#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৯|
গত কয়েকদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দিন নেই রাত নেই প্রকৃতি মুখরিত হয়ে আছে শ্রাবণ ধারায়। সুহাস, আইয়াজ গতকাল ঢাকায় ফিরেছে। ছুটি শেষ ওদের। ফারাহ আপাতত নামীর সঙ্গে নামীর বাসাতে থাকছে। একমাসের মধ্যে আইয়াজ তার পরিবারকে মানিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফারাহকে ঘরে তুলবে। আজ আইয়াজ আর সৌধর নাইট ডিউটি। তাই ওরা দু’জন হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। ফাঁকা বাসায় আয়েশ করতে করতে সুহাস কল করল নামীকে। নামী ব্যস্ত থাকায় ফোন রিসিভ করল ফারাহ। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া নামী শাওয়ার নিচ্ছে। ‘
সুহাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
‘ রাত বাজে ন’টা। এখন শাওয়ার নিচ্ছে মানে? জ্বর, ঠান্ডা লাগানোর মতলব করছে নাকি তোমার বান্ধবী? ‘
ফারাহ বিব্রত হলো। বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে গেল সুহাস। বলল,
‘ নামী এলে ব্যাক করতে বলো। ‘
ফোন কেটে দৃঢ়চিত্তে প্রচণ্ড ঝগড়ার সিদ্ধান্ত নিল সুহাস। কয়েকদিন ভালোবাসায় বুঁদ থেকে ঝগড়ার সময় হয়ে ওঠেনি। আজ বাসা ফাঁকা, বিশেষ করে সৌধ নেই। আরামসে, জবরদস্ত ভাবে ঝগড়া করা যাবে। মনটা শিহরিত হয়ে ওঠল সুহাসের। অনেকদিন পর তার সুহাসিনীকে আজ কঠিন রাগিনী রূপে দর্শন করবে। ঝগড়ার শুরুটা কী নিয়ে করবে? বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে ভাবল, প্রথমে সন্দেহি হওয়ার ভাণ করে এত রাতে শাওয়ার নেয়ার রহস্য জানতে চাইবে। ব্যস দপ করে জ্বলে ওঠবে নামীদামি!
.
.
হসপিটালে ঢুকতে না ঢুকতেই নিধির সম্মুখীন হলো সৌধ। কয়েক হাত দূরে একজন সিনিয়র ডক্টরের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে নিধি৷ সৌধ আর আইয়াজকে দেখে একটুখানি হাসল। সৌধ এক পলক দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে শ্বাসরোধ করে ত্বরিত স্থান ত্যাগ করল। তার পিছু পিছু ছুটল আইয়াজও৷ নিধি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরল সম্মুখে থাকা ডক্টরের ডাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি। কথা শেষে চলে গেল নিজের কাজে। একজন মহিলার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। তার ডি এন সি করানো হচ্ছে। পাশের কেবিন থেকে গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসছে। যে চিৎকার গুলো শুনে নিধির শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সে একজন প্যাশেন্টকে ইনজেকশন পুশ করতে গিয়ে হাতে কাঁপন ধরিয়ে ফেলল। পাশ থেকে সিনিয়র ডক্টর ধমকে ওঠল তাকে। ধমক খেয়ে নিজের কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সিনিয়র ডক্টর বুঝতে পারলেন তার অস্বাভাবিকতা৷ তাই বললেন,
‘ তোমাকে কিছুটা ডিপ্রেশড লাগছে। এভাবে রুগি দেখবে কী করে? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। ‘
‘ জি স্যার। ‘
ক্ষীণ কণ্ঠে এটুকু বলেই ত্বরিত বেরিয়ে এলো নিধি। আশপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজল যেন। না পেয়ে কল করল আইয়াজের ফোনে। এত বছরের বন্ধুত্ব তাদের। এই প্রথম এতখানি অবহেলা, এড়িয়ে চলা। মেনে নিতে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। সৌধর ব্যাপারটা না হয় আলাদা। আইয়াজও কথা বলল না? মনের ভিতর এসবই চলছিল তার৷ ফলে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিল৷ এরওপর কারো হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। যা তার হৃদয়ও ব্যথিত করল। সব মিলিয়ে অবস্থা করুণ। আইয়াজ ফোন না ধরাতে সেই করুণতা বৃদ্ধি পেল। হাসফাস চিত্তে এদিকওদিক ঘুরতে লাগল সে। তক্ষুনি ফোন এলো অর্পণ স্যারের। ফোন রিসিভ করতেই ভালো, মন্দ জিজ্ঞেস না করে সরাসরি অর্পণ স্যার প্রশ্ন করল,
‘ মা’কে ফোন দিয়েছিলে? ‘
আঁতকে ওঠল নিধি। বলল,
‘ সরি আমার খেয়াল ছিল না। ডিউটিতে আছি কাল সকালে দিব। ‘
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অর্পণের। চটে যাওয়া মেজাজি কণ্ঠেই বলল,
‘ ইট’স নট রাইট নিধি। আমার মায়ের একমাত্র ছেলের বউ তুমি৷ তোমার থেকে উনি অনেকবেশি আশা করে৷ তিনদিন হয়ে গেল মাকে একটা ফোনকল করার সময় তুমি পাওনি। এখন ডিউটির অজুহাত দিচ্ছ? সারাদিন কী করলে বাসায়? নাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছ সারাদিন! এক মিনিট, সৌধদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার? ‘
একনাগাড়ে এতগুলো কথা শুনে মাথা ধরে গেল নিধির। বিষণ্ন মনটা বিষিয়ে ওঠল খুব৷ তবু স্বামী হিসেবে সম্মান পূর্বক শেষ কথাটির জবাব দিল,
‘ হ্যা হয়েছিল। ‘
সেদিন বিয়ে বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভুলতে পারেনি অর্পণ স্যার। বন্ধুত্বের পাশাপাশি সৌধ নিধিকে ভালোবাসে আর নিধি স্রেফ বন্ধুই ভাবে। এ কথা নিধিই জানিয়েছে তাকে৷ সৌধর হয়ে ক্ষমা চেয়েছে অনেকবার৷ কান্নাকাটি করেছে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে। নিধির কোনো দোষ পায়নি অর্পণ স্যার৷ আর না সৌধকে দোষারোপ করতে পেরেছিল। সেদিন তিন বন্ধু খোলা চোখে যা দেখেছে তারই প্রতিবাদ করেছে। তারা তো আর জানত না তার আর নিধির ভেতরকার সম্পর্কটির কথা। তাই ওইদিনের ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ দূর্ঘটনা হিসেবেই নিয়েছে। তবু কিঞ্চিৎ অপমানের রেশ থেকে গেছে সুপ্তভাবে। খুবই ভদ্র শ্রেণীর মানুষ হওয়ার সুবাদে এ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি৷ সবচেয়ে বড়ো কথা বউয়ের বন্ধু ওরা৷ বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় খুঁজে পায়নি৷ কিন্তু নিজের বউকে অন্য কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখছে বা দেখবে এটা তার অহমিকায় আঘাত করে৷ তাই নিধিকে বোঝায়, সৌধর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে৷ যদিও নিধি কিছু বলেনি৷ তবু অর্পণ বুঝে নিয়েছিল তার কথা মেনে চলবে নিধি৷ কতটুকু মেনে চলল সেই সত্যতা যাচাই করতে প্রশ্ন করল,
‘ কথা হয়েছে? ‘
হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিধি উত্তর দিল,
‘ না। ‘
স্বস্তি পেল অর্পণ। বলল,
‘ সাবধানে থেকো। সমস্যা হলে জানিও আমাকে। ‘
‘ কী সমস্যা হবে? ‘
‘ প্রশ্ন করছ, বুঝতে পারছ না? সৌধ মোটেই সুবিধার ছেলে নয়। ‘
কপাল কুঁচকে গেল নিধির৷ শত হোক প্রিয় বন্ধু বলে কথা। তাই মন প্রতিবাদ করে ওঠল। শক্ত কণ্ঠে শুধাল,
‘ সুবিধার নয় বলতে কী বোঝাতে চাইলেন স্যার? সেদিন যা ঘটেছে তা ধরে আপনি সৌধকে বিচার করবেন না। সৌধ আর যাই হোক ক্যারেক্টারলেস নয়। সেদিন ও জানত না আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ। আমি ম্যারেড৷ কিন্তু আজ জানে…। ‘
‘ বন্ধুর জন্য স্বামীর সঙ্গে এমন শক্ত আচরণ! আমি একবারো বলিনি সৌধ চরিত্রহীন৷ ওকে আমিও জানি কিছুটা তবু ও তোমাকে ভালোবাসত। তোমার জন্য প্রচণ্ড ডেস্পারেট সৌধ। স্বামী হিসেবে এটুকু সচেতন করতেই পারি আমি। ‘
বিরক্ত হলো নিধি। থমথমে গলায় বলল,
‘ আপনার কথার টোন তেমনই ছিল। ‘
‘ ওকে ফাইন, হার মানলাম বউ। ঘুমাব আমি বুঝেছ?’
ছোটো করে উত্তর দিল নিধি,
‘ হু। ‘
অর্পণ স্যার বলল,
‘ শোনো, কষ্ট করে হলেও মাকে ফোন দিও একটা। জাস্ট তিন মিনিট সময় দিও। মা খুশি হবে, আমারো ভালো লাগবে৷ বিয়ে মানে শুধু বিয়েই নয় নিধি, বিয়ে মানে অনেকটা দায়বদ্ধতা। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ‘
‘ হু, রাখছি৷ গুড নাইট। ‘
চট করে কল কেটে দিল নিধি। হঠাৎই অর্পণ স্যারকে অসহ্য লাগছে তার। অথচ দু’দিন আগে অবধি তার কথায় মুগ্ধ হতো। তাকে দেখে বিমোহিত হতো চোখজোড়া। হৃদয় কোণে শিহরণ জাগত৷ কী প্রগাঢ় অনুভূতিতে সিক্ত ছিল মন। হঠাৎ করে এমন বিরক্তি ঠেকছে কেন? চারপাশ জুড়ে এত অসহ্য অসহ্য অনুভূতি কেন হঠাৎ? দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি৷ ভাবল মন ভালো নেই, বন্ধুরা এড়িয়ে চলছে৷ ওদিকে একই বাসায়, একই রুমে থেকেও প্রাচীকে আগের ন্যায় অনুভব করতে পারছে না৷ মেয়েটা কথা বলছে, মিশছে, হাসছে তবু যেন এক আকাশসম দূরত্ব। চোখে যেন এক সমুদ্র রাগ, অভিমান, ক্ষোভ। বাসায় প্রাচী হসপিটালে সৌধর পাশাপাশি আইয়াজের এড়িয়ে চলা সব মিলিয়ে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যা তার সমস্ত ভালোলাগা শুষে নিয়েছে। ফলে অর্পণ স্যারকেও এখন ভালো লাগছে না৷ কী অদ্ভুত মন তার। বিয়ে, স্বামী এসব কী আর ছেলেখেলা? গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অবস্থায় সহসা
মনে পড়ল আইয়াজকে কল করার কথা৷ ছেলেটা কল ধরল না। ব্যাকও করল না। তবে কী ওরা চাইছে না ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে! বুকের ভেতর গভীর এক চাপ অনুভব করল নিধি৷ অশান্ত হৃদয়ে পা বাড়াল আইয়াজের কেবিনের উদ্দেশ্যে। কেবিনে গিয়ে জানতে পারল আইয়াজ ইমারজেন্সিতে গেছে৷ ওর কোন আত্মীয় যেন এক্সিডেন্ট করেছে। কী আর করার হতাশ চিত্তে ফিরতে উদ্যত হলো নিধি। এমন সময় পাশের রেবিন থেকে সাদা অ্যাপ্রোন পরনে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো সৌধ বেরিয়ে এলো। আকস্মিক তাকে দেখে একটুখানি চমকালেও মুহুর্তেই সামলে নিল নিজেকে। এরপর সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই ত্বরিত ডাকল নিধি,
‘ সৌধ প্লিজ দাঁড়া। ‘
হাঁটা পা থেমে গেল সৌধর সম্মুখে দৃষ্টি অটল রেখে দু’পা পিছিয়ে এলো। কিন্তু ডানপাশ ঘুরে দাঁড়াল না। কান দু’টো সজাগ রাখল শুধু৷ নিধি ওর ভাবগতিক বুঝে ঢোক গিলল৷ ভয় ভয় কণ্ঠে বলল,
‘ তোরা এভাবে এড়িয়ে চলিস না আমাকে। মানছি আমার ভুল হয়েছে তোদের না জানিয়ে…।’
বাকিটুকু শোনার আর ধৈর্য্য রইল না সৌধর। শক্ত মুখে দৃঢ় চিত্তে প্রস্থান করল ত্বরিত। নিধি থমকে গেল। অসহায় চোখে নিষ্পলক দেখল রুদ্ধশ্বাসে সৌধর চলে যাওয়া৷ নিধির চোখের আড়ালে যাওয়া মাত্রই নিয়ন্ত্রণ হারাল সৌধ। সবার দৃষ্টির অগোচরে শক্ত মুঠো করে দেয়ালে ঘুষি দিল গোটা দশেক। এরপর বাথরুমে ঢুকে একবার নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরল। আরেকবার বুকের যে পাশটায় অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে সে পাশে খামচে ধরল। মনে মনে হাজারবার আর্তনাদ করে ওঠল,
‘ তুই আমাকে ডাকিস না রে, তুই আমার সামনে আসিস না রে বেইমান। ‘
.
.
ওদের ইন্টার্নির শেষ সময়গুলো ছিল খুবই দুর্বিষহ। সৌধ চাইত না নিধির সঙ্গে দেখা হোক৷ কিন্তু হয়ে যেত বারংবার। নিধি চাইত সুহাস, আইয়াজ, সৌধ, প্রাচী সবার সঙ্গে আগের মতো মন খুলে কথা বলতে। সময় কাটাতে চাইত বন্ধুদের সঙ্গে। কষ্ট পেত ওদের এড়িয়ে যাওয়া দেখে। দম বন্ধ লাগত, তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠত আগের সময় গুলো স্মরণ করে৷ স্মৃতির পাতায় সৌধর যত্নশীল আচরণ, সুহাসের দুষ্টুমি, আইয়াজের শীতল দুষ্ট স্বভাব, প্রাচীর বোনবোধ মিস করত খুব৷ কখনো কখনো তার শক্ত হৃদয় নরম হতো, কান্নাও করত। ইন্টার্নির শেষ দিন ফেরার পথে তো মেয়েটা সর্বসম্মুখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না সবাই সহ্য করলেও সহ্য করল না সৌধ। সে প্রচণ্ড রাগান্বিত হলো প্রাচীর ওপর, সুহাস আর আইয়াজের ওপরও। নিধি তাকে ঠকিয়েছে, তার সঙ্গে বেইমানি করেছে শাস্তি কেন সবাই মিলে দেবে? প্রাচীকে ধমকাল খুব। সুহাস, আইয়াজকেও ধমকে বলল,
‘ আমি একাই তোদের বন্ধু? ও বন্ধু নয়? কথা বলছিস না কেন ওর সঙ্গে? শেষদিন অন্তত তোরা একসঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারিস। আমার কোনো প্রবলেম হবে না। ‘
সৌধর কথায় সকলে স্তম্ভিত। কাঁদল নিধি একাই৷ ওর কান্নায় সৌধর ক্রোধ বাড়ল মারাত্মকভাবে। পকেট থেকে টিস্যু ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘ তোকে কাঁদলে মানায় না। যারা মানুষকে কাঁদায় তারা কাঁদলে হাস্যকর লাগে, অসহ্য ঠেকে। কান্না থামা, চোখের পানি মোছ। নয়তো থা প ড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব৷ তখন তোর অর্পণ তার মনের দর্পণে আর ঠাঁই দিবে না৷ ‘
সৌধর এহেন কথায় সকল মূঢ় হয়ে গেল। আর নিধি আবেগান্বিত হয়ে আকস্মিক সৌধকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল ওর জীবনে। সৌধ তো অপমান করে গা ঝাড়া দিয়ে ছুঁড়ে ফেললই৷ এদিকে অর্পণ স্যারের পরিচিত এক নার্স দৃশ্যটি দেখে দূর থেকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল মুহুর্তেই। বউয়ের প্রতি গোপন সন্দেহ ছিল অর্পণের। সে সন্দেহের জের ধরেই পরিচিত নার্সটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত৷ নিধির খেয়াল রাখতে বলত। সে খেয়ালটা কূটনীতিতে পরিণত হয়ে গেল হঠাৎ। আগে পড়ে না ভেবে নার্স মহিলাটির পাঠানো ছবির রেশ ধরেই অর্পণ, নিধির দাম্পত্য জীবনে অশান্তির সূচনা ঘটল…! এটা কী প্রকৃতির অভিশাপ নাকি করুণ নিয়তি?
তিনমাস পর,
বন্ধুমহল এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আইয়াজ, ফারাহ সুখে সংসার করছে। সোহান খন্দকারও উদয়িনীর সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে। নামীকে ঘরে তুলতে আপত্তি নেই উদয়িনীর। বেশ বড়ো করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেও প্রস্তুত সে। কিন্তু শশুর ঘরে ফিরে যেতে ঘোর আপত্তি নামীর৷ সে জানালো, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নড়চড় নেই। এই নিয়ে সুহাসের সঙ্গে তুমুল বাকবিতন্ডা হলো। সুহাসও জানিয়ে দিল, তার সঙ্গে না দেখা করবে আর না কথা বলবে। তার মা এতবড়ো মুখ করে সব আয়োজন করতে চাইল। আর সে দম্ভ দেখিয়ে না করে দিল? বেশ ভালো কথা। নামী যেমন ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে শশুর ঘরে পা মাড়াবে না। সেও তেমন নামীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ, ফোনকল, টেক্সট সমস্ত কিছু থেকে বিরত থাকবে। জেদ শুধু নামীর একারই নয় তারও আছে৷ সিদ্ধান্ত শুধু নামী না সেও নিতে পারে। সুতরাং সুহাস, নামী এখন পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন!
.
.
বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। বিয়ে নিয়ে সৌধর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে এক কথায় অনড়,
‘ আমি বিয়ে করব না৷ বিয়ে বিহীন বেঁচে থাকা অন্যায় হলে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দাও। ‘
ছেলের এহেন কথা শুনে মা তানজিম চৌধুরীর প্রেশার বাড়ে। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী রয় তিনদিন। একদিকে বিরহ বেদনা অন্যদিকে বিয়ের চাপ, মায়ের অসুস্থতা। সবমিলিয়ে সৌধ যেন আরো ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে৷ সিগারেটের পাশাপাশি অ্যালকোহলের প্রতিও ঝুঁকে পড়ে সে। সুজা চৌধুরীর কানে সমস্ত কথাই যায়। যেখানে সুহাস, আইয়াজ সহ সৌধর বাকি বন্ধুরা ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত। সেখানে সৌধর বেহাল দশা ভাবিয়ে তুলল তাকে। বন্ধু সোহান তাকে পরামর্শ দিল সৌধ যতই আপত্তি করুক, পাগলামি করুন বিয়ের বন্দোবস্ত করতে। তার বেপরোয়া, উদ্ধতস্বভাবের ছেলেটা যদি বিয়ের পর নামীর সংস্পর্শে এসে এতটা বদলাতে পারে৷ সৌধও নিশ্চয়ই পারবে। পুরুষ যতই কঠিন, শক্তিশালী হোক না কেন, যতই তাদের রক্ত উষ্ণ থাকুক নির্দিষ্ট একজন নারী যে কিনা তার অর্ধাঙ্গিনী তার সংস্পর্শে এলে ঠিক নরম, দুর্বল এবং শীতল হতে বাধ্য। বন্ধুর ইতিবাচক পরামর্শে সুজা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেয় এবার ছেলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে।
এদিকে অর্পণ স্যারের সঙ্গে নিধি এখন হসপিটাল কোয়ার্টারেই থাকে। তারা এখনো ডাক্তারি লাইসেন্স পায়নি। লাইসেন্স পাওয়ার আগ পর্যন্ত চর্চার ওপরে থাকবে৷ সপ্তাহে দু’দিন একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে বসে নিধি৷ একই শহরে থাকা সত্ত্বেও সৌধর সঙ্গে দেখা হয় না। এখন আর দেখা করার ইচ্ছেও হয় না। সৌধ তাকে সহ্য করতে পারে না। বন্ধুরা তার সঙ্গ পছন্দ করে না। তাই দূরত্ব বুকে পুষেই সংসার করে যাচ্ছে অর্পণ স্যারের সঙ্গে। সেদিনের সেই ঘটনার জন্য কম ভুগতে হয়নি৷ স্বামীর থেকে অপমান, অবহেলা, লাঞ্ছনা পেয়েও মাথা নত করে থেকেছে। একজন কঠিন ব্যক্তিত্বের নারীর ব্যক্তিত্ব কত সহজে একজন পুরুষ হরণ করে নিতে পারে নিজ জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। সে একজন প্রতিবাদী, প্রতিষ্ঠিত নারী হয়েও স্বামীর কাছে অতি নগন্য রূপে ধরা দিয়েছে। কেন দিয়েছে? এর সঠিক উত্তর নিজেকেও ঠিকঠাক দিতে পারবে না নিধি৷ আবার হয়তো দিতে পারবে কিন্তু দেবে না। কারণ তাকে ভালো থাকতে হবে। অর্পণ স্যারকে নিয়েই সুখে থাকতে হবে তাকে। যদি না পারে তবে অভিনয় করতে হবে সুখে থাকার৷ জগতে নারীর জন্য এ যে চির ধারিত অভিনয়। প্রতিষ্ঠিত সুন্দরী নারী হোক বা অসুন্দরী অশিক্ষিত, অবহেলিত গৃহিণী নারী৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনে নায়িকা না হলেও সুনিপুণ অভিনেত্রী। নিধির অভিনয় করে যেতে হবে৷ ক্লান্ত হলেও থামা যাবে না৷ কারণ যে সর্গীয় প্রেম অবহেলা, অনাদরে ফেলে ক্ষণিকের মোহে ডুবে অর্পণ স্যারকে বেছে নিয়েছে। সে প্রেমের সামনে নিজের অসুখ প্রকাশ করা যাবে না। নিজের অসুখী জীবন চিত্র সমাজ, বন্ধু, বান্ধবের সম্মুখে প্রকাশ হওয়ার ভয়েই অভিনয় করে যেতে হবে তাকে। দিনশেষে আফসোস রয়ে যাবে একটাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েও পাওয়া হলো না। নিজের ভুল অনুভূতির জন্য। নিধি আজ খুব করে অনুভব করে নিজের অনুভূতি দ্বারাই ভীষণ ভাবে প্রতারিত সে৷ সৌধর সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে কিনা জানে না৷ তবে নিজের সঙ্গে অনেক বড়ো একটি প্রতারণা করেছে। বিয়ের প্রথম দিকে নিধির মনে হতো অর্পণ স্যার তাকে ভীষণ ভালোবাসে। যে ভালোবাসার গভীরতা সৌধর ভালোবাসার চেয়ে হাজার গুণ বেশি৷ কিন্তু একসঙ্গে থাকতে থাকতে সে অনুভব করল, এরচেয়েও গভীরভাবে সৌধ তাকে ভালোবেসেছিল। যা তখন বুঝতে না পারলেও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে। এরপর যখন সৌধকে জড়িয়ে ধরা ছবি নিয়ে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হলো। তখন নিখুঁতভাবে অনুভব করল সে অর্পণ স্যারকে ভালোবাসে না৷ অর্পণ স্যারের প্রতি তার অনুভূতিটা আসলে মোহ মাত্র। বুকের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটল তখনি৷ যখন অর্পণ স্যারের কথায় তার মাথায় আসতে শুরু হলো এখানে সৌধ থাকলে কী বলত? নিশ্চয়ই এভাবে বলত, ওভাবে রিয়াক্ট করত। অর্পণ স্যার গভীর রাতে তার শরীর ছুঁয়ে কষ্ট দিলে আকস্মিক তার হৃদয় নড়ে ওঠত। মন বলত, এখানে সৌধ থাকলে নিশ্চয়ই এতটা হার্ডলি স্পর্শ করত না। মনে পড়ে যেত সৌধর করা সেই প্রথম চুম্বন মুহুর্তটুকু। কী আবেগপ্রবণ, কত ভালোবাসাময় ছিল সৌধর প্রতিটা কথায়, প্রতিটা স্পর্শে। এসব মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠত নিধি৷ গভীর রাতে দু’টো শরীর আদিম খেলা মত্ত। যার একটি মন ভালোবাসার অভাবে ডুকরে ওঠত। আকস্মিক নিধির কান্না শুনে অর্পণ স্যার বিরক্তি সুরে বলত,
‘ কী আশ্চর্য ফার্স্ট নাইটেও তো এভাবে কাঁদোনি! ‘
বলেই দূরে সরে যেত৷ এরপর সারারাত নির্ঘুম, ক্রন্দনরত নিধি ছটফট করতে করতে দীর্ঘ রাত পারি দিত৷ তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে অসহ্য হয়ে নিধি ভেবেছিল ডিভোর্স দেবে৷ বিয়ের এক বছর না যেতেই ডিভোর্স! এ নিয়েও গুমড়ে মরছিল মেয়েটা। তক্ষুনি মা বুদ্ধি দিল বাচ্চা নিতে৷ এতে তাদের সম্পর্ক মজবুত হবে। হুঁশে নয় বেহুঁশেই বাচ্চা নিয়ে নিল নিধি৷ সত্যি বলতে যে ভালোবাসা ভুলবশত দূরে ঠেলে এসেছে ঐ ভালোবাসা অর্পণ স্যারের কাছে পাওয়ার লোভ জন্মাল। কারণ এই মানুষটা তার স্বামী। সবশেষে তাদের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি পবিত্র সম্পর্ক আছে৷ যেটাতে প্রতিটি মেয়েই ভীষণ রকমের দুর্বল। দুর্বল নিধিও। সত্যি সত্যি অশান্তি কাটল ওদের৷ নতুন প্রাণের আগমনী বার্তায় প্রথম দিকের অর্পণকেই ফিরে পেল নিধি৷ বুকের ভেতর কিছুটা ক্ষ ত থেকে গেল অবশ্য। নিধি এখন তিনমাসের গর্ভবতী। তার গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে ওঠছে অর্পণ স্যারের অংশ। সেই অংশকে নিয়ে আজ বেরিয়েছে একটু ফুচকা খেতে৷ অর্পণ ব্যস্ত থাকায় একা একাই বেরিয়েছে। টুকটাক জিনিস কিনে ফুচকা খায়। খাওয়া শেষে অনুভব করে তার গা গুলাচ্ছে৷ তাই ত্বরিত সামনে থেকে পাঁচ মিশালি আচার কিনে রিকশা ডাকতে উদ্যত হয়৷ কিয়ৎক্ষণ অতিক্রান্ত হতেই মাথা চক্কর দেয় তার অমনি ভয়ে
জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে৷ যখন জ্ঞান ফেরে সম্মুখে স্তব্ধ মুখে, রক্তিম দৃষ্টিতে পলকহীন বসে থাকা সৌধকে দেখতে পায়! ভয়ে শিউরে ওঠে নিধি। ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসতেই দেখতে পায় তার দু’পাশে নামী আর ফারাহ বসে। নামী নিধিকে ধরে কিছু বলতে উদ্যত হতেই থমকানো কণ্ঠে সৌধ আদেশ করল,
‘ নামী, ফারাহ তোমরা দু’জন একটু বাইরে যাও। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা।
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪০|
বছর পেরোয়নি একটাও৷ তবু যেন বহু বছরের তৃষ্ণা। ঠিক এমন করেই তাকিয়ে আছে সৌধ। যে তাকানোতে বাইরে থেকে প্রকাশ পাচ্ছে তীব্র ক্রোধ, অভিমান। অথচ ভেতরে আকুলতায় ভরা। ব্যাকুলতায় গাঁথা। পুরুষালি দেহের ভিতর থাকা ছোট্ট হৃদযন্ত্রটা ছটফট করছে ভীষণ। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি দু’টো নির্মল হতে চাইছে ক্ষণে ক্ষণে। কী ভীষণ যুদ্ধ করে নিজের গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে ছেলেটা৷ কী ভয়ানক জেদ খাঁটিয়ে আঁটকে রেখেছে অনুভূতিদের। বাচিঁয়ে রেখেছে তীব্র রাগ, কঠিন জেদ। নিধির শরীরটা ভীষণ দুর্বল। মুখের ফর্সা ত্বক ফ্যাকাশেতে পরিণত হয়েছে। তার দুর্বল দেহের ভিতরে থাকা ছোট্ট হৃদয়খানি হঠাৎ অদ্ভূত অশান্তি চাপল। মলিন দৃষ্টিজোড়া ছলছল করে ওঠল। সে কোথায়, কীভাবে এলো, কেন এলো সব প্রশ্ন উহ্য রেখে সৌধর রাশভারি রক্তিম মুখটায় তাকিয়ে সহসা বলে ওঠল,
‘ এ কী অবস্থা তোর! কতদিন ধরে শেভ করিস না? বদ্ধ উন্মাদ লাগছে, ঠিক পাড়ার বখাটেদের মতো। ‘
সৌধর জীবন এখন ছন্নছাড়া। সারাজীবন ডিসিপ্লিন মেনে চলা ছেলেটা এখন উশৃংখল জীবন কাটাচ্ছে। যা তার চেহেরাতেও ফুটে ওঠেছে৷ নিয়ম মেনে না খাওয়াদাওয়া করে আর না শরীরের যত্ন নেয়। তাই তো মাথার এলোমেলো উষ্কখুষ্ক চুল, না কামানো ঘন দাঁড়ি, মোছ দেখে নিধি বিস্মিত। তার বিস্ময় কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল সৌধ। পা দু’টো লম্বা করে এক হাঁটুর ওপর হাত রেখে অন্য হাত ছেড়ে বসা ছিল সে। নিধির ছলছল দৃষ্টি আর মলিন মুখের প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে ফেলল৷ দু-হাত চট করে বুকে বেঁধে পা নাচাতে নাচাতে আকস্মিক চোখ বুজল৷ ভাবল কিছু একটা৷ এরপর চট করে চোখ খুলল। নিধি কিছুটা চমকে গিয়ে ঢোক গিলল। সৌধ খেয়াল করল আগের চেয়ে ঢেড় বেশি নিষ্পাপ আর সুন্দরী লাগছে নিধিকে। এলোমেলো চুল, মলিন মুখ, ভীত দৃষ্টি, শুষ্ক ঠোঁট। সর্বত্র জুড়েই আশ্চর্য রকমের সৌন্দর্যে ভরপুর। এই যে চোখের নিচের পাতলা ত্বক কাজল বিহীল কালচে বর্ণে পরিপূর্ণ। এতেও মারাত্মক সুদর্শনীয় লাগছে। ভাবতে ভাবতেই নিধির বুক বরাবর দৃষ্টি আটকাল। সহসা সৌধর চোখ নিচে নামতেই গলা শুঁকিয়ে গেল নিধির৷ ত্বরিত ওড়না ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খেয়াল করল সৌধ৷ তাচ্ছিল্য ভরে হাসল কিঞ্চিৎ। দৃষ্টি সরাল না৷ একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে পা নাচাতে নাচাতে ভাবল, ‘ওখানে থাকা মনটা সুন্দর তো?’
মুহুর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। চোখ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করল সম্মুখের নারীর প্রতি মুগ্ধতা, বুকের ভেতর হওয়া অসহনীয় ব্যথাকে মাটিচাপা দেয়ার চেষ্টা করল। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল নিধিকে ঘিরে সমস্ত অতীত৷ এত এত চেষ্টা কী সফল হলো? একদমই নয়। তবু পুরুষ তো? শক্তিশালী মনের অধিকারী কিনা… তাই ভাণ করল সব ঝেড়ে, মুছে পরিষ্কার করার৷ শেষ অব্দি অবশ্য পুরোপুরি পারল না। ঠিক যেমন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া আয়নাকে সারিয়ে তোলা যায় না৷ সৌধ নিজেও পারল না। দাগ ফুটে ওঠলই।
‘ তুই প্র্যাগনেন্ট? ‘
সহজ, স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন করতে অস্বাভাবিক ঠেকল সৌধর৷ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল। আচমকা সৌধর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেল নিধি। পড়ল তীব্র লজ্জা, অস্বস্তি আর ভয়ে। ঢোক গিলল সতর্ক হয়ে। উত্তর না পেয়ে একপেশে হাসল সৌধ। যাতে প্রকাশ পেল শুধুই তাচ্ছিল্য। নিধি জড়োসড়ো হয়ে গেল কেমন৷ মুখটা ছোটো হয়ে গেল খুব৷ সৌধ নিজে থেকেই ফের বলল,
‘ তোর শরীর দুর্বল। এমন অবস্থায় একা একা বেরিয়েছিস কেন জিজ্ঞেস করব না। তোর মহান স্বামী তোকে একা ছেড়েছে কেন তাও জিজ্ঞেস করব না। শুধু জিজ্ঞেস করব, তোর ক’মাস চলছে? বেবির টেককেয়ার করছিস না কেন? বেবিটা তো উড়ে আসেনি। তোদের ভালোবাসার মিলনেই এসেছে। ‘
শেষ বাক্যটি বলতেই নিঃশ্বাস আঁটকে গেল সৌধর। থেমে গেল ছেলেটা৷ দৃষ্টি নত হলো কিঞ্চিৎ। চোয়ালদ্বয় শক্ত হলো, নাকের দু’পাশে ফুলে ওঠল। বেঁধে রাখা হাত দু’টো ছেড়ে গেল আপনাআপনি। বসে থাকা নিধি বিচলিত হলো এহেন দৃশ্য দেখে। নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়ে ত্বরিত বেড থেকে নেমে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে সৌধর কাঁধ স্পর্শ করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
‘ সৌধ কী হলো, ঠিক আছিস? পাগলামি করিস না ভাই প্লিজ। ‘
স্বভাবসুলভ অতীতের ন্যায় ফের ভাই শব্দটি বলতেই সৌধর ঘোর কাটল৷ সম্বিৎ ফিরতেই সহসা মাথা তুলে রক্তিম দৃষ্টিতে তাকাল। নিধি আঁতকে পিছু হাঁটতে নিতেই শক্ত হাতের নিধির ডান হাত চেপে ধরল। শরীর দুর্বল থাকায় সৌধর বলিষ্ঠ হাতের কঠিন চাপে ব্যথায় হাত টনটন করে ওঠল নিধির। কাঁপা স্বরে বলল,
‘ ব্যথা পাচ্ছি। ‘
ফুঁসে ওঠা সাপটা যেন মিইয়ে গেল হঠাৎ। শক্ত খোলস পাল্টে নির্মল হয়ে গেল মুহুর্তেই। ধীরেধীরে হাতের বাঁধন আলগা করে দু-হাতে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল নিধির। মাথাটা ঠিক তলপেটের কাছে ছুঁইয়ে শ্বাসরোধ করে কম্পিত গলায় বলল,
‘ ও কেন আমার হলো না? ‘
কী আকুল ব্যথা প্রশ্নটিতে! সহসা ডুকরে ওঠল নিধি। ওর কান্নার শব্দে চমকে ওঠল সৌধ। পাগলপ্রায় হয়ে নিধিকে ছেড়ে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে আশপাশে তাকাল উন্মাদের মতো। এরপর তড়িঘড়ি করে কেবিন ছাড়তে উদ্যত হতেই ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল নিধি। পা দুটো অবশ হয়ে গেল সৌধর৷ কান জুড়ে বিস্ফোরণ ঘটাল নিধির হাউমাউ করে কান্নার শব্দ। সৌধ শক্ত মূর্তির ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়েই রইল। বুকের ভেতর বয়ে গেল কালবৈশাখী ঝড়। মিনিট দেড়েক পর কান্না থেমে গেল নিধির। আচমকা সৌধকে ছেড়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। শরীর দুলছিল তাই গিয়ে বসল বেডে। সৌধ আর ফিরে তাকাল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই বলল,
‘ তোর আড়াই মাস চলছে। এটাও গোপন রেখেছিলি। আমি গোপনীয়তা পছন্দ করি না৷ বিয়ে যখন করছিস বাচ্চা হবেই। কিন্তু মনে রাখিস, তুই আমার হসনি বলে তোর প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। ও আমার হয়নি বলে সেই ঘৃণাটা অটুট থাকবে। ‘
অশ্রুসিক্ত নয়নে চমকে তাকাল নিধি। সৌধ যেন টের পেল সেই তাকানো। ম্লান হেসে দুহাত পকেটে গুঁজে বুক টানটান করে বলল,
‘ নিধি শোন, ভুলবশতও আর কখনো আমাকে ভাই বলবি না। ‘
ক্রন্দনরত কণ্ঠে নিধি বলল,
‘ আমি তো তোর হইনি, তাহলে এখন কী সমস্যা? ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ৷ হতাশার সুরে বলল,
‘ বউ হোসনি সয়ে গেছে কিন্তু তোর বাচ্চার মামা হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য হবে না৷ ‘
বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠল নিধির। সৌধ কিয়ৎক্ষণ থেমে পুনরায় বলল,
‘ সাবধান করে গেলাম মাথায় রাখিস। আর তোর স্বামীকে বলিস, সপ্তাহে একদিন অন্তত বউকে দেয়ার জন্য। লাইফে টাকাই সবকিছু নয়। বউ, বাচ্চার থেকে বড়ো কিছু হতে পারে না। ‘
প্রস্থান করল সৌধ। ওড়নার আঁচল মুখে চেপে ফুঁপাতে লাগল নিধি। কয়েক পল পরেই নামী আর ফারাহর সঙ্গে একজন নার্স ঢুকল কেবিনে। তিনজন সচক্ষে দেখতে পেল ওড়নার আঁচল মুখে চেপে কাঁদছে নিধি। ওদের দেখে আকস্মিক সে কান্না থেমে গেল। নার্স বললেন,
‘ ম্যাম, স্যার এসে আপনাকে নিয়ে যাবে৷ কিছুক্ষণ এখানেই রেস্ট নিতে বলেছে। ‘
নিধি দেখল নার্স মহিলাটি তাদের দুই বাসা পরে থাকে। একমাস আগে কথা হয়েছিল একবার। যেদিন জানতে পারে সে গর্ভবতী। অর্পণ স্যার সেদিন সবার বাসায় মিষ্টি পাঠিয়েছিল তাদের মধ্যে এই নার্স আপাও ছিল। তবে কি এনার মাধ্যমেই সৌধ জানতে পেরেছে সে প্র্যাগনেন্ট? নামী, ফারাহর সঙ্গে কথা হলো কিছুক্ষণ। জানতে পারল, কেনাকাটা করে ফুচকা খেতে গিয়ে রাস্তার পাশে ভীড় দেখে কৌতূহল নিয়ে নামী, ফারাহ এগিয়ে আসে৷ ভীড়ের ভেতর তাকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে প্রচণ্ড তাড়াহুড়োয় তাকে নিয়ে হসপিটাল চলে আসে। সুহাস বর্তমানে ঢাকাতে। আওয়াজ গেছে চট্রগ্রাম। আশপাশে পরিচিত হেল্পফুল একমাত্র সৌধই রয়েছে। নিধির বিপদ! তারা বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে না? কোনোকিছু না ভেবেই সৌধকে কল করে নামী। ব্যস, সবকিছু ভুলে দিকবিদিকশুন্য হয়েই সৌধ উপস্থিত হয়। কিন্তু তাকে ফোন করা, তার উপস্থিতি যে একদম উচিত হয়নি এটা নামী সে সময় না বুঝলেও এবার বুঝতে পারছে। বিপদে মাথা কাজ করে না। আর এতে করেই ঘটে যায় আরেক বিপদ৷ অর্পণ স্যার এলো ঘন্টাখানিক পর। নামী, ফারাহকে দেখে সৌজন্য আচরণ প্রকাশ করল। তার অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হলো নামী। স্যারকে দূর থেকেই দেখেছে সে। ক্লাস পেয়েছিল খুব কমদিন। কাছ থেকে স্যার, স্টুডেন্ট সম্পর্কেই বাইরে আজই প্রথম আলাপ। মানুষটাকে বেশ ভালো লাগল তার। নিধি আপু সৌধ ভাইকে ভালোবাসেনি, বাসতে পারেনি। কিন্তু সে ভীষণ রুচিশীল আবারো টের পেল। কারণ অর্পণ স্যারের মতো মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাই করা দারুণ রুচিরই বহিঃপ্রকাশ। ভালোবাসায় আবেগ থাকে কিন্তু নিয়তি নয়। নিধি আপু হয়তো ভালোবাসাতেও আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি৷ আর সৌধ ভাই? তাকে কেবলই বন্ধু রূপে চেয়ে এসেছে। আজও চায়। প্রমাণ সরূপ কিছুক্ষণ আগের হাউমাউ করে কান্নাটিকেই ধরে নিল। অনুভব করল ঝোঁকের মাথায় সৌধকে ডাকা অন্যায় হয়ে গেছে। এদের সম্পর্ক এখন কোনদিকে বোঝা উচিত ছিল তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। অর্পণ স্যার তাদের খুব অনুরোধ করল বাসায় যেতে৷ কিন্তু তারা গেল না৷ বিদায় নিল স্যার আর নিধি আপুর থেকে। বিদায় নিয়ে হসপিটাল গেটের সামনে আসতেই দেখতে পেল সৌধর গাড়ি৷ অর্থাৎ এখনো সৌধ ফিরে যায়নি? দুরুদুরু বুকে এগিয়ে এলো নামী পাশাপাশি হাঁটল ফারাহ৷ গাড়ির কাছাকাছি আসতেই জানালা দিয়ে সৌধ মাথা বের করল। বলল,
‘ তোমাদের জন্য ওয়েট করছিলাম। ‘
.
.
কেটে গেল আরো তিনমাস। একদিন মাঝরাতে হঠাৎ সৌধর ফোনে নিধির কল এলো। ঘুমহীন সৌধ। সিগারেটের ধোঁয়ায় বুঁদ। হঠাৎ নিধির কল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিন্তু রিসিভ করল না। পরের বউ মাঝরাতে তাকে কল করবে কেন? পরের বউয়ের কল ধরতে বয়েই গেছে তার। মনে মনে এসব ভেবে অনবরত বাজতে থাকা ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল সৌধ। নিমেষে স্ক্রিন ফেটে বন্ধ হয়ে গেল ফোনটা। এরপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে। বেলা বারোটায় ঘুম ভাঙলে জানতে পারল সুহাস, আইয়াজ আর প্রাচী এসেছে!
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪১|
কোনোমতে শরীরে টি-শার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে এলো সৌধ৷ দেখতে পেল সুহাস, আইয়াজ আর প্রাচীর আতঙ্কিত মুখ। সুহাস ঢাকাতে ছিল, গতকাল সকালেই কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। তাই আকস্মিক সুহাসের আগমন সন্দেহ তৈরি করল মনে। আইয়াজ আর ফারাহর গত মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আইয়াজের বিয়েতে প্রাচী উপস্থিত থাকতে পারেনি৷ সুহাস, নামী আর সে উপস্থিত ছিল। বর্তমানে আইয়াজ ঢাকাতে থাকে আর ফারাহ এখানেই নামীর সঙ্গে থাকে। পরীক্ষা চলছে তাদের। হুট করে আইয়াজও তার বাড়িতে! আর প্রাচী? সে তো অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু’দিন আগেই কথা হলো। বলেছিল যাওয়ার আগে সময়, সুযোগ বুঝে দেখা করবে সবার সঙ্গে। কিন্তু আজ হঠাৎ এভাবে? চোখে, মুখে তীব্র দুঃশ্চিতার ছাপ নিয়ে কেন?
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে এগিয়ে এলো সৌধ। যখন ওদের একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়াল আচম্বিতে মস্তিষ্ক স্মরণ করিয়ে দিল গতরাতে নিধির ফোনকল পাওয়ার কথা। যে কারণে ক্রোধের বসে ফোন ভেঙে ফেলেছে সে! নিমেষে থমকে দাঁড়াল সৌধ। ক্ষীণ কণ্ঠে ‘ ওহ শীট ‘ বলেই চোখ দু’টো বুজে ফেলল। ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে চেপে ধরল কপালের একপাশ। বা’হাতে ধরল কোমরের এক পাশে। শ্বাস আঁটকে গেল হঠাৎ। চোয়াল দ্বয় দৃঢ় হয়ে কপালের নীল রগ ফুটে ওঠল। সম্মুখে বসা প্রতিটি ব্যক্তিই সৌধর এহেন অবস্থা দেখে ঢোক গিলল। চাওয়াচাওয়ি করল একে অপরের দিকে। এরপর সুহাস ওঠে এসে সৌধর কাঁধ স্পর্শ করে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ রিলাক্স দোস্ত। এদিকে আয় কথা আছে, বোস এখানে। ‘
নড়ে ওঠল সৌধ। গভীর একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মৃদু পায়ে এগুলো সোফার দিকে। বসল প্রাচীর পাশে। ভণিতা বিহীন ত্বরিত রাশভারি গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ কী হয়েছে? ‘
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রাচী৷ আইয়াজের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকাল একবার। আইয়াজ আশ্বাস দিলে বলল,
‘ চল তোর রুমে যাই। ‘
প্রশ্নের উত্তরে প্রাচীর এহেন বাক্য পেয়ে দৃঢ় চোখে তাকাল সৌধ। তক্ষুনি কফির মগ নিয়ে এগিয়ে এলো কাজের মেয়েটা। সৌধর মা তানজিম চৌধুরীই ছেলের বন্ধুদের জন্য কফি বানিয়ে পাঠিয়েছেন। সৌধ কফি গুলো উপরে তার ঘরে নিয়ে যেতে বলে ওঠে দাঁড়াল। বন্ধুদের ইশারা করে বলল সঙ্গে যেতে।
সৌধর রুমে গিয়ে সকলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন৷ সুহাস ঝটপট রুমের দরজা লক করে দিলে সকলে নিজেদের জায়গা দখল করে নিল। সুহাস আর আইয়াজ বসল বিছানায়। প্রাচী বসল ডিভানে সৌধর ঠিক ডান পাশে। সৌধর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছে আগেই। নিশ্চয়ই জটিল কিছু ঘটেছে। প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে গেল মুখটা। হাত, পা হিম ধরে শক্ত হয়ে গেল। বা হাতে ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করল একটা। আশপাশে তাকিয়ে লাইটার খুঁজতেই সুহাস বালিশের কাছ থেকে লাইটার নিয়ে ছুঁড়ে মারল। মুহুর্তেই কেস ধরে ফেলল সৌধ। আইয়াজ বলল,
‘ প্রফাশনালি সিগারেটখোর হয়ে গেলি? ‘
ঠোঁট কামড়াল সৌধ। তীব্র দুঃশ্চিতা ঘিরে ধরল ওকে। আইয়াজের কথিত বাক্যে তাই গম্ভীর কণ্ঠেই জবাব দিল,
‘ শুধু সিগারেট না অ্যালকোহলও পান করি। ‘
সুহাস দু-হাত, পা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। বেচারা টেনশন নিতে পারে না৷ জানে সৌধ। এই যে আচমকা শুয়ে পড়ল। এটা যে অতিরিক্ত চিন্তার ফল বুঝতে পারল। তাই প্রাচীর দিকে তাকাল সূক্ষ্ম নজড়ে। বলল,
‘ কী হয়েছে? ‘
বলতে বলতেই সিগারেট ধরাল। প্রাচী ঘনঘন ঢোক গিলল। কাঁধ সমান চুলগুলো ত্বরিত প্যাঁচিয়ে কাঁটা লাগিয়ে নিল। এরপর দম ছেড়ে বলল,
‘ যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কথা শেষ না করব রিয়াক্ট করবি না৷ ওভার রিয়াক্ট তো একদমই নয়। ‘
‘ প্রশ্ন করা যাবে? উত্তর দিতে পারব? ‘
সৌধর দৃঢ়, গম্ভীর কণ্ঠে প্রাচী ম্লান হেসে মাথা নাড়াল। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ফের সৌধ বলল,
‘ সহ্য করতে পারবি? ‘
প্রাচী তাকাল সৌধর হাতের দিকে৷ সিগারেট ধরাল সৌধ। সিগারেটের উদ্ভট গন্ধ সে সহ্য করতে পারে। অন্যান্য মেয়েদের মতো সিগারেটের গন্ধে এলার্জি নেই তার। মাঝেমধ্যে দু’একটা খাওয়ার অভ্যাসও আছে। যা তার বন্ধুমহলের মধ্যে শুধু সুহাসই জানে। তাই মৃদু হেসে বলল,
‘ নো প্রবলেম দোস্ত। ‘
সুহাস বলল,
‘ কফি গুলো ঠান্ডা হয়ে গেল৷ কেউ খাবি না? ‘
প্রাচী বলল,
‘ তোরা খা৷ কথা শেষে ঠান্ডা কফি এক চুমুকে খেয়ে নিব আমি। ‘
সৌধ সম্মতি দিয়ে একবার কফির মগে চুমুক দিল তো আরেকবার সিগারেট ফুঁকল। বন্ধুর কাণ্ড দেখে তাজ্জব বনে গিয়েও গেল না প্রাচী। কারণ এই মুহুর্তে তাকে এমন কিছু সত্যি আর জটিল বিষয়ে কথা বলতে হবে যে অন্য কোনো বিষয়, বস্তু নিয়ে ভাবার, আগ্রহ প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র ফাঁক পাবে না।
‘ দোস্ত আংকেল, আন্টি আমাদের শুক্রবার ইনভাইট করেছিল। আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা আগামীকাল তোদের বাড়ি আসব। সারপ্রাইজ দিব তোকে। ‘
‘ সারপ্রাইজটা একদিন আগে পেলাম যে? ‘
পায়ের ওপর পা তুলে বা’দিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্নটি করল সৌধ। প্রাচী সচেতন হয়ে ঢোক গিলে পুনরায় বলল,
‘ আমি গতকাল নামীদের বাসায় ওঠেছি। ভেবেছিলাম একদিন থেকে আগামীকাল তোদের এখানে আসব। আংকেল, আন্টি চায় তুই বিয়ে কর। সংসারি হো। কিন্তু তুই কিছুতেই এটা মানতে পারছিস না৷ তুই তোর সুস্থ জীবন মেনে নিতে চাইছিস না আর আংকেল, আন্টি পারছে না তোর অসুস্থ জীবন মেনে নিতে৷ তাই অসহায়ের মতো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তারা। তারা যেমন তাদের সন্তানের জীবন নিয়ে আতঙ্কিত। আমরাও আমাদের বন্ধুর জীবন নিয়ে আতঙ্কিত। ‘
থামল প্রাচী। সহসা উচ্চশব্দে হেসে ওঠল সৌধ। তার হাসিতে শুয়ে থাকা সুহাস ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। আইয়াজের হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে ওঠল। গলা শুঁকিয়ে গেল প্রাচীর৷ চৈত্রের খরার মতো গলা ঢোক চিপে ভিজিয়ে নিল নিমেষে। সিগারেটের শেষ অংশটুকু ফ্লোরে ফেলে হাত দিয়ে ধোঁয়া সরাতে সরাতে হাসতে হাসতেই সৌধ বলল,
‘ আমি তাহলে সবার জীবনে আতঙ্ক হয়ে পড়েছি! ‘
কণ্ঠে উপচে পড়ছে বিস্ময়। প্রাচী হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ স্পর্শ করল। বলল,
‘ দোস্ত আমার কথা শেষ হয়নি। ‘
মাথা দুলালো সৌধ। গা এলিয়ে বসে পায়ের ওপর তোলা পা নাচাতে নাচাতে বলল,
‘ ওকে, শেষ কর। ‘
প্রাচী এবার ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে বলতে শুরু করল,
‘ নিধি অসুস্থ! গতকাল রাতে হসপিটালে এডমিট করিয়েছে ওকে। আগামীকাল আসার কথা থাকলেও আজ আমরা এসেছি নিধির জন্য। ‘
‘ স্ট্রেঞ্জ! ‘
সহসা শব্দটি বলেই সোজা হয়ে দেহ টানটান করে বসল সৌধ। প্রাচী খেয়াল করল, সৌধর চোয়াল দ্বয় কঠিন থেকে কঠিনতর। চোখ দু’টোর বর্ণও পরিবর্তন হচ্ছে। পুরু ঠোঁটজোড়া নড়ল তক্ষুনি। ভেসে এলো গমগমে কণ্ঠস্বর,
‘ বউ তো আমার নয়। ওর বাচ্চার বাবাও আমি না। তাহলে অসুস্থতার খবর নিয়ে আমার এখানে এসেছিস কেন? তোদের তো ওর স্বামীকে খোঁজা উচিত। হসপিটালে ওকে দেখতে যাওয়া উচিত। ‘
কথাগুলো স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেও সৌধর ভেতরে ভেতরে চলছিল নিদারুণ উত্তেজনা। যা উপস্থিত সকলেই টের পেল। মৌন রইল সম্মুখের দুই বন্ধু। পাশের বন্ধুটি হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ যাব তার আগে তোর সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া আছে৷ ‘
আশ্চর্যান্বিত হয়ে ডানপাশে ঘাড় ঘোরাল সৌধ। তাচ্ছিল্য মিশ্রিত ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ আমার সাথে বোঝাপড়া! ‘
মাথা নাড়াল প্রাচী৷ সৌধ প্রায় নিঃশ্বাস আঁটকে মৃদু কাঁধ উঁচিয়ে ফের বলল,
‘ ওকে ফাইন। ‘
‘ তুই কেন বিয়ে করছিস না সৌধ। প্লিজ তুই রাজি হো দোস্ত৷ তোর এই একটা সিদ্ধান্তের ওপর শুধু তোর ভালো নয় আরো তিনটে জীবনের ভালো নির্ভর করছে। ‘
‘ মানে! ‘
‘ হ্যাঁ দোস্ত। তুই যতদিন একা থাকবি ততদিন নিধি ওর সংসারে মন দিতে পারবে না৷ নিধি সংসারে মন না দিলে অর্পণ স্যার ভালো থাকবে না। নিধি, অর্পণ স্যার আর অনাগত বাচ্চা তিনজনের ভবিষ্যত পরোক্ষভাবে তোর ওপরই নির্ভর করছে। ‘
‘ মানে! ‘
‘ হ্যাঁ সৌধ। তুই তোর জীবন গুছিয়ে নিলে নিধি আর অপরাধভোগে ভুগবে না৷ আর না ওর বুঝে যাওয়া অনুভূতি গুলো গুরুত্ব পাবে। তোর জীবন অন্যকারো সাথে না বাঁধলে নিধির তার নীতিজ্ঞান ভুলে যাবে। ‘
‘ ভণিতা বাদ প্রাচী। পরিষ্কারভাবে বল। ‘
রুদ্ধ কণ্ঠ সৌধর। প্রাচী বলতে শুরু করল,
‘ নিধি ঠিক নেই দোস্ত, একদম ঠিক নেই। আমাদের সেই চেনা, আদর্শ বান্ধবীটি বদলে গেছে রে। ও অর্পণ স্যারের সঙ্গে সুখে নেই। বিয়ের পর থেকেই ওর মনে অসুখ বিরাজ করছে৷ সেই অসুখটা সৃষ্টি হয়েছে তোকে নিয়ে৷ বিয়ের আগে ও যা অনুভব করতে পারেনি বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত তা অনুভব করে গুমরে ম রছে। আফসোস, হতাশায় জর্জরিত হয়ে মানসিক খেই হারিয়ে ফেলছে দিনকে দিন। ভয় হয় সৌধ। এই খেই হারানোর ওর চরিত্রে না দাগ লাগায়!’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল প্রাচী। সৌধ স্তব্ধ নয়নে সম্মুখে বসা আইয়াজ আর সুহাসের পানে তাকিয়ে রইল৷ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই হঠাৎ হাসল ঠোঁট বাকিয়ে৷ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে বলল,
‘ এই সুহাস, এই আয়াজ প্রাচীর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। পাগলটাকে সামলা তোরা। ‘
আইয়াজ, সুহাস হতভম্ব। প্রাচী দমে রইল না৷ ত্বরিত বেগে ওঠে পিছু নিল সৌধর। গিয়ে দাঁড়াল পাশে। সৌধ খোলা বেলকনির রেলিঙেয়ে দু-হাত রেখে পিছমুখী হয়ে দাঁড়ানো। প্রাচীও গিয়ে পাশে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ নিধি প্র্যাগনেন্ট হওয়ার পর থেকে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়ে দোস্ত৷ সব রাগ, অভিমান, অন্যায়, অভিযোগ শেষে আমরা তো বেস্ট ফ্রেন্ড বল? আমি পারিনি পুরোপুরি যোগাযোগ অফ করতে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় একটা মেয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। আমি বুঝতে পারছিলাম নিধি ভালো নেই। ডিপ্রেশনে ভুগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ওর ঘনঘন মুড সুইং হচ্ছে। এ সময় মেয়েদের এমন হয়েই থাকে৷ কিন্তু ধীরেধীরে বুঝতে পারি দাম্পত্য জীবনে ও অসুখী৷ কিন্তু কেন? এই অসুখের কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সব অভিমান ভুলে পুরোনো দিনের মতো করেই ওর সঙ্গে মিশতে শুরু করি। জানার চেষ্টা করি অর্পণ স্যারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে। আর তখনি কিছু আশ্চর্যজনক বিষয় টের পাই। জানিস বিষয়টা কী? ‘
সৌধ তাকাল না প্রাচীর দিকে। আর না মুখ ফুটে উত্তর দিল ‘কী’ শুধু গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। যে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল প্রাচী। ঈষৎ হেসে বলল,
‘ এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। যেই অজ্ঞতার জন্যই সারাজীবন চরম খেসারত দিতে হয়। এই অজ্ঞতা কিন্তু কোনো বোকা শ্রেণির মানুষদের আক্রমণ করে না৷ এই অজ্ঞতার শিকার হয় নিধিদের মতো জ্ঞান, বুদ্ধি সম্পন্ন আদর্শ রমণীরা। এরা সারাজীবন আদর্শ মেনে জীবনযাপন করতে করতে অনুভূতিদের মূল্যায়ন দিতে ভুলে যায়। এদের সবাইকে নিয়ে চিন্তা হয়, সবকিছু নিয়ে চিন্তা হয়। কেবল নিজের বিশেষ অনুভূতিটুকুন ছাড়া। দেখ না নিধি পরিবারের চিন্তা করল, পড়াশোনার চিন্তা করল, প্রিয় বন্ধুর প্রেমের প্রপোজাল রিজেক্ট করল পরিবার, পড়াশোনার কথা চিন্তা করে। দিনশেষে পরিবারের সম্মান, প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে প্রচণ্ড পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করেও ফেলল। কিন্তু একবারো কি অনুভূতির মূল্যায়ন করেছে? নাহ করেনি! ‘
শক্ত পাথরের ন্যায় দাঁড়ানো সৌধ। প্রাচী এক পলক তাকিয়ে দেখল ওকে। এরপর দম ছেড়ে ফের বলতে শুরু করল,
‘ তুই ওর প্রতি কতটা সিরিয়াস ছিলিস আগে বুঝলেও খুব একটা অনুভব করতে পারেনি। কিন্তু সেদিন তোর অবস্থা দেখার পর থেকে মনে মনে অপরাধবোধে ভুগছিল। তাছাড়া সেদিনের পর থেকে আমরা সবাই ওকে দোষারোপ করেছি, ওর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছি। যা ওর মনে বিরূপতা সৃষ্টি করে৷ নতুন জীবন থেকে মন ওঠা শুরু সেখান থেকেই। সারাক্ষণ মানসিক চাপ নিয়ে সংসারে মন বসত না। অর্পণ স্যার ভালো কথা বললেও ওর খারাপ লাগত। নিধির মুখেই শুনেছি ও তোকে মিস করে, তোর কেয়ার করা গুলোকে, তোর ভালোবাসাকে মিস করে। অর্পণ স্যারের মাঝে সারাক্ষণ তোকে খুঁজে বেড়ায়। একজন মানুষ কি আরেকজনের প্রক্সি দিতে পারে? বিশেষ করে ব্যক্তিগত মানুষের প্রক্সি? পারে না তো। অর্পণ স্যার আদর্শবান পুরুষ। তাকে দেখে ভালো লাগে, তার আচরণ মুগ্ধ করে। স্বীকার করে নিধি৷ কিন্তু একসঙ্গে থাকতে গিয়ে ও অনুভব করে তার ভালোবাসা ওর হৃদয় ছুঁয়ে দেয় না। কারণ বহু আগেই ওর হৃদয়ে অন্যকারো ভালোবাসা ছুঁয়েছে। এক হৃদয়ে কি দুই পুরুষের ভালোবাসা স্থান পায়? সঠিক সময়ে সঠিক অনুভূতি বুঝতে না পারার খেসারত দিচ্ছে বেচারি। ‘
‘ শাট আপ, জাস্ট শাট আপ! ‘
সহসা ধমকে ওঠল সৌধ৷ সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল প্রাচীর। ভিতর থেকে ছুটে এলো সুহাস, আইয়াজ। প্রাচী ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে সুহাস এসে ওর কাঁধ চেপে ধরল। বারকয়েক ঢোক গিলে প্রাচী বলল,
‘ ঠিক আছি আমি। ওকে শান্ত কর। ‘
সৌধ অগ্নি চক্ষুতে তাকিয়ে। আইয়াজ ওকে শান্ত করতে উদ্যত হলেই চোখ, মুখ খিঁচিয়ে বলল,
‘ প্রাচীকে চুপ থাকতে বল আয়াজ। আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব৷ ‘
আয়াজ নিশ্চুপ। সুহাস তেজ দেখিয়ে বলল,
‘ কন্ট্রোল হারিয়ে ভেসে যা তুই তবু প্রাচী চুপ করবে না৷ সবটা শুনবি বুঝবি তারপর রিয়াক্ট করবি সৌধ। নিজের আসল সত্তা এভাবে বিসর্জন দিস না তুই। ‘
কিঞ্চিৎ দমল সৌধ। প্রাচী স্বাভাবিক হতে সময় নিল একটু৷ এরপর ত্বরিত কণ্ঠে বলল,
‘ বেশকিছু দিন আগে অর্পণ স্যার আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। নিধির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমি তাই অনেক কিছুই শেয়ার করেছে। অনুরোধ করেছে নিধিকে বাস্তবতা বোঝাতে৷ কী আশ্চর্য তাই নারে? আমাদের মধ্যেকার সবচেয়ে বাস্তববাদী মেয়েটাকে এখন আমাকে বাস্তবতা বোঝাতে অনুরোধ করে তার স্বামী। ‘
একটুক্ষণ থামল প্রাচী। সময় নিয়ে বলল,
‘ লোকটা সত্যিই অসহায় হয়ে পড়েছে রে। আর তার মধ্যে আমি নিধির প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি বিরক্তিও দেখেছি। এই বিরক্তি তার প্রতি নিধির অনীহার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। বেচারা ভীষণ চিন্তিত ভবিষ্যত নিয়ে। বাচ্চাটাকে নিয়ে আতঙ্কে আছে ভীষণ। শুনেছি বাচ্চা নেয়ার তাড়া ছিল নিধিরই। আমার মনে হয় ও ভয় পাচ্ছিল নিজের আসল সত্তা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার। ও আসলে মন থেকে চায়নি ওর তোর প্রতি প্রগাঢ় অনুভূতি আছে সেটা ওর স্বামী বা বন্ধু – বান্ধব টের পেয়ে যাক। স্বাভাবিক, যা আগে প্রকাশ করেনি তা এখন করে তো বদনাম ছড়ানোর মানে হয় না৷ বাচ্চা পৃথিবীতে আসার সময় ঘনিয়ে আসছে আর ওর রাগের মাত্রা বাড়ছে৷ গতকাল রাতেও দু’জন ঝগড়া করেছে৷ নিধি নাকি ডিভোর্স চেয়েছে স্যারের কাছে। স্যার ডিভোর্স দেবে না। এ কথা সরাসরি না বলে রাগের মাথায় বলেছে ডিভোর্স দিয়ে কার কাছে যাবে সৌধর কাছে? নিধি নাকি জোর গলায় বলেছে, হ্যাঁ। স্যারের সামনেই নাকি তোকে ফোনও করেছিল। স্যার বলল তুই নাকি রিসিভ করিসনি৷ এরপরই অতিরিক্ত রাগান্বিত হয়ে সেন্সলেস হয়ে যায় ও। শারীরিক অবস্থা ভালো না ওর। অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিতে পারেনি বলেই এই অবস্থা। ফজরের আজানের সময় স্যার ফোন করে এসব জানিয়েছে আমাকে। ‘
প্রাচীর কথা শেষ হতেই হঠাৎ সুহাস অধৈর্য গলায় বলল,
‘ এই শোন প্রাচী তোদের মেয়েদের বড্ড প্যাঁচানোর স্বভাব। আর প্যাঁচিয়ে বলা লাগবে না৷ এবার আমি সরাসরি বলছি সৌধকে। ওর যা বর্তমান অবস্থা তোর কথা বোঝবার শক্তি নেই। ‘
এ কথা বলেই সৌধর দিকে তাকাল সুহাস। বলল,
‘ আমাদের দ্য গ্রেট নিধি জ্ঞানী আপা পরিবারের সম্মান, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে তার ক্রাশকে বিয়ে করেছে। বেচারি বুঝতে পারেনি বিয়ের পর তার ক্রাশিং ফিলিং বাঁশিংয়ে পরিণত হবে। এর ওপর আবার মনে মনে চুরি করে তোকেও ভালোবেসেছিল। চুন্নি মহিলা সেটা প্রকাশ করেনি৷ করবে কীভাবে গোবেট কিনা? জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধাশক্তি সব মেডিক্যাল পড়া আর পরের উপকারে খরচ করে নিজের জন্য এঁটোটুকুও রাখতে পারেনি। এখন জামাই চুমু দিলে ভালোবাসার ফিল আসে না। পান্তা ভাত লবণ ছাড়া খেলে যেমন লাগে তেমন লাগে৷ এখন লবণ নামক সৌধকে মনে পড়ে। ভেবেছিল বাচ্চা আনলে লবণের অভাব পূরণ হবে। কিন্তু ফলাফল শূন্য হওয়াতে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যার ফলাফল জামাইয়ের সাথে এই ঝামেলা আর হসপিটালে ভর্তি। ‘
থামল সুহাস। আইয়াজ প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। রেগে বলল,
‘ এই তোর প্যাঁচ ছাড়া কথা? সিরিয়াস মোমেন্টেও তোর এমন করা লাগবে? কী করে সহ্য করে নামী তোকে? ‘
সুহাস কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ ধমকে ওঠল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘ যা বলছিস এসব সত্যি হলে আমি নিধিকে খু ন করে ফেলব। ‘
তীব্র জেদি স্বর সৌধর। প্রাচী আতঙ্কিত হয়ে বলল,
‘ না তুই এসব করবি না। ‘
চিৎকার করে ওঠল সৌধ।
‘ এছাড়া আর কী করণীয় থাকতে পারে আমার? ওই বেইমানটা আমার সাথে বেইমানি করেনি শুধু ও নিজের সঙ্গেও বেইমানি করেছে। ‘
কথাটা বলেই সহসা শরীর ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল সৌধ। সুহাস ত্বরিত ধরল ওকে। সৌধ হতাশার সুরে বলল,
‘ আমি আর নিতে পারছি না। জাস্ট নিতে পারছি না। খু ন চেপে গেছে আমার৷ হয় কাউকে খু ন করব নয়তো নিজেই খু ন হবো। এছাড়া আমার আত্মায় শান্তি মিলবে না। ‘
সুহাস, আইয়াজ, প্রাচীর একসঙ্গে বলল,
‘ না সৌধ৷ এভাবে আবেগে গা ভাসালে চলবে না। তোকে এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে হবে। ‘
‘ সম্ভব না। ‘
প্রাচী বলল,
‘ কেন সম্ভব না? তুই যদি নিজের জীবন গুছিয়ে নিস নিধি বুঝবে ওর জন্য তোর জীবন থেমে নেই। ও দিকশূন্য হয়ে গেছে সৌধ। ওকে হুঁশে আনতে হবে তোকে। একমাত্র তুইই পারিস। আ’ম সিয়র তুই বিয়ে করে নিলে ও ছোট্ট একটা আঘাত পাবে। সেই আঘাতই ওকে ওর আসল জীবনটাকে মেনে নিতে বাধ্য করবে। ‘
‘ ওর জন্য অন্য একটা মেয়ের জীবন কেন নষ্ট করব প্রাচী? আমি তো নিধির মতো স্বার্থপর নই। আমি ওর মতো অজ্ঞ বা প্রতারকও নেই। ‘
‘ নষ্ট কেন করবি? বিয়ে করবি, বউকে ভালোবেসে সংসার সাজাবি। সুখে থাকবি। ‘
আইয়াজের কথা শুনে হোহো করে হাসল সৌধ। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,
‘ এ জীবনে কী এটা সম্ভব আর? ‘
প্রাচী বলল,
‘ এই পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তুই আমাদের কথা শোন সৌধ। আমরা আজ নিধির সঙ্গে দেখা করে বলব, তোর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। সামনে মাসে বিয়ে। ‘
.
.
পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল সিমরান। গলার স্বর উঁচিয়ে এক নাগাড়ে ডাকল,
‘ আন্টি, আন্টি, কোথায় তুমি? ‘
ভেতর থেকে ছুটে এলেন তানজিম চৌধুরী। দেখলেন হাঁপাচ্ছে সিমরান। চোখ মুখের অবস্থা বিধ্বস্ত! ত্বরিত পায়ের গতি বাড়িয়ে সিমরানের মুখোমুখি হলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে গাল স্পর্শ করে বললেন,
‘ কী হয়েছে সিনু মা? এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন! কোথায় থেকে আসলে তুমি? ‘
মুহুর্তেই থমকে গেল সিমরান। আশপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল তার ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুদের। স্মরণ করল ঘন্টা খানেক আগের ঘটনা –
***
ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ হাতে নেয়া মাত্রই সিমরান জানতে পারে সুহাস তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। গতকাল বেশ রাত করে ঢাকা থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরেছে। সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে যাচ্ছে? মেজাজ খারাপ হলো মেয়েটার। ছুটন্ত পায়ে নিচে এসে ভাইয়ের পথ রোধ করল। কোমরে দু-হাত রেখে রাগান্বিত স্বরে শুধাল,
‘ আমার সাথে দেখা না করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? নামীপুর কাছে নিশ্চয়ই নয়? ‘
চিন্তান্বিত মুখেই কিঞ্চিৎ হাসল সুহাস। হাত বাড়িয়ে বোনের এক গাল ছুঁয়ে বলল,
‘ সরি’রে। দেখা করার সময় পাইনি। নামীর ওখানে যাই না জানিসই তো। আমি সৌধদের বাড়ি যাচ্ছি। আয়াজ, প্রাচীও আসছে। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল সিমরানের। কোমর থেকে হাত নামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াল। সৌধর নাম নেয়াতে বিচলিত হলো কিঞ্চিৎ। আবার কিছু হলো না তো? প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তা নিয়ে মনের প্রশ্ন মুখে তুলল,
‘ কিছু হয়েছে? সৌধ ভাই আবার পাগলামি করছে? ‘
সময় কম তবু বোনকে প্রশ্নের উত্তর দিল,
‘ সৌধর কিছু হয়নি। হয়েছে নিধির। ‘
আকস্মিক কথায় বুক ধক করে ওঠল সিমরানের। আঁতকানো কণ্ঠে বলল,
‘ কী হয়েছে নিধিপুর! ‘
সুহাস পা বাড়াল সদর দরজার দিকে। সিমরান পাশে হাঁটতে হাঁটতে আকুতির সুরে বলল,
‘ ব্রো প্লিজ বলে যাও আমাকে, নয়তো টেনশন হবে খুব। ‘
গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে ত্বরিত স্বরে সুহাস বলল,
‘ আর বলিস না আমাদের প্ল্যান ছিল শুক্রবার সবাই মিলে সৌধদের বাড়িতে যাব। আংকেল, আন্টি গোপনে ইনভাইট করেছে। সৌধর বাড়ি থেকে মেয়ে দেখছে ওর বিয়ের জন্য৷ কিন্তু ফা জিলটা এই নিয়ে অশান্তি করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। থামাথামির আর নাম নেই৷ গত সপ্তাহে ভাঙচুর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল, ফিরেছে মাঝরাতে নেশাগ্রস্থ হয়ে। ভাব একবার আংকেলের সম্মানটা কোথায় নিয়ে ঠেকিয়েছে ও? এজন্যই আংকেল আমাকে অনুরোধ করেছিল একদিন যেন সময় দেই। আন্টি ফোন করে অনুরোধ করে আয়াজ, প্রাচীকেও সঙ্গে নিতে। অনেকদিন পর সবাইকে একসাথে পেলে সৌধর মন হালকা হবে। পাশাপাশি সৌধকে আমরা বোঝাতে পারব, গুড সাজেশন দিতে পারব। কারো জন্য কারো লাইফ থেমে থাকে না তো বল? ‘
কথার সমাপ্তি দিয়ে গাড়িতে ওঠে বসে সুহাস। ডোর লাগাতে নিলে সহসা সিমরান বাইরে থেকে টেনে ধরে৷ সুহাস খেয়াল করে সিমরান থরথর করে কাঁপছে। সাধারণত প্রচণ্ড ক্রোধে আর ভয়ে শরীর কাঁপে সিমরানের। এ মুহুর্তে ভয় পাওয়ারই বা কী হলো, রাগেরই বা কী হলো? বোধগম্য হলো না সুহাসের। শুধু হাত বাড়িয়ে বোনের গাল ছুঁয়ে বলল,
‘ ঠিক আছিস তুই? ‘
‘ না নেই! ‘
তীব্র রোষানলে ফেটে পড়ল সিমরান। সুহাস ভয় পেয়ে গেল। আশ্চর্য মুখে তাকিয়ে বলল,
‘ এমন করছিস কেন? ‘
নিমেষে নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেল সিমরান। চোখ বুজে কিয়ৎক্ষণ বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ খুলল। থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ তোমরা সৌধ ভাইকে বিয়েতে রাজি করাতে যাচ্ছ?’
‘ হ্যাঁ। কিন্তু আরেক বিপদ ঘটে গেছে। ‘
হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে সিমরান জিজ্ঞেস করল,
‘ নিধিপুর কী হয়েছে? ‘
‘ অর্পণ স্যারের সাথে ওর বনিবনা নেই তেমন। শুনলাম দোষ নিধিরই। স্যার যথেষ্ট ভদ্র আর ভালো মানুষ। ওই মানাতে পারছে না৷ এদিকে প্র্যাগ্নেসিরও সাড়ে পাঁচ মাস চলছে। গতকাল মাঝরাতে নাকি তুমুল ঝগড়া করেছে জামাই, বউ মিলে। এক পর্যায়ে নিধি সেন্স লেস হয়ে যায়। প্রাচী গতকাল নামীদের বাসায় ওঠেছে। কথা ছিল আজ আমাদের বাড়ি আসবে, কাল সবাই মিলে সৌধদের বাড়ি যাব৷ কিন্তু নিধি হসপিটালে ভর্তি। তাই আজই যেতে হবে। ‘
‘ কেন যেতে হবে? ‘
সিমরানের মাথা ঘুরছে। একদিকে সৌধ ভাইয়ের বিয়ের তোড়জোড়। অন্যদিকে নিধি আপুর অসুস্থতায় সবাই মিলে সৌধ ভাইয়ের কাছে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বুকের ভেতর তিতকুটে অনুভূতি হলো ওর। সুহাস বলল,
‘ বাকি কথা পরে বলব বোন। এখন যেতে হবে। ‘
আর অপেক্ষা করল না সুহাস। ডোর লক করে গাড়ি স্টার্ট করল। সিমরান নিশ্চল দেহে, শূন্য মস্তিষ্কে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক পল। এরপর আচমকা সম্বিৎ ফিরতেই ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। তাকে এক্ষুনি তৈরি হতে হবে। যেতে হবে চৌধুরী বাড়িতে।
***
সবটা স্মরণ হতেই দু-চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়ল সিমরানের। তানজিম চৌধুরী হকচকিয়ে গেলেন৷ হঠাৎ কী হলো মেয়েটার? এভাবে কোথায় থেকে ছুটে এলো? এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেন? কাঁদছেই বা কেন? বাবা, মায়ের সাথে আবার মান, অভিমান হয়নি তো? সুহাস তো কিছু বলল না এ ব্যাপারে। চিন্তিত মুখে সিমরানের চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন তিনি। বললেন,
‘ আমার সিনু আম্মাটার কী হয়েছে শুনি? ‘
কথাটা বলতেই আচমকা তানজিম চৌধুরীকে জাপ্টে ধরল সিমরান। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমি কি পাত্রী হিসেবে খুব খারাপ আন্টি? ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা