ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
917

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৬|

জগিংয়ে বেরিয়েছিল সৌধ৷ বাড়ি ফেরার সময় আকস্মিক তার কাঙ্ক্ষিত রমণীর দেখা মিলে। নিধি এসেছে! সাতসকালে প্রাণপ্রেয়সীর মুখ দর্শন। এক নিমিষে বক্ষঃস্থল চনমনে হয়ে ওঠল। চোখ, মুখে ছড়িয়ে পড়ল ভোরের স্নিগ্ধ জ্যোতি। ঝিমিয়ে পড়া হৃদয়টুকু সহসা তরঙ্গিত হলো। সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ছোট্ট একটি লাগেজ হাতে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিধি। কানে ফোন ধরা৷ কারো সঙ্গে কথা বলছে সে৷ সৌধ ত্বরিত গতিতে এগিয়ে এলো। পলকহীন তাকিয়ে রইল ভোরের শান্ত নদীর মতো মুখটায়। সৌধর উপস্থিতি টের পেয়ে সংক্ষিপ্তে কথা শেষ করে ফোন কেটে দিল নিধি৷ দীপ্তি চোখে তাকাল সৌধর পানে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না৷ বুকটা ধড়াস করে ওঠল প্রেমময় পুরুষটার চাউনি দেখে৷ ও চোখের গভীরতা বরাবরের মতোই বুকে গিয়ে বিঁধল। প্রথম কথা বলল সৌধ নিজেই। অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ কী ব্যাপার সাতসকালে কোথায় থেকে এলি তুই? ফুলবাড়িয়া থেকে এত্ত সকালে আসা তো সম্ভব না। তাহলে এলি কীভাবে ? ‘

থতমত খেল নিধি। কিয়ৎক্ষণ বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে থাকার পর আকস্মিক চোখ পাকিয়ে, ধমকানো সুরে বলল,

‘ সাতসকালে এসে কী অপরাধ হয়ে গেল? কেমন আছি জিজ্ঞেস করলি না। বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দিলি না৷ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বসলি। ওকে ফাইন ব্রো, চলে যাচ্ছি আমি। দুপুর না হওয়া পর্যন্ত আসছি না। ‘

শক্ত হাতে লাগেজ ধরে, রাগে গজগজ করতে করতে দু’পা এগুলো নিধি৷ তৎক্ষনাৎ চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে খপ করে তার হাতটা চেপে ধরল সৌধ। এত চাওয়া, এত অপেক্ষার পর যে মানুষটা তার দ্বারে উপস্থিত হয়েছে তাকে এত সহজেই ফিরে যেতে দেবে? সব সময়ের মতোই নিধি আজো তার কথার উল্টো মানে বের করল। এই মেয়েটা একবিন্দুও বোঝে না তাকে। আর না কখনো চেষ্টা করে এক চুল পরিমাণ বোঝার। হতাশা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে৷
আহত হলো হৃদয়, ব্যথিত হলো দৃষ্টি। কিন্তু মুখে স্বভাব সুলভ দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল,

‘ ফটাফট কাজ করা বন্ধ কর৷ এতদূর থেকে এসেছিস নিশ্চয়ই শরীর ক্লান্ত? তাই মেজাজটাও দ্রুত খারাপ হয়ে গেছে৷ চল রেস্ট নিবি৷ ‘

নিধি কীভাবে এলো? ভোররাতে রওনা দিয়েছিল কিনা। এসব প্রশ্ন মাথায় এলেও মুখে আর করল না৷ বেচারি জার্নি করে ভালো মুডে নেই একদম৷ বুঝতে পেরে ভেতরে নিয়ে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠল৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিধি। সৌধর দৃঢ় চোয়াল বিশিষ্ট মুখটায় তাকিয়ে ভেঙচি কে টে বলল,

‘ যাব না ভেতরে। নিব না রেস্ট। তুই আমাকে ইনভাইট করে এনে অপমান করেছিস হুহ। ‘

তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সৌধ। অধর কামড়ে কিছু একটা ভেবেই ধরে রাখা নরম হাতটায় শক্তি প্রয়োগ করল৷ এরপর হেঁচকা টানে নিয়ে এলো একদম নিজের কাছে। টাল সামলাতে না পেরে সৌধর বুকে নাক ঠেকল নিধির। সৌধর পরনে ব্লু কালার জগিংয়ের পোশাক। আর নিধির পরনে গ্রে কালার সেলোয়ার-কামিজ। দোতলার বেলকনিতে আইয়াজ আর সৌধর কয়েকজন বন্ধু দাঁড়িয়ে। দূর থেকে তারা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি সৌধ, নিধিকে। আকস্মিক এমন একটি দৃশ্য হতেই আজিজ একছুটে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে এলো। তুলে ফেলল ফটাফট গোটা দশেক ছবি। এদিকে সৌধর হাতের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড় পেতে ছটফট করে ওঠল নিধি৷ চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ভীত কণ্ঠে বলল,

‘ সৌধ ছাড়। কেউ দেখে ফেলবে। আমি কিন্তু চ্যাঁচাব, আন্টি, আংকেলকে ডাকব। ‘

সৌধর বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে একপেশে হাসল কেবল। বুকটা তার শীতলতায় ভরে ওঠেছে৷ এই মোহিত মুখ দর্শন করে। শরীর জুড়ে পাচ্ছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। ইচ্ছে করছে, নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। ওর আদুরে নরম ঠোঁটজোড়ায় উষ্ণ চুমুতে ভরিয়ে তুলতে। কিন্তু জায়গাটা বড্ড বেমানান। রোমান্সের জন্য এই স্থান উপযুক্ত নয়৷ গেটের ওপাশে দারোয়ান চাচাও বসে। সুতরাং, এক বুক আফসোস নিয়ে ছাড়তে হবে তার আগুন পোকাকে। সহ্য করতে হবে মন এবং মস্তিষ্কের তীব্র কিলবিলানো আর জ্বলুনি।

নিধি চ্যাঁচিয়েই যাচ্ছে,

‘ কী ছাড়বি না? ওকে দাদুনিকে ডাকতে হবে নিশ্চয়ই? ‘

সৌধর দাদুনির ব্যাপারে খুব ভালো করেই অবগত সবাই। অবগত নিধিও। তাই ভয় পাওয়াতে কথাটা বলল নিধি। এ পর্যায়ে নিজের মর্জিতেই ছাড়ল সৌধ৷ কিন্তু নিধি ভাবল, দাদুনিকে ডাকতে চাওয়ায় কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তাই হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,

‘ আচ্ছা তাহলে এই ট্রিকস ফলো করতে হবে৷ ‘
.
.
নিধির আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়তেই সকলে এসে ভীড় জমালো ড্রয়িং রুমে। শুধু সুহাস, নামী, সিমরান আর স্মৃতি আপু ছাড়া। তানজিম চৌধুরী নিধির সঙ্গে কথা বলছেন। তারা দু’জন সোফায় বসে। মায়ের পাশে সৌধ দাঁড়িয়ে। পকেটে একহাত গুঁজে দিয়ে অধর কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তাকিয়ে আছে প্রেয়সীর লাজুক মুখে৷ চোখের সামনে দু’জন প্রিয় নারী বসে৷ একে অপরের সঙ্গে গল্পে মশগুল তারা। পাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখতে সুন্দর লাগছে বেশ।
বাকি সদস্যরাও কেউ বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে আইয়াজ এগিয়ে এলো। সৌধর কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ কী বন্ধু চোখের পলক ফেলবা না নাকি? ‘

সৌধ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ না ফেললে দোষ কী তাতে? ‘

‘ নাহ কোনো দোষ নাই। ‘

‘ নজর দিস না। আগামীকাল ফারাহও আসবে। আমি নিজে গিয়ে ওর দুলা ভাইকে ইনভাইট করে আসছি। ‘

সহসা হৃদয় গভীরে কেঁপে ওঠল আইয়াজের৷ কাল ফারাহ আসবে? গুণে গুণে একশ একুশ দিন পর দেখা পাবে সে হৃদয় হরণকারী প্রিয়াকে? আকস্মিক একটা ঘোরের মধ্যে বিচরণ করতে থাকল আইয়াজ। সেলফোন বের করে সময় দেখে ভাবতে লাগল ঠিক কত ঘন্টা, কত মিনিট পর ফারাহর সঙ্গে তার দেখা হতে পারে। কাজের মেয়ে নিধির জন্য কয়েক প্রকারের হালকা নাস্তা নিয়ে এলো। নিধি নিষেধ করে বলল,

‘ এ বাবা আমি এত খাবার কী করে খাব? খেয়ে এসেছি আমি। প্লিইজ আন্টি আমি কিছু খাব না। ‘

তানজিম চৌধুরী সে কথা শুনল না। টি টেবিল টেনে সামনে এনে সবগুলো খাবার সাজিয়ে রাখল। সৌধ মায়ের পাশে বসতে বসতে বলল,

‘ অল্প অল্প করে সবগুলোই মুখে দিতে হবে। ‘

তানজিম চৌধুরী মাথা নাড়ালেন। ছোট্ট তাহানী ছুটে এলো দাদুনির রুম থেকে। পেছন পেছন দাদুনি নিজেও এলো। তাহানী এসে নিধির সামনে দাঁড়িয়ে চিকন কণ্ঠে বলল,

‘ বান্ধবী এসেছ বান্ধবী? ‘

ছোট্ট তাহানীর স্পষ্ট কথায় সকলেই চমকাল, ভড়কাল। আচমকা হেসেও ফেলল। নিধি এর আগেও অসংখ্য বার ভিডিয়ো কলে তাহানীকে দেখেছে। সাক্ষাতে দেখেছে মাত্র দু’বার। তাহানীর সঙ্গে তার খুব ভাব আগে থেকেই। তাই হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিল পিচ্চিটাকে। দুই গালে চুমু দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বলল,

‘ হ্যাঁ গো তোমার বান্ধুবি এসেছে। ‘

খিলখিল করে হেসে ওঠল তাহানী৷ নিধিকে তার ভীষণ পছন্দ। তাই গলা জড়িয়ে ধরে সৌধর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ছোটো ভাইয়া তোমার বান্ধবী আমারো বান্ধবী। ‘

উপস্থিত সবাইও হেসে ওঠল। দাদুনি এলো সে সময়ই৷ নিধি খেয়াল করে তাহানীকে একপাশে বসিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সালাম দিল নম্র স্বরে। দাদুনি বিগলিত হলো এতে৷ এই মেয়েটার শিষ্টাচার দেখে আগে থেকেই মুগ্ধ সে। আজ আবারো মুগ্ধ হলো। তানজিম চৌধুরী ওঠে শাশুড়িকে বসার জায়গা করে দিল। নিধি দাদুনির সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে নাস্তা সেরে নিল৷ পুরোটা সময় জুড়েই সৌধ পাশে ছিল। তাকিয়ে ছিল নির্নিমেষ চোখে৷ যা খেয়াল করে হাসফাস লাগছিল নিধির৷ তাই গল্পের ফাঁকে হঠাৎ বলল,

‘ এই সৌধ, জগিংয়ের পোশাক পাল্টাবি না? সেই কখন থেকে বসেই আছিস। ‘

বন্ধু, আর কাজিনরা আশপাশেই ঘুরাঘুরি করছিল। তন্মধ্যে আজিজ হঠাৎ দাঁত ক্যালিয়ে এগিয়ে এলো। বন্ধুদের মধ্যে সবাই এখন জানে সৌধ নিধির প্রতি ভয়ংকর রকমের দিওয়ানা৷ তাই টিপ্পনী কে টে বলল,

‘ সৌধ তো মুডে আছে এখন। পোশাক আর পাল্টাবে কী? ‘

দাদুনি চোখের চশমা ঠিক করতে করতে আজিজের দিকে সুক্ষ্ম চোখে তাকাল। খেয়াল করে কিঞ্চিৎ ভয় পেল আজিজ। তাই ধড়ফড় করা বুক নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল আইয়াজদের কাছে। দাদুনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকাল সৌধের দিকে। বলল,

‘ দাদুভাই যাও পোশাক বদলাও। ‘

এরপর নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তুমিও যাও বিশ্রাম নেও কিছু সময়। ‘

দাদুনি ওঠে চলে গেল। কাজের মেয়ে রুবি এসে নিধির লাগেজ নিতে উদ্যত হলো। কিন্তু সৌধ বাঁধ সেধে বলল,

‘ আমিই নিতে পারব। তুই অন্য কাজ কর। আপা ওঠেছে? আপাকে ঘুম থেকে তোল গিয়ে যা। ‘

এ বাড়ির সদস্যদের সংখ্যার থেকে কাজের লোকের সংখ্যা বেশি। তাই তারা থাকতে সৌধই লাগেজ নেবে। বিষয়টা বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য। তবু সেই বিষয়টিই ঘটতে দেখল সৌধর কাজিন মহল আর বাড়ির কাজের মেয়ে, মহিলারা। সেই সঙ্গে বুঝতে পারল সৌধর জীবনে নিধি নামক সুন্দরী রমণীটির স্পেশালিটিও।

সৌধর সঙ্গে একা উপরে যেতে ভয় করছে নিধির৷ দুরুদুরু বুকে এক একটা সিঁড়ি অতিক্রম করছে সে৷ এই ছেলেটার মাঝে এখন কোনো রাখঢাক নেই। আর না আছে একবিন্দু সংযম। ঢাকা থেকে আসার পর যে ভাবে এড়িয়ে চলেছে এতে করে আরো ভয়ংকর লাগামহীন হয়ে ওঠেছে। তা প্রতিক্ষণেই টের পাচ্ছে সে৷ একা পেলে নির্ঘাত ভুলভাল কিছু করে বসবে৷ ইতিপূর্বের ঘটনা গুলো তো সে আর ভুলে যায়নি। মনে মনে একাধারে বিপদের দোয়া পড়তে শুরু করল নিধি৷ বিপদটা খুব দ্রুত কেটেও গেল যখন দোতলায় ওঠতেই সুহাসের চিন্তান্বিত মুখাবয়বের সম্মুখীন হলো।

আধঘন্টা যাবৎ সিমরানের পাশে বসেছিল সে আর নামী। বোনটা তার কান্না করতে করতে চোখ, মুখ লাল করে ফেলেছে। কোনোভাবেই কান্না বন্ধ করা যাচ্ছে না৷ কী কারণে এভাবে কাঁদছে, কী নিয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে, কোনোটারি উত্তর দেয়নি। শুধু বলছে বাড়ি চলে যাবে। সুহাস, নামী দু’জনই এত করে বোঝাল কাল বাবা, মা আসবে। আজ শুধু শুধু বাড়ি গিয়ে কী করবে? তাছাড়া বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড় ফেলে হঠাৎ বাড়িই বা কেন যাবে? কত কী জিজ্ঞেস করল, কতভাবে বোঝাল। কিন্তু মেয়েটা এক জেদে অটুট। শেষে নামীকে দিয়ে স্মৃতি আপুকে ডেকে তুলল। ঘুম থেকে ওঠে স্মৃতি আপু সিমরানের অবস্থা দেখে স্তম্ভিত। তার মস্তিষ্ক পুরোটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শেষে বাধ্য হয়ে সুহাস সৌধকে খুঁজতে শুরু করে।

সুহাসের চিন্তান্বিত মুখ দেখে সৌধ, নিধি দু’জনই প্রশ্ন করে,

‘ তোর মুখ এমন কেন সুহাস এনিথিং রং? ‘

ত্বরিত কপালের ঘাম মুছে চিন্তান্বিত মুখেই সুহাস বলল,

‘ পুরোটাই রং। ‘

আঁতকে ওঠল নিধি। বলল,

‘ কী হয়েছে! ‘

সৌধর ভ্রূদ্বয় কুঁচকে গেছে। সুহাস অসহায় ভঙ্গিতে বলল,

‘ সিনু খুব কান্নাকাটি করছে। বাড়ি চলে যাবে বলছে। কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে কী হলো? ‘

এমন কথা শুনে সৌধর ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকাল। সিমরান চলে যেতে চাচ্ছে? এটা কী করে সম্ভব! ভেবেই প্রশ্ন করল,

‘ আপা কই? ওঠেছে? ‘

‘ স্মৃতি আপুও কিছু বুঝতে পারছে নারে। ‘

এদিকে সুহাসের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে নিধি বলল,

‘ কিহ, সিমরান চলে যেতে চাচ্ছে? হাউ পসিবল ভাইই…! ‘

সুহাস নীরব৷ বোনকে নিয়ে সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেছে সে। আসলে আকস্মিক সিমরানের এত কান্না। চোখ ভর্তি এত পানি মেনে নিতে পারছে না সুহাস। তার মন বলছে, ‘ সিরিয়াস কোনো আঘাত পেয়েছে সিমরান। ‘ সিমরান তার আদরের বোন, কলিজার টুকরা। তার চোখে অশ্রুজল, কান্না কি সহ্য হয়?

সৌধ বলল,

‘ ঘাবড়াস না আমরা দেখছি, চল ও কোন রুমে? ‘

নিধিও বলল,

‘ টেনশন নিস না। আমি দেখছি বিষয়টা৷ চল ওর কাছে যাই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি। ‘

চোখের পানি মুছতে মুছতে ক্লান্ত হয়ে গেছে স্মৃতি আপু। তবু কান্না থামছে না সিমরানের। পৃথিবীর কঠিনতম ভার হচ্ছে কথার ভার৷ যা বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না৷ সিমরানের মতো অতিআদুরে, নরম মনের মেয়ের পক্ষে তো একেবারেই সম্ভব না। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ রক্তিম হয়ে ওঠেছে মেয়েটার৷ নাকের ডগা পর্যন্ত লালচে হয়ে গেছে। বেচারি কী কঠিন দুঃখ পেয়েছে কেউ জানে না৷ শুধু জানে ওকে সামলাতে না পারলে উদয়িনী আন্টির ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হবে। বিছানার একপাশে নামী আরেক পাশে স্মৃতি আপু৷ মাঝখানে ক্রন্দনরত সিমরান। একটু পর পর স্মৃতি আপু টিস্যু দিচ্ছে নামী সেটা দিয়ে সিমরানের চোখের জল মুছছে৷ এমনই সময় সেখানে উপস্থিত হলো সুহাস, সৌধ আর নিধি৷ আচমকা সৌধর মুখোমুখি হয়ে সিমরানের কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে ওঠল। দু-হাতে মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে ওঠল সে। সৌধ বাদে উপস্থিত সবাই এহেন অবস্থা দেখে হতভম্ব, বাকরুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সুহাস অসহায় চিত্তে তাকাল সৌধর পানে৷ সৌধ ইশারায় শান্ত হতে বলল। ফিসফিস করে বলল,

‘ টেনশন ফ্রি থাক, আমি আছি, নিধি আছে। আমরা সবাই আছি পিচ্চিটাকে সামলে নিতে খুব কঠিন হবে না। শুধু জানতে হবে এই কান্নার সূত্রপাত কোথায়? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৭|
মানুষের অল্প ব্যথা তীব্র হয় আপনজনের সান্নিধ্য পেলে। সিমরানেরও ঠিক তাই হলো। প্রথমে ভাই সুহাস পরে সৌধ। দু’জন পুরুষই তার ভীষণ আপন। সুহাস আপন এতে কোনো প্রশ্ন আসে না, সন্দেহও থাকে না৷ আর সৌধ তার মনের মানুষ। বাবা, ভাইয়ের পর যে পুরুষকে সে সবচেয়ে কাছের ভাবে৷ আপন দৃষ্টিতে দেখে। যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে ব্যাকুল রয় দিবানিশি। সেই মানুষটার সামনেও মনের যন্ত্রণা প্রগাঢ় হলো। কান্নার বেগ বাড়তে থাকল ত্বরিত বেগে৷ সৌধ সন্দিহান মুখে চেয়ার টেনে বসল সিমরানের সম্মুখে। তার এক পাশে সুহাস আরেক পাশে নিধি। নিধিকে দেখে ওঠে এলো স্মৃতি আপু৷ ভীতিকর কণ্ঠে নিধির কাঁধ চেপে ধরে বলল,

‘ তুমি এসেছ! দেখো না সিনুটা কেমন করছে৷ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না৷ রাতে তো সব ঠিকঠাকই ছিল। ‘

নিধি চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে মুখে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ আমি দেখছি আপু। ‘

এরপরই সিমরানের পাশে গিয়ে বসল। মাথায় হাত রেখে বলল,

‘ আমার বনুটার কী হয়েছে? তার কথায় আমি এত্ত তাড়াতাড়ি চলে এলাম। দেখে খুশি না হয়ে কান্নাকাটি করে নিজেও অস্থির হচ্ছে, সবাইকেও অস্থির করে তুলছে কেন হুম? ‘

কিঞ্চিৎ শান্ত হলেও মুখ তুলল না সিমরান৷ সকলের মস্তিষ্কই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এক রাতের ব্যবধানে কী হলো মেয়েটার বুঝে ওঠতে পারছে না কেউই৷ প্রত্যেকের মধ্যে যখন প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি নামী তখন সংশয় চিত্তে তাকায়। একবার ক্রন্দনরত ননদের মুখ আরেকবার নিধির মুখ দেখে। দু’জন নারীকেই দেখতে থাকে নিষ্পলক৷ পাশাপাশি বোঝার চেষ্টা করে সিমরান কি সৌধ আর নিধির সম্পর্কে জেনে গেল! এজন্যই কী বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছে মেয়েটা? আকস্মিক বুক ধক করে ওঠে নামীর। তার ভীতিগ্রস্ত চোখজোড়া এবার সুহাসের চিন্তিত মুখে পড়ে। সৌধ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বোঝার চেষ্টা করছিল সিমরানের ভাবগতিক। এরপর গম্ভীর কণ্ঠে হঠাৎ শুধায় ,

‘ কী হয়েছে তোর? কে কী বলেছে? ‘

নিধির স্বান্তনায় একটু কান্না থেমেছিল। সৌধর গম্ভীর এবং সন্দিহান গলা শুনে পুরোপুরি থেমে গেল সিমরান। সকলের দৃষ্টি অনড় রইল তার কান্না মিশ্রিত লালচে মুখশ্রীতে। সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে।অপেক্ষা করছে উত্তর পাবার। টের পেল সিমরান৷ বুকের ভেতর অনুভব করল গভীর এক চাপ। তবু মুখ খুলল না। সৌধ ফের প্রশ্ন করল,

‘ বলবি না? ‘

কয়েক পল শ্বাসরোধ করে রাখার পর নিঃশ্বাস ছাড়ল সিমরান৷ মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বোঝাল ‘ না ‘ সে বলবে না। সৌধর কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তাগ্রস্ত সুহাস ঠোঁট কামড়ে বিচলিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে। সকলের হতভম্ব ভাব প্রগাঢ় হলো। হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। সৌধ একটু ধমকে কথা আদায় করতে চাইল। পরোক্ষণেই মত পাল্টাল। সিমরান ধমক খেয়ে কথা শোনার মানুষ নয়। বরং এতে করে জেদ বাড়বে, কান্না বাড়বে৷ তাই কণ্ঠ নরম করে প্রশ্ন করল,

‘ কেউ কিছু বলেছে? ‘

‘ আমি বাড়ি যাব। ‘

তীব্র জেদি স্বর সিমরানের। এতক্ষণ যাবৎ তাকে জোর করে আঁটকে রেখেছে নামী আর সুহাস। এবার বুঝি আর আটকানো সম্ভব হলো না। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সে৷ চোখ বড়ো বড়ো করে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল নামী আর নিধিও। সৌধর চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল। মেয়েটাকে আজ নতুন চেনে না৷ তবে খুব কাছ থেকে দেখা আজই প্রথম। সুহাসের কাছে অবশ্য ওর রাগ, জেদ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল বেশ। সুহাস এগিয়ে এসে সিমরানের মাথার মাঝখানে ডান হাতের তালু চেপে ধরল। বাবার কাছে শিখেছে এটা৷ সিমরান অতিরিক্ত রেগে গেলেই তার বাবা এভাবে মাথায় হাত রেখে শান্ত হতে বলে। সেও বলল,

‘ কুল সিনু। সিনক্রিয়েট করিস না তোর সমস্যা টা বল আমাকে। ‘

সিমরান বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে। অতিরিক্ত রাগ আর কান্নায় ফুঁসছে মেয়েটা। এমন পরিস্থিতিতে সহসা স্মৃতি আপু চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ এই সৌধ কাল ঘুমানোর আগে সিপনকে দিয়ে দাদুনি সিনুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ও ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোনোভাবে দাদুনি কিছু বলেনি তো? ‘

ফোঁস ফোঁস থেমে গেল সিমরানের। স্তব্ধ মুখে অনড় রইল সে৷ সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল সিমরানের দিকে। সৌধ যেন বুঝে ফেলল অনেক কিছুই৷ বসা থেকে সাবলীল ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়াল সে। সিমরানের মুখোমুখি হয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ দাদুনি বকেছে? ‘

আবারো দু’ফোঁটা অশ্রু গড়াল সিমরানের চোখ বেয়ে। নিধি তাকাল সৌধর দিকে। ইশারায় বলল সবাইকে নিয়ে বাইরে যা। কথানুযায়ী সবাই বেরিয়ে গেলে শুধু সুহাস, সৌধ আর সিমরান রইল রুমে। সিমরান তীব্র অস্বস্তি নিয়ে সুহাসের দিকে কঠিন চোখে তাকাল। সুহাস করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ প্লিজ বোন রাগ করিস না৷ তুই চলে গেলে আন্টি, আংকেলের সামনে বিব্রত হবো। বাড়িতে মাও অশান্তি করবে খুব। বলবে, আমি শুধু বউয়েরই কেয়ার করি, বোনের কেয়ার একটুও করি না। ‘

‘ চুপ থাক। ‘

সৌধ থামিয়ে দিল সুহাসকে৷ পুনরায় চেয়ারে বসে সিমরানকে বলল বসতে। সিমরান বসল না। সুহাস জোর করে ওকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসল। সৌধ বলল,

‘ আ’ম সিয়র দাদুনিই কিছু বলেছে কী বলেছে সবাইকে বলতে না পারলেও আমাদের দু’জনকে বলতে হবে। এরপর আমি নিজ দায়িত্বে তোকে বাড়ি দিয়ে আসব। আমি যখন দায়িত্ব সহকারে নিয়ে এসেছি। আমিই দিয়ে আসব। ‘

অনেক জোরাজুরির পর মুখ খুলল সিমরান৷ কাঁদতে কাঁদতে গতরাতে দাদুনির বলা সব কথা খুলে বলল। এরপর সুহাসের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপাতে শুরু করল একনাগাড়ে। সুহাস সৌধর দিকে থমথমে মুখে তাকাল। দাদুনির কথাগুলো ওরও গায়ে লেগেছে খুব। তার বোন এ বাড়ির মেহমান হয়ে এসেছে। দোষ থাকুক, ত্রুটু থাকুক মুখের ওপর এভাবে অপমান করতে পারে না দাদুনি। তাছাড়া তাদের জীবনের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে পরিবার। তারা পরিবার পায়নি৷ তাদের বাবা, মায়ের মধ্যে বনিবনা নেই৷ এগুলো নিয়ে তারা দু’ভাইবোন কথাটা হতাশায় ভোগে, কত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ছোটোবেলা বড়ো হয়েছে। এসব কি দাদুনি জানে? তার বোনের বয়স একুশ বলেই সে আর পাঁচ জনের মতো পরিপক্ব মস্তিষ্কের হয়ে ওঠেনি৷ সে স্বাভাবিক পরিবার পায়নি৷ পায়নি বাবা, মায়ের পরিপূর্ণ যত্ন, ভালোবাসা। এগুলো কি দাদুনি কখনো বুঝবে? যা বুঝবে না যা অনুভব করতে পারবে না। তা নিয়ে এত বড়ো বড়ো কথা কীসের? এই পৃথিবীতে যার যার অবস্থান সে সেই বুঝে। এর আগেও সিমরানকে ন্যাকা, অভদ্র বলতে শুনেছে। তার বোন যেমনি থাকুক তার কাছে সেরা৷ প্রচণ্ড আদুরে৷ তাই বোনকে নিয়ে অন্যের কুরুচিপূর্ণ কথা মেনে নেয়া বা সহ্য করা সম্ভব না, তার পক্ষে। সুহাসের কান দু’টো লাল টকটক করছে। লালচে হয়ে ওঠেছে নাকের ডগাও৷ সুহাসকে খুব ভালো মতোন চেনে সৌধ। সবটা শুনে তারও মেজাজ খিঁচে গেছে। দাদুনিকে পরে বুঝে নেয়া যাবে। আপাতত সিমরানকে সামলাতে হবে। গতরাতের তিক্ত অনুভূতি ভুলিয়ে দিতে হবে। নয়তো সিমরান চলে যাবে। আর সিমরান চলে গেলে সুহাসকে আঁটকে রাখা কঠিন হবে। তাছাড়া বন্ধুর বোনের অসম্মান মানে বন্ধুর অসম্মান। আর বন্ধুর অসম্মান মানে তার অসম্মান।
.
.
সৌধ সেই পুরুষ যার সম্মোহনী শক্তিতে সিমরান সকল বশ মানতে রাজি। সিমরানকে করা দাদুনির অপমান ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সৌধ৷ খুব সুন্দর করে মেয়েটাকে বুঝিয়েছে সে। সেই সঙ্গে দাদুনির বলা কিছু কথা যেগুলো সত্যি শিক্ষনীয় ছিল সেগুলো চমৎকার বাচনভঙ্গি দিয়েও বুঝিয়েছে। বুঝতে পেরেছে সিমরান। মেনে চলছে সর্বাত্মক চেষ্টায়। স্মৃতি আপুর গায়ে হলুদ চলছে। বাড়ির সকল মেয়েরা স্মৃতি আপুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হলুদ রঙের শাড়ি পরিধান করেছে। শাড়ি পরেছে নামী নিজেও। ছোট্ট তাহানীও বাদ যায়নি। বাচ্চা শাড়ি কিনে দেয়া হয়েছে তাকে৷ সেটা পরে ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক দিয়ে স্মৃতি আপুর পাশে বসে আছে চুপচাপ। সবাই শাড়ি পরলেও নিধি আর সিমরান পরেনি৷ তারা দু’জন হলুদ আর সবুজ মিশেলে সারারা পরেছে। নিধি এসেছে থেকেই ছোঁকছোঁক করছিল সৌধ। ঠিক যেমন সুহাস সারাক্ষণ নামীর পিছনে ছোঁকছোঁক করতে থাকে। বিষয়টা আইয়াজ খেয়াল করে সৌধকে বলল,

‘ কীরে মনে হচ্ছে নিধি ইলিশ মাছ আর তুই বিড়াল এমন ভাবে ছোঁকছোঁক করছিস। ‘

সৌধ থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। পাল্টা উত্তর দিয়ে দেয়,

‘ কাল তোর বোয়াল মাছ আসতেছে মনে আছে? পিছন লাগবি না একদম। বরং সুযোগ করে দে। কাল তাহলে বোনাস পাবি। ‘

চোখ দু’টো চকচক করে ওঠে আইয়াজের৷ গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ যখন মিসড কল দিব ছাদে চলে যাবি। আমি নিধিকে পাঠাচ্ছি। ‘
.
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ প্রায়৷ স্মৃতি আপু গোসলে যাবে। সিমরান অনেকক্ষণ ধরেই সৌধকে অনুসরণ করছিল। মনটা অত্যাধিক চঞ্চল হয়ে ওঠেছে তার৷ আজ মনের কথা না বললে মরণি হবে বোধহয়। যে মানুষটা তাকে এত সুন্দর করে ভালো, মন্দ বোঝায়, যে মানুষটা তার চোখের পানি শুষে নিতে নিগূঢ় চেষ্টা করে, যে মানুষটা তার চলে যাওয়া আঁটকে দেয় এক নিমেষে। সে মানুষটাকে মন কথন জানাতে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। না পারে সর্ব সম্মুখে চিৎকার করে বলে দেয়,

‘ আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সৌধ ভাই। আমি তোমার বউ হতে চাই চৌধুরী সাহেব। ‘

মনটা খলখল করে ওঠে সিমরানের। সৌধকে অনুসরণ করতে করতে সিঁড়ির কাছে চলে আসে৷ এত রাতে সৌধ ভাই ছাদে যাচ্ছে কেন? মনের ভেতর প্রশ্ন উঁকি দেয়৷ ভাবে, ভালোই হলো, নিভৃতে মনের কথা বলতে পারবে৷ কিন্তু পিছু যেতে যেতে আকস্মিক থেমে যায় বৈদ্যুতিক আলোয় নিধিকে দেখে। সৌধ ছাদের দরজা একটু চাপিয়ে চলে যায় নিধির কাছে। সিমরানের বুকটা ধক করে ওঠে অজানা সন্দেহে। গলা শুঁকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে যায়৷ দরজার ফাঁকে একটু করে উঁকি দিয়ে দেখে, সৌধ গিয়ে নিধির পাশে দাঁড়াল। তাদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা গেল না অস্পষ্ট। কিন্তু দেখতে পেল সবই শুনতে পেল অল্পস্বল্প। যা থেকেই পুরোপুরি বুঝে গেল তার মনের মানুষটির মনের মানুষ সে নয় অন্য কেউ!

আইয়াজের অনুরোধে এসেছিল নিধি। তারও ইচ্ছে ছিল সৌধর সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার। যেগুলো এখন না বললেই নয়৷ কারণ এ বাড়িতে আসার পর স্মৃতি আপু আড়ালে ডেকে বলেছে, স্মৃতি আপুর বিয়ের পরই সৌধ সুজা আংকেলকে মনের কথা জানাবে। এরপরই তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব যাবে চৌধুরী বাড়ি থেকে। তাই সৌধ ছাদে আসা মাত্র দেরি করল না নিধি। ভালো, মন্দ কথা দূরে থাক চট করে বলে ফেলল,

‘ সৌধ তুই আর আমি শুধু বন্ধু। আমরা সারাজীবন একে অপরের বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। তুই প্লিজ বিয়ের সিদ্ধান্ত বদলে ফেল। আংকেল, আন্টিকে কিচ্ছু বলবি না। স্মৃতি আপুকেও বলবি আমার প্রতি তোর উইকনেস কেটে গেছে। আমরা শুধুই বন্ধু। তোর তরফে যা ছিল নিছক আবেগ মাত্র। ‘

নিধির কথাগুলো অহেতুক ঠেকল সৌধর। এতদিন পর কাছাকাছি তারা। কোথায় ভালো, মন্দ দু’টি কথা বলবে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকবে দীর্ঘ সময়। কয়েকটা চুমুর বর্ষণ নামাবে তা না৷ আবারো সেই আবোলতাবোল বকা শুরু করেছে৷ বাঁকা হাসল সৌধ। আচমকা বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল নিধিকে। একহাতে কোমর পেঁচিয়ে অন্যহাতে নিধির মুখে পড়া সিলকি চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। বলল,

‘ বকবকানি থামাবি? কত মিস করেছি জানিস? ‘

প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে আকুল স্বরে কথাটা বলল সৌধ। নিধির বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠল৷ সৌধর বাঁধন থেকে ছাড় পেতে মরিয়া হয়ে ওঠল সে। কিন্তু সৌধ কি ছাড়ার বান্দা? সে আরো ঘনিষ্ঠ হলো। নিধির কপালে কপাল ঠেকিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ সব সময় ছটফট করিস কেন? এমন করলে ভালোবাসা দিব কীভাবে? ‘

‘ প্লিজ সৌধ এমন করিস না প্লিজ। আমার কথা শোন তোর সাথে আমার কথা আছে। খুব জরুরি। ‘

ত্বরিত স্বরে কথাগুলো বলতেই সৌধ ওর কপালে গাঢ় করে চুমু খেল। বলল,

‘ সব শুনব। তার আগে আমাকে শান্ত কর। দেখ বুকের ভেতর কেমন খাঁখাঁ করছে। আর কত জ্বালাবি এখানটায়? একটু তো ঠাণ্ডা কর। ‘

বুকে ইশারা করে কথাগুলো বলেই একহাত নিধির গালে রাখল। চোখ, মুখ খিঁচে রইল নিধি। শরীরের জোর প্রয়োগ করল ছাড়া পাওয়ার৷ কিন্তু সৌধ সেসব তোয়াক্কা করল না৷ সে তার প্রেয়সীকে আদর করতে ব্যস্ত৷ একনাগাড়ে কয়েকটা উত্তপ্ত চুমু পড়ল গাল জুড়ে। আকস্মিক চোখ খুলল নিধি৷ মুখটা শক্ত পাথর হয়ে গেছে তার। শরীর জুড়ে যেন দাউদাউ করে আগুন জলে ওঠেছে। সৌধ তার মতোই ব্যস্ত।

‘ খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব নিধি। তুই আর আমাকে দূর দূর করতে পারবি না দেখিস৷ খুব তাড়াতাড়ি এই সৌধর বুকে মুখ লুকোনোর ব্যবস্থা করব৷ খুব তাড়াতাড়ি তোকে সম্পূর্ণ আমার করে নেব আমি। ‘

ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে মাতাল কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে নিধির নাকে নাক ঠেকাল। এরপর উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল নিধির নরম অধরে। মুহুর্তে ক্রোধে ফুঁসে ওঠল নিধি। আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না নিজেকে। তার নরম হাতের শক্ত থাপ্পড় বসিয়ে দিল প্রিয় বন্ধু, সৌধর গালে। এতক্ষণ আড়ালে স্তব্ধ হয়ে থাকলেও শেষ দৃশ্য দেখে দু-হাত মুখে চেপে ডুকরে ওঠল সিমরান। আর সৌধ আকস্মিক নিধির রণমুর্তি দেখে বাক শক্তি খুইয়ে রইল কয়েক মিনিট। যখন তার ঘোর কাটল তখন হাতটা আপনাআপনি ডান গালে চলে গেল। জীবনে প্রথমবার কেউ তার গায়ে হাত তুলল! আর এই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটাল সে যাকে ভালোবাসে, তার হৃদয়ের নারী। চোয়াল দ্বয় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো সৌধর। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকাল নিধির ক্রোধান্বিত মুখশ্রীতে। ধীরেধীরে তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণে পরিণত হতে থাকল।
আর নিধি ওড়নায় মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে প্রস্থান করল ছাদ থেকে। সিমরান একই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। নিধি কি ওকে দেখতে পেল?

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৮|
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভূতি জন্মায় ভুল মানুষকে কেন্দ্র করে। প্রেম কখনো ভুল হয় না, ভুল হয় না কাউকে ঘিরে হৃদয়ের তীব্র অনুভূতিতেও। ভুল হয় আসলে মানুষটা৷ তাই তো তীব্র আবেগ, দৃঢ় ভালোবাসাও ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়।

কাল বিয়ে। সবাই ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কনে আজ ভীষণ ব্যস্ত। সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতায় মাথা ধরেছে৷ বিছানায় হাত, পা মেলে শুয়ে পড়েছে সে৷
তাকে ঘিরে আছে কাজিন মহল। দাদুনি চুলে বিলি কে টে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। শারীরিক দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, আশপাশ জুড়ে গিজগিজে মানুষ সিমরানের কথা বেমালুম ভুলিয়ে দিয়েছে স্মৃতি আপুকে। সৌধর মেয়ে বান্ধবীদের জন্য রুম গোছগাছ করা আছে। প্রাচী, আইয়াজ গেছে সুহাস, নামীর জন্য বরাদ্দ করা ঘরে৷ গল্প করছে তারা। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছে সৌধ নিধির ফিরে আসার৷ তারা দিব্যি জানে সৌধ, নিধি এখন নির্জন নিশীথে সময় কাটাচ্ছে। প্রাচী নিধির জন্য বরাদ্দ করা ঘরটা ফাঁকা ছিল। সিমরানেরও একটু ফাঁকা স্থানের দরকার ছিল। তাই ওই ঘরটায় ঢুকে পড়ল। বুকের বা’পাশটায় চিনচিন করছে তার। হাত, পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা। ঘরে ঢোকার পর তড়িঘড়ি করে দরজা আঁটকে দিল৷ অনুভব করল
নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব৷ শ্বাসরুদ্ধকর এই অনুভূতি থেকে মুক্তির আশায় শরীর ছেড়ে দিল মেয়েটা। আচমকা বসে পড়ল ফ্লোরে। থেকে থেকে দেহ কেঁপে ওঠল৷ বুকের বা’পাশের ব্যথাটা গাঢ় হচ্ছে ক্রমাগত টের পেয়ে
একহাতে চেপে ধরল ওখানটায়। অন্যহাতের তালু চেপে ধরল মুখে। কিয়ৎক্ষণ শব্দহীন বসে থাকার পর আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। সৌধ তার কিশোরী বয়সের আবেগ। যুবতী বয়সের তীব্র অনুভূতি। এত বছর ধরে চেনে মানুষটিকে। অথচ একবারো টের পায়নি তার ভেতরে অন্য নারীর বাস। সেই নারীটি আর কেউ নয়, তার ভাই এবং সৌধর বেস্ট ফ্রেন্ড নিধি আপু! কান্নার দমকে থরথর করে কাঁপতে থাকল সিমরান। এ দহন কীভাবে সহ্য করবে সে? ও দৃশ্য কীভাবে ভুলবে? কীভাবেই বা মেনে নেবে সৌধর জীবনে নিধি আপুকে?

বাথরুমে ঢুকে চোখে, মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছিল নিধি৷ হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দ পায়। এরপরই কারো চাপা কান্নার আওয়াজ। বুক ধক করে ওঠে নিমিষেই! কে কাঁদছে এভাবে? এমন যন্ত্রণাময় কান্না কার? তীব্র কৌতূহল নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে নিধি৷ অমনি দু-চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় তার। সিমরান কাঁদছে! মুহুর্তেই শক্ত হয়ে যায় নিধি। সৌধর সঙ্গে রাগারাগি করে যখন ছাদ থেকে নেমে এলো তখন আবছা আলোয় সিমরানকে দেখতে পেয়েছিল সে৷ কিন্তু অতিরিক্ত রাগান্বিত থাকায় থামেনি। ইচ্ছে করেনি সিমরানকে প্রশ্ন করতে, সে এখানে কেন? কোনোভাবে কি তাকে আর সৌধকে ফলো করছিল? না প্রশ্ন করেছে আর না বুঝতে দিয়েছে সে সিমরানকে দেখেছে। কিন্তু সিমরান যে তার আর সৌধর মধ্যেকার সমস্ত ঘটনা দেখেছে তা নিখুঁতভাবেই টের পেল এই মুহুর্তের এই দৃশ্য দেখে। তবে কি সিমরান কোনোভাবে সৌধর প্রতি উইক?
মাথাটা ঝিমঝিমিয়ে ওঠল নিধির। আকস্মিক চোখ দু’টো বন্ধ করে নিল। ভাবতে শুরু করল গভীর কিছু ভাবনা৷ নিধি চমৎকার বুদ্ধিমতী এবং জ্ঞানী নারী৷ তাই খুব বেশি ভাবতে হলো না। যা বোঝার বুঝে ফেলল এক নিমিষে। ঠোঁটদ্বয়ে হাসি ফুটল তার৷ শুধু বুকের খুব গভীরে সুক্ষ্ম এক ব্যথার আঁচ পেল। যাকে পাত্তা দিল না খুব একটা। বিড়বিড় করে বলে,

‘ আমি যা ভাবছি তাই যেন সত্যি হয় খোদা। ‘

কথাটা বলেই ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সিমরানের কাছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে আদর মিশিয়ে ডাকল,

‘ সিনুমনি ? ‘

হাঁটু নাড়িয়ে কেঁপে ওঠল সিমরান। আকস্মিক ভীতিকর কিছু দেখেছে এমন ভঙ্গিমায় তাকিয়ে রইল পলকহীন। নিধি ঈষৎ হেসে ধীরে ধীরে ওর সামনে বসল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ওর অশ্রুসিক্ত গাল। বলল,

‘ কী হয়েছে আমার বনুটার? এত কষ্ট পাচ্ছে কেন হুম? ‘

চোখ দু’টি করুণ করে তাকিয়ে সিমরান। নিধির ভীষণ মায়া হলো। দু’হাতে ওর গালের নোনাপানির ধারা মুছে দিতে দিতে বলল,

‘ আমাদের ওভাবে দেখে কষ্ট পাচ্ছিস? তুই জানতি না অনেক বছর ধরেই সৌধ আমার প্রতি উইক? ‘

সিমরানের বুকের ভেতর সুঁচ ফুটল যেন। সে জানত না, সত্যি জানত না। জানলে আজ এভাবে আঘাত পেত না৷ হাত, পা থরথর করে কেঁপে ওঠল ওর৷ নিধির সুক্ষ্ম নজর এড়াল না সিমরানের কাঁপাকাঁপি। নিধি ওর মাথায় হাত বুলালো। আদর করল কিছুক্ষণ পুনরায় বলল,

‘ সৌধকে ভালোবাসিস? ‘

চোখ দুটো বন্ধ করে হুহু করে কেঁদে ফেলল সিমরান৷ ওর কান্না দেখে নিধির চোখ দু’টোও টলমল করছে। সে আবারো প্রশ্ন করল,

‘ ভালোবাসিস ওকে? ‘

যে প্রশ্নের উত্তর অনায়াসে দিয়ে দিতে পারত সিমরান। সে প্রশ্নের উত্তর আজ একেবারেই দিতে পারল না। সৌধকে সে ভালোবাসে কিনা এই উত্তর দেয়ার আগে হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। চোখের পাতায় ফুটে ওঠল ছাদের সেই দৃশ্য। সৌধ ভাই নিধিকে ভালোবাসে। ব্যস, আর কী থাকে বলার? ঐ মানুষটার দৃঢ়তা সম্পর্কে কারোরি অজানা নয়৷ আজ যদি সে মরেও যায় সৌধর অনুভূতি, সিদ্ধান্ত কোনোটাকেই টলানো যাবে না। সে হয়তো আর পাঁচ জনের মতো ম্যাচিওর নয়৷ তাই বলে ভালোবাসার যে অনুভূতি বুকের ভেতর পুষে রেখেছে সে অনুভূতির প্রগাঢ়তা নিয়ে কোনো অবুঝতা নেই৷ সে সৌধকে ভালোবাসে বলেই জীবনে দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেনি৷ দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে কাছ ঘেঁষতে দেয়নি। সে যে অনুভূতিতে সৌধ ভাইকে ভালোবাসে। সৌধ ভাইও নিশ্চয়ই একই অনুভূতিকে নিধি আপুকে ভালোবাসে? বুকটা হুহু করে কাঁদতে লাগল তার। কান্না মিশ্রিত অসহায় চোখ দু’টি স্থির করল নিধির ভেজা মুখে। বুকে পাথর চাপল যেন নিধির মুখটা দেখে। মন বার বার ডুকরে ওঠল একটা কথাই বলে,

‘ তুমি কত ভাগ্যবতী নিধি আপু, তুমি কত ভাগ্যবতী!’

সহসা কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিধি প্রশ্ন করল,

‘ কীরে ভালোবাসিস সৌধকে? ‘

অসহায় ভঙ্গিতে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না বোঝাল সিমরান৷ নিধি বিশ্বাস করল না। তাই কড়া গলায় বলল,

‘ তাহলে কাঁদছিস কেন? ‘

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে সিমরান বলল,

‘ তুমি সৌধ ভাইকে কেন মারলে নিধি আপু? ভাইয়া তো তোমাকে ভালোবাসে। ‘

বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় নিধি! সন্দিহান চিত্তে ভাবে সিমরান এজন্য কাঁদছে? তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল? তৎক্ষনাৎ ক্ষীণ কণ্ঠে শুধায়,

‘ এজন্য কাঁদছিস? পিছু নিয়েছিলি কেন আমাদের? ‘

‘ সৌধ ভাই ছাদে যাচ্ছে দেখে ভাবলাম ভাইয়া, নামী আপু, তোমরা সবাই আছ৷ গল্প, আড্ডা হবে এসব ভেবেই পিছু নিয়েছিলাম। ‘

হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল সিমরান৷ নিধি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কেমন ডাহা মিথ্যা বলল তাকে। আর কত অবাক করবে সুহাসের আহ্লাদী বোনটা? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বলল,

‘ শোন এই পৃথিবীতে ছিয়ানব্বই পার্সেন্ট মানুষের প্রথম প্রেম হয় ভুল মানুষের প্রতি। আর চার পার্সেন্ট হয় সঠিক মানুষের প্রতি। সৌধ হচ্ছে ছিয়ানব্বই পার্সেন্টের মধ্যে একজন৷ আর তুই হলি চার পার্সেন্টের মধ্যে একজন। ‘

নিধির কথার মর্মার্থ এই মুহুর্তে বোঝা সম্ভব না সিমরানের। সে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে রইল। নিধি বুঝল মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ডুকরে ম রছে। তাই আরো কাছাকাছি বসে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। পিঠে হাত বুলিয়ে নিচু গলায় বলল,

‘ সৌধকে ভালোবাসিস বোন? ‘

সিমরান চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল,

‘ না আপু। সৌধ ভাই তোমাকে ভালোবাসে। ‘

‘ কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি না সিনু। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। এমন একজন পুরুষের ভালোবাসা কোনো মেয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? মুখে বলল,

‘ সৌধ ভাইকে ভলো না বেসে থাকতে পারবে না আপু৷ দেখে নিও। ‘

‘ আর সম্ভব নয়। ‘

সহসা ওঠে দাঁড়াল নিধি। বলল,

‘ যদি তুই সৌধকে ভালোবাসিস বিনা দ্বিধায় বলতে পারিস। আর যদি না বাসিস তাহলে আমার বোঝার ভুল, চোখের ভুল দুঃখিত। ‘

কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হয় নিধি। সিমরান ত্বরিত তার দু’পা আঁকড়ে ধরে। বলে,

‘ আমি সৌধ ভাইকে ভালোবাসি না আপু। তুমি প্লিইজ সৌধ ভাইকে ফিরিয়ে দিও না। ‘

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলল সিমরান। নিধি হতভম্ভ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তার বুঝতে বাকি রইল না এই বাচ্চা মেয়েটা ভয়াবহ ভাবে সৌধতে আসক্ত। খাঁটি ভালোবাসার নিদারুণ উদাহরণ। সুহাসের ইমম্যাচিওর, রগচটা, জেদি, খামখেয়ালি বোনটা কবে এত বড়ো হয়ে গেল? কবেই বা বুকের ভেতর তার সৌধর জন্য এতখানি ভালোবাসার জন্ম দিল? আঁতকে ওঠল নিধি। একহাতে মুখ চেপে ধরে মনে মনে বলল,

‘ ছিঃ ছিঃ আমার সৌধ কেন হবে? আজ থেকে সৌধ তো শুধুই সিমরানের। ‘
.
.
গতরাতে সৌধ একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে আর নিধির কাছে ভালোবাসার আবেদন রাখবে না। আর না তার প্রণয় আহ্বানে সাড়া দিতে অনুরোধ করবে। অনেক হয়েছে ভদ্রভাবে, নরম সুরে ভালোবাসার ডাক। অনেক হয়েছে সোজা আঙুলে ঘি তোলার প্রচেষ্টা। এবার আঙুল বাঁকাবে। বাঁকাতেই হবে। সরাসরি নিধির পরিবারের সামনে দাঁড়াবে সে। হয় শান্তশিষ্ট ভাবে তার মনের মানুষকে চেয়ে নেবে নয়তো তীব্র অশান্ত রূপে ছিনিয়ে আনবে। সৌধর এই মনোবাসনাকে শুধু কঠিন সিদ্ধান্ত বললে ভুল হবে। এটা সৌধ চৌধুরীর এক কঠিন জেদও বলা যায়। যে জেদ নিধিকে তার বউ করেই ছাড়বে।
.
.
বিয়ে বাড়িতে সকল অতিথি উপস্থিত হয়েছে। বাকি শুধু সৌধর মেডিকেল কলেজের কয়েকজন টিচার্স। তার মধ্যে রয়েছে অর্পণ স্যারও। অর্পণ স্যারের অপেক্ষাতেই ছিল সকলে৷ স্যার এলে সৌধ, সুহাস, নিধি, নামী, আইয়াজ, ফারাহ এবং সিমরান। সকলে একসঙ্গেই খেতে বসল। গতরাতের পর থেকে সৌধ নিধির সঙ্গে কথা বলেনি। চোখ তুলে একবারটি যে তাকাবে তাও তাকায়নি৷ নিধি অবশ্য কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। ছেলেটা মারাত্মক জেদি। নিজের জেদে অটল রয় সব সময়। তাই কথা বলেনি। রাত থেকে সিমরানও বেশ স্বাভাবিক। নিধির পাশেই বসেছে সে। খাওয়ার ফাঁকে বারবার অর্পণ স্যারের দিকে তাকাচ্ছে সিমরান। অভিভূত হয়ে দেখছে শ্যামবর্ণীয় ত্বকের বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী অর্পণ স্যারকে। গতরাতে সে নিধির সঙ্গে শুয়ে ছিল। অনেক গল্প করেছে দু’জন। সে গল্পের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল অর্পণ স্যার৷ সেই গল্পের সঙ্গে আজ সামনাসামনি দর্শনে পুরোপুরি মিলে গেল অর্পণ স্যার। সিমরানের মুগ্ধতাও বিস্তৃত হতে শুরু করল। মনে মনে বলল,

‘ইশ, কী সুন্দর! ‘

খাওয়াদাওয়া শেষে কনে বিদায়ের পালা চলে আসে। পরিবারের সকলের মুখে নামে মেঘের ঘনঘটা। স্মৃতি আপু তার বড়ো ভাই সুনীল চৌধুরী আর ছোটো ভাই সৌধকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে সৌধর চোখ দুটিও। বোন বিদায় এত্ত যন্ত্রণাদায়ক হয় বুঝতে পারেনি সে। কলিজাটা ছিঁ ড়ে যাচ্ছে যেন উফফ। সুজা চৌধুরী আর তানজিম চৌধুরী এলেন সেই মুহুর্তে। ছেলেমেয়ে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনই। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী হলো পরিবার, পরিজন আর অতিথিবৃন্দরা।

একদিকে স্মৃতি আপুর বিদায় পর্ব চলছে। অন্যদিকে নিধির ফোনে সমানতালে কল করে যাচ্ছে অর্পণ স্যার। নিধি সবার থেকে কৌশলে নিজেকে আড়াল করে অর্পণ স্যারের বলা জায়গাটায় চলে এলো দ্রুত। সৌধদের বাড়ির পিছন সাইট এটা। যার একপাশে ছোট্ট একটি পুকুর আর একপাশে টিন দিয়ে নির্মিত একটি স্টোর রুম। খেয়েদেয়ে হাঁটাহাঁটি করতে করতে ঠান্ডা আবহাওয়া খুঁজে পায় বাড়ির পেছন দিকে। আর তখনি নজর পড়ে দরজা খোলা স্টোর রুমটায়। এদিকে একেবারেই নির্জন। মানুষ জন নেই। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল অর্পণ স্যারের। পারপেল কালার চাকচিক্যময় শাড়ি পরিহিত রমণীরত্নটি আসা মাত্রই হেঁচকা টানে নিয়ে চলে গেল ঘরের ভেতর। নিধি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই অর্পণ স্যার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট চেপে ধরল। ভারিক্কি কণ্ঠে বলল,

‘ কত মিস করছিলাম জানো? ‘

চোখ দু’টি বুজে এলো নিধির। ঠোঁটে লাজুক হাসি আর বুকে তার ধুকপুকানি। অর্পণ স্যার যেন বড্ড বেপরোয়া এখন। তার মুখ, হাত বড্ড লাগাম ছাড়া। প্রথমে সায় দিল নিধি। যখন বুঝল অপর মানুষটা হুঁশে নেই তখন বাঁধা দিয়ে বলল,

‘ কী করছেন কী? পাগল হলেন নাকি! আমরা কোথায় হুঁশ আছে? ‘

‘ পাগল তো সেদিনই করেছ ডার্লিং, হুঁশ তো সেদিনই হারিয়েছি আমি যেদিন তিন…’

আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না অর্পণ স্যার। তিন জোড়া হাত বাঘের মতো থাবা দিয়ে তার থেকে ছিনিয়ে নিল নিধিকে। সেই তিন জোড়া হাতের মালিক আর কেউ নয় , সৌধ, সুহাস আর আইয়াজ!

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে