরে থাকা মন এটা চায় না বলেই কী? তার ভেতরের হৃদযন্ত্র এই নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারল না বলেই কী তীক্ষ্ণ মুচড় অনুভব করল বুকে?

সিমরান ফোন রেখে দিতে উদ্যত হয়েছে। অমনি ত্বরিত কণ্ঠে ডাক দিল সৌধ,

‘ সিনু? ‘

চমকে ওঠল সিমরান। হাতটা কেঁপে ওঠল একটু। শুঁকনো গলায় বলল,

‘ হুহ, কিছু বলবে? ‘

ঢোক গিলল সৌধ। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আজিজ, প্রাচী, আইয়াজের দিকে একবার দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বুক চিরে বেরিয়ে এলো, রুদ্ধশ্বাস। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্থির রাখল সম্মুখের দেয়ালে। শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ আজিজ, প্রাচী ওরা চাইছিল আমরা পুরোনো বন্ধুরা মিলে ক্লাবে আড্ডা দিই আজ। আরো তিনদিন বাকি আছে। আগামীকাল আমরা বেরুই কী বল? আজ ওদের সময় দিই? ‘

সহসা মৃদু হাসিতে মুখ ভরে ওঠল সিমরানের। বুকের ভেতরটা যেন প্রশান্ত নদীতে রূপান্তরিত হলো। একদম মাখনের মতো নরম হয়ে গেল মন। বলল,

‘ আচ্ছা। নো প্রবলেম। আমি একটুও মন খারাপ করিনি। কাল তো যাচ্ছিই। কাল আমরা একসঙ্গে কেনাকাটা করে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফিরব ঠিক আছে? ‘

উল্লসিত কণ্ঠ সিমরানের। সৌধ সায় দিয়ে আবার ডাকল,

‘ সিনু? ‘

‘ বলো। ‘

‘ নিধি আসতে পারে। ‘

এক নিমেষে নিভে গেল সিমরান। কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ নিধি আপু আসবে? ‘

‘ সম্ভবত। ‘

বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠল মেয়েটার। একহাতে বুকের বা’পাশে চেপে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা। ‘

সৌধ নিশ্চুপ। সিমরান কিয়ৎক্ষণ নীরবতায় থেকে বলল,

‘ থ্যাংকিউ। ‘

এ পর্যায়ে একপেশে হাসল সৌধ। বলল,

‘ রাখছি। ‘

ফোন কেটে যেতেই বুকের মধ্যিখানে ফোনটা চেপে ধরে বসে রইল সিমরান। অস্বীকার করবে না। সে চায় না নিধি আপু সৌধ ভাইয়ের আশপাশে থাকুক। এই যে আজ দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতেও ঘোর আপত্তি রয়েছে তার৷ কিন্তু সৌধ ভাই নিধি আপুকে কেন্দ্র করে যে প্রাধান্যটা দিল তাকে। এতে নিজের মাঝে একদম চৌধুরী সাহেবের বউ বউ অনুভূতি টের পেল। অনুভব করল অদৃশ্য এক অধিকার বোধ। যা স্ত্রী হিসেবে প্রতিটি মেয়ের থাকে। তারও তৈরি হচ্ছে! তিন কবুল পড়েনি। তবু মনে মনে সম্পর্কের যে সমীকরণ তৈরি হয়েছে। এতেই ভবিষ্যতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে মন খারাপ অন্যদিকে নিজেকে সুখী অনুভব করল সিমরান। মনে মনে পণ করল, আজ সারাদিন যখন খুশি তখন সৌধ ভাইকে কল করবে। নিধি আপু পাশে থাকুক, কাছে থাকুক। তার কল রিসিভ করতে হবে ডক্টর সৌধ চৌধুরীকে। যতক্ষণ না সে ফোন ছাড়বে ততক্ষণ ফোন ধরে থাকতে হবে। যদি এর হেরফের হয় সে চুপ করে থাকবে না। সরাসরি চলে যাবে ক্লাবে। নিধি আপু আর সৌধ ভাই যদি পাশাপাশি বসে থাকে। সে গিয়ে মাঝখানে বসবে। মাঝখানে জায়গা না হলে একদম সৌধ ভাইয়ের কোলে ওঠে বসে থাকবে।

আবোলতাবোল ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠল মেয়েটা। আকস্মিক অনুভব করল বুকের গভীরে কোথাও একটু যন্ত্রণা হচ্ছে। যাকে পাত্তা দিতে চাইল না সে। বিরবির করে মনকে বুঝাল বলল,

‘ ওরা শুধু বন্ধু হিসেবেই মিট করছে ব্যস। কিছুই হবে না৷ কোনো ভয় নেই। যেখানে সৌধ ভাই নিজে ফোন করে কিছুটা অনুনয় সুরেই কথা বলে জানালো সবটা। সেখানে এত চিন্তা করার কিছু হয়নি। নিধি আপু ম্যারেড, বিউটিফুল একটি বেবি আছে। আর সৌধ ভাই তার সঙ্গে কমিটেড। ‘

সব অস্বস্তি দূরে ঠেলে স্বস্তি ভরে শ্বাস নিল সিমরান।
তার অবস্থা মানসিক টানাপোড়নে রূপ নিয়েছিল৷ আকস্মিক ফের কল এলো সৌধর। সিমরান অবচেতনেই রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সৌধর বিচলিত কণ্ঠস্বর,

‘ আমরা সন্ধ্যার পর বের হচ্ছি সিনু। আজ যখন কথা ছিল আজই বের হবো। এই গরমে দিনের চেয়ে সন্ধ্যাবেলাটাই বেস্ট হবে। ছ’টা ত্রিশে বাড়ির সামনে থাকব। রাখছি এখন।’

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে