ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৩৭+৩৮

0
897

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৭|
মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে ফোন কেটে দিল সুহাস। তার রাগের মাত্রা দেখে নামীর বুকে ধুকপুক শুরু হলো। এতক্ষণ সুহাস কথা বলছিল আর সে পাশে বসে সমস্ত কথা শোনার এবং বোঝার চেষ্টা করছিল। যতটুকু বুঝল সিমরানকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। এটা নিয়েই অশান্তি করেছে সিমরান। অশান্তির মাত্রা কতখানি টের পেল নামী। কারণ আর কেউ না জানলেও সে জানে। মেয়েটা একগুঁয়ে স্বভাবের। সৌধ ভাইয়ের প্রতি মেয়েটা গভীর প্রণয়ে আসক্ত। সৌধর জীবনে যে ঝড় এসেছে এই ঝড় থামাতে সিমরানের এক বুক ভালোবাসাই যথেষ্ট। যদি সৌধ সুযোগ দেয়। এতদিন ভয় পেলেও এখন নামী মন প্রাণ দিয়ে চায় সৌধের সঙ্গে সিমরানের জুটি মিলুক। এজন্য সুহাসের সাহায্য দরকার। সাহায্যের আগে সুহাসকে জানানো দরকার সিমরান সেই কিশোরী বয়স থেকে এক সৌধতে মত্ত। ভীষণ ভালোবাসে মেয়েটা। যে ভালোবাসা সমুদ্রের অতল গহ্বরের চেয়েও গভীর। নিধি আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। নিয়তি বা পরিস্থিতি যে কারণেই হোক সৌধর জীবনে সিমরানের আগমনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছে নিধি আপু। আর কোনো বাঁধা নেই, দোটানা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। সুহাসের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ মাথা ঠান্ডা করো সুহাস। ‘

নামী ভেবেছিল এবার সিমরানের সত্যিটা জানাবে৷ কিন্তু তার আগেই সুহাসের রোষানলের শিকার হলো।

‘ শাটআপ! ‘

ধমকে ওঠল সুহাস। নামী কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

‘ আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? আমি কী করেছি? ‘

আকস্মিক সমস্ত ক্রোধ নামীর ওপর ঝেড়ে ফেলল সুহাস। প্রচণ্ড জোরে দেওয়া ধমকটি নামীর দেহ ছাড়িয়ে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলল। ফলে আপনাআপনিই জল গড়াল চোখ বেয়ে। সুহাসের সেদিকে হুঁশ নেই। তার একমাত্র আদরের বোন। তার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। বাবা, মা সিমরানের বিয়ের কথা ভাবছে। অথচ সে জানে না। মেয়েটা বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত কিনা, ওর কাউকে পছন্দ কিনা এসবও জেনে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল সুহাস। তীব্র ক্রোধে নাক, কান রক্তিম বর্ণ ধারণ করল তার। ধমক খেয়ে স্তব্ধ নামী কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সুহাসের অবস্থা দেখে পিঠে হাত বুলালো। নিচু আর নরম গলায় শুধাল,
‘ সুহাস, প্লিজ শান্ত হও। ‘

দু’হাতে কপাল থেকে চিবুক অবধি জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিয়ে লম্বা শ্বাস নিল সুহাস৷ বলল,

‘ বাড়িতে প্রচুর অশান্তি হয়েছে। ভাঙচুর করেছে সিনু। আমাদের আজই ফিরতে হবে নামী। ‘

চমকে ওঠল নামী। আজই ফিরতে হবে? তারা তো হানিমুনে এসেছে। এভাবে ভেঙেচুরে হানিমুন বরবাদ করে চলে যাওয়ার মতো সত্যিই কি কিছু ঘটেছে? তাছাড়া আজ তো আইয়াজ ভাই আর ফারাহর বিয়ে হবার কথা। সুহাস কি ভুলে গেছে এসব? গোপনে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নামী বলল,

‘ কিন্তু আজ তো আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে। কীভাবে ফিরে যাব আমরা? ‘

তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। ওরা বসেছিল বীচের কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে। লোক সমাগম কম তবু দু’একজন ছিল। রাগ ওঠলে সুহাসের মাথার ঠিক থাকে না৷ তাই মায়ের রাগ নামীর ওপর খাঁটিয়ে দিল,

‘ তোমার যেতে সমস্যা থাকলে আমি একাই যাব। বোনটা তো আমার। দায়দায়িত্ব, দরদ সবটাও আমার। তুমি বুঝবে কী করে আমার অনুভূতি? ‘

‘ সুহাস, কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ! ‘

রেষ্টুরেন্টের কাছাকাছিই ছিল সৌধ। আইয়াজ, ফারাহর ছবি তুলে দিচ্ছিল সে। হঠাৎ সুহাসের চড়া গলা শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসে। সুহাসকে রাগান্বিত দেখে আর নামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখে এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে ধমক দেয়,

‘ কী ব্যাপার তোর! ওকে ধমকাচ্ছিস কেন? লোকজন দেখছে সুহাস রাগ কন্ট্রোল কর। শান্ত হয়ে বসে বল সমস্যা কী? ‘

সহসা ওঠে দাঁড়াল নামী। কান্না প্রায় মুখ করে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে একছুটে রিসোর্টে চলে গেল। পিছন থেকে ফারাহ ডাকল কয়েকবার। নামী শুনল না। দূর থেকে দেখা গেল চোখের পানি মুছতে মুছতে ত্বরিত বেগে হেঁটে চলে যাচ্ছে মেয়েটা।
.
.
বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বেশ মন দিয়ে শুনল সৌধ। প্রচণ্ড অবাক হলো সে। উদয়িনী আন্টি এত তাড়াতাড়ি সিনুর বিয়ের কথা ভাবার মতো মানুষ নন৷ তাহলে হঠাৎ এই ভুত কে চাপালো তার মাথায়? আর সামান্য একটি বিষয় নিয়ে সিনুই বা এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাল কেন? বিয়ে না করলে না করবে। তাই বলে ভাঙচুর করে নিজে আহত হবে? এই মেয়েটা যে সত্যি ভাইয়ের ফটোকপি এতে একবিন্দু সন্দেহও নেই। বিস্মিত মুখে সুহাসের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিল সৌধ। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল সুহাসের কথায়,

‘ দোস্ত আমাকে এক্ষুণি ফিরতে হবে৷ এদিকটা তুই ম্যানেজ করে নিস প্লিজ। ‘

হাসফাস চিত্তে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। মুহুর্তেই তার হাত টেনে বসিয়ে দিল সৌধ। কঠিন মুখে বলল,

‘ তুই কোত্থাও যাবি না। যাব আমি। ‘

‘ হোয়াট! ‘

‘ ইয়েস ব্রো। হানিমুনে এসেছ হানিমুন করো ওদিকটা আমি সামলে নিব। ‘

‘ আমার বোন হসপিটালে ভর্তি সৌধ! ‘

চ্যাঁচিয়ে ওঠল সুহাস৷ সৌধ নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর কাঁধে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে জবাব দিল,

‘ আমার বোনটা রিসোর্টে গিয়ে চোখের জল ফেলছে সুহাস। ‘

উদ্যমি চিত্ত আকস্মিক নিরুদ্যম হয়ে গেল। চঞ্চল দৃষ্টি হলো অঞ্চল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। বলল,

‘ নামী বুঝদার সৌধ। ওকে আমি ম্যানেজ করে নিব।’

‘ তুই বুঝদার নোস সুহাস৷ তাই অবুঝতা করছিস। ওদিকের খবর নিয়েছি আমি৷ সিনুকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। পায়ে লেগেছে, ব্যান্ডেস করে দিয়েছে দ্যাটস ইট। বাকি যা সমস্যা দেখে নিব আমি। মাত্র ক’টা দিন ছুটি৷ তুই নামীকে সময় দে দোস্ত। ভালোবাসা পেয়ে যাওয়া মানেই ইট’স ওকে নয়। ভালোবাসা পাওয়া মানে যত্নের সঙ্গে তা রক্ষা করা। অবহেলা, অনাদরে ভালোবাসা হারাতে নেই সুহাস৷ যা পেয়েছিস তা আগলে রাখতে শেখ। ‘

‘ কিন্তু সিনু…’

‘ ব্যাপারটাকে তুই একটু বেশিই জটিল করছিস। ‘

‘ ওর কারো সাথে রিলেশনশিপ আছে সৌধ। ‘

‘ না নেই। ‘

‘ হয়তো আছে আমরা জানি না। নয়তো এমন কিছু কেন ঘটাবে? ‘

‘ তোর বোন সম্পর্কে তোর চেয়েও আমি জানি। কার সাথে মিশছে, কখন কোথায় আড্ডা দিচ্ছে সব আপডেটই পাই। এমনভাবে পাই মনে হয় বোনটা তোর না আমার। ‘

এক চিলতে বাঁকা হাসির দেখা মিলল সৌধর অধর কোণে৷ সুহাস পুনঃপুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ কী করব আমি এখন আমি? ‘

‘ তুই বউয়ের সঙ্গে এনজয় করবি। আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে দিবি। আমি এক্ষুনি রওনা দেব। ‘

কৃতজ্ঞতায় বুক ভার হলো সুহাসের। সৌধর বুকে মৃদু কিল বসিয়ে ওঠে দাঁড়াল। দাঁড়াল সৌধও। এরপর আচমকা সুহাস তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,

‘ তুই শুধু বন্ধু না সৌধ তুই আমার ভাই। ‘

ওদের কথোপকথন শেষে আইয়াজকে ফোন করল সৌধ। বলল,

‘ আমি ব্যাক করছি দোস্ত। ইমিডিয়েটলি ব্যাক করতে হচ্ছে আমাকে। সরি ভাই, তোর বিশেষ দিনটায় পাশে থাকতে পারলাম না। ‘

আকস্মিক সৌধর সিদ্ধান্তটি সুহাসের মনে দানা বেঁধে থাকলেও আইয়াজ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ ভোরবেলা প্রাচীর দেয়া বার্তাটি দেখেছে সে৷ আর সেই থেকেই হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছিল তার। তাই হঠাৎ সৌধকে ব্যাক করতে হবে জেনে মন খারাপের পাশাপাশি একটু খুশিও হলো। উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নয়তো সৌধ থেকে গেলে কোনোভাবে যদি নিধি আর অর্পণ স্যারের মুখোমুখি হয়ে যায়। সেই বীভৎস মুহুর্তটুকু নিয়ে আর ভাবতে চাইল না আইয়াজ। বলল,

‘ সাবধানে যাস। ‘

সৌধ বাঁকা হাসল। যেন টের পেল আইয়াজের মনোভাবনা। বেইমানদের সহ্য করা গেলেও বেইমান তৈরির মেশিনদের সহ্য করা যায় না৷ সৌধর কাছে অর্পণ স্যার বেইমান তৈরির মিশনের মতো৷ যার মুখ দর্শন করতে ভয় হয় তার৷ না জানি তার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় মেশিনটা। খু ন হয়ে যায় অর্পণ স্যার! না জানি বিধবা রূপে ধরা দেয় তার আগুনপোকা নিধি!
.
.
|চলবে…|

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৭| (বর্ধিত অংশ)

গভীর নিস্তব্ধ রজনী। স্পষ্ট সমুদ্রের গর্জন শুনা যাচ্ছে। চারদিক থেকে শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে কয়েকটা মানব শরীর। পাতলা ফিনফিনে শাড়ি পরিহিত রমণী হিম বাতাসে থেকে থেকে শিউরে ওঠছে। শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ছে তার৷ পাশে দাঁড়িয়ে আছে রমণীটির অর্ধাঙ্গ। বউয়ের
নাজুক অবস্থা দেখে লম্বাটে দেহখানা গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল,

‘ এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে কমপ্লিট। তারপর রুমে চলে যাব। ‘

সুহাসের নরম স্বরে বিগলিত হলো নামী। চোখের ইশারায় বোঝাল,

‘টেনশন করো না। আমি ঠিক আছি। ‘

মন মানল না সুহাসের। নামীর হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিল। গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চুপ। নামীও জড়োসড়ো হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ওদের সঙ্গে আরো কয়েকজন সদ্য পরিচয় হওয়া মানব, মানবি রয়েছে। যারা আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে উপলক্ষে সাহায্য করতে এসেছে৷ এরা সৌধর পরিচিত। মধ্যরাতে কাজী সাহেবও উপস্থিত। মোটা অংকের টাকা দিয়ে ঠিক করা হয়েছে তাকে। আজকের সব আয়োজন সৌধরই পরিকল্পনা। বলা যায় বন্ধু আইয়াজের বিয়ের উপহার এটি৷ এমন স্মরণীয় একটি উপহার কেবল সৌধর মাথা থেকেই আসা সম্ভব। সমুদ্রের কাছাকাছি বালুচরের ওপর গোলাকৃতির একটি টেবিল ঘিরে তিনটে চেয়ার রাখা। যার দু’টিতে বসে আছে আইয়াজ, ফারাহ। আর একটিতে কাজী সাহেব৷ বিয়ে পড়ানো শুরু করতেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করল ফারাহ। কাজী সাহেব ভ্রু কুঁচকে একবার আইয়াজের দিকে তাকাল তো আরেকবার সুহাসের দিকে। বলল,

‘ জবরদস্তি করে বিয়ে পড়ানো ঠিক না। বিয়ে কবুল হয় না৷ ‘

সুহাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। আইয়াজ আহত চোখে একবার কাজী আর একবার ফারাহর ভীত মুখের দিকে তাকাল৷ নতুন বরের করুণ দশা দেখে সুহাস মিটিমিটি হাসল। নামীকে ইশারায় বলল ফারাহর কাছে যেতে। সঙ্গে সঙ্গেই নামী ফারাহর পাশে এসে ওর কাঁধ স্পর্শ করল। অভয় দিয়ে কাজী সাহেবকে বলল,

‘ আসলে ও নার্ভাস ফিল করছে। ‘

কথাটা বলেই ফারাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ বি স্ট্রং ফারাহ। আজ তোর জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। তোদের পাঁচ বছরের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে আজ দোস্ত, ভাবতে পারছিস? ‘

কেঁপে ওঠল ফারাহ। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে তাকাল আইয়াজের পানে। মৃদুমন্দ বাতাসে মৃদু আলোয় প্রিয়জনের আকুল দৃষ্টি দেখে বুক ধুকপুক করে ওঠল৷ নিমেষে দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নামী কাজীকে ইশারা করল বিয়ে পড়াতে। পাঁচ বছরের ভালোবাসা! ঢোক গিলল কাজী সাহেব। ভালোবাসাবাসির বিয়ে তাহলে… মধ্যরাতে অদ্ভুত বিয়ের আয়োজন দেখে সন্দেহ হচ্ছিল তার। ভেবেছিল মেয়েটাকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে। সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলে নিশ্চিন্ত মনে বিয়ে পড়ানো শুরু করল। বিয়েটা সুসম্পন্ন হতেই দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে ওঠল ফারাহ। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। নামী তৎক্ষনাৎ পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল। আসলে ওর অনুভূতি একমাত্র নামীই বুঝতে পারল। আইয়াজও বুঝল কিছুটা তবে পুরোপুরি নয়। সে শুধু আহত চোখে, নির্বাক মুখে বসে রইল চুপচাপ। অনেকটা সময় নিয়ে ফারাহ শান্ত হলে আকস্মিক সবাই মিলে আতশবাজি ফোটাতে শুরু করল। নামী সুহাস সহ সকলেই একসুরে বলে ওঠল,

‘ মাঝরাতে সমুদ্রপাড়ে একজোড়া লাভ বার্ডের বিয়ে সম্পন্ন হলো। হাউ রোমান্টিক! ‘

আর পাঁচটা স্বাভাবিক, সাধারণ বিয়ের মতো বিয়ে নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, অনন্য দৃশ্যপটে বিয়ে হলো আইয়াজ, ফারাহর৷ পূর্ণতা পেল দু’টো আকুল হৃদয়। যে প্রণয়ে সার্বক্ষণিক ভয় জেঁকে ছিল সে প্রণয় পরিণয় পেল। মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যপট তৈরি করল কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ে। বিয়েটা যেমন আর পাঁচটা স্বাভাবিক, সাধারণ নয় বাসরটাও অসাধারণ ভাবে করল ওরা৷ বদ্ধ, নিস্তব্ধ ঘরে বিছানায় শরীর বিছিয়ে শরীর ছুঁয়ে নয় এই নব দম্পতির বাসর হলো সমুদ্র পাড়ে। বালুচর আর শীতল জলে পা ডুবিয়ে। একে অপরের হাতে হাত রেখে। কাঁধে মাথা ফেলে। সূর্যোদয়ের একটুক্ষণ পূর্বে দু’জনার আকুল হৃদয়ের টানে কিয়ৎক্ষণের জন্য দু’টো ঠোঁট অবশ্য এক হলো। সিক্ত হলো গভীর প্রণয় স্পর্শে…!
.
.
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৮|
আজ সকালে সূর্যের দেখা মেলেনি। থেকে থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে৷ প্রকৃতি অবসাদগ্রস্ত। সেই অবসাদ গ্রাস করে নিয়েছে সিমরানকেও। দু’পায়ে এখনো ব্যান্ডেজ মেয়েটার। কান্নাকাটি করে ফর্সা মুখ লালচে বর্ণে পরিণত হয়েছে। চোখ দু’টোও ফুলে আছে ভীষণ। সময় সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ মেয়ের ঘুম ভেঙেছে, উদয়িনী টের পেয়েছে ব্লুটুথ স্পিকারে গান শুনে। বাইরে থেকে অল্পস্বল্প শোনা যাচ্ছে সিমরানের ঘরে গান বাজছে। হিন্দি গান। যে গানে মিশে আছে বিরহ বেদনা। যে অনলে নিজে দগ্ধ হচ্ছে সে অনলে মেয়েকে দগ্ধীভূত হতে দেখতে চায় না বলেই বিয়ের তোরজোর শুরু করেছিল উদয়িনী। তবু যেন শেষ রক্ষা হলো না৷ ভালো করতে গিয়ে মন্দতে পরিণত হলো সব৷ বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উদয়িনীর। মেয়ের জন্য নিজ হাতে সকালের নাস্তা তৈরি করতে নিচে নামে। এমন সময় আবির্ভাব ঘটে সৌধ চৌধুরীর। যা রীতিমতো বিস্মিত করে তুলে তাকে। সৌধ স্বভাবসুলভ সালাম দিয়ে মৃদু হাসল। উদয়িনী নিজের বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ তোমরা তো কক্সবাজার ছিলে! সাতসকালে কী করে এলে? ‘

‘ আমি গতকাল রাতেই ফিরেছি আন্টি৷ এদিকের খবর শুনে সুহাস টেনশন করছিল খুব। তাই বললাম আমি গিয়ে অবস্থা দেখি। সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করি৷ তোরা আস্তে ধীরেই আয়। ‘

সন্তুষ্ট হলো না উদয়িনী। যেখানে সুহাসের আসার কথা সেখানে শুধু সৌধ আসাতে মন কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তার ছেলের বউ প্রীতি এতটাই যে যে আদরের বোনের অসুস্থতার কথা জেনেও আসল না৷ দায় এড়াতে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিল। অন্য সময় হলে সৌধর উপস্থিতি তাকে খুশি করত কিন্তু আজ করল না। কারণ মনে মনে সৌধকে নিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখত তা আর এখন দেখে না। তবু পারিবারিক বন্ধুত্ব, ছেলের বন্ধু হিসেবে সৌজন্যতা দেখাল। সৌধকে বসতে দিয়ে নিজেও পাশে বসল। বাড়ির পরিস্থিতি জানালো, মা হয়ে সে মেয়ের মন পড়তে পারছে না৷ মেয়েটাও তাকে বন্ধু ভেবে নিজের যন্ত্রণা ভাগাভাগি করতে চাইছে না৷ বাবার সাথে যেটুকু সখ্যতা ছিল সেটুকুও এখন আর নেই। শুধুমাত্র না জানিয়ে তার জন্য পাত্রপক্ষ নিয়ে আসার ভুলে। সৌধ সমস্ত কথা শুনল৷ এরপর বুঝেশুনে প্রশ্ন করল,

‘ আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না আন্টি। সিনু সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। অন্তত পক্ষে অনার্স কমপ্লিট করার পর তোমরা বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারতে। এত দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছ যে শুধু সিনু নয়, আমরা সবাই স্তব্ধ! ‘

এত দ্রুত সিমরানের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে দু’টো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, উদয়িনীর চতুর বুদ্ধিমত্তা বলে, খুব শিঘ্রই চৌধুরী বাড়ি থেকে সিমরানের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে৷ কারণ সৌধর মা তানজিম চৌধুরী সিমরানকে খুবই পছন্দ করে। এছাড়া খবর পেয়েছে সুজা চৌধুরী ভাবছেন ছোটো ছেলের বিয়ের ব্যাপারে৷ ব্যস্ততা কাটিয়ে পারিবারিক ভাবে বসবেনও তারা৷ এই পারিবারিক আলোচনায় সোহান খন্দকারও থাকবেন৷ সোহান কেমন মানুষ জানে উদয়িনী। তাই সেই অঘটন ঘটার আগেই স্বামীকে নিজের কিছু দুর্বলতা দিয়ে ঘায়েল করেছে। রাজি করিয়েছে সিমরানের জন্য ভালো পাত্র দেখতে৷ সব ঠিকঠাক চলছিল। মাঝে বেঁকে গেল সিমরান। কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা বুঝতে পারছে না৷ এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি সিমরান। শতবার প্রশ্ন করা শেষ। অথচ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে মেয়েটা৷ না প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আর বা ভালো, মন্দ কিছু বলছে। সে যেন নির্বাক বনে গিয়েছে। আর এর জন্য দায়ী তারা বাবা, মা দু’জন। সবচেয়ে বেশি দায়ী সে নিজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল উদয়িনী। সৌধর কথার বিপরীতে বলল,

‘ তুমি তো জানো বাবা তোমার আংকেলের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না৷ আত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশি সবার মাঝে আমাদের নিয়ে চর্চা হয়৷ ইদানীং তোমার আংকেলের সাথে সম্পর্কটির একটুআধটু উন্নতি হয়েছে। তাই ভেবেছিলাম ছেলেটা তো নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছে। মেয়েটা এখন যুবতী। খুব সরল মনের৷ আমরা দু’জন তো ওকে সময় দিতে পারি না৷ সারাক্ষণ একা একা থাকে। যদি বিয়ে দিয়ে একটা সঙ্গী জুটিয়ে দিই মন্দ হবে না৷ সিনু কেমন জানোই তো। ওর জন্য ভালো হবে। সবদিক দিয়ে ও স্যাটিসফাইড হবে এমন পাত্রই দেখছিলাম। ‘

সৌধ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে। উদয়িনীর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ল। নাকের এক পাশে তর্জনী দিয়ে চুলকে নিল আয়েশি ভঙ্গিতে। উদয়িনী আন্টির কথাতে গড়মিল স্পষ্ট। সে যে গড়মিল পেয়েছে বুঝতে দিল না। সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল,

‘ সিনুর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল আন্টি। বিয়ে জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। হুট করে বিয়ের বিষয়টা সামনে আসাতে ওর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ‘

‘ বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর রিয়াকশন ওভার ছিল। এতটাও কাম্য ছিল না। আমরা বিয়ে দিয়ে দিইনি। জাস্ট দেখতে এসেছে মাত্র। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। ভাবুক কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার কী মনে হচ্ছে ও কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে, কমিটেড? ‘

‘ সন্দেহ হচ্ছে, ভুলও হতে পারে। আসলে বাবা এ সময় সুহাসকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। সিনু আমার আর তোমার আংকেলের থেকেও সুহাসকে বেশি ভরসা করে। কিন্তু সুহাসের বোধহয় আমাদের জন্য সময় হবে না। ‘

শেষ বাক্যে ছেলের প্রতি কিছু অভিমান মিশে ছিল৷ সৌধ লক্ষ করল, ইদানীং উদয়িনী আন্টির অভিমান বেড়েছে। মানুষ যখন ধীরেধীরে বড়ো হয় তখন অভিমানও বাড়তে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সময় তা স্থির রয়। আবার যখন বয়স বাড়ে, বৃদ্ধ হতে শুরু করে তখন অভিমানেরাও বৃদ্ধ হয়। উদয়িনী আন্টির অভিমান কি সেসবেরই ইঙ্গিত? কত আর বয়স হয়েছে তার? এ বয়সী নারীরা তো বৃদ্ধা তকমা পায় না। মনের ভাবনা মনেই রইল। মুখ ফুটে কিছু বলল না সৌধ। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎ বলল,

‘ আমি কি সিনুর সঙ্গে কথা বলব একবার? ‘

চিন্তান্বিত মুখে উদয়িনী বলল,

‘ বলবে? দেখো গিয়ে। যতটুকু জানি তোমাকে খুব মানে ও। আমাদের তো কিছু বলে না। যদি তোমাকে বলে। ‘

উদয়িনীর কণ্ঠে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখার মতো ভরসা মিশে ছিল৷ সৌধ দু’কাঁধ মৃদু নাড়িয়ে ত্বরিত ওঠে দাঁড়াল। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে পা বাড়াল উপরের দিকে। বলে গেল,

‘ অকে, আই সি। ‘

উদয়িনী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ত্বরান্বিত হয়ে সকালের নাস্তা তৈরি করতে লাগল৷ পাশাপাশি আফসোস হলো, সৌধ কেন নিধির প্রতি আসক্ত হলো? ছেলেটা যদি নিধির প্রতি দুর্বল না থাকত। তাহলে আজ এসব কিছুই ঘটত না৷ সে কখনোই সিমরানের জন্য অন্যত্র পাত্র দেখত না। এমন সময় হঠাৎ মন বলল, সিমরান যদি কারো সাথে সম্পর্কে থেকে থাকে। তাহলে পারিবারিক ভাবে সৌধর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আগাতে গেলেও তো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো!
.
.
জানালার থাই গ্লাসে ভীড় জমিয়েছে অগণিত বৃষ্টিফোঁটা। সেদিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে সিমরান। স্পিকারে তখন গান বাজছে,
” এ হামনাভা, মুঝে আপনা বানা লে…
ছুখি পারি দিল কি ইছ জামি-কো ভিগা দে ।
হুমম… হু এ্যাকেলা, জারা হাথ বারহা দে…”

গানের লিরিক এ পর্যন্ত যেতেই দরজায় টোকা পড়ল। ভেসে এলো পুরুষালি মোটা, সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর,

‘ ক্যান আই কাম সিনু? ‘

থমকানো দৃষ্টি দুটো এক নিমিষে বারকয়েক পলক ফেলল। বিরস বদনে ভর করল বিস্ময়। পীড়িত চিত্তে চঞ্চল হলো। নিঃশ্বাস, প্রশ্বাসে বাড়ল অস্থিরতা। ম্রিয়মাণ বুকটায় অশান্তির ঢেউ ওঠল। ধুকপুক শব্দে মুখরিত হলো বক্ষগহ্বর। কার কণ্ঠ পেল? দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে? অস্থির হয়ে গান বন্ধ করে দিল। বদ্ধ উন্মাদের মতো এপাশ, ওপাশ তাকিয়ে ওড়না গলায় ঝুলালো। সৌধ ফের দরজায় টোকা দিল৷ সিমরান কান সজাগ করে শুনল সেই টোকা। সৌধ ফের বলল,

‘ কীরে আসব? ‘

আচমকা দৃষ্টিজোড়া টলমল হয়ে ওঠল৷ বুকের ভেতর থেকে উপচে এলো কান্না। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে শ্বাস রোধ করে ঠাঁই বসে রইল। প্রচণ্ড কষ্ট হলো কণ্ঠস্বর বের করতে। তবু উচ্চারণ করল,

‘ এসো। ‘

এসো বলেও শান্ত থাকতে পারল না। অস্থির, উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইল দরজার পানে। মুহুর্তেই দেখা মিলল, কালো রঙের টিশার্ট আর ধূসর রঙা প্যান্ট পরিহিত তাগড়া যুবকটির। যে ধীরেসুস্থে এগিয়ে এলো। আশপাশে তাকিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে থাকা কাঠের চেয়ার টেনে বসল তার পাশে। সিমরান আবেগে বিগলিত হলো। আন্দোলিত হলো তার ছোট্ট হৃদয়। বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইল মন৷ অবাধ্য ইচ্ছেরা বুকে তরঙ্গ বইয়ে দিল, একটিবার, শুধু একটিবার সৌধভাইকে জড়িয়ে ধরার জন্য। ঐ হৃষ্টপুষ্ট পুরুষালি বুকটায় ঝাঁপিয়ে পড়ার তৃষ্ণা জাগল খুব৷ হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছে করল। অভিযোগ জানাতে ব্যাকুল হলো মন।

‘ সৌধ ভাই জানো আব্বু, আম্মু আমার জন্য পাত্র দেখছে। আমাকে কয়েকজন অপরিচিত লোক এসে দেখে গেছে৷ আমি তো তোমাকে ভালোবাসি সৌধভাই। আমি তো তোমার বউ হতে চাই। ওরা কেন এমন করল কেন ওরা মন বিষিয়ে দিল আমার৷ আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই আমার ভাগিদার হতে দিব না৷ তুমি ছাড়া আর কাউকেই এই হৃদয়ে স্থান দিতে পারব না। ‘

ইশ অতিআবেগ মিশ্রিত, ছেলেমানুষি বাক্যগুলো মনে মনেই রয়ে গেল৷ তা আর বলার সাহস করে ওঠল না৷ আর না ওই বুকে মুখ গুঁজে নিজের কষ্টগুলো কমাতে পারল। কেবল অসহায়িনীর ন্যায় মুখ করে বসে রইল চুপচাপ। কী বিষাদগ্রস্ত ওই মুখ। ছোট্ট, সুন্দর মুখখানিতে কী গভীর মলিনতা! দু-চোখে এহেন দৃশ্য দেখে বড্ড খারাপ লাগল সৌধর৷ মনে মনে বলল ‘ সিনুর অবস্থা তো খুব খারাপ। আমাদের সন্দেহটাই ঠিক নাকি! ‘ মনে মনে এসব বলেকয়ে প্রকাশ্যে আচমকা বলে ফেলল,

‘ কীরে পিচ্চি সত্যি করে বল তো কার জন্য এই বিধ্বস্ততা? ‘

সহসা সচেতন হয়ে গেল সিমরান৷ বারকয়েক ঢোক গিলে স্বাভাবিক হয়ে নিয়ে বলল,

‘ মিথ্যা করে বলছি কারো জন্য না। ‘

‘ আমি মিথ্যা সহ্য করতে পারি না। ‘

‘ তুমি সত্যিটাও সহ্য করতে পারবে না। ‘

‘ পাকনি হয়ে গেছিস! পুতুলের মতো সুন্দর গালটায় আমার পাথুরে হাতের পাঁচ আঙুল বসার আগে সত্যি বল পাকনি। ‘

ম্লান হাসল সিমরান। বলল,

‘ তোমরা চলে এসেছ? ‘

‘ আমরা না আমি একা। ‘

‘ কেন? ‘

‘ তোর জন্য। ‘

বুকে গহিনে তীক্ষ্ণ ব্যথা লাগল বুঝি। হতভম্ব মুখে সরাসরি তাকাল সিমরান। সৌধ স্বাভাবিক ভণিতায় বলল,

‘ আমি না এলে তোর পাগলা ভাই বউ, হানিমুন সব কক্সবাজার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিল। ওদিক যেন না ভাসে তাই আমি চলে এলাম এদিক সামলাতে। এদিক ঠিক থাকলেই ওদিক রক্ষা। ‘

কথা শেষ করে মৃদু হাসল সৌধ। সিমরান অপলকে তাকিয়ে দেখল, একটা ছেলের কথার ভঙ্গিমা কত সুন্দর হতে পারে। কী সুন্দর তার দিকে না তাকিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিজোড়া নাড়িয়ে, পেশিবহুল হাত এপেশওপেশ করে, ঠোঁটদ্বয়ে অমায়িক মৃদু হাসি বজায় রেখে কথা বলছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটি যেন এই মানুষটা। যার সর্বত্রেই চোখ ধাধানো সৌন্দর্য বিরাজ করে৷ এছাড়া সব পরিস্থিতি সামলানোরও ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে এই মানুষটার৷ ভাবতেই নিমেষে চমকে গেল। সত্যি কী তাই? সবার জীবনের কঠিন পরিস্থিতি সহজ, স্বাভাবিক করতে পারলেও মানুষটা কি পারে নিজের জীবনে আসা কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে? সেদিনের সেই দৃশ্য, সেই পরিস্থিতি এখনো ভুলতে পারেনি সিমরান। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো তার। শুনতে পেল পুনরায় সৌধর করা প্রশ্নবিদ্ধ বাক্যটি,

‘ সমস্যা কী বলত? প্রকাশ্যে তো বয়ফ্রেন্ড নেই, গোপনে আছে? ‘

অকপটে সিমরান জবাব দিল,

‘ না নেই। ‘

‘ তাহলে এখন বিয়ে করতে চাইছিস না? ‘

শ্বাসরোধ করে উত্তর দিল,

‘ না চাইছি না। ‘

‘ ওকে ফাইন করবি না৷ তাই বলে হাত, পা কে টে, ঘরকুনো, গুমরামুখো হয়ে বসে থাকতে হবে? আর কী গান শুনছিলি এসব গান শোনার বয়স এখন? ‘

সিমরানের বিষণ্নতা কেটে গেল অনেক। চোখজুড়ে ভর করল একরাশ মুগ্ধতা। সকাল সকাল স্বপ্ন দেখছে না তো? অপ্রত্যাশিতভাবে সৌধকে পেয়ে হৃদয় জুড়ে শিহরণ জেগে ওঠল। পলকহীন তাকিয়েই রইল মানুষটার দিকে। মুগ্ধতার রেশ কণ্ঠে মিশিয়েই বলল,

‘ তুমি কেমন আছো সৌধভাই? ‘

সহসা এহেন প্রশ্নে সৌধ একটু থমকাল। নতমস্তকে ঠোঁট কামড়ে একটুখানি ভাবার চেষ্টা করল, সে কেমন আছে? তৎক্ষনাৎ আচম্বিতে একটি মুখ ভেসে ওঠল দু-চোখের পাতায়। নাক জুড়ে চেনা শরীরী ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল সেই রমণীর। বুক আর মস্তিষ্ক জুড়ে কিলবিলিয়ে ওঠল একটি নাম, নিধি! কী আশ্চর্য! সে ভালো আছে কিনা ভাবতে গেলেও বেইমান নিধির মুখ ভেসে ওঠে। ওই মুখ, ওর ঘ্রাণ, ওই নাম সবই তীক্ষ্ণ ভাবে মনে করিয়ে দেয় সে ভালো নেই৷ কেন ভালো নেই? নিধি নামক প্রতারকের জন্য হাহ…।

সিমরান আকুল চোখে তাকিয়ে৷ সৌধ প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,

‘ শোন বিয়ে করবি না ইট’স ওকে। নো প্রবলেম, তোর বিয়ে হবে না৷ কেন হবে না, কীভাবে হবে না এসব আমার ওপর ছেড়ে দে৷ কিন্তু শর্ত আছে যা তোকে পালন করতে হবে। ‘

‘ কী শর্ত? ‘

সিমরানের কণ্ঠে বিস্ময়। সৌধ বাঁকা হাসল। যে হাসিতে ফের ফাঁসল সিমরান। তরুণিমাকে নিজের বাঁকা হাসিতে পুরোদস্তুর ফাঁসিয়ে তরুণ বলল,

‘ মন খারাপ করে থাকা যাবে না। সব সময় হাসি, খুশি থাকতে হবে৷ নিজের যত্ন নিতে হবে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করতে হবে। মন দিয়ে পড়তে হবে। আর যে কোনো সমস্যায় পড়লে তৎক্ষনাৎ আমাকে বা সুহাসকে জানাতে হবে। আর হ্যাঁ আন্টি, আংকেল না বুঝে ভুল করে ফেলেছে এটা নিয়ে সমস্ত রাগ, অভিমান ভুলে যেতে হবে৷ ক্লিয়ার? ‘

সৌধর কথার সমাপ্তি ঘটতেই সিমরান বাধ্য মেয়ের মতো মাথা কাত করল। সৌধ মাথা দুলিয়ে হেসে বলল,

‘ তুই আসলেই গুড গার্ল। সুহাস, আন্টি শুধু শুধু তোকে নিয়ে টেনশন করে। পায়ের অবস্থা কেমন হাঁটতে পারিস? ‘

প্রথম বাক্যদ্বয়ে ঠোঁট ফুলাচ্ছিল সিমরান। মা আর ভাই তার ইমেজ কতখানি নষ্ট করতে পারে জানে সে। কিন্তু শেষ বাক্যে সিরিয়াস হলো। বলল,

‘ ট্রাই করিনি। ‘

‘ আজ থেকে করবি। ওঠছি আমি, সাবধানে থাকিস।’

সৌধ ওঠতে উদ্যত হলে সিমরান ত্বরিত ডাকল,

‘ সৌধভাই? ‘

‘ হু? ‘

‘ আর একটু বসবে? ‘

ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে করা আবেদনটি ফেলল না সৌধ। মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই৷ নিজের জীবনে চলা সমস্যা গুলোর সমাধান তার কাছে নেই। কিন্তু অন্যের জীবনের সমস্যা গুলো কী অনায়াসেই সমাধান করতে পারে৷ এই যেমন সিমরানকে দেখে তার স্বাভাবিক লাগছে না। মেয়েটি ভয়াবহ বিষণ্নতায় ভুগছে। বর্তমানে ডিপ্রেশন শব্দটির ভয়াবহতা সম্পর্কে কারোরি অজানা নয়। আর সিমরান যে ধরনের মেয়ে। এই মেয়ে তীব্র বিষণ্ণতায় যা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসল সৌধ। বলল,

‘ তোর যদি এখানে ভালো না লাগে আমাদের বাড়ি চলে যা। ওখানে আম্মা, তাহানীর সঙ্গে সময় কাটাবি ভালো লাগবে। ‘

‘ তোমার ছুটি কতদিন? ‘

‘ ছুটি আরো কয়েকটা দিন আছে। বাট আমি আগামীকালই চলে যাব। ‘

মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেল সিমরানের। সৌধ খেয়াল করে বলল,

‘ আর কিছু বলবি? ‘

চট করে তাকাল সিমরান। অসহায় মুখ করে আবদার করল,

‘ একটা গান শুনাবে প্লিইজজ? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে