#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫১|
সংসার জীবন সম্পর্কে ধারণা কম সিমরানের। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার তিক্ত সম্পর্কে ধারণা বেশ৷ ছোটো থেকে বাবা মায়ের মধ্যে তিক্ততা দেখে বড়ো হয়েছে। ঝগড়া, বিবাধ করে কতকাল বাবা, মা একে অপরের মুখ দেখেনি হিসেব ছাড়া। তবে শেষদিকে এসবের অবসান ঘটেছিল। আফসোস একটাই সময়টা ছিল খুবই অল্প। দুঃখের দিনগুলো এত বেশি। সুখের দিন এত অল্প কেন? উত্তর জানা নেই মেয়েটার৷ তবে এবার মনে মনে তীব্র আতঙ্কিত হলো। বাবা, মায়ের অতীত জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তো? ভাই, ভাবির জীবনে!
নামী কোথায় গিয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। সুহাসও নাছোড়বান্দা। উত্তরের জন্য পিছু পিছু বেডরুমে গেছে। নিচ থেকে স্পষ্ট তর্ক শুনতে পেল সিমরান৷ ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। আর ভালো লাগে না এসব। কবে সমাপ্তি ঘটবে এই অশান্তির? কবে একটু হাঁপ ছেড়ে নিঃশ্বাস নেবে সে।
ইদানীং বাবাকেও কেমন বিষণ্ণ লাগে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও ভালো নেই। সারাজীবন ভালো না বেসে যে নারীর সঙ্গে সংসার করল। যে নারী তাকে দু’টো সন্তানের বাবা হওয়ার সুখ দিল। সেই নারী বিয়োগে এটুকু বিষণ্নতা স্বাভাবিকই। সিমরান অনুভব করল তাদের বাড়ি থেকে সুখ বিলীন হয়ে গেছে। আর মন থেকে ওঠে গেছে শান্তি৷ তারা এখন বিরাজ করছে সুখহীন অশান্তির রাজ্যে। এ রাজ্য থেকে কবে মুক্তি পাবে সে? দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। চারপাশে দেখতে পায় শুধু ঘন অন্ধকার। একটু প্রশান্তির শ্বাস, কিঞ্চিৎ আলোর দেখা এ জন্মে পাবে তো? নিভৃতে ওর গাল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে৷ সে অশ্রুকণা সন্তর্পণে মুছে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে হ্যান্ড পার্স আর সেলফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বুকভরে শ্বাস নিতে৷ এই দমবন্ধকর বাড়িটায় আর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না। তবু কিছুক্ষণের জন্য রেহাই পাওয়ার প্রত্যাশায় ছুটে বেরিয়ে যায়।
.
অনেকক্ষণ ধরে তর্ক করেও নামী মুখ ফুটে বলল না। কোথায় গিয়েছিল? সুহাসের ক্রোধ এবার গগনচুম্বী। নামী বুঝতে পারল তবু নিজের ক্রোধটুকু দমাতে পারল না। আপাতত সুহাসের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না৷ মাথাটা দপদপ করছে। নতুন একটি সেলোয়ার-কামিজ বের করে তোয়ালে নিয়ে বাথরুম ঢুকে পড়ল সে। সুহাস অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল সবই। নামী গোসল করে ভেজা চুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বেরুতেই ফের সে প্রশ্ন করল,
‘ কোথায় ছিলে সারাদিন? কোথায় গিয়েছিলে? ‘
বিরক্ত হলো নামী। এই ঘ্যানঘ্যান আর ভালো লাগছে না। খিদে পেয়েছে খুব। শরীরটা দুর্বল লাগছে। তাই কিছুই বলল না। চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল। চুলগুলো ভালো করে মুছে নিয়ে মুখে ক্রিম লাগালো। সুহাস উত্তর না পেয়ে মুখের লাগাম হারালো এবার। বলল,
‘ কার সঙ্গে ফূর্তি করে এলি! যে বলতে লজ্জা করছে?’
নিমেষে চটে গেল নামী। তড়াক করে ওঠে এসে তর্জনী উঁচিয়ে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘ মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ ডক্টর. সুহাস খন্দকার। আমার ক্যারেক্টার তোমার মতো জঘন্য নয়। ‘
‘ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কার সঙ্গে ডেটে গিয়েছিলে সেটা বলো। ‘
সুহাস ইচ্ছে করে ঘাঁটতে শুরু করল। যাতে রাগান্বিত হয়ে সত্যিটা বলে দেয় নামী। সে নিজেও জানে নামী কেমন চরিত্রের মেয়ে৷ তবু খোঁচাখুঁচির স্বভাব তার। সুহাসের মনোভাব পুরোপুরি বুঝতে পারেনি নামী৷ সকালের ঘটনাটি নিয়ে তীব্র ক্রোধে জর্জরিত ছিল সে। তাছাড়া ইদানীং ঘনঘন মেজাজ হারাচ্ছে তার। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ত্বরিতবেগে। সবচেয়ে বড়ো কথা এই সুহাসকে তার অসহ্য লাগছে। তাই ওর বলা কথাটি মারাত্মক ভাবে আঘাত করল মাথায়। ফলশ্রুতিতে চিৎকার করে বলল,
‘ কী বললে তুমি? সবাইকে নিজের মতো চরিত্রহীন ভাবো? তোমার মতো ল’ম্পট চরিত্রের অধিকারী আমি না সুহাস খন্দকার! ‘
আকস্মিক নামীর মুখে এমন কথা শুনে সুহাসের ক্রোধও নিয়ন্ত্রণ হারালো। মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল নিমেষে। চোখ, মুখ খিঁচিয়ে বলল,
‘ আমি চরিত্রহীন! ল’ম্পট! তুমি যদি এতই সৎ চরিত্রের অধিকারী হও। সাহস করে বলতে পারছ না কেন কোথায় গিয়েছিলে? আমি ল’ম্পট? আমি? তাহলে… তাহলে ইউ আর অ্যা বেড কিড! শুনতে পেয়েছ? ইউ আর এ বেড কিড! এজন্যই ঠিক এজন্যই স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বলতে পারছ না সারাদিন কোথায় কার সাথে কাটিয়ে এলে। ‘
সহসা থরথর করে কেঁপে ওঠল নামী। ক্রোধে চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। শেষ পর্যন্ত বাবা, মা পর্যায়ে চলে গেল সুহাস? সে খারাপ মানুষের সন্তান? আচম্বিতে মায়ের সরল মুখটা ভেসে ওঠল চোখের পাতায়৷ মুহুর্তেই আত্মাটা হুহু করে কেঁদে ওঠল মেয়েটার। আচমকা তেড়ে এসে সুহাসের কলার চেপে ধরে বলল,
‘ আমার মৃত মাকেও ছাড়লে না তুমি! আমার মা খারাপ নয় সুহাস। আমার মা মাটির মতো মানুষ ছিল। যার সঙ্গে জোচ্চুরি করেছিল তোমার মা৷ বিশ্বাস না হলে তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। তাহলেই বুঝতে পারবে আমার মা কী ছিল? আর তুমি যে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি বলে আমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছ সে মা কী ছিল। ‘
নামী কথার সমাপ্তি দিতে পারল না। নিজের মাকে জোচ্চর বলাতে সুহাসের মাঝে ভর করল পশু রূপি পৌরুষ। সহসা নামীর দু’গাল প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘ কী বললি! আমার মা জোচ্চর, আমার মা জোচ্চর?’
বলতে বলতে নামীর গাল চেপে ধরা অবস্থাতেই এগুতে লাগল। আর নামী পিছুতে পিছুতে একদম দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেল৷ পুরুষালি শক্ত চাপে গাল দু’টো ব্যথায় টন টন করে ওঠল তার। অনুভব করল তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সর্বাঙ্গ অবশ। আচমকা স্মরণ হলো, আজ দুপুরের কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের কথা। যে সময় প্রথম জানতে পারল সে মা হচ্ছে। তার গর্ভে বেড়ে ওঠছে তার আর সুহাসের ছোট্ট একটি অংশ। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল মেয়েটার। সুহাসের ক্রোধ মিশ্রিত রক্তিম চোখে তাকিয়ে মাথা দু’দিকে নাড়াল। অর্থাৎ, সুহাসের মা জোচ্চর ছিল না। একজন মৃত মানুষকে এভাবে বলতে চায়নি নামী। ক্রোধের বশে কীভাবে বলে ফেলল জানে না। সুহাস বলেছে বলে তারও বলতে হবে? তাহলে দুজনের মধ্যে তফাৎটা কোথায় থাকল? আচমকা নিজের একটা হাত তলপেটে চলে গেল নামীর। ওখানটায় কেমন কাঁপছে। বাবা, মায়ের ঝগড়াতে ভয় পাচ্ছে কি তার ছোট্ট সোনামুনিটা? বাবা মাকে কষ্ট দিচ্ছে বলে তারও কি কষ্ট হচ্ছে খুব?
নামীর ক্রন্দনরত অসহায় মুখশ্রী দেখে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিল সুহাস৷ রাগে হিসহিসিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আর নামী ওখানেই বসে পড়ল। অঝড় কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। চিৎকার করে কাঁদল। তার কান্নার শব্দ সিঁড়ি পেরুতে পেরুতেও শুনল সুহাস।
.
.
দেড়মাস পর:
সেদিনের পর যে সকালটা এসেছিল। সে সকালে আর নামীর দেখা পায়নি কেউ। শুধু সেদিন নয় আজ সাতচল্লিশ দিন হয়ে এলো নামীর দেখা নেই। আর না আছে কারো সঙ্গে যোগাযোগ। সেদিন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কী ঘটেছে কেউ জানে না। কিন্তু যত দিন এগুতে লাগল সুহাস যেন নিভে যেতে শুরু করল। মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত নামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল সে। প্রথমে সবগুলো নাম্বার বন্ধ পেল। তার বাবা, আর বোন বহু আগে থেকেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ধারণা সুহাসের সাথে রাগ করে সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করেছে নামী। কিন্তু সুহাসের মনে কু ডাকছে। সে জানে নামী আমেরিকা যাবে। কতদিনের জন্য সেটা জানে না। সে আর নামী গেলে বিশ, পঁচিশ দিনের জন্য যেত৷ যেহেতু সে যাচ্ছে না। তার সঙ্গে নামীর সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। সেহেতু নামী একাই যাবে। কিন্তু গিয়ে যদি আর না আসে? এই ভয়েই নামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে ছেলেটা। ফোনে না পেয়ে নামী যেখানে থাকে সেখানে যায়৷ জানতে পারে পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে যাবে নামী। কিন্তু কবে, কখন আর বর্তমানে নামী কোথায় আছে এসব কিচ্ছু জানতে পারেনি। কেউই সঠিক বলতে পারেনি।
নামীর ওখান থেকে ফিরে এসে সৌধর সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। আর কাউকে কিছু না বললেও সৌধকে খুলে বলে সবটা। সব শুনে প্রচুর গালাগাল করে সৌধ৷ হু’মকি দেয়,
‘ সামনে পেলে তোকে মে’রে তক্তা বানিয়ে দেব শা’লা। ‘
সুহাস বিষণ্ন চিত্তে জবাব দেয়,
‘ তক্তা এমনিতেই হয়ে গেছি দোস্ত। প্লিজ নামীকে খুঁজে দে। ‘
‘ তোর মতো লিজেন্ড আমি দু’টো দেখিনি। আর কতবার বউ হারাবি তুই? ‘
সুহাস ধরা গলায় বলে,
‘ আমি ভুল করেছি সৌধ৷ আমি আর পারছি না এভাবে থাকতে। আমার নামীকে চাই, আমার নামীদামিকে চাই সৌধ। ‘
‘ এক মিনিট, ফারাহর সঙ্গে কথা বলেছিস? ‘
সহসা চমকে ওঠল সুহাস৷ কোনোকিছু না বলেই ফোন কেটে দিয়ে সেই মুহুর্তেই কল করল ফারাহকে। ফারাহ রিসিভ করেই উত্তেজিত গলায় বলল,
‘ আরে সুহাস ভাইয়া, কেমন আছেন? ভাবছিলাম আপনাকে কল করব। এই নামীটার কী হয়েছে বলুন তো? ফোন অফ, ফেসবুক আইডি বন্ধ করে রেখেছে। হোয়াটসঅ্যাপেও এক্টিভ নেই। ‘
নিমেষে নিঃশ্বাস আঁটকে গেল সুহাসের। দু-চোখ বেয়ে না চাইতেও জল গড়িয়ে পড়ল৷ ফোন কেটে দিল আচমকা। ফের কল করল সৌধকে। সৌধ শুনতে পেল নাক টানার শব্দ। হকচকিয়ে বলল,
‘ কী রে ভাই! বউ হারিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে কাঁদছিস নাকি? ‘
ধরা গলায় সুহাস বলল,
‘ ফারাহ কিচ্ছু জানে না৷ ও নিজেও নামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ‘
এ পর্যায়ে সৌধও চিন্তিত হলো। সে ডিউটিতে আছে বলে তাড়া নিয়ে বলল,
‘ দোস্ত আমি ডিউটিতে। ডিউটি শেষ করে ফোন দিই। তুই কোনো চিন্তা করিস না। নামী যেখানেই আছে ভালো আছে৷ ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। নিজেকে ভালো রাখার মন্ত্র খুব ভালো করেই জানে। নামী ভালো আছে এটুকুতেই তুই শান্ত থাক। রাগ, অভিমান করে বউ হারালে বউ খুঁজে পাওয়া যায় নো টেনশন। ‘
.
.
পরিবার নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে সোহান খন্দকার। গোপনে সে খবর পেয়েছে নামী আমেরিকায় যাওয়ার তোরজোর শুরু করেছে। ভিসা রেডি। নামীর ওপর অভিমান হলো মানুষটার৷ মেয়েটাকে এত ভালোবাসে। আর সে সুহাসের সাথে অভিমান করে তার সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল! নিজের বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নামী৷ তাদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছে, খুব তাড়াতাড়িই সে আমেরিকায় পারি জমাবে। তাই নামীর বাবা বন্ধু আখতারুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করেছে সোহান। নামী যাচ্ছে অসুবিধা নেই তার। নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক মেয়েটা। অনেক সময় দূরত্বও কাছে আসতে সাহায্য করে। যদি সৃষ্টিকর্তা সুহাস, নামীর সংসার চায়। তাহলে ওরা আবার এক হবে। সে আর জোরজুলুম করবে না। অনেক হয়েছে আর না৷ ছেলেমেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। তার শাসন বারণ আর মানে না। তাই যদি মানত সে এত বোঝানোর পরও, নিষেধাজ্ঞা করার পরও নামী বাড়ি ছাড়া হতো না৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখত না। বয়স হয়েছে সোহানের। দুনিয়ার ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগে না। সেই কবে নিলু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। এরপর একদিন শুনতে পারল দুনিয়া থেকেও বিদায় নিয়েছে মানুষটা। হারিয়ে গেল উদয়িনীও। এত তাড়াতাড়ি কেন তারা চলে গেল? এই গোটা পৃথিবীতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশ্ব লাগে সোহানের। দুনিয়ার মোহ, মায়া ত্যাগ করতে ইচ্ছে করে। পারে না শুধু মেয়েটার জন্য।
সোহান খন্দকারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু এসব শুনে তাকে পরামর্শ দিল আল্লাহর দরবারে যেতে। তাহলেই তার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। হৃদয়ে প্রশান্তি আসবে৷ জীবনে টাকা, পয়সা অনেক রোজগার করেছে। এবার পরকাল নিয়ে চিন্তা করতে পরামর্শ দিল। বন্ধুর কথাটি মনে ধরল সোহানের। সায় দিল সে। তখন বন্ধু বলল, ‘ ছেলেকে তো বিয়ে করিয়েছ। এবার মেয়ের ব্যবস্থা করো। তারপর চলো দু’জন একসাথেই হজ্জে চলে যাই। আমার সবগুলো বিয়ে করানো শেষ। ছোটো মেয়ে ইন্টারে পড়ে। তবু বিয়ে দিয়ে দিছি। শশুর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে আমার ঘরেই থাকবে। ‘
বন্ধুর এহেন কথা শুনে সহসা নড়ে ওঠে সোহান খন্দকার। সিমরানের বিয়ে! এটা নিয়ে তো আর ভাবা হয়নি। অথচ ভাবা উচিত ছিল তার। চোখের সামনে মেয়েটা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে৷ একাকীত্বে ভুগে টের পায় সে। অনার্স শেষ হতে আর দেড়, দু’বছর। এবার বাবা হিসেবে ওর জীবন গুছিয়ে দেয়া উচিত। তার আদরের মেয়েটা এমন বিষণ্নতায় ভুগছে। ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। আর সে একবারো ভাবেনি তার জন্য উপযুক্ত সঙ্গী বাছাই করার? মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বন্ধুকে বলল,
‘ আমার একটামাত্র মেয়ে জাবের। কোনদিকেই কোনো কিছুর কমতি নেই। সুপাত্রের খোঁজ পেলে জানিও। ‘
ঠিক এর পনেরো দিনের মাথায় বন্ধু জাবের আলী ফোন করল সোহান খন্দকারকে। জানালো,
‘ তোর মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র পেয়েছিরে সোহান। ছেলে এডভোকেট। ‘
পাত্রের বিবৃতি দিতেই পছন্দ করে ফেলল সোহান। বলল আগামীকালই ছেলেকে দেখতে যাবে সে। তার যদি সবকিছু মিলিয়ে পছন্দ হয়। তবেই মেয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কথানুযায়ী ছেলেকে দেখে এসে সিমরানের সঙ্গে আলোচনায় বসে সোহান খন্দকার। বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনে মুখে আঁধার নেমে আসে সিমরানের। ছেলের বিবৃতি শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ জীবনে কি আর কাউকে হৃদয়ে স্থান দিতে পারবে? অসহায় বোধ করে খুব। সোহান খন্দকার টের পায় মেয়ের অনুভূতি। তাই বোঝায়,
‘ মা আমরা যা চাই সব সময় কি তা পাই? পাই না। জীবন অনেক কঠিন রে মা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের যা দেয় তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যা দেয় না তা নিয়ে আফসোস করতে হয় না। মনে রাখতে হয়, যা কিছু পেলাম তাতে নিশ্চয়ই মঙ্গল আছে। যা পেলাম না তা আমার জন্য মঙ্গলদায়ক না। ‘
মন কাঁদছে সিমরানের। কিন্তু বাবাকে বুঝতে দিল না। সে জানে তার বাবা ভালো নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভোগে খুব। কিয়ৎক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল সে। সোহান খন্দকার চাতক পাখির ন্যায় মেয়ের অনুমতির অপেক্ষা করতে লাগল। সিমরানের গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়াল৷ তীব্র কষ্টে কেঁপে কেঁপে ওঠল বুক। ভেতরটা হাহাকার করে বলল, ‘ সৌধ ভাই, আমি অন্য কারো বউ হয়ে যাব! আমার জন্য অন্য কাউকে বাছাই করেছে আব্বু। জাস্ট অনুমতি দিলেই অন্য কেউ এসে আমাতে অধিকারত্ব পাবে! ‘
আচমকা হুহু করে কেঁদে ফেলল সিমরান। সোহান খন্দকার চমকে ওঠল৷ কাছে টেনে নিল মেয়েকে। বাবার বুকে মুখ লুকিয়েও কাঁদল খুব৷ মেয়ের কান্না দেখে সোহান খন্দকারের চোখ বেয়েও জল গড়াল। মনে মনে ভাবল,
‘ তোর যন্ত্রণা আমি বুঝি রে মা। কিন্তু কী করব বল? আমরা যে নিরূপায়। যার হাতে দিব সেই তো তোকে নিতে চায় না৷ বাবা হয়ে কী করে এমন কারো হাতে তোকে তুলে দেই। যে তোকে গ্রহণ করতে অনাগ্রহী। নিজ জীবন দিয়ে যা উপলব্ধি করেছি তা অন্য কাউকে করাতে চাই না। আর না তোর জীবনটা তোর মায়ের মতো হোক এটা চাই। ‘
মুখে বলল,
‘ জোর নেই মা। তুই না চাইলে আমি আর কথা আগাব না। ‘
সহসা মাথা তুলল সিমরান। কান্না থেমে গেছে তার। তবু চোখ দু’টি অশ্রুসিক্ত। ওষ্ঠদ্বয় ভেজা। নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করে বলল,
‘ আমার না চাওয়ার কোনো কারণ নেই আব্বু। তুমি কথা আগাও। কোনো সমস্যা নেই আমার। এই পৃথিবীতে সবাই তার ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে, এর কোনো মানে নেই।’
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫২|
আগামীকাল শুক্রবার। সিমরানের এনগেজমেন্ট। অ্যাডভোকেড অণুজ সরকারের সঙ্গে। লোকটার গায়ের বর্ণ শ্যাম হলেও আকর্ষণীয় চেহেরা। ভীষণ সুদর্শন। সুহাস নিজে গিয়ে দেখা করেছে ছেলেটির সঙ্গে। প্রথম দেখা এবং আলাপচারিতায় চোখ, মন দুটোই কেড়েছে অণুজ। এক দুইদিনের পরিচয়ে মানুষ চেনা ভার৷ পারিবারিক বিয়ে অবশ্য অল্প পরিচয়েই হয়৷ তাছাড়া এনগেজমেন্ট হওয়ার পর বেশকিছু দিন সময় পাওয়া যাবে জানা শোনার। নিজের মনের সকল বিষণ্নতা দূরে ঠেলে আপাতত বোনকে সময় দিচ্ছে সুহাস৷ পাশাপাশি নামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা থেমে নেই। বাড়িতে বাবা, ছেলে আর বোন। তারা দু’টি ছেলে কি আর অতকিছু বোঝে? আত্মীয়, স্বজন সব দূরে দূরে থাকে। নানুমনি বৃদ্ধা। শারীরিক অবস্থা সুবিধার নয়। তাই তাকে এখন আর টানাহেঁচড়া করতে চাইল না। বিয়ে ঠিক হোক। একেবারে বিয়ের সময়ই সবাই আসবেনি৷ আবার ভাবল কালকের মতো দিনে সিমরানের পাশে একজন মেয়ে থাকা জরুরি। নামীকে মনে পড়ল খুব। মেয়েটা বড্ড পাষাণ। এমন পাষাণীকে কোন দুঃখে বিয়ে করল সে? পরোক্ষণেই মনে পড়ল, কোন দুঃখে আবার? বাবার হু’মকি নামক দুঃখে! অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল আইয়াজ, আর ফারাহকে খবর দিবে। ওরা দু’জন ছুটি কাটাতে বাড়ি আছে কিছুদিন। এ মুহুর্তে ওরা ছাড়া বড়ো কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই তার। ভেবেই বন্ধুকে ফোন করে নিজের অবস্থা জানায়। সব শুনে আইয়াজ, ফারাহ আর দেরি করেনি চলে এসেছে। সন্ধ্যা মাথায় করে এলো দু’জন৷ এসেই জানতে পারল, বন্ধুদের মধ্যে তাদেরই জানিয়েছে শুধু। সৌধর পরিবার বা সৌধকে জানায়নি। সিমরানের দুর্বলতা আছে ওদের প্রতি৷ তাই সুহাসই জানাতে নিষেধ করেছে বাবাকে। ছেলের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে সোহান খন্দকার। কারণ সেও জানে এতে সিমরানের মঙ্গল হবে। মেয়েটার মন ভীষণ নরম। ও বাড়ির সদস্যরা সামনে থাকলে নিজেকে যেটুকু শক্ত করেছিল সেটুকু ভেঙে পড়বে নিষ্ঠুরভাবে। একবার বাগদানটা হয়ে যায়। অণুজের সঙ্গে আলাপ হোক। ভালোলাগার জায়গা তৈরি হোক। এরপর না হয় বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানাবে চৌধুরী বাড়ির সবাইকে। ড্রয়িংরুমে বসে সবাই অণুজ সরকারের ফটো দেখছে। প্রথম দর্শনেই সবার পছন্দ হয়ে যায়। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে সকলে। সিমরানের এসব ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি করছে সবাই। যেন বাচ্চা মেয়ে সে। মার্কেটে গিয়ে একটা ড্রেস পছন্দ করেছিল। সেটা কিনে না দিয়ে অন্যটা কিনে দিয়েছে। এখন সেটা পরার আগে বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রশংসা করে তার মন ভুলানোর চেষ্টা করছে। গোপনে তাচ্ছিল্য ভরে হাসল সে। ওঠে চলে গেল উপরে৷ আকস্মিক বোন ওঠে যাওয়ায় মুখে আঁধার নেমে এলো সুহাসের। আইয়াজ খেয়াল করে ফারাহকে ইশারায় সিমরানের কাছে যেতে বলল৷ ফারাহ মাথা দুলিয়ে ওঠে পা বাড়াল উপরের দিকে।
অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলছে ফারাহ৷ সিমরান হু, হা তে উত্তর দিচ্ছে। মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের যন্ত্রণা বোঝা সহজ। তাই তো ফারাহ বুঝে ফেলল সিমরানের বুকের ভেতর বিষাদ সিন্ধু তৈরি হয়েছে। যে সিন্ধুতে বইছে তীব্র তরঙ্গ। এমনই এক তরঙ্গে সে ভুগেছে বহুদিন। যা থেকে তাকে মুক্ত করেছে আইয়াজ নাম শুদ্ধ প্রেমিক পুরুষটি৷ বিষাদ সিন্ধুতে অঢেল প্রেম দিয়েছে। যে প্রেম সকল বিষণ্নতাকে গ্রাস করে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত ডুবিয়ে রাখছে প্রগাঢ় প্রেম তরঙ্গে। মুহুর্তেই মনে মনে প্রার্থনা করল ফারাহ, সিমরানের জীবনেও এমন একজন পুরুষ আসুক। যে তার মনের সব বিষণ্নতা শুষে নিয়ে অঢেল প্রেমে ভরিয়ে তুলবে, ডুবিয়ে রাখবে। যা পেয়ে সিমরানের এই পৃথিবীটা নরক না স্বর্গ মনে হবে। নিজের জীবনের সুখগুলোকে মনে হবে স্বর্গীয় সুখ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারাহ। সিমরানকে বলল,
‘ শুনলাম শপিং করেছ? দেখি কাল কী পরবে? শাড়ি, ল্যাহেঙ্গা না গাউন। ‘
নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল সিমরান। সে শপিং করেছে? ওহ হ্যাঁ করল তো গতকাল। ভাই ছিল সাথে। নিজে থেকে কিচ্ছু পছন্দ করেনি। সব সুহাসের পছন্দে কিনেছে। যেখানে সঙ্গীটাই নিজের পছন্দের হবে না। সেখানে এসব সাজ সজ্জার জিনিস নিজের পছন্দের হয়ে কী হবে? রুদ্ধশ্বাস ফেলল সিমরান। মৃদু হেসে যা যা কেনাকাটা করেছে সবই দেখাল। ফারাহ বেশ প্রশংসা করল প্রতিটি জিনিসের। সিমরানের মনে হলো আজ সবাই সবকিছুতে বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করছে। যা দৃষ্টিকটুর পাশাপাশি কর্ণকটুও ঠেকল। ফারাহর সঙ্গে সময় গুলো কেটে গেল তাড়াতাড়িই। রাতে খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এলো। সুহাস ডাকতে এলো ওদের। খেতে ইচ্ছে করছে না সিমরানের। চারদিকে বিষাদে ছেয়ে গেছে। তীব্র অবসাদে ভুগছে মনটা। তবু খেতে যেতে হলো। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না ওর৷ পানি দিয়ে গিলে গিলে খেল। ওর অবস্থা দেখে আইয়াজের দিকে করুণ চোখে তাকাল ফারাহ। চোখের সামনে এসব দেখে সহ্য হয়? আইয়াজ চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল ওকে। বোনের অবস্থা খেয়াল করল সুহাসও৷ এই পরিস্থিতিতে আসলে কী করা উচিত, কী বলা উচিত বোধগম্য হলো না। শুধু গোপনে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মনের কোথাও একটা যেন সৌধর প্রতি ওর ক্রোধ জন্মেছিল। যা সিমরানকে এই অবস্থায় দেখে জেগে ওঠল৷ প্রিয় বন্ধু সৌধকে এখন অপাত্র মনে হলো তার। আর বোনের তীব্র ভালোবাসাকে মনে হলো ঘি। অপাত্রে ঘি ঢালতে গেলে এভাবেই কষ্ট পেতে হয়৷ আফসোস হলো ভীষণ। আদরের বোন তার। ভুল মানুষকে ভালোবেসে এভাবে পস্তাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল, কালকের পর থেকে যেন ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। নতুন মানুষে নতুন উদ্যমে যেন বাঁচতে শেখে সিমরান।
.
.
আজকের দিনটা যেন চোখের পলকে মিলিয়ে গেল। রাত যত বাড়তে লাগল ততই অদৃশ্য এক ভয় জাপ্টে ধরল সিমরানকে। কাল তার এনগেজমেন্ট হবে। সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একজন মানুষ। যাকে নিয়ে কখনো কল্পনা করেনি সে। এমন একজন মানুষ তাকে দেখবে। গভীরভাবে দেখবে। আংটি পরানোর সময় তার হাতও স্পর্শ করবে। সহসা গায়ে কাঁ টা দিয়ে ওঠল সিমরানের। বুকের ভেতর ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে শুরু করল৷ কীভাবে মেনে নেবে সে? পারবে তো নিজেকে শক্ত রেখে সব সয়ে নিতে? প্রচণ্ড হাসফাস চিত্তে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে মেয়েটা। ঘুম চোখে ধরা দিচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে খুব৷ একসময় বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে ওঠল। একবার মৃদু আর্তনাদে ডাকল, ‘ আম্মু… কেন চলে গেলে এভাবে? আমি যে আর পারছি না নিজেকে সামলাতে। ‘ আরেকবার ডাকল,’ সৌধ ভাই! কাল থেকে আমি অন্যকারো হয়ে যাব। আফসোস কেউ আমার হবে না। আমি মানিয়ে নিতে পারব ঐ লোকটাকে কিন্তু মনে নিতে পারব না। ‘
রাত একটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ একটা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সৌধ। মারাত্মক একটা ঘুম পেয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার চাপ বেশি যাবে। তাই ঘুমানোর তোরজোর শুরু করল। বিছানায় গা এলিয়ে ফোনে এলার্ম দিতে গিয়ে খেয়াল করল, হোয়াটসঅ্যাপে বেশকিছু ম্যাসেজ এসেছে। একটা প্রাচীর। লিখেছে, “কেমন আছিস দোস্ত। ” আর গুলো এলাকার ছোটো ভাই আর বন্ধুর। হঠাৎ নোটিফিকেশন এলো দেখতে পেল সিমরানের ফেসবুক আইডি থেকে জাস্ট একটার দিকে একটি পোস্ট করা হয়েছে। এই মেয়ে রাত জাগাতে পটু৷ খেয়াল করেছে সে। অনেকদিন ভেবেছে কিছু বলবে, ঝাড়িটাড়ি দেবে। পরমুহূর্তে আর দেয়নি৷ কিন্তু রাতদুপুরে পোস্ট! এটা যেন বাড়াবাড়ি ঠেকল। তা কী পোস্ট করেছে দেখি। ভেবেই নোটিফিকেশনে ক্লিক করল। ভেসে ওঠল ইংরেজিতে লেখা কয়েক লাইন। ইংরেজির স্টুডেন্ট। পোস্ট ইংরেজিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে বিরবিরিয়ে পুরো লেখাটা পড়ল সৌধ।
“Why do people get lost? Tears flow in the eyes when a loved one dies. If you lose your life, why does the fire burn in the chest? A dreamer’s dream of a man will never come true The end of the dreamer’s dream. ”
ইংরেজিতে পোস্টটি পড়ে নিমেষে চোখ বুজে ফেলল সৌধ। সিমরানের ইংরেজি পোস্টটির বাংলা হলো-
“মানুষ কেন হারিয়ে যায়? ভালোবাসার মানুষ মরে হারালে চোখে অশ্রু ঝড়ে। জীবন্ত হারালে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে কেন? স্বপ্নচারিণীর স্বপ্ন পুরুষ কখনো সত্যি হবে না৷ স্বপ্নচারিণীর স্বপ্নের সমাপ্তি। ”
বাংলা অর্থ বুঝতেই বুক ধক করে ওঠে সৌধর। ঘুম ছুটে যায় নিমেষে। মুখ হয়ে ওঠে গম্ভীর। অধর কামড়ে বিচলিত চিত্তে হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে সিমরানের নাম্বারে ম্যাসেজ পাঠায়,
‘ ঘটনা কী বলত সিনু, তোর কি ইংরেজি সাহিত্যিক হতে ইচ্ছে করেছে? ওহ হ্যাঁ তুই তো ইংরেজি সাহিত্য নিয়েই পড়ছিস। তা মাইকেল মধুসূদনের জীবন কাহিনি জানিস? ‘
ম্যাসেজটা দিল। সিন হলো। অথচ উত্তর নেই। শুয়ে থাকা ভারিক্কি দেহটি আচমকা ওঠে বসল। সিনু তার ম্যাসেজ সিন করল আর রিপ্লাই দিল না? আশ্চর্য! চোখ, মুখ কুঁচকে গেল সৌধর৷ ত্বরিত আঙুল চালিয়ে ফের টেক্সট দিল,
‘ ঘুমোসনি কেন এখনো? ‘
আবারো সিন হলো। সৌধ ত্বরিত লিখল,
‘ রিপ্লাই কর। ‘
সৌধর ম্যাসেজ পেয়ে ধাতস্থ হতে সময় লাগল সিমরানের। মধ্যরাতে সৌধ ভাইয়ের ম্যাসেজ অপ্রত্যাশিত ছিল। আবারো কান্না পেয়ে গেল মেয়েটার। কাঁদতে কাঁদতে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। মন, মস্তিষ্ক সবটাই বিধ্বস্ত। শেষে ‘রিপ্লাই কর’ ম্যাসেজটি দেখে চমকে ওঠল। এটা ধমক ছিল। বুঝতে পারল সে। তাই তীব্র অভিমান বুকে চেপে উত্তর দিল,
‘ আজ দুপুরে আমার এনগেজমেন্ট সৌধ ভাই। সেই খুশিতে ঘুমাতে পারছি না। কেমন আছো তুমি? ‘
সিমরানের ফোনে চার্জ শেষের পথে ছিল। সারাদিন এত দুঃশ্চিন্তা, মানসিক অশান্তিতে ভুগেছে যে ফোন চার্জ দিতেও খেয়াল নেই। সবকিছু থেকে এমনি ভাবে মন ওঠে গেছে তার। তাই এটুকু রিপ্লাই দেয়ার পর পরই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। আচমকা ফোন বন্ধ হওয়াতে একটুও বিচলিত হয় না সিমরান। বিরবির করে আফসোসের সুরে বলল,
‘ এই ফোনটাও চায় না তোমার সাথে আমার কথা হোক। ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। সহসা তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফোনটা নিয়ে চার্জ দেয়ার পরিবর্তে বন্ধ অবস্থাতেই ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রাখল। কিচ্ছু দরকার নেই তার, কিচ্ছু না। বিছানায় ফিরে এলো আবার। ধপাস করে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদতে লাগল। সারারাত কেঁদেকেটেই শেষ করে দিল৷ ঘুমালো না একটুও। সকালের দিকে একটু চোখ লেগেছিল বটে। কিন্তু তা কি আর দেহ, মনের ক্লান্তি দূর করতে পারে?
.
.
আজ সিমরানের সব দায়িত্ব ফারাহর ওপর পড়েছে। ফারাহ অনেক বুঝিয়ে সকালে একটু খাইয়ে দিয়েছিল৷ এরপর আর খাওয়াতে পারেনি৷ এখন সময় হয়ে এসেছে। অনেক বলে বলে গোসলে পাঠাল মেয়েটাকে৷ ততক্ষণে সে সবকিছু গুছিয়ে রাখল। সিমরান বেরিয়ে আসতেই একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ফারাহ৷ এতক্ষণ কী ভয়ংকর লাগছিল মেয়েটা। মুখের বর্ণ পুরোপুরি লাল ছিল। চোখ দু’টো এখনো ফোলা। সারারাত কী পরিমাণ কান্নাকাটি করেছে। তার প্রমাণ ফুলো ফুলো চোখেই দেখতে পাচ্ছে ফারাহ। চুলগুলো মুছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে পুরোপুরি শুঁকিয়ে ফেলল সিমরান। ফারাহ ওকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসতে বললেই একবার শান্ত চোখে তাকাল। পরোক্ষণেই স্মিত হেসে এগিয়ে এসে বসল চুপচাপ। ফারাহ মৃদু হেসে কাঁধে হাত রাখল। বলল,
‘ আগে চুল বাঁধি তারপর মুখ সাজাই কী বলো? শেষে ল্যাহেঙ্গা পরো। এতে গরম কম লাগবে। এসির পাওয়ার কি আরেকটু কমাব? ‘
‘ না ঠিক আছে। তোমার যেমন খুশি তেমনি সাজাও নো প্রবলেম। ‘
নির্লিপ্ত স্বর সিমরানেও। ফারাহ মৃদু হেসে একে একে সাজাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বিষণ্ন মুখের সিমরান হয়ে ওঠল বিষাদ রাজ্যের রাজকুমারী। যার সব আছে সব। নেই মুখে হাসি। চোখে আনন্দের ঝিলিক। সাজ সম্পন্ন হওয়ার পর পুরোপুরি তৈরি হয়ে নিল সিমরান। ফারাহ যেন ওর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারল না। অবাক গলায় বলল,
‘ কী কিউট লাগছে! তুমি কিন্তু মারাত্মক সুন্দরী সিনু। ‘
একপেশে হাসল সিমরান। মনে মনে বলল,
‘ এই সৌন্দর্যও এক সময় আমার অহংকার ছিল। কিন্তু আজ মূল্যহীন! ‘
মৃদু পায় ড্রেসিং টেবিলের খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল সে। আয়নায় দেখতে পেল আপাদমস্তক সুসজ্জিত নিজেকে। তার শুভ্র ত্বকে লাইট পিঙ্ক কালার ল্যাহেঙ্গাটি দারুণ মানিয়েছে। ল্যাহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে ব্রাইডাল জুয়েলারি গুলোও ভীষণ সুন্দর। গলায় একটি নেকলেস পরেছে হীরের। যা ইন্ডিয়া থেকে তার বাবা এনেছিল তার জন্য। আলতো স্পর্শ করল নেকলেসটায়। মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসল। তার বাবা, ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হয়। এরপর তাকাল নিজের পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ফারাহ আপুর দিকে। আপু এত সুন্দর সাজাতে পারে জানা ছিল না৷ সে বরাবরই ব্রাইডাল সাজতে পছন্দ করে। যদিও সৌধর পছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইদানীং ব্রাইডাল সাজত না। তবে আজ নিজেকে সম্পূর্ণ ব্রাইডার লুকে দেখে পছন্দ হলো ঠিক৷ কিন্তু মনের ভিতর দানা বেঁধে রইল একটাই। এই সাজ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য নয়। মুহুর্তেই বুকের ভেতরটা ডুকরে ওঠল। কান্না উপচে এলো গলা পর্যন্ত। সেই মুহুর্তেই দরজায় টোকা পড়ল সুহাসের।
‘ এই ফারাহ, অণুজরা এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। ‘
সহসা বাক্যে শিউরে ওঠল সিমরান। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল তার৷ নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে তীব্র কষ্ট অনুভব করল। চারিদিকে ঝকঝকে আলো তবু যেন কী গভীর অন্ধকারে ডুবতে শুরু করল সে। তবে কী সবাই মিলে এক আঁধার থেকে অন্য আঁধারে নিক্ষেপ করছে তাকে?
পাশাপাশি বসে অণুজ, সিমরান। সিমরানের মস্তক নত৷ বড়োরা কথা বলছে। আংটি বদল হয়ে গেলেই একসঙ্গে খেতে বসবে সবাই। বর্তমান যুগের স্মার্ট কোনো মেয়ে এত লাজুক হয় নাকি? অণুজের ভারিক্কি জ্ঞানে প্রশ্নটি বার বার উঁকি দিতে লাগল৷ এর আগে দু’বার কথা হয়েছে সিমরানের সাথে। তখনও টের পেয়েছিল সিমরান বেশ লজ্জা পাচ্ছে। তার সঙ্গে কথা বলতে জড়তা কাজ করে মেয়েটার৷ সে যা প্রশ্ন করত তাই উত্তর দিত। নিজে থেকে একটি প্রশ্ন করত না৷ আজ সামনাসামনি দেখা হলো। কিন্তু কথা বলল সে একাই৷ সিমরান মুখে হু, হা উত্তর দিয়েছে। আর মাথা নাড়িয়ে। এর বাইরে একটি কথাও বলেনি। ভেতরে ভেতরে এটা নিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি অনুভব করছিল অণুজ৷ তার মা বিষয়টা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোনো সমস্যা? ‘
অণুজ মাথা নাড়াল। কোনো সমস্যা নেই। দু’পক্ষের আলাপচারিতা শেষ হলো। অণুজ অনুমতি পেল সিমরানকে আংটি পরিয়ে দেয়ার জন্য। ফারাহ এসে বসল সিমরানের অপর পাশে। মেয়েটার বুক কম্পন হচ্ছিল বহুক্ষণ ধরেই৷ সে কম্পন এবার শরীরে শুরু হয়েছে। দূর থেকে খেয়াল করেই চলে এসেছে ফারাহ। অণুজ খুব সুন্দর একটি হীরের আংটি বৃদ্ধা এবং তর্জনী আঙুল দিয়ে ধরে সিমরানের সামনে নিয়ে এলো। এ সময় আইয়াজ বলল,
‘ অণুজ ভাই দাঁড়িয়ে পড়ুন। সিনু ওঠে দাঁড়া। ‘
আইয়াজের হাতে ক্যামেরা। অণুজের চোখ দু’টোয় দীপ্তি ফুটে ওঠল। ওঠে দাঁড়াল সে। ফারাহ ফিসফিস করে ওঠতে বলল সিমরানকে। সিমরান ওঠল না৷ তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না। যেন এ জগতে সে নেই। ঢোক গিলল ফারাহ। কী হচ্ছে এসব? সিমরান কেন বুঝতে পারছে না? এটা কোনো সিনেমার অংশ নয় এটা বাস্তব জীবন। আজ এ মুহুর্তে একটু ভুলচুক হয়ে গেলে দু’পক্ষকেই বিব্রত হতে হবে। পড়তে হবে তীব্র লজ্জায়। সবশেষে অসম্মানিত হতে হবে আংকেল আর সুহাস ভাইকে।
অনেক বলে ধাক্কাধাক্কি করে অবশেষে ওঠানো হলো সিমরানকে। যা খেয়াল করে অণুজের মুখে আঁধার নেমে এলো। তবে কী এই বাগদানে সিমরানের মত নেই? যা হচ্ছে পারিবারিক চাপে পড়ে? শ্বাস রোধ হয়ে এলো অণুজের। বিয়ে ব্যাপারটা তার কাছে খুব ইম্পর্ট্যান্ট। তার বউ হতে এলে আলাদা উৎসাহ নিয়ে হতে হবে। তার প্রতি তীব্র আগ্রহী থাকতে হবে মেয়েকে। এসব না হলে, না থাকলে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না৷ সে কোনো ফেলনা পুরুষ নয়। সিমরান নিঃসন্দেহে সুন্দরী নারী। ছবিতে প্রথম দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে সে। বাস্তবে দেখে সেই আগ্রহ গাঢ় হয়েছে।
কিন্তু সিমরান? সে তো তার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। আকর্ষণ দূরে থাক একবিন্দু আগ্রহীও নয়। জীবনের কাঙ্ক্ষিত একটি মুহুর্তে এসে অণুজ যেন ভেঙে পড়ল৷ মা, বাবা, ভাইরা তাকে উৎসাহ দিচ্ছে আংটি পরাতে। নিমেষে ভাবনা ফুরালো। মন বলল, সে যা ভাবছে এমন কিছু নয়। তাই হলে এত সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে সামনে আসত না সিমরান। আজকালকার মেয়েরা এত বোকা নয়। বুকটা হালকা হলো এবার৷ মৃদু হেসে বা’হাতে সিমরানের বা’হাতটায় প্রগাঢ়ভাবে স্পর্শ করল। অনুভব করল একটুখানি কেঁপে ওঠেছে সিমরান। যা অবিরত চলতেই থাকল।
কাঙ্ক্ষিত সেই মুহুর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আগমন ঘটল সৌধর। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সুহাসদের উন্মুক্ত সদর দরোজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল সে! প্রথমে সামনে পড়ল আইয়াজ। যে ক্যামেরা তাঁক করে আছে অণুজ আর সিমরানের দিকে। সৌধ অবিশ্বাস্য, থমকানো দৃষ্টিতে একবার আইয়াজ আরেকবার সিমরানের দিকে তাকাল৷ এরপর আচমকা আইয়াজের থেকে থাবা মে রে ক্যামেরা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। বিধ্বস্ত মুখ, উষ্কখুষ্ক চুল কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পরনে ইস্ত্রি বিহীন কালো শার্ট। দু’হাতের হাতাই গোটানো। বুকের কাছটায় দু’টো বোতাম খোলা। ফর্সা বুকে কালো লোম গুলো উঁকি দিচ্ছে স্পষ্ট। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করে দেখা গেল ওর পরনে প্যান্ট নয় ট্রাউজার! সৌধ চট্টগ্রামে ছিল। গতকাল সকালেও কথা হয়েছে আইয়াজের সাথে। তাহলে আচমকা সৌধর আগমন কী করে? তাও কিনা এই রূপে। যে রূপে সৌধর বেডরুম ব্যতীত নিজের বাড়ির ড্রয়িং রুমেও দেখেনি কখনো। সেই রূপে দেখে আইয়াজ, ওপাশে থাকা সুহাস, ফারাহ, সোহান খন্দকার প্রত্যেকেই হতভম্ব। উপস্থিত প্রত্যেকে ধাতস্থ হতে সময় নিল। সৌধ হঠাৎ এসে এমন বিশৃঙ্খলা করছে কেন? ও তো এমন ছেলে নয়। নিমেষে সবার কর্ণকুহরে পৌঁছাল আইয়াজের কলার ধরে বলা সৌধর গমগমে কণ্ঠস্বর,
‘ ভেবেছিলাম সুহাসই আমার চরম শত্রু হয়ে গেছে। এখন দেখছি তুইও! ‘
বলেই কলার ছেড়ে দিল। হাত ঝাড়া দিয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখল সকলের স্তম্ভিত মুখ৷ কেবল একজনই নির্লিপ্ত। আচমকা চোখ বুজে নিজের মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করল সৌধ৷ নিমেষে আবার চোখ খুলল। সোহান খন্দকার ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। কিছু বলতে উদ্যত হতেই সে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ আমি খুব দুঃখীত আংকেল। নিরুপায় আমি। ‘
থেমে গেল সোহান খন্দকার। সৌধ চোখ ফিরিয়ে নিল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অণুজ, সিমরানের দিকে। নিমেষে পথে বাঁধা হয়ে সুহাস দাঁড়াল। অনুরোধের সুরে বলল,
‘ কী করছিস এসব? ওদিকে যাচ্ছিস কেন? ‘
‘ তোর সাথে তো আমার কথাই চলে না। পথ ছাড়।’
ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল সৌধ। সুহাস আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ নাটক করবি না। ‘
সৌধ ওর বুক সই করে ধাক্কা দিয়ে বলল ‘ওটা তোর স্বভাব। আমার না। ‘
ধাক্কা খেয়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেল সুহাস। চোখের পলকে সিমরানের মুখোমুখি হলো সৌধ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল একবার৷ এরপর নিজের বলিষ্ঠ ডানহাতটা তুলে সিমরানের স্নিগ্ধ, মসৃণ গাল দু’টো আলতো চেপে ধরল। ব্যথা যেন না পায় এভাবেই ধরল। অদ্ভুত করে হাসল কিঞ্চিৎ। সে হাসিতে এক টুকরো ব্যথা মিশে ছিল কী? জানা নেই। অদ্ভুত সে হাসি হেসে সিমরানের মুখশ্রীতে গাঢ় চোখে তাকাল। দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘তোর কি পার্বতী হওয়ার শখ হয়েছে সিনু? ‘
সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল। অণুজ বাকহারা। আর তার পরিবার স্তম্ভিত মুখে সোহান খন্দকারের পানে তাকিয়ে। সিমরান নিষ্পলকে সৌধকে দেখছে। সত্যি সৌধ ভাই এসেছে? এটুকু বিশ্বাস করতেই সময় লাগল বেশ। এরপর হুট করেই বুকটা মুচড়ে ওঠল। পার্বতী কে? সে কেন পার্বতী হতে যাবে!
এদিকে সৌধ উত্তর না পেয়ে একটুও বিচলিত হলো না৷ সে ঘাড় বাঁকিয়ে সিমরানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির পানে তাকাল। দেখল সিমরানের বা’হাত ছেলেটির বাঁহাতে ধরা। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল এ দৃশ্য দেখে। বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যেন দৃশ্যটি। ভেবেই সিমরানের দিকে একবার নিজের রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই দৃষ্টিটাকে শীতল করে ফের তাকাল অণুজের পানে। অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিমায় হাত বাড়িয়ে সিমরানের হাত থেকে অণুজের হাতটা সন্তর্পণে ছাড়িয়ে নিল। এরপর অণুজের ডানহাতের দিকে নিজের ডানহাত এগিয়ে ধরে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল,
‘ হ্যালো আমি সৌধ চৌধুরী। সন অফ এমপি সুজা চৌধুরী। ‘
অণুজ বাকশূন্য। সৌধর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে হাত ছেড়ে দিয়েছে। পুনরায় তাকিয়েছে সিমরানের বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে। ওর বিস্মিত মুখ তার মনকে চনমনে করে তুলল। মুখ বলল,
‘ তুই কি চাস দেবদাস হতে গিয়ে ফিরে এসে আমি আবার দেবদাস হয়ে যাই? ‘
একটু থামল। উপস্থিত সকলের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল,
‘ যদি না চাস চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়াবি। ভয় নেই। লজ্জিত হবারও কারণ নেই। আর না আছে কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত হবার। লাইফে অনেক সিনেমা দেখেছিস৷ মনে কর আজ এ বাড়িতে তোর আমার জীবন্ত একটি সিনেমা হচ্ছে। যা ইতিহাসের পাতায় যুগের পর যুগ লিখিত ভাবে বেঁচে থাকবে। কাম অন সিনু। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৩|
চোখের পলকে ভবিতব্য বদলে গেল৷ মনের বাইরে চলা পরিকল্পনা গুলো হেরে গেল মনের ভিতরে চলা পরিকল্পনার কাছে। যারা মনের বাইরে পরিকল্পনা করেছিল তারা জানে না, ভেতরের পরিকল্পনাকারীর চিন্তাশক্তির প্রখরতা। জানে না তার বিচার বিশ্লেষণ আর পাঁচ জন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। খুবই শান্ত একটি পরিবেশ চোখের পলকে অশান্ত হয়ে ওঠেছিল। সারাজীবন শৃঙ্খলা মেনে চলা ছেলেটি বহু বছরের ভালোবাসা হারিয়ে উশৃংখল হয়ে ওঠেছিল প্রথম। এরপর দীর্ঘ একটি সময় কেটে যায়। নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করে ফেলার আগেই দ্বিতীয়বার এলোমেলো হয়ে যায় মানুষটা। ফলাফল দু’টো পরিবারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সেই পরিস্থিতিও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে সামলে নেয়। একজন চৌকস রাজনীতিবিদ। সৌধর শ্রদ্ধেয় পিতা সুজা চৌধুরী।
গতরাতে সিমরানের শেষ ম্যাসেজটা পড়েই স্তব্ধ হয়ে যায় সৌধ। তার আড়ালে এতকিছু হয়ে গেল। অথচ সুহাস একটিবারও তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না? বন্ধুত্বের জায়গা থেকে তীব্র অভিমান হয়৷ পরোক্ষণেই হিসেব করে মেলায় সুহাসেরও তার প্রতি চাপা অভিমান আছে৷ সেই অভিমান কী নিয়ে? টের পেতেই শিউরে ওঠে৷ মানুষের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই থাকে। যাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নেই। তারা জীবনের ভিন্ন এক স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়৷ সৌধ বঞ্চিত হয়নি৷ সে পেয়েছে জীবনের ভিন্ন স্বাদ৷ সে দেখেছে প্রকৃতির অদলবদল। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তো এই অদলবদল ঘটায়। গভীর রাতে ফাঁকা ঘরটায় দেহজুড়ে হঠাৎই অদ্ভুত রকমের অশান্তি শুরু হয় সৌধর। এতকাল যে চিন্তা, চেতনা বুকের গভীরে লুকায়িত ছিল। ক্রমশ তার উন্মোচন ঘটতে থাকে৷ নিজেকে স্থির রেখে আর বিছানায় বসে থাকতে পারে না৷ সেদিনের দেখা সিমরানের অসহায় মুখশ্রী, অশ্রুতে টলমল দৃষ্টিজোড়া মনে পড়ে আচমকা। কতগুলো মাস ধরে এই আচমকা মনে পড়ার রোগে হয়েছে তার৷ সে প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবক। ভগ্ন হৃদয়ের অধিকারী। যে হৃদয় কেউ নির্মম ভাবে ভেঙে দেয়। সে হৃদয়ে কি আবারো নড়াচড়া করে? সে তো ভেবেছিল এইতো শেষ। ওখানেই জীবনের সমাপ্তি। রঙহীন এক বেরঙিন জীবন৷ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এ কী লীলা? কেঁপে ওঠে সৌধ। নিধিকে যেমন আকস্মিক ভালোবেসেছিল, হারিয়েছিলও আকস্মিক। নিধি তখন সম্পূর্ণরূপে অন্যকারো। জীবনের এ পর্যায়ে এসে সে অনুভব করে সৃষ্টিকর্তা চায়নি তাদের মিলন হোক। তাই তো পুরোপুরি অন্যকারো হয়েই তার দৃষ্টি খুলল। আর সিমরান? যে কিনা নিজের অনুভূতি উজার করে দিয়ে তাকে ভাবাতে বাধ্য করল। হ্যাঁ ভেবেছে সৌধ। সিমরানকে নিয়ে ভেবেছে সে। যে ভাবনাতে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই৷ আছে শুধু অন্যরকম শান্ত, স্নিগ্ধ এক অনুভূতি। দু’টো নারী। দু’জনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেহ আলাদা, দেখতে আলাদা। হৃদয়? সেটিও ভিন্ন৷ সে দেখেছে নিধির হৃদয়ের পাষাণত্ব। দেখেছে সিমরানের হৃদয়ের অসহায়ত্ব৷ আজ জীবনের এমন একটি পর্যায়ে এসে কোনটা তাকে বেশি টানছে? নিখুঁত ভাবনা ভেবে নেয়।
নিধি, সিমরান এদের একজনকে বদ্ধ উন্মাদের মতো প্রেম নিবেদন করেছিল সৌধ। কিন্তু মানুষটি নির্বিকার ছিল। আর একজন যাকে নিয়ে কখনো ভুল ক্রমেও স্বপ্ন দেখেনি৷ সে তাকে শুদ্ধরূপে ভালোবেসে সঙ্গী হয়ে জীবনে আসার আবেদন দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান পেয়ে ফিরেও গেছে।
যে হারায় সেই তো জানে হারানোর বেদনা। যার হৃদয় ভাঙে সেই তো জানে হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা। যার ভাঙে না সে কি জানে? সিমরানের অনুভূতি প্রগাঢ় ভাবে অনুভব করে সৌধ৷ ভালোবাসায় ভুল থাকে না। ভুল থাকে ভুল মানুষকে ভালোবাসাতে। তার জীবনে ভুল মানুষ এসেছিল। ভুলের মাশুল আজো দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কারো জীবনে ভুল হতে চায় না। এক নিষ্পাপ হৃদয়ে ফুল হয়ে ফুটতে চায়৷ মানুষটি যদি হয় সিমরান তবে তো একদমই ভুল হওয়া উচিত নয়। তাই বলে সেদিন সিমরানকে প্রত্যাখ্যান করে কি সে ভুল করেছিল? একদমই নয়। সেদিন সে ভুল করেনি। আজো করবে না। কিন্তু আজ যদি সিমরানের এনগেজমেন্ট না ফেরায়৷ নিজের ভেতর জন্ম নেয়া সুপ্ত অনুভূতিদের স্বীকার না করে তবে ভুল হয়ে যাবে। মস্ত বড়ো ভুল। যে ভুলটা নিধির জীবনে হয়েছে। সে ভুল সে করতে চায় না। কারণ সে নিধি নয়। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাই না? সময় কি চমৎকার ভাবেই মানুষের গতিবিধি বদলে দেয়৷ বদলে দেয় মনের ভেতরে চলা অনুভূতিদেরও সমীকরণ। নিজের ভাবনাচিন্তা গুলোর সমাপ্তি দিয়েই সিমরানকে ফোন করে সৌধ। ফোন বন্ধ পায়৷ যা তার ভেতরের অনুভূতিকে গাঢ় করে। বুকের ভেতরে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বারবার ফোন করেও যখন ফোন খোলা পায় না। তখন কল করে সুহাসকে। ফোন রিসিভ হয় না। নিমেষে ভয় জাপ্টে ধরে। তবে কি দ্বিতীয়বারের মতো সে হেরে যাবে? হার শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছে নিধি। দ্বিতীয় কোনো নারী আর তাকে এ শব্দের সঙ্গে পরিচয় না করাক। ভেবেই টালমাটাল হৃদয়টুকু নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শুধু একটি মোবাইল ফোন আর ওয়ালেট ছাড়া কিছুই সঙ্গে নেয় না৷ তীব্র দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পুরো জার্নির সমাপ্তি ঘটায়। ভরদুপুর তখন। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই তার স্মরণ হয় একবার বাবাকে কল করা উচিত। মুহুর্তেই বাবাকে কল করে। রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বলে,
‘ আপনি কোথায় আব্বা? ‘
ছেলের কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠেন সুজা চৌধুরী। আবার কী হলো ছেলেটার? উদ্বিগ্ন চিত্তে শুধায়,
‘ আমি একটি মিটিংয়ে আছি। লাঞ্চ করছ? ‘
‘ আমি মাত্র টাংগাইলে নামলাম। সুহাসদের বাড়ি যাচ্ছি। আজ সিনুর এনগেজমেন্ট। যে করেই হোক আটকাতে হবে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ও কাউকে বিয়ে করতে পারবে না আব্বা। ‘
হতভম্ব হয়ে যায় সুজা চৌধুরী। নির্লপ্ত কণ্ঠে বলে,
‘ যেইখানে তুমি ওদের প্রত্যাখ্যান করছ। সেইখানে এমন মনোবাসনা নিয়ে যাবা না। ‘
‘ আমি সিনুকে বিয়ে করব আব্বা। আপনি কথা বলুন আংকেলের সাথে। আমি পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। ‘
‘ তুমি ভেবেচিন্তে বলছ সৌধ? তোমার এই সিদ্ধান্ত কতটুকু শক্ত?’
তীব্র আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ সৌধর,
‘ যতটুকু শক্ত থাকলে আমাকে আর কেউ ভাঙতে পারবে না। ‘
.
.
প্রধান দপ্তরে নোটিশ দেয়ায় সৌধর কাজ সহজ হয়ে গেল। যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন শান্ত। প্রকট এক ঝড় বয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতি যেমন শান্ত, শীতলতায় রূপ নেয়। সোহান খন্দকারের বাড়ি এবং উপস্থিত সদস্যরা তেমনি শান্ত আর শীতল হয়ে আছে। সৌধ, অণুজ পাশাপাশি বসে আছে। অণুজের বাবাকে সোহান খন্দকার কি বোঝাবে? এমপি সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘ বিশ মিনিট কথার সমাপ্তি দিয়ে সেই বোঝাচ্ছে সোহান খন্দকারকে,
‘ দেখুন আজকাল এমন হয়েই থাকে। ছেলেমেয়েরা তাদের পছন্দ মুখ ফুটে বলতে পারে না। ভাগ্যিস এমপি সাহেবের ছেলে সাহস করে ছুটে এসেছিল৷ নয়তো কতবড়ো বিপদ ঘটে যেত। আপনার মেয়েকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম। বুক ফাটছে তবু মুখ ফুটে কিছু বলছে না৷ ‘
সৌধ মেকি হাসল উনার কথা শুনে। কারণ ভদ্রলোক মুখে যতই মধু মিশিয়ে কথা বলুক। ভিতরে ভিতরে ঠিকই এমপি সাহেবের চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালি দেয়া শেষ৷ দেয়ারই কথা। বড়োসড় ছ্যাঁকা খেয়েছে কিনা…। সৌধর এসবে যায় আসে না। সে আপাতত নিজেকে নিয়েই ভাবতে চায়। নিজের সুখ, শান্তিকেই প্রাধান্য দিতে চায়। ভাবতে ভাবতেই দোতলা সিমরানের ঘরের দিকে একবার তাকাল। এতকিছুর ভীড়ে সিমরান কখন চলে গেছে খেয়াল করেছে সে৷ কিন্তু যে খুশিটা ওর মুখে দেখার প্রত্যাশা ছিল তা দেখেনি। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। তাকাল সুহাসের দিকে। গম্ভীর মুখে আইয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ দৃঢ় দৃষ্টিতে দুই বন্ধুকে পরোখ করল সে। সুহাসকে উদ্দেশ্য করে বিরবির করে বলল,
‘ মীর জাফর কোথাকার! বাঙালির সম্পদ ইংরেজের হাতে তুলে দিচ্ছিল। ‘
.
.
দুপুরের খাবার খেয়ে অণুজ সহ অণুজের পরিবার বিদায় নিল৷ খুবই আন্তরিকতার সাথে। তারা বিদায় নেয়ার পরই সোহান খন্দকার পুরোপুরি হাঁপ ছাড়লেন৷ একজন বাবার কাছে মেয়ের সুখের চেয়ে বড়ো কোনো প্রাপ্তি থাকতে পারে না৷ তাই তো সৌধর আকস্মিক আগমনে প্রথমে হকচকালেও এখন তার বুকে প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে। কারণ মেয়েটাকে যে আর বুকে পাথর চেপে কিছু মেনে নিতে হবে না৷
অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে। তিন বন্ধুর কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। অতিথি বিদায় নিলে সুহাসই প্রথম মুখ খুলল। তেড়ে এসে সৌধর বুক বরাবর মৃদু ঘু ষি দিয়ে বলল,
‘ মাতলামি করবি না সৌধ। যা করেছিস খুব খারাপ করেছিস। ‘
সুহাসের রাগান্বিত মুখে তাকিয়ে ফিচেল হাসল সৌধ। খুব যত্নসহকারেই এড়িয়ে গেল বন্ধুকে। সম্মুখীন হলো, হবু শশুর মশাইয়ের। দৃঢ় গলায় বলল,
‘ আসছি আংকেল। আব্বার সাথে তো কথা হয়েছেই৷ বাকি কথাও সেরে নেবেন পারিবারিক ভাবে। আমি ভীষণ টায়ার্ড। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে হবে। ‘
সোহান খন্দকার এতদিন এই ছেলেকে দেখে শুধু অবাকই হয়েছে। কিন্তু আজ ঝড়ের মতো উড়ে এসে কী শান্ত ভঙ্গিমায় সমস্তটা সামলে নিয়ে বিদায় নিল। চোখের সামনে এমন অমায়িক ঘটনা এবং ঘটনার কেন্দ্রে থাকা মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ হলো। তার অনুমতি নিয়ে সুহাস, আইয়াজকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল সৌধ। না বন্ধু আর না সিমরান। আপাতত কারো সাথেই কথা বলার প্রয়োজন মনে করল না।
ক্লান্ত দেহে বাড়িতে পৌঁছাল সৌধ। ড্রয়িংরুমে গিজগিজে মানুষ দেখতে পেল। অমনি তার মস্তিষ্ক সজাগ হলো। তার বিয়ের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে আব্বা। প্রথম সে চোখে পড়ল তার আম্মার। তানজিম চৌধুরী ছেলেকে দেখেই খুশিতে গদগদ হয়ে এগিয়ে এলেন। সৌধর ঘর্মাক্ত কপালে চুমু খেতে একটুও দ্বিধা করলেন না। সন্তর্পণে স্নেহময় একটি চুমু খেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। সৌধও মায়ের আলিঙ্গন উপভোগ করে শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘ মাথা ধরেছে আম্মা। জাস্ট ঘরে যাব, শাওয়ার নিব। এরপর লম্বা ঘুম। ‘
ছেলের অবস্থা বুঝতে পারলেন তানজিম চৌধুরী। সৌধ উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে শুধু দাদুনিকে সালাম দিয়ে শুধাল কেমন আছেন? দাদুনি অদ্ভুত সুরে উত্তর দিল। সৌধ সেসবে খেয়াল না দিয়ে নিজের অবস্থা জানিয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই শুনতে পেল দাদুনির বলা কিছু কথা,
‘ সুহাসের বোনকে আমার পছন্দ না জানোই বউ মা। তোমরা যদি ওরেই বউ করবা ঠিক করে থাকো। সৌধ যদি নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। তাহলে ওই মেয়েকে শিখায়, পড়ায় নিয়ো। অতো ফটর ফটর কথা বলা যাবে না৷ চলনবলনেও পরিবর্তন আনতে হবে। ধেই ধেই করে পুরা বাড়ি নাচাও যাবে না। ‘
সিঁড়ির দু ধাপ উঠতেই রেলিং ধরে থেমে গেল সৌধ। ঘাড় বাঁকিয়ে, ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ সুহাসের বোন বোবা না দাদুনি৷ আর তোমার প্রাণপ্রিয় নাতি কোনো বোবা বা খোঁড়া মেয়েকে বউ করে আনছে না। অল্প বয়সী মেয়ে যখন তখন মুখও চলবে, পা দু’টোও দৌড়াবে। তোমার বয়সী হলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। নো প্রবলেম। ‘
আকস্মিক কথায় দাদুনির চোখ কপালে ওঠে গেল! সৌধ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেল নিজের ঘরে।
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা