#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪২|
সৌধর মা তানজিম চৌধুরী। সিমরানকে খুব ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখেছে। সেদিনের সেই এক রত্তি মিষ্টি মেয়ে সিমরান। চোখের পলকে কতবড় হয়ে গেল৷ সচক্ষে দেখল, বাবা, মা, ভাইয়ের কাছে একরোখা, জেদি তকমা পাওয়া মেয়েটি আদর, ভালোবাসা, যত্ন পেলে কেমন মোমের মতো গলে যায়৷ মিলিয়ে যায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। তানজিম চৌধুরী দু’টো পুত্র আর একটি কন্যা সন্তানের জননী। উচ্চ শিক্ষিত হলেও ভীষণ সংসারী। স্বামী, সন্তান আর বিরাট সংসারেই সুখ খুঁজে পায় সে। সেই সুখের রাজ্যে রাজ করতে করতে সুখের উৎসর্গ সম্পর্কেও খুব জ্ঞান আহরণ করে। তার নিখুঁত দৃষ্টিতে পরিবারের সকল সদস্যই এক একটা বইয়ের মতো। দীর্ঘদিন সংসার করে, তাদের যত্নআত্তি নিয়ে , দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করার মাঝে এই বই গুলোর অনেক পৃষ্ঠাই পড়া হয়ে গেছে। তার চতুর দৃষ্টিজ্ঞান শুধু পরিবারেই সীমাবদ্ধ নয়৷ তার পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যার মধ্যে সিমরানও একজন। যে মেয়েটা ছোটোবেলা থেকে বাবা, মায়ের সঙ্গে অদৃশ্য দেয়াল দেখে বড়ো হয়েছে। শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনের যাত্রাটি যার আর পাঁচ জন সাধারণ মেয়ের মতো ছিল না। বড্ড ভালোবাসার কাঙালি মেয়েটা৷ যেখানেই ভালোবাসা পায়, একাকীত্ব কাটানোর সঙ্গী পায় সেখানেই ছুটে যায় দ্বিধাহীন। তাই তো কিশোরী বয়সের দীর্ঘ সময় গুলো কেটেছে বন্ধু, বান্ধবীদের সঙ্গে অবাধে চলাফেরা করে। যৌবনে পা রাখার পর পারিপার্শ্বিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের সান্নিধ্যে এসে অবশ্য সেই চলার পথ থেমেছে। বাঁক নিয়েছে মার্জিত, সুন্দর পথে। তাই তো সব দেখা, সব জানা, আপাদমস্তক বুঝে নেয়া, চিনে নেয়া মেয়েটিকে নিজের অতিপ্রিয় ছোটো পুত্রের জন্যে মনে মনে বাছাই করেছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকা সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ কে বলল তুমি পাত্রী হিসেবে খারাপ? কার এতবড়ো স্পর্ধা মা! ‘
সিমরানের কান্নার বেগ বাড়ল। তানজিম চৌধুরী আশপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে সিমরানকে বুকে আগলেই নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে নিজের পাশে সিমরানকেও বসালেন। এরপর দু’হাতে আদর করে গাল মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালেন,
‘ কী হয়েছে সিনু মা? আমাকে খুলে বলো। না বললে তো বুঝতেছি না। ‘
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলল মেয়েটা৷ শান্ত হতে সময় নিল অনেকক্ষণ। তানজিম চৌধুরী তার জহরি দৃষ্টি দ্বারা তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। সিমরান শান্ত হলো কিছুটা। এরপর থেমে থেমে গা কাঁপিয়ে ফের একই প্রশ্ন বাক্য ছুড়ল,
‘ আমি কি পাত্রী হিসেবে খুব খারাপ? ‘
কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা মুখটা লাল বর্ণে পরিণত হয়েছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। বিধ্বস্ত লাগছে মেয়েটাকে। তানজিম চৌধুরীর মাতৃ হৃদয় নড়ে ওঠল। হাত বাড়িয়ে দু-চোখ উপচে পড়া অশ্রুকণা গুলো মুছতে মুছতে বলল,
‘ ছিঃ ছিঃ মা এসব কী প্রশ্ন! পাত্রী হিসেবে খারাপ কেন হবা? এত সুন্দর ফুলের মতো মেয়ে তুমি। কত লক্ষ্মীমন্ত! আজকাল এমন পাত্রী পাওয়াই তো দুরাশা। কত ভালো পরিবার তোমার। কোনোদিকে এক চুল কমতি নেই। এসব প্রশ্ন কে মাথায় ঢুকিয়েছে? তোমাকে না বলছি আজেবাজে বন্ধু, বান্ধবের সাথে মিশবা না। ‘
ওড়নার কোণা দিয়ে চোখের পানি মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। ভাঙা কণ্ঠে বলল,
‘ এখন আর মিশি না তো। ‘
বারকয়েক পলক ফেলল তানজিম। এরপর সিমরানের কাছাকাছি বসে ক্ষীণ কণ্ঠে শুধাল,
‘ কী নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ মা? আমার কাছে শেয়ার করো। আমি তো বলেছি আমি তোমার দ্বিতীয় মা। উদয়িনী ভাবি তো সব সময় কাছে থাকে না। তাই যখন ইচ্ছে হবে এই মায়ের কাছে আসবা, মনের কথা শেয়ার করবা। সময় কাটাবা৷ ‘
বিগলিত হলো সিমরান। মাথা নিচু করে নিঃশ্বাস আঁটকে বলল,
‘ আমার মতো পাত্রী পাওয়া যদি দুরাশাই হয়। তোমার ছেলের জন্য তবে অন্য মেয়ে কেন দেখছ? ‘
দু-চোখ বেয়ে আবারো অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। তানজিম চৌধুরী স্তম্ভিত! স্বাভাবিক হতে সময় নিল। সিমরান নত মস্তক একটুখানি তুলে দেখল আন্টিকে। আন্টির স্তম্ভিত মুখশ্রী দেখে হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে ওঠল তার৷ চোখ দুটো টলমল হলো আবার৷ কিন্তু অশ্রুজল গড়াল না। গলায় আঁটকে থাকা কান্না গুলো গিলে নিল ভয়ে। কাঁপা কাঁপা স্বরে পুনরায় বলল,
‘ আমি তোমার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসি আন্টি। তুমি প্লিজ আমাকে বেহায়া ভেবো না। বিশ্বাস করো আমি নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। আমাকে বোঝার মতো কেউ নেই আন্টি কেউ নেই। এই কঠিন পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য একমাত্র তুমি ছাড়া কাউকেই খুঁজে পাইনি আমি। ‘
বাক্যের সমাপ্তি দিয়ে দু-হাত বাড়াল সিমরান। তানজিম চৌধুরীর দুগাল আলতো ছুঁয়ে ঘাড় ডানদিকে কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে, অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ ক্লাস নাইন থেকে সৌধ ভাইকে ভালোবাসি আমি। সাহস করে কখনো বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম বলব একদিন। এরপর জানলাম সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে৷ সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে জানার পর আমার হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেই কষ্ট আমি আজো ভুলতে পারিনা। এখনো কষ্ট হয় খুব। ‘
একটু থামল মেয়েটা। এরপর আচমকা করুণ স্বরে বলল,
‘ নিধি আপুর জন্য সৌধ ভাইয়ের যে যন্ত্রণা সেই যন্ত্রণা সৌধ ভাইয়ের জন্য আমাকে পেতে দিও না আন্টি৷ ম রে যাব! বিশ্বাস করো ম রে যাব! আমি সৌধ ভাইয়ের মতো স্ট্রং না। সহ্য করতে পারব না আন্টি। সৌধ ভাইয়ের জীবনে অন্য কোনো মেয়ে, অন্য একটা মেয়ে সৌধ ভাইয়ের বউ!’
কথাগুলো বলতে বলতে শ্বাস আঁটকে এলো সিমরানের। দু’হাতে আগলে ধরা আন্টির গাল দুটো আলগোছে ছেড়ে একহাত নিজের বুকে চেপে ধরল। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসি আন্টি। এই দেখো এখানটায় কত কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছি না৷ দম বন্ধ হয়ে আসছে। এসব শুধুমাত্র তোমার ছেলেকে পাগলের মতো ভালোবাসি বলেই তো হচ্ছে।
ভালোবাসা কি প্রমাণ করা যায় আন্টি? তুমি এখানটায় হাত রেখে দেখো কত্ত ছটফট করছে। ট্রাস্ট মি, আমার এই ছটফটানিটুকু বুঝলে তুমি প্রমাণ চাইবে না ঠিক বিশ্বাস করবে। ‘
সহসা তানজিম চৌধুরী হাত বাড়ালেন। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেপে ধরলেন সিমরানের বুকের বা’পাশে। এবারে সিমরানের চোখের অশ্রু ঝড়ল। আঁটকে রাখা কান্না বাঁধন হারালো ফের। ভাঙা স্বরে বলল,
‘ যেদিন জানতে পারি তোমার ছেলের ভালোবাসার মানুষ অন্য কেউ। সেদিনের পর থেকে ঠিক এমনই যন্ত্রণা নিয়ে রাত কাটে, দিন হয়৷ তুমি বিশ্বাস করছো তো আমাকে? ‘
‘ চুপ! আর কিছু বলতে হবে না বিশ্বাস করেছি আমি। ‘
আকস্মিক কথাটা বলেই সিমরানকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তানজিম। নিভৃতে দু-চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়াল তার। সন্তর্পণে চোখ বুজে লম্বা একটি শ্বাস নিলেন তিনি। মনে মনে বললেন,
‘ আমার সৌধর জন্য সিনুকেই চাই। এই ভালোবাসা থেকে সৌধ মুখ ফেরাতে পারবে না৷ এই নিষ্পাপ ভালোবাসা বৃথা যাবে না৷ মা হয়ে আমি ছেলের জন্য সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করিনি৷ একদম করিনি। কিন্তু উদয়িনী ভাবি! ‘
চমকে ওঠলেন তানজিম। সৌধর বিয়ের কথাবার্তা চলছে বেশ কয়েকমাস ধরেই। সর্বপ্রথম কথা ওঠেছিল সিমরানকে নিয়ে। কিন্তু সেই কথাবার্তা থেমে গিয়েছে। কারণ উদয়িনী চায়নি সৌধর সঙ্গে সিমরানের জুটি মিলুক। এই নিয়ে উদয়িনীর প্রতি কারো রাগ নেই। বিষয়টাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে৷ কোন মা চাইবে জেনে-বুঝে মেয়েকে মাঝ সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলতে? যেখানে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করবে না স্থির করেছে সৌধ। সেখানে এসব জেনেশুনে উদয়িনীর মতো দাম্ভিক মহিলা নিজের মেয়েকে বিয়ে দেবে? উদয়িনী প্রস্তাব নাকোচ করার পর থেকে অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করে সুজা চৌধুরী। ভালো পরিবারের এডুকেটেড মেয়ে দেখেছে। সাধারণ পরিবারের সুন্দরী মেয়েও বাদ রাখেনি। মনের মতো কাউকেই পাচ্ছে না। যাও দু একটা পাচ্ছে ভয়ে এগুচ্ছে না৷ সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়ে কি সৌধর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে? যেই মানসিক সমর্থনটা প্রয়োজন তা দিতে পারবে তো? সবচেয়ে বড়ো কথা আজকালকার যুগে কোন মেয়ে এমন সম্পর্কে এগুবে? ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে ছন্নছাড়া জীবন বেছে নেয়া ছেলের হাত ধরার সাহস কি সব মেয়ের হয়? হয়তো একদম সাধারণ পরিবারের মেয়ে বিয়েতে রাজি হবে। বিপুল সম্পদ, ক্ষমতা, সুদর্শন পুরুষ, চমৎকার ভবিষ্যত পাওয়ার লোভে। কিন্তু দিনশেষে কি সৌধকে ভালো রাখতে পারবে? হয়ে ওঠতে পারবে মনের মতো জীবন সঙ্গী? হয়তো পারবে, নয়তো না। এই নিয়ে প্রচণ্ড শঙ্কিত তানজিম চৌধুরী। তার বিশ্বাস ছিল সিমরানের বিষয়টা পুরোপুরি ভিন্ন। আজকে সৌধর প্রতি সিমরানের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি পেয়ে সেই বিশ্বাসের জায়গাটা মজবুত হলো। সিমরানকে আলাদা করে সৌধর ব্যাপারে না কিছু জানানোর আছে আর না কিছু বোঝানোর। সৌধরও ঠিক তাই। সবচেয়ে বড়ো কথা আলাদা পরিবারের আলাদা মেয়ের সঙ্গে সৌধ মানিয়ে নিত কিনা, সৌধ তাকে গ্রহণ করতে পারত কিনা এই নিয়ে বিরাট সংশয় ছিল৷ কিন্তু সিমরানের বেলাতে এই সংশয় নেই৷ কারণ সিমরানের প্রতি সৌধ যথেষ্ট সংবেদনশীল। সেটা ভালোবাসা নামক অনুভূতি থেকে না হলেও বন্ধুর বোন হিসেবে। সিমরানকে সৌধ অপছন্দ করে না৷ বরং মেয়েটার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল পূর্ব থেকেই। বন্ধুর বোনের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা, যত্নশীলতাই কি পারে না আগামী দিনে তাদের মধ্যে আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে। যে ভালোবাসা সিমরানের বুকে লালিত আছে সেই ভালোবাসা কি সৌধর ভগ্ন হৃদয় জোড়া লাগিয়ে পূর্বের থেকেও শতগুণ মজবুত করে দিতে পারে না? অবশ্যই পারে। উদ্দেশ্য যদি সৎ এবং পবিত্র হয় মানবকূলের পক্ষে সবই সম্ভব। আর যে নারীর হৃদয়ে ভালোবাসা নামক বীজ রোপিত আছে সে নারীর পক্ষে সে বীজ থেকে বৃক্ষ তৈরি অস্বাভাবিক কিছু না৷
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। ধীরেসুস্থে সিমরানকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘ দেখি মাথা তুলো। আমার কথা শোনো মন দিয়ে। এতক্ষণ আমি শুনেছি, এখন তুমি শোনো। শোনার পর যত পারো কাঁদো। এই আজকেই শেষ। এরপর তোমার জন্য আমার বাড়ি কান্না হারাম। ‘
মাথা তুলল সিমরান। ভয় হচ্ছে ভীষণ। এখন পর্যন্ত আন্টির রিয়াকশন পায়নি কোনো। তাই এবার নিজেকে তৈরি করল কঠোর প্রতিক্রিয়া সহ্য করার জন্য। কিন্তু তানজিম চৌধুরী যা বললেন তা শুনে গায়ে কাঁ টা দিয়ে ওঠল তার।
‘ সৌধর জন্য অনেক আগে থেকেই তোমাকে পছন্দ আমার। আমরা যেদিন থেকে সৌধর জন্য পাত্রী খুঁজছি। সৌধর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করছি। সেদিন তোমার কথাই আগে মাথায় এসেছে। তোমার আংকেলকেও জানিয়েছিলাম বিষয়টা। তোমার আংকেল তোমার বাবা,মাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। তোমার বাবা রাজিও ছিলেন কিন্তু বাঁধা এলো তোমার মায়ের থেকে। সে শঙ্কিত তোমার ভবিষ্যত নিয়ে। আসলে সে তার জায়গায় সঠিক। আজ যদি তার জায়গায় আমি আর তোমার জায়গায় স্মৃতি থাকত আমিও বাঁধা দিতাম। ‘
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটুক্ষণ থামল। এরপর আবার বলতে শুরু করল,
‘ তার রাজি না হওয়াতেই আমরা অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করি৷ কিন্তু ঐ যে নিয়তির লেখা বলেও কিছু থাকে তাই তো যোগ্য পাত্রী খুঁজে পাইনি। আজ তুমি যা বললা এটা যদি আগে জানতাম অন্য কোথাও মন দেওয়ার কথা ভাবতাম না। যেখানে তুমি সৌধকে ভালোবাসো সেখানে আর অন্য কোথাও মন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস চৌধুরী বাড়ির ছোটো পুত্রবধূ তুমি ছাড়া কেউ হবে না৷ কারো সাহস নেই এ বাড়ির ছোটো ছেলের বউ হবার। কারণ কেউ তোমার মতো করে সৌধকে ভালোবাসতে পারবে না। সবটা জেনে-বুঝে কেউ এমন কঠিন আবদার করতেও পারবে না৷ এই ক্ষমতা, এই সাহস এক সিমরান খন্দকারেরই আছে। ‘
‘ আমি নিজেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি আন্টি কিন্তু পারিনি৷ অনেক বুঝিয়েছি মনকে, সৌধ ভাই আমাকে ভালোবাসে না। তবু মানাতে পারিনি। বুকটা হুহু করে আমার। মন বুঝ দেয় একদিন বাসবে। কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি আমার প্রথম প্রেমকে হারাতে চাই না। আমি সেদিন ওই এক মুহুর্তের জন্যই সৌধ ভাইকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলাম। নিধি আপুর কাছে কারণ সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে। এরপর আর কারো কাছে কোনোকিছুর বিনিময়ে ত্যাগ স্বীকার করতে পারব না। ট্রাস্ট মি আন্টি, সৌধ ভাইকে ছাড়া অন্য কারো প্রতি আমার রুচি আসে না। তুমি প্লিজ ক্ষমা করো আমাকে। আমি জানি তুমি সৌধ ভাইয়ের মা। তোমাকে এভাবে বলা নির্লজ্জতা হচ্ছে। কিন্তু কী করব বলো? ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে নিঃশেষ হওয়ার চেয়ে নির্লজ্জ হওয়া ঢেড় ভালো। ‘
তানজিম চৌধুরীর চিত্ত বিগলিত হলো। হাসল কিঞ্চিৎ। আদর পেল খুব। মেয়েটা জেদি, একরোখা ছাপিয়ে ভীষণ মিষ্টি আর প্রচণ্ড সৎ। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করল ওর সাহসীকতা। ক’টা মেয়ে পারে এভাবে ছেলের মা’কে এসে বলতে, ‘ তোমার ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসি আন্টি? ‘ সৌধর মতো শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষের জীবনে এমন সাহসী নারীই তো প্রয়োজন। যে মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে ভীরু হয় না, কুণ্ঠা বোধ করে না। সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তানজিম। দৃঢ় গলায় বললেন,
‘ আমি আজই তোমার আংকেলের সাথে কথা বলব। তার মত নিয়ে কথা বলব সৌধর সঙ্গে। কিন্তু মা তোমার মা আর ভাইকে নিয়েই চিন্তা। ‘
‘ আম্মু, ভাইয়াকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার আন্টি। ‘
তীব্র আত্মবিশ্বাসী স্বর শুনে হাসলেন তানজিম। সে জানেন উদয়িনী সহজে মানবে না। না মানলেও এখন আর কিছু করার নেই৷ যেখানে সিমরান রাজি, তারা রাজি। সেখানে বিয়েতে বড়ো কোনো বাঁধা নেই বললেই চলে। একটুখানি চিন্তিত হলেন অবশ্য ছেলেকে নিয়ে। পরোক্ষণেই মাতৃহৃদয় বলল, তার ছেলেটা অমানুষ বা অজ্ঞ নয়। ক্ষণিকের যন্ত্রণা তাকে হয়তো ছন্দহীন করে তুলেছে। এটাকে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া থেকে আটকাতে সিমরানকে প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। মেয়েটাকে সে নিজ হাতে গড়ে তুলবে। একদম সৌধর জন্য যোগ্য নারী হিসেবে তৈরি করবে। যাকে দেখে একদিন সৌধ স্বীকার করতে বাধ্য হবে নিধি নয় সিমরানই তার যোগ্য নারী৷ যোগ্য ভালোবাসার মানুষ।
“প্রথমা হয় যদি ভুল দোষ কি দ্বিতীয়ায়?
প্রথমায় ভুল ফুল হয়ে ফুটুক দ্বিতীয়ায়। যে’জন যায় তার বিরহে মন না মরুক। যে’জন আসে তার প্রণয়ে মন ভরুক। দ্বিতীয়বারো প্রেম হয়, পরিপূর্ণতা পায় ভালোবাসা। শর্ত কেবল একটাই, মানুষটা সঠিক হতে হবে। ”
.
.
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৩|
সেদিন কথোপকথন শেষ করে গভীর ভাবনায় পড়ে তানজিম চৌধুরী। এরপর বেশ তাড়াহুড়ো করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সিমরানকে৷ কারণ সে সময় সৌধ, সুহাস ছাড়াও ওদের আরো বন্ধু, বান্ধবী বাড়িতে উপস্থিত ছিল। সিমরান চলে যায়। কেউই টের পায় না, জানতে পারে না সেদিন সিমরানের চৌধুরী বাড়িতে আসার খবর৷ এরপর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন তানজিম চৌধুরী। স্বামীর অনুমতি নিয়েই দু’দিন পর ডেকে পাঠান ছেলে সৌধ আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুহাসকে। তারা দু’জন প্রস্তুত ছিল। সুহাসের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, সৌধর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন আন্টি। সুহাস খুশিই হলো। দু’দিন আগেই তারা বন্ধুরা মিলে নিধিকে দেখতে গিয়েছিল। প্রাচী বুঝিয়েছে মেয়েটাকে। সারাজীবন বাস্তবতা আঁকড়ে ধরা মেয়েটা জীবনের এমন পর্যায়ে এসে আবেগে যেন গা না ভাসায়৷ হুশিয়ারি দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়েছে একটুখানি মিথ্যার আশ্রয়৷ সৌধ এনগেজড। খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে করবে সৌধ চৌধুরী। সৌধকে নিয়ে বলা এহেন কথা বিশ্বাস করতে পারেনি নিধি৷ তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা টের পায় কিছু একটা গড়বড় আছে। সে যে টের পেয়েছে সেটি বুঝতে দেয় না কাউকেই৷ বন্ধুরা তার সঙ্গে দেখা করে, স্বান্তনা দিয়ে, জ্ঞান মূলক বাণী আওড়ে ফিরে আসে। সেও ফিরে যায় স্বামী অর্পণের সঙ্গে তার বাসায়। নিধিকে বলা সেই মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করতে বন্ধুরা উদগ্রীব। তীব্র অনীহা সৌধর। সুহাস যতটা উৎসাহিত হয়ে তানজিম আন্টির সঙ্গে দেখা করতে এলো। সৌধ মায়ের কাছে এলো ততটাই নিরুৎসাহিত ভাবে।
.
.
অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বস্ত কথাগুলো শুনে দু’টো মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ ঘটল! সৌধ, সুহাস হতভম্ব মুখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল কয়েক পল। এরপর বিমূঢ় মুখে তাকাল তানজিম চৌধুরীর পানে। এই মানুষটা কখনো নড়বড়ে কথা শোনা পছন্দ করেন না৷ সেখানে নিজে নড়বড়ে কথা বলা তো অসম্ভব। সম্পূর্ণভাবে সঠিক তথ্য বিহীন আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া মানুষ নন মা। জানে সৌধ৷ মনে প্রাণে বিশ্বাসও করে। কিন্তু আজকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু বিশ্বাস নয় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্টবোধ করছে। সিমরান! সিমরান তাকে ভালোবাসে? সেই ক্লাস নাইন থেকে ভালোবাসে সিমরান তাকে? অথচ সে টের পেল না আশ্চর্য! নাকি ওভাবে কখনো খেয়াল করেনি বলেই বুঝতে পারেনি। এসব কথা, প্রশ্নের মাঝেই আচমকা মনে পড়ল সেদিন সিমরানের বলা সেই কথাটি। সে যখন বলল, গোপন প্রেমিক আছে কিনা। সিমরান তখন সত্যি, মিথ্যার প্রশ্ন তুলল৷ তখন সে বলেছিল,
‘ আমি মিথ্যা সহ্য করতে পারি না। ‘
আর সিমরান উত্তর দিয়েছিল,
‘ তুমি সত্যিটাও সহ্য করতে পারবে না৷’
তবে কি সত্যি এটাই ছিল!
সৌধর মতো একই অবস্থা সুহাসেরও হলো। কিন্তু পরোক্ষণেই মাথায় আসল সেদিন সিমরানের দেয়া প্রতিক্রিয়াটি৷ শুধু সেদিন নয় গত কয়েকমাস ধরে সিমরানের সমস্ত আচরণ এক এক করে স্মরণ হতেই কেঁপে ওঠল অকস্মাৎ। থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল সৌধর পানে। সৌধ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘ আই কান্ট বিলিভ দিস। ‘
সুহাসেরও বিস্মিত স্বর,
‘ মি ঠু। ‘
ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে তানজিম চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানালেন পূর্বে করা তাদের পরিকল্পনার কথাটিও। এক পৃথিবীতে একই সঙ্গে এতবার বজ্রপাত হয়েছে কি কখনো? যতবার সৌধ আর সুহাসের মাথায় হলো? আর নিতে পারল না সুহাস। অতিআদুরে বোন তার। যাকে কোনোদিন একটা ধমক পর্যন্ত ঠিকভাবে দিতে পারেনি। তার উদ্দেশ্য এবার কড়া শাসনের সুর আওড়াল। সৌধ কেমন মানুষ খুব ভালো করেই জানে সে। বন্ধু সম্পর্কে ধারণাও কম নেই তার। তাই তাকে স্বান্তনার স্বরে বলল,
‘ আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব আর সিমরানকে কড়া শাসন করব৷ এখন বুঝতে পারছি ওর কতটা শাসনের অভাব। কতবড়ো ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। আজ সপাটে কয়েকটা থা প্পড় মেরে বুঝিয়ে দিব। ‘
ক্রোধে জর্জরিত সুহাস। বিচলিত সৌধ। সে জানে রাগের বশে সুহাস এভাবে বললেও এতখানি করতে পারবে না। কিন্তু সেই জানার বাইরে গিয়ে যদি ঝোঁকের বশে করে ফেলে মারাত্মক বিপদ ঘটে যাবে৷ সিমরানকে তো কম দিন দেখছে না। সেই ছোট্ট সময় থেকে চেনে মেয়েটাকে। তাই সাবধানি বাক্য ছুঁড়ল,
‘ সুহাস মাথা ঠান্ডা কর। যা বলেছিস বলেছিস এসব করতে যাস না। বিপদ ঘটবে। ‘
বন্ধুকে কথাটা বলেই শান্ত মুখে শীতল দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। তানজিম চৌধুরী অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন। সুহাসকে দেখছেন জহরি চোখে। সৌধ তার দিকে তাকিয়েছে টের পেতেই দৃঢ় কণ্ঠে সুহাসকে প্রশ্ন করল,
‘ সুহাস, তোমার কি আমার ছেলে সৌধকে অযোগ্য মনে হয়? ‘
চমকে তাকাল সুহাস। বিব্রত কণ্ঠে বলল,
‘ এ কী বলছ আন্টি! সৌধ আমার কতটা ঘনিষ্ঠ, বন্ধু কম ভাই বেশি। অযোগ্য কেন মনে হবে? ‘
‘ তাহলে সিনু মাকে কেন শাসন করবে? কেন তার গায়ে হাত তুলবে? তার দোষটা কোথায়? ‘
দৃঢ় কাঁধ দু’টো নুইয়ে পড়ল সুহাসের। হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘ জেনে বুঝে বোন আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছে আন্টি। ভাই হয়ে আমি আটকাব না? ‘
চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল তানজিম চৌধুরীর। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
‘ আমার ছেলে আর এই পরিবার দু’টোই তোমার কাছে আগুন? ‘
আকস্মিক জিভ কামড়াল সুহাস। বলল,
‘ না, না এই পরিবার না। কিন্তু সৌধকে আমি যতটা চিনি ততটা এই পরিবারের কেউ চেনে না। আমার বোন সম্পর্কেও তো জানি আমি। বোন আমার উপর থেকে যেমনি দেখো ভেতরে ভেতরে খুব নরম, ঠান্ডা পানি একদম। সেখানে সৌধ! রাগ করো না আন্টি। সৌধ সত্যি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। ও নিধি ছাড়া আর কোনো মেয়ের জন্য মোমের চেয়েও নরম, বরফের চেয়েও ঠান্ডা হতে পারবে না। আমি সৌধকে খুব কাছ থেকে জানি৷ এমন জানা তোমরা কেউ জানো না। সিনু অবুঝ। বিশ্বাস করো, ও খুব অবুঝ আর আবেগি মেয়ে। ভালোবাসার কাঙাল। খুব বোকাও। নয়তো চোখের সামনে এতসব দেখে ও কেন তোমার কাছে আসবে। এভাবে আবদার করবে? আমার মনে হয় একা একা থাকতে থাকতে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ‘
সুহাসের কথা শুনে হাসল তানজিম চৌধুরী। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ শুধু সিনু নয় তার ভাইটাও খুব বোকা আর ভীতু। ‘
‘ হ্যাঁ আমি ভীতু আন্টি। আমার বোন অসুখী যেন না হয় সেই ভয়ে থাকি আমি। সারাজীবন দু ভাই বোন ভালোবাসার কাঙাল হয়ে বড়ো হলাম। বাবা, মায়ের দূরত্ব, বিবাদ দেখলাম। সেই একই অবস্থা বোনের জীবনে হোক চাই না। ‘
থামল সুহাস। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। তানজিম চৌধুরী একটু ভাবুক হলেন। তাকালেন সৌধর দিকে। সৌধ নিশ্চুপ। যেন ভাবছে গভীর কোনো ভাবনা। সে বললেন,
‘ সৌধ, সুহাসের বক্তব্য শুনলাম। আমার আর তোমার বাবার ইচ্ছে, আদেশ যাই বলো আমরা সিনুকে তোমার বউ করে আনতে চাই। সোহান ভাইয়েরও মত আছে। তোমার মত জানতে চাই। ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল সৌধ। সে চিন্তিত সিমরানকে নিয়ে। কিন্তু সিদ্ধান্ত সেটা আবার কী? নতুন করে কী সিদ্ধান্ত দেবে সে। যা দেয়ার তা তো আগেই দিয়েছে।
‘ আমার সিদ্ধান্ত পূর্বে যা ছিল এখনো তাই আছে আম্মা। ‘
সহসা রেগে গেলেন তানজিম। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে? ‘
চোখ তুলে তাকাল সৌধ বিনয়ের সঙ্গে হাসল মৃদু। বলল,
‘ ইয়েস। এভাবেই কাটিয়ে দেব। ‘
‘ বিয়ে তোমাকে করতে হবে সৌধ। ‘
তীব্র জেদি কণ্ঠ তানজিম চৌধুরীর। মায়ের এমন জেদি রূপ এই প্রথম দেখল সৌধ। কড়া দৃষ্টি বরাবর নিজের দৃষ্টি রাখতে পারল না আর। মস্তক নত করল৷ ফেলল গভীর এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস। পাশ থেকে সুহাস বলল,
‘ এভাবে জীবন কাটানো যায় না সৌধ। সব সময় তো তুই নীতি বাক্য বলিস। আমাদের ভালো, মন্দ পরামর্শ দিস। আজ আমি দিচ্ছি, শোন উপরে একজন আছেন। যার নিয়মেই পৃথিবী চলে, মানুষ চলে। একটি গাছের একটি পাতাও তার আদেশ ছাড়া নড়ে না। সেখানে তুই আমি কিন্তু তুচ্ছ। বিয়ে কিন্তু আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় একটি অধ্যায়। আমি চাই নিজের জন্য যোগ্য পাত্রী নির্বাচন করে বিয়ে কর তুই। ‘
‘ জ্ঞান দিস না এসব তোর থেকে ভালো আমি জানি আমি বুঝি। আম্মা সামনে না থাকলে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতাম আরো। ‘
মৃদু ধমকে কথাগুলো বলল সৌধ। তানজিম চৌধুরী ছেলের আচরণ দেখে স্তব্ধ হয়ে রইলেন৷ বিমূঢ় স্বরে বললেন,
‘ বিয়ে তোমাকে করতেই হবে সৌধ৷ এরজন্য যদি আমার প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় দিব। ‘
সহসা হুমকিতে বুক কেঁপে ওঠল সৌধর। বিস্মিত গলায় বলল,
‘ আম্মা! ‘
সুহাসও ভয় পেয়ে গেল। তীব্র দুঃশ্চিতায় শরীর দুর্বল অনুভূত হলো তার। এমন সময় চোখ, মুখ শক্ত করে হঠাৎ সৌধ বলল,
‘ ওকে ফাইন, বিয়ে করা যদি তোমরা বাধ্যতামূলকই করো করব। কিন্তু সিনুকে না আম্মা। ও আমাদের সবার খুব স্নেহের, আদরের। জেনে-বুঝে ওর জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না। আমি চাই না ও অসুখী হোক। স্বামীর ভালোবাসার অভাব নিয়ে জীবন কাটাক৷ ‘
একই চাওয়া সুহাসেরও। একই মতও সুহাসের। তানজিম চৌধুরী কড়া গলায় বললেন,
‘ তুমি চাও না সিনু অসুখী হোক। আর আমরা কেউ চাই না পরের বাড়ির পরের মেয়ে অসুখী হোক। নারী হয়ে আমি আরেক নারীর চরম সর্বনাশ করতে পারব না সৌধ। তাই তোমার জন্য সিনু ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আনাও সম্ভব না। ‘
রাগান্বিত হলো সৌধ। সিমরান যদি তার প্রতি দুর্বল হয়েও পড়ে তার মা কেন দুর্বল হচ্ছে সিমরানের প্রতি? সে কি বুঝতে পারছে না এই দুর্বলতা সিমরানের জন্য ক্ষতিকারক! আর এক মুহুর্ত মায়ের সামনে বসে থাকার ধৈর্য্য হলো না সৌধর। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে প্রস্থান করল। এটুকু না করলে শ্রদ্ধেয় আম্মার সঙ্গে চরম বেয়াদবি করে ফেলত! বিয়ে করতে সম্মত হয়েছে শুধু মায়ের হুমকি শুনে নয় ওদিকে তার বন্ধুরা নিধিকে বলে এসেছে তার বিয়ে ঠিক। বন্ধুদেরকে মিথ্যাবাদি প্রমাণ করতে চায় না সে। আর না চায় ওই বেইমানটার সংসার ভাঙুক। প্রতারকটা দুশ্চরিত্রা রূপে সর্বমহলে পরিচিতি পাক। সবশেষে সে নিজেও সহ্য করতে পারবে না নিধির ওই ঘৃণিত চেহেরা। যে গুণে মানুষটাকে ভালোবেসে এত এত বিরহ বুকে পুষল সেই গুণ গুলোর সবটুকু এভাবে মিথ্যা, ধোঁয়াশায় পরিণত হতে পারে না৷ একদমই না।
সৌধর মায়ের কথায় তীব্র অসন্তুষ্ট সুহাসও। তাই বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না আর৷ কিন্তু তানজিম বললেন,
‘ সুহাস তুমি নিজেও কিন্তু প্রথমে নামীকে মেনে নিতে পারোনি। নামী তোমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একটা মেয়ে ছিল। এরপরও সৃষ্টিকর্তার রহমতে পবিত্র সম্পর্কের জোরে তোমাদের মধ্যে অপরিমেয় ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। যেখানে তোমাদের অসম্ভব সম্পর্ক সম্ভবে পরিণত হয়েছে। সেখানে সিনু আর সৌধর সম্পর্ক কিন্তু সম্ভব। সিনু সৌধকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর সৌধ সিনুর প্রতি সংবেদনশীল। প্রচণ্ড স্নেহ করে সিনুকে। সবচেয়ে বড়ো কথা অন্য একটা মেয়েকে সৌধর বউ করে আনলে তার প্রতি সৌধ অবিচার করতে দুবার ভাববে না৷ কিন্তু সিনুর প্রতি অবিচার করার আগে ওর বিবেক নড়ে ওঠবে। ‘
‘ ভুল বললে আন্টি। সৌধ কিন্তু সুহাস নয়। প্রথম দিকে নামীর প্রতি যে অন্যায়টা আমি করেছি সেটা সৌধ করবে না। তোমার ছেলেকে তুমিই চিনতে পারোনি আন্টি! ‘
থেমে গেল তানজিম। সত্যিই তো। তার সৌধ কক্ষণো কারো প্রতি অবিচার করতে পারবে না। সেভাবে ছেলেকে গড়েই তুলেনি সে৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এই অস্ত্রটিই তো কাজে লাগবে তার। সবাইকে এটাই বোঝাতে হবে। তবেই না সবাই রাজি হবে সিনু আর সৌধর শুভ বিবাহের জন্য। তাই পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,
‘ সুহাস তোমার কথা হয়তো ঠিক৷ কিন্তু বাবা যাকে বিয়ে করবে তার প্রতি বিবেকবান হয়ে লাভ কি যদি মন থেকে ভালোবাসতেই না পারে? ‘
‘ তুমি কী বলতে চাচ্ছ সৌধ সিনুকে ভালোবাসতে পারবে? ‘
‘ পারবে? ‘
‘ কীভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছ আন্টি? ‘
‘ আমি তো মা সুহাস। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি একজন নারী। নারী ভালোবেসে সব জয় করতে পারে। সিনু যদি সৌধকে এতটা ভালো না বাসত তাহলে এতখানি জোর করতাম না বাবা। যে ভালোবাসা আমি দেখেছি যে হৃদয় নাড়ানো কথা শুনেছি এরপর সিনুকে কষ্ট দেয়া সম্ভব না৷ এই মুহুর্তে সৌধ সিনুর ভালো ছাড়া আমি আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। ‘
এত বুঝিয়েও লাভ কিছু হলো না। সুহাস একদম নিরুত্তর হয়ে ওঠে পড়ল৷ বিদায় নিল একরাশ হতাশা ভরে। এরপর বাড়ি গিয়ে সর্ব প্রথম বোঝাপড়া করল সিমরানের সাথে। দু ভাই বোনের প্রথমে তর্ক, বিতর্ক হলো। এক পর্যায়ে তীব্র ক্রোধে আচমকা সুহাস থা প্পড় মেরে বসল সিমরানের গালে। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে নিজের ঘরে দৌড়ে চলে গেল সিমরান। দরজা আঁটকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা। নিচ থেকে বোনের এমন করুণ দশা দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না সুহাস৷ ত্বরিত টেলিফোনের কাছে গিয়ে কল করল মা, বাবাকে৷ জানালো কী কঠিন পরিস্থিতিতে আছে তারা ভাইবোন। বাবা জানালো সে এক্ষুনি আসছে। মা আগামীকাল আসবে। এরপর সুহাস অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবল কী করা যায়। সিমরানকে কীভাবে বোঝানো যায়। কিন্তু কোনো সুরাহা মিলল না। নিজের এই কঠিন পরিস্থিতিতে নামীর সঙ্গে হওয়া সব রাগ, অভিমান ভুলে গিয়ে ছুটে গেল নামীর ফ্লাটে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কাক ভেজা হয়ে হঠাৎ সুহাসের আগমন। চোখ দু’টো রক্তিম, মুখ ভাড়। ভয় জেঁকে ধরল নামীকে। কী হয়েছে সুহাসের? এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন? ফারাহ আজকের জন্য পাশের রুমে চলে গেল। তারা দু’জন এখন বিরাট একটি ফ্লাট ভাড়া করে থাকে। আগে সুহাস আসত৷ রাগারাগি হওয়ার পর আসে না আর৷ আইয়াজ আসে মাঝে মাঝেই৷ এছাড়া পুরো ফ্লাটে তারা দুই বান্ধবীই রাজত্ব করে বেড়ায়। মাঝেসাঝে সিমরান এসেও থাকে অবশ্য। আজ হঠাৎ সুহাস আসাতে ফারাহ চলে গেল অন্য রুমে। বদ্ধ ঘরে সুহাস হাত, পা ছেড়ে ফ্লোরে ভেজা কাপড়ে বসে রইল। নামী ঠান্ডা গলায় বেশকিছু ক্ষণ সময় বলল,
‘ সুহাস কাপড় বদলে আসো ঘর ভিজে যাচ্ছে। ‘
সে কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না ছেলেটা। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল নামী৷ কাল পরীক্ষা আজ হঠাৎ সুহাস এলো। তাও এই বিধ্বস্ত অবস্থায়। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে এলো। মোবাইল নিয়ে দ্রুত চলে গেল বেলকনিতে। ফোন করল সিমরানকে। চারবার রিং হলো অথচ ফোন রিসিভ হলো না। টেনশনের মাত্রা দ্বিগুণ হলো এবার৷ কাকে ফোন করা যায় ভাবতে ভাবতে ফোন করল সেলিনা আপাকে। সুহাসদের বাসার কাজের মহিলা। সেলিনা আপা ফোন রিসিভ করেই ভয় জড়ানো কণ্ঠে এক এক করে সবটা খুলে বলল নামীকে। সব শুনে শিউরে ওঠল নামী। বুকে সৃষ্টি হলো কম্পন। তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিল সে। রাখার আগে সাবধান করে বলল,
‘ সিনুর খেয়াল রেখো। দরজা বন্ধ তাতে কী? জানালা তো খোলা, সব সময় খেয়াল রাখবে। কোনো বিপদ ঘটতে নিলেই ফোন করবে বাবা, মাকে। ‘
সেলিনা আপার সাথে কথা শেষ করেই সোহান খন্দকারকে কল করল। জানতে পারল সে বাসার পথে। এবার কিছুটা নিশ্চন্ত হয়ে ফোন কেটে দিল। রুমে গিয়ে ফোন রেখে নিজের ছোট্ট কাভার্ড থেকে ভাঁজ করে রাখা সুহাসের গরম কাপড় বের করল।
চটজলদি তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এলো সুহাসের কাছে। যত্ন নিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে বলল,
‘ ঠান্ডা লেগে যাবে সুহাস৷ কাপড় চেঞ্জ করো। ‘
যেন কিছুই শুনেনি এমন একটা ভাব। আগের চেয়েও দ্বিগুণ জেদ ধরে, শরীরটা দৃঢ় করে বসে রইল। নামী ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখটায় তাকাল একবার। মাথা মুছা শেষ। তাই বিছানার এক পাশে তোয়ালে রেখে। কাছাকাছি সম্মুখীন হয়ে বসে সুহাসের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল এক এক করে। মনে মনে ভেঙচি দিয়ে বলল,
‘ যত তেজ আমার কাছেই। ‘
মুখে বলল,
‘ আরে বাবা শরীর শক্ত করে রাখলে শার্টটা খুলব কী করে? ‘
পরোক্ষণেই মনে মনে গজগজ করতে করতে বলল,
‘ এতদিন মুখে কথার খই ফুটিয়ে জ্বালিয়েছে। এখন এসেছে গম্ভীর, বোবা বনে গিয়ে জ্বালাতে। ‘
বেশ বেগ পেতে হলো শার্টটা খুলতে। ভেজা শার্ট ফ্লোরের একপাশে রেখে শরীর মুছে দিল। সুহাসের কোনো ভাবান্তর নেই৷ প্যান্টটাও ভেজা। বড্ড মুসিবতে পড়ল নামী। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
‘ প্যান্টটাও কি আমাকে খুলতে হবে? ‘
এ পর্যায়ে নড়চড় করল সুহাস। অন্য সময় হলে কতশত অসভ্য কথা বলে ফেলত এ মুহুর্তে। লজ্জা দিত সভ্য বউটাকে। কিন্তু আজ কিছুই বলল না। চুপচাপ ওঠে বের করে আনা পোশাক গুলো নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। এতেই বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠল নামীর। ভীষণ মায়াও হলো। ভালোবাসার মানুষটির একটুখানি কষ্টও যে সহ্য হয় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মনস্থির করল, আজ আর সিনু, সৌধ ভাই নিয়ে কোনো প্রকার কথা বলবে না। প্রশ্ন করবে না। কিছু বোঝাবেও না। রাগ অভিমান চলছে তাদের। কত্তদিন পর এলো মানুষটা। আজ একসঙ্গে সময় কাটাবে। মন ভালো করার চেষ্টা করবে। সুহাস যদি কিছু বলতেও চায় সে শুনবে না। বলবে,
‘ সব কথা আগামীকাল শুনব৷ আজ শুধু তোমার, আমার কথা চলবে। আজকের এই বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যা, দীর্ঘ রাতটা শুধু তোমার আর আমার জন্য। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৪|
গভীর রাত। ধরণিতল বৃষ্টিতে ভিজে চুপ চুপ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুহাস ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। তার এক হাত নামীর কাঁধ আঁকড়ে, এক পা কোমরে তোলা। বউকে ঠিক কোলবালিশের ন্যায় আঁকড়ে ঘুমোচ্ছে সে৷ ক্ষণে ক্ষণে মুখের ভারিক্কি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নামীর ঘাড়ে এবং কানে। সুহাস গভীর ঘুমে থাকলেও নামীর ঘুম গভীরতায় পৌঁছায়নি। তাই তো রাত বাড়ার সাথে সাথে সুহাসের দেহের প্রগাঢ় উষ্ণতা অনুভব করতে পারল সে৷ এক পর্যায়ে শঙ্কিত চিত্তে দৃষ্টি মেলে তাকাল। বলিষ্ঠ দেহে জড়ানো তার দেহখানি রয়েসয়ে সরিয়ে ওঠে বসল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের কপাল। নিমেষে চোখ দু’টি বড়ো বড়ো হয়ে গেল৷ ভীত স্বরে বলল,
‘ হায় আল্লাহ, এত্ত জ্বর! ‘
বারকয়েক ঢোক গিলল সে। ত্বরিত সুহাসের ডান গালে হাত রেখে ডাকল,
‘ এই সুহাস, তোমার তো খুব জ্বর। এই সুহাস শুনছ?’
কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিল নামী। দু’টো বেজে একান্ন মিনিট৷ বুক ধুকপুক করে ওঠল৷ এগারোটায় পরীক্ষা৷ এদিকে সুহাসের ভয়াবহ জ্বর। আর বসে থাকতে পারল না৷ ছুটে গিয়ে মেডিসিন বক্স আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। সুহাসের ঘুম ছুটোতে পরিশ্রম হলো খুব। জ্বরে কাতর সুহাস বেঘোরেই মেজাজ দেখাল কিঞ্চিৎ। কত্ত বড়ো সাহস নামীদামির। তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়! মেজাজ টুকুতে
রাগ করল না নামী। সব সময় স্বামীর মেজাজকে তোয়াক্কা করতে নেই। মন খারাপ হতে নেই। কিছু পুরুষ মানুষ থাকেই আজন্মের বেআক্কল। এরা নিজের ভালো বুঝে না। বউ ভালো করতে এলেও দেমাক দেখায়। আবার ভালো করতে না এলে তকমা দিয়ে দেয় অযত্নশীল বউ। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা নেই ইত্যাদি, টিত্যাদি। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল নামী৷ বুঝিয়ে, অনুরোধ করে জোর পূর্বক জ্বর সেরে ওঠার প্রাথমিক ট্যাবলেট গুলো খাইয়ে দিল। এরপর নরম কাপড় ভিজিয়ে জলপট্টি দিল তিনটা পর্যন্ত। সুহাস ঘুমে কাঁদা। বেচারির আর ঘুম হবে না। তাই ওঠে গিয়ে টেবিল থেকে বই নিয়ে এলো৷ জলপট্টি দেয়ার পাশাপাশি পড়ে নিলো কিছু ইম্পর্ট্যান্ট টপিক।
সুহাসের জ্বর কমল চারটার দিক। এতক্ষণ পাঁচ মিনিট পর পরই কপালে, গলায় হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিল কখন জ্বর কমবে? যদি না কমে আজকের পরীক্ষাটা তার মাটি। যতই হোক মানুষটাকে তো ভালোবাসে। এভাবে জ্বরে রেখে পরীক্ষার হলে মন টিকবে? একটুও টিকবে না৷ তাই জ্বর কমাতে খুশি হলো। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ফারাহকে টেক্সট করল একটি,
‘ সুহাসের খুব জ্বর ওঠেছিল। ঘুমাতে পারিনি ঠিকভাবে৷ এখন ঘুমাব। ন’টার আগে ওঠা সম্ভব না।
আমাদের রান্না তরকারিতে ঝাল বেশি৷ সুহাস ঝাল খেতে পারে না একদম। ওর জন্য ঝাল কম দিয়ে মাছ ভাজা করিস শুধু, এতেই হবে৷ পরীক্ষা আমাদের বুঝবে ও। তুই আবার টেনশন করিস না৷ ইলিশ মাছ প্রিয় ওর ভাজি খেতে পছন্দ করে, ক’টা পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে দিস। ‘
পরীক্ষা বলে নিজেদের রান্না করে রেখেছিল ওরা। সকালে শুধু গরম গরম ভাত করতে হতো। সুহাস আসাতে অল্প কাজ বাড়ল। যা ফারাহকে করতে বলে সুহাসের পাশে শুয়ে পড়ল নামী। চেষ্টা করল ঘুমুতে। আশ্চর্য! ঘুম এলো না৷ এপাশ-ওপাশ করতে করতে ওঠে বসল। হাত বাড়িয়ে সুহাসের গা স্পর্শ করে আবার দেখল জ্বর আছে কিনা। অনুভব করল জ্বর ছেড়ে ঘাম বেরুচ্ছে শরীর থেকে৷ তাই ত্বরিত টি-শার্ট খুলতে চেষ্টা করল। এতেই ঘুম ছেড়ে গেল সুহাসের। বৈদ্যুতিক তীক্ষ্ণ আলোয় নামীর শ্যামলাটে স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে থমকালো একটু৷ কয়েক পল নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে আচমকা দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠল ঠোঁটে। নামী ওর টি-শার্ট উঁচিয়ে ধরেছিল মাত্র। সেই ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরে হেঁচকা টান মারল। সহসা মুখ থুবড়ে পড়ল বুকে। সুহাস সাপের মতো প্যাঁচিয়ে ধরল বুকের মাঝে। ভীষণ গভীর করে। এরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ আমাকে অচেতনে পেয়ে এতবেশি ডেস্পারেট হয়ে গেলে? সচেতনে কেন হও না ডার্লিং? পারবে না বলে? ‘
নিমেষে মুখ হা হয়ে গেল নামীর। রেগেমেগে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ এইতো গর্তের ইদুর গর্ত থেকে মাথা তুলেছে। সারারাত যে জ্বরে কাতরাচ্ছিলে সেই খেয়াল আছে? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে যে সেবা করলাম জানো? জ্বর ছেড়ে ঘেমে একাকার দেখে জাস্ট টি-শার্ট খুলার ট্রাই করছিলাম। অমনি শুরু হয়ে গেল অসভ্যতামি? ‘
কথার বলার ফাঁকে সুহাসের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করল নামী৷ কিন্তু সুহাস তাকে মুক্তি দিল না। তার রাগান্বিত চোখ, মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলল। কতদিন, কতদিন পর এই পাগল আর পাগলামো আক্রমণ করল নামীকে? হিসেব করতেই বুকটা হুহু করে ওঠল। সহসা সেও জড়িয়ে ধরল সুহাসকে। বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল বাচ্চাদের মতো। বলল,
‘ খুব মিস করেছি সুহাস, খুব। ‘
আলতো হেসে মাথায় হাত বুলালো সুহাস। মুখ তুলে কপালে চুমু এঁটে মৃদুস্বরে বলল,
‘ বাতি নিভিয়ে এসো। ‘
গলার স্বরে পরিচিত আহ্বান। নামী লজ্জা পেল। বিস্ময়ে বলল,
‘ না, একদম না। পরীক্ষা আছে আমার, ওঠতে হবে।’
আড়চোখে ঘড়িতে সময় দেখে নিল সুহাস। জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই নামীর কোমরের পাশে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরল। ভারিক্কি, উষ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ ছ’ঘনটা সময়ের মধ্যে বরকে একঘন্টা দিতে পারবে না? কেমন বউ তুমি? ‘
‘ সব সময় বাড়াবাড়ি তাই না? ‘
‘ মেয়েরা তো বাড়াবাড়ি রোমান্স করা ছেলেদেরই পছন্দ করে। ‘
‘ হ্যাঁ সেই। তুমি তো মেয়েদের নিয়ে পিএইচডি করেছ। ‘
‘ মেয়েদের নিয়ে না করলেও নামীদামিকে নিয়ে করেছি৷ একদম আপাদমস্তক। পা থেকে মাথার চুলের প্রতিটি গোড়া পর্যন্ত। প্রুফ চাই? ‘
শেষে প্রশ্নবোধক দু শব্দের বাক্যটি বলেই নামীর দিকে দুর্বোধ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। অমনি তার
বুকের বা’পাশে আচমকা কিল বসাল নামী। নিচু গলায় বলল,
‘ অসভ্য, খুব খারাপ তুমি। ‘
সুহাস টোপ করে অসভ্য বলা মুখটায় চুমু খেল। এরপর চট করে ওঠে গিয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে ফিরে এলো৷ নামী ঢোক গিলে ত্বরিত স্বরে বলল,
‘ সারারাত জ্বরে কাতরাচ্ছিলে সুহাস। অসুস্থতা কাটেনি পুরোপুরি। ‘
সুহাস হেঁচকা টানে ফের বুকে জড়াল ওকে। কানের লতিতে আলতো কামড় দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ এইতো এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাব আমি। ‘
‘ সুহাস… ‘
তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে সুহাস বলল,
‘ আদর করার সময় বাঁধা দেওয়ার অভ্যেস ছাড়ো৷ জানোই তো বাঁধা দিলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠি আমি৷ নাকি ইচ্ছে করেই এমন করো। আমার বেপরোয়া ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় পড়েছ নাকি?’
চুপসে গেল নামী। লজ্জায় যাচ্ছেতাই হয়ে গেল যেন।
বুকে ধুকপুক শুরু হলো। সুহাস যেন আজ খুব বেশিই বেপরোয়া। দূরত্বই বুঝি পেছনের কারণ? দেহ শিরশির করল। তিরতির করে কেঁপে ওঠল ঠোঁটদ্বয়৷ সুহাস টের পেল৷ আদুরে স্পর্শে কাছে টেনে নিল গভীরভাবে। লজ্জা ভয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নামী। সুহাস হাসল৷ বেগ পেতে হলো বক্ষঃতলে নামীর দেহশ্রী বিছাতে। ধীরেধীরে একচ্ছত্র ভারিক্কি নিঃশ্বাসে দু’টো শরীর এলোমেলো হয়ে গেল। সময়ের প্রবাহে একজন সুখকর স্পর্শে বুঁদ হলো। আর অপরজন সুখদায়ক অশ্রুতে।
.
.
পরীক্ষা শেষ করে বেরুতেই সুহাসের মুখোমুখি হলো নামী৷ সুহাস তার হাতটা ধরে রিকশা নিল একটা৷ বলল,
‘ চলো। লেকের পাড়ে বসব কিছুক্ষণ। ‘
নামী মৃদু হেসে ওঠে বসল। সে জানে সুহাস এবার সিমরানকে নিয়ে আলোচনা করবে৷ সকালে খেতে বসে কথা তুলেছিল একবার৷ সে বলেছে পরীক্ষা শেষ করে ফ্রি মুডে সব শুনবে। আট মিনিটের পথে সুহাসের ফোন বাজছিল অনবরত। বারবার কেটে দিচ্ছল সুহাস৷ নামী জিজ্ঞেস করল,
‘ কে ফোন করেছে? ‘
‘ সৌধ। ‘
‘ ধরছ না কেন? ‘
‘ ইচ্ছে করছে না তাই। ‘
ক্রোধের সঙ্গে অভিমান স্পষ্ট। এই ক্রোধ, এই অভিমানের পেছনের কারণ খুঁজে পেল না নামী৷ এত ভালো বন্ধু ওরা৷ ওদের বন্ধুত্ব ভাই, ভাই সম্পর্ককেও হার মানায়। তাহলে এই অভিমান, ক্রোধের উপসর্গ কী?
.
পাশাপাশি লেকের ধারে চুপচাপ বসে আছে দু’জন। নামী আশপাশে তাকিয়ে দেখছে একজোড়া কিশোর, কিশোরীকে। তারা একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মুচকি হাসল সে। তাকাল সুহাসের পানে৷ সুহাস তার দিকেই স্থির নেত্রে তাকিয়ে। সে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ সিনু সৌধকে ভালোবাসে। ‘
সুহাস অপেক্ষায় ছিল নামীর চোখে বিস্ময় দেখতে। মুখে বিস্ময় ভরা কিছু বুলিও শুনতে চেয়েছিল৷ কিন্তু এমনটা হলো না৷ নামী নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
‘ এরজন্য এত রাগ কেন সুহাস? একটা মেয়ে কি একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে না? ‘
‘ পারে৷ কিন্তু মেয়েটা আমার বোন হলে পারে না। ছেলেটা সৌধ হলে ভালোবাসা অন্যায়। ‘
তাচ্ছিল্য ভরে হাসল নামী। বলল,
‘ ভালোবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না। সিনুর ভালোবাসায় আমি কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। ‘
‘ সবকিছু জেনেও এভাবে বলতে পারছ? ‘
‘ কেন পারব না? ‘
‘ সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। নিধির প্রতি ওর অনুভূতির প্রগাঢ়তা তুমি জানতে। ‘
‘ আমি সিনুর ভালোবাসার প্রগাঢ়তাও জানি। ‘
‘ হোয়াট! ‘
বিস্ফোরিত কণ্ঠ সুহাসের। সহসা ওর হাত চেপে ধরল নামী৷ বলল,
‘ ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনো। আমি সবটা আগে থেকেই জানি। বলতে পারিনি কারণ সৌধ ভাই নিধিকে ভালোবাসত। তাছাড়া যখন জানতে পারি তখন তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে দূরত্ব ছিল। আর যখন থেকে সম্পর্ক ভালো হয়েছে। বলতে চেয়েছি ব্যাপারটা, কোনো না কোনোভাবে বাঁধা পেয়েছি। মানসিক দ্বন্দ্বের কবলে পড়েছি৷ তাই বলা হয়নি। ‘
সুহাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ সব জেনেও সিনুকে বাঁধা দাওনি কেন? ‘
‘ তোমার বোন নাবালিকা নয় সুহাস। আর না সে আমার বাধ্যগত। ‘
‘ ও তোমাকে মানে। ‘
‘ এক্ষেত্রে ও কাউকে মানে না। ‘
নিভে গেল সুহাস। কিয়ৎক্ষণ থম মেরে থেকে বলল,
‘ আমার কী করা উচিত? ‘
নামী এবার ওর কাঁধ স্পর্শ করল। বলল,
‘ আমরা সবাই মিলে কি পারি না সৌধ ভাই আর সিনুকে এক করতে? ট্রাস্ট মি, এণ্ড ট্রাস্ট হার। ও খুব ভালোবাসে সৌধ ভাইকে৷ আমি ওর ভালোবাসাকে সম্মান করি৷ খুব কাছ থেকে দেখেছি, অনুভব করেছি সিনুর গভীর ভালোবাসাকে। এতদিন পুরোপুরি সমর্থন করতে পারিনি নিধি আপুর জন্য। কিন্তু নিধি আপু যখন সৌধ ভাইকে ভালোই বাসে না৷ নিজের জীবনে অন্য একজনকে বেছে নিয়েছে তখন সৌধ ভাইয়ের পাশে যোগ্য হিসেবে সিনুকেই পাচ্ছি আমি।’
‘ অসম্ভব। ‘
‘ কেন অসম্ভব সুহাস? সিনুর জন্য কি তুমি এমন একজনকেই চাইতে না? ‘
‘ চাইতাম কিন্তু তার হৃদয়ে সিনুর প্রতি গভীর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে চাইতাম৷ সৌধ দ্বিতীয় কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না নামী। আমি আমার বোনকে খুব ভালোবাসি। আমি ওকে স্বামীর ভালোবাসা বিহীন সংসারী দেখতে চাই না। আমি আমার মাকে যে জায়গায় দেখেছি সে জায়গায় সিনুকে দেখতে চাই না। ‘
‘ দেখবে না। ‘
তীব্র আত্মবিশ্বাসী স্বর নামীর। সুহাস ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
‘ তুমি কী করে নিশ্চিত হচ্ছো?’
কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল নামী। মনে মনে ভাবল বলাটা ঠিক হবে না। সুহাসের মা অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিল বলেই সে সংসার জীবনে সুখী হতে পারেনি। কিন্তু সিমরান তা নয়৷ সে কারো ভালোবাসা কেড়ে নিচ্ছে না। বরং নিজের ভালোবাসাকেই মনে, প্রাণে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটির ভগ্ন হৃদয় নিজের ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করতে চাচ্ছে। উদ্দেশ্য সৎ থাকলে জীবনে সুখী হওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এসব সুহাসকে বলতে পারল না। মায়ের বিরুদ্ধে সন্তানকে বলে লাভ নেই। বলা উচিতও নয়৷ তাই শুধু বলল,
‘ সিনুর ভালোবাসায় আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে৷ আস্থা আছে সৌধ ভাইয়ের বিচক্ষণতায়ও। তার দ্বারা ভুল একবারি হয়েছে। ভুল মানুষকে বাছাই করে। দ্বিতীয়বার হবে না আশা করি৷ এবার নিজের জীবনে সঠিক মানুষকে চিনে ঠিক বাছাই করে নিবে। ‘
তাচ্ছিল্যতার হাসি হাসল সুহাস। নামীর কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ ও এক কথার মানুষ নামী। ও যখন বলেছে সিনুকে বিয়ে করবে না এর মানে করবেই না। গতকাল আন্টি বুঝিয়েছে। লাভ হয়নি। ‘
নামী সুক্ষ্ম চোখে তাকাল। রয়েসয়ে বলল,
‘ আমি যদি ভুল না করি সুহাস তুমি সৌধ ভাইয়ের ওপর কিছুটা রেগে আছো। সৌধ ভাই তোমার বোনকে রিজেক্ট করেছে এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মনকে বুঝ দিচ্ছ এত বছরের পরিচিত সৌধর অনুভূতি গুলোকে সম্মান করে। শতহোক সিনু তোমার বোন। নিঃসন্দেহে সৌধ ভাই তার উপযুক্ত। এভাবে রিজেক্ট হলে খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু কী জানো সৌধ ভাই এখন যা বলছে, যা করছে এগুলো একটাও সে তার স্বীয় সত্তা থেকে বলছে, করছে না৷ সে এখন একজন ভঙ্গুর মানুষ। নিজের আবেগ, অনুভূতি ভেঙেচুরে নিঃস্ব প্রায়। এমতাবস্থায় তার কোনো কথা বা সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া অনুচিত। ‘
নামীর বিচক্ষণতা মুগ্ধ হওয়ার মতোই। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়ে রাগান্বিত হলো সুহাস। বলল,
‘ ভুল তুমি। সৌধ নিধিকে ভালোবেসে ছ্যাঁকা খেয়েছে। আমি কোনো ছ্যাঁকা খাওয়া মানুষের কাছে আমার নিষ্পাপ বোনকে দিতে রাজি নই। রাগ আমার সিনুর প্রতি। পৃথিবীতে এত এত ছেলে থাকতে ও কেন সৌধর মতো ব্যাকুবকে বেছে নিল? ‘
মুখে এ কথা বলে মনে মনে ভাবতে লাগল নামীর শেষ কথাগুলো নিয়ে। এদিকে তার কথা শুনে আচমকা হেসে ফেলল নামী৷ সে হাসিতে সুহাসের ক্রোধ গাঢ় হলো। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে ওঠে নামী বলল,
‘ উহুম বোনের প্রতি রাগ না অভিমান তোমার। ইশ বোন তার ভালোবাসার মানুষকে পাবে না৷ আজ বন্ধুকে যে অবস্থায় দেখছ কাল বোনকে সে অবস্থায় দেখার ভয়ে আছো খুব৷ ‘
এটুকু বলেই সুহাসের কাঁধে মাথা রাখল। বলল,
‘ শোনো সুহাস। বউ আমি তোমার। তোমাকে তোমার থেকেও বেশি আমি চিনি, বুঝি। ‘
এক নির্মল ভালো লাগায় সহসা বুক শীতল হয়ে ওঠল সুহাসের। বলল,
‘ সৌধ সিনুকে জীবনসঙ্গী রূপে চায় না নামী। কী করব এখন আমি? সিনুকে কীভাবে সামলাব। ও যে শেষ হয়ে যাবে৷ কী দরকার ছিল সৌধকে ভালোবাসার? আমরা সবাই মিলে ওর জন্য একজন বেস্ট পার্সন এনে দিতে পারব না বলো? ‘
‘ এত টেনশন করছ কেন তুমি? উপরে যিনি আছেন তার পরিকল্পনার চেয়ে বেস্ট কিছু হতে পারে?’
‘ তুমি সিনুকে বুঝাও৷ তুমিই পারবে ওকে বুঝাতে। সৌধ ওর জন্য ঠিক নয়, একদম ঠিক নয়। ‘
নামী পাত্তা দিল না সে কথায়। মনে মনে বলল,
‘ আগে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় দেখি। তারপর না বোঝানোর পালা। ‘
মুখে বলল,
‘ সৌধ ভাইয়ের বাবা, মা কী বলেন দেখো৷ এরপর তোমার বাবা, মায়ের সিদ্ধান্ত দেখো৷ বড়োদের সিদ্ধান্ত জানার পর আমরা সিনুকে বুঝাব৷ তার আগে নিজেকে শান্ত করো। সিনুর গায়ে হাত তুলেছ না? ভুল করেছ। কারো অনুভূতিকে আঘাত করতে নেই। তুমি কাল ওর গায়ে আঘাত করোনি৷ করেছ অনুভূতিকে। বাবা, মায়ের থেকে ও তোমাকে বেশি ভরসা করে৷ সেই তুমিই যদি এমন করো ও কোথায় যাবে? কার কাছে আশ্রয় নিবে?
.
.
গুটিগুটি পায়ে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। লক্ষ ভ্রষ্ট সৌধ৷ বন্ধুরা যে যার মতো ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে। অথচ সে নিরাসক্ত, লক্ষ হীন জীবন কাটাচ্ছে। মাত্র দুই কি তিন মাসের ব্যবধান। অর্পণ স্যার বাবা হবে। একেবারে সফল পুরুষ। নিধি মা হবে। ক্যারিয়ার গুছানো। স্বামী, সন্তান নিয়ে এবার সুখের সংসার৷ সুহাস, আইয়াজ সবাই সবার পথে এগিয়ে চলেছে। থেমে আছে শুধু সৌধ। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব অবশ্য পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কি করছে। এগিয়ে চলার বিন্দু উৎসাহ, ইচ্ছে কোনোটাই পাচ্ছে না সৌধ। সে আপতত বিয়ার খেতে খেতে ল্যাপটপে মুভি দেখছে। ভারতীয় মুভি। দিন গুলো অবশ কাটে তার। রাতগুলো কাটে তীব্র বিষাদে। মনকে একটু হালকা রাখার জন্যই রোজ সিগারেট, বিয়ার আর মুভিতে ডুবে থাকে। ‘একজন এমপির যোগ্য পুত্র কি একেই বলে?’ ভেড়ানো দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে প্রশ্নটি করলেন সুজা চৌধুরী। এতক্ষণ জানালা দিয়ে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করে আর চুপ থাকতে পারেনি মানুষটা। সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি পরনে। চিবুক ভরা মেহেদি রাঙা দাঁড়ি। দৃষ্টি জোড়া চৌকস। তুখোড় রাজনীতিবিদ। বাবা সামনে দাঁড়িয়ে। কোলের ওপর থাকা ল্যাপটপটা কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত সহকারে বা’পাশে রাখল সৌধ৷ বা’হাতে থাকা বিয়ারের বোতল অত্যন্ত কৌশলে বিছানার ওপাশে ফেলে দিল৷ বিপত্তি ঘটল ফ্লোরে পড়ে তা অদ্ভুত শব্দ করল বলে৷ সুজা চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সৌধ মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বাবাকে বসার জায়গা করে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ বসুন আব্বা। ‘
দৃঢ় চোয়ালে, ভারিক্কি কদম ফেলে ছেলের কাছাকাছি এলো সুজা চৌধুরী। অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বসল একপাশে। ততক্ষণে সৌধ পাশ থেকে টি-শার্ট পরে নিজের আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ, উদাম শরীরটা ঢেকে নিয়েছে।
‘ এত খেটেখুটে ডাক্তারি পাশ করলা রাতে ঘরে বসে বিয়ার পান করার জন্য? এটাত বুঝিনাই আব্বা। ‘
সৌধর বুকটা ভার হয়ে ওঠল৷ করুণ চোখে তাকিয়ে রইল শ্রদ্ধেয় আব্বার পানে। সুজা চৌধুরী ছেলের দৃষ্টি দেখে গম্ভীরতা কমিয়ে নিলেন। বললেন,
‘ আগামীকাল সোহান আসতেছে। তোমার আর সিনুর বিয়ে উপলক্ষে কথা বলব আমরা। তোমার আপত্তি আছে জানি৷ কিছু কিছু সময় সন্তানদের আপত্তি থাকলেও বাবা, মাকে বিরোধিতা করতে হয়। আমাদের এখন সেই সময়টা আসছে। ‘
এ পর্যন্ত বলেই ছেলের দিকে তাকালেন। সৌধ যেন নিঃশ্বাস আঁটকে রয়েছে। টের পেয়ে বললেন,
‘ নিঃশ্বাস ছাড়ো। আর কত আঁটকে রাখবা? আমার ছেলে এত দুর্বল প্রকৃতির জানা ছিল না। সবল হও। সুজা চৌধুরীর ছেলেদের এভাবে মানায় না। ‘
‘ আব্বা…।’
‘ এ বিষয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। তুমি এত বড়োও হয়ে যাও নাই যে নিজের সব ভালো বুঝবা। নিজের সব সিদ্ধান্ত নিবা। যেদিন আমার মতো আব্বা হবা সেদিন নিজের সব সিদ্ধান্ত নিয়ো। আর শুনলাম কোনো হসপিটালে জয়েন দিতেছ না। আর দিয়ে কাজ নাই। যেখানে পড়াশোনা করছ ঐখানেই লেকচারার হিসেবে ঢুইকা যাও। নাকি বাইরে টাইরে যাবা? ‘
সৌধ নিশ্চুপ। অত্যন্ত সচেতনতার সাথে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কখনো বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে, গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে বলতে। ইচ্ছে করছে ভয়ানক বেয়াদব রূপে উপস্থাপন করতে নিজেকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্ত বদলালো। বাবা, মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ হবে না। হয় তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে নয়তো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে হবে। দু’টো কাজই তার জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং অসম্ভব ব্যাপার। তাই ভাবল, আগামীকাল সে উদয়িনী আন্টির সাথে দেখা করবে। এরপর কথা বলবে সিনুর সঙ্গে। এই দু’জনই পারে তাকে সাহায্য করতে। নিজের জীবনে এত বড়ো বিপর্যয়ের পেছনে যার হাত রয়েছে তাকে একবার স্মরণ করল সৌধ। মনে মনে বলল,
‘ তোকে আসলে ক্ষমা করা যায় না নিধি। বেইমান একটা। তোর জন্য সারাজীবন যুদ্ধ করে গেলাম আমি৷ এতদিন মনের সঙ্গে করেছি। এখন পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে করব। ‘
সুজা চৌধুরী চলে গেলেন। আগামীকাল শুধু সোহান খন্দকারই আসবে। উদয়িনী বা সুহাস আসবে না৷ সৌধ জানে এই দু’জনের কেউই রাজি নয় সিনু আর তার বিয়েতে৷
সৌধ চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার ভাবনায় এখন সিমরান এসে ভর করেছে। কখনো ভাবেনি সিমরানের সঙ্গে তার সম্পর্কের সমীকরণ এভাবে বদলে যাবে। কিঞ্চিৎ আফসোস হলো। বিরবির করে বলল,
‘ তুই অনেক ভালো মেয়ে সিনু। এতবড়ো ভুল কী করে, করে ফেললি তুই? আমার চেয়ে অনেক ব্যাটার কাউকে ডিজার্ভ করিস তুই। প্রে ফর ইউ, আমার প্রতি তোর সব অনুভূতি মুছে যাক। ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। সিমরান সুহাসের বোন৷ মেয়েটাকে ছোটো থেকে দেখছে সে। ব্যক্তিত্বে চঞ্চলতা আছে,প্রচণ্ড রাগ, জেদও আছে। ম্যাচিওরিটি নেই। ও ঠিক নিধির বিপরীত স্বভাবের। ভেবেই অস্থিরতা অনুভব করল। ফের ভাবল, বিপরীত হওয়াটাই ভালো। সিনু আর যাইহোক নিধির মতো স্বার্থপর, বেইমান না৷ অনেস্ট একটা মেয়ে৷ এ পর্যায়ে সৌধর কাছে নিধির চেয়ে সিমরানের ব্যক্তিত্ব অনেক উঁচুতে ওঠে গেল।
সব ছাপিয়ে সিমরানের মাঝে নরম একটা মনও আছে। ওই মনটুকুতে আঘাত করতে চায় না সৌধ। কাল সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পর হয়তো ক্ষণিকের জন্য আঘাত পাবে৷ কিন্তু বেঁচে যাবে চিরজীবনের জন্য। সৌধ নামক অগ্নিকুণ্ডতে জেনেশুনে ও পুড়বে না। পুড়তে চাইলেও সৌধ পুড়তে দিবে না। কিছু জিনিস থাকে খুব নরম আদরের। সিমরান তার জীবনে এমনই একজন। যাকে কষ্ট দিতে চায় না, কাঁদাতে চায় না বলেই জীবনে জড়াবে না৷ কারণ এ জীবনে দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব না। ভালোবাসা বিহীন, অনুভূতি ছাড়া সিমরানকে নিজের বউ করার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য কোনো ছেলে হয়তো পারত৷ কিন্তু সৌধ পারবে না। সে সবার ব্যক্তিত্বের ঊর্ধ্বে জীবন যাপন করে৷ সবাই যা পারে সে তা পারে না। আর সবাই যা পারে না তাই সে করে দেখাতে পছন্দ করে।
সৌধ জীবনে বিয়ের সম্পর্কে জড়াব কিনা তার ইয়ত্তা নেই। যদিও বা জড়ায় তা কারো চাপে পড়ে নয়৷ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় জড়াবে৷ পরিস্থিতি যেমনি হোক নিজ সিদ্ধান্তে সে অটল। হোক তা বাবা, মায়ের সামনে বিরোধীতা করে বা আড়ালে, চতুরতা খাঁটিয়ে।
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা