ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
921

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩২|
প্রিয় মানুষের মৃত্যু শোকও একসময় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব৷ কিন্তু চোখের সামনে তাকে অন্যকারো হয়ে যাওয়ার শোক কাটানো অসম্ভব। এই শোক এতটাই
দৃঢ় যে আজন্মকাল থেকে যায়। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ হারালে হৃদয় ব্যথিত হয় ঠিকি কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ হারালে তা হয় দুর্বিষহ যন্ত্রণার। কেটে গেছে তিন রাত তিন দিন। স্বাভাবিক হতে পারেনি সৌধ। তীব্র আঘাতে হুঁশ হারিয়ে অর্পণ স্যারকে যে আঘাত করেছিল তারা তিন বন্ধু, সে আঘাত সেরে গেছে অনেকটাই। সময়ের স্রোতে একদিন পুরোপুরিই সেরে যাবে। কিন্তু হুঁশে থেকে নিধি যে আঘাত সৌধকে করেছে এ আঘাত কি কোনোদিন সেরে ওঠবে? কিছুটা মলিন হলেও সেরে ওঠবে না কোনোদিন। রাতগুলো কাটছে নির্ঘুম। সৌধকে সামলানো মুশকিল খুব। পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে একেবারেই অপারগ। সুজা চৌধুরীর ভরসা ছোটো ভাই অর্থাৎ সৌধর ছোটো চাচা৷ যাকে খুব মানে সৌধ। বলা যায় তার প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড ছোটো চাচা সুলল চৌধুরীই। ভাতিজার কঠিন সময়টা অনুভব করতে পারছে সুলল। তারা উভয়ই প্রিয়তমা হারানোর শোক পেয়েছে। পার্থক্য এটুকুই সে প্রিয়তমার মৃত্যু শোক পেয়েছিল আর সৌধ প্রিয়তমা অন্য কারো হয়ে যাওয়ার শোক পেয়েছে। নিজের ব্যথার চেয়েও ভাতিজার ব্যথা তীব্র। দিনশেষে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বস্তি পেলেও সৌধ পাবে না। তাদের সবাইকে বেশ কঠিন সময় পার করতে হবে এবার। সামলাতে হবে সৌধকে। সুহাস আর আইয়াজ নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায়নি। গতকাল নামী আর সিমরান চলে গেছে। যদিও তার ইচ্ছে ছিল না। সুহাস, নামী আর উদয়িনী তিনজনের চাপেই মেয়েটা যেতে বাধ্য হয়েছে। নামী গেছে তার বাসায় আর সিমরান মায়ের সঙ্গে নিজ বাড়িতে। উদয়িনী এতটা জোর করত না মেয়েকে৷ কিন্তু তার মেজাজ চটে গেছে সৌধ নিধিকে ভালোবাসত শুনে। যার কাছে নিজের মেয়েকে দিতে চেয়েছিল। যাকে মেয়ে জামাই করতে তীব্র আগ্রহী ছিল। সে অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত! মেনে নিতে পারেনি উদয়িনী। যদিও সৌধর জীবনে এখন নিধি আর আসবে না, নিশ্চিত। তবু সৌধর মনের ঘরে অন্য নারীর বাস ছিল এখনো আছে। তাই তো এভাবে ভেঙে পড়েছে ছেলেটা৷ ঠিক এখানেই ঘোর আপত্তি জানিয়েছে উদয়িনীর মন৷ নিজ জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকেই নিজের বিশেষ মনোবাঞ্ছা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সৌধর মায়ের মনের ভাবনা জানে উদয়িনী।
যা সব ঘটে গেল এরপর কী হতে পারে চৌধুরী পরিবার কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দ্বারা ঠিক টের পাচ্ছে। তাই ভয় পেয়েই যতদ্রুত সম্ভব মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। কারণ যে ভুলটা সে করেছে একই ভুল তার মেয়েকে করতে দেবে না। যদিও তার বিশ্বাস সিমরান নিজেও আগ্রহী হবে না এসবে। অন্য নারীর প্রতি আসক্ত পুরুষের প্রতি লোভ করে জীবন, যৌবন সবটা ধ্বংস করে দিয়েছে উদয়িনী। একই ভুল আর মেয়ের জীবনে করতে চায় না। অন্য নারীর প্রতি আসক্ত ছেলেকে নিজের মেয়ের জন্য মরে গেলেও বাছাই করবে না৷ এতদিন পছন্দ করত, মনে মনে আশা রেখেছিল কারণ এতদিন জানত না সৌধ নিধির প্রতি ভয়ানক ভাবে দুর্বল।
.
.
গত তিন রাতের মতো চতুর্থ রাতটাও নির্ঘুম। সৌধর সঙ্গে জেগে আছে আইয়াজ আর সুহাসও। সৌধ তার বিছানার মাঝ বরাবর সটান হয়ে শুয়ে। একধ্যানে তাকিয়ে আছে চরকির মতো ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে ছেলেটা। জীবনটাও তো ঠিক চরকির মতোই। আজ তুমি যাকে যতটা দেবে কাল সে তোমাকে ততটাই ফেরত দেবে। আকস্মিক চোখ বুজে ফেলল সৌধ। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,

‘ আমি তাকে একবিন্দু কষ্টও ফেরত দিতে চাই না৷ শুধু চাই ও সুখী হোক, সুখে থাকুক। কারণ আমি ওকে ক্ষমা করতে চাইনা। ও যতদিন সুখে থাকবে আমি ঠিক ততদিনই ওকে ক্ষমা করতে পারব না৷ ওর সুখটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকুক। আমি যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি ওর সুখের গল্প শুনে। আমি যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় একটিবার বলতে পারি নিধি, আমি তোকে ক্ষমা করিনি। ‘

রাত গভীর হয়নি৷ সবে দশটা বাজে। আইয়াজ আর সুহাস কমেডি মুভি দেখার প্ল্যান করছে। যাতে সৌধর বুক একটু হালকা হয়৷ তাদের এই প্রচেষ্টা বুঝতে পারে সৌধ। তাচ্ছিল্য ভরে একটুখানি হাসে। ওর ব্যথা কি আর ওরা বুঝে? যে পুরুষের বুকের ভেতরে বাস করা নারী প্রতি রাতে অন্য পুরুষের বুকে ঘুমায় সে পুরুষ জানে জীবন কত নৃশংস, নিয়তি কত্ত বড়ো বেইমান, নারী কি ভয়াবহ ছলনাময়ী!

সহসা ওঠে বসল সৌধ। বিড়বিড় করে বলল কিছু কথা৷ সুহাস, আইয়াজ কান সজাগ করে শুনে নিল সবটাই,

‘ও যদি ক্লাস নাইন বা ইন্টার পড়ুয়া মেয়ে হতো।তাহলে নিজের মনকে বুঝ দিতে পারতাম। মনের দিকে যদি দুর্বল প্রকৃতির মেয়ে হতো তবু মেনে নিতাম। যদি আল্লাহ প্রদত্ত কোনো অসুখ করে ও মারা যেত তবু মনটাকে স্বান্তনা দিতাম। ছাব্বিশ বছর বয়সী একটি মেয়ে। খুব শিঘ্রই পরিপূর্ণ ডক্টর পেশায় নিয়োজিত হবে। সে কী করে পারল এমন একটি ঘটনা ঘটাতে? কী করে পারল! ‘

শেষে চিৎকার করে ওঠল সৌধ। সুহাস এসে ধরল ওকে৷ আইয়াজ ভীত স্বরে বলল,

‘ ছোটো কাকুকে ডাকব? ‘

সৌধ তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। বদ্ধ উন্মাদের মতো সুহাসের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে গেল ঘরের বাইরে। পেছন পেছন সুহাস আর আইয়াজও ছুটে গেল। সুহাস ভেবেছিল, সৌধ বাড়ির বাইরে চলে যাবে৷ কিন্তু না সে তার মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে ডাকতে শুরু করল,

‘ আম্মা, আম্মা দরজা খোলো, আম্মা। ‘

সৌধর কণ্ঠে বড্ড তাড়াহুড়ো। যা থেকেই টের পাওয়া যায় মানুষটার বুকের ভেতর কতখানি অশান্তি বিরাজ করছে। সুহাস, আইয়াজ চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে সৌধর পেছনে দাঁড়িয়ে। ওদের শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে বন্ধুর করুণ দশা দেখে। তানজিম চৌধুরী আধোঘুমে ছিলেন৷ ছেলের এক ডাকেই ধড়ফড়িয়ে ওঠেছেন তিনি৷ এরপর দ্রুত পায়ে এসে দরজা খুলেই ভীত স্বরে বললেন,

‘ কী হইছে আব্বা? ‘

সৌধ কিছুটা শান্ত হলো। ধীরপায়ে ঘরে ঢুকে অসহায় ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকাল। বলল,

‘ আমি কি খুব বেশি বড়ো হয়ে গেছি আম্মা? ‘

চোখ ছলছল করছিল তানজিমের। হঠাৎ অশ্রু ছেড়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে সৌধর গাল স্পর্শ করলেন। বললেন,

‘ এই কথা বলো কেন আব্বা? মায়ের কাছে সন্তান কোনদিন বড়ো হয়? ‘

সৌধর মুখে দেখা দিল একটুখানি হাসির আভাস। পেছন থেকে সুহাস, আইয়াজ এগিয়ে এসে বলল,

‘ সৌধ রুমে চল। আংকেলের ঘুম ভেঙে যাবে। ‘

‘ ভাঙবে না, আব্বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। ‘

বন্ধুকে উত্তর দিয়েই মা’কে নিঃসংকোচে বলল,

‘ আমি যদি আজ তোমাদের সাথে ঘুমাই অন্যায় হবে আম্মা? ‘

আকস্মিক ছেলেকে জাপ্টে ধরলেন তানজিম চৌধুরী। সন্তানের ব্যথা মায়ের চেয়ে কে বেশি বুঝে? যে ছেলেটা ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই বাবা, মায়ের সাথে ঘুমাতে লজ্জা পেত। যার ব্যক্তিত্বে আঘাত করত বাবা, মায়ের মাঝখানে ঘুমাতে। আজ সে নিজে থেকেই বাবা, মায়ের কাছে থাকতে চাচ্ছে।

মায়ের সম্মতি পেয়ে পেছনে তাকাল সৌধ। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুহাস, আইয়াজকে বলল,

‘ তোরা কি হাসবি? ‘

সুহাস তৎক্ষনাৎ মাথা দু’দিকে নাড়াল। না না একদম হাসবে না। আইয়াজ স্তব্ধ মুখে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

‘ না, না হাসব কেন? তোর আম্মা তোর আব্বা একশবার ঘুমাবি তাদের সাথে। আমরা হাসার কে, হু আর উই? ‘

আইয়াজের প্রতিক্রিয়া দেখে সৌধর চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল। আইয়াজ মুহুর্তেই মাথা ঝাঁকানো থামিয়ে বোকা বোকা হাসতে লাগল। সৌধ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ গো এ্যাঁ। ‘

ওরা চলে গেল। তানজিম চৌধুরী ছেলের জন্য বালিশ বের করে বিশাল বিছানার মাঝ বরাবর রাখল। গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল সৌধ। তানজিম চৌধুরী ছেলের পাশে শুয়ে বললেন,

‘ সকালবেলা তোর আব্বা দেখে অনেক খুশি হবে। ‘

ঈষৎ হাসল সৌধ। চোখজোড়া বন্ধ করে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর হাত বাড়িয়ে মায়ের একটা হাত টেনে নিজের মাথায় রেখে বলল,

‘ হাত সরাবা না। ‘

বুক ভেঙে কান্না এলো তানজিম চৌধুরীর। সারারাত সে আর ঘুমাতে পারল না। সৌধও যে ঘুমায়নি টের পেল ওর চোখের কার্ণিশ ঘেষে পড়া একফোঁটা অশ্রু কণা দেখে। যা তার বুকের ভেতরটা তীরের ফলার মতো আঘাত করল। কখনো সে সৌধর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কখনো বা বুকে। মা মাথায় হাত বুলানোর পাশাপাশি বুকেও হাত বুলাচ্ছে। কিঞ্চিৎ আরাম পেল সৌধ। একসময় চোখ বোজা অবস্থাতেই বুকে রাখা মায়ের হাতের ওপর দৃঢ়ভাবে নিজের হাতের তালু রেখে চাপ দিয়ে বলল,

‘ এখানে ব্যথা করছে বুঝতে পারলে কী করে আম্মা?’

‘ মায়েরা সব বুঝতে পারে। ‘

উত্তর দিয়েই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠল তানজিম চৌধুরী। কাঁদল সৌধও। তার কান্না শব্দহীন। অথচ ব্যথা কী ভীষণ গভীর!
.
.
কেটে গেছে চার রাত৷ পঞ্চম রাতটাও নির্ঘুম। সুহাস ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। এভাবে কাটতে থাকলে সৌধকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। নাওয়া, খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে ছেলেটা কী একটা ঘোরে আছে, কীভাবে বের করবে এখান থেকে মাথা কাজ করছে না৷ হঠাৎ আইয়াজ বলল,

‘ দোস্ত আর মাত্র তিনদিন ছুটি আছে৷ চল সৌধকে নিয়ে দু’দিনের জন্য কক্সবাজার চলে যাই। খোলা আকাশের নিচে, সমুদ্র পাড়ে নির্ঘুম কাটালে আর যাইহোক বদ্ধ ঘরের মতো যন্ত্রণা হবে না। ‘

আইয়াজের কথাটা মনে ধরল সুহাসের। সুজা আংকেলকে কল করে অনুমতি নিয়ে সৌধকে জানাল তারা আগামীকাল কক্সবাজার যাবে। এ কথা শুনে হঠাৎ সৌধ বলল,

‘ বারে যাবি? ‘

সুহাস চোখ, মুখ কুঁচকে বলল,

‘ হোয়াট! ‘

গতকাল থেকেই সিগারেট চাচ্ছিল সৌধ। প্রথমে দিতে না চাইলেও আজ সকালে এনে দিয়েছে। তাকে সঙ্গ দিয়ে নিজেরাও এক, দুইটা খেয়েছে। ভেবেছিল সিগারেট অবধিই সীমাবদ্ধ থাকবে সৌধ। কিন্তু এখন তো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি মাত্রায় চলে যাচ্ছে। যদিও সৌধর জন্য এটা ব্যাপার না। সৌধর বড়ো ভাইয়ের বন্ধুর নিজস্ব বার আছে। তবু তাদের তো একটা ইমেজ আছে। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল সুহাস, আইয়াজ। এখন যা অবস্থা তাতে সৌধর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা৷ কিন্তু সে তো বিবাহিত। নামী যে ধরনের মেয়ে যদি একবার ভুলক্রমেও এসব কানে যায় রক্ষা থাকবে না। এমনিতেই ক’দিন ধরে মেয়েটাকে সময় দিতে পারছে না৷ না দেখা না ঠিকভাবে কথা। এরওপর যদি শুনে বন্ধু নিয়ে বারে গেছে সে। নিশ্চিত গলা কা টবে। নয়তো বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেবে। এই মেয়ের নীতি, রাগ, জেদ সম্পর্কে এতদিনে খুব ভালো করেই জানা হয়ে গেছে। এদিকে আইয়াজও অসহায় বদনে দাঁড়িয়ে। ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে বন্ধুর মুখের দিকে৷ বন্ধুর বিরহে আজ যদি তারা দু’জন বারে যায় তাদের বিরহ আসন্ন নিশ্চিত!

সৌধ বারে যাবি প্রশ্নটা করেই ঝটপট তৈরি হয়ে নিয়েছে। এরপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে আদেশ করে গেছে, তৈরি হতে। বুক ধুকপুক নিয়ে তৈরি হয়ে নিল সুহাস, আইয়াজ। আত্মাটা হাতের মুঠোয় নিয়েই বেরিয়েছে বারের উদ্দেশ্যে।

নেশায় অভ্যস্ত না সৌধ বা সুহাস, আইয়াজ। আজই প্রথম বারে এসেছে তারা৷ চারপাশে চাকচিক্যময় লাইটিং। পরিচিত অনেক ভাই, বন্ধুরাও রয়েছে। ওদের তিনজনকে দেখে তারা ভূত দেখার মতোই তাকিয়ে আছে৷ বিগ বস ক্লাবের তিন পার্টনার বারে এসেছে! বিষয়টা হজম হচ্ছিল না অনেকেরই৷ এরই মধ্যে সুন্দরী ডান্সারের রঙ্গলীলা শুরু হয়ে গেল। সৌধর অবশ্য এসবে হুঁশ নেই। সে জীবনে প্রথমবারের মতো রেড ওয়াইন গলায় ঢালল। চোখ, মুখ কুঁচকে মাথা নিচু করে ফেলল মুহুর্তেই। সুহাস, আইয়াজ ঢোক গিলে বলল,

‘ খুব বাজে নারে? ফেলে দে ইস কী দুর্গন্ধ! ওয়াক থু..’

কিয়ৎক্ষণ পর মাথা তুলল সৌধ। মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,

‘ এই দুর্গন্ধই তো চাই। যাতে ভেতরে থাকা আগুনপোকাটা এই গন্ধে পালিয়ে যায়। ‘

কথাটা বলেই একের পর এক গ্লাস শেষ করতে লাগল সৌধ। সুহাস ওর হাত টেনে ধরে আকুতি স্বরে বলল,

‘ দোস্ত আর না। ‘

সৌধ চোখ গরম করে তাকাল। সুহাস ফের বলল,

‘ দোস্ত চল বাড়ি যাই৷ নামী কল করছে। যদি টের পায় আমরা কোথায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। ‘

এ পর্যায়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল সৌধ। ধরে রাখা রেড ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলে রেখে সুহাসের দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ ভাবে। বলল,

‘ নামীকে কল কর। ‘

চমকে ওঠল সুহাস৷ বলল,

‘ ভাই গর্দান যাবে আমার। ‘

‘ কিচ্ছু হবে না। ফোন করে বলবি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে আমরা হানিমুন যাব। ‘

‘ হোয়াট!’

চিৎকার দিয়ে ওঠল সুহাস৷ আইয়াজ হতভম্ব। সৌধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,

‘ বলদ! কক্সবাজার যেতে চাইলি তখন, তাই বলছি হয়ে যাক হানিমুন। তুই আর নামী। আইয়াজ আর ফারাহ। আর তোদের চারজনের সাথে আমি। তাহলে কী হলো আমরা না?’

হঠাৎ কাশতে শুরু করল সুহাস। একটুক্ষণ কেশে নিয়ে বলল,

‘ তাই বল। ‘

পরোক্ষণেই আবার চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ আইয়াজ ফারাহ কী করে যাবে? ওদের তো বিয়েই হয়নি। ‘

‘হবে, আগামীকাল। ‘

সৌধর কথা শুনে চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো ওদের। আইয়াজ ধরা গলায় বলল,

‘ ও মনে হয় পাগল হয়ে গেছে রে। আমার ইমোশন নিয়ে মজা নিচ্ছে। ‘

‘ ধূরর শা লা ওর নেশা হয়ে গেছে। ‘

সুহাস কথাটা বলেই ঢুলতে থাকা সৌধকে জাপ্টে ধরল। বলল,

‘ দোস্ত তোর নেশা হয়ে গেছে, বাড়ি চল। ‘

‘ নেশা হলেও তাল ঠিক আছে। ‘

সুহাসের কানে কানে বলল সৌধ। সুহাস বলল,

‘ ওঠ বাড়ি যাব। ‘

সৌধ হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেল। সামনে যে মেয়েটি ডান্স করছে তার দিকে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আঙুল তুলে সুহাসকে দেখিয়ে বলল,

‘ সুহাস দেখ ওই মেয়েটা বার ডান্সার সবাই ওকে ঘৃণার চোখে দেখে। তুই আর আইয়াজও দেখছিস।
কিন্তু আমি দেখছি না। কেন জানিস, ও নর্তকী হলেও বেইমান না। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৩|
ঘুম পাগলী মেয়েটা হঠাৎ ঘুম বিমুখ হয়ে পড়েছে৷ রাত যত বাড়ে বুকের বা’পাশের চিনচিনে ব্যথাটুকু ততই তীব্র হয়৷ বক্ষঃস্থল জুড়ে আশ্চর্যজনক এক অশান্তি বইতে থাকে সর্বক্ষণ। যে অশান্তি তাকে না ঘুমোতে দেয় আর না প্রত্যাহিক জীবনের কোনো কাজে মন বসাতে দেয়। মন কেবল ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে ওঠে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটি আফসোসে। কিশোরী বয়স থেকে যে মানুষটিতে সে মত্ত ওই মানুষটি গত পাঁচ বছর যাবৎ মত্ত ছিল অন্য নারীতে। বুকটা হাহাকার করে ওঠে একটি কথাই ভেবে সে ওই মানুষটির প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্পর্শ হতে পারল না৷ প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার গভীরতা সে খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারে৷ কারণ ওই মানুষটির প্রতি তার যে প্রেম, ভালোবাসার অনুভূতি সবটাই প্রথম। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ওঠে বসে সিমরান৷ বিছানা থেকে ধীরেসুস্থে নেমে দাঁড়ায়। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়াতে শরীরটা কেমন নুইয়ে পড়ছে৷ মাথা ঝিমঝিম করে খুব। হঠাৎ হৃদয় গভীরে একটি কথা ছলকে ওঠে সিমরানের। কোথায় যেন সে পড়েছিল, কারো প্রথম প্রেম হওয়াটা গর্বের না হলেও শেষ প্রেম হওয়া গর্বের। এছাড়া সেদিন রাতে নিধি আপুও তাকে কত কী বোঝাল। সৌধ ভাইয়ের আগে তো সেই জানতে পেরেছিল নিধি আপু বিবাহিত। তার হাজব্যান্ড ডক্টর অর্পণ শিকদার। নিধি তাকে তার বিয়ের সব কাহিনি বলেছিল সেদিন। জানিয়েছিল সৌধর অনেক কথাও। অনুরোধ করেছিল,

‘ সিনু, তুই আমাকে কথা দে কোনো পরিস্থিতিতেই সৌধর থেকে মুখ ফিরাবি না৷ ও এখন আবেগে ভাসছে ঠিক৷ কিন্তু যেদিন বাস্তবতা বুঝবে আর তোর ভালোবাসার গভীরতা টের পাবে সেদিন ঠিক তোকে আপন করে নেবে। ‘

সিমরান ভয় পায় সে কথা শুনে। বিষয়টা অসম্ভব লাগে। নিধি তার দু গালে হাত রেখে তখন বলে,

‘ শোন, আমরা যদি মোনাজাতে চেয়েও কাউকে না পাই তাহলে বুঝতে হবে আমাদেরও কেউ মোনাজাতে চাচ্ছে। যার প্রার্থনা আরো বেশি গভীর আর বেশি জোরালো। দেখ না সৌধ আমাকে কত চাইল পেল কি? পেল না। কেন পেল না এর সঠিক উত্তরটাই আমি খুঁজছিলাম। আজ পেয়েও গেলাম। কারণ সৌধ আমাকে যেভাবে চায় তার চেয়েও বেশি গভীরভাবে তুই সৌধকে চাস। আই বিলিভ দ্যাট অবুঝ বয়সের প্রেমে বেশি গভীরতা থাকে। তুই যে বয়স থেকে সৌধকে ভালোবাসিস ও বয়সে ভালোবাসা ছাড়া, মুগ্ধতা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নেই। ‘

নিধি আপুর সে কথা শুনে চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায় সিমরান। অবাক কণ্ঠে বলে,

‘ সৌধ ভাই যে তোমাকে ভালোবাসে এটায় কী স্বার্থ আপু? ‘

জোর পূর্বক হাসে নিধি। উত্তর দেয়,

‘ বোকা মেয়ে ওর ভালোবাসায় স্বার্থ আছে বলছিনা৷ কিন্তু তোর ভালোবাসায়ও স্বার্থ নেই। ‘

সিমরান থমকানো কণ্ঠে বলল,

‘ সৌধ ভাই কেন পেল না তোমাকে? ‘

স্মিত হেসে নিধি জবাব দিল,

‘ তুই পাবি বলে। যার জন্য যেটা মঙ্গলদায়ক সৃষ্টিকর্তা তাকে সেটাই দেয় রে সিনু বুড়ি। ‘
.
.
বেলা করে ঘুমানো মেয়েটা যে ইদানীং সাতসকালে ওঠে পড়ে খেয়াল করেছে উদয়িনী। আজও ভোরবেলা ওঠে সিমরান৷ হাসফাস চিত্তে পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উল্টায়৷ দু’টো কফি করে এনে দরজার সামনে উপস্থিত হয় উদয়িনী৷ মিষ্টি হেসে এগুতে এগুতে বলে,

‘ আম্মুজান আজো জলদি ওঠেছে দেখি। ‘

ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় সিমরান৷ ঈষৎ হেসে মুখ ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। ইদানীং আম্মুকে ভীষণ শান্ত আর স্নিগ্ধ লাগে সিমরানের কাছে। অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়েছে তার আম্মুর৷ আব্বুর মাঝেও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি হচ্ছে তার আব্বু, আম্মুকে এখন একসঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়, গল্প করতে দেখা যায় এবং রাতে তারা এক ঘরে একই বিছানাতে ঘুমায়। ঠিক আগের মতোন স্বাভাবিক। ভালোবাসা না থাকলেও তাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল সেটি যেন ফিরে এসেছে আবার। সিমরানের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ঠিক বুঝতে পারে এটি সম্ভব হয়েছে আম্মুর কারণেই। একটা মেয়ে চাইলে আসলে সবই সম্ভব। বিশেষ করে একজন সভ্য পুরুষকে সঠিক পথে আনা কঠিন কিছু নয়৷ একটু সম্মান, যত্ন, ভালোবাসা এবং সততা পেলে পুরুষ মানুষ বশ মানতে বাধ্য। সোহান খন্দকার ভীষণ ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। আগ বাড়িয়ে গরম হওয়ার ব্যাপারটা তার ব্যক্তিত্বে নেই। তার মধ্যেকার বিশেষ গুণটি হলো, সে মানুষকে ক্ষমা করতে পারে। বিশেষ করে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া, নিজের ভুল বুঝতে পারা মানুষ গুলোকে সে পছন্দ করে। এরা প্রকৃত অর্থেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য৷ জীবন থেকে যা কিছু হারিয়ে গেছে তা হয়তো ফিরে পাওয়া সম্ভব না৷ কিন্তু যা কিছু রয়ে গেছে তা ধরে রাখা সম্ভব। সোহান খন্দকার হয়তো এ কারণেই ঘরে মন দিয়েছে। তার মন নরম করেছে উদয়িনীর মাঝেকার আমূল-পরিবর্তন। নানারকম ভাবনা, কল্পনা, জল্পনা করে গোপনে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ে সিমরান। উদয়িনী তার পাশে চেয়ার টেনে বসে কফি এগিয়ে দেয়। বলে,

‘ শরীর তো ভীষণ দুর্বল। ঠিকঠাক খাবার না খেলে, ঘুম না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। ‘

মেয়ের শরীরের দিকে তাকিয়ে, চোখ লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল উদয়িনী। সিমরান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে কফির মগ হাতে নিল। এক চুমুক দিয়ে বলল,

‘ কিছু হবে না। আব্বু ওঠেছে? ‘

‘ হ্যাঁ, তুমি অন্য প্রসঙ্গ টেনো না। কী নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছ সেটা শেয়ার করো। ‘

আকস্মিক স্তব্ধ হয়ে গেল সিমরান৷ তার ব্যস্ত আম্মু মেয়ের দিকে খেয়াল করেছে তাহলে? একটুখানি হাসে সিমরান। বলে,

‘ ছুটিত শেষ। যাচ্ছ না কেন? ‘

‘ ছুটি বাড়িয়েছি। ‘

‘ কেন? ‘

‘ ভালো লাগে না আর। হাঁপিয়ে ওঠেছি খুব৷ ভাবছি রিটায়ার্ড করে নিব। ‘

‘ সে কী! আর তো ক’টা বছর সময়ের আগে রিটায়ার নিতে পারবে? ‘

‘ উপযুক্ত কারণ দেখালে পারব। ‘

‘ কী দেখাবে? ‘

‘ আমি অসুস্থ। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। বলল,

‘ মিথ্যা বলবে? ‘

‘ জীবনে প্রচুর মিথ্যা বলেছি। এবার সত্যি বলেই নিব। ‘

মন খারাপ হয়ে গেল সিমরানের। বলল,

‘ সামান্য অসুখে রিটায়ার নেয়া যায়? ‘

সিমরান জানে বয়সের কারণে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে উদয়িনীর। তাই বলল কথাটা। উদয়িনী মৃদু হেসে বলল,

‘ যায়। ‘

মেয়ের সাথে কথোপকথনের এ পর্যায়ে সুহাসের কল পেল উদয়িনী। রিসিভ করতেই জানতে পারল, আজ তারা তিন বন্ধু কক্সবাজার যাচ্ছে। সঙ্গে নামীও যাবে। আইয়াজের যে মেয়েটার সাথে রিলেশন চলছে সে মেয়েটার সাথে আজই বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে আইয়াজ৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হলে আইয়াজের বউও যাবে৷ এ পর্যন্ত কথা বলেই ফোন কেটে দিল সুহাস। গোপনে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল উদয়িনী। ছেলের সাথে তার দূরত্ব দূরত্বই রয়ে গেল৷ আর কমল না। যতটুকু সম্পর্ক ততটুকু বোধহয় দায়ে পড়ে। প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলে না ছেলেটা। মায়ের প্রতি ছেলের ভালোবাসা কতটুকু ক্ষীণ হয়েছে চার বছরে ভাবলেই বুক কাঁপে উদয়িনীর। সিমরান বেশকিছু ক্ষণ উশখুশ করে হঠাৎ বলল,

‘ ভাইয়া কক্সবাজার যাবে? সৌধ ভাইও? ‘

উদয়িনী মাথা নাড়াল৷ সিমরান হঠাৎ আকুল স্বরে বলে ওঠল,

‘ আমিও যাব আম্মু। ‘

উদয়িনী ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,

‘ কী সব বলো? ভাই ভাবি আর তার বন্ধুরা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে তুমি কী করবে? ‘

মন খারাপ হয়ে গেল সিমরানের। সব আকুলতা নিভিয়ে কফির মগে চুমুক দিল। বুঝতে পারল সত্যি ঝোঁকের বশে আম্মুর কাছে এমন একটি আবদার করা উচিত হয়নি।
.
.
সকাল হতে না হতেই নজরুল মিঞার বাসায় সুজা এমপির ছোটো ছেলের আগমন। নজরুল মিঞা সম্পর্কে ফারাহর দুলাভাই। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। লোকটাকে প্রথম দেখাতে পছন্দ হয়নি সৌধর। চোখ দু’টো দেখে মনে হচ্ছে কঠিন কামাসক্ত মানুষ। এই মনে হওয়া নিয়ে একটুও বিব্রত নয় সৌধ। পুরুষ হয়ে নারীর চোখের ভাষা বুঝতে সে অক্ষম হলেও পুরুষের চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম নয়। সৌধর সঙ্গে তার ছোটো চাচা আর সুহাস এসেছে। তারা এসেছে আইয়াজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নজরুল মিঞার শুধু চোখ দু’টিই সন্দেহ জনক নয়। তার ব্যবহারেও প্রকাশ পাচ্ছে অতিভক্তি। যা চোরের লক্ষণ। সে যাইহোক এসবে যায়-আসে না সৌধ বা সুহাসের৷ তারা মূল কথা বলল। প্রথমে নজরুল মিঞা বুঝতে পারছিলেন না এত বড়ো ঘরের লোক তার বাসায় কেন? কিছুটা ভয় আর কৌতূহল থেকে সম্মান দেয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত কথাও বলে ফেলেছে। পাঁচ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী আর শালিকাকে খাঁটিয়ে আপ্যায়নও করেছে। কিন্তু তাদের আসার কারণ জানতে পেরে হঠাৎ দমে গেলেন যেন৷ আমতা আমতা করে বললেন,

‘ ফারাহকে চেনেন আপনারা? ওর কারণেই আসছেন? ‘

সৌধ মাথা নাড়ায়। ওর চাচা সুলল চৌধুরী বলে,

‘ আমরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি৷ আপনাদের অনুমতি পেলে আজই বিয়ে পড়ানো হবে। পরে ধীরেসুস্থে মেয়ে ওঠিয়ে দেবেন। ‘

ফারাহর বর্তমান গার্জেন বলতেই নজরুল মিঞা আর তার স্ত্রী। সবাই এ সম্পর্কে জানে। এতিম মেয়েটা বোন আর দুলাভাইয়ের দায়িত্বে আছে। ভালো পাত্র পেলে খুশি মনে বিয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নজরুল মিঞা খুশি হলেন না। স্বস্তিও পেলেন না৷ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকলেন। তার এহেন আচরণের মাথা মুণ্ডু খুঁজে পেল না কেউই। আগের মতো আর ধৈর্য নেই সৌধর৷ বর্তমানে তার মাথা খারাপই বলা যায়। তাই নজরুল মিঞার ইনিনো বিনানো, আমতা আমতা ভাবে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। আকস্মিক চোয়াল শক্ত করে, কঠিন চোখে তাকাল নজরুল মিঞার দিকে৷ নজরুল মিঞা হকচকিয়ে গেলেন। এমপির ছেলে সৌধ। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এরা ক্ষেপে গেলে তার চাকরি যেতে সময় লাগবে না। এ শহরে থাকাও স্বস্তি দায়ক হবে না৷ জীবনেরও গ্যারান্টি থাকবে না৷ রাজনীতির সাথে জড়িত মানুষ গুলো কতখানি ভয়ংকর হয় জানে সে৷ তাই ঢোক গিলল। সৌধ তার ভয় পাওয়া বুঝতে পেরে ভয়কে দ্বিগুণ করতে বলল,

‘ ফারাহর বাবা,মা নেই৷ অর্থাৎ এ পৃথিবীতে ওর কোনো অরিজিনাল গার্জেনই নেই। তাই আমরা ফারাহর অনুমতির পর বড়োজোর আপনার স্ত্রীর অনুমতি নিতে পারি৷ এরপরও আপনাকে বলছি জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে৷ এবার আপনিও ভদ্রতার পরিচয় দিন। নয়তো আমরা অভদ্রতার পরিচয় দেব।’

সুহাস তখন সৌধর গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করল,

‘ দোস্ত দুলাভাইকে সুবিধার লাগছে না৷ নিশ্চিত ভেজাল আছে। ‘

‘ ভেজাল আছে তা তো প্রথম পলকেই টের পেয়েছি। জাস্ট ওয়েট, বেশি বুঝলে দুলাভাইয়ের পশ্চাৎদেশে ব্যান্ড বাজিয়ে আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে দিব। ‘

সুহাস মাথা দুলাল একটু। বুঝতে পারল তার প্রিয় বন্ধুটি নিজের ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে বন্ধুদের নিয়েও চিন্তায় আছে। সে যে আঘাত পেয়েছে এ আঘাতের সম্মুখীন যেন তার আর কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ না হয় সেই প্রচেষ্টা করছে। সত্যি এই ছেলেটার মনে যেমন খাঁটি প্রেম রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে বন্ধুত্ব। এমন একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এভাবে নিঃস্ব করে দিতে পারে না৷ যদি করে দেয় তাহলে এর চারগুণ নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে?

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৪| [ এলার্ট- এই পর্বটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত। ]

ইতঃপূর্বে ফারাহর যত বিয়ে এসেছে সব ফিরিয়ে দিয়েছে নজরুল মিঞা। কিন্তু এবার সরাসরি ফিরিয়ে দিতে অক্ষম। কারণ এবার তার সামনে চৌধুরী বাড়ির দুই ছেলে উপস্থিত। যার মধ্যে একজন অর্থাৎ সুলল চৌধুরী তুখোড় রাজনীতিবিদ। তাই নানারকম জটিলতা দেখাতে শুরু করলেন। বিয়ে দেবে না এ কথা না করলেন না৷ সময় চাইলেন, এ মুহুর্তে কেন বিয়ে দিতে পারবেন না তার পিছনে নানাধরণের যুক্তি দাঁড় করালেন। ফারাহর বড়ো বোন ফারজানা দূর থেকে সৌধদের খেয়াল করল, আর স্বামীর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল, তাকেই কিছু একটা করতে হবে। তার পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ফারাহ দাঁড়িয়ে ছিল। ফারাহকে টেনে ভিতর ঘরে নিয়ে গিয়ে সে শুধাল,
‘ তুই বিয়েটা করতে চাস? ‘

সহসা হুহু করে কেঁদে ফেলল ফারাহ। বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি আয়াজকে খুব ভালোবাসি আপা। আর ভালোবাসি বলেই বিয়েটা করতে চাই না। ও খুব ভালো আপা, ভেরি অনেস্ট। কিন্তু আমি ভালো নই, অনেস্ট নই। আমি কলঙ্কিত! ‘

শেষ শব্দটা চোখ, মুখ খিঁচে বলল ফারাহ। বোনের যন্ত্রণার গল্প জানে ফারজানা। একই যন্ত্রণায় সেও ভুগছে বহুদিন৷ বুক যেন ফেটে গেল তার। এতিমদের জন্য দুনিয়া কত কঠিন তারা দু’বোন হারে হারে টের পাচ্ছে। তাই তো সেদিন নিজের মেয়ের মুখ চেয়ে সুইসাইড করতে পারেনি ফারজানা। সদ্য জন্ম দেওয়া শিশু সন্তানটির মুখ চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নরপশু স্বামীর ঘর করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। একজন মা সন্তানের সুখে নরক জীবন কাটাতেও দ্বিধা করে না। ফারজানা সেই মা যে নিজের দুশ্চরিত্র স্বামীর সংসার করছে শুধুমাত্র সন্তানের মুখ চেয়ে। আজ থেকে ঠিক সাড়ে চার বছর আগের ঘটনা,

ফারজানার সিজার হয়েছে দু’দিন। দু’রাত বোনের কাছে হসপিটালে কাটিয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে ফারাহ৷ আরো দু’দিন থাকতে হবে। তাই দুলাভাই তাকে বাসায় গিয়ে কয়েকঘন্টা কাটিয়ে আসতে বলে। এর মধ্যে ঘুম আর গোসলটাও সারতে বলে। ফারজানার শাশুড়ি দুপুরে খাবারদাবার নিয়ে আসবেন। তাই রান্না না করলেও চলবে। বোন এবং দুলাভাইয়ের কথানুযায়ী ফারাহ রাজি হয়। আর দুলাভাইয়ের সঙ্গে চলে যায় বাসায়৷ শরীর অতিরিক্ত দুর্বল থাকায় গোসল সেরে বিছানায় গা মেলে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ছোটোবেলা থেকেই সে ভীষণ ঘুমকাতুরে। একবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে সে ঘুম ভাঙানো খুব কঠিন। ঠিক এই সুযোগটাই নেয় তার দুলাভাই। নজরুল মিঞা নিজেও জানতেন না নিজের শালিকার সঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন ৷ গোসল করে ছাদে কাপড় মেলে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরছিলেন তিনি৷ আকস্মিক দৃষ্টি পড়ে জানালা ভেদ করে শালিকার দিকে। দুধে আলতা গায়ের বরণ ফারাহর। অল্প বয়সী হৃষ্টপুষ্ট, আকর্ষণীয় শরীর তার। ওড়না বিহিন হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে ওঠানামা করছে বক্ষঃস্থল। কামিজের গলা বড়ো হওয়াতে আকর্ষণীয়, নরম বক্ষ বিভাজন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা নজরুল মিঞার ভেতর সম্ভোগের ইচ্ছে জাগায়৷ ফারাহ এর সাথে তার সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয় ভেতরের কাম সত্তা। মুহুর্তেই হয়ে ওঠে লোভাতুর জন্তু। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা ফারাহ যেন কাঁচা নরম মাংসের দলা, আর সে ক্ষ্যাপাটে কুকুর। এভাবে হামলে পড়ে। দেহ থেকে একে একে সব বস্ত্র হরণ করে তবু ঘুম ভাঙে না মেয়েটার। সম্পূর্ণ ন গ্ন দেহশ্রী যখন পুরুষালি শরীর দ্বারা আবৃত করে ফেলে, নরম ঠোঁটে পুরুষালী ঠোঁটের দৃঢ় স্পর্শ পড়ে, বক্ষস্থলের নরম মাংসপিণ্ডে পড়ে শক্ত হাতের গভীর চাপ তখনি আচমকা দৃষ্টি বড়ো করে তাকায় ফারাহ। নিঃশ্বাস ছাড়ার ফাঁক টুকু পায় না মেয়েটা৷ দৃষ্টি বড়ো করে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় এতকাল বড়ো ভাইয়ের চোখে দেখে আসা, সম্মান দেয়া দুলাভাইয়ের কামাসক্ত মুখাবয়বে। নিজের বস্ত্রহীন দেহে তাকিয়ে লজ্জায়, ঘৃণায় ছটফটিয়ে ওঠে। কণ্ঠনালী থেকে সুর আসে না৷ মস্তিষ্ক অসাড়। নজরুল মিঞার বিকৃত স্পর্শে শরীরে অসহ্য পীড়া শুরু হয়। সেই স্পর্শ চূড়ান্ত মুহুর্তে পৌঁছে গেলে গগনবিদারী চিৎকার দেয় ফারাহ। নজরুল মিঞা যেন সেই চিৎকারে আরো বেশি উন্মাদ হয়ে ওঠে৷ পুরুষালি শরীরটার সঙ্গে পেরে ওঠে না ফারাহ৷ বড়ো বোনের স্বামীর কাছে নিজের কুমারীত্ব হারাতে বাধ্য হয়। আপার কাছে শুনেছিল তার দুলাভাই এর একটা কঠিন রোগ আছে৷ সেই রোগটা কী কোনোদিনও ফারাহকে বলেনি। চোখের সামনে শুধু আপার কষ্ট দেখেছে ফারাহ। তার সুন্দরী আপা বিয়ের পর কেমন অসুন্দরী হয়ে ওঠল। তার মতোই স্বাস্থ্য ছিল আপার৷ বিয়ের পর সে স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটল। ফারাহ ভেবেছিল প্রিয়তম স্বামীর অসুস্থতার জন্য আপা খুব চিন্তা করে। সে চিন্তার ফলেই নিজের প্রতি অযত্ন। কিন্তু আজ বুঝতে পারল তার দুলাভাইয়ের সমস্যাটা ঠিক কী? সে যে যৌ ন বিকারগ্রস্ত! এটা টের পায় তখন যখন দুলাভাইয়ের শরীরী চাহিদা মিটে গেলে আকস্মিক তার পা ধরে ক্ষমা চায়। আর বোঝাতে শুরু করে সে ইচ্ছে করে এই পাপ করেনি৷ তার ভেতরের কামসত্তা বাধ্য করেছে এটা করতে। যদিও মানসিক, শারীরিক কোনোভাবেই ফারাহ সক্ষম ছিল না এসব শোনার। তবু শুনতে হয়েছিল। দুলাভাই ক্ষমা চেয়ে, কান্নাকাটি করে বিদায় নেয়ার পর রক্তাক্ত চাদর গায়ে চেপে বিধ্বংসী কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যা করবে। এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। বাবা,মা মারা যাওয়ার পর বোনের বিয়ে দেয় চাচারা এরপর বোনের আশ্রয়ে চলে আসে সে। আত্মীয়-স্বজনরা এখন আর তেমন যোগাযোগ রাখে না৷ তার জীবনের শেষ ভরসা ছিল বোন, দুলাভাই৷ সেই ভরসার মানুষটার মাধ্যমে আজ সে ধ র্ষিত! নিজের ওপর ঘৃণায় মূর্ছা ধরে ফারাহ৷ ফ্যানে ওড়না বেঁধে গলায় ধরবে ঠিক এমন সময়ই মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। আপা কল করেছে! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। কল রিসিভ করেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। আপা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জানতে চায় কী হয়েছে? ফারাহ বলতে পারে না৷ শেষে আপা স্বান্তনা দেয়,

‘ কোথায় আমার মেয়ের কান্না থামাবি তা না করে নিজেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস? কখন আসবি তোরা? বাবু কাঁদছে শুনতে পাচ্ছিস? ‘

ফারাহর কান্নার বেগ বাড়ে। সে না হয় মরে গিয়ে নিজের কলঙ্ক মুছবে কিন্তু তার আপার কী হবে? চরিত্রহীন স্বামীর সঙ্গে ঘর করবে কী করে তার আপা? আর বাবু সেও তো চরিত্রহীন বাবা পেল। দিশেহারা হয়ে ওঠে ফারাহ৷ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে নিমিষেই। নতুন সিদ্ধান্ত নেয়, দুলাভাইয়ের মুখোশ টেনেহিঁচড়ে বোনের সামনে তুলে ধরবে। হসপিটালে কিছু বলতে না পারলেও বাসায় আসার পর বোনকে সবটা জানায় ফারাহ। সব জেনে ফারজানা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ তার স্বামী প র্ণগ্রাফিতে আসক্ত। এ কথা জানতে পারে বিয়ের কয়েকমাস পরেই। অতিরিক্ত প র্ণ দেখার ফলে মন, মস্তিষ্ক দু’টোই বিকৃত হয়ে গেছে। মানসিক ভাবে অসুস্থও হয়ে পড়েছে৷ একজন স্বাভাবিক পুরুষের আচরণ আর একজন যৌ ন বিকারগ্রস্তের আচরণে পার্থক্য থাকে অনেক। যা স্ত্রী হিসেবে অনুভব করেছে ফারজানা। কিন্তু এসব তো আর লোকের কাছে বলা যায় না। এগুলোর সমাধান নিজেদেরই খুঁজতে হয়। নজরুল মিঞা ফারজানার কথায় পাত্তা দেয় না। নিজের বিকৃত, বিধ্বস্ত আচরণে প্রতিরাতে যখন ফারজানা অসুস্থ হয়ে পড়ত, কখনো কখনো জ্ঞান হারাত তখন কিছুটা অনুতপ্ত হতো। সকাল হলেই সেসব ভুলে যেত আর বলত, সে একদম সুস্থ। আসল সমস্যা ফারজানারই। স্বামীকে খুশি করার মুরোদ নেই। অথচ বর্তমান সময়ে অনেক পুরুষের মাঝেই এই সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা রঙিন জগতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে বাস্তবতাতে৷ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়৷ হবে কী করে? চোখে যে লেগে আছে রঙিন পর্দা। সে পর্দা ভেদ করে প্রাকৃতিক, সত্যতে বিশ্বাস করতে পারছে না৷

ফারজানা অল্প শিক্ষিত নারী৷ মা, বাবার মৃত্যুর পর সে পড়াশোনা করতে পারেনি। চাচারাও বিয়ে দিয়ে দিল। সংসার আর ছোটোবোনের চিন্তায় পড়াশোনা থেকে একেবারেই মন ওঠে যায়৷ স্বামী, সন্তানকে ঘিরে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানোটাই একমাত্র লক্ষ্য তার। সেই লক্ষ্যের মাঝে আকস্মিক ধাক্কা পায়। কী করবে? কোথায় যাবে কূলকিনারা মিলে না। শালিকা আর বউয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে নজরুল মিঞা পা ধরে ক্ষমা চায় ফারজানা আর ফারাহর কাছে৷ যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছে সে, তার ক্ষমা কি আদেও হয়? জানা নেই ওদের৷ কিন্তু এ পৃথিবীতে ওদের মতো অসহায় এ মুহুর্তে কেউ নেই। মান, সম্মান, লজ্জা চারিদিক থেকে চেপে ধরে। ফারজানার সন্তানও একদম শিশু৷ সব মিলিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীকে ক্ষমা করার নাটক করে ফারজানা। আর ফারাহ সে ঘরকুনো হয়ে কাটাতে লাগে এক একটা দিন। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর নামীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর পরিচয় হয় আইয়াজের সঙ্গে। প্রেম ভালোবাসায় জড়ানো তো দূরে থাক কোনোদিন বিয়েও করবে না। এমন সিদ্ধান্ত নেয়া মেয়েটি আইয়াজের গভীর প্রণয়ে ফেঁসে যায়৷ অবচেতনে হওয়া সে প্রেম থেকে চেতনায় ফিরে বহুবার বেরুতে চেষ্টা করে ফারাহ৷ কিন্তু সে যত দূরে সরতে চায় আইয়াজ যেন ততোই গভীরে তলিয়ে নেয়৷ এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা বছর। ফারজানা আপা দ্বিতীয় বার গর্ভবতী হওয়ার পর একদিন দুলাভাই তাদের দু’বোনের কাছে প্রস্তাব রাখে সে ফারাহকে বিয়ে করবে। তাদের ধর্মে চার বিয়ে ফরজ। সেখানে দুই বিয়ে কোনো ব্যাপার না। এমনই মন্তব্য করে দুলাভাই৷ ফারজানা, ফারাহ কেউ রাজি হয় না। দুলাভাই তখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, সেদিন যা ঘটেছে অনিচ্ছাতে, ঘোরের মাথায়৷ এমন ঘটনার পর ফারাহকে আর কেউ বিয়ে করবে না। এছাড়া নিজের পাপের জন্য সেও অনুতপ্ত। তাই ফারাহকে বিয়ে করে আল্লাহ পাকের কাছে পাপ মুক্ত হবে। তার এই সিদ্ধান্তের পর দু’বোন খুবই আতঙ্কিত। এই আতঙ্কের মাঝেই আইয়াজের হয়ে সৌধরা এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। যা ফারজানার কাছে আল্লাহ তায়ালার আশীর্বাদ। কিন্তু ফারাহ কেন এত ভয় পাচ্ছে? সত্যিটা আইয়াজকে কখনো না জানালেই তো হলো।

ফারাহর পিঠে হাত বুলিয়ে ফারজানা বলল,

‘ তুই কি ভয় পাচ্ছিস? তোর সঙ্গে যে দূর্ঘটনাটি ঘটেছিল তা আইয়াজ জেনে যাবে বলে? ‘

কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়াল ফারাহ। বলল,

‘ ভয় পাচ্ছি না। আমি ওকে খুব ভালোবাসি আপা। তাই চাইছি না আমার মতো মেয়ে ওর জীবনসঙ্গী হোক। ‘

থরথর করে কাঁপতে লাগল ফারাহ। ফারজানা বোনের মুখ তুলে চোখের পানি মুছে দিল। নিজের কান্না আঁটকে বলল,

‘ তুই খুব ভালো মেয়ে বোন। যা ঘটেছে সব আমাদের কপালের দোষ। ‘

একটু থেমে আবার বলল,

‘ শোন এই দুনিয়ায় তো কত মেয়ে স্বেচ্ছায় নিজের সতীত্ব হারায়। একসময় সেই অবৈধ সম্পর্ক ভুলে দিব্যি অন্য পুরুষের ঘর করে৷ তুই তো তাদের মতো না বোন। তুই পরিস্থিতির স্বীকার। আমার কথা শোন, তুই রাজি হয়ে যা। আমি এক্ষুণি গিয়ে ওদের জানাব তুই আমি রাজি৷ তোর দুলাভাইকে আজ আর তোয়াক্কা করব না। ‘

আপার কথা শুনে ভয়ে শিউরে ওঠল ফারাহ। জাপ্টে ধরে বলল,

‘ ও আপা, আমিত আয়াজকে ভালোবাসি। আমি কি করে পারব ওকে ঠকাতে? ওর জায়গায় অন্য পুরুষ হলে বিয়ের ক্ষেত্রে এতখানি বাঁধত না৷ বিয়ের পর আয়াজ যদি বুঝতে পারে বা কোনোদিন সত্যিটা জানতে পারে আমি ওর চোখের দিকে তাকাব কী করে? ‘

‘ তাহলে সবটা আইয়াজকে জানা তুই। যদি সত্যি ও তোকে ভালোবেসে থাকে, যদি সত্যি সৎ হয়, মনের দিকে শুদ্ধ হয় বুঝবে তোকে। সম্মান করবে তোর ভালোবাসাকে। ‘

‘ আমি পারব না আপা, পারব না৷ আয়াজ এসব জানার আগে মৃত্যু হোক আমার, মৃত্যু। ‘

ফারজানা হতাশ ভঙ্গিতে সরে গেল৷ বুঝতে পারল এভাবে হবে না৷ ফারাহও ঘরের এক কোণে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠল৷ কেন সে আইয়াজকে জীবনে জড়াল কেন? কেন হার মানল ওর ভালোবাসার কাছে? প্রেমিকা হিসেবে সামনে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু স্ত্রী হয়ে কি কোনোদিন ও চোখে চোখ রাখতে পারবে? আইয়াজের মতো শুদ্ধ পুরুষ কি পারবে ওর কলঙ্কিত নারীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মেনে নিতে?
.
.
ক্রন্দনরত ফারাহকে ঘরে রেখে বাইরে আসে ফারজানা। স্বামীর ভাবগতি আর বোনের অনুভূতি বুঝে দারুণ এক সিদ্ধান্ত নেয়। উপস্থিত হয় ড্রয়িংরুমে। নজরুল মিঞার কথায় বিরক্তে চোখমুখ কুঁচকে আছে সৌধ। মেজাজ ভীষণ তপ্ত হয়ে ওঠেছে। তার একহাত শক্ত করে চেপে ধরেছে সুহাস৷ বলা যায় না, কখন হাত চালিয়ে দেয় সৌধ। এমন মুহুর্তে হঠাৎ সৌধর দৃষ্টি পড়ে গর্ভবতী ফারজানার দিকে৷ ইশারায় কিছু একটা বলছে ফারজানা। এমন সময় নজরুল মিঞার দৃষ্টি পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেল ফারজানা। তৎক্ষনাৎ সৌধ ওঠে দাঁড়াল। মুহুর্তেই সকলের হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে ওঠল৷ সৌধ বলল,

‘ আমার একটু ওয়াশরুম যাওয়া দরকার। ‘

নজরুল মিঞা ওঠে দাঁড়াতে নিলে সৌধ সুহাসকে ইশারা করল কিছু। সঙ্গে সঙ্গে সুহাস নজরুল মিঞার হাত চেপে ধরে বলল,

‘ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সৌধকে আপা ওয়াশরুম দেখিয়ে দিক। আপনি কাকুর সাথে আলাপের সমাপ্তি টানেন। ‘

সুললও ভীষণ চৌকস। তাই সৌধর হাবভাব টের পেয়ে নজরুল মিঞাকে কথার প্যাঁচে ফেলতে শুরু করল। সৌধও ত্বরিত চলে গেল ফারজানার কাছে। বলল,

‘ চলুন আপা ওয়াশরুম দেখিয়ে দেবেন। ‘
.
.
রাত আটটায় তিনজন তাগড়া যুবক অপহরণ করল ঘুমন্ত এক সুন্দরী যুবতীকে! সহায়তা করল যুবতীর বড়ো বোন নিজেই!

পরিকল্পনাটি করা হয় আজ সকালেই। সৌধদের ফ্লাইট রাত সাড়ে দশটায়। সে অনুযায়ী যে করেই হোক ফারাহকে আজ তাদের চাই’ই চাই। তাদের এই চাওয়া পূর্ণ করল, ফারজানা আপা। সৌধর সঙ্গে পরিকল্পনা করে সন্ধ্যা বেলায় স্বামী আর বোনকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ায়। ওরা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেই কল করে সৌধকে। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রো নিয়ে বাসার সামনে হাজির হয় সৌধ, সুহাস, আইয়াজ। সৌধ ড্রাইভিং সিটে বসে অপেক্ষা করে৷ নামী পেছনে বসা। সুহাস আর আইয়াজ যায় বাসার ভেতরে। ফারজানা আপার সহায়তায় আইয়াজ তার প্রেয়সীকে পাঁজা কোল করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে৷ পেছন পেছন ফারাহর লাগেজ হাতে বেরোয় সুহাস। তাড়াহুড়োয় ফারজানা আপার থেকে বিদায় নেয়া হয় না। গাড়িতে ওঠার পর আইয়াজ জালানার বাইরে উঁকি দিয়ে ইশারা বিদায় নেয় আর তার ওপর ভরসা রাখতে বলে। ফারজানা আপার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। এক টুকরো আশার আলো খুঁজে পায় স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে থাকা বিশ্বস্ত দু’টি চোখ দেখে।

এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পুরো সময়টাই ফারাহ আইয়াজের বুকে ঘুমিয়েছে। সেই যে ছেলেটাকে কোলে তুলেছে একটুর জন্যও নামায়নি। সুহাস বার বার বলেছে সিটে শুইয়ে দিতে। প্রচুর জায়গা আছে। তবু শুনেনি। ফারাহর ঘুম সকালের আগে ভাঙবে কিনা সন্দেহ। এমনিতেই ভীষণ ঘুমকাতুরে। এ-র ওপর ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, কক্সবাজার পৌঁছানোর পরও ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা নেই। মেয়েটা ঘুমাক। তারা নির্ঝঞ্ঝাটে পৌঁছে যাক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে।

বিয়ের পর নামীকে নিয়ে এই প্রথম দূরে কোথাও যাচ্ছে সুহাস৷ প্রথম হানিমুন। একদিকে বন্ধুর বিয়ে অন্যদিকে প্রথম হানিমুন। সব মিলিয়ে সুহাসের মনটা বেশ ফুরফুরে। ড্রাইভিং সিটে সৌধ। মাঝখানে সে আর নামী। আইয়াজ ফারাহ পেছনে। অনুভূতি বেশ প্রগাঢ়। সেই অনুভূতির রেশ ধরে নামীর গালে টোপ করে চুমু এঁটে দিল সুহাস। মুহুর্তেই চোখ বড়ো বড়ো করে নামী তাকাল সামনের দিকে। সৌধর মন এদিকে নেই৷ সে ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত। দেখেই ত্বরিত পিছনে তাকাল আইয়াজের দৃষ্টি ফারাহতে স্থির৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে এবার নিজের বরের দিকে তাকাল। বকা দেয়ার আগ মুহুর্তে হঠাৎ পুরো গাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল! এমন কাণ্ড কে ঘটাতে পারে বুঝতে বাকি রইল না কারোরি৷ নিজের মতো লাইট অফ করে নামীর কোমর পেঁচিয়ে ধরল সুহাস। একটানে একদম নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো৷ আঁতকে ওঠল নামী। সুহাস ঘনিষ্ঠ হতে হতে ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলল,

‘ হানিমুন জার্নি একটু হর্নি না হলে চলে জান? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে