#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৫|
সৌধ ভেবেছিল উদয়িনী আন্টির সাথে দেখা করবে। শেষ পর্যন্ত দেখা করা হলো না৷ আইয়াজের সাথে কথা হয়েছে ভোরবেলা। সে পরামর্শ দিল, উদয়িনী আন্টি নয় শুধু সিমরানের সঙ্গেই একান্তে কথা বলতে। এই বিয়েতে সুহাস রাজি নয়। রাজি নয় উদয়িনী আন্টিও। সুহাসের বিয়ে যেমন সোহান আংকেল নিজের সিদ্ধান্তে দিয়েছে। তেমনটা সিমরানের বেলায়ও করতে চাচ্ছে। সুহাসের সঙ্গে সৌধর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ফাটল ধরেছে। সুহাসের তরফ থেকেই এই ফাটল। ওর মাঝে ছেলেমানুষী আছে। আইয়াজ, সৌধ দু’জনই অবগত এ ব্যাপারে। সৌধ যদি এখন বাড়ি বয়ে গিয়ে উদয়িনী আন্টিকে জানায় সে এই বিয়েতে রাজি নয়। বিয়েটা যেভাবেই হোক আটকান। তবে সুহাস ভুল বুঝতে পারে৷ সিমরান ওর একমাত্র বোন৷ সে কোনো ফেলনা বস্তু নয়। মা ছেলের অহংবোধ প্রগাঢ়। সেখানে অযথা আঘাত করার প্রয়োজন নেই৷ সিমরানের মাঝে ছেলেমানুষী থাকলেও সুহাসের থেকে ওর বুঝ শক্তি আলাদা। তাছাড়া সৌধকে ছোটোবেলা থেকেই খুব মানে মেয়েটা৷ সেটা যে কারণেই হোক না কেন। তাই একমাত্র সিমরানের সাথে কথা বলাই সমীচীন হবে৷ সিমরান, সৌধর সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে পরিবারে। তাদের সিদ্ধান্ত বিপরীতে মোড় নিচ্ছে বলেই এত জটিলতা। যদি সিদ্ধান্ত এক হয় তবে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে না৷ আর না তাদের এত বছরের পারিবারিক বন্ধুত্ব, সুহাস সৌধর ঘনিষ্ঠতায় দেয়াল ওঠবে৷
আইয়াজের সাথে কথা শেষ করল সৌধ। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে কল করল সিমরানকে। এ সময় সিমরান ঘুমে থাকে৷ জানে সৌধ। তাই একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়নি বলে বিচলিত হলো না৷ কিয়ৎক্ষণ পর আবার কল করল। রিসিভ হলো ফোনটা। কর্ণকুহরে পৌঁছাল মিহি কণ্ঠের বিস্ময়কর দু’টি শব্দ,
‘ সৌধ ভাই! ‘
বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল সৌধ৷ বা’হাতে কানে ধরা থাকা ফোন ডানহাতে নিয়ে কানে ধরল৷ এরপর বা হাতটা সযত্নে ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল রুম জুড়ে। ফোনের ওপাশে থাকা তরুণী শূন্য মস্তিষ্কে, ছটফটে হৃদয়ে অপেক্ষা করছে। টের পেল সৌধ। তাই অপেক্ষা দীর্ঘ হতে না দিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ ন’টার দিকে গলির মোড়ে দাঁড়াব আমি৷ কারো সঙ্গে কিছু শেয়ার করবি না৷ জাস্ট তৈরি হয়ে চলে আসবি৷ দু’তিনঘন্টা সময় নিব। ওকে? ‘
কথাগুলোতে অনুরোধ ছিল না স্পষ্ট। তবে কি আদেশ ছিল? উহুম এ মুহুর্তে এসব ভেবে সময় নষ্ট করতে চায় না সিমরান। তাই ত্বরিত হকচকানো মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ ওকে, ওকে আমি আসব। ‘
সিমরান বাক্যের সমাপ্তি দিতেই ফোন কেটে দিল সৌধ। ভাবতে লাগল কোথায় মিট করবে? আর পাঁচ জনের মতো সে কাউকে একাকী রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে বসতে পারে না৷ পরিস্থিতি যা তাতে বাড়িতে নিয়ে আসাও সম্ভব না৷ তাহলে যাবে টা কোথায়? অনেক ভেবেচিন্তে ছোটো কাকার বাংলোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল৷ ত্বরিত কল করল ছোটো কাকাকে। যদিও তাকে না জানিয়েও যেতে পারত৷ তবু সে তার ব্যক্তিত্বে স্বচ্ছতা ধরে রাখতেই কল করে অনুমতি চাইল। ছোটো কাকা বলল,
‘ তুই তুইই রয়ে গেলি সৌধ। সময় কাটাতে কাকার বাংলোতে যাবি এরজন্য অনুমতির কী প্রয়োজন? সাত্তার কাকার কাছে চাবি আছে। চাইলে ভাবির থেকেও চাবি নিতে পারিস। ‘
সাত্তার কাকাকে চেনে সৌধ। বাংলো দেখাশোনার দায়িত্বে আছে সে৷ ওখানেই রাস্তার ধারে চায়ের দোকান। ছোট্ট চায়ের দোকান আর বাংলো দেখাশোনা। এই করেই বৃদ্ধ বয়সে পেট চালায় লোকটা৷ ফোন রেখে সকালের নাস্তা সেরে নিল সৌধ। মায়ের থেকে চাবি নিল না। সাত্তার কাকাকেই ভরসা করল৷ মায়ের থেকে চাবি নেয়া মানে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। সে এবং তার মা কেউই মিথ্যা সহ্য করতে পারে না৷ সত্যি বলাও সম্ভব না। তাই মিথ্যা যেন বলতে না হয় সে ব্যাপারে সচেতন রইল।
.
.
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে৷ যাদের ব্যক্তিত্ব এতটাই দৃঢ়, শীতলতায় আচ্ছন্ন যে তাদের সামনে খুব হিসেব করে কথা বলতে হয়৷ বেহিসেবে একটু বেচাল হয়ে গেলেই পড়তে হয় তীব্র লজ্জা আর অস্বস্তিতে। সিমরানের জীবনে সৌধ এমনই একজন। যার সামনে দাঁড়াতে হলেও দশবার ভাবতে হয় তাকে৷ পরনের কাপড় ঠিক আছে তো? সাজসজ্জায় বাড়াবাড়ি রকমের কিছু নেই তো? জামার রঙটা সৌধ ভাইয়ের পছন্দ হবে? কথা বলার সময় সৌজন্য ধরে রাখতে পেরেছে? উগ্র হয়ে যায়নি তো কোনো বাক্য? সে কি সৌধ ভাইয়ের কাছে সুশীলা হতে পারবে? এরকম অজস্র দুঃশ্চিন্তা জাপ্টে ধরে সিমরানকে। তার অনুভূতি সেই সব মেয়েরাই বুঝতে পারবে। যারা কিশোরী বয়স থেকে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিজের প্রতি আকর্ষিত করতে স্ট্রাগল করে যাচ্ছে। অথচ কিশোরী বয়স পেরিয়ে যুবতীর কোঠায় পৌঁছে গিয়েও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হচ্ছে না।
একরাশ দুঃশ্চিন্তায় বুঁদ হয়ে দুরুদুরু বুকে গলির মোড়ে এলো সিমরান। মুহুর্তেই ডানপাশের রাস্তা থেকে সৌধর গাড়ি এসে থামল তার সামনে। গাড়ির দরজা খুলে দিতেই কোনোদিক না তাকিয়ে ঝটপট ওঠে পড়ল সে। এরপর দরজা লক করে পাশে তাকাতেই দেখতে পেল নেভি ব্লু রঙের টি-শার্ট পরনে সৌধ। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসে আছে। দৃষ্টি সামনে অবিচল ছিল। সে তাকিয়েছে টের পেতেই তার দিকে ফিরে তাকাল। নিরাসক্ত, সচ্ছ সুন্দর দৃষ্টি। সিমরান তাকিয়েই রইল। সৌধ বুঝতে পারল না মনে মনে হাসছে সে। কারণ কাকতালীয় ভাবে তাদের দু’জনের পোশাকের রঙ মিলে গেছে। প্রায় ঘন্টা লাগিয়ে ড্রেস বাছাই করার কষ্ট দূর হলো সিমরানের। এই ড্রেসটা নামী কিনে দিয়েছিল তাকে৷ এখন পর্যন্ত পরা হয়নি। আজই প্রথম। নেভি ব্লু কালার কটন কাপড়ের গাউন৷ জমিনে সোনালি সুতোর কাজ বিধায় তার সাথে মিলিয়ে সোনালি রঙের ওড়না নিয়েছে। গোপনে একটি শান্তির নিঃশ্বাস বেরুলেও মনটা শান্তি পেল না। কারণ তার অবচেতন মন ঠিক টের পেয়েছে সৌধ ভাই কেন আলাদা করে তাকে ডাকল। প্রত্যাখ্যান নিশ্চিত জেনেও এসেছে সে৷ নামী সব সময় বলে, সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সবচেয়ে উত্তম। সেই কথাটায় তীব্র বিশ্বাস রেখেই আসা। তার ভবিতব্যে যদি সৌধ না থাকে। কীভাবে সামলাবে নিজেকে জানে না৷ এতদিন যেভাবে কেটেছে এভাবে কাটলে কতদিন বাঁচবে তাও জানে না।
ভাবনার অতল গহ্বরে সিমরান। সৌধ গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। বেশি দূরের পথ নয়। সতেরো মিনিটেই পৌঁছাল। জায়গাটা চেনা সিমরানের। বন্ধু, বান্ধব নিয়ে ঘুরতে এসেছে বহুবার। কিছু দূরেই রেললাইন। ওখানে করা কতশত ছবি, ভিডিয়ো আছে তার। চেনা জায়গাতেও অচেনা জায়গার দেখা পেল সে। এদিকটা কেমন সুনসান। ভূতুড়ে ভূতুড়েও। ঢোক গিলল সে। সৌধ গাড়ি থামিয়েছে। এখানে পার্কিং করার মতো ব্যবস্থা নেই৷ তাদের পেছনে দু’টো বাইক আসছিল। সৌধ ফোন করল প্রথম বাইকে থাকা একজনকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বলল,
‘ রাসেল আশপাশেই থাকিস। গাড়ি এখানে রেখে গেলাম। ‘
‘ ওকে ভাই। ‘
ফোন কেটে সিমরানকে নামতে ইশারা করল সৌধ। মুখে মাস্ক পড়ে নিজেও নেমে পড়ল। দু’মিনিটের মতো হাঁটতে হলো ওদের৷ উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম তিন মোড়ের রাস্তা৷ পশ্চিমের রাস্তা শুরু হতেই একটি ছোট্ট চা স্টল। চা স্টলে বসা বৃদ্ধ লোকটির সামনে গিয়ে সৌধ সালাম দিল। বলল,
‘ ভালো আছেন সাত্তার চাচা? ‘
সাত্তার চাচা সেই বৃদ্ধ যার দাদু শব্দটির সঙ্গে পরিচয় নেই। সবাই তাকে এক নামে চেনে৷ সে নামটি হলো সাত্তার চাচা। কচি থেকে তাগড়া যুবক সবাই তাকে সাত্তার চাচা বলে। এই যেমন সৌধর ছোটো কাকা সুলল চৌধুরী তাকে সাত্তার চাচা ডাকে। সৌধও সাত্তার চাচা ডাকে৷ কুশলাদি বিনিময় করে বাংলোর চাবি নিল সৌধ। এরপর তাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু বাংলোর সামনে চলে এলো সিমরান। প্রথম দর্শনে সিমরান হকচকিয়ে গেল। তার শহরে এত সুন্দর একটি বাংলো আছে শুনেনি তো কখনো। আশ্চর্যান্বিত মুখে চারপাশে তাকিয়ে রইল সে। বাংলো সইসই চিকন পাকা রাস্তাটা ধরে হাঁটছিল ওরা। সৌধ নির্লিপ্ত। সিমরান বিহ্বল দৃষ্টিতে চারপাশ তাকিয়ে দেখছে আর এগুচ্ছে। দু’পাশে হরেকরকমের ফুল গাছ। রঙবেরঙের সে ফুল গুলো থেকে সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। একপাশে ছোট্ট একটি পুকুর। খেয়াল করল সেখানে লাল, সাদা শাপলা ফুটেছে। বুকের ভেতরটা ভালো লাগায় শিরশির করে ওঠল ওর। সৌধ অনেকটা এগিয়ে গেছে। বাংলোর বারান্দা পেরিয়ে প্রধান দরজার তালা খুলল। ভেতর থেকে দু’টো বেতের চেয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো তক্ষুনি। সিমরানের মুগ্ধতায় ভরা মুখে তাকিয়ে বলল,
‘ পুকুর পাড়ে আয়। এদিকটা ঠান্ডা। ‘
হুঁশ ফিরল সিমরানের। ত্বরিত তাকাল সৌধর দিকে। দু-হাতে দু’টো চেয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষটি। এই তো আর কিছু সময়। মানুষটা প্রত্যাখ্যান করবে তাকে। বুকের ভেতর এই মুহুর্তে যে পুলকিত অনুভূতি আছে সবটা শুষে নেবে একটি বাক্যে,
‘ আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব না সিনু। ‘
বিদ্যুতের ঝটকা লাগার মতো কেঁপে ওঠল সিমরান। লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে তা ছেড়ে দিল আবার। পা বাড়াল ডান পাশে। সৌধর পাশে গিয়ে বসতেই সৌধ বলল,
‘ প্রথম এনিভার্সারিতে ছোটো কাকিকে এই বাংলোটা গিফট করেছিল কাকা। প্র্যাগ্নেসির তিনমাস চলছিল। দাদুনি বাড়ির বাইরে তাও আবার এমন একটা জায়গায় নতুন বাংলো বাড়িতে থাকার পারমিশন দেয়নি। প্ল্যান ছিল প্রথম সন্তানকে নিয়ে দ্বিতীয় বছর প্রথম এখানে থাকবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষের পরিকল্পনাকে অসফল করে নিজ শক্তির দৃঢ়তা দেখিয়ে দিলেন। ‘
কথার সমাপ্তি টেনে অদ্ভুত রকমের হাসল সৌধ। সিমরান বলল,
‘ খুব সুন্দর বাংলো। ছোটো আংকেল ভীষণ রুচিশীল। ‘
সৌধ তাকাল একবার। সিমরান খেয়াল করে পুকুরের দিকে তাকাল। সৌধ স্মিত হেসে বলল,
‘ আমি জানতাম তুই’ই অনেক রুচিশীল। জানাটা ভুল কেন হলো? ‘
আচমকা চোখ ফেরাল সিমরান। সৌধর দৃষ্টি তখন পুকুরে ফুটা ছোট্ট সাদা শাপলাতে স্থির। বলল,
‘ আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব না সিনু৷ আই এম রেইলি সরি। ‘
সিমরানের সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল। নিমেষেই সামলে নিল আবার। বলল,
‘ বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। পাত্রী আমি হলে সমস্যা কোথায়? ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল সৌধ। এমন ভারিক্কি কথা সিমরানের থেকে আশা করেনি সে। সেদিনের একরত্তি মেয়ে সিমরান। কবে এত বড়ো হয়ে গেল! নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে সৌধ কিছু কথা বলল ও’কে। যাতে তার অনুভূতি বুঝতে পারে সিমরান। আর একটা মেয়ে কখনোই অন্য মেয়ের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত ছিল এমন ছেলেকে স্বামী রূপে চাইবে না৷ জানে সে।
কথা গুলোতে তীব্র আফসোস ছিল,
‘ কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথমদিন। বড়ো ভাইরা ফার্স্ট ইয়ারদের রেগ দিচ্ছিল। রেগিং আমার তখন থেকেই অপছন্দ। তাই বন্ধুদের নিয়ে কিছুটা দূরে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেরুন রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরা একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে। লম্বা, ফর্সা অতি সাধারণ পোশাকের মেয়েটিকে সাধারণ ভাবেই দেখছিলাম। বড়ো ভাইরা ডাকল ওকে। রেগ দিল। মেয়েটা তেজীয়ান। বড়ো ভাইদের আদেশ মানবে না। ভাইরাও কম তেজীয়ান নয়৷ হট্টগোল বেঁধে যাচ্ছে প্রায়। এমন সময় আমি ওখানে উপস্থিত হলাম। জানতে পারলাম আমাদেরই ব্যাচমেট। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম একবার। গোলগাল মুখ। ঠোঁট দু’টো লাভ শেপ। মৃদু হেসে ভাইদের জিজ্ঞেস করলাম, কী করতে বলেছেন? ওরা প্রথমে বিব্রত হচ্ছিল। বড়ো হলেও আমার স্থান তাদের কাছে আরো বড়োতে। ভয়ও পাচ্ছিল কিঞ্চিৎ। আমি আশ্বাস দিলাম। তারা আমাকে বলল বড়ো ভাইদের মধ্যে দেখতে কালো, মোটা আর চোখের মণি সাদা ভাইয়ার চোখের দিকে পলকহীন এক মিনিট তাকিয়ে থাকতে হবে। মেয়েটা নাছোড়বান্দা। কিছুতেই তাকাবে না। আমি ওর সামনে গেলাম। চোখে চোখ রাখতেই আমার বুকে টান পড়ল। কী আশ্চর্য দু’টো চোখ। পিঙ্গলবর্ণের ঐ চোখ দু’টি দেখেই আমি ভাইদের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘ আছলাম ভাইয়ের জায়গায় আমি থাকলে সমস্যা আছে? ‘ ওরা এক সুরে না করল। সমস্যা নেই। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ফার্স্ট ইয়ার? ‘
‘ হ্যাঁ।’
‘নাম?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘ জান্নাতুল ফেরদৌসী নিধি। ‘
আমি ওর চোখে, ওর নাকে, ঠোঁটে, থুতনীতে সমস্ত জায়গায় আমার চোখ বিচরণ করতে করতে বললাম, ‘কলেজ সম্পর্কে ধারণা নেই তোমার? শোনো বড়ো ভাই রেগ দিচ্ছে। এটা মেনে নিতে তুমি বাধ্য৷ আছলাম ভাইয়ের চোখে তাকাতে অসুবিধা থাকলে আমার চোখে তাকাও। যত দেরি করবে তোমারি সময় নষ্ট হবে। ‘
নিধি এবার আমার দিকে ভালোভাবে তাকাল। আমি চোখে ইশারা করে বুঝালাম আমরা সেম ব্যাচ। উই আর ফ্রেন্ডস। সো অসুবিধা কী? বুদ্ধিমতী মেয়ে। মেনে নিল। পাক্কা এক মিনিট পলকহীন তাকিয়ে রইল আমার চোখে। আর আমি তাকিয়ে রইলাম ওর ব্রাউন কালার হৃদয়ে টান পড়া চোখ দু’টিতে। এরপরই পরিচয় আর বন্ধুত্ব হলো আমাদের। সময় প্রবাহিত হলো ঠিকই। কিন্তু ওই যে এক মিনিটের দৃষ্টি বিনিময়। আমি ওর চোখে খুঁজে পেলাম আমার প্রথম যৌবনে সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া গোলাপকে। শুরুটা ওখান থেকেই হলো। ভীষণ জেদি আমি। এক কথার মানুষ যেমন, তেমনি এক অনুভূতিতে অটুট৷ কলেজ জীবনের পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলাম। একতরফা ভালোবেসে আর অপেক্ষা করে। এরপর যখন সেই নিখুঁত, গভীর ভালোবাসা থেকে আঘাত পেলাম। তখন আমার মনে কী ভয়ানক জেদ চেপে ওঠল কল্পনাতীত। এই আঘাত কোনোদিন সেরে ওঠবে না। আর না প্রথম অনুভূতির তিক্ততা আমার হৃদয় থেকে মুছে যাবে। আমি নিধিকে ভালোবাসতাম, প্রচণ্ড পরিমাণে ভালোবাসতাম। ঐ ভালোবাসা এ জন্মে কারো প্রতি আসা সম্ভব না। আর যদি ভুলক্রমেও আসে তাহলে প্রথমবারের ভুলটা দ্বিতীয়বার করব না। ‘
থামল সৌধ। অনুভব করল সিমরান অস্বস্তিতে ভুগছে। কিন্তু তাকাল না একবারো। পুনরায় বলল,
‘ আমার ভুল কি ছিল জানিস? নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা। ভালোবাসায় অন্ধত্ব বোকামি। আমি ওকে সেক্রিফাইস করেছিলাম। ভালোবাসায় ততক্ষণ সেক্রিফাইস করতে নেই যতক্ষণ না অপর মানুষটা পূর্ণাঙ্গ রূপে নিজের হয়। আমার ভুলটা ঠিক এখানেই। আমার দম ছিল। নিধিকে নিজের করার দম ছিল আমার। আমি ওকে মুক্ত পাখির মতো চেয়েছিলাম বলে সেই দমটা নিভিয়ে রেখেছিলাম। ‘
ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ৷ জড়োসড়ো হয়ে গেল সিমরান৷ বুকের ভেতর জ্বলছে। ভীষণ জ্বলছে তার। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস গুলো স্বাভাবিক করে নিয়ে সৌধ বলল,
‘ একজন মানুষকে দূর থেকে যেমন দেখায় সে পুরোপুরি তেমন হয় না। আমাকে তুই ততটুকুই চিনিস যতটুকু তোর সামনে প্রকাশ করেছি। এ পৃথিবীর কোনো মানুষই কারো কাছে নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করে না৷ আমিও করি না। সুহাস আমাকে যেভাবে, যে রূপে চিনে তুই চিনিস না। তুই যেভাবে যে রূপে জানিস অন্য কেউ সেভাবে জানে না। আমি আমার আম্মার কাছে যে রূপ দেখাই সেটা কিন্তু অন্য কেউ দেখে না। প্রত্যেকটা মানুষ ভেদে আমি আলাদা। আমি তোর কাছেও আলাদা। এই আলাদাটুকু নিয়েই থাকতে চাই। ‘
সিমরান কিছু বলতে উদ্যত হলো। সৌধ বলতে দিল না৷ নিজেই বলল,
‘ আমি তোকে বিয়ে করতে চাই না। শুধু তোকে নয় এ মুহুর্তে আমার পক্ষে কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। আর তোকে কোনো মুহুর্তেই সম্ভব না কারণ, আমি হয়তো দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব না। সিনু, তোর জীবনটা উদয়িনী আন্টির মতো হোক। এটা আমরা কেউ চাই না৷ সোহান আংকেল ভীষণ ভালো মানুষ। আমি তার মতো ভালো নই, উদার নই। আমাকে বিয়ে করলে উদয়িনী আন্টির থেকেও অধিক যন্ত্রণা পাবি তুই৷ ‘
এত এত কথার ভীড়ে সৌধ খেয়াল করল না সিমরানের চোখ বেয়ে অনর্গল জল গড়াচ্ছে। সে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ তুই কী চাস মায়ের মতো ভালোবাসাহীন সংসার করতে? সারাজীবন ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাতে। সামনে থাকা উজ্জ্বল ভবিষ্যতটাকে দূরে ঠেলে নরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে? ‘
‘ তুমি নরক নও। আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমার কাছে স্বর্গ তুমি। ‘
আচমকা চোখ বুজে ফেলল সৌধ। দু-হাত মুঠোবন্দি করে পরোক্ষণেই দৃষ্টি খুলল। সিমরান কাঁদছে। সে আঁচ করেছিল এমন কিছুই হবে। তাই না তাকিয়েই দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ আমি শপিংমলের কোনো জামা নই সিনু৷ কান্নাকাটি করে আমাকে পাওয়া যাবে না। ‘
সহসা কান্না থেমে গেল সিমরানের। অদ্ভুত এক খারাপ লাগা এসে ভর করল বুকের ভেতর। সৌধ ভাই এভাবে বলতে পারল তাকে? ভালোবাসে বলে সে তো আর ছ্যাঁচড়া মেয়ে মানুষ হয়ে যায়নি। অসহায় বোধ করল খুব৷ নিরুপায় লাগল নিজেকে। সৃষ্টিকর্তা কেন এই মানুষটাকে ঘিরে তার হৃদয়ে এত ভালোবাসার জন্ম দিল? যদি নাই পাবে তবে এতখানি ভালোবাসায় কেন মন ডুবাল? অসহায় চোখে তাকাল সৌধর পানে। শক্ত চোয়ালে সৌধ সটানভাবে বসে। সিমরান তাকিয়েছে। অশ্রুসিক্ত তার দৃষ্টিদ্বয়। টের পেয়ে ঢোক গিলল। এক নিঃশ্বাসে বলল,
‘ আমি তোকে ভালোবাসি না। তুই যে চোখে আমাকে দেখিস আমি ভুলক্রমেও কখনো সে চোখে দেখিনি৷ তোর আত্মসম্মান কি এতটাই ঠুনকো? যে ছেলে তোকে ভালোবাসে না, নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াতে চায় না৷ যে ছেলে তার পরিবারের কাছে তোকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আজ তোর সামনে বসেও প্রত্যাখ্যান করছে। তাকে বিয়ে করবি? বউ হবি তার? ‘
দম বন্ধ হয়ে এলো সিমরানের। আচমকা দু’হাতে কান দু’টো চেপে ধরে বলল,
‘ চুপ করো প্লিজ। ‘
সৌধ চুপ করল না। একের পর এক বলতেই থাকল,
‘ তুই জেনে-বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিবি? ‘
সহসা মৃদু চিৎকার দিল সিমরান। অসহনীয় গলায় বলল,
‘ কথা শেষ করো সৌধ ভাই। ‘
সিমরান উত্তেজিত হচ্ছে। আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলতে ফের সৌধ বলল,
‘ বাড়ি ফিরে যা৷ আম্মাকে ফোন দিয়ে বল এই বিয়েতে তুই রাজি না৷ এতদিন ভুল করেছিস। আজ মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে না করে দিলি। সোহান আংকেল আমাদের বাড়ি যাওয়ার আগে আম্মাকে ফোন দে৷ ‘
বাক্য গুলো কী নিষ্ঠুর! পাশের মানুষটা কত বড়ো মাপের পাষাণ। ভেবেই সহসা ওঠে দাঁড়াল সিমরান। অমনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভয়ংকর ভাবে কেঁপে ওঠল৷ সে কাঁপুনি আর থামল না৷ অতিরিক্ত যন্ত্রণা, উত্তেজনা মিলিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সৌধ বিচলিত হলো এ দৃশ্য দেখে। ত্বরিত সিমরানের হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল পাশে। দৃঢ় গলায় বলল,
‘ শান্ত হো। মাথা ঠান্ডা কর। জাস্ট কন্ট্রোল সিনু। ‘
ধরে রাখা হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিল সিমরান। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,
‘ তুমি শান্ত হতে পেরেছিলে? তুমি কন্ট্রোল করতে পেরেছিলে নিজেকে? পারোনি তো। আমাকে কেন বলছ তাহলে। যে যন্ত্রণায় নিজে ভুগছ সেই একই যন্ত্রণায় আমাকে ভোগাতে তুমিই বাধ্য করলে। ‘
সত্যি বাক্য। সৌধ নিভে গেল৷ হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ওর মাথায়। বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ আমি নিরুপায় সিনু। তোর ভালোর জন্যই বলছি। আমি তোকে বিয়ে করতে পারব না। আমি ভুলতে পারব না আমার প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদ যন্ত্রণাকে। ‘
আবারো তাচ্ছিল্য ভরে সৌধর হাত ছাড়িয়ে দিল সিমরান। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমিও পারব না। তুমি যেমন নিধিপুর স্বার্থপরতা মনে রেখেছ। আমিও তোমার প্রত্যাখ্যান মনে রাখব।’
কথাটা বলেই হুহু করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। সৌধ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল৷ কেটে গেল কয়েক পল। এরপর আচমকাই থেমে গেল সিমরান৷ ধাতস্থ হয়ে নিজের চোখের পানি গুলো মুছে ওঠে দাঁড়াল। ওঠে দাঁড়াল সৌধ নিজেও। বলল,
‘ চল, বাড়ি ফিরবি। ‘
তিনটে শব্দ বলেই পা বাড়াল সৌধ। শরীর টলছে সিমরানের। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে এগুচ্ছিল। আর ভাবছিল সৌধর বলা প্রতিটি কথা। হঠাৎ স্মরণ হলো, কলেজে নিধি আপুর চোখ দেখেই প্রেমে পড়েছিল সৌধ। মন মানল না সিমরানের। প্রত্যাখ্যান পেয়েও তার ভেতরের অনুভূতি হাহাকার করে ওঠল। হৃদয় গহিন থেকে জাগ্রত হলো একটিই কথা। যে চোখে প্রেম, ভালোবাসা ছিল না সে চোখ দেখে সৌধ ভাই প্রেমে পড়ল। ভালোবেসে ফেলল বিশুদ্ধভাবে। তবে যে চোখে তার জন্য অগাধ প্রেম আছে, প্রগাঢ় ভালোবাসা আছে। আছে তাকে পাওয়ার একরাশ তৃষ্ণা। সে চোখে তাকালে কি পাথর মনে ফুল ফুটবে না? গলবে না বিরহে ভরা বরফ টুকরো?
‘ সৌধ ভাই।’
কান্না মিশ্রিত ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনতেই পা দু’টো থমকে গেল সৌধর৷ পেছন ঘুরে দাঁড়াতেই সিমরানকে সম্মুখে আবিষ্কার করল। বলল,
‘ বল? ‘
‘ তুমি যাকে ভালোবাসো তার চোখে তাকিয়েছিলে তো। ‘
‘ বহুবার। ‘
অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল সৌধ। সিমরান বলল,
‘একটা অনুরোধ করব? ‘
‘হু?’
‘ সেই কিশোরী বয়স থেকে যে তোমাকে ভালোবাসে তার চোখের দিকে একবার তাকাবে? গভীর ভাবে। ‘
ঢোক গিলল সৌধ। সিমরানের ফর্সা মুখশ্রী কান্নার ফলে লালচে বর্ণে পরিণত হয়েছে। নাকের ডগাও রক্তিম। মেয়েটার ভেতর জেদ আছে। তেজও আছে। জানত সে। শুধু জানত না এই মুহুর্তে দেখা অসহায়ত্ব টুকুকে। এর পেছনে দায়ী সে নিজে। ভাবতেই তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব বিব্রত হলো। সুহাস যদি জানতে পারে আজকের ঘটনাটি। তাকে ক্ষমা করতে পারবে তো? শ্বাস রোধ হয়ে এলো। ভাবনায় বিভোর হয়েই সিমরানের চোখে চোখ রাখল সে। অশ্রুতে বড়ো বড়ো ঘন পাপড়ি গুলো জড়োসড়ো হয়ে আছে। জলপূর্ণ দৃষ্টি। ঝাপসা সে দৃষ্টিতে তীব্র অভিমান। প্রগাঢ় ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যান পেয়ে তীব্র অভিমানী দু’টো চোখ। ভিজে ওঠছে ক্ষণে ক্ষণে। নিঃশ্বাস আঁটকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে সৌধ। নির্নিমেষে সে চোখে তাকিয়ে শুধু একটা কোথাই ভাবছে, কার জন্য আঘাত দিলাম তোকে? নিধির জন্য, নিজের জন্য নাকি তোরই জন্য।
‘ সৌধ ভাই? ‘
‘ হু? ‘
‘ তুমি কেন নিধি আপুকে এতখানি ভালোবাসলে? আমায় কেন একটুও ভালোবাসলে না। আমাকে যদি অল্পখানিও ভালোবাসতে তোমাকে এত দুঃখ পেতে হতো না, আমিও এতখানি দুঃখ পেতাম না। ‘
সৌধ নিশ্চুপ। সিমরানের দুই গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ল। ভাঙা কণ্ঠে ফের বলল,
‘ আমাকে ভালোবাসলে কী খুব ক্ষতি হতো? ‘
এতক্ষণ অনেক কথা বললেও এ মুহুর্তে উত্তর খুঁজে পেল না সৌধ। রক্তিমা, অসহায় মুখশ্রীর সিক্ত দৃষ্টিজোড়ায় তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। ভাবতে লাগল দ্বন্দ্বময় অজস্র ভাবনা৷ অনুভব করল তার বুক কাঁপছে। কেন কাঁপছে?
আচম্বিতে সম্মুখের নারী শরীর, অসহায় মুখ আর জলপূর্ণ চোখ দুটি মিলিয়ে গেল৷ সিমরান চোখের পানি মুছতে মুছতে এক ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে গেল৷ সৌধ স্তব্ধ মুখে অবশ দেহে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এদিকে তীব্র অভিমান বুকে চেপে, ভগ্ন হৃদয়ে অটোতে ওঠে বসল সিমরান। সৌধ ভেবেছিল সে গাড়িতে গিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণ পর এসে যখন দেখল সিমরান গাড়িতে নেই৷ আশপাশে তাকিয়েও খুঁজে পেল না। তখন সাত্তার চাচার কাছে ছুটে গেল। জিজ্ঞেস করলে সাত্তার চাচা বলল,
‘ মেয়া তো অটোত কইরা চইলা গেল। ‘
চমকে ওঠল সৌধ। দেরি না করে তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। সিমরান যে অটোতে ওঠেছে সেটা ধরতে সময় লাগল না তার। শুধু নিশ্চিত হয়ে নিল সিমরান ঠিক আছে৷ এরপর বাড়ি পর্যন্ত অটোর পিছু পিছু এলো সৌধ। সিমরান নেমে বাড়িতে ঢুকছে দেখে নিয়ে অতঃপর সে রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল। গাড়ি ঘুরালো নিজের বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরে প্রথম যে কথাটি শুনল তা বলল তার দাদুনি। কারণ সে সিমরানকে একদমই পছন্দ করে না। আর সৌধ তার অতি পছন্দের নাতি৷ তাই তাদের বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন কঠিন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ওই মেয়েকে বাড়ির বউ করো না। কেউ তার নিষেধ মানছিল না। আজ সিমরান নিজেই ফোন করে বিয়েতে অমত পোষণ করেছে। তাই দাদুনি বেজায় খুশি। বেশ খোশমেজাজে সে এসে সৌধকে জানালো,
‘ শুনছ দাদুভাই ঐ দস্যি মেয়ে বিয়েতে না করে দিছে। আল্লাহ কতবড়ো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিল তোমারে। অমন দস্যি মেয়ের স্বামীর হওয়ার চেয়ে চিরকুমার থাকা ঢেড় ভালো। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৬|
অন্ধকার আছে বলেই আলোর মর্ম বোঝা যায়৷ প্রকৃতির নিয়মেই রাত্রির আগমন ঘটে। তাই বলে কি মানবকূল বিচলিত হয়? নাহ, তারা অপেক্ষা করে প্রভাতের। তারা জানে সন্ধ্যায় যে সূর্য অস্ত যায়। সময়ের চাকা ঘুরে সে সূর্য উদিতও হবে। মানুষের জীবনে সুসময়, দুঃসময়, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ঠিক সূর্যাস্ত আর সর্যদয়ের মতোন। আজ দুঃখ পেয়েছ? অপেক্ষা করো কাল সুখী হবে। প্রাপ্তির খাতা আজ শূন্যতায় ভুগছে? সবুর করো কাল পরিপূর্ণতায় রূপ নেবে। মানুষের জীবনের এই ধারাবাহিকতা চলছে, চলবে৷
কেটে গেছে কয়েকটি সপ্তাহ। এরই মধ্যে বেশকিছু হসপিটালে এপ্লাই করে রেখেছে কার্ডিওলজিস্ট সৌধ চৌধুরী। পরিবার, বন্ধু কাউকে না জানিয়েই। নিজের হার্টের অবস্থা যখন বিধ্বস্ত তখন সে কী করে অন্যের হার্টের চিকিৎসা দেবে? এমন প্রশ্নবাক্যকে পুঁজি করেই সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে কাটিয়েছে এতদিন। এবার কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। হৃদয় থেকে অনুভব করছে তার ভালো থাকা উচিত। ক্যারিয়ারে ফোকাস করা উচিত। সর্বোপরি তাকে যারা ভালোবাসে তাদের কষ্ট দেয়া অনুচিত। যে ভালো থাকতে ছেড়ে গেছে সে ভালো থাকুক। সে ক্ষত টুকু নিয়েই না হয় ঘুরে দাঁড়াক।
তানজিম চৌধুরী খবর পেয়েছে ছোটো পুত্রধন আর নেশা করছে না। দিনে একটা, দু’টো সিগারেটেই সীমাবদ্ধ থাকছে। মাতৃহৃদয় এখন অনেকটাই শান্ত। কিন্তু সৌধ আচমকা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়াতে চিন্তায় পড়েছিল। সে চিন্তা দূর হলো শাশুড়ির কথায়। সৌধর দাদুনি আশায়রা বলেছেন,
‘ বড়ো বউ তুমি খেয়াল করছ কিনা জানি না।সুহাসের বোন বিয়েতে না করার পর থিকাই দাদু ভাই স্বাভাবিক হইতেছে। তোমরা তো জোর কইরা চাপাই দিতে চাইছিলা৷ এখন বুঝলা তো তোমার ছেলের আসল ভালো কোথায় ছিল? ‘
শাশুড়ির কথা শুনে আশ্বস্ত হয় তানজিম। যদি এটাই সত্যি হয় বেশ তো। ছেলেটা ভালো থাকুক এটাই মূখ্য বিষয়। একজন মায়ের এর বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না। সিমরান বিয়েতে না করেছিল বলে অভিমান হয়েছিল তার৷ কিন্তু ছেলেকে ভালো থাকতে দেখে সব অভিমান কেটে গেল। মনে মনে ভাবল, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সিমরানকে।
নতুন একটি সূর্যের আবির্ভাব। ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি গায়ে মাখিয়ে শরীরচর্চা করল সৌধ। এরপর ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে নিচে এলো। রুমে গিয়ে গোসলের প্রস্তুতি নিতেই সেলফোন বেজে ওঠল৷ আইয়াজের ম্যাসেজ করেছে,
” ওয়েল ডান দোস্ত। আমরা খুব খুশি। পুরোনো সৌধকে খুব মিস করছিলাম। ”
ম্যাসেজটা দেখে বাঁকা হাসে সৌধ। শরীরচর্চা করার সময় ছোট্ট একটি ভিডিও করে পোস্ট করেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেটা দেখেই আইয়াজ ম্যাসেজটি করেছে। সে পাল্টা ম্যাসেজ করল,
‘ ভাবছি বিগ বস ক্লাব থেকে ট্যুর দিব একটা। তুই আর সুহাস তো ব্যস্ত। বাকি সদস্যদের নিয়ে যাই কী বলিস? ‘
‘ সিয়র, নো প্রবলেম। আমাদের ঝিমিয়ে পড়া গ্যাংটাকে তুইই পারবি সচল করতে। ‘
সৌধ আর কোনো রিপ্লাই দিল না। লম্বা শাওয়ার নেবে এবার। পরের সিদ্ধান্ত অনেকদিন পর পরিবারের সঙ্গে বসে সকালের নাস্তা করবে। কয়েকদিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে ক্লাব থেকে দীর্ঘ ট্যুরে যাবে। দৃঢ় বিশ্বাস এরই মধ্যে পছন্দ সই কোনো না কোনো হসপিটালে জয়েন করতে পারবে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্তও নিল। নিজের পরিকল্পনার কথা কাউকেই জানালো না। যারা একবার ব্যর্থ হয় তারা কখনো জীবনের আর কোনো সু পরিকল্পনা কাউকে জানাতে পারে না। আসলে পূর্বের জোশটা আর থাকে না। সবকিছু ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। আর অপেক্ষা করে সময়ের। নিজের ওঠে দাঁড়ানো, সফলতা মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে দেখিয়ে দেয়ার।
.
.
ভোরবেলা। কাজের মেয়েটার সঙ্গে মিলে নাস্তা বানাচ্ছে উদয়িনী। শরীরটা ভালো নেই। মেয়েকে নিজ হাতে কিছু বানিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে বলেই রান্না ঘরে আসা৷ বয়সের সাথে সাথে মানুষের মানসিক অনেক পরিবর্তন ঘটে। উদয়িনীর মাঝে যেন সেই পরিবর্তন লক্ষনীয়। কিছুদিন আগেই
রিটায়ার করেছে সে কিন্তু অফিশিয়ালি বিদায় হয়নি। সামনে মাসে বিদায় পর্ব। এরই মাঝে চলে এসেছে বাড়িতে। বাড়ি ফেরার পর যখন প্রথম সিমরানকে দর্শন করল। আত্মা কেঁপে ওঠেছে তার। অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়েছে টপ টপ৷ কী অবস্থা তার মেয়েটার? সিমরান নিঃসন্দেহে একজন সুন্দরী তরুণী। কিন্তু উদয়িনী তার মাঝে কোনো সৌন্দর্য্য খুঁজে পায়নি। যে বয়সে মেয়েদের লাবণ্য বৃদ্ধি পায়। সে বয়সে সিমরানের লাবণ্য ম্রিয়মাণ। চৈত্রের খরা মানুষের দেহে, মুখশ্রীতে এভাবে দৃশ্যমান হয়? উদয়িনী মেয়ের মাঝে ঠিক যেন চৈত্র মাসের খরা দেখতে পেল। স্বাস্থ্যের অবনতি যে মেয়ের ওজন দুমাস আগে ছিল পঞ্চাশ কেজি। বর্তমানে তার ওজন কিনা ঊনচল্লিশ! রূপ লাবণ্যের অবনতি এতটাই যে এই মেয়েটার গায়ের বর্ণ দুধে আলতা ছিল এখন দেখে কেউ বিশ্বাসই করবে না৷ পড়াশোনার অবস্থাও করুণ৷ সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট খারাপ এসেছে৷ সবমিলিয়ে মেয়ের শোক
জেঁকে ধরল উদয়িনীকে। ছেলেকে ফোন করে কান্নাকাটি করল। সুহাস মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সিমরানের খেয়াল রাখতে বলে ফোন রেখে দিল৷ সে এখন ভীষণ ব্যস্ত৷ উদয়িনী মেয়েকে নিয়ে তীব্র দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করে। জোর করে ভালোবাসা পাওয়ার লড়াইয়ে যদি সে হেরে না যেত। সংসার জীবনে যদি অসুখী না হতো। স্বামীর চোখে যদি এতটা নীচ না হতো তবে মেয়ের জন্য সৌধকে যেভাবেই হোক নিয়ে আসত৷ নিজের জীবনকে বাজি রাখা যায় কিন্তু সন্তানের জীবন বাজি রাখা অসম্ভব। আজকাল সুনিশ্চিত ভবিষ্যতও দূর্ভাগ্য বয়ে আনে। সেখানে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে দূর্ভাগ্য তো নিশ্চিত হবেই।
সিমরান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এদিকে ফোন রিংটোন বাজতে বাজতে থেমে গেল। একবার, দু’বার এমন করে চারবার ফোন এলো আর থামল। পাঁচবারে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তার। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে অচেনা নাম্বার দেখে রিসিভ করে কানে ধরল। চোখ দু’টো বন্ধ, ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে৷ ঘুম কাতুরে কণ্ঠস্বরে বলল,
‘ কে বলছেন? ‘
ওপাশটা নীরব রইল কিয়ৎক্ষণ। এরপর সহসা ভেসে এলো একটি আদুরে, মিষ্টি কণ্ঠ,
‘ সিনুপি হাউ আর ইউ? ‘
ঝড়ের গতিতে ঘুম ছুটে গেল সিমরানের। ত্বরিত ওঠে বসল সে। বাম কান থেকে ডান কানে ধরল ফোনটা। হকচকানো কণ্ঠে বলল,
‘ তাহানী! আই এম ফাইন বনু। তুমি কেমন আছো? হাউ আর ইউ কিউটি? ‘
আদুরে স্বরে তাহানী উত্তর দিল,
‘ আই এম ভেরী ওয়েল সিনুপু। ‘
সহসা খিলখিল করে হেসে ওঠল সিমরান৷ নিজের এলোমেলো চুলগুলো এক হাতে গুছিয়ে নিয়ে বলল,
‘ তাহানী বুড়িটা আমাকে মিস করছে বুঝি? ‘
ওপাশ নীরব। একটুক্ষণ পর মিষ্টি সুরটা ভেসে এলো আবার,
‘ ইয়েস, আই ডু। ‘
হাসির মাঝেও কান্না এসে গেল সিমরানের। ঐ বাড়ির প্রতিটা মানুষের প্রতি যে অগাধ মায়া জন্মেছে বুকে। তা কাটাবে কীভাবে? এতগুলো দিনে বুক যে তার শুকিয়ে ওঠেছে। কী নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার সে। গলায় আঁটকে থাকা কান্নাগুলো সযত্নে গিলে ফেলল সিমরান। এরপর জিজ্ঞেস করল,
‘ চলে এসো বেবি। আমরা একসঙ্গে খেলব, খাব, ঘুমুবো। আসবে? ‘
ওপাশে উৎসাহিত স্বর,
‘ ইয়েস, ইয়েস। ‘
‘ তবে দেরি কেন? পাপার অনুমতি নিয়ে চলে এসো।’
সৌধর ছোটো চাচার মেয়ে তাহানীর সঙ্গে কথা শেষ হলো। ফোন কাটতেই সিমরানের মনে পড়ল, নাম্বারটা কার জিজ্ঞেস করা হয়নি৷ তাহানী একা একা তার নাম্বার খুঁজে ফোন দিতে পারবে না৷ কেউ তাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু কে? তানজিম আন্টি? নাহ সে তো রেগে আছে তবে ছোটো আংকেল? নাম্বারটা কী নামে সেভ করবে বুঝতে পারছিল না সে। অনেক ভেবেচিন্তে তাহানী নামেই সেভ করল। এরপর সারাদিন অপেক্ষা করল। তাহানীর জন্য। তাহানী এলো না। আর না এলো সেই নাম্বার থেকে ফোন। ভাবল, তাহানী বাচ্চা মানুষ। হয়তো তার বায়নায় কেউ বাধ্য হয়ে ফোন করেছিল৷ শিশু মস্তিষ্ক তারপরই ভুলে গেছে তাকে। সে আর বায়না করেনি। আর না কেউ মিটিয়েছে তার বায়না৷ এ পর্যায়ে তাহানীকে হিংসে হলো খুব। ভাবল, ছোটোরা কত সহজেই সব ভুলে যায়। তবে বড়োরা কেন ভুলতে পারে না? তবে কি বড়ো হওয়া অভিশাপ! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সিমরানের৷ নিজের দুঃখ গুলো শেয়ার করার মতো একটা মানুষও নেই তার। নামী ইন্টার্ন ডক্টর হিসেবে জয়েন করেছে। থাকে গাজীপুর। এখন আর তাকে সময়ে, অসময়ে কাছে পাওয়া যায় না। আপন মনেই হাসল সিমরান। ফোন করল বান্ধবী লুনাকে। বলল,
‘ ন’টায় বেরুতে পারবি? শহর ঘুরব। ‘
লুনা বলল,
‘ সাতসকালে কে শহর ঘুরে? শহর ঘুরতে হয় রাতের বেলা। ‘
‘ আমার কাছে সাতসকাল বলে কিছু নেই৷ প্রতিটা সময়ই রাত। ‘
‘ দোস্ত সিগারেট খাবি? ‘
‘ কতবার না করেছি? ‘
‘ আরে ইয়ার ছ্যাঁকা খেলে সিগারেট খাওয়া বৈধ হয়ে যায়। ‘
‘ বাজে বকিস না তো। ফুল ফ্যামিলি ডাক্তার আমার। আমি সিগারেট খেলে মানাবে না৷ একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না জান। প্লিজ, প্লিজ। ‘
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান। ধমকে বলল,
‘ ফ্রেশ হবো। সময় মতো কলাবাগান দাঁড়াবি। ‘
.
.
বহুদিন পর গিটারিস্ট সৌধর আগমন ঘটেছে। ছাদে একাকী বসে গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলছে সে৷ রাতের সময় তখন কত জানা নেই। চারপাশে নীরবতায় আচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ রজনী। আকাশে তাঁরার মেলা। মধ্যিখানে হাস্যজ্জ্বল চাঁদের বুড়ি। ছাদের একপাশে বসে সৌধ। আকাশে চাঁদের বুড়ির পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তার শান্ত হৃদয় আর শীতল দৃষ্টিতে হাতছানি দিল বিস্ময়কর কেউ। দু-চোখের তারায় ভেসে ওঠল কৃষ্ণবর্ণীয় একজোড়া ঝাপসা দৃষ্টি। নিমেষে দু’হাতের আঙুল গুলোয় চঞ্চলতা বৃদ্ধি পেল। ছাদ থেকে নিচ পর্যন্ত শুনতে পাওয়া গেল গিটারের সুর। মনে হলো এই সুরকে আজ থামানো সম্ভব না। তবু থেমে গেল৷ সৌধ চৌধুরীকে থামিয়ে দেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা যার সেই থামালো। ফোনের শব্দ পেয়ে বা’হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে অচেনা নাম্বার দেখল সৌধ। ত্বরিত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। যা তার মস্তিষ্ক বিগড়ে দিতে কৃপণতা করল না। ওপাশের মানবী বলল,
‘ কেমন আছিস সৌধ? ‘
আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেলে যেমন ঘর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সৌধ আপাদমস্তক তেমনি নিভে গেল৷ ক্রমশ চোয়াল দ্বয় কঠিন হয়ে এলো তার। এক পর্যায়ে তীব্র ক্রোধে হাত, পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ওপাশের মানবী সৌধর থেকে উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,
‘ জানি ভালো নেই। বিশ্বাস কর তোকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজেও ভালো নেই। সৌধ, ইদানীং আমার শরীরটা ভালো যায় না রে। ডেলিভারির টাইম যত ঘনিয়ে আসছে ততই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। আমি জানি একজন ডক্টর হিসেবে এমন কথা অতি লজ্জার। তবু কেন এত ভয় পাচ্ছি নিজেও জানি না। আমি একটা আবদার করব সৌধ রাখবি? প্লিজ, একটা দিন জাস্ট একটা দিন সময় দে আমাকে। দেখা কর। আমি সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী সবাইকে কল করেছিলাম রে। কেউ রাজি হয়নি। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। সবার এই ব্যস্ততা থেকে আমার জন্য একটা দিনও সময় নেই। ‘
তীব্র আফসোস ঝড়ে পড়ল নিধির কণ্ঠে। সৌধ এবার অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ তোর স্বামী কোথায়? ‘
‘ জানি না। তার সাথে আমার জোনো যোগাযোগ নেই। ‘
‘ থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব। ফাইজলামি করিস? সময় চাস আমার কাছে সময়? এই সময়টা তোর বরের কাছে চা ইডিয়ট! ‘
‘ সৌধ…’
‘ শাট আপ! কী করে ভাবলি তোকে আমি সময় দিব? সিরিয়াসলি! তোর মনে হয় পরের বউয়ের জন্য আমার সময় আছে? ডক্টর অর্পণ শিকদারের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে চাস আমাকে? শ্যাম অন ইউ নিধি, জাস্ট শ্যাম অন ইউ। ‘
আর এক মুহুর্তও নিধির কথা তো দূরে থাক। শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও সহ্য করতে পারল না সৌধ। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে গিটার রেখে ওঠে দাঁড়াল সে৷ বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বিরবির করে বলল,
‘ ওই অর্পণকে বিয়ে করার সাথে সাথে তোর বোধবুদ্ধি সব গিলে খেয়েছিস নিধি। বড্ড সাহস বেড়েছে এখন তাই নারে? এই সাহসটা অন্য একজন পুরুষকে জীবনে জড়িয়ে তার সন্তান গর্ভে ধারণ করার আগে দেখানো উচিত ছিল৷ শোন নিধি সম্পূর্ণ হুঁশে থেকে আজ তোকে বলছি, সৌধ চৌধুরী তোর জন্য উন্মাদ ছিল সত্যি, কিন্তু ভুলবশতও চরিত্রহীন হতে পারবে না। আমি তোকে ভুলতে চাই না এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য আমি তোকে ছাড়া ভালো থাকতে চাই। ইয়েস, আই ওয়ান্ট টু বি ব্যাটার উইথআউট ইউ! ‘
শেষ বাক্যটি প্রচণ্ড চিৎকার করে বলল সৌধ। যা বার বার বাতাসের বেগে প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছেই ফিরে এলো।
প্রকৃতির নিয়ম এটাই। সময় বহমান। আর মানুষ পরিবর্তনশীল। দুঃখকে আলিঙ্গন করে সুখের পথে পা বাড়ানোই মানুষের ধর্ম। আমি, আপনি বা সৌধ কেউই এই ধর্মের ঊর্ধ্বে নয়।
চলবে..
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৭|
প্রকৃতির যৌবন মাস চলছে। আকাশ, বাতাস, মাঠ, মাটি সর্বস্তরই নিজের যৌবন দ্বারা সুবাসিত করে রেখেছে শরৎরানি৷ আকর্ষিত মানব চিত্ত। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুভ্র আলোকরশ্মি আর স্নিগ্ধ আবহাওয়া। প্রকৃতির এই রূপকে ভীষণ ভালোবাসে নামী৷ তার সেই ভালোবাসায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল সুহাস৷ জানালো, পরশু তারা রাঙামাটি বেড়াতে যাবে। শুধু তারাই নয় আইয়াজ, ফারাহও যাচ্ছে। সরকারি ছুটি পড়েছে। এই সুযোগে ঘুরে আসবে তারা৷ কথানুযায়ী ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঢাকা চলে এলো নামী। সুহাসের কোয়াটারে। এসেই জানতে পারল আইয়াজ, ফারাহও এসেছে। অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে কাছে পেয়ে বিগলিত চিত্তে ফারাহকে জড়িয়ে ধরল নামী। সুহাস এ দৃশ্য দেখে ঢঙ করে আইয়াজকে জাপ্টে ধরল। নামী খেয়াল করে সঙ্গে সঙ্গে ফারাহকে ছেড়ে সুহাসের দিকে তেড়ে গেল। সুহাস অমনি বন্ধু আর বন্ধুর বউয়ের সামনে জড়িয়ে ধরল নামীকে। লজ্জায় মূর্ছা গেল নামী। সুহাসের বুলে কিল বসিয়ে বলল,
‘ নির্লজ্জ। ‘
সুহাস দুষ্টুমি ভরে হাসল। ওর ছোট্ট ললাটে গভীর ওষ্ঠ স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ ইয়েস সম্পূর্ণ লজ্জা বর্জিত স্বামী তোমার। ‘
ওদের কাহিনি দেখে আর সুহাসের কথা শুনে ফারাহর মুখটা লজ্জায় লাল টমেটো হয়ে গেছে৷ খেয়াল করে চোখের চশমা ঠিক করতে করতে গলা খাঁকারি দিল আইয়াজ। অমনি সুহাস ছেড়ে দিল নামীকে। বলল,
‘ ধূরর দুইজোড়া তাকালে সমস্যা ছিল না। এ তো দেখি চার জোড়া তাকিয়ে আছে। ‘
ফারাহ স্তব্ধ। এই সুহাস ভাই আর বদলালো না। একই রয়ে গেল৷ খুব লজ্জায় ফেলে দেয় সবাইকে। আইয়াজ বলল,
‘ তোরও একজোড়া চোখের প্রয়োজন। চশমাকে চোখ বলছিস। নামী এক কাজ করো তো সুহাসকে চোখের ডাক্তার দেখাও। ‘
বেশ লম্বা সময় ওদের খুনসুটি চলল। যার অবসান ঘটল আইয়াজের ফোনে সৌধর ফোনকল এলে। আইয়াজ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সৌধ বলল,
‘ এই বদমাশ! স্টেশনে থাকতে বলেছিলাম তোকে। ‘
‘ দোস্ত বিলিভ মি থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফারাহ অসুস্থ ফিল করছিল বলে চলে আসছি। ‘
‘ বউ ছাড়া দেড় মিনিট চলতে পারিস না সেটা বল। থাকার ইচ্ছে থাকলে বউ রেখেও আসতে পারতি। ‘
আইয়াজ প্রচণ্ড নার্ভাস ফিল করতে লাগল। খেয়াল করে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল সুহাস৷ কতগুলো মাস হয়ে গেল। সৌধর সঙ্গে নিজে থেকে যোগাযোগ করে না সে। সৌধও ব্যস্ত খুব। নিজের স্বপ্ন পূরণে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছে। দেড়মাস হলো চট্রগ্রাম মেডিকেলে হার্ট সার্জন হিসেবে জয়েন করেছে সৌধ। এর মাঝে কথা হয়েছে বার দুয়েক। তবু সে ফোন করেনি৷ সৌধ নিজেই ফোন করেছে৷ নিজের হালচাল জানিয়ে জেনে নিয়েছে তার হালচাল। বহুদিন পর বোধহয় স্বেচ্ছায় সৌধর সঙ্গে কথা বলল সুহাস। আইয়াজের থেকে ফোন নিয়েই সে বলল,
‘ পৌঁছে গেছিস? ‘
সৌধ একটু অবাকই হলো। পরোক্ষণেই ভাবল, পৃথিবীর কোনো শক্তি কি তাদের বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে? ভেবেই আলতো হেসে বলল,
‘ এইতো পৌঁছালাম। আগামীকালের টিকেট কেটেই আসছি। ‘
‘ আগামীকালই ফিরে যাবি? ‘
‘ ফিরব না কী করব? তোদের ব্যাগপত্রে ওঠিয়ে আমাকে সাজেক নিয়ে যাওয়ার ধান্ধা করছিস নাকি। শোন সুহাস, আমি ব্যাচেলর হতে পারি। কিন্তু কাবাব মে হাড্ডি না। ‘
দু বন্ধুর কথোপকথন চলল বেশকিছুক্ষণ। এরপর ফোন রেখে দিল সৌধ। সুহাস আইয়াজকে ফোন ফেরত দেয়ার সময় বলল,
‘ ওর ডেলিভারির ডেট কবে? ‘
আইয়াজ ধাতস্থ হয়ে উত্তর দিল,
‘ সামনে সপ্তাহ। রবিবার। ‘
‘ আমরা ঘুরে এসে নবজাতক সহ দেখা করব। কিন্তু সৌধ কি তখন আসতে পারবে? ‘
‘ মেবি না তবু কথা বলে দেখিস। নিধির ইচ্ছেটুকু জানাস। ‘
নিধি চায় ডেলিভারির আগে একবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ব্যস্ততা কাটিয়ে নিজেদের জন্য সময় বের করেছে আইয়াহ, সুহাস। যদি নিধির সঙ্গে সম্পর্কটা আগের মতো থাকত। তাহলে নিজেদের জন্য বাছাই করা সময় অনায়াসে দিয়ে দিত। কিন্তু পরিস্থিতিটা আজ এমন যে নিধিকে সময় দিতে গেলে ওদের বন্ধুদের তীব্র অস্বস্তি জড়িয়ে ধরে। সবচেয়ে বড়ো কথা যে স্থানে সৌধর থাকার কথা ছিল। সে স্থানে অর্পণ স্যারকে মেনে নিতে পারে না ওরা। শুনেছে অর্পণ স্যারের সঙ্গে ঝামেলা ঠিক হয়েছে নিধির৷ হবে নাই বা কেন? ক’দিন পর নতুন অতিথি আসবে। এসেই যদি বাবা, মা’কে সেপারেশনে দেখে ভালো লাগবে ওর? শিশুটা তো নিষ্পাপ। যা কিছু হচ্ছে এর জন্য ও তো কোনোভাবেই দায়ী নয়৷ নিধি, অর্পণ দু’জনই পূর্ণ বয়স্ক এবং শিক্ষিত। স্পেশালি দু’জনই ডাক্তারি প্রফেশনে আছে৷ তাই একটি শিশুর ভালো, মন্দ তারা দু’জনই খুব ভালো বুঝবে৷ পাশাপাশি নিজেদের ভুল গুলোও টের পাবে। দূরে গিয়ে ভুলবোঝাবুঝি বাড়ানোর চেয়ে। কাছে থেকে ভুল শুধরে নেয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
.
.
নামী আর ফারাহ মিলে রান্নাঘরে। আর তিন বন্ধু ড্রয়িং রুমে কফি আড্ডা দিচ্ছে। কখনো ওরা পুরোনো দিনে ফিরে গেল। কখনো বা ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করল। হঠাৎ আইয়াজ বলল,
‘ সামনে সপ্তাহে নিধির ডেলিভারি। ও তো আমাদের খুব পুরোনো বন্ধু। আমাদের কি উচিত না ওর সঙ্গে একটিবার দেখা করা। নতুন অতিথিকে ওয়েলকাম করা? ‘
ওরা তিন বন্ধু ভীষণ ঘনিষ্ঠ। যখন একাকী একসঙ্গে সময় কাটায় তখন বাঙালি আর পাঁচ জন ছেলে বন্ধুদের মতোই মিশে যায়। একে অপরের সঙ্গে মারপিট করে, গালাগালি করে। সবচেয়ে বেশি গালি দেয় সুহাস। সৌধ দু একটা সহজ গালি দিয়ে ফেলে। আইয়াজ এমনিতে ভোলাভালা সভ্য হলে কী হবে। কলিজা পঁচানো গালি সেও জানে। প্রয়োজন পড়লে সে গুলো ব্যবহার করে প্রয়োজন ব্যতীত ব্যবহারিত হয় না৷ এ মুহুর্তে আইয়াজের বলা কথাগুলো আশা করেনি সৌধ। মানুষ কি তার জীবনের দূর্ঘটনা গুলো বার বার স্মরণ করতে চায়? দেখতে চায় ফেলে আসা দুঃস্বপ্ন? নিধি সৌধরও বন্ধু। তবু বন্ধুত্বের বাইরে গিয়ে নিধির প্রতি যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তা যে আজ ক্ষতবিক্ষত। সে ক্ষত আজ সেরে ওঠলেই দাগ ঠিকই রয়ে গেছে। সে দাগকে দু-চোখে দেখার আগ্রহ পায় না সৌধ। তাই আওয়াজের বলা আকস্মিক কথাটায় মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল তার। বেমালুম ভুলে গেল সে কোথায় আছে। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
‘ ধূরর বা*ল! এসবের জন্য ডেকে এনেছিস? ‘
‘ ছিঃ সৌধ ভাই! এসব বলে না। আপনিও এসব স্ল্যাং ইউজ করেন? ‘
থতমত খেয়ে গেল সৌধ। চমকে গিয়ে তাকাল নামীর দিকে। নিমেষে মুখ কঠিন হয়ে ওঠল ওর। নামী ভয় পেল একটু৷ সৌধ মুখ ফিরিয়ে নিল। সুহাস নামীর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কী চাই? ‘
‘ কফির মগ গুলো নিতে এসেছিলাম। ‘
‘ নিয়ে যাও। ফ্রেন্ড সার্কেল কথা বললে এসব হয়েই থাকে। তুমি কান দুটো বন্ধ করে কাজ করো। ‘
নামী আপাতত কিছু বলল না। সৌধ সম্পর্কে তার ধারণা অন্যরকম৷ তাই আকস্মিক ছোট্ট একটি গালি শুনে ভড়কে গিয়েছিল৷ খেয়াল করল সৌধও অস্বস্তি বোধ করছে৷ তার বোধহয় এভাবে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি৷ সৌধ সবার কাছে যেমনি হোক৷ বন্ধুদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বন্ধুসুলভই থাকে? ধূর বোকামি করে ফেলল। নামী কফির মগ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেলে মুখ খুলল সৌধ।
‘ বন্ধুর জন্য বড্ড বেশি দরদ উতলাচ্ছে তোদের। যা তোরা গিয়ে দেখা করে আয়। বেবিকে ওয়েলকাম কর। আমার পক্ষে পসিবল না। কারণ হিসেবে আপাতত উত্তর একটাই। ঐ বেবিটা আমার না। অথচ ও আমার হতে পারত! ‘
পরিবেশ গুমোট হয়ে গেল৷ নীরবতায় কাটল দীর্ঘক্ষণ। সুহাস, আইয়াজ নিধি বিষয়ে আর কথা এগুলো না। অন্য গল্পে চলে গেল সুহাস৷ চিন্তান্বিত গলায় বলল,
‘ ডিসেম্বরে নামী ইউ এস এ যেতে চায়। আমাদের দুজনেরই পাসপোর্ট আছে৷ ভিসার জন্য জোরাজোরি করছে। এদিকে মা বলেছে ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক ভাবে নামীকে ঘরে তুলবে৷ দুজনের দুরকম সিদ্ধান্তের মাঝখানে পড়ে গেছি আমি। ‘
আইয়াজ কোনো মন্তব্য করল না। বিবাহিত জীবন সহজ নয়৷ পারিবারিক বহু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়৷ জানে সে। তাই নিশ্চুপ রইল। সৌধ পিঠ এলিয়ে বসেছিল৷ সুহাসের কথায় সোজা হলো। ভাবুক গলায় বলল,
‘ আন্টির কথা শুনে নামীর মতামত কী? ‘
‘ নামী জেদ করছে অত্যাধিক। এতদিন অপেক্ষা করানোর পর আরো সময় মা নেবে? মা যে খুশি মনে আমাদের জন্য আয়োজন করতে চাচ্ছে এটাই তো অনেক৷ নামী বুঝে না ব্যাপার গুলো। ‘
সৌধর বিশ্বাস হলো না। নামী এমন করতে পারে। তাই বলল,
‘ তুই বোঝাসনি? ‘
‘ ওর বাবা জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসবে। ও চায় অনুষ্ঠানে ওর পরিবারও উপস্থিত থাকুক। ‘
‘ চাওয়াটা অন্যায় নয়। এতবড়ো আয়োজন যখন হচ্ছে নামী বাবা উপস্থিত থাকুক। বেচারির মা নেই। বাবা থাকলে শান্তি পাবে। ‘
‘ কিন্তু মা…’
‘ তুই বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। এ বছর তাহলে দু’বার হানিমুন হচ্ছে তোদের। এবার বেবি প্লানিং করে ফেল সুহাস। ‘
মজার ছলে সৌধ কথাটা বলতেই আইয়াজ সুহাসের কাঁধ চেপে ধরল। বলল,
‘ সিরিয়াসলি দোস্ত। নিধির একটা ছেলে হোক আর সামনে বছর তোর আর নামীর মেয়ে আসুক। তারপর তোরা বেয়ান, বেয়ানি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলবি। ‘
ঝোঁকের বশে। গল্পে মজে ফের নিধির কথা ওঠল। সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকাল আইয়াজের পানে। আইয়াজ থতমত খেয়ে বলল,
‘ সরি। ‘
সৌধ থমকানো গলায় বলল,
‘ সরি আমার বলা উচিত। আমার কারণে এত বছরের গভীর বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। হাজার চাইলেও তোরা নিধিকে ভুলতে পারবি না। আসলে ভোলা যায়ও না। বন্ধু তো! ‘
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। ভুলতে কি সে পারছে? পারছে না। সবকিছুর পরও কোথায় যেন একটা টান রয়ে গেছে। আচমকা নীরব হয়ে গেল সৌধ। চারপাশে অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠল তার। অন্তঃকোণ বলে ওঠল,
‘ সামনে সপ্তাহে নতুন একটি প্রাণের আগমন ঘটবে। নিধির সন্তান সে। নিধি মা হচ্ছে… অথচ সে বাবা হতে পারল না। ‘
নিমেষে বুক ভার হয়ে গেল। আফসোস মিশ্রিত এক টুকরো নিঃশ্বাস বের হলো নাসিকা বেয়ে। বুকের গহীনে অসহ্য এক পীড়া শুরু হতেই ঝড়ের বেগে ভারিক্কি বুকটায় বর্ষণ নামল। একদম বিনা বজ্রপাতে। এ বর্ষণ আকাশ চিঁড়ে নয় এ বর্ষণের আগমন ঘটল কারো একজোড়া চোখ চিঁড়ে। কী আশ্চর্য! আজো ওই হরিণী চোখ দু’টির নোনাজল ভিজিয়ে তুলে তার বক্ষগহ্বরে খরায় আক্রান্ত মৃত্তিকাকে।
সৌধর শান্ত রূপ বন্ধুদের অশান্ত করে তুলল। সুহাস কাঁধ ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘ কী ভাবছিস? ‘
চমকে ওঠল সৌধ। অধর কামড়ে ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘ ভাবছি না, বোঝার চেষ্টা করছি। ‘
‘ কী? ‘
‘ পুরোপুরি বোঝার পর বলব। ‘
জীবনে কখনো কখনো এমন একটি সময় আসে। যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের বুঝতে পারি না, চিনতে পারি না৷ চেনা আমিটা যখন অচেনা হয়ে যাই। তখন চারপাশের সবকিছু অস্বস্তিকর মনে হয়। যে অস্বস্তি কখনো আমাদের অস্থির করে তুলে৷ কখনো বা জড়িয়ে ফেলে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায়।
সৌধর কথা শুনে সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ওদিকে নামীর গলা শুনতে পাওয়া গেল,
‘ সুহাস, তোমরা কি এখনি ডিনার করবে? নাকি লেট হবে। ‘
‘ লেট হবে। ‘
গলা উঁচিয়ে বলল সুহাস৷ ফিরতি কথায় নামী শুধাল,
‘ তোমরা আজ একসাথে থাকবে তো। রুম গুছিয়ে দেব? ‘
‘ দাও। ‘
বহুদিন পর আজ তিন বন্ধু একসঙ্গে রাত কাটাবে৷ বহুদিন পর দুই বান্ধবীও একসঙ্গে ঘুমাবে। আজ ওরা প্রত্যেকেই ভীষণ উল্লসিত।
.
.
ওজন মাপার মেশিন এখন সিমরানের ঘরেই রাখা হয়েছে। অবসর নেয়ার পর থেকে বেশ মন দিয়ে সংসার সামলাচ্ছে উদয়িনী৷ সেই সঙ্গে ছেলেমেয়ের কাছে ধরাও পড়েছে। রোজ গাদাগাদা ওষুধ সেবন করে উদয়িনী। তার ডক্টর ছেলে একদিন ধরে ফেলল মায়ের দেহে ডায়াবেটিস আছে। প্রেশার সব সময় হাই। আজ থেকে ছয় বছর আগেও একদম সুস্থ, সবল ছিল মা। অথচ আজ দেহে নানারকম রোগ ভর করেছে। কঠোর নিয়মে চলতে হয় উদয়িনীকে। সে নিয়ম মানার পাশাপাশি সিমরানের যত্নে ত্রুটি রাখে না। সারাজীবনের সব যত্ন যেন একবারে ঢেলে দিচ্ছে মেয়েটাকে। তিনবেলার এক বেলাও নিজহাতে ভাত খেতে হয় না সিমরানকে। যেন দিন দিন তার বয়স বাড়ছে না কমছে। অন্তত মায়ের আদর, ভালোবাসা দেখে তো সিমরানের তাই মনে হয়৷ মাঝে মাঝে ভাবে ভাগ্যিস মা তার প্রতি কেয়ারিং হয়েছে। নয়তো সৌধ ভাইকে না পাওয়ার যন্ত্রণা একদিন নিঃশেষ করে দিত তাকে।
রাতের খাবার তৈরি। মেয়েকে ডাকতে এসে ভ্রু কুঁচকাল উদয়িনী। সন্ধ্যা থেকে ফোন ঘাঁটছে মেয়েটা৷ এখনো সেই তালেই আছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সে। এগিয়ে এসে শাসনের সুরে বলল,
‘ আম্মুজান? এখনো ফোনে কী? অতিরিক্ত ফোন দেখলে স্বাস্থ্যটা আবার খারাপ করবে। চোখের নিচে আবার ডার্ক সার্কেল দেখা দেবে। রাখো ফোন। নিচে চলো খেয়েদেয়ে পড়তে বসবে। ‘
মায়ের মিষ্টি বকা খেয়ে হাসল সিরমান। ফোন রেখে ওঠতে ওঠতে বলল,
‘ কিচ্ছু হবে না আম্মু। তুমি আছো তো আমার পাশে। তুমি পাশে থাকলে আমার কিচ্ছু হবে না। ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে আমি। কোন অসুখের সাধ্য আমাকে গ্রাস করে? ‘
হিহি করে হেসে ফেলল সিমরান। মেয়েকে টেনে নিয়ে ওয়েট মেশিনে দাঁড় করাল উদয়িনী। উপরের ঠোঁট দ্বারা নিচের ঠোঁট চেপে ধরে ওজন দেখল। এরপর মৃদু হেসে বলল,
‘ বাহ নাইস! আটচল্লিশ হয়ে গেছ। ‘
আঁতকে ওঠল সিমরান। বলল,
‘ আল্লাহ! আর বাড়ানো যাবে না বুঝছ আম্মু। লোকে মটু বলবে। ‘
‘ ধূর পাগলী। পাঁচ ফুট তিন উচ্চতার মেয়েদের আটচল্লিশ কোনো ওজনই না। আরো বাড়াতে হবে। চলো খেয়ে নিবে। খাওয়ায় বড্ড অনিয়ম করো। আমার অনুপস্থিতিতে এসব করে করেই চেহেরার বাজে হাল করেছিলে। এখন আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখলে প্রাউড ফিল হয় না? ‘
হাসল সিমরান। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে উদয়িনী বলল,
‘ খাবারদাবার আর ঘুম এই দু’টো জিনিস ঠিকঠাক রাখবে। কোনোকিছু নিয়েই দুঃশ্চিতা করবে না। তাহলে মন, শরীর দু’টোই ফিট৷ আর সব সময় মনে রাখবে দুঃশ্চিন্তা তোমার জীবনে একবিন্দু সফলতাও এনে দিতে পারবে না। দুঃশ্চিন্তা মানুষকে গ্রাস করে নেয়।’
খাবার টেবিলে সব গুছানোই ছিল। উদয়িনী খুব যত্ন করে খাইয়ে দিল মেয়েকে। সিমরান নিজের ফোন ঘরে রেখে এসেছে। তাই মায়ের ফোন থেকেই বাবাকে কল করল। বাবা রিসিভ করতেই সে আহ্লাদী স্বরে বলল,
‘ মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো আব্বু? ‘
মেয়ের মুখ দেখেই মুখে হাসি ফুটল সোহানের৷ বলল,
‘ কী বাবা? ‘
‘ মনে হয় এতদিন আমি বড়ো ছিলাম। আর এখন শিশু বয়স পাড় করছি। ‘
কথাটা বলেই ক্যামেরা মায়ের দিকে তাক করল। উদয়িনীর মুখ দেখে হাসি প্রশস্ত হলো সোহানের। বলল,
‘ সেলিনা আসেনি আজ? ‘
‘ এসেছিল। সন্ধ্যায় চলে গেছে। ‘
মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে উত্তর দিল উদয়িনী। সোহান খন্দকার বলল,
‘ তোমায় ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘
সহসা চমকাল উদয়িনী। সোহান বলেছে তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এর মানে সুক্ষ্ম নজরে সোহান খেয়াল করেছে তাকে। আচমকা চোখ ঝাপসা হয়ে এলো উদয়িনীর৷ স্বামী আর মেয়ের চোখে ধরা পড়ার ভয়ে দৃষ্টি নত করে ভাত তরকারি মাখাতে শুরু করল। সিমরান ক্যামেরা নিজের দিকে ঘুরিয়ে উৎসুক হয়ে বলল,
‘ কবে আসবে আব্বু? মিস ইউ… ‘
‘ এইতো মা পরশু ফিরছি। ‘
.
.
ঠিক তিনদিন পর। আজ সেলিনা আপা আসেনি। গতকাল থেকে তার ছেলের ভীষণ জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে যাবে। উদয়িনী বলেছে ব্লাড টেস্ট করে রিপোর্ট এনে দেখাতে। গতরাতে উদয়িনী সিমরানকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। সকালে কী খাবে সে? হঠাৎ করেই সরষে ইলিশ খেতে চেয়েছে সিমরান। কারণ তার মামা গতকাল অনেক বড়ো একটি ইলিশ মাছ পাঠিয়েছে। আবদার শুনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উদয়িনী বলে,
‘ এটা কখনো করিনি। ইউটিউব দেখে শিখে নিব। খারাপ লাগলে নাক কুঁচকাবে না। ‘
সত্যি বলতে উদয়িনী এতকাল সেভাবে কোনো রান্নাই পারত না। অবসর নেয়ার পর সেলিনার কাছে আর ইউটিউব ঘেঁটে শিখেছে অনেকটাই। সরষে ইলিশ এখন পর্যন্ত রাঁধেনি সে। সিমরানের আবদার শুনে সকাল সকাল ওঠে ইউটিউব দেখে রাঁধবে সিদ্ধান্ত নেয়। রাতে একবার রেসিপিটা দেখেছে৷ সকালে আর একবার দেখলেই হয়ে যাবে।
নতুন আরো একটি সকাল। বেলা তখন ন’টা পঁচিশ। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সিমরানের। ঘড়িতে সময় দেখে চমকে ওঠে সে।’ কী ব্যাপার! আম্মু আজ এখনো ডাকতে এলো না। ‘ নাক ফুলিয়ে বসে রয় মেয়েটা। পরোক্ষণেই খুশিতে চিত্ত চঞ্চল হয়। নিশ্চয়ই আম্মু সরষে ইলিশ ট্রাই করতে গিয়ে তাকে ডাকতে আসতে পারেনি। আজ সেলিনা আপাও নেই। ইশ আম্মুর ওপর চাপ হয়ে গেল৷ ভেবেই দেরি না করে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে ঘরটা ফাঁকা। চুলা জ্বলছে না। তবে কি রান্না শেষ? আম্মু উপরে। ঠোঁট ফুলালো সে। গুটিগুটি পায়ে নাক বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। প্রতিটি কড়াই, পাতিলের ঢাকনা উঁচিয়ে উঁচিয়ে খুঁজল সরষে ইলিশের ঘ্রাণ৷ নিমেষে নিরাশ হলো সে। অভিমানে বুক ভার। তবে কি আম্মু রান্না করেনি? তাহলে সে এখন খাবে কী? তার যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উপরে ওঠে এলো সিমরান। মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে স্বাভাবিক শক্তিতে দরজা ধাক্কা দিতেই বুঝল ভেতর থেকে দরজা আটকানো। প্রথমে বিস্মিত হলো। এরপর রাগান্বিত হয়ে দরজায় মৃদু থাপ্পড় দিয়ে ডাকল,
‘ আম্মু, আম্মু দরজা খোল। ‘
ভেতর থেকে সাড়াশব্দ পেল না। আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল যেন। মুহুর্তেই ভাবনায় এলো, আম্মু কি ওয়াশরুমে গেছে? ধূরর। হতাশ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে দু’টো চকোলেট ছিল। তার থেকে একটি নিয়ে খেতে খেতে ফের মাকে ডাকতে এলো। ফের দরজায় ঠকঠক করতে করতে বলল,
‘ অ্যাঁই আম্মু, কী করছ তুমি দরজা খুলছ না কেন? খিদে পেয়েছে আমার। ‘
মেজাজ ক্রমশ খারাপ হতে লাগল এবার। আকস্মিক খেয়াল করল জানালা খোলা। দেরি না করে ছুটে এলো জানালার কাছে৷ চকোলেট চিবুচ্ছে সে৷ পাশাপাশি জানালা গলিয়ে ভেতরে তাকাতেই আশ্চর্য হয়ে গেল। সে কী! আম্মু যে এখনো ঘুমুচ্ছে। এবার গলার স্বর উঁচু হলো সিমরানের। ডাকতে লাগল অবিরত। এক পর্যায়ে তার আম্মু আম্মু ডাক আচমকা থেমে গেল। কেউ যেন সহসা বুকের ভেতর বিশাল এক পাথর চেপে ধরল । শ্বাসরোধ হয়ে এলো নিমিষে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে ওঠল। ঠোঁট দু’টিও একসঙ্গে চেপে রইল না। কাঁপতে শুরু করল তিরতিরিয়ে৷ সর্বাঙ্গ অবশ হতে গিয়েও এক ঝটকায় স্বাভাবিক করে নিল নিজেকে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘ তোমার কি শরীর খারাপ আম্মু? ও আম্মু, দরজা খোলো। দরজা না খুললে তোমার কাছে যাব কীভাবে? কী হয়েছে তোমার, জ্বর হয়েছে? ‘
আশপাশে অদ্ভুত ভাবে তাকাল সিমরান। মাথাটা ঘুরছে। ধীরেধীরে পা এগুলো। নিজের ঘরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন তুলল। কল করল আব্বুকে। ফোন রিসিভ হতেই ঢোক গিলে শান্ত গলায় বলল,
‘ আম্মু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি আব্বু। মনে হয় শরীর খারাপ। জানো আম্মু কী করেছে? দরজা ভেতর থেকে লক করে ঘুমিয়েছে। এত ডাকছি তবু ওঠছে না। এখন আমি কী করে ভেতরে যাব? ‘
কথাগুলো বলতে বলতে সিমরান অনুভব করল ওর কণ্ঠনালী দিয়ে আর কথা বেরুচ্ছে না৷ ওপাশে কী আব্বু কিছু বলল? সে তো শুনতে পেল না। যখন হুঁশ এলো দেখল ফোন কেটে গেছে। সিমরান শান্ত ভঙ্গিতে আবার মায়ের ঘরের সামনে চলে গেল। দরজা ঠকঠক শব্দে মুখরিত করল বারকয়েক। ডাকল,
‘ আম্মু, গলা শুঁকিয়ে যাচ্ছে ডাকতে ডাকতে। তুমি কি দরজা খুলবে নাকি রাগারাগি করব আমি? অনেকদিন আমার ভাঙচুর দেখো না তাই না। আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি আম্মু। ‘
এবারেও কণ্ঠনালী রোধ হয়ে এলো। ঘামতে শুরু করল সিমরান৷ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত। একটুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কল করল ভাই সুহাসকে। সুহাস রিসিভ করতেই সিমরান শান্ত কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,
‘ অ্যাঁই ভাই, আম্মু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি জানো? এত ডাকছি ওঠছেই না৷ দরজা লক করে ঘুমিয়েছে। আমি ভেতরেও যেতে পারছি না। ‘
‘ সাড়ে দশটা বাজে আর মা ঘুম থেকে ওঠেনি? সিনু বাবাকে কল কর। মায়ের শরীর খারাপ হয়তো। আমি মাকে কল করছি। ‘
সুহাস কেটে দিল৷ কিয়ৎক্ষণ পরই উদয়িনীর শিয়রে থাকা ফোনটা বাজতে লাগল অনবরত। সিমরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল বার বার ফোনটা বেজে কেটে যাচ্ছে। অথচ তার আম্মু ওঠছে না। আম্মুর ঘুম তো এত প্রগাঢ় নয়। সে ঘুমালে তার রুমে কেউ হাঁটাহাঁটি করলেও জেগে ওঠে। আজ তাহলে এত ঘুমাচ্ছে কেন? ঘুমের ওষুধ খেয়েছে কী? আচমকা হাতে থাকা ফোনটির রিং বাজতেই কেঁপে ওঠল সিমরান। স্ক্রিনে বাবা নামটা জ্বলজ্বল করছে।
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা