#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৮|
মিসেস উদয়িনী ইজ নো মোড়! ডক্টর উদয়িনী আর নেই৷ দু’টো সন্তান আজ মাতৃহারা। সোহান খন্দকার বিপত্নীক হলেন৷ দুনিয়াতে নতুন প্রাণের আগমনে চারপাশ ঝলমলে হয়ে ওঠে৷ আপনজনেরা ছড়িয়ে দেয় উল্লাস। আনন্দে উদ্ভাসিত হয় সকলের মুখ।
আর পুরোনো প্রাণ বিদায় নিলে চারপাশ মলিনতায় ছেয়ে যায়। আপনজনেরা হয় শোকাবহে স্তব্ধ। মুখাবয়বে ফুটে ওঠে বিষণ্ণতা। মানুষের জীবন যেন প্রদীপের আলো। যতদিন বাঁচে ততদিন কাছের মানুষদের আলোকিত করে রাখে। যখন মৃত্যু ঘটে জ্বলন্ত প্রদীপটা ধুপ করেই নিভে যায়। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষ।
সকালবেলা ডিউটির জন্য তৈরি হচ্ছিল সৌধ। আচমকা বাড়ি থেকে কল আসে। খবর পায়, সুহাসের মা উদয়িনী আন্টি আর নেই৷ নিমেষে মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়। পা দু’টো হয় অবশ। বুকের ভেতর তীরের ফলার মতো এসে বিঁধে সিমরানের মলিনত্বে ঘেরা শুভ্র মুখশ্রী। ঝাপসা সেই অক্ষিযুগল স্মরণ হতেই শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্থিরতা বাড়ে। ফোন রেখে থমকানো দৃষ্টিতে স্ক্রিনে আঙুল চালায়। সুহাস! সুহাস, নামী জানে? কোথায় ওরা? ভেবেই ত্বরিত সুহাসের ফোনে কল দেয়। ওপাশ থেকে নামী রিসিভ করে। কান্নারত গলায় বলে,
‘ সৌধ ভাই, আমরা রওনা হয়েছি। কখন পৌঁছাব জানি না৷ আপনি এখন কোথায়? ‘
‘ আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি নামী। তুমি জাস্ট সুহাসকে সামলে নিয়ে এসো। আয়াজ! আয়াজ, ফারাহ আছে তো? ‘
‘ হ্যাঁ, ওরা আছে৷ ‘
বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নামী। সৌধ ফোন রেখে নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ল। ওরা পৌঁছাল সন্ধ্যাবেলা। সুহাসদের বাড়িটা নিরিবিলি হলেও আলাদা প্রাণ ছিল৷ আজ যেন জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটা প্রাণশূন্য। যে বাড়িতে এতদিন মানুষের দেখা মেলাই কঠিন ছিল। আজ সে বাড়িতে গিজগিজে মানুষ। সদর দরজা অব্দি পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হলো সুহাস, নামীকে। আইয়াজ ভীড় ঢেলে আগে যাচ্ছিল। সুহাস, নামী এসেছে দেখেই জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দু’দিকে ভাগ হয়ে গেল। সুহাসের পা দু’টো নড়ছে না। শরীর টলছে। নামী শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। এগুচ্ছে একটু একটু করে। সুহাস শোকে স্তব্ধ। তার ধূসর দৃষ্টিজোড়া আজ ভয়াবহ রক্তিম। নিথর দেহে মাকে দেখলেই বোধহয় রক্ত বেরুবে ওই দৃষ্টিদ্বয় বেয়ে। নামীর গলা শুঁকিয়ে কষ্ঠে রূপান্তরিত। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত। মা হারার যন্ত্রণা জানে সে। তাই সুহাস আর সিমরানের মনের অবস্থা টের পেল। বুকের ভেতর ধকধক করছে৷ কীভাবে সামলাবে সুহাসকে? সিমরানকেই বা কী বলে সান্ত্বনা দেবে আজ? সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো ভাষাই যে জানা নেই তার কাছে।
সুহাস সদর দরজায় পা রাখতেই হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটল। তাদের সাজানো, গোছানো বিশাল বড়ো ড্রয়িং রুমের সব আসবাবপত্র একপাশে রাখা। ফ্লোরের মধ্যিখানে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে মাকে। তার পায়ের কাছে হাত, পা ছেড়ে বসে আছে সোহান খন্দকার। তার পাশে সুহাসের দুই মামা। মাথার কাছটায় বিধ্বস্ত রূপে সিমরানকে দেখতে পেল। চোখের জল শুঁকিয়ে আবারো গাল দুটো ভিজে ওঠেছে মেয়েটার৷ সারাদিনে কতবার জ্ঞান হারিয়েছে হিসেব নেই। এলোমেলো ভেজা চুল দেখে বোঝা গেল মাথায় পানি ঢালা হয়েছে বেশ কয়েকবার। চিৎকার করে কান্নাকাটি আর মাকে ডাকাডাকির ফলে গলা ভেঙে গেছে। এখন আর শব্দ করে কাঁদতে পারছে না মেয়েটা। আশপাশে পরিচিত, অপরিচিত অনেক আত্মীয়কে দেখতে পেল সুহাস৷ সিমরানের পাশে একজন সুদর্শনীয় বৃদ্ধা বসে আছেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে বোঝা যাবে, তার চোখ দু’টি কাঁদছে না। কেঁপে কেঁপে ঠোঁটজোড়া নড়ছে শুধু। দোয়া পড়ছে। বুঝল সুহাস। কারণ বৃদ্ধাটি তার নানুমনি। যার চোখ না কাঁদলেও মনটা হুহু করে কাঁদছে। সন্তানের মরা মুখ কোন মায়ের সহ্য হয়? শেষ বয়সে এসে সন্তানের মৃত্যু দেখা একজন বৃদ্ধার জন্য নির্মমই বটে। নিশ্চল দেহে স্তব্ধ চোখে সমস্তই অবলোকন করল সুহাস। এরপর বা’পাশে ঘাড় ঘুরাল। শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্ত্রী নামীর দিকে। নামীর বুক ধক করে ওঠল। সুহাস সন্তর্পণে নামীর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। টলানো শরীরে এগিয়ে গেল মায়ের প্রাণহীন দেহের কাছে। ভাই এসেছে! আচমকা ভাঙা গলায় ভাইয়া ডেকে এক চিৎকার দিল সিমরান। যে চিৎকার সুহাসের হৃদয় নাড়িয়ে দিল। পুরুষ মানুষ। তবু নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দুই ভাইবোনের গগনবিদারী সে চিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠল। কেঁপে ওঠল সোহান খন্দকারের স্বামী সত্তা, পিতৃ সত্ত। পাশ থেকে সুহাসের মামা কান্না করতে করতে বলল,
‘ দুলাভাই ওদের কাছে যান। ছেলেমেয়ে দু’টোকে ভরসা দিন। ‘
নামী ছুটে এসে ততক্ষণে সুহাসকে ধরেছে। সিমরান ভাইয়ের বুকে সমানতালে কিল বসাতে বসাতে বিলাপ করছে,
‘ আম্মুকে ফিরিয়ে দাও ভাইয়া, ফিরিয়ে দাও আমার আম্মুকে। তুমি তো ডাক্তার ফিরিয়ে দাও আমার আম্মুকে প্লিজ। এমন কোনো ইনজেকশন দাও যাতে আম্মু জেগে ওঠে। ‘
‘ মা আর ফিরবে না সিনু। মা আর ফিরবে না। ‘
রেগে গেল সিমরান। চিৎকার করে বলল,
‘ কেমন ডাক্তার তুমি? নিজের মাকে বাঁচাতে পারবে না? ‘
বলেই ফোপাঁতে শুরু করল। সোহান এসে ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরল। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই সুহাস বাবার আলিঙ্গন ছেড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। দু’হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে নাক টেনে বলল,
‘ ও মা, আমি এসেছি৷ তোমার সুহাস। ‘
নামী এসে সুহাসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠল। সুহাস সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। বাবার বুকে মাথা রেখে কতক্ষণ নিশ্চুপ রইল সিমরান৷ সহসা তার দুই মামি এসে বলল,
‘ দুলাভাই আপাকে গোসল করাতে হবে। সময় বেশি নেই। ‘
এশার নামাজের পর জানাজা পড়ানো হবে। কবর হবে, সোহানদের গ্রামের বাড়ির গোরস্তানে। মামির কথা শুনে তড়াক করে বাবার বুক থেকে মাথা তুলল সিমরান। হাঁটু ভর দিয়ে চলে গেল মায়ের মাথার কাছে। মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু কণ্ঠে ডাকল,
‘ আম্মু, আম্মু ও আম্মু। ‘
সুহাসও ডাকল,
‘ মা ও মা, মা। ‘
সোহান খন্দকার ওদের কাছে আসতে নিলে নানুমনি বাঁধা দিলেন। বললেন,
‘ কিছুক্ষণ চোখ ভরে দেখুক ওরা। মন ভরে মাকে ডাকুক। বাঁধা দিও না বাবা। আর তো দেখতে পারবে না। আর তো ডাকতে পারবে না। ‘
বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে ওঠলেন বৃদ্ধা। মায়া দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মৃত মেয়ে আর তার জীবন্ত দুই নাতি নাতনিকে। এরপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ আমাকে ঘরে দিয়ে আয় কেউ। নামাজে বসব আমি। ‘
.
.
সুহাসের বন্ধু, বান্ধব সকলেই উপস্থিত। উপস্থিত সৌধদের বাড়ির সদস্যরাও। সৌধ এখন পর্যন্ত ভেতরে আসেনি৷ সে বাড়ির সামনেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকলেই বন্ধুর করুণ দশা দেখতে হবে। দেখতে হবে বিধ্বস্ত রূপী সিমরানকেও। কেন যেন সাহস পেল না ভেতরে ঢুকবার। অপেক্ষা করতে লাগল শুধু। সুহাসদের গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। গাড়ি সব রেডি। উদয়িনী আন্টির দেহ বিদায় পর্ব শেষেই বেরুবে। উদয়িনীকে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সিমরান, সুহাস নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের মা যেন হাসছে৷ সিমরান অভিমানে ভেঙে পড়ল। থমথমে কণ্ঠে সুহাসকে বলল,
‘ দেখো ভাইয়া, আম্মু হাসছে। ‘
এটুকু বলতেই গলা জড়িয়ে এলো। নিজেকে সামলে নিল মুহুর্তেই সময় বেশি নেই। ভেবেই ভেতরটা কাঁপতে লাগল। নিঃশ্বাস রোধ। মায়ের মুখে নিষ্পলক তাকিয়ে হঠাৎ সিমরান বলল,
‘ আম্মু, অ্যাঁই আম্মু। এত অল্প সময় ছিল তোমার আমার জন্য? ‘
একটু থামল। পরোক্ষণেই হাঁপানো সুরে বলল,
‘ কেমন ঘুম ঘুমালে আম্মু? এত ডাকলাম তবু ওঠলে না? ‘
সুহাস মায়ের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে। সিমরান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘ তোমার ছেলে কেমন ডাক্তার হলো যে মায়ের ঘুম ভাঙাতে পারছে না? লাখ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে ডাক্তার করলে এত তাড়াতাড়ি আমাদের মা হারা করার জন্য? ‘
নামী এসে মাথায় হাত রাখল সিমরানের। সিমরান নামীকে দেখে ছোটো ছোটো করে তাকাল। বলল,
‘ এই যে আরেক ডাক্তারনি। তোমরা আমার আম্মুর ঘুম ভাঙাতে পারছ না কেন? কোনো মেডিসিন কি নেই ঘুম ভাঙানোর? ‘
নামী কেঁদে ফেলল আবার। সিমরানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ চিরনিদ্রা ভাঙানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো ডাক্তারেরই নেই সিনু। ‘
.
.
রাত প্রায় এগারোটা। সুহাসকে নিয়ে বন্ধুরা বাড়ি ফিরে এলো। সোহান খন্দকার আজ আর ফিরবেন না৷ সৌধ, আইয়াজ, প্রাচী সহ অনেক বন্ধুরাই আছে। সুহাসের পাশে রয়েছে তারা। নেই শুধু নিধি। তার গর্ভাবস্থার শেষ ধাপ। নয়তো ঠিকই আসত। জানে সবাই। সৌধদের বাড়ি থেকে খাবার এসেছে। সৌধ আইয়াজ মিলে নামীকে দিয়ে সুহাসের রুমে খাবার আনালো। নামী খাইয়ে দিতে চাইল৷ সুহাস খেলো না৷ সৌধ জোর করল৷ বোঝাল তাকে এখন শক্ত থাকতে হবে। বাবা, বোন সবাইকে সামলাতে হবে। বোনের প্রসঙ্গ আসামাত্র সম্বিৎ ফিরল সুহাসের। থমকানো গলায় বলল,
‘ সিনু! সিনু কোথায়? সারাদিন কিছু খায়নি ও। আমার বোনটাও মরে যাবে। ‘
নামী কম্পিত কণ্ঠে বলল,
‘ তানজিম আন্টি আছে সিনুর কাছে। নানুমনিও আছে। আন্টি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে ওকে৷ তুমি প্লিজ খেয়ে নাও। ‘
শান্ত হলো সুহাস। ভাতের থালা ঠেলে দূরে সরিয়ে বলল,
‘ একদিন না খেলে কিছু হবে না। জাস্ট এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাব। ‘
তৎক্ষনাৎ নিচে গিয়ে ঠান্ডা পানি আনল নামী। অনেক জোরাজোরি করেও খাওয়াতে পারল না সুহাসকে৷ যত সময় বাড়ল ছেলেটা ততই ভেঙে পড়ল। মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বেরুলো,
‘ ওই অন্ধকারে কীভাবে মাকে মাটিচাপা দিয়ে এলাম আমি! ‘
সুহাসের অবস্থা দেখে দুঃশ্চিতায় পড়ে গেল সৌধ। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। মানসিক অবস্থাও বিধ্বস্ত। একটু ঘুমাতে পারলে কাজ হতো৷ কিন্তু আজ কি ঘুম আসবে ওর? অনেক ভেবে নামীকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। এরপর দু’জন পরামর্শ করে ঘুমের ইনজেকশন আনিয়ে সুহাসকে বুঝতে না দিয়ে কৌশলে পুশ করে দিল। সুহাস টের পেল যখন তখন সৌধর হাত চেপে ধরল। সৌধ স্মিত হেসে বলল,
‘ তোর ঘুম প্রয়োজন। ‘
এরপর সুহাসের দায়িত্ব নামীকে দিয়ে বন্ধুরা ওদের বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তখন নিচে যেতেই প্রাচী বলল,
‘ সুহাসের মামিরা খেতে ডাকছে চল খেয়ে নিই। ‘
এমন সময় পাঁচ বছরের তাহানী নিচে নেমে এলো। গুটিগুটি পায়ে সৌধর কাছে এসে বলল,
‘ সিনুপু খাচ্ছেই না। বড়ো মা আমাকে জোর করে খাওয়াতে পারে। সিনুপুকে পারেই না। ছোটো ভাইয়া? আমার আম্মুও তো আল্লাহ তায়ালার কাছে চলে গেছে। আমিত অভিমান করে না খেয়ে থাকি না৷ সিনুপুকে কতবার বললাম। কেয়ারই করল না। আজ তাহানী বেবিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ‘
হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে ওঠল তাহানী৷ সৌধ ভ্রু কুঁচকে মনোযোগ দিয়ে শুনল কথা গুলো। এরপর আচমকা প্রাচীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোরা খেয়ে নে। আমি সিনুর কাছে যাচ্ছি। ‘
কথাটা বলেই দেরি করল না সৌধ। তাহানীকে কোলে তুলে উপরে চলে গেল। উদয়িনী আন্টির রুমে।কারণ সিমরান ওখানেই আছে। নানুমনিকে মাত্রই সুহাসের বড়ো মামি এসে নিয়ে গেল। ঘরে এখন তানজিম চৌধুরী আর সিমরান। সুজা এমপির পত্নী সিমরানের কাছে রয়েছে। এতেই সকলে বেশ নিশ্চিন্ত। আর কাউকে প্রয়োজন নেই সিমরানের জন্য৷ সকলে এটা ভাবলেও সৌধর মন বলল সিমরানের পাশে তাকে ভীষণ প্রয়োজন। সৌধ ঘরে এলো। দেখল, ভাতের থালা হাতে মন খারাপ করে বসে আছে তার আম্মা। আর সিমরান বিষণ্ন মুখে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে। তাহানীকে কোল থেকে সযত্নে নামাল সৌধ। মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ আম্মা, খাচ্ছে না সিনু? ‘
‘ না বাবা। এত বুঝাচ্ছি। কেমন থম ধরে আছে। এভাবে তো সমস্যা হবে। সুহাস খেয়েছে? ‘
‘ না। এক গ্লাস পানি খেয়েছে শুধু। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে এলাম। ‘
হতাশা ভরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন তানজিম। সৌধ এগিয়ে এলো। আচমকা বলল,
‘ যদি কিছু মনে না করেন আমি সিনুর সঙ্গে একা কথা বলতে চাই। ‘
সহসা ছেলের কথায় চমকে ওঠল তানজিম। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। এরপর ধাতস্থ হয়ে নেমে দাঁড়াল। সৌধ মায়ের হাত থেকে ভাতের থালা নিজ হাতে নিয়ে বলল,
‘ আমি চেষ্টা করি? ‘
শোকের মাঝেও এক টুকরো সুখ ফুটে ওঠল তানজিম চৌধুরীর চোখে। ত্বরিত ছেলেকে অনুমতি দিয়ে তাহানীকে নিয়ে চলে গেল সে। দরজা খোলাই রাখল। আম্মা বেরিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিমরানের পাশে বসল সৌধ৷ খেয়াল করল সিনুর মনে কোনো ভাবান্তর নেই। একই ভাবে বসে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হাত পরিষ্কারই ছিল। তাই ডাল আর আলুভাজি দিয়ে ভাত মেখে সিমরানের মুখের সামনে ধরল। শীতল গলায় বলল,
‘ না খেয়ে থাকলে আন্টি ফিরে আসবে না সিনু৷ হা কর। আন্টি চলে গেছে। তার জায়গা কেউ পূরণ করতে পারবে না জানি। কিন্তু আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আমি তোর পাশে আছি সিনু। ‘
শেষ বাক্যে কী যেন মিশে ছিল। যা সহসা বুকে কম্পম সৃষ্টি করল সিমরানের। অদৃশ্য একটি ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে বিস্মিত চোখে সৌধর পানে তাকাল সে৷ দৃঢ় চোয়াল বিশিষ্ট সুগভীর চোখ দু’টোয় মলিনত্বের ছাপ স্পষ্ট। তবু অদ্ভুত এক শীতলতা খুঁজে পেল। যা প্রগাঢ় হলো তার মুখের সামনে ধরে রাখা পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতটি দেখে৷ নিমেষে ভেতর থেকে কান্না উপচে এলো সিমরানের। কিন্তু কাঁদল না সে। হতভম্ব মুখে একবার সৌধর হাত আরেকবার চোখে তাকাতে লাগল শুধু৷ সৌধ একই সুরে পুনরায় বলল,
‘ ছোটো থেকেই নিজহাতে খেতে ভালোবাসি৷ কারো হাতে খাই না৷ কাউকে খাইয়েও দিই না। আজ তোকে দিচ্ছি, নে হা কর। ‘
ভাগ্যের কী লীলা! ভারিক্কি ব্যক্তিত্বের সৌধ চৌধুরী। নিধিতে ভয়ংকর মাত্রায় আসক্ত ছিল মানুষটা। কী নির্মমভাবেই না প্রত্যাখ্যান করেছে সেদিন সিমরানকে৷ আজ সেই সৌধ কিনা সিমরানের দুর্দিনে এভাবে পাশে থাকছে৷ অবিশ্বাস্য দৃশ্যে সিমরানের চিত্ত বিচলিত হলো কিঞ্চিৎ। মনের অস্থিরতা মুখে প্রকাশ করল না। সৌধ তৃতীয়বারের মতো তাকে খাবার মুখে নিতে বলল,
‘ সিনু হা কর। ‘
সৌধের কণ্ঠে দৃঢ়তা স্পষ্ট। সিমরান লম্বা একটি শ্বাস টানল। পলকহীন দৃষ্টিতে পলক ফেলল বারকয়েক। এরপর নির্লিপ্ত ভাবে সৌধর হাতটা দূরে ঠেলে দিল। ভাতের থালা নিজহাতে কোলের ওপর তুলে নিয়ে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দু’টি দিয়ে ফের তাকাল সৌধর পানে। কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা৷ তবু বলল,
‘ আমি কি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছি সৌধ ভাই?’
আকস্মিক কথায় সৌধর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। কেন জানি স্বাভাবিক লাগছে না সিমরানকে। সে কিছু বলতে উদ্যত হবে তক্ষুনি আবারো সিমরান বলল,
‘ আমি তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম সত্যি। কিন্তু দয়া চাইনি একটুও। আমি জানি এমন সময় সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন। কিন্তু তোমার থেকে এটা নিতে আমার কষ্ট বাড়বে।
‘ সিনু! ‘
সৌধর কণ্ঠে বিস্ময়। সিমরান থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমি নিজ হাতেই খাব। তুমি আমার কথা ভেবে এটুকু সহায়তা করতে এসেছ। এজন্য থ্যাংকিউ। ‘
গলায় কান্না আঁটকে কথাটা বলেই নিজহাতে ভাত তুলে মুখে দিল। না চিবিয়ে গিলে ফেলল নিমেষে। বলল,
‘ আমি বিজনেসম্যান সোহান খন্দকারের মেয়ে। ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে আমি। ডক্টর সুহাসের বোন আমি। আর ডক্টর নামীর ননদ। আমার জন্য এদের ভালোবাসা আর সাপোর্টই যথেষ্ট। তোমার ভালোবাসা পাইনি৷ দায়টুকুরও প্রয়োজন নেই। এই দেখো একাই খেতে পারি। যাদের মা নেই তাদের তো একা একাই খেতে হয়। ‘
বলেই আবারো একনাগাড়ে ভাত তুলে মুখে দিতে লাগল। না ঠিকভাবে ডাল, আলুভাজির সঙ্গে মাখালো আর না চিবালো। সৌধ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
‘ সিনু আস্তে, আস্তে গলায় আঁটকে যাবে। ‘
শুনল না সিমরান। ওর অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সৌধ। আজকের মতো একটি দিনে হয়তো ধমক দেয়া ঠিক হবে না। তবু কঠিন চোখে তাকাল।
ওর ভালোর জন্যই দৃঢ় কিন্তু নিচু গলায় ধমকও দিয়ে ফেলল। যে ধমকে কেঁপে ওঠল সিমরান। এতক্ষণ যা গিলেছিল সব বেরিয়ে এলো সহসা। সে মুখে হাত চেপে ধরলেও লাভ হলো না। হাতের দু’পাশ দিয়ে সব বেরিয়ে বিছানা নষ্ট হলো। চোখের সামনে এমন অবস্থা দেখে সৌধ উঁচু গলায় তার আম্মাকে ডাকতে লাগল। পাশাপাশি পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলো সিমরানের কাছে। মুখের কাছে গ্লাস ধরে কঠিন গলায় রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
‘ পানি খা। ‘
পানি খেল সিমরান। সৌধর শরীরটা রাগে তখনো কাঁপছে। সিমরান শান্ত হয়ে এলে রাগটুকু আর প্রকাশ করল না। শুধু বলল,
‘ মেয়েদের জেদ থাকা ভালো, তেজও ঠিক আছে। কিন্তু ভুল স্থানে, ভুল মানুষে, ভুল বুঝে জেদ, তেজ কোনোটাই ভালো না। ‘
এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেল। চোখ বুজে একটুক্ষণ কী যেন ভেবে চোখ মেলল আবার। সাদা পোশাকে, বিষণ্ন মুখশ্রীর সিমরানের দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে, ডক্টর সুহাসের বোন তাই তো? ‘
কথা আঁটকে এলো তবু সিমরান জবাব দিল,
‘ বিশ্বাস হয় না? ‘
তীক্ষ্ণ রাগ ঝড়ে পড়ল যেন। সৌধ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,
‘ ডক্টর নামীর ননদ?’
দু-চোখে এবার অশ্রু ঝড়ে পড়ল সিমরানের। সৌধ দৃষ্টি সরিয়ে নিল মুহুর্তেই বলল,
‘ নিজেকে একা সামলে প্রমাণ করে দে তোর কাউকে প্রয়োজন নেই। পারবি? ‘
চোখের পানির মাত্রা বাড়ল। নিঃশ্বাসে বাড়ল অস্থিরতা। তবু চোখ বুজে ঠোঁট কামড়ে কান্নারত গলায় দৃঢ় শব্দে সিমরান বলল,
‘ পারব। ‘
সহসা একপেশে হাসল সৌধ। অতি সন্তর্পণে ওঠে দু’হাত পকেটে গুঁজে দিয়ে কয়েক কদম হেঁটে গেল দরজার দিকে। নিমেষে ঘাড় বাঁকিয়ে ফিরে তাকাল একবার। নিচু কণ্ঠে সিমরান শুনতে পাবে এমন করে বলল,
‘ বেস্ট উইশেষ। ‘
তানজিম চৌধুরী এলেন সেই মুহুর্তে। বললেন,
‘ খেয়েছে? ‘
সৌধ রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে মৃদু স্বরে আম্মাকে বলে গেল,
‘ খাবে। খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি থাকুন ওর কাছে। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৯|
লোকমুখে একটি কথা প্রায়শই শুনত সুহাস৷ আজ মরলে কাল দু’দিন। নিঃসন্দেহে কথিত সেই বাক্যটি চিরন্তন সত্য। উদয়িনী নেই আজ একমাস দশদিন। এত গুলো দিন চলে গেল। মা নেই। বাড়ি ফিরে বোনের রুগ্ন দেহ আর শুষ্ক মুখ দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল সুহাসের। দু’দিনের ছুটি। তাই ছুটে চলে এসেছে মায়ের স্বপ্নের বাড়িতে। আফসোস মা নেই। দীর্ঘশ্বাস মা আর কোনোদিন আসবে না৷ গম্ভীর রূপে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এ বাড়িময় আর বিচরণ করবে না। সে এসেছে বাবা আর বোনের কাছে। বোনটা যে তার চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে। সুহাস আসার আধাঘন্টা পরেই নামীর উপস্থিতি ঘটল। ড্রয়িং রুমে ঢুকে সুহাসকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল নামী।
মা মারা যাওয়ার পর থেকে বেশ পরিবর্তন এসেছে সুহাসের মাঝে। এই পরিবর্তনে দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা হচ্ছে নামীর সঙ্গে তার দূরত্ব। যত সময় গড়াচ্ছে দূরত্ব বাড়ছে বৈ কমছে না৷ নামী ঠিকই তার খেয়াল রাখার চেষ্টা কারে৷ কাজের সূত্রে দূরে থাকলেও নিয়ম করে খোঁজ নেয়৷ ফোন করে রোজই৷ কিন্তু সুহাস ফোন ধরতে চায় না। বার বার ফোন করার পর এক প্রকার বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে। কথা বলে প্রচণ্ড উদাসীনতা নিয়ে। যা টের পায় নামী। খারাপ লাগে ওর। কষ্টও হয়। তবু ধৈর্য্য ধরে থাকে। সদ্য মা হারিয়েছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই আশায় অপেক্ষা করে। পুরোনো সুহাসকে ফিরে পাবার৷ এই যে আজ সে বাড়িতে আসবে। গতকাল বলেছিল সুহাসকে। জিজ্ঞেস করেছিল, সুহাস আসবে কিনা। উত্তর দেয়নি সুহাস। নিরুত্তর ছিল। সুহাস আসবে না। নামীর আসারও বাধ্যবাধকতা নেই। তবু এসেছে। শশুর আর ননদের সঙ্গে সময় কাটাতে। ফাঁকা বাড়িতে সিমরান সারাদিন একাই থাকে। ভাবি হিসেবে তার কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য আছে। তাই এসেছে। তাছাড়া এই সংসারের ভাড় এখন তার ওপরই। যতই চাকরি করুক, ব্যস্ত থাকুক৷ দিনশেষে সংসার নামক জীবনটাকেও আগলে রাখতে হবে। নামীকে দেখে সিমরান অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশি হলো। সুহাস দেখেও না দেখার ভাণ ধরে বসে রইল৷ নামী এগিয়ে এসে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ গতকাল জিজ্ঞেস করেছিলাম আসবে কিনা। কেন বলোনি? ‘
বোনের সঙ্গে বসে ফোনে কী যেন দেখছিল সুহাস। সেলিনা আপা দু কাপ কফি দিয়ে গেল। নামীকে দেখে খুশি হলো সেলিনা আপাও। বলল,
‘ ভাবি আসছেন! কেমন আছেন? ‘
‘ ভালো। তুমি ভালো আছো? এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো। ‘
বলতে বলতে সুহাসের পাশে গিয়ে বসল নামী। চুল গুলো ঠিক করতে করতে সিমরানের দিকে তাকাল। সিমরান মৃদু হেসে বলল,
‘ কেমন আছো ভাবিপু? ‘
সিমরানের মুখ পানে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল নামী।
মেয়েটা এখন তাকে নামীপু না বলে ভাবিপু ডাকে।
***
ছুটি শেষ। তাই উদয়িনী মারা যাওয়ার সাতদিনের মাথায় সুহাস, নামী দু’জনকেই চলে যেতে হলো। যাওয়ার সময় নামীকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে সিমরান। বলে,
‘ আমার আম্মু খারাপ মানুষ নয় নামীপু৷ জানো আম্মু চেয়েছিল পুরোনো সব তিক্ততা ভুলে তোমাকে আপন করে নিতে। অনেক ধুমধাম করে এ বাড়িতে তোমাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। আমি আর আম্মু মিলে কত প্ল্যান করেছিলাম। ভেবেছিলাম যেদিন এ বাড়িতে আবার আসবে সেদিন থেকে তোমাকে ভাবিপু বলে ডাকব। তুমি তো আমার ভাইয়ের বউ। আমরা সবাই তোমাকে মেনে নিয়েছি। সবাই ভালোবাসি তোমাকে। ‘
***
সিমরানের প্রশ্নে নামী উত্তর দিল,
‘ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? মুখটা শুঁকিয়ে গেছে। ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করো না নিশ্চিত? বাবা কোথায়? ‘
সিমরান হাসল কিঞ্চিৎ। অনেকদিন পর ভাই, ভাবিকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে তার। সিমরানের সাথে কথা বলার ফাঁকে সুহাসের দিকে তাকাল নামী। মৃদুস্বরে বলল,
‘ কিছু বলেছি তোমায়। ‘
সুহাসের মাঝে ভাবান্তর হলো না। সিমরান সুহাসের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ কী ব্যাপার ব্রো? ভাবিপুর সাথে অভিমান করেছ নাকি? ‘
উত্তর দিল না সুহাস। নামীর মেজাজ খারাপ হলো। রাগান্বিত হয়ে সুহাসের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘ সুহাস কিছু বলেছি তোমায়। ‘
নিমেষে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। সিমরান, নামী দু’জনই চমকে ওঠল ওই দৃষ্টি দেখে। ভয়াবহ ক্রোধে জর্জরিত সুহাস৷ সে আর এক মুহুর্ত ওখানে বসল না। ফোনটা নিয়ে তড়াক করে ওঠে উপরে চলে গেল৷ নামী হতভম্ব হয়ে ঠাঁই বসে। সিমরান ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বলল,
‘ কী হয়েছে ভাইয়ার? ‘
নামীর চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অজান্তেই বেরুলো। নিমেষে তা আবার তর্জনী দিয়ে মুছে মৃদু হেসে বলল,
‘ মা চলে যাওয়ার পর থেকে একটা দিনও আমরা এক বিছানায় ঘুমাইনি সিনু। আর না একসঙ্গে বসে ভালো মন্দ দু’টো কথা বলেছি। আমি চেষ্টা করেছি কাছে যাওয়ার কথা বলার। ও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফোন দিলে ফোন রিসিভ করে না। বার বার দেয়ার পর যদিও বা একবার রিসিভ করে যা বলি তার উত্তর দিয়েই কেটে দেয়। আমার ওখানে যেতে বললে যায় না৷ আজ বাড়ি আসবে কিনা কতবার জিজ্ঞেস করলাম বলল না। অথচ এসেই ওকে দেখলাম। জানালে কী হতো? একসঙ্গে আসতে পারতাম না বলো? ‘
উদয়িনী বেঁচে থাকাকালীন নামী কখনো তাকে মা বলেনি। এই প্রথম আজই বলল। সিমরাম খুশি হলো এতে। কিন্তু সুহাসের ব্যাপারে বলা কথা গুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার ভাই এমন করছে! এত রাগ কেন ভাবিপুর প্রতি? কীসের এত্ত অভিমান? গা শিউরে ওঠল আচমকা। জিজ্ঞেস করল,
‘ কারণ? ‘
নামী বলল,
‘ প্রথমে ভেবেছিলাম সদ্য মা হারিয়েছে তাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সুহাস আমাকে ভুল বুঝছে। ‘
‘ কেন? ‘
‘ মা চেয়েছিলেন ধুমধাম করে আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে। আমি সময় নিচ্ছিলাম। এত বেশি নিলাম যে উনি আর পৃথিবীতেই রইলেন না। ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। নিঃশ্বাস আঁটকে এলো সিমরানের। সত্যি বলতে এ বিষয়টা নিয়ে তারও আফসোস আছে। মায়ের শেষ ইচ্ছে এটাই ছিল। যা পূরণ হয়নি। ভাবিপু সময় নিয়েছে এটা কি দোষ হতে পারে? সে তো জানত না মা এক্ষুনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে৷ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে সিমরান বলল,
‘ তুমি মন খারাপ করো না ভাবিপু৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। না হলে আমি, আব্বু মিলে বুঝাব ভাইকে। ‘
স্মিত হাসল নামী৷ সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। রাতে কী খাবে বলো। ‘
সিমরান মৃদু হেসে কী খাবে জানালো। নামীও ত্বরিত পা বাড়াল উপরে। গোসল করে বাইরের পোশাক বদলে তারপর নিচে আসবে৷ নিজহাতে রান্না করবে শশুর, স্বামী আর ননদের জন্য।
.
.
অনেকদিন পর বাড়িটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। একসঙ্গে খেতে বসে এটাই ভাবল সোহান খন্দকার। ছেলে, ছেলে বউ আসাতে ভীষণ খুশি সে। নামী আজ একা হাতে তাদের জন্য রান্না করেছে। সব সুহাস, সিমরানের পছন্দের খাবার৷ এসব খাবার পছন্দ সোহান খন্দকারেরও। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক গল্প করছিল সোহান। গল্পের ফাঁকে খেয়াল করল, সুহাস খাচ্ছে না৷ আঙুল দ্বারা নাড়াচাড়া করছে শুধু৷ তাই শুধাল,
‘ সুহাস খাচ্ছিস না কেন? খাবার ভালো হয়নি? ‘
নামীও খেয়াল করেছিল। সুহাস খাচ্ছে না৷ কিছু বলার সাহস করে ওঠতে পারছিল না। বাবা বলায় ভরসা পেল। কিছু না ভেবেই বলে ফেলল,
‘ আমার ওপর রাগ থাকতেই পারে। খাবারের ওপর তো নেই। ভণিতা না করে খেয়ে নাও সুহাস। ‘
নামী কথাটা বলেছে মাত্র। অমনি ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ওঠে দাঁড়িয়েছে সুহাস। তার কাণ্ড দেখে কয়েক পল হতবাক ছিল সোহান খন্দকার। সুহাস যখন খাবার ঠেলে চলে যেতে উদ্যত হলো তখন চমকাল সে৷ আকস্মিক সুহাসের হাত টেনে ধরে মৃদু ধমক দিল,
‘ এটা কী ধরনের আচরণ সুহাস! বসো, বসো বলছি। খাবার ফেলে এভাবে যাবে না৷ ‘
বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারল না সুহাস। নামীর দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একবার। এরপর চুপচাপ বসে খেতে শুরু করল৷ বাবা, মা যে জীবনের কতবড়ো সম্পদ। মা চলে যাবার পর থেকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মায়ের অভাব বাবা পূরণ করতে পারে না। কিন্তু সোহান খন্দকার নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে ছেলেমেয়েদের আগলে রাখতে। যতই সুহাস প্রতিষ্ঠিত হোক। বিবাহিত হোক। দিনশেষে তারও মাথার ওপর ছায়ার প্রয়োজন পড়ে। যা সোহান খন্দকার দিচ্ছে পরিপূর্ণ ভাবে। তাই তো এখন বাবার প্রতি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে ছেলেমেয়ে দু’টো। খাওয়া শেষে সুহাস চলে গেলে সোহান খন্দকার নামীকে জিজ্ঞেস করল,
‘ সুহাস তোমার ওপর রেগে আছে মা? ‘
নামী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। গ্লাসে পানি ভরতে ভরতে বলল,
‘ তেমন কিছু না বাবা৷ জানেনই তো আপনার ছেলে কেমন রগচটা। অল্পতেই রেগে যায়। ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না। ‘
সোহান খন্দকারের পৃথিবী বলতেই সুহাস, নামী আর সিমরান৷ তিনজনকে নিয়ে ভাবে মানুষটা। চিন্তা করে খুব৷ নামী বুঝে সবটা। তাই তাকে চিন্তায় ফেলতে চায় না বলে সবটা চেপে গেল। মিথ্যে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলল নিজের যন্ত্রণা গুলো।
.
.
সিমরানের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে নিজেদের ঘরে ফিরল নামী। তার আর সুহাসের ঘর। সুহাস অবশ্য এখন ঘরে নেই৷ বাইরে গেছে হয়তো। ভেবেই লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদু পায়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সময় নিয়ে চুল গুলো আঁচড়ে বিনুনি গাঁথল। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিয়ৎক্ষণ। হৃদয় পুলকিত হলো৷ আগের চেয়ে মুখে গ্ল্যামার বেড়েছে তার। শুধুই কি মুখে? দু পা পিছিয়ে গিয়ে আপাদমস্তক দেখল নিজেকে। শারীরিক গঠন আগের চেয়েও আকর্ষণীয় লাগছে। বডিশেপটাও মারাত্মক আকর্ষণীয়। আপনমনে নিজেকে নিয়ে এসব ভেবেই তীব্র লজ্জায় আরক্ত হলো মুখশ্রী। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরণ জেগে ওঠল হঠাৎ। পুলকিত চিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে তাকাল একবার। সুহাস কখন আসবে? সুহাসের অপেক্ষায় বিছানায় গিয়ে বসে রইল। সহসা কেঁপে ওঠল হোয়াটসঅ্যাপের ম্যাসেজ টোনে৷ ত্বরিত ফোনটা হাতে নিতেই দেখল, ফারাহ ম্যাসেজ করেছে।
‘ কেমন আছিস দোস্ত? জানিস গতকাল নিধি আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল আয়াজ। আপুর ছেলেটা দেখতে মাশাআল্লাহ। কী কিউটরে! দাঁড়া তোকে ছবি পাঠাচ্ছি। ‘
হেসে ফেলল নামী। নিধি আপুর ছেলে! উদিয়িনীর মৃত্যুর ছয়দিন পর নিধির ডেলিভারি হয়। ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় সে। সে সময় তাদের মানসিক অবস্থা এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে তারা কেউ দেখতে যেতে পারেনি৷ স্বাগতম জানাতে পারেনি বাচ্চাটাকে।
পরে অবশ্য সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী আপু গিয়েছিল। কিন্তু সে যেতে পারেনি। তাই তরান্বিত হয়ে রিপ্লাই করল,
‘ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ‘
ফারাহ উত্তর দিয়ে গোটা দশেক ছবি পাঠাল। নামী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল প্রতিটা ছবি। চোখ দু’টো তার প্রশান্তিতে ভরে ওঠল যেন৷ ত্বরিত লিখল,
‘ হাউ কিউট! মাশাআল্লাহ। নিধি আপুর মতোই হয়েছে রে। নাম কী বাবুর?’
‘ অনিরূপ শিকদার। অর্পণ স্যারের অ আর নিধি আপুর নি নিয়ে ছোট্ট করে সবাই নাকি অনি ডাকে। জানিস, বাবুটাকে দেখে এসে আয়াজ সারারাত ঘুমাতে পারেনি। এত্ত বাবু পাগল ছেলেটা। ভুলতেই পারছিল না অনিকে। তাছাড়া নিজের বান্ধবীর মেয়ে তো। ওদের বন্ধু মহলের ফার্স্ট বেবি। টানটা একটু বেশিই৷ আর জানিস কী করেছে? সে আবদার করেছে। তারও অনির মতো কাউকে চাই। বাবা হতে চায় সে। ‘
ম্যাসেজটা দিয়েই লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিল ফারাহ। নামী শিউরে ওঠল সহসা৷ ফারাহকে বলল,
‘ আয়াজ ভাইয়ের আবদার পূরণ কর ফারাহ। মা হওয়ার বয়স হয়েছেই আমাদের। এবার মা ডাক শোনা উচিত। ‘
ফারাহকে ম্যাসেজটা দিয়েই মন খারাপ হয়ে গেল নামীর। তার বয়স কত হলো? ছাব্বিশ চলছে। এবার তো একটা বেবি নিতে পারে৷ মুহুর্তেই চমকে ওঠল সে। গত মাসে পিরিয়ড মিস গেছে তার। এ কথা বেমালুম ভুলে গেছিল। আচমকা মনে পড়ায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করল অনবরত। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আকস্মিক শাশুড়ির মৃত্যু, কর্ম জীবনে ব্যস্ততা, সুহাসের দূরত্ব সব মিলিয়ে সে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে হেলাফেলা করেছে!
সুহাস কোথায়? চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল নামীর। তর আর সইল না যেন। মন বলল এক্ষুণি টেস্ট করতে। কিন্তু কিন্তু…কীভাবে? সুহাসকে ফোন দিয়ে বলবে, প্র্যাগ্নেসি কীট নিয়ে আসতে? না থাক। আগে নিজে একা একা পরীক্ষা করবে। রেজাল্ট পজেটিভ হলে তারপর জানাবে সুহাসকে। একদম চমকে দেবে। স্ত্রীর থেকে পাওয়া একজন পুরুষের জীবনের বেস্ট গিফট তো এটাই৷
নামী যখন এসব ভাবনায় মশগুল। তখন ঘরে ফিরল সুহাস। নামীকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলল। নামী সুহাস এসেছে দেখেই বিগলিত চিত্তে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। সুহাস তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেলকনিতে চলে গেল। কিয়ৎক্ষণ পর নামীর নাকে এলো সিগারেটের গন্ধ। সুহাস সিগারেট খাচ্ছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো! ক্রোধে জর্জরিত হলো মন। এতটা অধঃপতন! মেনে নিতে পারল না৷ সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না নামী। তাই আচমকা কড়া গন্ধে নাক চেপে ধরে কেশে ওঠল।কাশতে কাশতে এক পর্যায় পেটে মোচড় খেয়ে গা গুলিয়ে ওঠল তার। ছুটে চলে গেল বাথরুমে। বেলকনিতে দাঁড়িয়েই সুহাস শুনতে পেল, নামীর কাশির শব্দ। গলগল করে বমি করছে এটাও টের পেল৷ নিমেষে বিরক্ত হয়ে সিগারেট ফেলে দিল বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একদম নিচে। এদিকে বমি করে মাথা ধরে গেল নামীর। চোখ, মুখে পানি দিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসতে বসতে হাঁপিয়ে ওঠা স্বরে ডাকল সুহাসকে,
‘ সুহাস, এই সুহাস এদিকে এসো না…। ‘
সুহাস শুনল তবু এগিয়ে এলো না। এবার কান্না করে দিল নামী। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ফের ডাকলে বিরক্ত মুখে সুহাস এলো। তাকে দেখে শান্ত হলো নামী। বলল,
‘ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে সুহাস। ‘
সুহাস ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বমি হলো তাই৷ শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। ‘
‘ তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে বলে! ‘
আর জবাব দিল না সুহাস৷ চুপচাপ বাতি নিভিয়ে বিছানার অপর পাশে শুয়ে পড়ল। নামীর এত্ত খারাপ লাগল যে আর একটিও কথাও বলতে পারল না। সেও নিশ্চুপ শুয়ে রইল এক কোণে৷ অন্ধকার ঘরে নিশ্চুপ তারা দু’জন। দু’জনার মাঝে দূরত্ব একহাত সমান৷ হঠাৎ নামীর কেমন ভয় ভয় লাগল। এর আগে কখনো এত ভয় করেনি৷ আজ ভয় পাচ্ছে কেন? অজান্তেই নিজের একটা হাত পেটে রাখল। বুলাতে বুলাতে বলল, কোনো ভয় নেই। এরপর জড়োসড়ো হয়ে সুহাসের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে রইল।
সুহাস অনুভব করল নামীর স্পর্শ। কিন্তু ফিরে তাকাল না। ঠিক যেন রোবট সে। এভাবে শুয়ে রইল। বুকের ভেতর চলল তীব্র অশান্তি। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা এভাবে তিনঘন্টা অতিক্রম হলো। নামীর শরীর দুর্বল ছিল। তাই সে ঘুমিয়ে গেছে৷ কিন্তু সুহাসের ঘুম হলো না। সে ফোন হাতে নিয়ে সৌধকে ফোন করল। সৌধ ফোন ধরল না। আর কাকে ফোন করবে? এ সময় কে জেগে আছে তাকে সঙ্গ দিতে? রাত গভীর। পাশে স্ত্রী। তবু তীব্র একাকীত্বে ভুগতে লাগল সুহাস। যে একাকীত্বের সুযোগ পেয়ে শয়তান তার মস্তিষ্ক বিগড়ে দিল। পুরোনো নাম্বার ঘেঁটে ঘেঁটে সে ফোন করল তার পুরোনো গার্লফ্রেন্ডদের মধ্যে ইসমা নামের একটি মেয়েকে। আশ্চর্য হলো দুবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হওয়ায়। এরপর কথা বলতে বলতে আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন যখন ইসমার সাথে কথা বলে নিজের মাঝে ভালো লাগা অনুভব করতে শুরু করল। এতক্ষণ যে অশান্তিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, সে অশান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে গেছে বুঝতে পেরেই ইসমার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করল। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা এভাবে ভোর পর্যন্ত কথা বলল ওরা।
ফজরের আজান দিতেই নামীর ঘুম ছুটে গেল। সে শুনতে পেল মৃদু স্বরে সুহাস কথা বলছে কারো সাথে। কী বিনয়ের সুর৷ সে সুর শুনতে শুনতে আকস্মিক মস্তিষ্ক সচল হলো তার। তড়াক করে ওঠে বসেই শুধাল,
‘ কার সঙ্গে কথা বলছ সুহাস! ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫০|
এক সময়ের প্লেবয় খ্যাত সুহাস এখন বিবাহিত। এ সম্পর্কে সবাই অবগত। রোমিও সুহাস এখন আর আগের মতো নেই৷ বিয়ের পর বদল ঘটেছে বিস্তর।
আকস্মিক বদলে যাওয়া এই ছেলেটি যখন বহু বছর পর ইসমাকে ফোন করে। প্রচণ্ড অবাক হয় ইসমা। বিস্ময়াপন্ন হয়ে ফোন রিসিভ করে। এরপর ভালো, মন্দ কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। ইসমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। স্বামী বিরাট বড়ো বিজনেস ম্যান। নিজের প্রাক্তন সুহাসকে এ কথা জানাতে ভুলে না সে৷ এক সময় সুহাসের প্রতি ভীষণ দুর্বল ছিল ইসমা৷ সে জানত সুহাস তাকে প্রকৃত ভালোবাসে না৷ তবু ক্ষণিকের একটি সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল তারা। অগণিত প্রেমিকার ভীড়ে সেও ছিল একজন৷ চেষ্টা করেছিল সুহাসের হৃদয়ে পৌঁছাতে। কিন্তু পারেনি৷ সুহাস সম্পর্কে সিরিয়াস ছিল না কখনোই৷ কাপড় বদলানোর মতো গার্লফ্রেন্ড বদলানো স্বভাব যার তার কি আর সাধারণ ঘরের ইসমাতে মন আঁটকায়? এরপর আচমকাই একদিন জানতে পারে সুহাস বিয়ে করেছে। তার সাথে ব্রেকআপ বিহীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল বহু আগেই। সুহাসের বিয়ের খবর শুনে সেদিন প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল সে। রাত জেগে কেঁদেছিল খুব৷ সবচেয়ে অবাক হয়েছিল যখন সুহাসের বউকে দেখল। বিশ্বাস করতে পারছিল না গায়ের রঙ চাপা এমন একটি মেয়ে সুহাসের বউ৷ এত সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েদের সঙ্গে টাইমপাস করে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করল শ্যামবতী নামীকে! পুরুষ মানুষের মন বোঝা খুব কঠিন৷ আর সুহাসের মন তো জিলিপির প্যাঁচকেউ হার মানায়৷ সেদিনের কষ্টকে স্মরণ করে প্রাক্তন প্রেমিককে কৌশলে অনেক কথাই বলে ইসমা৷ তার হবু বর দেখতে কেমন, বাড়ি কেমন, কয়টা গাড়ি আছে সবই বিবৃতি করে শোনায়। বোঝানোর চেষ্টা করে সুহাসের চেয়ে বহুগুণে গুণান্বিত কেউ তার জীবনে আসতে চলেছে। সুহাসও কম নয়। সে এখন কোথায় কী করছে, তার ওয়াইফ কী করছে সবটাই জানায়। নিজের বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্য বলে না৷ নামীর সঙ্গে সে যে রাগ করে আছে, তীব্র অভিমানে জর্জরিত হয়ে আছে সেটিও লুকায়। সে শুধু তার দাম্পত্য জীবনের ভালো ভালো কথাগুলো বিবৃতি করতে থাকে। নামী তাকে কত ভালোবাসে, কেয়ার করে সবই বলে। সুখের গল্প শেষে দুঃখের গল্পও করে। হঠাৎ করে মা চলে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি৷ রাতে ঘুম আসে না। ঘুমালেই দুঃস্বপ্ন দেখে। এই রাতবিরেতে বন্ধুদের ফোন করে পেল না। তার স্ত্রীও অসুস্থ। তাই হঠাৎ ইসমাকে মনে পড়ল বলেই কল দেয়া। ইসমা শুনে হাসে। তারা আবারো তাদের গল্প জমে ওঠে। এভাবে রাত পেরিয়ে যায়। নামীর ঘুম ভাঙে। চকিতে ওঠেই প্রশ্ন করে সুহাসকে কার সাথে কথা বলছে? সুহাস উত্তর দেয় না৷ ইসমার সঙ্গে কথার সমাপ্তি টানে৷ ফোন কেটে বিছানা ছাড়তেই হঠাৎ নামী তার হাত টেনে ধরে। তীব্র ক্রোধে জর্জরিত হয়ে শুধায়,
‘ কতদিন ধরে চলছে এসব? ‘
‘ বলতে বাধ্য নই। ‘
নামী বরাবরের শান্তশিষ্ট। খুব সহজে রাগে না৷ আজ এই মুহুর্তে তার কী হলো কে জানে? নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না একদমই। আচম্বিতে ওঠে গিয়ে সুহাসের কলার চেপে ধরল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
‘ কার সঙ্গে কথা বলছিলি? কতদিন ধরে চলছে এসব? বলতে বাধ্য নই মানে আলবাত বাধ্য।’
নামীর আচরণে যারপরনাই অবাক হলো সুহাস। সহসা নামীর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে বাতি জ্বালালো সে। এরপর বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো নামীর অগ্নিদৃষ্টি আর ক্রোধে জর্জরিত মুখশ্রীর পানে। নিমেষে বুক কেঁপে ওঠল। ইতিপূর্বে নামীকে এই রূপে দেখেনি সে। আর ওর মুখে তুই তুকারি! সে তো দুঃস্বপ্ন। সুহাস হতভম্ব মুখে তাকিয়ে। নামী বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল। যেন কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। হাঁপানি রোগিদের মতো শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। সুহাস হতবাক হয়ে তাকিয়ে। রাগ, অভিমানের ঊর্ধ্বে বুকের খুব গভীরে নামীর জন্য খারাপ লাগা অনুভব করল। দেখতে পেল কিয়ৎক্ষণ পূর্বে অগ্নিমূর্তি ধারন করা মেয়েটা
ধীরেধীরে শান্ত হয়ে গেল। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল বিছানার একপাশে। মুখটা বিধ্বস্ত লাগছে ওর৷ এরপর সুহাসকে অবাক করে দিয়ে দু-হাত মুখে চেপে ডুকরে ওঠল নামী৷ সুহাসের ইচ্ছে করল ছুটে কাছে যেতে। কাঁধে হাত রাখতে। মাথায় হাত বুলাতে৷ বুকের ভেতর আগলে নিয়ে সান্ত্বনা দিতেও ইচ্ছে করল৷ ইচ্ছে করল বলতে,
‘ কাঁদছ কেন নামীদামি? এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবি না৷ কতদিন ধরে না, জাস্ট আজকেই ফোন করেছি৷ বন্ধু হিসেবেই কথা বলছিলাম এর বাইরে কিচ্ছু না। তোমার সুহাস তোমারি আছে। ডোন্ট ক্রাই নামী, ডোন্ট ক্রাই। ‘
ইচ্ছে গুলোকে দমিয়ে নিল সুহাস। বুকের ভেতর যে পাথর চাপা আছে। সে পাথর যে পর্যন্ত সরে না যাচ্ছে। নামীর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারবে না সে৷ রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস৷ মাথাটা ঘুরছে তার। নিজের খারাপ লাগাকে বুঝতে দিল না নামীকে। শার্টের কলার ঠিকঠাক করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মুহুর্তেই। নামী টের পেল সুহাস বেরিয়ে গেছে। যার ফলে তার কান্নার মাত্রা বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে মাথা চক্কর দিল। ক্ষণে ক্ষণে গা গুলিয়েও ওঠল৷ শেষ পর্যন্ত বাথরুমে গিয়ে বমি করে শান্ত হলো সে।
.
.
সূর্যদয় দেখতে ভীষণ ভালোবাসে সৌধ। ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি গায়ে মাখাতে পছন্দ করে বেশ। আজ হসপিটালে যেতে হবে না। তাই জগিংয়ে বেরুলো। প্রকৃতি প্রেমী মানুষ সে। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চটজলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঝকঝকে সাদা রঙের রানিং সুজ, গাঢ় নীল রাঙা শর্টস আর সাদা রঙের টিশার্ট পরিহিত সৌধ। এখানকার স্থানীয় কিছু যুবক রয়েছে। যারা বয়সে তার ছোটো৷ কিন্তু রাজনীতির সাথে সংযুক্ত। সেই সুবাদেই সৌধর সঙ্গে তাদের বেশ খাতির। সৌধ যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়৷ তবু বাবা, ভাইয়ের উছিলাতে সব জায়গাতেই রাজ করে বেড়ায়৷ আয়েশ করে কাটিয়ে দেয়৷ চট্রগ্রাম শহরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ সাতসকালে জগিংয়ে বের হলেও নয়, দশজন ছেলেপুলে সঙ্গ দিতে চলে আসে৷ সৌধ বুঝতে পারে এসবের পেছনে তার বাবা, ভাইয়ের সুকৌশল দায়ী। তবু চুপ রয়। উপভোগ করে বেশ।
যে বাসায় ভাড়া থাকে সৌধ। সে বাসার মালিকের কনিষ্ঠ কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। নাম আভিরা খান। এবার বাড়ি এসে প্রথমেই তার নজর পড়েছে ডক্টর সৌধ চৌধুরীর ওপর। প্রথম দেখা হয় বাড়ির গেটের সামনে। প্রথম কথোপকথনে জেনে নেয় সৌধর ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সৌধর ব্যক্তিত্ব। রূপ, লাবণ্যের কমতি নেই আভিরার। প্রথম দর্শনে যে কোনো পুরুষই কপোকাত হতে বাধ্য। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা। চোখ দু’টি কাজল কালো নয় তবে আকর্ষণীয়। চোখের বর্ণ ধূসর। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত। স্বাস্থ্য মোটামুটি। সব মিলিয়ে শহরের সেরা দশজন সুন্দরীদের মধ্যে একজন হওয়ার মতোন। সেই আভিরার দিকে সৌধ একবার ছেড়ে দু’বার তাকায়নি। খেয়াল করে আভিরা। অত্যন্ত সুকৌশলে দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সৌধ কেমন স্বল্প আলাপ করল তার সঙ্গে। যা তার যুবতী চিত্তকে অশান্ত করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে রাতের ঘুম। বাড়ি এসে বেলা করে ঘুমোনোর অভ্যাস বদলেছে। শুধুমাত্র সৌধ চৌধুরীকে এক পলক দেখার লোভে। কথা বলার তৃষ্ণায়। রোজ সৌধ যখন জগিংয়ে বেরোয় এই সময়টাতে আভিরাও বেরোয়৷ তার প্রিয় বিড়ালছানাকে কোলে নিয়ে পিছু নেয় সৌধর। দু’দিন খেয়াল করেছে সৌধ। তৃতীয় দিন খেয়াল হতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। এসব ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিত্বের মেয়ে তার একদম পছন্দ নয়। তারা একটি পার্কে ছিল। আভিরাকে দেখেই পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো সৌধ। অমনি পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল,
‘ ডক্টর সৌধ চৌধুরী… ‘
সহসা থেমে গেল সৌধ। সে থেমেছে বলে আভিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে এগিয়ে এলো। বিড়াল ছানাকে বুকে চেপে ধরে বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা নিয়ে সৌধর মুখোমুখি দাঁড়াল। আচমকা তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল সৌধর বলিষ্ঠ বুকে। নিমেষেই ঠোঁট দু’টি কেঁপে ওঠল। এই ছেলেটা তার বয়ফ্রেন্ড হলে সে তো সারাদিন ওই বুকেই একশখানা কিস করে দিবে। ঢোক গিলল আভিরা। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে তার। ধীরেধীরে দৃষ্টি উঁচু করল। তাকাল সৌধর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আবৃত দৃঢ় চোয়ালের পানে। মনে মনে বলল, ‘ মাইন্ড ব্লোয়িং! ‘ তার বেশরম মনটা আকুপাকু করে ওঠল। শেষ দৃশ্যে যেন মরে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনো পুরুষ মানুষের ঠোঁটও বুঝি এত আকর্ষণীয় হয়? সবকিছুতে অদ্ভুত সৌন্দর্য আর দৃঢ়তা। এই ছেলেটা এতকাল কোথায় ছিল? কেন আগে দেখা পায়নি এর? আফসোস হলো ভীষণ। এই এত এত দেখার ভীড়ে একবারো সৌধর চোখের দিকে তাকাল না আভিরা৷ যদি একবারো তাকাতো। তাহলে সৌধ চৌধুরীর কঠোর দৃষ্টির কবলে পরে মোহময় হৃদয়টা তার শতসহস্র বার ফাঁসিতে ঝুলতে চাইত। তার মতো সুন্দরী মেয়েকে কোনো যুবক মুগ্ধ দৃষ্টির বাইরেও অন্য কোনো দৃষ্টিতে দেখতে পারে তাও কিনা ক্রোধান্বিত, দৃঢ় দৃষ্টিতে। এ যে অকল্পনীয়!
আভিরার ওপর চরম বিরক্ত সৌধ। শুধু তাই নয় আভিরার আচরণে ভয়াবহ ক্রোধও চেপেছে মাথায়। সেই ক্রোধ প্রকাশিত হলো আভিরা যখন তাকে বলল,
‘ আজ এখনি চলে যাচ্ছেন কেন সৌধ? আসুন না ওদিকে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। ‘
প্রতুত্তরে চিবিয়ে চিবিয়ে সৌধ বলল,
‘ আপনি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছেন। অথচ নূনতম ভদ্রতা নেই আপনার মাঝে! না হলেও আমি আপনার ছ’বছরের সিনিয়র। সো, ইউ শুড হ্যাভ কলড মি ব্রাদার। ‘
অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল আভিরার। বুকের ভেতর ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে ওঠল সৌধর বলা প্রতিটি বাক্য শুনে। সৌধ নিজের বক্তব্য দিয়ে এক মুহুর্তও সময় নষ্ট করেনি। চলে এসেছে। এদিকে আভিরা অপমান সহ্য করতে না পেরে বুকে আগলে রাখা বিড়ালটাকে অবচেতনে এত্ত জোরে চেপে ধরল যে। দম আঁটকে ছটফটিয়ে ওঠল বিড়ালছানা। মিউউউ শব্দে কেঁদে ওঠতেই আচমকা হাত দু’টো আগলা করে দিল আভিরা। বিড়ালছানা মাটিতে পড়ে জোরে জোরে মিউ মিউ করতে লাগল।
.
.
সকালবেলা বেরিয়েছে নামী। কোথায় গেছে কাউকে বলে যায়নি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অথচ বাড়ি ফেরার নাম নেই। সিমরান, সুহাস দু’জনই প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তা করছে৷ ঘনঘন ফোন দিচ্ছে। ধরছে না নামী। ওরা দুই ভাই যখন চিন্তায় অস্থির। চারিদিকে যখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে। তখন বাড়ি ফিরল মেয়েটা। তার চোখ, মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই সুহাস যেন খাবলে ধরল তাকে। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ কোথায় ছিলে সারাদিন? ‘
নামীও ক্রোধানলে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেটা মনে মনে। মুখটা একদম শান্ত। চোখ দু’টোও সুস্থির। সহসা মৃদু হাসল সে। সুহাসের ধূসর বর্ণীয় চোখ দু’টোয় দৃঢ় চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
‘ বলতে বাধ্য নই। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা।