ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
949

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৯|
কন্যা বিদায়ের পর নিজ ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল সুজা চৌধুরী। এমন সময় বাড়ির কাজের লোকদের হট্টগোল শুনতে পেল। তানজিম চৌধুরী স্বামীর মাথা টেপা স্থগিত রেখে মাথায় কাপড় তুলে বেরিয়ে এলেন। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বললেন,

‘ এই তোরা চুপ করবি? কর্তা বিশ্রাম নিচ্ছে। ‘

চৌধুরী গিন্নির উক্ত কথায় একজন প্রায় কেঁদে দিয়ে বলল,

‘ খালা গো সৌধ ভাই আর হের বন্ধুরা মিলা কারে জানি কু পাইতে গেল গো! ‘

আকস্মিক কথায় মুখে ডানহাত চেপে ধরল তানজিম চৌধুরী। আতঙ্কিত গলায় বললেন,

‘ এসব কী কথাবার্তা! ‘

ত্বরিত গতিতে নিচে নেমে এলেন তানজিম চৌধুরী। হাঁকডাক করে ডাকতে লাগলেন দেবর আর বড়ো ছেলে সুনীলকে। অন্যান্য ঘর থেকে ছেলে, মেয়েরা ছুটে এলো। বেরিয়ে এলো নামী, ফারাহ, প্রাচী আর সিমরানও। তারা ভারি পোশাক পরিবর্তন করতে ঘরে গিয়েছিল। এরই মাঝে বাইরে থেকে সৌধর বন্ধু আজিজ দৌড়ে এলো। চিৎকার করে বলল,

‘ সুজা আংকেল কোথায়? সুজা আংকেল? প্লিজ আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন। ভয়ানক কিছু ঘটে যাবে। অর্পণ স্যারকে মেরেই ফেলবে ওরা! ‘

বাড়ির হট্টগোল কানে পৌঁছেছে সুজা চৌধুরী আর ছোটো চাচা সুলল চৌধুরীর। সুজা চৌধুরী বেরুতে দেরি করলেও সুলল আর সুনীল দেরি করল না৷ মেয়ে তাহানীকে ঘুম পাড়াচ্ছিল সুলল। হট্টগোলে মেয়েটা আর ঘুমাতে পারল না৷ তাই মেয়েকে কোলে নিয়েই নিচে নেমে এলো। সকলের আতঙ্কিত মুখ আর কথা শুনে তাহানীকে বোনের মেয়ের কোলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঘটনা কী? আর সৌধরা কোথায়। নামী, প্রাচী, ফারাহ কিছুই বুঝতে পারছিল না৷ কিন্তু সিমরান সমানে ঢোক গিলছে৷ সে বুঝতে পারছে ঠিক কী ঘটতে পারে। গতরাতে নিধি আপুর ব্যাপারে সবটা জেনেছে সে। সেই সবই সৌধ ভাই জেনে যায়নি তো? যদি জেনে যায় তবে এখন থেকেই শুরু হবে তাদের সবার জীবনে কঠিন পরীক্ষা। যে পরীক্ষার জন্যই নিধি সাহস জুগিয়েছে তাকে। কথা দিয়েছে পরীক্ষায় সফল না হওয়া পর্যন্ত সে সব সময় পাশে থাকবে। মুহুর্তেই হাত, পা কাঁপতে শুরু করল সিমরানের৷ একটা কথা তার মাথায় ঢুকছে না। নিধি আপু বলেছিল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই নিজের ব্যাপারে সব জানাবে বন্ধুদের। তবে কেন আজ এমন অসময়ে জানালো? সবটা জেনেই কি সৌধ ভাই অর্পণ স্যারকে খু ন করতে চাইছে? সিনেমার মতো নিধি আপুকে পেতে সৌধ ভাই কি খু নও করতে পারে!
.
.
বোন বিদায়ের পর পর নিধিকে খুঁজতে থাকে সৌধ৷ ঠিক সে সময়ই আইয়াজ জানায় অর্পণ স্যার জোর পূর্বক নিধিকে টেনে তাদের স্টোর রুমে নিয়ে গেছে। নিধি স্বেচ্ছায় অর্পণ স্যারের হাত ধরতে পারে। এমন কথা ভাবতেই পারে না আইয়াজ। খোলা চোখে যা দেখেছে আর যা বুঝেছে তাই বন্ধুকে গড়গড় করে বলেছে এতেই মাথা বিগড়ে গেছে সৌধর৷ এত্ত বড়ো সাহস অর্পণ স্যারের? তার বাড়ি এসে তারই ভালোবাসার মানুষকে জোরজবরদস্তি! মুহুর্তেই ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো তিন বন্ধু ছুটে আসে। দীর্ঘদিন যাবৎ যে মেয়েটাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। নিজের সর্বস্ব জুড়ে রয়েছে যে মেয়েটা। যাকে বউ করে ঘরে তোলার জন্য বুকের ভেতর তোলপাড়। যার একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা। তাকে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে দেখে মাথায় রক্ত ছলকে ওঠে। টগবগিয়ে ফুটতে থাকে শরীরের রক্ত কণিকা। নিধি শুধু সুহাস, আইয়াজের বান্ধুবিই নয়। প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু সৌধের মনের মানুষ। তাদেরও মাথা ঠিক নেই নিধি আর অর্পণ স্যারের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের দৃশ্য দেখে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ওরা৷ কিছু মুহুর্তের জন্য হয়ে ওঠে মানুষ থেকে অমানুষ। প্রথমে তিনজন এলোপাতাড়ি মা রধর করে অর্পণ স্যারকে। নিধি বাঁধা দিতে গেলে আইয়াজ শক্ত হাতে ওকে টেনে ধরে ঘরের বাইরে নিতে চায়৷ ধস্তাধস্তি হয় দুজনের মধ্যে। সৌধ বুঝতে পারে অর্পণ স্যারকে রক্ষা করতে আহাজারি করছে নিধি৷ শুনতে পায় বারবার বলা ওর কিছু কথা,

‘ সৌধ প্লিজ উনাকে ছেড়ে দে। উনি কোনো জুলুম করেনি আমাকে। যা হচ্ছিল আমার ইচ্ছেতে হচ্ছিল, প্লিজ সৌধ। আমার কথা শোন তোরা পায়ে ধরি ভাই আমার কথাটা শোন। ‘

নিধির থেকে এমন একটি বাক্য শোনার পর সৌধ আর ঠিক থাকে না৷ থাকতে পারে না৷ অর্পণ স্যার ওকে ছুঁয়েছে। সে ছোঁয়াটা ওর ইচ্ছের ছিল! যেখানে গতরাতে ওকে ছুঁয়ে থা প্পড় খেয়েছে সেখানে অর্পণ স্যারের ছোঁয়াতে ওর সম্মতি? আরো বীভৎস হয়ে ওঠে সে। এতক্ষণ স্বাভাবিক মারধর থাকলেও এরপরের গুলো হয় অমানুষিক। অর্পণ স্যার নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট। কিন্তু পারেনি৷ দু’জন বলিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে একজন পেরে ওঠা অসম্ভব। চোখে, মুখে অগণিত লা ত্থি পড়ায় চশমার কাঁচ ভেঙে চোখের মণিতে ঢুকে যায়। নাক মুখে রক্ত ছলকে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মাথায় একটি মোটা কাঠের আঘাত সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায় অর্পণ স্যার। নিধির হাতটা শক্ত করে ধরে আছে আইয়াজ৷ বেচারি গলা ফাটিয়ে আহাজারি করছে। শেষ পর্যন্ত না পেরে আইয়াজের হাতে কামড় বসিয়ে ছাড়া পায়। ছুটে এসে অর্পণ স্যারকে জড়িয়ে ধরে৷ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। মুহুর্তেই তার বাহুতে থাবা দিয়ে নিজের বুকে তুলে আনে সৌধ। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে নিধিকে জড়িয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘ ডোন্ট ক্রাই নিধি, এই জা নো য়া রটা তোকে ছুঁয়ে ছিল না? জন্মের মতো তোকে ছোঁয়ার স্বাদ মিটিয়ে দিয়েছি। ‘

আকস্মিক কান্না থেমে যায় নিধির। বিধ্বস্ত মুখে তাকায় সৌধর ভয়ানক রক্তিম চোখে। এরপর আচমকাই কষিয়ে এক থা প্পড় বসায় গালে। দু’হাতে কলার চেপে ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে,

‘ কেন করলি এটা কেন করলি? বললাম তো যা হচ্ছিল দু’জনের আগ্রহতেই হচ্ছিল। তোকে আমি ছাড়ব না সৌধ। তোকে আমি ছাড়ব না। ‘

কথাগুলো বলেই হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে এক ছুটে অর্পণ স্যারের কাছে চলে যায়৷ হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে স্যারকে। সুহাস স্তব্ধ মুখে পাশেই দাঁড়িয়ে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ সুহাস, অর্পণ স্যার মরে যাবে। উনাকে হসপিটাল নিতে হবে৷ প্লিজ আমাকে হেল্প কর। সৌধর বন্ধু হয়ে মা রতে সাহায্য করেছিস। আমার বন্ধু হয়ে মানুষটাকে বাঁচাতে সাহায্য কর প্লিজ। ‘

নিধির কথাগুলো বিষাক্ত ঠেকে সৌধর। পুনরায় উদ্ভ্রান্তের মতো নিধিকে ধরতে এলেই ওখানে উপস্থিত হয় তার ছোটো চাচা আর বড়ো ভাই। নিধি তাদের দেখে আরো ভেঙে পড়ে৷ ছুটে এসে সুলল চৌধুরীর দু’পা আঁকড়ে ধরে বলে,

‘ কাকু প্লিজ আমার হাজব্যান্ডকে বাঁচান! ওরা মেরে ফেলল উনাকে৷ প্লিজ হেল্প করুন, হসপিটাল নিয়ে চলুন উনাকে। প্লিইইজ কাকু। ‘

সুলল চৌধুরীর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায় নিজের ভাতিজার কাণ্ড দেখে। সে জানত অর্পণ শিকদার সৌধদের কলেজের টিচার। নিধি সৌধর বান্ধবী। এখন শুনছে অর্পণ শিকদারের স্ত্রী নিধি। এখন এসব ভাবার সময় নয়। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। কঠিন চোখে তাকায় সৌধর দিকে। অসহায় একটা মেয়ের আর্তনাদ বুকে লাগে সৌধর ভাই সুনীলের৷ সেই সাথে রক্তাক্ত দেহে পড়ে থাকা অর্পণকে দেখে প্রচণ্ড রেগে যায়। ছুটে এসে ভাইকে মারতে উদ্যত হয়৷ তাকে আটকায় সুহাস। তাদের পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত। যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তার ছোটো ভাই৷ এটা যদি বাইরের কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়, বিরোধী দলের সদস্যরা জানতে পারে অতিথিকে এভাবে আহত করা হয়েছে। মারাত্মক ক্ষেপে ওঠবে তারা, ক্ষেপিয়ে তুলবে জনগণকেও। দিশেহারা প্রায় হয়ে ড্রাইভারকে কল করে বাড়ির পেছন গেটে আসতে বলে সুনীল।
সুহাস, আইয়াজ, সৌধ তিনজনই বিস্ফোরিত নিধির বক্তব্যে। সৌধ ভয়াবহ লাল চোখে তাকিয়ে আছে। যে চোখে বিস্ময়, অবিশ্বাস সমস্তই ভর করেছে। এমতাবস্থায় নিধিকে ধরে ওঠায় ছোটো চাচা। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেয়। ততক্ষণে গাড়ি এসে পড়ে। সুনীল আর সুলল মিলে অর্পণ স্যারকে গাড়িতে তুলে। সঙ্গে বদ্ধ উন্মাদের মতো ছুটে যায় নিধিও৷ কিন্তু গাড়িতে ওঠতে পারে না৷ তার পূর্বেই শক্ত থাবা দিয়ে নিধিকে আঁটকে দেয় সৌধ৷ বড়ো ভাই সুনীল চোখ গরম করে বলে,

‘ সৌধ ওকে ছাড়। ‘

সৌধ শক্ত মুখে জবাব দেয়,

‘ মরে গেলেও না। ‘

নিধি করুণ স্বরে বলে,

‘ তোর দু’টি পায়ে ধরি সৌধ। আমাকে যেতে দে, ছেড়ে দে আমায়। ‘

‘ না ছাড়ব, না যেতে দেব। ‘

তীব্র জেদি স্বর। এরপরই হেঁচকা টানে নিধিকে একদম নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। নিধি সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ছাড় পেতে। সুলল চৌধুরী ধমকায়। তবু ছাড়ে না সৌধ। আজ যেন স্বয়ং উপরওয়ালা ছাড়া কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তাকে৷ কাউকে পরোয়া করবে না সে। ধৈর্য্যের সব বাঁধ ভেঙে গেছে তার। এদিকে অর্পণ স্যারের মুখ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। জ্ঞান হারা তখনো। বাধ্য হয়ে সুনীল বলল,

‘ কাকা আমাদের যাওয়া উচিত। সৌধর সঙ্গে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে। ‘

সুলল চৌধুরী সায় দিল বড়ো ভাতিজাকে। এরপর নিধিকে বলল,

‘ মা নিধি, আমরা যাই। তুমি চিন্তা করো না অর্পণ শিকদারের চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হবে না। ‘

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল নিধি। সৌধর থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে হতাশ ভঙ্গিতে তাকাল সুললের দিকে। অসহায় ভাবে মাথা কাত করে সম্মতি দিল। গাড়ি স্টার্ট হলো। তক্ষুনি চোখের পলকে চলেও গেল গাড়িটা। এরপরই বাঘের মতো গর্জন দিয়ে সৌধ বলল,

‘ অর্পণ তোর হাজব্যান্ড? ‘

নিধির কান্না থেমে গেল আচমকা। শক্ত মুখে জবাব দিল,

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি আমার স্বামী। ‘

সহসা নিধির গলা চেপে ধরল সৌধ। সুহাস, আইয়াজ দু’জনি ছুটে এসে সৌধকে থামানোর চেষ্টা করল। নিধি চোখ উল্টে দিলে ছেড়ে দিল সৌধ৷ এরপর টানতে টানতে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। পাশাপাশি বন্ধুদের হুংকার দিয়ে বলল,

‘ কাজী ডাক তোরা। আগে বিয়ে পরে বোঝাপড়া। ‘

নিধিকে টেনে হিঁচড়ে সদর দরজার সামনে যেতেই মুখোমুখি হলো শ্রদ্ধেয় পিতা সুজা চৌধুরীর। ছোটো ভাই আর বড়ো ছেলের ওপর দায়িত্ব দিয়ে সে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ির একটা মেয়ে বউ বা অতিথিবৃন্দ। কাউকেই যেতে দেয়নি ওদিকে। কিন্তু এবার সর্ব সম্মুখে সৌধই এলো। তার চেহেরা দেখে পরিষ্কার সে স্বাভাবিক অবস্থাতে নেই। সৌধর অস্বাভাবিকতা নিশ্চিত হলো তখন যখন একঘর লোকের সামনে শক্ত হাতে বান্ধুবির কব্জি ধরে বাবার মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘ আব্বা ও নিধি, চিনেন তো? আমি ওকে ভালোবাসি আজ পাঁচ বছর৷ স্মৃতি আপুর বিয়ে মিটে গেলেই জানাতে চেয়েছিলাম। বিয়ে মিটে গেছে জানিয়ে দিলাম৷ সুহাস কাজী ডাকতে গেছে। আজ এক্ষুনি ওকে বিয়ে করব আমি। ‘

সুজা চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে সৌধর পেছনে তাকালেন। সুহাস থমথমে মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। সৌধর মা তানজিম চৌধুরী পেছন থেকে কান্নারত গলায় বলল,

‘ সুহাস তো তোর পেছনে। ‘

সহসা ক্রোধান্বিত ভঙ্গিতে পেছনে তাকাল সৌধ। চোয়ালদ্বয় কঠিন করে বলল,

‘ তোকে না বললাম কাজী ডাকতে? ‘

সুহাস বোঝানোর ভঙ্গিতে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ বিশ্রী একটা গালি দিল ওকে। সুজা চৌধুরী ধমকে ওঠল। সে ধমক শুনে বাড়ির সদস্যরা ভয়ে সরে পড়ল সবাই। রইল শুধু দাদুনি, সৌধর ফুপু আর মা তানজিম চৌধুরী। নিধি মাথা নিচু করে কাঁদছে। সুজা চৌধুরী সুক্ষ্ম চোখে তাকালেন ওর দিকে। দেখলেন তার ছেলের হাত থেকে ছাড় পেতে মেয়েটার তীব্র চেষ্টা৷ কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে থেকে সুজা চৌধুরী ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘ ভিতরে আসো ওকে নিয়ে। ‘

সৌধ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল নিধির দিকে। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে৷ কী বিশ্রী এই কান্না। বুকটা বিতৃষ্ণ লাগল সৌধর। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ কান্না থামা। ‘

নিধি চোখ, মুখ শক্ত করে হাত মোচড়াতে লাগল। সৌধর বিধ্বস্ত মুখে ঈষৎ হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। বাম দিক, ডান দিক ঘাড় বাঁকিয়ে প্রগাঢ় চোখ নিক্ষেপ করল নিধির পানে। ফিসফিসে কণ্ঠে বলল,

‘ ভালোবাসা দিয়ে আমাকে চেনাতে চেয়েছিলাম চিনলি না। এবার আমার রাগ, জেদ, ক্ষমতা দিয়ে চেনাব। ‘

বুকের ভেতর চিড়িক দিয়ে ওঠল নিধির। দু’চোখ উপচে আবারো অশ্রু গড়াতে শুরু করল। তা দেখে সৌধ আঁতকানো কণ্ঠে বলল,

‘ এই আবার কাঁদছিস, ভয় পাচ্ছিস তুই? বোকা মেয়ে, সবকিছুর পর আমি তোকে ভালোবাসিরে। জাস্ট বউ হয়ে যা, সাত খু ন মাফ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ আগে যা সব বলেছিস এসব জাস্ট ভুলে যাব। বিলিভ মি, সব ব্যথা ভুলে ভালোবাসব আমরণ, জাস্ট আমার বউ হয়ে যা পাগলি। ‘

শেষ বাক্যগুলো ছিল তীব্র আবেগ মেশানো। যা বলার সময় গলা কাঁপছিল সৌধর৷ কাঁপছিল বুকের গহীনে থাকা হৃদযন্ত্রটাও। আর নিধি? সে ছিল নির্বিকার। সৌধকে কেবল অমানুষ, ডক্টর রূপে কষাই ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। বিষাক্ত ঠেকছে ওর স্পর্শ, কণ্ঠ, মুখাবয়ব সবটা।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩০|
বিয়ে বাড়ির আমেজ এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কাছের অতিথিবৃন্দের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত আছে। তাই সুজা চৌধুরীর ব্যক্তিগত মিটিং রুমে নেয়া হলো সৌধ, নিধিকে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৌধর মা আর দাদুনিকে রাখা হয়েছে৷ বন্ধুদের মধ্যে রাখা হলো শুধু সুহাস, আইয়াজকে। ছোটোবেলা থেকেই সৌধ ভীষণ শান্ত প্রকৃতির হলেও জেদটা মারাত্মক।
ব্যক্তিভেদে প্রচণ্ড গম্ভীরও এই ছেলে। মেজাজের ব্যাপারটা কালেভদ্রে দেখা যায়। কিন্তু এমন উশৃংখল মেজাজের দেখা মিলল এবারি প্রথম। সুজা চৌধুরী স্তম্ভিত মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে। ছোটো ছেলের এ কোন রূপের সঙ্গে পরিচয় ঘটল তার? সে জানত বড়ো ছেলেটা তার স্বভাবের হয়েছে। ছোটোটা পেয়েছে মায়ের স্বভাব। মাথায় রক্ত ওঠা, খু ন চাপা ক্রোধ তো স্ত্রী তানজিমের নয়। এই ক্রোধ তো তারই অংশ। ঘোর কাটল সুজা চৌধুরীর। তার পাশের চেয়ারে দৃষ্টি মেঝেতে স্থির রেখে সৌধ বসা। সম্মুখের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে নিধি৷ তার ডান পাশে তানজিম চৌধুরী, বামপাশে দাদুনি। সুহাস আর আইয়াজ একপাশে উদ্বিগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে। সকলের দিকে একবার শীতল দৃষ্টিপাত করে মুখ খুললেন সুজা চৌধুরী। টেবিলে দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে নিধিকে উদ্দেশ্য করে দৃঢ়স্বরে বললেন,

‘নিধি মা, তুমি আমার ছেলের সাথে কমিটেড ছিলা?’

তৎক্ষনাৎ দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে হুহু করে কেঁদে ওঠল নিধি। দু-হাত মুখ চেপে একাধারে কেঁদেই গেল সে। নিজেকে বড্ড এলোমেলো লাগছিল সৌধর। মাথাটা ঘুরাচ্ছে। মস্তিষ্কে চাপ পড়ছে খুব। বুকের ভেতর একটা অংশ জুড়ে অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করছে। কোনোভাবে হিসেব মেলাতে পারছে না সে৷ তার এই এলোমেলো অবস্থায় বাবার প্রশ্নে নিধির উত্তর বিস্ফোরণ ঘটাল। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে উদ্যত হলো নিধির দিকে তেড়ে আসতে। সুজা চৌধুরী বুদ্ধিমান মানুষ। তুখোড় রাজনীতিবিদ। এক মাথায় ঘরে, বাইরে রাজনীতি করে বেড়ায়। তার তীক্ষ্ণ জ্ঞানে ছেলের প্রতিক্রিয়া আর নিধির প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ অমিল লক্ষ্য করলেন। তাই ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহসা হাত টেনে ধরে গরম চোখে তাকালেন। বাবার তোপের মুখে পড়ে কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রণ হলো সৌধ। ধীরগতিতে বসল আগের ন্যায়। সুজা চৌধুরী ফের ক্রন্দনরত নিধির পানে তাকালেন। বললেন,

‘ দেখো মা আমার বিশ্বাস সৌধকে আমি যতটুকু চিনি তার চেয়ে বেশি তুমি, সুহাস, আইয়াজ চিনো। আমার ছেলের প্রতি কিছুটা বিশ্বাস রাখাকে তুমি অন্যায় ভাবে দেখো না। ‘

কথাটা বলে শেষ করতেই হঠাৎ তার চোখ পড়ল সুহাসের দিকে। সুহাস যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। অনুমতির অভাবে সাহস পাচ্ছে না। তাই অনুমতি, সাহস দু’টোই দিলেন তিনি বললেন,

‘ সুহাস এদিকে আসো। ‘

সঙ্গে সঙ্গে সুহাস এগিয়ে এলো। সুজা আংকেল বলল,

‘ বসো তোমার কিছু বলার থাকলে বলো। আমি শুনতে চাই। ‘

সুহাস যেন এই সুযোগটারি অপেক্ষায় ছিল। তাই চেয়ারে না বসে চট করে নিধির সম্মুখে মেঝেতে বসে পড়ল৷ এরপর তাকাল সুজা আংকেলের দিকে। বলল,

‘ আমি নিধির সাথে কথা বলতে চাই আংকেল। আমার মনে হয় এতে করে সবাই সবার উত্তর পাবে। কী সত্যি, কী মিথ্যা সেটাও জানা হবে। ‘

‘ বেশ কথা বলো। ‘

কিয়ৎক্ষণ নীরবতা চলল। সুহাসও তৈরি হয়ে নিল নিধির সঙ্গে বোঝাপড়া করার। নিধি দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। যে কথাগুলো ঠান্ডা মাথায়, ঠান্ডা পরিস্থিতিতে বন্ধুদের বলতে চেয়েছিল। আজ এই বিধ্বস্ত মুহুর্তে সে কথাগুলো বলতে বাধ্য হলো সে। তার পূর্বে অবশ্য সুহাসের ক্রোধ মিশ্রিত কিছু কথার উত্তর দিয়ে নিল। সুহাস বলল,

‘ তুই জানতি না সৌধ তোকে ভালোবাসে?’

নিধি মাথা নাড়াল। সুহাস আবারো প্রশ্ন করল,

‘ তুই ওকে সময় দিসনি? ‘

এবারেও মাথা নাড়াল নিধি। চোয়াল শক্ত করে রক্ত বর্ণ চোখে তাকিয়ে সুহাস বলল,

‘ স্মৃতি আপুর বিয়ের পর পরিবারকে জানিয়ে তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার কথা ছিল না? ‘

সুহাসের প্রতিটা প্রশ্নে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল নিধি। এতে সুহাসের ক্রোধ প্রগাঢ় হলো। বলল,

‘ তাহলে এই বেইমানিটা কীভাবে করতে পারলি? সৌধকে তুই ভালোবাসা, সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিসনি মানলাম। কিন্তু গত তিন বছরে তোদের চালচলন, হাবভাবে কিছু সুপ্ত অনুভূতি ছিল। যা খোলা চোখে দেখা না গেলেও আমি এবং আমরা দেখতে পেয়েছি। তুই কেন সৌধর অনুভূতি নিয়ে খেললি? অর্পণ স্যারের প্রতি তুই ক্রাশড ছিলি। তাই বলে তাকে ভালোবাসিস বা তার সাথে সম্পর্কে আছিস এমন কিছু না দেখেছি আর না শুনেছি আর না তুই বলেছিস। কেন করলি এমন বল? যদি অর্পণ স্যারকেই ভালোবাসিস গত তিন বছরে কেন আমাদের বা সৌধকে জানাসনি। সৌধর অনুভূতিতে কেন নীরব ছিলি, কেন এভাবে ধোঁকা দিলি? খুব কষ্ট হচ্ছে নিধি খুব। তোকে বেইমান ভাবতে, তোর এই নতুন রূপ দেখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবশেষে সৌধর অনুভূতি নিয়ে এভাবে খেলাধুলা জাস্ট মেনে নিতে পারছি না। ‘

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সুহাস। ওপাশ থেকে আইয়াজ বলল,

‘ মুখ খোল নিধি। নয়তো আজ এখানেই আমাদের বন্ধুত্ব শেষ। ‘

আকস্মিক কেঁপে ওঠল নিধি। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে ত্বরিত স্বরে বলল,

‘ সব বলব আমি। বলতে চেয়েছিলামি। কিন্তু সেই সুযোগটা পাইনি। ভেবেছিলাম স্মৃতি আপুর বিয়ের ঝামেলা কে টে গেলে বলব। আমি চাইনি আমার জন্য সৌধর আনন্দ মাটি হয়ে যাক। ‘

সুহাস স্তব্ধ মুখে বলল,

‘ একটা কথা বল, অর্পণ স্যারের সঙ্গে তোর প্রেম কত দিনের? ‘

ঢোক গিলল নিধি। মাথা নিচু করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ আমাদের মধ্যে কখনো প্রেম ছিলই না। উনার প্রতি আমার সফট কর্ণার ছিল তবু তিন বছর আগে। ‘

‘ এখন? ‘

‘ আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী! ‘

ঠান্ডা কণ্ঠ নিধির । বাবার পাশে বসা সৌধ অস্থির হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুজা চৌধুরী তার মুখে হাত চেপে ধরল। দৃঢ়স্বরে বলল,

‘ আব্বা শান্ত হও। আমার ওপর ভরসা রাখো। বলতে দেও ওরে, আগে শুনি সব। ‘

সৌধ শান্ত হতে পারল না। তবু বাবার কথায় কান সজাগ করে বসে রইল ঠাঁই। নিধির কথা শুনে সুহাসের কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না সে৷ কিন্তু নিধি নিজে থেকেই বলতে শুরু করল সবটা –

***
সৌধকে আমি বন্ধুর চোখে দেখেছি মাত্র দু’বছর। এরপরই ওর দৃষ্টিতে বন্ধু ছাড়া আলাদা কিছু টের পাই। এর সত্যতা মিলে যায় সেদিন যেদিন নিজ মুখে ও স্বীকার করে ও আমাকে ভালোবাসে। যা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম তা সত্যি হয়ে যাওয়াতে একদিকে খুশি আরেকদিকে দুঃখ হচ্ছিল। সৌধ নিঃসন্দেহে চমৎকার একজন মানুষ। প্রতিটা মেয়েই ওর মতো ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওর মতো ছেলের ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষায় থাকে। তাছাড়া চৌধুরী বাড়ির মতো পরিবার আমি খুব কমই দেখেছি। সব মিলিয়ে সৌধর ভালোবাসা পাওয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্য ছিল৷ এর আগে ওদের মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের বলতাম৷ এরপর থেকে মনে মনে সব সময় নিজেকে সৌভাগ্যবতী ভাবতাম। কিন্তু কোনোদিন ওকে নিজের করে পাবো বা আমি ওর বউ হতে পারব বিশ্বাস হতো না৷ এর কারণ আমার পারিবারিক সমস্যা। সেই সমস্যা গুলোই তিনবছর আগে খোলাখুলি বলি ওকে। সবটা শুনে ও আমাকে এত সুন্দর করে বোঝায়, ভরসা দেয় আমি জাস্ট বিমোহিত হয়ে যাই। আশার আলো খুঁজে পাই ওকে পাওয়ার। সেদিন থেকে বন্ধুত্বের বাইরেও ওর প্রতি একটা দুর্বল জায়গা সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু সেটাকে আজ আমি ভালোবাসা বলতে পারছি না, তখনো পারিনি৷ যেহেতু আমরা বন্ধু ছিলাম সেহেতু ভালোবাসাবাসির ব্যাপারটা আসলে সেভাবে আসেনি। সৌধর দিক থেকে এলেও আমার দিকে আসেনি। চেষ্টা করিনি তা না চেষ্টা করেছি কিন্তু সেই অনুভূতি আসেনি। তবে নিজেকে তৈরি করছিলাম ওর জন্য৷ কারণ আমি সিয়র ছিলাম একদিন সৌধকেই বিয়ে করতে হবে আমাকে। কারণ ওর ভয়ংকর রকমের ভালোবাসার কাছে হারতে বাধ্য আমি। সব ঠিকঠাকই ছিল। অর্পণ স্যারের প্রতি আমি ক্রাশড ছিলাম ঠিকি। কিন্তু গত তিন বছরে সেসব মুছে গিয়েছিল। আমরা আমাদের মতো পড়াশোনা করেছি৷ বন্ধুদের সময় দিয়েছি, আড্ডা জমিয়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছি। তখন বুঝতে পারিনি, খেয়াল হয়নি আমাদের চেয়েও বড়ো পরিকল্পনাকারী একজন আছেন। সৃষ্টিকর্তার লিখন খণ্ডানোর সাধ্য আমাদের মতো নগন্য মানুষদের নেই। সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময়। যেইদিন হঠাৎ মামার অসুস্থতার খবর পেয়ে ময়মনসিংহে ছুটতে হয়েছিল। আমার মামার একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যায় সেদিন। কারণ, মামার একমাত্র মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। মান, সম্মানের ভয়ে মামার ওই অবস্থা হয়নি। মামার ওই অবস্থা হয়েছিল প্রিয় বন্ধুকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারল না বলে। মামার বন্ধু মারা গেছে দেড় বছর আগে৷ মামির থেকে জানতে পারি, মামা তার বন্ধুকে কথা দিয়েছিল তার একমাত্র মেয়েকে বন্ধুর বড়ো ছেলের কাছে বিয়ে দেবে। কোনো এক কারণবশত মামা তার বন্ধুর কাছে ঋণী ছিল। যা আমি জানি না৷ আমি ওখানে পৌঁছে যখন এসব শুনলাম তার ঘন্টা খানিক পরই অর্পণ স্যারের দেখা পাই। আমার মতো সেও মামাকে দেখতে হসপিটালে এসেছে। প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম সেদিন কারণ কোইন্সিডেন্সলি অর্পণ স্যারই ছিলেন আমার মামাত বোনের হবু বর৷ আমি যেমন স্যারকে দেখে বিস্মিত ছিলাম স্যারও ছিলেন। সেদিন স্যারকে দেখেই মামা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ হাত জোর করে বার বার ক্ষমা চায়। সবাই খুব আতঙ্কে ছিল প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার যন্ত্রণায় মামার আরো ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে না তো? অর্পণ স্যার একজন ডক্টর, আমিও ইন্টার্ন ডাক্টার। সে মুহুর্তে মামার মানসিক, শারীরিক উভয় অবস্থাই আমরা টের পাচ্ছিলাম। অর্পণ স্যার মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো। তাই মামাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, যা ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে এসব নিয়ে তার সমস্যা নেই। উপরওয়ালা নিশ্চয়ই তার ভাগ্যে ব্যাটার কিছু রেখেছেন৷ কিন্তু মামা এসব কানে তুলেনি৷ ভেঙে পরছিল খুব। মা, মামি সবার অবস্থাই দিশেহারা। একদিকে বোন নিখোঁজ অন্যদিকে মামার এই অবস্থা মাথা কাজ করছিল না আমার। এরপর অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। আমরা সবাই হসপিটালেই ছিলাম। হঠাৎ অর্পণ স্যার মামার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চায়। তারা কথা বলার পর আমাকে আর আম্মুকে ডাকা হয়। মামা জানায় মামার শেষ একটা ইচ্ছে আছে তা হলো, অর্পণ স্যারের সঙ্গে আমার বিয়ে। স্যার নাকি বলেছেন, সে আমাকে বহুদিন ধরেই পছন্দ করে। মেয়ে আর ভাগ্নি আলাদা কী? এক মেয়ে দিতে পারেনি তো কী হয়েছে আরেক মেয়ে আছে তো? মামার চোখে আমি ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পাই। দেখতে পাই তার প্রতিশ্রুতি ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা ক্ষীণ হতেও। আম্মুরও আপত্তি দেখলাম না। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমিও আপত্তি করতে পারলাম না। সেদিন রাতে বিয়ের আগে স্যারের সঙ্গে যখন আলাদা কথা বলতে দেয়া হয়, স্যার বলেন, তার আমাকে অপছন্দ নয়। কিন্তু মামাকে যেভাবে কনভিন্স করেছে তা পুরোপুরি সত্যি নয়। মামার গ্লানিবোধ কাটাতেই একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে জানাতে পারি। ওই মুহুর্তে আমি আপত্তি করতে পারিনি। আমি জানতাম সৌধ আমাকে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটা আমাকে। কিন্তু ওর ভালোবাসা আমাকে ওই সময়ে একটুও ছুঁতে পারেনি। নিজেদের স্বার্থে ঠিক অর্পণ স্যারকে বিয়ে করে নিয়েছি। মামার প্রতি ঋণী ছিলাম আমি আর আম্মুও। টাকা পয়সার ঋণ শোধ করা গেলেও ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না। কিন্তু মামার ভালোবাসার ঋণ আমি শোধ করেছিলাম তাকে আত্মগ্লানি থেকে রক্ষা করে। এত সব ঝড় মোকাবিলা করার পর আরো একটা ঝড়ের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম। অনুভব করছিলাম আমার জীবনে খুব সহজ কিছু ঘটে যায়নি, সামনেও সহজ কিছু ঘটবে না। সৌধ আমার বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। ওর প্রতি আমি দুর্বল ছিলাম। ও ছিল আমার প্রতি ভয়ানক দুর্বল। তাই সেভাবেই সবটা সামলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই যে এতকিছুর সম্মুখীন হতে হবে বুঝতে পারিনি। সবকিছুর পরও সৌধকে আমি খুব ভালো বন্ধু ভাবি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভেবেও যাব। সৌধ ভাবুক আর না ভাবুক৷ তবু ভালোবাসা বিহীন ওর জীবনে জড়াব না। ওর প্রতি আমার উইকনেস থাকলেও ভালোবাসা ছিল না এটার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ আমি অর্পণ স্যারের বউ। আমার শেষ কথা এটাই, আমাকে যদি বন্ধু ব্যাতীত সৌধর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করা হয় এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত স্টেপ আমি নিব৷ আজ যা হয়েছে তার জন্য হয়তো ওকে ক্ষমা করতে পারব কিন্তু এরপর কোনোভাবেই ক্ষমা সম্ভব না। সবকিছুর পর আমি নিজের কাছে স্বচ্ছ এটাই আমার সাহস এটাই আমার শক্তি।
***

নিধির চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে। তার বলা প্রতিটি বক্তব্য বাকরূদ্ধ হয়ে শুনল উপস্থিত সকল ব্যক্তি। সবার শরীর বরফের মতো শীতল আর শক্ত। শুধু সৌধ ব্যাতীত৷ সে একধ্যানে নিধির দিকে তাকিয়ে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। হাত, পা ছড়িয়ে রক্তশূণ্য মুখে তাকিয়ে আছে কেবল নিধির পানেই। নিধি এক পলক তাকিয়ে দেখল সৌধকে। ত্বরিত চোখ সরিয়ে মুখ নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টাও করল। সৌধকে সে ভালোবাসতে পেরেছিল কিনা জানে না৷ কিন্তু সবার সামনে ভালোবাসি না বলাটা খুব জরুরি ছিল বলেই বলা। অন্যের বউ হয়ে এটুকু তো তাকে বলতেই হতো। সবকিছুর পর বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক যন্ত্রণা হচ্ছে। যতক্ষণ সৌধর সামনে থাকবে ততক্ষণ এই যন্ত্রণা উপশম হবে না। বুঝতে পারল নিখুঁত ভাবেই।এদিকে অর্পণ স্যারকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তায় বুক ভার৷ যা কিছু লুকোনো ছিল সব প্রকাশ করে দিয়েছে। সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে সে স্বেচ্ছায় কিছু লুকোয়নি। পরিস্থিতি তাকে তৎক্ষনাৎ সবাইকে জানাতে দেয়নি। আর কিছু বলার নেই তার। নেই আর কিছু জানানোরও। এখন বিদায় নেয়ার পালা। চলে যাওয়া উচিত তার। নিজের স্বামীর মরণাপন্ন অবস্থায় পাশে থাকা উচিত। এতকিছুর পরও যদি সৌধ তাকে জোর করে জবরদস্তি করে আটকাতে চায় তাহলে আর বন্ধুত্বের খাতিরে চুপ থাকবে না। ভেবেচিন্তে সুহাসের বাকরূদ্ধ মুখটায় তাকাল নিধি। কান্নারত মুখে ঈষৎ হাসল। এরপর তাকাল সুজা চৌধুরীর চিন্তান্বিত মুখপানে। অসহায় ভঙ্গিতে কান্নারত কণ্ঠে বলল,

‘ আংকেল, আমার হাজব্যান্ডের অবস্থা খুব খারাপ। আমি তার কাছে যেতে চাই। ‘

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩১|
ভালোবাসা ভালো কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধত্ব বোকামি। সৌধর মতো শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষটাও দিনশেষে হেরে গেল। সত্যিই কি হারল? খাঁটি প্রণয়ে কি হার শব্দটি জড়ায় কখনো? নাকি এই হারটাই একদিন বিস্ময়কর জয়ে পরিণত হবে? সৌধ কি সত্যি হেরে যাওয়ার মতো ছেলে? দিনশেষে আসলে হারল কে? যে গভীর প্রণয় আহ্বান করল সে নাকি যে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করল সে? বনেদি পরিবারের ছেলে সৌধ। রূপ, গুণ, বংশপরিচয়, আত্মমর্যাদা সবকিছুতে শতভাগ এগুনো ছেলেটা নিঃস্বার্থ ভাবে কেবল নিধি নামক এক সাধারণ পরিবারের মেয়েকেই ভালোবেসেছিল। আর পাঁচটা ছেলের মতো অহরহ নারী লোভ ছিল না তার। এক নারীতেই আসক্ত ছিল পাঁচটা বছর। সেই নারীটার শত প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েও আশায় বেঁচেছিল। এক নারীকে বুকে পুষেই স্বপ্ন দেখেছিল। আজকের পর সব আশা, সব স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে। পুরুষের গভীর প্রেম যে নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনা। সে নারীর জীবনে প্রেম কি কেবলই মরীচিকা নয়?

বলিষ্ঠ লম্বা হাত, পা গুলো ছড়ানো সৌধর৷ গোল গোল রক্তিম চোখ দু’টো নিষ্পলক তাকিয়ে নিধির বিধ্বস্ত, অশ্রুসিক্ত মুখটায়৷ সকলের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ নীরবতা চলল। সুজা চৌধুরী বুড়ো আঙুল দ্বারা নিজের বাম ভ্রু চুলকাচ্ছে। গভীর চিন্তা করা কালীন ভ্রু চুলকায় তিনি৷ তানজিম চৌধুরী ছেলের পানে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সৌধর ভেতরে কী ঝড় বইছে টের পাচ্ছেন তিনি। একসঙ্গে এত ধাক্কা সামলে ওঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। তার ছেলে নিধিকে পছন্দ করে জানতেন না তিনি। আজ যখন জানতে পারলেন তখন আর কিছু করার রইল। আর যাইহোক কারো বউকে তো আর ছেলের জন্য নিয়ে আসতে পারবেন না তারা। যেখানে মেয়েটাও স্পষ্ট বলছে সে সৌধর সঙ্গে বন্ধু ব্যাতীত আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না। সৌধর বুক ফাটা আর্তনাদ মা হয়ে যেন শুনতে পেলেন তিনি। স্বামীর দিকে তাকালেন করুণ চোখে৷ সুজা চৌধুরীও স্ত্রীর পানে তাকালেন একবার। এরপর তাকালেন পাশে বসা ভঙ্গুর ছেলেটার দিকে। মেয়ে হলে নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদত? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ছেলের কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,

‘ আব্বা, আজ পর্যন্ত আমার দ্বারা কোনো অন্যায় হয়নাই। তুমি চাইলে আজ একটা অন্যায় আমি করতে পারি৷ কিন্তু কথা দিতে হবো তুমি এতে সুখ পাবা। ‘

সুজা চৌধুরীর কথা শুনে সৌধ বাদে উপস্থিত সবাই কেঁপে ওঠল। থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিধিও। সে আঁচ করতে পারল কী ভয়ানক একটি কথা সুজা আংকেল বলেছেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠল সে। হাত, পা কাঁপতে শুরু করল মৃদুভাবে। সৌধর দৃষ্টিজোড়া তখনো তার দিকে অনড়। বাবার কথায় নিধির হাত, পায়ের কাঁপন, মুখে ভীতিগ্রস্ত ভাব। স্পষ্টই দেখতে পেল। সহসা চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল সৌধ। তানজিম চৌধুরী দেখলেন দু’গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়াল। মুহুর্তেই আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠলেন তিনি৷ সুহাস, আইয়াজ আচমকা সৌধর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল বিস্ময়কর দৃশ্যটি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সুহাস। ছুটে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল। ছুটে এলো আইয়াজও। কাঁধে হাত রেখে তীব্র ক্রোধে তাকাল নিধির পানে। নিধি জড়োসড়ো হয়ে ঠাঁই বসে। সৌধ যেভাবে ছিল ওভাবেই রইল৷ না বন্ধুদের ধরল আর না চোখ তুলে তাকাল। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ দৃঢ়স্বর ভেসে এলো সৌধর,

‘ ছাড় আমাকে। ‘

সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল সুহাস। সরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার পানে তাকাল। বাবার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ আপনাকে কোনো অন্যায় করতে দিব না আমি। ‘

সুজা চৌধুরী প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। আকস্মিক ছেলের কথা শুনে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লেন। যা বোঝার বুঝে গেছেন৷ তাই স্ত্রী তানজিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ ড্রাইভারকে ফোন দেও। নিধিকে হসপিটালে পৌঁছে দিতে বলো। ‘

স্ত্রীকে কথাটা বলেই ফের ছেলের দিকে তাকালেন। সৌধ চুপচাপ আগের জায়গায় বসে পড়ল। আগের ন্যায় তাকিয়ে রইল নিধির পানে। পরিস্থিতি বুঝেশুনে ওঠে দাঁড়াল নিধি। কিন্তু আর একবারো সৌধর দিকে তাকানোর সাহস পেল না। সুজা চৌধুরী নিধিকে বললেন,

‘ যা কিছু হইছে এরজন্য আমার ছেলেকে যদি ক্ষমা করতে পারো করো নয়তো অনুমতি দিলাম ওর বিরুদ্ধে যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার আইনিভাবে নেও। ‘

সুজা চৌধুরী চৌকশ চরিত্রের মানুষ। সে ঠিক জানে নিধি কোনো পদক্ষেপই নেবে না। আর নিলেও তা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। তবু নিজের দাম্ভিকতা দেখিয়ে কথাটা বললেন। এরপরই ওখান থেকে প্রস্থান করলেন তিনি৷ সঙ্গে করে নিজের মাকেও নিয়ে গেলেন। ছেলেকে সামলাতে রেখে গেলেন স্ত্রী আর ছেলের বন্ধুদের। স্বামী প্রস্থান করতেই মুখ খুললেন তানজিম চৌধুরী। বললেন,

‘ আজকালকার মেয়ে মানুষ হয়ে তুমি কী কাজ করলা বুঝলাম না। আমার ছেলে কোন দিক দিয়ে কম? তোমরা না লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াইতেছ? শুনছি তোমার নাকি মুখের ওপর উচিত কথা বলার স্বভাব আছে? বাপের বিরুদ্ধে যাইয়া ডাক্তারি পড়ছ? এমন মেয়ে হইয়া পরিবার চাপ দিল আর বিয়ে করে নিলা! মেয়েতো আমারো আছে। ‘

তানজিম চৌধুরীর কথায় স্পষ্ট রাগ। নিধি অবাক হলো না। সৌধর মা হিসেবে এটুকু স্বাভাবিক তাই ঈষৎ হেসে বলল,

‘ যার পরিস্থিতি সেই বুঝে। তাছাড়া আমিত বলেছি ওর প্রতি আমার উইকনেস ছিল কিন্তু ভালোবাসা না। ‘

তানজিম চৌধুরী মুখ ঝামটা দিলেন। সুহাস এসে নিধির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

‘আই কান্ট বিলিভ তুই এভাবে বিয়ে করতে পারিস।’

নিধির মাথা ধরে গেল। কোনোরকমে সোজা হয়ে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তর দিল,

‘ মি ঠু সুহাস। ‘

চোখ, মুখ শক্ত হয়ে ওঠল সুহাসের। নিধি আর কথা বাড়াতে চাইল না। তার এবার যাওয়া উচিত। অর্পণ স্যার কেমন আছে জানা উচিত। বিনা দোষে, নিরপরাধ হয়ে মানুষটা যা কিছুর মুখোমুখি হলো। সবটার জন্য একমাত্র সে দায়ী। আকস্মিক পেছনে তাকাল নিধি৷ রোবটের মতো তাকিয়ে থাকা সৌধর দিকে কয়েক পল চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল৷ চোয়াল শক্ত করে লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে। সৌধর ঘোর কাটল ঠিক তক্ষুনি। বসা থেকে তড়াক করে ওঠে এলো সে। বন্ধু, মাকে অতিক্রম করে নিধির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। চমকে ওঠল নিধি। ঢোল গিলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌধর পাগলপ্রায় মুখটায়। তানজিম চৌধুরী ত্বরিত এসে ছেলেকে ধরতে চাইল তার আগেই হাত ওঠিয়ে মাকে নিষেধাজ্ঞা দিল সৌধ। বলল,

‘ আমি ঠিক আছি আম্মা। তুমি অস্থিরতা কমাও। ‘

চুপসে গেলেন তানজিম চৌধুরী। সুহাস, আইয়াজ দু’জনই এগিয়ে এলো। নিধি সুহাসের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। যেন সে খুবই অসহনীয় এখন। সৌধ বুঝতে পারল, নিধির বুকে এখন কেবলই অর্পণ স্যারকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। তার হৃদয় যে চুরমার হয়ে যাচ্ছে এতে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই বেইমানটার। আকস্মিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠল সে। উন্মাদ গ্রস্ত কণ্ঠে বলল,

‘ তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছিস? ‘

দৃষ্টি নত করে মাথা নাড়াল নিধি। সৌধ বলল,

‘ আমার দিকে তাকিয়ে বল। ‘

নিধি তাকাল না৷ কয়েক পল অপেক্ষা করে ফের সৌধ বলল,

‘ তুই অন্যকারো বউ? ‘

নিধি হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়াল। হঠাৎ মায়ের দিকে তাকাল সৌধ। বলল,

‘ আম্মা একটু সরে দাঁড়াও ব্যক্তিগত কোশ্চেন করব। ‘

তানজিম চৌধুরী একবার নিধির দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন কিছুটা। বুকের ভেতর অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে তার। সৌধকে স্বাভাবিক ঠেকছে না। ছেলেটা নিজের মধ্যে নেই। মা সরে যেতেই নিধির খুব কাছাকাছি হয়ে দাঁড়াল সৌধ। একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে শুধাল,

‘ বাসর করেছিস? ‘

আঁতকে ওঠল নিধি। হতভম্ব হয়ে একবার সৌধ আর একবার পাশে সুহাস, আইয়াজের দিকে তাকাল। তীব্র অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে। তাদের বিয়ের অনেক গুলো দিন কেটে গেছে। স্বামী হিসেবে যখন অর্পণ স্যারকে গ্রহণ করেছে। তখন সব ধরনের অধিকারও দিয়েছে। ব্যক্তিগত এই প্রশ্নটিতে বিব্রত হলো খুব। ঢোক গিলল ঘনঘন৷ সৌধ যেন মরিয়া হয়ে ওঠল জানার জন্য। সহসা চিৎকার করে বলল,

‘ কী হলো বল সে ক্স করেছিস তোর অর্পণ স্যারের সাথে? ‘

কাঁধ ঝাকিয়ে কেঁপে ওঠল নিধি। চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে স্বীকার করল। হয়েছে বাসর। মুহুর্তেই বীভৎস এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল সৌধ। সুহাসকে বলল,

‘ বিশ্বাসঘাতক, বেইমানটাকে চোখের সামনে থেকে নিয়ে যা। আর এক মুহুর্তও যদি ও আমার সামনে থাকে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারবে না। ‘

কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সৌধ। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। নিধিও আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে চলে গেল। তার পেছনে গেল সুহাস। কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সৌধর কাছে তানজিম চৌধুরী এলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ মায়ের হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ দৌড় দিল। সিঁড়ি বেয়ে, ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজার বাইরে চলে গেল ছেলেটা। তানজিম চৌধুরী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের পেছনে ছুটলেন। ছুটল আইয়াজও। ভেতর ঘর থেকে নামী, সিমরান সহ সবাই বেরিয়ে এলো। সদর দরজার বাইরে বেরুতেই দেখতে পেল নিধি গাড়িতে ওঠতে নিচ্ছিল এমন সময় সৌধ গাড়ির ডোর টেনে ধরল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে বলল,

‘ আল্লাহর কসম তোকে আমি ক্ষমা করব না। ‘

নিধি স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে। সুহাস সৌধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আইয়াজ পিছন থেকে টেনে ধরেছে। তবু সৌধ টলছে না। নিধি ফের গাড়িতে ওঠতে নিলে সৌধ ওর আঁচল টেনে ধরল। বলল,

‘ তুই আমার গভীর ভালোবাসা দেখেছিস, ঘৃণা দেখিসনি। ‘

এ পর্যায়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল নিধি। বলল,

‘ সৌধ আমাকে ক্ষমা কর তুই। ‘

নিধির কান্নায় আরো ক্ষেপে গেল সৌধ। বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বলল,

‘ আমার ভালোবাসায় অন্যকারো অধিকার। আমার অধিকারে অন্যকারো আধিপত্য। কসমরে, মরে গেলেও ক্ষমা পাবি না। তোর মতো ছলনাময়ীর জায়গা এই বুকেও আর হবে না। ‘

কথাগুলো বলে সরে আসতে নিয়েও আসল না। নিধির একদম পেছন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গা থমথমে কণ্ঠে বলল,

‘ তোর স্বামীকে যেন আমার ত্রিসীমানায়ও কখনো না দেখি। যদি ভুলেও কোনোদিন দেখিরে…জীবন বাজি রেখে বলছি, ও আর প্রাণ নিয়ে তোর কাছে ফিরবে না! যে অধিকারে ও তোর কাছে যায় আজন্মের মতো শেষ করে দিব সেই অধিকার। যে পরিচয়ে আজ তুই আমাকে খু ন করে গেলি চিরতরে খু ন হয়ে যাবে সেই পরিচয়! ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
রিচেক দিইনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে