#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৩|
ইদের ছুটি কাটাতে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছে। গতরাত দেড়টার দিকে সুহাস এসেছে নামীর কাছে। এই নিয়ে প্রচণ্ড রাগারাগি করেছে নামী। দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে প্রায় দু’ঘন্টা। সিমরানের থেকে খবর পেয়েছে সুহাস বাড়ি এসেছে বিকেলের দিকে। এরপর দু’ঘন্টা সময় বোন এবং মাকে দিয়েছে। উদয়িনীর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে, মতের অমিলও অনেক। চাপা অভিমান আকাশছোঁয়া। তবু মায়ের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। সুহাস এখন পুরোপুরি নামীতে মত্ত৷ বুঝতে পারে উদয়িনী। কিন্তু আগের মতো ঘাটে না আর৷ তার মনে তীব্র ভয় আছে৷ ছেলেমেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। বুঝ, শক্তি প্রখর হচ্ছে। প্ররোচিত করার চেষ্টা পূর্বে বহুবার করলেও এখন আর করে না৷ পাছে নিজের কুকর্ম প্রকাশ পেয়ে যায় এই ভয়ে। শতহোক পৃথিবীর কোনো মা নিজের প্রতি গর্ভজাত সন্তানের ঘৃণা দেখতে চায় না৷ চায় না উদয়িনীও। তাই বলে নামীকেও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি৷ কখনো পারবে কিনা তাও জানে না। নামী সম্পর্কিত কোনো কথাই সুহাসের কাছে জানতে চায় না সে। আর না সুহাস বউ সম্পর্কে মাকে কিছু জানায়৷ মাঝেমাঝে অবশ্য সিমরানকে টিটকিরি দিয়ে অনেক প্রশ্নই করে। সিমরানও কম নয়। তার মা যদি বুনো ওল হয় সে যেন বাঘা তেঁতুল। ঠিক এমনই করে জবাব দিয়ে দেয়। বাড়িতে সময় দিয়ে ক্লিনিকে গিয়ে বাবার সাথেও দেখা করে আসে সুহাস। এরপর বেরোয় বন্ধুদের সঙ্গে বাইক নিয়ে। সেখান থেকেই নামীর কাছে ফিরতে রাত বাজে দেড়টা। সুহাস আসবে বলে কয়েক পদের রান্না করেছিল নামী। সেগুলো আর কারোরি খাওয়া হয় না। ঝগড়া করতে করতে এক পর্যায়ে রেগে বাসা ছাড়তে উদ্যত হয় সুহাস। নামী তখন আর কিছুই বলতে পারে না। এই ছেলেটা তার অনুভূতিই বুঝে না৷ তীব্র অভিমান বুকে চেপে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে চুপচাপ। রাগি বউয়ের আকস্মিক নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ায় সুহাসও দমে যায়। বাসা ছাড়তে পারে না আর। রুমে গিয়ে বউয়ের মান ভাঙাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে৷ শেষ রাত কাটে বউয়ের মান ভাঙিয়ে, আদর দিয়ে, ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখে।
রাতটা নিদ্রাহীন কাটিয়ে সকালবেলা সুহাস গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। নামী আর ঘুমায়নি। শাওয়ার নিয়ে এসে ভেজা চুল আঁচড়ে চুপচাপ বসে আছে সুহাসের পাশে৷ তাকিয়ে দেখছে উবু হয়ে ঘুমানো বরটাকে।
গত কয়েক বছরে সবকিছুর পরিবর্তনের সঙ্গে সুহাসের শারীরিক পরিবর্তনও চোখে লাগার মতো। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের ফলে সে যে পেশিবহুল শরীরটা তৈরি করেছে। এর পিছনে একমাত্র অবদান নামীরই। সেদিনের সেই অপমান কতখানি মনে গেঁথেছিল তা আজ ওর শরীরের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। শুধু কি তাই? অসভ্য ছেলেটা ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না। নিজের পেশিবহুল উন্মুক্ত বক্ষঃতলে পিষতে পিষতে ফিসফিস করে শুধায়,
‘ তোমার সেই ফকফকা চেঙ্গিস খান এখন লোমশে আবৃত বলিষ্ঠ বুকের নিচে তোমাকে পিষতে পারে। এ মুহুর্তে তোমার অনুভূতি ঠিক কী জান? শর্টকাটে শেয়ার করো প্লিজ? ‘
নামী তখন তীব্র লজ্জায়, ঈষৎ রাগে ছটফটিয়ে ওঠে। নখ ডাবিয়ে দেয় সুহাসের পুরো পিঠজুড়ে। সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠে৷ শক্ত করে চেপে ধরে আদুরে কামড় বসায় বউয়ের গ্রীবাদেশে। নিজেদের সেই একান্ত মুহুর্তের কথা স্মরণ করে লজ্জায় আরক্ত হয় নামী। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে সুহাসের পিঠে। বেচারার পিঠজুড়ে অসংখ্য নখের আঁচড়। মায়া হয় খুব৷ পরোক্ষণেই ভেঙচি কেটে বিড়বিড়ায়,
‘ বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘
.
.
সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠেই তৈরি হয়ে নিল সিমরান। হ্যান্ড পার্স নিয়ে বের হবার পূর্বে মায়ের ঘরে উঁকি দিল। দেখল, মা কফি খাচ্ছে। তাকে দেখেই বলল,
‘ সাতসকালে কোথায় যাচ্ছ? ‘
সিমরান মৃদু হেসে কপটহীন স্বরে বলল,
‘ নামীপুর বাসায়। ব্রোও আছে ওখানে। ‘
সুহাস নামীর কাছে বুঝতে পেরেছিল উদয়িনী। এ নিয়ে আর কিছু বলার নেই তার। কিন্তু সকাল হতেই মেয়েও সেখানে ছুটছে? মুখটা কঠিন হয়ে এলো। কিছু বলতে উদ্যত হলে সিমরান প্রচণ্ড তাড়া নিয়ে বলল,
‘ আমি বেরুচ্ছি আম্মু, ফিরতে দেরি হবে টেনশন করো না। ‘
চলে গেল সিমরান৷ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল উদয়িনী৷ ইদের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে। পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটাবে বলে। অথচ তার পরিবার নেই। গত কয়েক বছর ধরেই ছেলেমেয়েদের সাথে তার দূরত্ব। নিজের অহংবোধে ডুবে গিয়ে এই দূরত্বকে এতকাল সে গুরুত্ব দেয়নি৷ এখন বয়স বাড়ছে। চাকরির মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব নতুন নয় পুরোনো। ছেলেমেয়েদের সাথে যে মনের সংযোগ ছিল তা ছিন্ন হতে হতে এবার সে নিজেকে সম্পূর্ণ একা অনুভব করতে শুরু করল। কেঁপে ওঠল বুক। মৃদু কম্পন অনুভব করল হাত, পায়েও৷ কফির মগ পাশের টেনিলে রেখে ফোন হাতে নিয়ে কল করল ছেলেকে। ঘুম ভেঙে গেল সুহাসের। ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেল মায়ের কাঁপা স্বর,
‘ বাবা ওঠেছিস? ‘
ঘুম কাতুরে কণ্ঠে সুহাস জবাব দিল,
‘ না, এনি প্রবলেম? তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন?’
উদয়িনী ঠোঁট কামড়ে নিজের কষ্ট চেপে নিল। বলল,
‘ সিনু না খেয়েই বেরিয়ে গেল। বলল তোদের ওখানে যাবে। একসঙ্গে খেয়ে নিস। ‘
সুহাস চোখ ডলতে ডলতে ওঠে বসল। শত অভিমান থাকলেও মায়ের এই কণ্ঠ সুহাসের হৃদয়ে গিয়ে লাগল। সে নরম গলায় বলল,
‘ চিন্তা করো না। নামী খাইয়ে দিবে ওকে। নামীর হাতে খেতে পছন্দ করে সিনু। ‘
উদয়িনী চমকে গেল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ ওহ! ‘
‘ তোমার শরীর ঠিক আছে মা? ‘
বাঁকা হেসে উদয়িনী বলল,
‘ হ্যাঁ ঠিক আছে। তোর বাবার নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে দিতে পারবি? ‘
পৃথিবীতে এরচেয়ে বিস্ময়কর কিছু হতে পারে কী? এক নারী তার সন্তানকে ফোন করে বলছে তার স্বামীর ফোন নাম্বার দিতে? বাবা নাম্বার পরিবর্তন করেছে আড়াই বছর আগে। সেই নাম্বার যে মা জানে না। সুহাস মাত্রই জানতে পারল৷ মায়ের শতদোষ থাকলেও বাবার প্রতি রাগ হলো এবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ দিচ্ছি। তুমি কী করছ মা? ‘
‘ কফি খাচ্ছিলাম। তোর নানু আসবে দুপুরে। তার ঘরটা গুছাব। বাবার নাম্বারটা মনে করে দিয়ে দিস। রাখছি। ‘
ফোন কেটে গেল। সুহাস কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে বাবার নাম্বার সেন্ট করল মাকে। আজ মায়ের কণ্ঠ ভীষণ অন্যরকম লাগল। ঐ কণ্ঠে ক্রোধ ছিল না ছিল প্রচণ্ড অসহায়ত্ব। যা অনুভব করে সুহাস বাবাকে একটা টেক্সট করল,
‘ মা ভালো নেই বাবা। মা তোমায় ফোন করলে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলো প্লিজ। ‘
রাতে রান্না করা খাবার গুলো গরম করে রুমে এলো নামী। ননদ এলেই খাবে তারা। আপাতত ভেজা চুলগুলো শুকানো যাক। হেয়ার ড্রায়ারে লাইন দিয়ে বরের হাতে ধরিয়ে দিল সে। সুহাসের ঘোর কাটল শ্যাম্পুর কড়া ঘ্রাণে৷ চুল কী শুকাবে? বউকে জাপ্টে ধরে কোলে বসিয়ে চুলে নাক গুঁজে বসে রইল কিয়ৎক্ষণ। এরপর চুল শুকাতে শুকাতে গল্প করল বন্ধুদের নিয়ে। আইয়াজ আর ফারাহর সম্পর্ক কেমন চলছে? মাঝেমধ্যেই ফারাহকে জ্বিনে ধরে। তখন বেচারা আইয়াজের দশা হয় ঠিক দেবদাসের মতো৷ ছেলেটা বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। কিন্তু ফারাহই ভিড়াচ্ছে শুধু। মাঝে মাঝে ফারাহকে বেশ সন্দেহ হয়, রহস্যময় লাগে। সুহাসের মুখে এ কথা শুনে নামীও চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুহাসের কথা বা ভাবনা ভুল নয়। তার নিজেরও ইদানীং ফারাহকে বেশ রহস্যময় মনে হয়৷ আইয়াজ ফারাহর গল্প শেষে সৌধ আর নিধিতে চলে গেল ওরা। সৌধ নিধির প্রতি ভীষণ পজেসিভ৷ এতগুলো বছর ধরে বিনা স্বার্থে ভালোবেসে যাচ্ছে মেয়েটাকে। অথচ তার তরফ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। খুব কঠিন হৃদয়ের নারী নিধি। এতকিছু করেও টলানো যাচ্ছে না। সৌধ, নিধির কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেল নামী। সৌধ যেমন নিজের সবটুকু দিয়ে নিধিকে ভালোবাসে। ঠিক তেমনি সিমরান ভালোবাসে সৌধকে। এরা দু’জনই একতরফা ভাবে ভালো বেসে যাচ্ছে। নামী জানে সৌধ কোনোদিন সিমরানকে ভালোবাসবে না। তার ভালোবাসা সব একমাত্র নিধির জন্যই। সৌধ খুব একগুঁয়ে স্বভাবের। তার বিশ্বাস নিধিকে সে নিজের করেই ছাড়বে। তাছাড়া একটি ছেলের থেকে এমন ভয়ানক ভালোবাসা পেলে কোন মেয়েই বা মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? থাকলেও কতদিন পারবে? সবটা বুঝে নামী৷ তাই সিমরানকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেক সময়ই বোঝায়, সৌধ তাকে ভালোবাসে না৷ কিন্তু মেয়েটা নেতিবাচক কথাগুলোও ইতিবাচক নিয়ে নেয়৷ তার দৃঢ় বিশ্বাস সৌধকে সে নিজের করে পাবেই পাবে। এর কারণ বহু যুবকের প্রেম প্রত্যাখ্যান করে এক সৌধতে মগ্ন সে। তার এই প্রগাঢ় বিশ্বাস, ভালোবাসা কখনোই বৃথা যেতে পারে না। সিমরানের সেসব কথা শুনে চুপসে যায় নামী৷ কিছুই বলতে পারে না৷ আর না কখনো সুহাসের সাথে শেয়ার করে এসব। যে যাই বিশ্বাস করুক৷ সে একমাত্র ভাগ্যে বিশ্বাস করে। খুব ভালো করেই জানে মানুষ যাই পরিকল্পনা করুক না কেন সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা।
চুল শুকানো শেষে রাবার ব্যন্ড দিয়ে চুল বেঁধে সুহাসের দিকে ঘুরে বসল নামী। জিজ্ঞেস করল,
‘ সৌধ ভাই নিধি আপুর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে না কেন? ‘
‘ পাঠাবে স্মৃতি আপুর বিয়ের পরই। ‘
‘ তাদের বাড়ির সবাই জানে নিধি আপুর ব্যাপারে?’
‘ এখনো না। জানাবে শিঘ্রই। ওর পরিবারে এসব নিয়ে প্রবলেম নেই। সব প্রবলেম নিধির পরিবারেই। সুজা আংকেলকে জানানোর পর এসব সলভ হয়ে যাবে৷ ‘
নামী মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,
‘ এবার সিমরানকে সৌধ ভাই আর নিধি আপুর ব্যাপারে জানানো উচিত। ‘
পরোক্ষণেই ভাবল,
‘ উহুম, যখন বিষয়টা পারিবারিক ভাবে আগাবে তখনি জানাব৷ আমার কাজ শুধু পাশে থেকে মেয়েটাকে সামলানো। ‘
এরপর ভাবল, সৌধর প্রতি সিমরানের অনুভূতি বিষয়ে সুহাসকে জানাবে কিনা? প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে গেল সে। বলবে বলবে করেও শেষ পর্যন্ত আর বলল না। না জানি সুহাস কী প্রতিক্রিয়া দেবে। এই ভয়েই কিছু বলতে পারল না৷ সে তো জানে বোনের ব্যাপারে ছেলেটা কতখানি পজেসিভ!
.
.
এমপি সুজা চৌধুরীর বাড়ি আত্মীয়, স্বজনে ভরপুর। পুরো বাড়িটা সাজানো হচ্ছে ঠিক রাজমহলের মতো। এ যেন ঠিক এক রাজকন্যেরই বিয়ের আয়োজন। সৌধদের বাড়ির নাম স্মৃতিসৌধ। এই বাড়িটা সুজা চৌধুরীর খুব শখের বাড়ি৷ আজ বাদে কাল যে মেয়েটির বিয়ে। সেই মেয়েটিও এ বাড়ির খুব শখের। বাড়ি জুড়ে একদিকে সুখের বন্যা বইলেও অন্যদিকে চাপা কষ্টের জোয়ার আসছে। তবু জীবন চালনা করতে হবে জীবনের নিয়মেই। সকালের নাস্তা শেষে চৌধুরী গিন্নি ছোটো ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। সৌধর মা তানজিম চৌধুরী। মায়ের ঘরে এসে সৌধ দেখল, মা পান মুখে দিচ্ছেন৷ পাশে আপু আর ছোটো কাকার চার বছরের মেয়ে তাহানী। তাহানী নামটা রেখেছে তানজিম চৌধুরী। যাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু তাহানীকে অভিনন্দন জানিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে চৌধুরী বাড়িতে। তাহানী নামের অর্থ অভিনন্দন।
সৌধর একমাত্র কাকা সুলল চৌধুরী। স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি আর বিয়ে করেনি। বয়স গতমাসে একচল্লিশে পড়েছে। চার বছর ধরে পরিবারের সবাই খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে সুললকে বিয়ে করানোর জন্য৷ সে চেষ্টা বরাবরের মতোই বৃথা। তাহানীকে সৎ মা নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় করাতে নারাজ সে। ঘোর আপত্তি। তার বুড়ো মা আর ভাবির দায়িত্বেই আছে ছোট্ট তাহানী। আর সে একাগ্রচিত্ত ঢাকা শহরে থাকা তাদের পারিবারিক বিজনেস সামলাচ্ছে৷ মায়ের ঘরে ঢুকে তাহানীকে কোলে তুলে নিল সৌধ। ছোটো ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে রইল তাহানী। সৌধ ওর ছোট্ট গালে চুমু খেয়ে মাকে বলল,
‘ আম্মা ডাকছিলে? ‘
তানজিম চৌধুরী পান চিবুতে চিবুতে বললেন,
‘ হু আব্বা ডাকছিলাম। সোহান ভাইয়ের বাড়ি যাও তাড়াতাড়ি। সিনু মারে নিয়া আসো গা। ‘
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে সৌধ বলল,
‘ তোমাকে কতদিন বলেছি পান খাবে না। আর তুমি এটা অভ্যাসে পরিণত করছ? ‘
তানজিম চৌধুরী হাসলেন। কাঁধে পড়ে থাকা আঁচলখানি মাথায় তুলে নিয়ে বললেন,
‘ এই একটুআধটু খাই। তুমি যাও সিনু মারে নিয়া আসো গা। সুহাস ব্যাটায় নাকি শশুর বাড়ি গেছে শুনলাম। মেয়ে মানুষ বৃষ্টি মাথায় কইরা একা একা না আসাই ভালো। ভাবিও নাকি আসছে৷ তার সাথে কথা বইলা তারপরে নিয়া আইসো। ‘
স্মৃতি আপু আড়চোখে ভাইকে দেখে নিল। গতরাতেই ভাইকে সে বলেছিল সিনুকে সাতসকালে নিয়ে আসতে। ভাইয়ের মেজাজ ভালো নেই। তাই রাজি হয়নি৷ সুহাসের পরিবারের সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই সুবাদে স্মৃতি আর সিমরানের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ আর মধুর। একদিন বাদেই মেহেদি অনুষ্ঠান। টুকটাক শপিং এখনো বাকি। সিমরানের পছন্দ জ্ঞান ভালো। প্রচণ্ড স্মার্ট আর মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। স্মৃতির মতে বিয়ে বাড়ির আমেজ খুবই সাদামাটা। বিয়ে বিয়ে অনুভূতিটা ঠিক আসছে না। আসল কথা তার কাজিনদের সাথে বা অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে মতের অমিল, রুচির অমিল হচ্ছে। নিজের বাড়িতেও ভীষণ অস্বস্তিকর লাগছে। সৌধর বন্ধু, বান্ধবী সবাই আসবে ইদের পরদিন। তার বান্ধবীরাও ইদের পর আসবে। আগে কারো পক্ষে আসা সম্ভব হবে না৷
নামী আসবে আগামীকাল। সে সুহাসকে নিয়ে গেছে তার গ্রামের বাড়িতে। একদিন থেকে তারপর ফিরবে। এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশে সিমরান একা একা আসুক চায় না স্মৃতি৷ তাছাড়া উদয়িনী আন্টিকে খুব ভয় পায় সে৷ তানজিম সবটা বুঝিয়ে ছেলেকে আদেশ করল সিমরানকে নিয়ে আসতে। মায়ের আদেশ অমান্য করার মতো ছেলে সৌধ নয়৷ পারিবারিক ভাবে তারা সকল ভাই, বোনই খুব কঠিন নিয়মে মানুষ হয়েছে। বেয়াদবের স্থান সুজা চৌধুরীর বাড়িতে নেই৷ তাই মায়ের আদেশ আদবের সঙ্গেই মান্য করল সৌধ৷ তাহানীকে স্মৃতি আপুর কোলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে৷ প্রথমে ভেবেছিল গাড়ি নিয়ে বের হবে৷ বৃষ্টি থেমেছে। আকাশটাও পরিষ্কার। সবটা দেখে নিয়ে বাইক নিয়েই বের হলো। স্মৃতি আপুও সিমরানকে টেক্সট করে বলে দিল,
‘ সিনু, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসিস৷ একদম বিয়ের পর বাড়ি ফিরবি৷ আব্বাকে দিয়ে আংকেলকে ফোন করিয়ে দিব নো প্রবলেম। আর আন্টিকে ভাই ম্যানেজ করে নেবে নো টেনশন। ‘
স্মৃতি আপুর ম্যাসেজ পেয়ে সিমরানকে আর পায় কে? ঝড়ের গতিতে সে তৈরি হয়ে নিল। সৌধ ভাই! তার স্বপ্নের পুরুষ আসছে তাকে নিতে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভাবল, বিয়ের আগেই ঘটা করে শশুর ঘরে ক’জন যেতে পারে হু হু? আহা! আকাশে বাতাসে আজ শুধু খুশির ঢেউ।
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৪|
বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক বৃষ্টি দেখছিল উদয়িনী। সোহানের নাম্বার নিয়েছে কিছুদিন আগে। অথচ ফোন বা টেক্সট কিছুই করা হয়নি। অপেক্ষার সমাপ্তি টানতে বাধ্য হলো সে। বুঝে ফেলল সোহান আজো আসবে না। তাই কল করল স্বামীর নাম্বারে। দু’বার রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো। উদয়িনী সাবলীল কণ্ঠে শুধাল,
‘ কেমন আছো? ‘
সেদিন সুহাসের ম্যাসেজ পেয়ে বিরক্ত হয়েছিল সোহান। তবু ছেলের অনুরোধ ফেলে দিতে চায়নি৷ অপেক্ষা করছিল উদয়িনীর ফোনকলের। দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। উদয়িনী কল করল না। সোহান খন্দকারও অপেক্ষা করা বন্ধ করে দিল। ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগল একাগ্রচিত্তে। এরই মধ্যে আজ হঠাৎ করে অপ্রিয় স্ত্রীর ফোন পেয়ে একটুও অবাক হলো না। সহজ গলায় বলতে উদ্যত হলো,
‘ বলো কী বলবে? ‘
তার পূর্বেই উদয়িনীর বিস্ময় করা কণ্ঠের স্বাভাবিক প্রশ্ন শুনে বলল,
‘ সৃষ্টিকর্তা যে হালে রেখেছেন সে হালেই আছি। ‘
ব্যস থেমে গেল সোহান। উদয়িনীকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল না সে কেমন আছে? একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের মন ওঠে গেলে সে ভালো আছে কিনা জানতে চাওয়া কি সত্যি সম্ভব? অন্যকারো দ্বারা সম্ভব হলেও সোহান খন্দকারের পক্ষে সম্ভব হলো না। উদয়িনী বোধহয় আশা করেছিল। তাই নিশ্চুপ ছিল কয়েক পল। অপরপ্রান্তেও নীরবতা অটুট থাকলে থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ বাড়ি আসবে কবে? ‘
সোহান খন্দকারের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল। বলল,
‘ তুমি কি এটা জিজ্ঞেস করতেই ফোন করেছ? ‘
‘ না। ‘
‘ যে কারণে ফোন করেছ সে কারণটাই বলো। ‘
‘ আমি জানি তুমি বিরক্ত হচ্ছো। ‘
‘ এরপরও কেন কল করেছ? ‘
গলা কেঁপে ওঠল উদয়িনীর। আকস্মিক কেঁদে ফেলল। ওপাশে চমকাল সোহান। উদয়িনীর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যে নারী এতকাল কখনো ভাঙেনি আজ সে এত অল্পতেই ভেঙে পড়বে? বিশ্বাস হলো না। শক্ত মুখে বসে রইল সোহান৷ কানে ধরে রইল ফোন। বোঝার চেষ্টা করল ভাবগতিক। উদয়িনী নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,
‘ সোহান, একটা দিন কি আমাকে দেয়া যায় না? তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন সোহান, ভীষণ। ‘
‘ আমি শান্তিতে থাকলে তোমার সহ্য হয় না? আর কতভাবে অশান্তিতে রাখবে? আর কী প্রয়োজন আমাকে? আমার জীবন, যৌবন সবটাই তো ধ্বংস করে দিয়েছ৷ আর কী ধ্বংস করার আছে? আমার ছেলেটার জীবন ধ্বংস করতেও ওঠে পড়ে লেগেছ। সফল হতে পারছ না বলে নতুন ছক কষছো? ‘
চ্যাঁচিয়ে কথাগুলো বলল সোহান৷ উদয়িনী কয়েক পল স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে রইল। পরোক্ষণেই স্তব্ধতা কাটলে বলল,
‘ আর কারো জীবন ধ্বংস হবে না সোহান। তুমি প্লিজ একটা দিন সময় দাও আমাকে। ‘
উদয়িনী হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়। সোহান ভেবেছিল বরাবরের মতোই তর্ক দেবে উদয়িনী। এরপর প্রচণ্ড কথা-কাটাকাটি করে ফোন রেখে দেবে। কিন্তু উদয়িনীর তরফ থেকে এমন একটি উত্তর পেল যে আর কোনো কঠিন কথা শোনাতে পারল না। শত হোক সে ভদ্রলোক। আর উদয়িনী তার স্ত্রী এবং তাদের দু’টো সন্তানের মা। তাই ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল,
‘ আমার পক্ষে সম্ভব না। ‘
‘ এটা যদি আমার শেষ চাওয়া হয় তবু না? ‘
চুপ হয়ে গেল সোহান। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ ঠাট্টা করছ? ‘
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উদয়িনী। বলল,
‘ সে বয়সটা আর নেই সোহান। ‘
বাক্যটির সমাপ্তি ঘটিয়ে আকস্মিক কেশে ওঠল উদয়িনী। কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে ওঠল। ধীরপায়ে ঘরে এসে বিছানায় বসল আধশোয়া হয়ে। ওপাশে চুপচাপ সমস্তই শুনছে সোহান। কল কেটে দেয়নি বলে উদয়িনী একটু স্বস্তি পেয়ে বলল,
‘ কবে ফ্রি থাকবে? ‘
‘ কেন? ‘
‘ তুমি না আসতে পারলে আমি যাব। ‘
দমে গেল সোহান। উদয়িনী আসতে চাইলে নিষেধ করার উপায় নেই। কারণ তার সবকিছুই উদয়িনীর মাধ্যমে পাওয়া। এই যে ক্লিনিকটায় সে অবস্থান করছে এটা তার নিজের হলেও এর সূত্রপাত হয়েছে উদয়িনীর মাধ্যমেই। উদয়িনীর পারিবারিক সাপোর্ট না থাকলে আজ সে এভাবে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারত না। সবকিছু বিবেচনা করে সে বলল,
‘ দিনে সময় দিতে পারব না। সন্ধ্যায় বাড়ি আসছি। ‘
উদয়িনী হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক চিলতে হাসি ফুটল তার অধর কোণে। বলল,
‘ থ্যাংকস অ্যা লট সোহান। ‘
ফোনে কথা বলা শেষ হতেই কাজের মেয়ে সেলিনা এসে খবর দিল, সৌধ এসেছে। সিমরানকে নিয়ে যাবে তাদের বাড়ি৷ চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। তারা সবাই আমন্ত্রিত। সুহাস, সিমরান কয়েকদিন আগে চৌধুরী বাড়ি যাবে। কথা হয়েই ছিল। আজ
সিমরানকে নিতে আসবে এটাও স্বাভাবিক। যেহেতু সৌধ নিতে এসেছে একবিন্দু আপত্তিও করল না উদয়িনী। তাছাড়া আজ সোহান আসবে। তাই সিমরান ও বাড়ি চলে গেলে সোহানের সঙ্গে একাকী দীর্ঘ সময় কাটানো যাবে। ভেবেই সেলিনাকে বলল,
‘ সিনুকে তৈরি হতে বলো। আমি নিচে যাচ্ছি। ‘
কথাটা বলেই গলায় ওড়না ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেলিনাকে পিছু ডেকে আবার বলল,
‘ তাড়াতাড়ি এসে দু’কাপ কফি করে দাও। সৌধ কফি ছাড়া কিছু খাবে না। ‘
সেলিনা মাথা কাত করে সিমরানের ঘরে চলে গেল।
.
.
রেইনকোট আর হেলমেট খুলে টি টেবিলের ওপর রাখল সৌধ। নিঃশব্দে বসল সোফায়৷ উদয়িনী এলো এক মিনিটের মাথায়। সৌধ তার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ করল। ততক্ষণে সেলিনা এসে কফি তৈরি ফেলেছে। উদয়িনী সৌধ দু’জনই কফি খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক গল্প করে সময় কাটাল। সবাই উদয়িনীর সামনে বেশ অস্বস্তি নিয়ে থাকলেও সৌধর মধ্যে অস্বস্তির ছিটেফোঁটাও নেই। উদয়িনী সবার অস্বস্তি টের পায়, টের পায় কেউ তাকে পছন্দ করে না৷ তার সামনে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। কিন্তু সৌধ আলাদা। সে উদয়িনীকে আলাদা চোখে দেখে না। সবার চোখে যা কঠিন, অস্বাভাবিক সৌধর চোখে যেন তাই সহজ আর স্বাভাবিক। মোটকথা উদয়িনীর কলহপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এড়িয়ে চলে সৌধ। ঠিক এই জিনিসটাই ভালো লাগে উদয়িনীর। ব্যক্তিগত ভাবে সৌধকে ভীষণ পছন্দ তার। তাদের পারিবারিক সম্পর্কটাও বেশ মধুর৷ যা থেকেই সুপ্ত একটি ইচ্ছে অনেক আগে থেকেও বুকের ভেতর দানা বেঁধেছে। আজ সোহান এলে এ বিষয়েও কথা বলতে হবে। সুজা চৌধুরী তাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে। সিমরানকেও চোখে হারায় ও পরিবারের লোকগুলো। আত্মীয়ে আত্মীয়ে পরম আত্মীয়ের ইঙ্গিতটা তানজিম ভাবিই প্রথম দিয়েছে তাকে। তখন এ বিষয়ে ভাবা না হলেও এবার ভাবতে হবে। হাতে সময় খুবই অল্প। আলাপচারিতার মাঝেই লাগেজ নিয়ে সিমরান নিচে নেমে এলো৷ বুক ধুকপুক করে ওঠল সৌধর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির দৃঢ় চোয়ালদ্বয় দেখে। সিমরানকে দেখে উদয়িনীর মুখে হাসি ফুটে ওঠল৷ মেয়েকে কাছে ডেকে কপালে চুমু খেল সে৷ এরপর সৌধ দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। ‘
সৌধ বিব্রতবোধ করল। সিমরান দীপ্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে৷ সৌধ মাথা নাড়াল। বলল,
‘ সিয়র আন্টি , বাড়িতে সবাই ওর খেয়াল রাখবে৷ টেনশন করো না। ‘
উদয়িনীকে কথাটা বলেই সিমরানের দিকে তাকাল। বলল,
‘ হেলমেট কই? ‘
হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে সেলিনা আপাকে ডেকে হেলমেট আনাল সিমরান৷ পরনে হলদু রঙের রেইনকোট আর মাথায় কালো হেলমেট পরে তৈরি সে৷ সৌধও রেইনকোট আর হেলমেট মাথায় দিয়ে বিদায় নিল উদয়িনীর থেকে৷
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রমণীর বুকের ভেতর অনাসৃষ্টি চলছে। তার মনের পুরুষটি ভয়াবহ সুদর্শন। যার পেছনে বসে তার বলিষ্ঠ কাঁধ স্পর্শ করে বাইকের মৃদু গতিতে সে যাচ্ছে স্বপ্নের বাড়ি৷ স্বপ্ন পুরুষটির বাড়িই তার স্বপ্নের বাড়ি৷ একদিন যে বাড়ির ছোটো বউরানি হবে সে। আপন গতিতে বাইক নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে সৌধ। সিমরান সুহাসের ছোটো বোন৷ প্রচণ্ড আদরের সম্পদ। এই বাচ্চা মেয়েটা শুধু সুহাসেরই নয়৷ তাদের পরিবার, বন্ধু -বান্ধবী প্রত্যেকেরই ভীষণ আদরের৷ সৌধ নিজেও যথেষ্ট আদর করে সিমরানকে। মেয়েটা এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তবু তাদের কাছে মনে সিমরান যেন ঠিক ঐ আট বছরের আঁটকে আছে। সৌধর পেছনে দু’পা দুদিকে দিয়ে বসে সিমরান৷ একহাত সৌধর কাঁধে, অন্যটি নিজের ভাজকৃত হাঁটুর উপরে রাখা। পাঁচ মিনিট অতিক্রম করতেই হঠাৎ সৌধ বলে ওঠল,
‘ ভালোভাবে ধরে বোস। স্টাইল দেখাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটবে। ‘
আকস্মিক কথায় ভড়কে গেল সিমরান। সে স্টাইল দেখাচ্ছে? কীভাবে, কখন? চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে সৌধকে ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকাল। এতক্ষণ তার মধ্যে ভীষণ জড়তা কাজ করছিল। সৌধ তাকে স্রেফ বন্ধুর বোন, ছোটো বোনের নজরে দেখলেও সে তো তা দেখে না। তাই তো একটুখানি স্পর্শ করতেই অদ্ভুত শিহরণে পাগলপ্রায় লাগছিল। সব অনুভূতি তুচ্ছ করে দৃঢ়ভাবে কাঁধ ধরল সিমরান। কিছুটা ঘেঁষেও বসল। ঠান্ডা প্রকৃতি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, পছন্দের পুরুষটার বাইকের পেছনে বসে তাকে ছুঁয়ে অল্প পথ ভ্রমণেই মনটা রোমান্টিক হয়ে ওঠল। আলগোছে চোখ বুঝে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আই ফিল ইউ সৌধ ভাই , ডিপলি ফিল ইউ! ‘
‘ কিছু বললি? ‘
গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সৌধ। সিমরান চমকাল। ঈষৎ হেসে বলল,
‘ না কিছু বলিনি। ‘
এরপর হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,
‘ অনেক কিছু বলি আমি, অনেক কিছু অনুভব করি। তুমি কি শুনতে পাও? পাও না তো। তোমার মতো এটিটিউড বয় কি এসব শুনতে পাবে? ‘
মনে মনে কথাগুলো বলে সিদ্ধান্ত নিল অনেক হয়েছে আড়ালে আবডালে ভালোবাসা। অনেক হয়েছে অপেক্ষা। এবার সে সৌধকে মনের কথা জানাবে। এতদিন অপেক্ষা করছিল সৌধ নিজে থেকেই তাকে প্রেম নিবেদন করবে৷ একটা সময় সে ধারণা করেছিল তার মতো করেই সৌধও তাকে মনে মনে ভালোবাসে। সে ধারণা থেকেই এতগুলো বছর অপেক্ষা। কিন্তু সৌধ তেমন কিছু বলেনি। অথচ তার হাবভাব সিমরান ঠিক বুঝতে পেরেছিল সে তাকে ভালোবাসে। এই যেমন সিমরান টিকটক করত। সেগুলো আবার ফেসবুকেও ছাড়ত৷ এটা নিয়েই একদিন ফোন করে শাসাল,
‘ সিনু এরপর যদি ফেসবুকে তোর একটা টিকটক পাই বাসায় এসে ঠাটিয়ে এক থা প্প ড় লাগাব। সবগুলো টিকটক ডিলেট করবি। ‘
এরপর আরেকদিন সে তার ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে মহেরা ঘুরতে গিয়েছিল। এই নিয়েও শাসন করেছে। কোন কোন ছেলে ভালো না, কার ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে। এরপর থেকে আর তাদের সাথে মেশেনি সে। মোটকথা তার যেসব কর্মকাণ্ড সৌধর পছন্দ না সবই এড়িয়ে চলেছে। সৌধর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সিমরান কথা মান্য করত না৷ সে এতটাও বাধ্য মেয়ে নয়৷ কিন্তু সৌধ যখন এসব বলেছে ওর মনে হয়েছে সৌধ চায় না তার ব্যক্তিগত নারী অন্য কোনো ছেলের সাথে চলাফেরা করুক বা পাবলিকলি সহজলভ্য হয়ে যায়। নিজের পোশাকআশাকেও যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছে৷ আগের মতো শার্ট, প্যান্ট এখন খুব একটা পরে না। সৌধর পছন্দ অনুযায়ী ঢিলেঢালা পোশাকই পরার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে স্মৃতি আপুকে অনুসরণ করে খুব। এতকিছু করার পরও সৌধর থেকে ইতিবাচক কোনো বার্তা পায়নি৷ তাই এখন তার মনে হচ্ছে শক্ত ব্যক্তিত্বের ছেলেরা ভালোবাসার মানুষটার কাছে ভালোবাসার আবেদন নিয়েও ছ্যাবলামি করতে পারে না৷ সৌধ আলাদা ধরনের। এজন্যই সিমরান তাকে ভালোবাসে। থাকুক না মানুষটা তার আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে৷ নাইবা বলল নিজে থেকে ভালোবাসার কথা। তাদের ভালোবাসাটা না হয় ভিন্ন ধারার হবে৷ সেই না হয় আগে ভালোবাসা প্রদান করবে।
বাড়ির প্রায় কাছাকাছিই এসে পড়েছে। এমন সময় আকস্মিক বাইক থামাল সৌধ৷ চমকে ওঠল সিমরান। বাইক থামিয়ে সিমরানকে নামতে বলল সে। সিমরান অবাক হয়ে নেমে দাঁড়াল। নেমে দাঁড়াল সে নিজেও৷ এরপর আশপাশে তাকিয়ে দেখল হেলমেট খুলবে কিনা৷ ফাঁকা রাস্তা। একটা, দু’টো গাড়ি যাচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে আর হেলমেট খুলল না। পাছে কে দেখে চিনে ফেলল। সুজা চৌধুরীর ছোটো পুত্র একটি মেয়ে নিয়ে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই তো আর জানে না সিমরান তার বন্ধুর বোন। পারিবারিক আত্মীয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। মন, মেজাজ তার খুব একটা ভালো নেই। কারণ নিধির মধ্যে ভয়াবহ ধরনের পরিবর্তন খেয়াল করেছে সে৷ আজকাল আর রাত দশটার পর ওকে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ দিনেও বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে। এই ব্যস্ততার কারণ কী বুঝে ওঠতে পারে না। বুঝতে পারে শুধু নিধি তাকে এড়িয়ে চলছে। কিছুদিন আগেও এই এড়িয়ে চলাটা ছিল না। বরং কিছুটা আশকারা ছিল। হঠাৎ সব কেমন যেন হয়ে গেল। দু’দিন হলো কথা হয় না। রাগারাগি করেছে সে নিজেই৷ কিন্তু নিধি আর রাগ ভাঙায়নি। বলা যায় সে হয়তো রাগ ভাঙানোর সময় করে ওঠতে পারেনি। রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা সবকিছুর পরও মেয়েটাকে ভালোবাসে সৌধ। তাই আর নিজেকে আটকাতে পারল না। সাহায্য নিল সিমরানের। বলল,
‘ একটা হেল্প কর তো। ‘
বুক ধক করে ওঠল সিমরানের। উত্তেজনায় ঠোঁট কাঁপছিল তার। মন বলছিল সৌধ বুঝি কাঙ্ক্ষিত কিছু বলার জন্যই এভাবে মাঝরাস্তায় বাইক থামিয়েছে। কিন্তু না সে তো হেল্প চাইছে! কী হেল্প? মনের প্রশ্ন মুখেও বেরিয়ে এলো,
‘ কী হেল্প? ‘
‘ নিধিকে তোর ফোন থেকে একটা কল কর। আর জিজ্ঞেস কর কবে আসবে। ‘
সৌধর চিন্তান্বিত দু’টি চোখে তাকিয়ে ঘনঘন পলক ফেলল সিমরান৷ নিধি সৌধ ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। শুধু সৌধ না তার ভাই সুহাসেরও বেস্ট ফ্রেন্ড। তারা সবাই সবার প্রতি খুব পজেসিভ। ঠিক যেন গল্পটা বন্ধুত্বের নাটকের মতো ওদের বন্ধুত্বের বন্ডিং। সবই জানে সিমরান৷ সেই সাথে নিধির পারিবারিক সমস্যার কিছু কথা শুনেছে। স্মৃতি আপুর বিয়েতে সবাই আসবে। নিধি আসবে কিনা এ নিয়ে সকলের মধ্যে সংশয়৷ সংশয় সৌধর চোখে, মুখেও ফুটে ওঠেছে৷ ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসল সিমরান। বলল,
‘ আচ্ছা ফোন দিচ্ছি। তুমি টেনশন করো না। নিধিপু ঠিক আসবে। ‘
কথাটা বলেই কল করল নিধির ফোনে। সৌধ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখনো। একবার রিং হলে ধরল না৷ সৌধ অধৈর্য হয়ে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে গেলে রিসিভ হলো সিমরানের ফোন। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঘুম কাতুরে এক পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
‘ হ্যালো কে বলছেন? ‘
আঁতকে ওঠল সিমরান। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করেই ফোন কেটে দিল। ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
‘ সৌধ ভাই, ছেলে মানুষ ফোন ধরেছে। ‘
ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো সৌধ। হাত বাড়াল ফোন চেয়ে। সিমরান ফোন এগিয়ে দিলে সে নিজেই কল করল। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো। শোনা গেল নিধির শান্ত গলা,
‘ হ্যালো সিমরান? ‘
সৌধ সঙ্গে সঙ্গে সিমরানের হাতে ফোন দিল। সিমরান ফোন কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই নিধি বলল,
‘ কেমন আছো? ‘
‘ এইতো ভালো আপু তুমি কেমন আছো? কে ফোন ধরেছিল? ‘
নিধি কথাটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
‘ কিছু বলবি? ‘
‘ কবে আসবে তুমি? সবাই জানতে চাচ্ছে। ‘
সবাই বলতে কে ঠিক বুঝে নিল নিধি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুচকি হাসল। বলল,
‘ সৌধকে বল আমি ইদের পরেরদিনই যাব। এত ফোন দিতে হবে না৷ একবার যখন বলেছি যাব তো যাবই। ‘
ফোনে কথা শেষ করে সৌধকে সবটা বলতেই বাইক স্টার্ট দিল সৌধ। এরপর তারা পৌঁছাল নিজেদের গন্তব্যে। বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই সৌধর মা তানজিম চৌধুরী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। এরপর সিমরানের কোমল থুতনি ছুঁয়ে কপালে চুম্বন এঁটে বলল,
‘ আমার ছোটো আম্মা হাজির। এইবার আমার ঘরের খুশি কানায় কানায় পূর্ণ। ‘
স্মৃতি আপু চোখ ছোটো ছোটো করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ বড়ো ভাবিকে তার মা, বাবা বড়ো আম্মা বলে ডাকে। সিমরানকে ছোটো আম্মা ডাকল কেন? তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে অন্য রকম গন্ধ পৌঁছাল। ঠিক সেই মুহুর্তে সৌধ এসে সিমরানের পাশে দাঁড়াল। এক মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল স্মৃতি। পরোক্ষণেই মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনার ইতি টানল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ধূরর কী সব মাথায় আসছে। পাঁচ বছর যাবৎ সৌধ নিধিকে ভালোবাসে। আর আম্মা হয়তো এত ডিপলি চিন্তা করে কিছু বলেনি। আর যদি চিন্তা করে বলেও থাকে এটা কখনোই সম্ভব না। আমার ভাই যা জিনিস! ‘
মাথা ঝাঁকিয়ে দুঃশ্চিতা সরিয়ে দিয়ে সিমরানকে গিয়ে চেপে ধরল স্মৃতি । প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা যখন হাজির৷ এবার বাড়িতে বিয়ে বিয়ে অনুভূতি ঠেকায় কে?
চলবে…
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৫|
সিমরান বেড়ে ওঠেছে একক পরিবারে। যেদিন থেকে সৌধদের যৌথ পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে সেদিন থেকে এই পরিবারের প্রতি আলাদা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এ পরিবারের মানুষ গুলোও তাকে খুব আপন করে নিয়েছে। নিজের পরিবার বলতে বাবা, মা, ভাইকেই দেখেছে সে। বাবা, মাকে পেয়েছে খুব কম সময়। পরিবার কী? পরিবার কেমন হয় জানত না। তেমন কোনো অনুভূতি ছিলই না পরিবার নিয়ে। চৌধুরী বাড়ির সঙ্গে তার বাবা, মায়ের বন্ধুত্ব সম্পর্কের সুবাদে এ বাড়ি আসা, যাওয়া শুরু হয়৷ তারপর থেকেই বুঝতে শুরু করে যৌথ পরিবারের মর্ম। একটি যৌথ পরিবারে শুধু হাসি, খুশি, আনন্দ, উল্লাস বা শুধু ভালোবাসাই থাকে না। থাকে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ এবং নিয়মানুবর্তিতা। সিমরান খোলা চোখে এ পরিবারে শুধু অঢেল ভালোবাসা আর আনন্দ টুকুই দেখেছে। বাদবাকি বিষয়ে খুব একটা খেয়াল করা হয়নি। তার মাধ্যে প্রচণ্ড পরিমাণে ম্যাচিওরিটির অভাব। বাবা, মায়ের সান্নিধ্য পায়নি বলেই শিশুকাল থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। চাইতে দেরি কিন্তু পেতে দেরি হয়নি কখনো৷ বাবা, মায়ের অভাব বোধ অনুভব করলেও তারা দুই ভাই, বোন কখনো অভিযোগ করতে পারেনি। কেন করবে? ছোট্ট থেকেই তো শেখানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে , ‘ তোমরা যখন যা চাচ্ছ তাই পাচ্ছ। অন্যান্য পরিবারের বাচ্চারা তোমাদের মতো এত সুবিধা পাচ্ছে না। সবাই সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে না। একদিকে সেক্রিফাইস করলে অন্যদিকে পরিপূর্ণ ভাবে পাওয়া যায়। ‘ সেই শেখানো বুলি মস্তিষ্কে চেপেই বেড়ে ওঠা ওদের। অভিযোগ করার কারণ দাঁড় করাতে পারেনি কখনোই। সেই একক পরিবারের সন্তান হয়ে যৌথ পরিবারে মানিয়ে নেয়াও ভীষণ কঠিন৷ যতই ভালোলাগা থাকুক তবু কিছু জটিলতার সম্মুখীন তো হতেই হয়৷ হতেও হলো সিমরানের৷ গতকাল স্মৃতি আপুর মেহেদি অনুষ্ঠান ছিল। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সৌধর বাবা-মা দু’দিকের আত্মীয় আর বন্ধু, বান্ধব। নিধি বাদে সব বন্ধুরাই উপস্থিত ছিল। নিধি গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত এই তিনদিন থাকবে কথা দিয়েছে। তাই মেহেদি অনুষ্ঠানে না থাকায় রাগ করেনি সৌধ। চুপচাপই ছিল সে। বড়ো বোনের মেহদি অনুষ্ঠানে আনন্দ করেছে খুব। নাচ, গান, গল্পআড্ডা সবশেষে কাজিন আর বন্ধুদের জোরাজোরিতে একটু মেহেদি লাগানো হাতে৷ সব মিলিয়ে সময়টা তার দারুণ কেটেছে। তাকে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে সিমরান। কাজিনদের মধ্যে সবাই সৌধকে ভীষণ ভয় পায়৷ প্রচণ্ড সম্মান আর ভালোওবাসে। কিন্তু পাশাপাশি বসে তার হাত ধরে মেহেদি দিয়ে দেয়াতে সাহস সিমরান ছাড়া কারোরি বেশি ছিল না। প্রিয় মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে হাত রাঙিয়ে দেয়ার সুযোগটুকুও হাত ছাড়া করতে চায়নি সিমরান, লুফে নিয়েছে তৎক্ষনাৎ। সৌধর দাদি আশায়রা বেগম। খুবই চতুরা নারী। সেকালের মেট্রিক পাশ । শিক্ষিতা নারী। এ-র ওপর বড়ো ঘরের বউ। ভীষণ দাপুটে। বর্তমানে বয়স পয়ষট্টি ছুঁয়েছে। মাথায় কাঁচা চুলের দেখা মেলে না। দেহের চামড়া ঝুলে বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটে ওঠেছে। চোখের পাওয়ারও কম। চশমা ছাড়া চোখে দেখে না৷ তবু তেজ কমেনি এক চুল পরিমাণও। এই পরিবারে তার চোখে চোখ রেখে, তার কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে পারো দু’জন ব্যক্তি। একজন তার বড়ো ছেলে সুজা চৌধুরী। আরেকজন ছোটো নাতি সৌধ চৌধুরী। আশায়রা বেগম ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করে না সিমরানকে। তার কাছে সিমরান আর সুহাস দু’জনকেই অতিরিক্ত চঞ্চল, আর ঔদ্ধত্য মনে হয়৷ যাদের মধ্যে সাধারণ জ্ঞান নেই। ভদ্রতা, সভ্যতার লেশমাত্র নেই। বড়োদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হয় এদেরকে পরিবার থেকে শিখানো হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা আশায়রা বেগম উদয়িনীকে অপছন্দ করেন। তার পরিবারের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না উদয়িনী এবং তার ছেলেমেয়েদের চলনবলন। সুজা কীভাবে এমন একটি পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল সৌধই বা কোন রুচিতে এদের সঙ্গে বন্ধু পাতালো বুঝে ওঠতে পারেন না তিনি। সিমরানের অতিরিক্ত হৈহৈ রৈরৈয়েও বিরক্ত তিনি। এই বিরক্তি ক্রোধে পরিণত হলো তার দুই মেয়ে অর্থাৎ সৌধর দুই ফুপু আর ফুপাত ভাই, বোনরা আসার পর৷ কারণ সৌধর ফুপাত ভাইদের মধ্যে দু’জনই তাগড়া যুবক। বাড়ি, ভর্তি আত্মীয়স্বজন, এদের মাঝে সিমরান বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে। কানামাছি, লুকোচুরি খেলে। পরনের ওড়না ঠিকভাবে রাখে না। রাতদুপুরে শুধু টিশার্ট আর প্লাজু পরে ঘুরে বেড়ায়। সব মিলিয়ে সিমরানকে তার নির্লজ্জ মনে হয়েছে। আর নির্লজ্জ নারীরা তার দুচোখের বিষ। গতকাল মেহেদি অনুষ্ঠানেও তার নাতনিদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে দেখেছে। শেষ পর্যন্ত সৌধকেও ছাড় দেয়নি। সর্ব সম্মুখে হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। তার চোখ জহুরি। সিমরানের চোখ দু’টোর ভাষাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই অনুষ্ঠান শেষে সিমরানকে একা ডেকে পাঠায় সে। দাদুনিকে আর সবার মতো সিমরানও ভয় পায় ভীষণ। হঠাৎ ডেকে পাঠানোতে বুকের ভেতর ধুকপুকানি নিয়েই উপস্থিত হয়। ঘরে ঢুকেই চোখে, মুখে হাসি ফুটিয়ে শুধায়,
‘ দাদুনি আমাকে ডেকেছ? ‘
তিনটে শব্দে ভুল আরো একটা করে বসে সিমরান। দাদুনিকে এ বাড়ির বড়ো থেকে ছোটো সবাই আপনি সম্বোধন করে। বিষয়টা একদমই মনে থাকে না সিমরানের। মনে তখনো ছিল না৷ তাই তুমি করেই বলে ফেলে৷ এতে দাদুনির রাগ তীব্র হয়। সদ্যই চশমা খুলে পাশের টেবিলে রেখেছিল। তা পুনরায় চোখে তুলে৷ এরপর সুক্ষ্ম চোখে তাকায় সিমরানের পানে। সিমরানের পরনে কালো রঙের টিশার্ট আর ধূসর রঙের ঢোলা পাজামা৷ কাঁধের দু’পাশে চুল ছাড়া একদম বুক অবধি। তাই আলাদা করে আর ওড়না পরেনি৷ মধ্যরাত৷ অনুষ্ঠানে রাত জেগে সবাই যে যার ঘরে ঘুমুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই যেভাবে ছিল ওভাবেই ত্বরিত এসে পড়েছে। আপাদমস্তক সিমরানের দিকে নজর বুলিয়ে দাদুনি বলল,
‘ এ বাড়ির সবাই আমাকে আপনি সম্বোধন করে। বড়োদের সম্মান পূর্বক আপনি সম্বোধন করাই উচিত। যদি গদগদ সম্পর্ক হয় আর কেউ তুমিতে সায় দেয় তবেই তুমি করে বলা যায় নচেৎ তুমি বলা চরম বেয়াদবি। ‘
মুহুর্তেই মুখটা থমথমে হয়ে যায়। থমকানো কণ্ঠে সিমরান বলে,
‘ সরি দাদুনি, মনে ছিল না। ‘
দাদুনি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
‘ এরপর থেকে মনে রাখবা। ‘
মাথা কাত করে সিমরান। দাদুনি কিয়ৎক্ষণ চুপ রয়৷ সিমরান দু-হাত সামনে বেঁধে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। দাদুনি এবার শোনাতে শুরু করে কয়েকটা কড়া কথা। কথাগুলো শিক্ষনীয় হলেও প্রকাশভঙ্গী খুবই কঠিন আর অপমান দায়ক ছিল। যেসবে একেবারেই অভ্যস্ত নয় সিমরান৷ প্রচণ্ড মিশুক প্রকৃতির মেয়ে সে। কারো সঙ্গে নিজেও কঠিন আচরণ করতে পারে না। আর না কারো কঠিন আচরণ সহ্য করতে পারে।
দাদুনি বলে,
‘ শুনো তোমার পারিবারিক শিক্ষার অভাব আছে আমরা সবাই জানি। যাদের বাবা, মায়ের মাঝে বনিবনা কম, যাদের বাবা মা সন্তানকে একা ছেড়ে দূরে থাকে তারা এমনই ঔদ্ধত্য হয়৷ কিন্তু সব পরিবার তো আর তোমার এই ঔদ্ধত্য মেনে নিবে না৷ তাছাড়া মেহমান হয়ে কোনো বাড়িতে এসে মেয়ে মানুষের ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলিও সব পরিবার সহ্য করবে না৷ বয়স তোমার কম হয় নাই। পুরুষ মানুষের থেকে দূরত্ব রেখে চলা উচিত। বাড়ি জুড়ে মেহমান ভর্তি। দামড়ি মেয়ে সকলের সামনে ছুটাছুটি করো লজ্জা করে না? তাহানী, আর ইনানের সাথে তোমার তাল মিলানি তো মানায় না। তোমাকে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ার মানুষ নাই। তাই আমিই দিলাম, অতো ছটফটানি বাদ দিয়া দাওয়াত খাবার আসছ। খেয়েদেয়ে বিদায় হও। ‘
তাহানী এ বাড়ির ছোটো ছেলের মেয়ে। আর ইনান সৌধর বড়ো ভাইের ছেলে বয়স সাড়ে তিন বছর৷ এই বাচ্চা দু’টোর সঙ্গে সিমরানের সখ্যতা অনেক বেশিই।
চুপচাপ দাদুনির কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যেন চোখ গলে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মেয়েটার। দাদুনি সেটা খেয়াল করল না৷ সিমরান ত্বরিত বেগে দু’হাতে অশ্রু কণা মুছে নিল। দাদুনি আরো বলল,
‘ আর বিশেষ করে আমি নাতিদের থেকে দূরত্ব মেপে চলবা। পরনের কাপড় ঠিকঠাক রাখবা৷ তোমাদের বাড়ির মতো এই বাড়ি না৷ এখানে অনেক সদস্য আছে। তার ওপর অনুষ্ঠান বাড়ি৷ পুরুষ মানুষের আনাগোনাও কম নাই৷ তোমার লজ্জা, শরম কম এইটা পরের বাড়ি এসে বোঝানোর দরকার নাই৷ তোমার কারণে আমার বাড়ির সম্মান নষ্ট হউক এটা আমি চাই না। মনে রাখবা কথাগুলো। যাও এখন। ‘
মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করত পারল না সিমরান। গলা কাঁপতে লাগল। বহু কষ্টে মাথা কাত করে সম্মতি দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুতে উদ্যত হলো। তৎক্ষনাৎ দাদুনি ফের পিছু ডেকে বলল,
‘ আর একটা কথা। কারো ঘরে ঢুকবার আগে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়। কেউ মনে হয় শিখায় নাই। আমি আজ শিখিয়ে দিলাম৷ এটাও মাথায় রাখবা। ‘
বুকের ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে যেন গলায় আঁটকে রইল। দরজার ওপারে যেতেই একছুটে উপরে চলে আসে সিমরান। স্মৃতি আপু ঘুমিয়ে কাঁদা। সে গিয়ে চুপচাপ স্মৃতি আপুর পাশে শুয়ে পড়ে৷ কিন্তু সারারাত কাটে নির্ঘুমে। সকাল হলেই সিদ্ধান্ত নেয় এ বাড়িতে আর এক মুহুর্ত নয়। দাদুনি তাকে পছন্দ করত না টের পেয়েছিল আগেই৷ কিন্তু গতরাতে যেভাবে ঘরে ডেকে অপমান করল এরপর আর এ বাড়িতে থাকা সম্ভব হলেও তার সামনে যাওয়া সম্ভব না। এ বাড়িতে থাকতে হলে তার সামনে যেতেই হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিল, বাড়ি চলে যাবে সে। ত্বরিত ব্যাগপত্র গুছিয়ে ভাইয়ের ফোনে কল দিল।
.
.
বেশ রাত করে ঘুমিয়েছে সুহাস, নামী। সৌধদের গেস্ট রুমে ঘুমিয়েছে তারা। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে রাতে৷ যুদ্ধ আবার কবে হয় না তাদের? সেই শুরুর দিন থেকে চলছে যুদ্ধ। এরপর থেকে একটা না একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে লেগেই থাকে। স্বামী-স্ত্রী থেকে শত্রু হলো। শত্রু থেকে আবার বন্ধু। এরপর তাদের সম্পর্ক মোড় নিল গাঢ় প্রণয়ে। তবু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল না। সৌধর দু’জন যুবক ফুপাত ভাইদের মধ্যে একজনের মাঝে ছ্যাবলামি দোষ রয়েছে। নাম, রোশান আহমেদ। ছোটো করে শান ডাকে সবাই। অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মামাত বোনের বিয়েতে এসেছে আর মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করবে না? তাই কখনো হয় নাকি? তাই কেন জানি এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে নামীকেই খুঁজে পায় সে৷ গল্প জমানোর ফাঁকে অবশ্য জানতে পারে নামী সুহাসের বউ। তাতে তার কী? কে কার বউ এসবে তার কাজ নেই। বিয়ে বাড়িতে এসেছে, তার দরকার ফ্লার্ট করার তাই সেটা করাতেই মন দিয়েছে। নামী তখন মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিল ছোট্ট তাহানীর হাতে৷ তখনি শান এসে পাশে বসে। অনেকক্ষণ ইয়ার্কি, ঠাট্টা করার পর হাত পেতে বলে,
‘ ভাবিজান, দেবরের হাতে মেহেদি পরিয়ে দেন না? ‘
স্মার্ট মেয়ে নামী। সবকিছুরই প্রতিত্তোর দিতে পারে সে৷ তাই ঠাট্টার উত্তর ঠাট্টা দিয়েই দিচ্ছিল৷ কিন্তু তাহানীর মেহেদি পরা শেষ হতেই নামীকে সে বায়নার স্বরে বলল,
‘ শানুভাইয়ের হাতে মেহেদি দিয়ে দাও ভাবি। ‘
বাচ্চা মেয়েটার বায়না আর শানের ঠাট্টা,
‘ তোমার ভাবি শুধু তোমাকেই মেহেদি পরাতে পারে তাহানী সিস্টার৷ দেবরদের মেহেদি পরানোর কলিজা তার নেই। ‘
ব্যস কথাটা অহমিকায় লাগল খুব। মনে জেদ চেপে শানকে মেহেদি দিয়ে দিতেও শুরু করল। সুহাস, আইয়াজ আর আজিজকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে গিয়েছিল৷ হাঁটাহাঁটি শেষে অনুষ্ঠানে আসতেই দেখতে পেল, তার বউটি সৌধর ফুপাত ভাইয়ের হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই এই ছেলেটাকে পছন্দ না তার। কেমন যেন মেয়েদের গা ঘেঁষে থাকা স্বভাব। সে নিজেও অসংখ্য গার্লফ্রেন্ড লালন, পালন করা ছেলে৷ কিন্তু এই রোশান ছেলেটার সঙ্গে তার যেন বহুগুণ তফাৎ। একটি ছেলে আরেকটি ছেলের চোখের ভাষা, মনের ভাষা যেভাবে পড়তে পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা কখনো সম্ভব হয় না৷ রোশানকে অপছন্দ করার পেছনে আরো একটি কারণ হলো, সৌধ। সৌধ নিজেও রোশানকে পছন্দ করে না। তাহলে নিশ্চয়ই এই ছেলেটার মধ্যে সমস্যা আছে? তাই কঠিন ক্রোধে ফেটে পড়ে সুহাস৷ বার বার ডেকে পাঠায় নামীকে। কিন্তু মেহেদি পরানো শেষ না হওয়া অবধি নামী তার কাছে আসে না৷ এরপর রাতের খাবার খেয়ে শোবার সময় হয়ে এলে নামী যখন গেস্ট রুমে আসে। পাগলা ঘোড়ার মতো আক্রমণ করে সে। দরজা লক করে আচমকা নামীর গাল দু’টো একহাতে চেপে ধরে বলে,
‘ এখন এলি কেন? থেকে যেতি ঐ শানের কাছে। ‘
গাল ব্যথায় অসহ্য হয়ে ওঠে নামী। এরওপর এমন বাঁকা কথা শুনে রাগও হয়। এক ঝটকানি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে,
‘ পাগল হয়ে গেছ সুহাস? এটা কী ধরনের আচরণ!’
চ্যাঁচিয়ে ওঠে সুহাস নিজেও,
‘ একদম উপযুক্ত আচরণ। এখানে এসেছিস কেন? যা ঐ শানের ঘরে যা। যাকে এতক্ষণ আদর করে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিলি। ‘
চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলে নামী৷ বলে,
‘ মুখ সামলে কথা বলো। ‘
‘ তুই সামলে চলবি না আর আমি সামলে বলব? ‘
‘ আশ্চর্য! কী করেছি আমি? তোমার মতো বউ থাকা সত্ত্বেও দশ, পাঁচটা জিএফ পুষেছি? ‘
‘ জিএফ পুষবি কেন তুই ওটা পুষব আমি৷ তুই পুষবি বিএফ। ‘
দুজনের মধ্যেই ভয়াবহ ঝগড়া লেগে যায়। সুহাসের চিৎকার, চ্যাঁচামেচি, অপমান, গায়ে হাত তুলতে আসা সবটায় তিক্ত হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় নামী৷ সুহাস তখন পেছন থেকে জাপ্টে ধরে তাকে। বলে,
‘ কোথায় যাচ্ছিস শানের ঘরে? ‘
তীব্র ক্রোধে নামীও স্বীকার করে,
‘ হ্যাঁ শানের ঘরেই যাচ্ছি। তোমার মতো পুরুষের কাছে থাকার চেয়ে অন্য পুরুষের কাছে যাওয়া ঢের ভালো! ‘
এমন একটি কথা কি আর সহ্য হয়? এক হাতে নামীর মুখ চেপে ধরে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সুহাস বলে,
‘ এটা কী বললি তুই? ‘
আর কিছু বলে না নামী। বলতে পারে না। সুহাসের মতো রাগের বশে যাতা বলার স্বভাব নেই তার। তবু বলে ফেলেছে। তাই আর জোর খাটায় না সুহাসের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য৷ কিন্তু সুহাসের কি আর রাগ কমে? সমস্ত রাগ, সমস্ত ঝড় উগ্রে দেয় নামীর শরীরের ওপর। অন্ধকার, বদ্ধ ঘরে ক্ষেপাটে সুহাসকে সামলানো খুব সহজ ছিল না। তবু সহজ করে নিয়েছে নামী। ভোর হলেই শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে শাওয়ার নিয়ে নেয় দ্রুত। এরপর ঘরে এসে ভেজা চুল শুকাতে নিলে সুহাস সাহায্য করতে চায়। নামী তার সাহায্য নিতে নারাজ। শরীর জর্জরিত তীব্র ব্যথায় আর মন তীব্র অভিমানে। তাই ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসে। পিছু পিছু এসে সুহাস পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। নরম স্বরে বলে,
‘ সরি বউ। ‘
নামী চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ সুহাস ওর কানের নিচে কামড়ের দাগটায় আলতো চুমু খায়। রাতে রাগের বশে এমন অসংখ্য দাগ বসিয়েছে বউয়ের শরীরে। যা এখন স্পষ্ট দেখতে পেয়ে নিজেরি খারাপ লাগছে। নামী তার থেকে ছুটার জন্য ছটফট করে৷ সুহাস জোরপূর্বক গালে একটি চুমু দিয়ে বলে,
‘ শান ভালো ছেলে নয় নামী। আমি আগেই বলতে চেয়েছিলাম ওর থেকে সাবধানে থাকতে৷ তার আগেই ও তোমার সঙ্গে এসে ভাব জমিয়েছে আর তুমিও সায় দিয়েছ দেখে রাগটা সামলাতে পারিনি। ‘
‘ এখন আর কী চাই? রাগ কমেনি, ঝাঁঝ মেটেনি? আরো মেটাতে চাও। বিছানায় আসো তবে। এটুকুই তো জোর। ‘
নামীর গলা কাঁপছিল কথাগুলো বলার সময়৷ সুহাস জোরপূর্বক ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। দু’হাতে গাল দুটো আলতো করে ধরে কপালে চুমু খেল। বলল,
‘ সরি জান। জানোই তো আমি কেমন। তুমি তর্ক না দিয়ে শান্ত থাকলেই এতটা রিয়াক্ট হতো না। ‘
নামী চোখ ঘুরিয়ে নিল। তাচ্ছিল্য মুখে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। সুহাস আদুরে স্বরে বলল,
‘ সরি বউ, তোমার বরটা কেমন পাগলাটে, তার রাগটাও কেমন পাগলাটে জানোই তো। ‘
‘ না জানি না৷ এখন জানছি তুমি কেমন রাক্ষস! ‘
মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে ওঠল সুহাস৷ জোরপূর্বক নামীর চুল শুকাতে সাহায্য করল। এরপর বিছানায় বসিয়ে নিজের রাগ মিশ্রিত ভালোবাসার চিহ্ন গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আদুরে চুমু বসাল প্রতিটি স্থানে। নামীর মন তখনো গলল না। তাই বাঁধ্য হয়ে বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দু’কান ধরল সে। বলল,
‘ ক’বার ওঠবোস করলে রাগ কমবে? ‘
নামী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সুহাস মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,
‘ বউয়ের রাগ ভাঙাতে এই সুহাস সব করতে পারে। ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল নামী। বলল,
‘ ওকে পঁয়ত্রিশবার ওঠবোস করো। ‘
ঠিক পঁয়ত্রিশ বারই ওঠবোস করল সুহাস। সেই সঙ্গে শানের থেকে কেন দূরত্ব বজায় রাখবে এবং সে ঠিক কী কী অপছন্দ করে সবটাই খুলে বলল। সবশেষে বলল,
‘ ভালোবাসি খুউব জান৷ তোমায় নিয়ে আমি ভয়ংকর পজেসিভ বউ। সবকিছুতে ছাড় পাবে শুধু আমি ব্যতীত অন্য পুরুষের সান্নিধ্যে থাকবে এ বিষয়টায় ছাড় পাবে না৷ এতে সুহাস তোমার কাছে খারাপ হোক, রাক্ষস হোক বা নরকের কীট হোক আই ডোন্ট কেয়ার। ‘
তাদের সে যুদ্ধের সমাপ্তি শেষেই সিমরানের কল আসে। কল রিসিভ করতেই শুনতে পায় সিমরানের হুহু করে কান্নার শব্দ। নিমেষেই বুক ধক করে ওঠে সুহাসের। নামী কাছেই ছিল কান্নার শব্দ শুনে সেও চিন্তিত হয় খুব৷ অন্তঃকোণে প্রশ্ন জাগে সাতসকালে মেয়েটার কী হলো হঠাৎ?
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
প্রিয় পাঠক, ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।