ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২০+২১+২২

0
885

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২০
চোখের পলকেই অতিক্রান্ত হলো বিবাহিত ব্যাচেলর জীবনের কয়েকটা মাস। এই কয়েকমাসে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। নামী, সুহাসের সম্পর্ক মোড় নিয়েছে বন্ধুত্বে। প্রত্যহ কাজের পাশাপাশি নিয়ম করে তিনবেলা খুনশুটিও চলে তাদের। ওদের এই বন্ধুত্ব, খুনশুটির আড়ালে রয়েছে প্রগাঢ় ভালোবাসা। যা ওরা টের না পেলেও টের পায় আশপাশে থাকা প্রত্যেকে। সুহাস, নামী কেউই মুখে স্বীকার করেনি ওরা একজন অপরজনকে ভালোবাসে। অথচ অবলীলায় দু’জন স্বীকার করে তারা বন্ধু। তাদের ভেতরে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাদের সে কথায় বন্ধু মহল মুচকি হাসে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে গাঢ় বন্ধুত্ব থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। ওদের এই সম্পর্কটা বাকি বন্ধুদের কাছে বাচ্চা শিশুর মতোই অবুঝ। পৃথিবীতে কিছু মানুষ তো থাকেই যারা নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিজেরাই ভীষণ আনাড়ি হয়৷ এই দু’জনকে ঠিক ঐ মানুষদের তালিকাতেই রাখা যায়।

সোহান খন্দকার আর উদয়িনীর সম্পর্ক এখন শুধু কাগজে, কলমেই রয়েছে। নামী চলে যাওয়ার পর থেকে উদয়িনীর মুখোমুখি একবারই হয়েছিল সোহান খন্দকার। এরপর আর উদয়িনীর মুখোমুখি হয়নি। উদয়িনী ছুটিতে এলে সে চলে যায় ক্লিনিকে। ওখানে তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায়ই সময় কাটায়। তবু স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘরে থাকা তো দূরের কথা এক বাড়িতেও থাকে না৷ উদয়িনী চলে গেলে তখন বাড়িতে আসে। ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটায়৷ মায়ের শিক্ষায় বেঁকে যাওয়া দু’টো বাচ্চা যে এখন বাবার সান্নিধ্য পছন্দ করে বুঝতে পারে সে৷ তাই তো ভাগ্যের প্রতি শেষ ভরসা টুকু রেখেছে। নামীর সাথেও মাসে দু’বার দেখা করে। মেয়েটার কাছে সে অপরাধী। অথচ মেয়েটা তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় রাখেনি। যতবারই দেখা করতে গেছে ততবারই শ্রদ্ধাভরে কয়েকঘন্টা সময় কাটিয়েছে। নিজ হাতে রান্না করে যত্ন নিয়ে খাইয়েছে। ঠিক নিলুর স্বভাবের হয়েছে নামী৷ মানুষের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা হয়েছে মায়ের মতোই দৃঢ়৷ ইদানীং সুহাসের আচরণ সোহান খন্দকারের মনে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। সুহাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঠিক নামীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেবে। ঘরেও তুলবে৷ এটাও নিশ্চিত হয়েছে সুহাস নামীকে সম্মানের সাথে ঘরে আনতে চাইলে নামী তাকে ফিরিয়ে দেবে না৷ সে সুহাসের বন্ধু সৌধ, নিধির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। ওদের দেয়া তথ্য মতে
এটুকু বুঝেছে তার ছেলে নামীর প্রতি ধীরেধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর নামী শুরু থেকেই দুর্বল তার আর সুহাসের সম্পর্কের প্রতি। ওদের দু’জনের এই দুর্বলতা যেদিন কঠিন ভালোবাসায় পরিণত হবে৷ সেদিন আর কারো সাধ্য থাকবে না ওদের আটকাতে। উদয়িনীর গড়ে তোলা দেয়াল যে ভাঙতে শুরু করেছে এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত।

নামী, সুহাসের বন্ধুত্বের সম্পর্কটি স্বাভাবিকই চলছে৷ স্বাভাবিক আইয়াজ, ফারাহ এর সম্পর্কও। তারা একটি স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্কে রয়েছে। ফারাহর কোনো পরিবার নেই। সে বোনের পরিবারে আগাছার মতো জীবনযাপন করছে৷ মেয়েটা চাপা স্বভাবের হওয়াতে তেমন কিছুই শেয়ার করে না৷ কিন্তু বুদ্ধিমান আইয়াজ বুঝতে পারে অনেক কিছুই। তাই সে সবসময় ফারাহকে ভরসা দেয়। কোনো প্রকার দুঃশ্চিন্তা না করতে৷ মাত্র কয়েকটা বছর। ইন্টার্নির সময়ই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে তার আপু আর দুলাভাইয়ের কাছে। পারিবারিক ভাবে খুব ধুমধাম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে তারা৷ আইয়াজের থেকে এই ভরসা পেয়ে ভারি বুকটা হালকা হয় ফারাহর। পরোক্ষণেই আবার সুক্ষ্ম আতঙ্ক জেঁকে বসে। এই আতঙ্কের পেছনে থাকা করুণ গল্পটা জানার পর আইয়াজ তাকে ভালোবাসবে তো? গ্রহণ করতে পারবে তো? সে যে কোনোকিছু গোপন রেখে আইয়াজের বউ হতে চায় না৷ পৃথিবীর সবার কাছে সেই নির্মম সত্যিটুকু গোপন রাখলেও আইয়াজের থেকে গোপন রাখার শক্তি ধীরেধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। তাদের ভালোবাসা যত গভীর হচ্ছে ভেতরের যন্ত্রণাটা ততই তীব্র হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতেই ফারাহ সিদ্ধান্ত নেয় আর এই সম্পর্ক এগোবে না৷ সে আইয়াজের যোগ্য না। আইয়াজ তার থেকে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত অনড় থাকতে দেয় না আইয়াজ। দু’দিন কথা না বললেই কেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না সে সবকিছু ঠিকঠাক করে, যতক্ষণ না স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবে, ততক্ষণ যেন পুরো দুনিয়াটাই অস্থির করে রাখে। এই পাগলটাকে কীভাবে ছাড়বে সে? কীভাবেই বা বলবে সেই ভয়ানক সত্যিটা? এসব নিয়েই প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তার মধ্যে জীবনযাপন করছে ফারাহ। সুযোগ পেলেই অদ্ভুত আচরণ করে। যেন আইয়াজ তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে যায়। কিন্তু প্রতিবারই ছেলেটা তাকে ভালোবাসার বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে বশে এনে ফেলে। এই ছেলেটার ভালোবাসার সম্মোহনী শক্তি এতটাই প্রখর যে চোখে চোখ রাখলেই পৃথিবী ভুলে গিয়ে শুধু ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
***
নিধির তরফ থেকে এখন পর্যন্তও সাড়া পায়নি সৌধ৷ রোজ রোজ এই নিয়ে অভিযোগ করতে করতে সৌধ বিরক্ত হয়ে ওঠেছিল। অভিযোগ শুনতে শুনতেও বিরক্তি এসে গিয়েছিল নিধির। তাই একদিন ক্লাস শেষে পুকুর ঘাটে গিয়ে দাঁড়ায় নিধি৷ সৌধকে একা আসার আহ্বান জানায় সে। কথানুযায়ী সৌধ একাই আসে। সেদিন নিধি ঠাণ্ডা মাথায় শান্ত সুরে সৌধকে বোঝায়,

‘ সৌধ, তোদের মতো আমার জীবন নয়৷ নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য অনেক স্ট্রাগল করতে হচ্ছে আমায়৷ জন্মদাতার বিরুদ্ধে গিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। মা আর মামার সাহায্যে পড়াশোনা করছি। এই সময়টা আমি অন্যকিছুতে ব্যয় করতে পারব নারে। আজ যদি তোর সাথে সম্পর্ক গড়ি কাল আমার বিবেক আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে৷ আমি কি এসব করতে এসেছি? আজকাল অনেক মেয়ে আছে যারা পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে দূরে গিয়ে প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এসব মেয়েদের নিয়ে সমাজে খুব চর্চাও হয়। আমি নিজেও একসময় চর্চা করেছি৷ বাবা, মা যখন এসব ইস্যু দেখিয়ে আমাকে দূরে পড়তে পাঠাতে অমত করছিল। আমি জোর গলায় বলেছি, আমি অমন নই। আমি অমনটা কখনোই করব না৷ সেই আমি যদি আজ তোর সাথে সম্পর্কে জড়াই আর এসব যদি বাবা, মা বা মামা জানতে পারে পরিস্থিতি কতটা বিগড়ে ওঠবে জানিস না। তাছাড়া তোকে আরো একটা কথা বলা হয়নি, সেম এজ রিলেশনে আমি বা আমার পরিবারের কেউ ভরসা করে না। কারণ আমার বড়ো বোন ডিভোর্সি। নিজে পছন্দ করে ক্লাসমেটকে বিয়ে করেছিল আপু। দু’বছরের মাথায় বোঝাপড়ার অভাবে সে সম্পর্কটা আর টিকাতে পারেনি। তুই বুঝতে পারছিস আমার কথা? ‘

সৌধ সমস্ত কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। এরপর অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বলেছিল,

‘ সব বুঝতে পারছি। ‘

নিধি ওর ভাবমূর্তি দেখে ব্যাকুল স্বরে বলল,

‘ আমি আমাদের বন্ধুত্বটুকু নষ্ট করতে চাই না সৌধ৷ চাই না তোর মতো বন্ধুকে হারাতে। ‘

নিধির সে কথা শুনে আচমকা ওর দুগালে আলতো করে দু-হাত রাখে সৌধ। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলে,

‘ আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না। আমাকে তুই কখনোই হারাবি না নিধি। আজ আমি তোকে কথা দিচ্ছি, তোর বিবেক তোকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না৷ তোর পারিবারিক পরিস্থিতিও বিগড়াবে না। ঠিক এমন করেই তোকে আমার বউ করব৷ আর রইল সেম এজের বিষয়টা। এমন সময় তোকে বউ করব যে সময় এই ব্যাপারটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা থাকবে না। আজ আমি তুই মেডিকেল তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। আর মাত্র দু’টো বছর। এরপর আর এই পরিচয় থাকবে না। কার্ডিওলজিস্ট সৌধ চৌধুরী বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবে গাইনোকলজিস্ট জান্নাতুল ফেরদৌস নিধির পরিবারে, ইনশাআল্লাহ। ‘

দৃঢ়চিত্তে বলা সৌধর সে কথা শুনে বিস্মিত হয় নিধি। রেগেমেগে বলে,

‘ তুই তোর জেদ অটল রাখবি? ‘

সৌধ স্মিত হেসে উত্তর দেয়,

‘ ভুল হলো ম্যাডাম, জেদ নয় ভালোবাসা অটল রাখব। ‘

‘ কিন্তু আমি তোর প্রতি ঐরকম ভালোবাসা ফিল করি না। ‘

অকপটে জবাব সৌধর,

‘ আপাতত ওসব ফিল করার প্রয়োজন নেই। মন দিয়ে পড়াশোনা কর, আর আমাকেও করতে দে। ‘

নিধির গাল টিপে কথাটা বলেই চোখ টিপল সৌধ। নিধি নাক ফুলাল এতে৷ তা দেখে পুনরায় বলল,

‘ যা বাসায় যা। ওরা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। ‘

নিধি উঁকি দিয়ে দেখল কয়েকহাত দূরে আম গাছের পেছনে দশবারো জন ছেলে দাঁড়িয়ে। আইয়াজ, সুহাস নেই ওখানে৷ আজিজ সহ আরো অনেক পরিচিত মুখ। নিধির ভালো লাগে না ওদের। কিন্তু সৌধর আশপাশে সব সময় এসব ছেলেপুলে থাকেই। যতই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকুক। সেফটি নিয়ে চলতেই হয় ওকে।
***
আজ মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে নামীর। পড়ার টেবিলে দু’হাতের কনুই ভর করে হাতের তালুতে থুতনি রেখে বসে আছে সে৷ প্রাচী তিন মগ কফি বানিয়ে একটা নামীকে দিয়ে বলল,

‘ মুড অফ নাকি বনু? এটা খাও মন, মাথা সবই ফ্রেশ হয়ে যাবে। ‘

মৃদু হেসে কফির মগ হাতে নিল নামী। বলল,

‘ থ্যাংকিউ সো মাচ আপু, খুব প্রয়োজন ছিল এটার৷ কিন্তু আলসেমির জন্য করা হচ্ছিল না। ‘

‘ মেয়ে, ফর্মালিটি রাখো। ক্যাম্পাসে সিনিয়র হলেও এখানে ওসব মেইনটেইন করার প্রয়োজন নেই। আলসেমি লাগছিল মুখে বলতেই পারতে, এই প্রাচী যা এক মগ কফি বানাই আন। ‘

নামী হেসে ফেলল। বলল,

‘ তাই বলে নাম ধরে তুই, তুকারি করতে বলো না। এটা আমাকে দিয়ে হবে না। ‘

বিছানায় বসে পড়ছিল নিধি। হঠাৎ ঘড়ির টাইম দেখে প্রাচীকে ধমক দিল,

‘ কিরে কফি দিবি না ওখানেই দাঁড়াই থাকবি। ‘

‘ আসতেছি, আসতেছি। ‘

প্রাচী ছুটে গেল। নামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা দু’টো ভাঁজ করে চেয়ারে তুলে বসল। এরপর কফিতে চুমুক দিতে দিতে মোবাইল হাতে নিল। সুহাসের নাম্বার ডায়াল লিস্টে দেখে ভাবল কল করবে কিনা। আবার কি যেন ভেবে আর কল করল না। ইয়ারফোন খুঁজে বের করে কানে গুঁজল। ইউটিউবে ঢুকে রবীন্দ্র সংগীত বের করে শুনতে লাগল একের পর এক।

প্রাচী, নিধি বিছানায় পাশাপাশি বসে। নামীকে খেয়াল করে মিটিমিটি হাসছে দুজন। চুপিচুপি নিজেদের মধ্যে ম্যাসেজিং করে কথাও বলছে তারা। প্রাচী বলল,

‘ আর দেড়ঘন্টা দোস্ত। ‘

প্রাচীর ম্যাসেজের রিপ্লাই করল নিধি,

‘ সিনু আর সৌধ প্র্যাক্টিকেলে সুহাসকে বোঝাচ্ছে। আমি বলেছি ভিডিয়ো ক্লিপ পাঠাতে। ‘

কথাটা বলতে বলতেই হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিয়ো পাঠাল আইয়াজ। যেখানে সৌধ সিমরানকে প্রপোজ করে সুহাসকে শেখাচ্ছে ঠিক কীভাবে নামীকে মনের কথা জানাবে৷ ধূসর রঙের টিশার্ট পরনে সৌধর। সিমরানের পরনে কালো রঙের টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট৷ গলায় একটি জর্জেট ওড়না ঝুলানো৷ ব্রাউন কালার থ্রি স্টেপ চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সৌধর মুখোমুখি। সৌধ ধীরেধীরে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই সিমরান চিল্লিয়ে ওঠল।

‘ না না এভাবে না। এটা এখন ওল্ড স্টাইল তুমি দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে বলো। ‘

সৌধ দাঁড়াল। একহাত পকেটে ঢুকিয়ে অন্যহাত মুঠো করে সিমরানের দিকে এগিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতো সে মুহুর্তে আবারো চ্যাঁচিয়ে ওঠল সিমরান,

‘ থামো থামো। আমাকে তোমার থেকে বেশিই শর্ট লাগছে। নামী আপু ব্রোর চেয়ে এত্ত শর্ট না৷ ওয়েট আমি হিল পড়ে আসছি। ‘

কথাটা বলেই সিমরান দৌড় দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সৌধ চোখ কটমট করে তাকাল সুহাসের দিকে। আর ভিডিয়ো করতে থাকা আইয়াজের দিকে। বলল,

‘ এত আয়োজন করার কী আছে বুঝতে পারছি না। মেয়েদের এই এক সমস্যা সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। ‘

সুহাস বলল,

‘ এই একদম সিনুর ওপর বিরক্ত হবি না। ও যে আমাদের হেল্প করতে রাজি হয়েছে এই তো অনেক। ‘

আইয়াজ বলল,

‘ অভিনয় নিখুঁত না হলে সুহাসের মতো আনাড়ি প্রেমিক শিখবে কীভাবে? সিনুর আয়োজন ঠিকই লাগছে আমার। মেয়েদের বুদ্ধি ছাড়া পুরুষ অচল আবারো প্রুফ হলো। ‘

সৌধ ঠোঁট কামড়াল। আইয়াজ যেদিন থেকে ফারাহর প্রেমে পড়েছে সেদিন থেকে মেয়েদের নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করে। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখন এসব ভাবার সময় নয়। তাই বলল,

‘ আমি বা সিনু কেউই প্রেমটেম করিনি। তবু আমরা এই শা’লাকে প্রেম শেখাচ্ছি। তোর তো বুড়িগঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে মরা উচিতরে। ‘

শেষ কথাটা সুহাসকে ভর্ৎসনা করে বলল সৌধ। সুহাস চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘ কথায় কথায় শা’লা বলবি না। তোর নিধি আমার বোন না যে আমি তোর শা’লা হবো। আর আমার বোনকে তোর মতো অশ্লীলের কাছে দিবও না। ‘

সৌধ তেড়ে এলো সুহাসের দিকে। বলল,

‘ এই শা’লা আমি অশ্লীল? তাহলে তুই কি তুই তো ইমরান হাসমির সিকোয়েন্স! ‘

দু’জনের মা’রামারি লাগল প্রায় মুহুর্তে হিল পড়ে ত্বরিত সামনে এসে দাঁড়াল সিমরান। দুই বন্ধু মুখে শরীর, মুখ উভয়তেই লাগাম টানল। সৌধ আর সময় নষ্ট না করে প্রপোজ করে দেখাল সিমরানকে,

‘ ইহজনম এবং পরজনম দু’জনমের জন্যই আমার হৃদয়কে মুঠো ভর্তি করে তোমার তরে সমর্পণ করলাম। ‘

সিমরান বিগলিত চিত্তে সৌধর মুঠো ভরা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বারকয়েক ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর নিজের হাত মুঠো করে বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বলল,

‘ গ্রহণ করলাম। ‘

পাশ থেকে আইয়াজ চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ ফাটাফাটি। ‘

ভিডিয়োর শেষ হতেই নিধি, প্রাচী দু’জনই চিল্লিয়ে ওঠল,

‘ দারুণ অভিনয়। ‘
***
ঠিক বারোটা সময় নামীর ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো,

‘ হ্যাপি ফার্স্ট মিটিং নামীদামি। ‘

বই থেকে মুখ তুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল নামীর। এরপর আরো একটি ম্যাসেজ এসে হৃদয় নাড়িয়ে তুলল তার।

‘মিসেস সুহাসিনী… হ্যাপি ফার্স্ট ওয়েডিং এনিভার্সারি। ‘

দ্বিতীয় ম্যাসেজটা দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠল সে। অতিরিক্ত কম্পনের ফলে দু’হাতে ফোন ধরে রাখতেও হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় এলো
তৃতীয় ম্যাসেজটি। যেটা দেখে দু’চোখ উপচে জল গড়াতে গড়াতে আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল নামী।

‘ টু ডে ইজ দ্য ডে টু কিস ইয়র ফরহ্যাড মাই বেগাম ‘

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১

ঠিক বারোটা সময় নামীর ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো,

‘ হ্যাপি ফার্স্ট মিটিং নামীদামি। ‘

বই থেকে মুখ তুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল নামীর। এরপর আরো একটি ম্যাসেজ এসে হৃদয় নাড়িয়ে তুলল তার।

‘ মিসেস সুহাসিনী… হ্যাপি ফার্স্ট ওয়েডিং এনিভার্সারি। ‘

দ্বিতীয় ম্যাসেজটা দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠল সে। অতিরিক্ত কম্পনের ফলে দু’হাতে ফোন ধরে রাখতেও হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় এলো
তৃতীয় ম্যাসেজটি। যেটা দেখে দু’চোখ উপচে জল গড়াতে গড়াতে আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

‘ টু ডে ইজ দ্য ডে টু কিস ইয়র ফরহ্যাড মাই বেগাম ‘

কান্নায় ডুবে গিয়ে চতুর্থ ম্যাসেজটি দেখতেই পেল না। নিধি, প্রাচী এক ছুটে এসে দু’পাশ থেকে নামীর দু’কাধ জাপ্টে ধরল। একসুরে বলল,

‘ হ্যাপি এনিভার্সারি বনু, হ্যাপি এনিভার্সারি। ‘

আকস্মিক হুঁশ ফিরল নামীর। এ কী করছে সে? কাঁদছে কেন? হঠাৎ এতটা ভেঙেই বা পড়ল কেন? সে তো এমন দুর্বল নয়। তবে কি ভালোবাসা নামক অনুভূতিটুকু তার মতো শক্ত ধাঁচের মেয়েকেও দুর্বল করে ফেলল? মুখ থমথমে হয়ে গেল তার। প্রাচী, নিধি দু’জন তাকে ছেড়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

‘ তোমার আর সুহাসের সম্পর্ক আজ এক বছরে পদার্পণ করল। ‘

ওদের সে কথায় কর্ণপাত করল না নামী। তার মনের গভীরে চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। এটা কী করে ফেলল সে? এবার যদি এ কথা সুহাসকে জানানো হয় খুব বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি হবে। ছেলেটা খুব খুঁচিয়ে কথা বলতে জানে। তাছাড়া সে ওর জন্য কেঁদে গা ভাসিয়েছে এ কথা জানলে অহংকারে মাটিতে পা’ই ফেলল না। দেখা গেল আকাশে ভাসতে ভাসতে তার মাথার ওপর থুথু নিক্ষেপ করতে শুরু করবে! রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল নামী। সুহাসের কাছে নিজের দুর্বলতা কক্ষনো প্রকাশ করবে না সে। কক্ষনো না। ত্বরিত সামলে নিল নিজেকে। নিধি টেবিলে রাখা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নামীকে দেয়া সুহাসের চতুর্থ ম্যাসেজটি দেখতে পেল।

‘ আ’ম ওয়েটিং নামী। নিচে এসো। ‘

ম্যাসেজটা দেখে নিধি বলল,

‘ ঐ দেখো রোমিও হাজির। ‘

প্রাচী অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ এতদ্রুত? ‘

‘ আসবে না? ‘

হাসতে হাসতে প্রাচীকে এ প্রশ্ন করেই নামীকে বলল,

‘ বনু তাড়াতাড়ি ড্রেস চেঞ্জ করে নিচে যাও। সুহাস অপেক্ষা করছে। ‘

নামীর অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া সীমাহীন বিস্ময়ে ভরে ওঠল। ঢোক গিলল রয়েসয়ে। বলল,

‘ সুহাস এসেছে! ‘

প্রাচী নিশ্চিত হতে বেলকনির দরজা খুলে উঁকি দিল গ্রিলের ফাঁকে। অমনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সুহাসের বেশভূষা দেখে কপালে পড়ল সুক্ষ্ম ভাঁজ। কবে হবে এই ছেলেটার বুদ্ধি? এমন প্রশ্নে জর্জরিত হলো হৃদয়। তাদের সবচেয়ে লম্বা বন্ধু সুহাস। অথচ ওর বোধবুদ্ধি সব হাঁটুর নিচে। তার দিদা ঠিকই বলে লম্বা ছেলেদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুর নিচে। সুহাসই তার চাক্ষুুস প্রমাণ৷ বিবাহবার্ষিকীতে বউকে উইশ করতে এসেছে। তার গেটআপ থাকবে অন্যরকম। অথচ এ ছেলে কিনা টিশার্টের সাথে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে এসেছে! চোখমুখ কুঁচকে ফেলল প্রাচী। তক্ষুনি ফোন করল সুহাসকে। বলল,

‘ এই ছ্যাড়া, তুই থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ছস কেন? এইভাবে কেউ কোনো মেয়েকে প্রপোজ করতে আসে? ‘

‘ বইন যা গরম পড়ছে। ফুল প্যান্ট পড়ে বেরোনোর সাহস পাইনি। সৌধও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আসছে। ‘

‘ আরে গাধা ওর ব্যাপার আর তোর ব্যাপার এক হলো নাকি? আজ তোর ম্যারেজ ডে। বউকে উইশ এণ্ড প্রপোজ করতে আসছিস। ‘

‘ ধূরর, প্রবলেম নেই। আমি তো আর কোনো অচেনা মেয়ে বা গার্লফ্রেন্ডকে প্রপোজ করতে আসিনি। এসেছি বউকে প্রপোজ করতে। থ্রি কোয়ার্টার পড়ি, হাফ পড়ি বা কিছু নাই পড়ি তাতে কি আসে যায়। ‘

কথাগুলো বলেই দুষ্টুমি ভরে হাসল সুহাস৷ প্রাচী বিড়বিড় করে বলল,

‘ অসভ্য ছেলে ! ‘

‘ আমার সভ্য বউটাকে কুইকলি পাঠারে জান। ধৈর্যে কুলাচ্ছে না আর৷ ‘

প্রাচীর সংবিৎ ফিরল। পিছনে তাকিয়ে দেখল নিধির উৎসুক চোখ আর নামীর থমথমে মুখ। অমনি ফোন কেটে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠল,

‘ ঐ তো আমার দোস্তটা দাঁড়াই আছে। ‘

প্রাচীর কথা শুনে নামীর হৃৎস্পন্দন যেন লাফাতে শুরু করল। সুহাস এসেছে! আজ তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। শুধু ম্যাসেজ করে উইশ নয় সরাসরি দেখা করতেও চলে এসেছে। আবারো কান্না পেয়ে গেল তার। অসম্ভব সে কান্না কেন পেল? খুশিতে কী? এই খুশি কীসের আভাস? তার আর সুহাসের সম্পর্কের মোড় বদলে দেয়ার? নিধির কথায় ধ্যান ভাঙল নামীর।

‘ কোনো ভয় নেই, পুরো এলাকা ম্যানেজ করা আছে আজ। যতখুশি এই চত্তরে দু’জন সময় কাটাও। ‘

প্রাচী ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘ তুমি রাজি থাকলে আমরা কিন্তু আজ রুম বুকও করে ফেলতাম! ‘

মৃদু কম্পন খেলে গেল নামীর শরীরে। লজ্জায় মস্তক নত হলো কিঞ্চিৎ। নিধি পুনরায় চাপাস্বরে তাড়া দিল তাকে,

‘ কী হলো নামী, ছেলেটা অপেক্ষা করছে তো। ‘

ছেলেটা অপেক্ষা করছে তো। এই বাক্যটি যেন কর্ণে নয় একদম বুকে গিয়ে লাগল নামীর। অতীতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা, বর্তমানের স্রেফ বন্ধুত্ব সব তুচ্ছ করে কাপড় বদলে, গেটের চাবি নিয়ে ছুটে নিচে চলে গেল৷

গলির মোড়ে গাড়ির ভেতর শুয়ে আছে সৌধ। আজ সে ছোটো কাকার গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। তাদের বাড়িতে দু’টো গাড়িতে এসি রয়েছে এক বাবা দুই ছোটো কাকা। আজ ছোটো কাকার গাড়ি ফ্রি ছিল। তাই তারটা নিয়েই বন্ধুর বিয়ের প্রথম বছর পালন করতে এসেছে। প্রাচী জানাল নামী নিচে নেমেছে। অর্থাৎ সব ঠিকঠাক। এবার সে আরামসে ঘুম দেবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আজিজ। সে এলাকার কয়েকটা ছুটকো নেতাদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। সৌধ গলা উঁচিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল,

‘ এই আজিজ সুহাস গেছে? ‘

‘ হ’রে মাম্মা গেছে। ‘

‘ খেয়াল রাখিস। ‘

আজিজের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা বলল,

‘ ভাই আপনি চিন্তা না করে চিল করেন। আমরা আছি। ‘

সৌধ বাঁকা হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ তোদের না থেকে উপায় আছে? পকেট ভরিয়েছি কি আর এমনি এমনি। ‘
***
গেট খুলে পুনরায় তালাবদ্ধ করল নামী। জড়ীভূত হয়ে দুরুদুরু বুকে তাকাল সুহাসের দিকে। ল্যামপোস্টের আলোয় লম্বাটে দেহটি দেখেই হৃৎস্পন্দন যেন থমকে গিয়েও আবার চঞ্চল হয়ে ওঠল। সুহাস ইশারা করল কাছে যেতে। নামী ধীরে ধীরে এগুতে লাগল। অদ্ভুত এক সম্মোহনে ডুবে রইল সে। নামীর অগ্রগতি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। ঠোঁট জুড়ে মুচকি মুচকি হাসি লেপ্টে দাঁড়াল রাস্তার মাঝখানে। দীর্ঘ কয়েকমাস যাবত ব্যায়ামের মাধ্যমে তৈরি দেহের বুক টান টান করে সে দণ্ডায়মান রইল। যেন নিজের স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখাতে ভীষণ মরিয়া সে। মরিয়া থাকবে না কেন? এসব যে শুধুই নামীর জন্য। তার প্রাক্তনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বর্তমান লুক দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অরিন তো সেদিন কমেন্টেই বলল,

‘ বলেছিলাম আমি নিয়মিত জিমে যাও। নিজের প্রতি যত্নশীল হও। এবার আমার কথা ফলল তো? কীসে তোমার ভালো, কীসে তোমার মন্দ এই অরিন ছাড়া আর কে বুঝবে? ‘

কমেন্টটা সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দিয়েছে সে। এতদিন ম্যাসেন্জারে ব্লক থাকলেও সেদিন সরাসরি ফেসবুক থেকেই ব্লক করেছে। তার এই উন্নতি সব মেয়েদের নজড়ে পড়েছে শুধু নামী ছাড়া৷ এখন পর্যন্ত নামী কোনো প্রকার মন্তব্য করেনি। অথচ সে মুখিয়ে আছে এই মেয়েটার থেকে কিছু শোনার জন্য।

নামী এসে সামনে দাঁড়াতেই প্রকৃতির স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে দিল সুহাসকে। তার কপাল জুড়ে থাকা সিলকি চুলগুলো উড়তে লাগল সে বাতাসে। উড়ল নামীর পিঠ জুড়ে থাকা খোলা চুলও। আচমকা মাথা তুলে আকাশ পানে তাকাল সুহাস। ঘন মেঘে ঢাকা আকাশটায় না আছে চন্দ্র, না আছে নক্ষত্রের মেলা। আকাশের মুখ ভার বুঝতে পেরে দৃষ্টি নামাল। তাকাল নামীর স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে। নামী দু’বার পলক ফেলল। সুহাস দেখল ঘন পাপড়ি যুক্ত কাজল কালো চোখ দু’টির নমনীয়তা।ঢোক গিলে ত্বরিত কানের নিচে চুলকে নিয়ে বলল,

‘ তুমি এসেছ? ‘

বোকার মতো প্রশ্নটি করে আপনমনেই গালি দিল নিজেকে। কয়েক পল চোখ বন্ধ করে থেকে মনে করার চেষ্টা করল সৌধ, আইয়াজের শেখানো বুলি গুলো। এরপর চোখ খুলল। নামী একই ভঙ্গিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে আছে তার পানে। আবারো ঢোক গিলল সুহাস। আপাদমস্তক নামীকে দেখে নিয়ে উদ্যত হলো হাঁটু গেড়ে বসার। আচমকা প্রকৃতির শান্তরূপ অশান্ত হতে শুরু করল। বাতাসের বেগ বেড়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে প্রকৃতিতে। আবারো আকাশে চোখ তুলল সুহাস। বলল,

‘ বৃষ্টি আসবে নাকি! ‘

নামী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। সে নিঃশ্বাসের শব্দে সুহাস তাকাল ওর দিকে। বলল,

‘ শুভ বিবাহবার্ষিকী নামী। ‘

নামীর হাঁটুতে কিঞ্চিৎ কম্পন অনুভূত হলো। নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে সে বলল,

‘ সেম টু ইউ সুহাস। ‘

ঈষৎ হেসে চারপাশে দৃষ্টি ঘোরাল সুহাস। পকেট হাতিয়ে কিছু একটা বের করে হাত মুঠো করে রাখল। নামী হঠাৎ চমকে ওঠল শরীরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ফোঁটা পড়ায়। বলল,

‘ বাসায় চলে যাও সুহাস বৃষ্টি পড়ছে! ‘

কথাটা বলেই পিছু ঘুরল সে। উদ্যত হলো ফিরে যেতে। সুহাস কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হলো এতে। পিছন থেকে হাত টেনে ধরল নামীর। বলল,

‘ এটাত হয় না নামীদামি। বৃষ্টি আসুক, সুনামি আসুক, ভূমিকম্প হয়ে পৃথিবী ধসে পড়ুক। তবু আমি যাব না। আর না তোমাকে যেতে দিব। ‘

নামী বিস্ময় ভরে তাকাতেই সুহাস হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের সম্মুখীন করে দাঁড় করাল। হাতে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করল নামী। বড্ড জোর খাঁটিয়ে ধরেছে ছেলেটা। বুঝেই চাপা গলায় বলল,

‘ এত জোরে ধরেছ কেন? ছাড়ো, যাব না আমি ছাড়ো। ‘

ছেড়ে দিল সুহাস। ততক্ষণে তুমুল বর্ষণ শুরু হয়েছে। গা ভিজে কাপড় লেপটে যাচ্ছে শরীরে। নামী হতভম্ব মুখে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আর সুহাস রয়েসয়ে হাঁটু গেড়ে বসল তার সামনে। যদিও সৌধ, সিমরান এটি শেখায়নি তবু নিজ গরজে বসল। অবাক হওয়ার শীর্ষে পৌঁছে গেল নামী। দৃষ্টি কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সুহাস পলকহীন নামীর সিক্ত মুখের অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ শত চেষ্টা করেও ভালোবাসি বলতে পারিনি। চাইও না বলতে। লাইফে এত মেয়েদের ভালোবাসি শব্দটা বলেছি যে আসল জনকে বলতে এলেই দ্বিধায় পড়ে যাই। আই লাভ ইউ শব্দটাকে আমি হাঁট, বাজারের জিনিসের মতো সস্তা করে ফেলেছি। তাই হয়তো তোমার মতো মূল্যবান মানুষটাকে ওটা বলতে এত দ্বিধা কাজ করে আমার৷ ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায়। আই লাভ ইউ শব্দটি ছাড়াও প্রিয়জনকে প্রপোজ করা যায়। নামীদামি,
ইহজনম এবং পরজনম দু’জনমের জন্যই আমার হৃদয়কে মুঠো ভর্তি করে তোমার তরে সমর্পণ করলাম। ‘

ডান হাত মুঠো বন্দি করে উঁচু করতেই চমকে গেল নামী। এ কোন সুহাসকে দেখছে সে? আজ কোন সুহাস তার সম্মুখে এসেছে? কী বলছে এসব সে? হৃদয়কে মুঠোভরে সমর্পণ এও সম্ভব! দু-চোখ জলে ভরে তা গাল বেয়ে পড়তে লাগল নামীর। মৃদু আলোয় নামীর মুখে সুহাস শুধু বৃষ্টির পানিই দেখতে পেল। বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানিও যে বেরুচ্ছে তা বুঝল তখন যখন নামী ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল,

‘ সেই স্বপ্ন দেখিয়ো না সুহাস, যে স্বপ্ন একদিন দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেঙে যায়। ‘

সুহাস প্রতিবাদ করে বলল,

‘ ভাঙবে না নামী। ক্যান ইউ ট্রাস্ট মি। ‘

ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। প্রচণ্ড শীত লাগল নামীর। এই শীত শুধু দেহ নয় মনেও পৌঁছে গেল। সুহাস হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল নামীর এক পা। নামী আঁতকে ওঠে পিছু হাঁটতে নিতেই সুহাস টেনে ধরল। বোঝাল পা উঁচু করতে সে কোনো বাঁধা শুনবে না আজ। নামী থেমে গেল৷ অবাধ্য হতে ইচ্ছে করল না আর। আজ যেন তার বাধ্য হওয়ার দিন। সুহাসের বাধ্য বধূ রূপে ধরা দেয়ার দিন৷ সুহাস নিজের হাঁটুর ওপর নামীর পা তুলে ভেজা পাজামা একটু উপরে তুলল। এবারে ভয়ানক লজ্জা পেল নামী। কী করছে এসব সুহাস? বোধগম্য হলো না তার। সুহাস অতি যত্ন নিয়ে বা হাতে থাকা একটি রূপোর পায়েল পরিয়ে দিল পায়ে। বলল,

‘ গার্লফ্রেন্ডদের প্রপোজ করলেও বউকে প্রপোজের ব্যাপারে বড্ড আনাড়ি আমি৷ তাই কীভাবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ প্রাচী একটা গানের ভিডিয়ো পাঠাল। হিরো হিরোইনকে এভাবেই পায়েল পড়াচ্ছিল। তাই এভাবেই ট্রাই করলাম। ‘

কথাগুলো বলেই ওঠে দাঁড়াল সুহাস। বৃষ্টিতে ভেজা নামীর অধরকোণে তাকিয়ে পুনরায় বলল,

‘ স্বীকৃতি দেইনি বলে যে বিয়েটা আড়ালে পড়ে আছে। তা আমি প্রকাশ্যে আনতে চাই। কেন জানো? তোমার আশপাশে ওকে সহ্য করতে পারছি না। কেন পারছি না জানো? বিকজ ইউ আর মাই ওয়াইফ৷ মিসেস. সুহাসিনী। ‘

‘ ও ‘ শব্দটায় ভড়কে গেল নামী। কার কথা বলছে সুহাস? নামীর মুখো ভঙ্গি দেখে ফিচেল হাসল সুহাস। বলল,

‘ কুশলের থেকে দূরে থাকবে। ওকে জানিয়ে দেবে ইউ আর ম্যারেড, এণ্ড আ’ম ইউর হাজব্যন্ড। ‘

মুখ হা হয়ে গেল নামীর। কুশল তার ক্লাসমেট, ভালো বন্ধুও। গতমাসে হুট করেই প্রপোজ করে বসে ছেলেটা। বিষয়টা খুবই গোপনে ঘটেছে। তবু সুহাস জেনে গেছে সবটা। তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে গেল নামী। বলল,

‘ আসলে ব্যাপারটা। ‘

‘ আসলে, নকলে শুনতে চাই না। যা বললাম মাথায় রাখবে। ‘

উত্তর দিল না নামী। সুহাস এ প্রসঙ্গে আর কথা বলল না। আপাতত নামীকে নিয়ে উথাল-পাতাল বৃষ্টিতে গা ভেজাতে ইচ্ছে করল। দুলতে ইচ্ছে করল প্রগাঢ় প্রণয় তরঙ্গে। যে ইচ্ছেটাকে উস্কে দিল আকস্মিক বজ্রপাত ঘটে ল্যামপোস্টের বাতি নিভে গিয়ে। নামী অন্ধকার ভয় না পেলেও বজ্রপাত ঘটে বাতি নিভে যাওয়ার ভীত হলো। আতঙ্কিত স্বরে ডাকল,

‘ সুহাস! ‘

তৎক্ষনাৎ মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানিয়ে নামীর হাত চেপে ধরল সুহাস। কণ্ঠে গভীরতা মিশিয়ে বলল,

‘ এই তো। ‘

হৃৎস্পন্দন থেমে গেল নামীর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাথা ভনভন করতে লাগল। অন্ধকার, তুমুল বর্ষণে সুহাসের হাতের স্পর্শে যেন আরো গভীরতা মিশে রইল। টের পেল নামী। দুরুদুরু বুকে কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ বাসায় যাব, ফিরে যাও তুমি। ‘

‘ যাব তো। ‘

সহসা ভেজা, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল নামীর মুখশ্রীতে। শিউরে ওঠে পিছুটান দেওয়ার চেষ্টা করল নামী৷ টের পেয়ে এক হাতে ওর কটিদেশ বেঁধে ফেলল সুহাস। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ভারিক্কি স্বরে বলল,

‘ ডোন্ট মুভ নামী। ‘

নামী শুনল না। শক্তি প্রয়োগ করল খুব। সুহাস অনড় হয়ে নামীর কপালে অধর স্পর্শ করে পুনরায় বলল,

‘ ডোন্ট মুভ জান। ‘

শরীর জুড়ে ঝংকার খেলে গেল নামীর। দু’হাতে সুহাসের বাঁধন আলগা করার চেষ্টা করে কাঁপা গলায় বলল,

‘ আমরা রাস্তায় আছি সুহাস। কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ। ‘

এ কথায় ক্ষেপে ওঠল সুহাস। হাতের বাঁধন দৃঢ় করে নামীর নাকে নাক ঠেকাল। ঠোঁটের কাছাকাছি ঠোঁট নিয়ে বলল,

‘ আর কত কন্ট্রোল করব? কন্ট্রোলে আছি বলেই বিয়ের এক বছর পরও তুমি স্টিল ভার্জিন। ‘

‘ কী আশ্চর্য পাগলামি করছ কেন? ‘

‘ চুপপ, জাস্ট দু’মিনিট। ‘

‘ মানে! ‘

‘ কিস অন দ্য লিপ। ‘

‘ সুহাস… ‘

‘ অনুমতি দেবে না? ভেবে বলো। আমি অতটা ভদ্র নই যে অনুমতি না দিলে খালি মুখে ফিরে যাব৷ জোর করেই কিস করে দিব৷ এমন ভাবে করে দিব দুদিন কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। ‘

‘ ছিঃ ‘

মুখ ঝামটা মেরে দিল নামী। সুহাস বলল,

‘ তার মানে তুমি অনুমতি দেবে না? ‘

নামী কড়া গলায় বলল,

‘ না। ‘

‘ অর্থাৎ কঠিন চুমু চাচ্ছ? গোটা এক বছর জমিয়ে রাখা বিধ্বস্ত চুমুর বর্ষণ? ‘

হৃৎস্পন্দন ধড়াস ধড়াস শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠল। নামী আর শক্তি প্রয়োগ করছে না। আর না সুহাসের থেকে ছোটার আকুতি জানাচ্ছে। সুহাস অনুভব করল নামীর শরীর শীতল আর নরম হয়ে এসেছে। নিঃশ্বাসে বেড়েছে গভীরতা। আর অনুমতির অপেক্ষা করল না সে। কিন্তু অনুমতি না দেয়াতে শাস্তি দিল ঠোঁটে ঠোঁটে উত্তপ্ত ঘর্ষণে। মৃত্তিকা ভিজল আকাশ চেড়া বর্ষণে। কোনো এক নারীর কোমল ঠোঁটজোড়া ভিজল কোনো এক পুরুষ ঠোঁটের উত্তপ্ত চুমু বর্ষণে। দু’জোড়া হৃদয়ও ভিজে ওঠল হৃদয় চেড়া বর্ষণে। আজ যেন উথাল-পাতাল বর্ষণে শান্ত আকাশ, উত্তপ্ত মাটি, তৃষ্ণার্ত হৃদয় সমস্তই ভিজিয়ে তোলার দিন৷

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা

|২২|

আজ সূর্যি মামার দেখা মেলেনি। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। জানালা ঘেঁষে উদাস মুখে বসে আছে নামী। ঐ আকাশের সকল মেঘ যেন তার মুখে ভর করেছে আজ৷ দেখতে দেখতে তাদের জীবনে কেটে গেছে তিন বছর। পড়াশোনা, বন্ধুত্ব, প্রেম, ঘুরাফেরা, মান অভিমান সবই ছিল বছর জুড়ে। কোনোটাতেই এক রত্তি কমতি ছিল না। এরই মধ্যে ইতি ঘটেছে সুহাস, সৌধদের ম্যাডিকেল পড়ারও। তারা এখন ঢাকা ম্যাডিকেলে ইন্টার্নি করছে। গতকাল ছিল নামী, সুহাসের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। ঠিক রাত বারোটার সময় নামীর দ্বারে এসেছিল সুহাস। প্রিয়তমাকে বিয়ের চারবছর পূর্তির অভিনন্দন জানিয়েছে। গতকালের সেই সুখে পরিপূর্ণ স্মৃতি গুলো মনে পড়ছে বারবার। আগে সুহাস খুব একটা দায়িত্বশীল ছিল না৷ ইদানীং বেশ দায়িত্বশীল হয়েছে। শিখেছে প্রেমিক এবং স্বামী হিসেবে প্রেমিকা, বউকে বিশেষ যত্ন নিতে৷ ইন্টার্নি করে অল্পস্বল্প আয় করে সে৷ যা দিয়ে বউকে ছোটোখাটো উপহার দেয়। অবশ্য সবার কাছে ছোটোখাটো হলেও নামীর কাছে এগুলোই বিশাল ব্যাপার। অদ্ভুত সুখ আর সীমাহীন ভালোবাসার। সেদিনের দুরন্ত ছেলেটা যে একদিন তাকে ভালোবেসে এতটা উজার করে দেবে একবিন্দুও টের পায়নি৷ ভেবেছিল ওখানেই বোধহয় সব শেষ। ওখানেই সে একদম নিঃশেষ। এই পৃথিবীতে আসলে শেষ বলতে কিছু নেই৷ যেখানেই শেষ ঘটে, সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন সম্ভাবনার।

গতরাতে নামী, সুহাস দু’জন মিলে একসাথে খাবার খেয়েছে। নামীর হাতে খেতে ভীষণ ভালোবাসে সুহাস৷ নামীও সুযোগ হলেই নিজ হাতে যত্ন নিয়ে খাইয়ে দেয় তাকে। খুব ছোটোবেলা থেকেই নিজ হাতে খেতে শিখেছে সুহাস আর সিমরান৷ বাবা, মা দু’জনই ব্যস্ত মানুষ। তাদের ভাই, বোনকে দেখাশোনা করত কাজের লোকেরা। তাই মা তিন বছর বয়স থেকেই নিজহাতে খেতে শিখিয়েছে৷ বাসার কাজের লোকের হাতে ছেলেমেয়েরা খাবার খাবে এটা একদম পছন্দ করত না উদয়িনী৷ মায়ের সে শিক্ষায় মানুষ হয়ে কখনো কারো আদর, স্নেহভরা হাতে ভাত খাওয়া হয়নি। যখন থেকে নামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। যখন থেকে দু’জন দু’জনের পরিপূরক হতে শুরু করেছে তখন থেকেই দু’জন একসাথে খেতে বসলে নামীর হাতেই খাওয়া হয়। একদিন আবদার করেও বসে কখনো সুযোগ হলে সিমরানকেও যেন খাইয়ে দেয়। নামী বুঝতে পারে এটা শুধুই আবদার নয়৷ ভালোবাসা, যত্নের অভাবে নিমজ্জিত থাকা বোনটিকে একটু যত্ন আর ভালোবাসার অনুনয়। এরপর থেকে সিমরান যখনি আসে তাকেও নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। এতে করে শশুর, ননদ, স্বামী সবার সঙ্গে খুবই মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মেয়েটার।

রাতে খাবারের পাট চুকিয়ে সুহাসের দেয়া শাড়ি পরে একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটায়। চার বছরে সুহাসের সঙ্গে অসংখ্য সময় কাটালেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে স্বাভাবিক দৈহিক মিলন ঘটে, তা কেবল একবারই ঘটেছিল৷ তাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীতে। সৌধদের বাড়িতে। সেদিন সৌধদের বাড়িতে কাজের লোক আর সৌধ ছাড়া কেউ ছিল না৷ তাই প্রিয় বন্ধু আর বোন নামীকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল সৌধ৷ সেই মিলনের পর থেকেই যেন সুহাসের মাঝেকার পরিবর্তন গুলো গাঢ় হতে থাকে৷ এক নামীর মাঝেই খুঁজে পায় সকল সুখ। এর আগে নামীর সঙ্গে মন দেয়া, নেয়া চললেও অভ্যেসের দোষে পুরোনো গার্লফ্রেন্ডদের সঙ্গেও সময় কাটিয়েছে বারকয়েক। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কম ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়নি৷ কিন্তু যেদিন থেকে পরিপূর্ণ ভাবে স্ত্রী রূপে নামীকে পেয়েছে। সেদিন থেকে পিছু ফিরে তাকায়নি একবারো। সেইরাত কখনো ভুলার নয়। যেই রাতে ভালোবেসে নিজের সবটা উজার করে দিয়েছে নামী। সে রাতের পর দ্বিতীয় রাত তাদের জীবনে এলো ঠিক এক বছর পর। শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর নিকট এসেছে সুহাস। দ্বিতীয়বারের মতো স্ত্রীর দেহ, মনে তুলেছে আদিম সে ঝড়। যে ঝড়ের তাণ্ডবে মেয়েটা শতসহস্র বার তার বুকে মরণাপন্ন হয়ে থাকে। মাত্র কয়েকঘন্টা কাছে পেয়ে যতটা সুখ পায় নামী তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা পায় যখন মানুষটা দীর্ঘ সময়ের জন্য দূরে চলে যায়৷ এখনো পাচ্ছে সেই যন্ত্রণা। হৃদয় জুড়ে লেপে আছে সুহাস, শরীর জুড়ে এঁটে আছে সুহাস। অথচ সামনে নেই সুহাস। তার দেয়া প্রতিটা স্পর্শকে স্মরণ করে এখনো বুকে শিহরণ জাগছে। দেহ জুড়ে রয়েছে তার দেয়া আদুরে চিহ্নগুলোও। যা দেখে একই সঙ্গে সুখ, দুঃখ দু’টোই হয়। কবে তারা একসঙ্গে থাকতে পারবে। কবে থেকে তার প্রতিটা রাত কাটবে সুহাসের বুকে মুখ লুকিয়ে? কবে হবে তার সুখে ভরা একটি সংসার? বিষণ্ণ চোখ দু’টো এবারে ঝাপসা হয়ে ওঠে। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া বুজে ফেলে আচমকা। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে৷ তাকায় সহসা, কোলের উপরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে। দু’টি শব্দের ম্যাসেজ লিখে সেন্ট করে প্রিয়তমকে,

‘ মিস ইউ। ‘

চোখের পানি মুছে পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে বসল নামী৷ নিধি, প্রাচী চলে যাবার পর এই নতুন বাসায় ওঠেছে সে। বাসাটা সুহাসই ভাড়া করে দিয়েছে। দু’টো বেডরুম, একটি ড্রয়িং, ডাইনিং এবং একটি কিচেনের ছোটোখাটো ফ্ল্যাট। এক রুমে নামী একাই থাকে৷ আরেক রুমে সুহাসের পরিচিত দু’জন ছোটোবোন। সিমরানের স্কুল ফ্রেন্ড এরা। কুমুদিনীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স করছে। দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট’স। ওরা দু’জন থাকে দু’জনের মতো আর নামী থাকে নামীর মতো৷ সুহাস মাঝেমাঝে এখানে আসে, সময় কাটায় এই যে রাতটা কাটিয়ে গেল৷ এতে করে ওদের বা বাসার মালিকের কোনো সমস্যা হয়নি৷ কারণ সবাই জানে সুহাস, নামী স্বামী-স্ত্রী। পড়াশোনার জন্যই আলাদা থাকতে হচ্ছে দু’জনকে। এছাড়া সিমরান প্রায় রোজই একবার করে আসার চেষ্টা করে৷ এই তিন বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনে দূরত্ব কমেছে সিমরান আর নামীর মধ্যেও। ননদ, ভাবি নয়৷ তারা এখন একে অপরের শুভাকাঙ্ক্ষী। সিমরান নামীকে ভাবি নয় বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে মূল্যায়ন করে৷

সময়ের স্রোতে সবকিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পরিবর্তন ঘটেনি উদয়িনীর মাঝে। সে নিজের জেদে অটুট। যা বাড়িয়ে তুলেছে ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার দূরত্ব। স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব নতুন নয় পুরোনো। শুধু কাগজে, কলমেই তারা স্বামী-স্ত্রী। সম্পর্ক কেবল দুটো সন্তানের বাবা, মা পর্যন্তই। সোহান খন্দকার এখন আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। বাড়িতে আসেন শুধু ছেলেমেয়েদের জন্য। মাসে একবার কিংবা কয়েকমাস পরপর৷ স্ত্রীর মুখদর্শন করে না বহুদিন। ভুলবশত একবার, দুবার হয়ে যায় তখন যখন ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক ঘরে না থাকলেও এক ছাদের নিচে থাকতে হয়। তবু উদয়িনীর হৃদয় নরম হয়নি। চূর্ণ হয়নি অহংকার। ভাঙেনি ভুল। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যারা ভেঙে যাবে তবু মচকাবে না। উদয়িনী সেই মানুষদের মধ্যেই পড়ে। এ পৃথিবীতে সেই মানুষ গুলো খুব বোকা হয়৷ যারা বলে ভাঙব তবু মচকাব না। নিজেদের ভেঙে চুরমার করে দিতে যারা প্রস্তুত। তবু মচকাবে না একচুল৷ অথচ তারা কখনো ভেবে দেখে না। মচকানো জিনিস সারিয়ে তোলা যত সহজ ভাঙা জিনিস সারিয়ে তোলা ততই কঠিন। যা একবার ভেঙে যায় তা কখনো জোড়া লাগে না৷ সম্পর্কের সুতোয় টান পড়েছে বহুদিন। ছিঁড়ে যাওয়ার আগে উদয়িনী কি শুধরাবে? উত্তর দেবে একমাত্র সময়।
.
.
কোরবানির ইদের জন্য বেশকিছু দিন ছুটি পেয়েছে সৌধ। বড়ো আপু স্মৃতির বিয়ে ইদের তৃতীয় দিন। হাজব্যান্ড কানাডায় স্যাটেলড। বিয়ের পর বউকেও নিয়ে যাবে৷ সুজা এমপির একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তোড়জোড় চলছে খুব। ধুমধাম করে মেহেদি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত সবমিলিয়ে জমকালো আয়োজনের করা হচ্ছে। সৌধর সকল বন্ধু, বান্ধুবী, স্কুল, কলেজ মিলিয়ে সকল স্যার, ম্যামকেও আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছে। বাকি শুধু একজন সে হলো সৌধর হৃদয়েশ্বরী নিধি। ঢাকাতে সুহাস সে আর আইয়াজ একসঙ্গেই থাকে। নিধি, প্রাচী থাকে হোস্টেলে। গতকাল ভোরবেলা নিধির মামা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থতার মাত্রা কতখানি জানা নেই। নিধি সেভাবে কিছু বলে যেতে পারেনি প্রাচীকে। তেমন কিছু না জানিয়েই ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে মেয়েটা। প্রাচীর কাছে দুপুরে এসব জানতে পেরে প্রচণ্ড রাগ করে সৌধ। ভোরবেলা মেয়েটা একা এতদূর চলে গেল! ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। প্রাচীর ডিউটি ছিল বলে সঙ্গে যেতে পারেনি। তাই বলে তৎক্ষনাৎ তাকে একবার ফোন দেবে না? এবারে প্রাচীর প্রতিও বিরক্ত সে৷ এরপর কেটে যায় একদিন। পরের দিন নিধির ডিউটি থাকা সত্ত্বেও সে ঢাকায় ফিরে আসেনি৷ ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। ওদিককার কী খবর কে জানে? কী পরিস্থিতিতে আছে মেয়েটা তাও অজানা।
একদিকে বোনের বিয়ে আসন্ন অন্যদিকে হুট করে নিধি উধাও।

পাক্কা তিনদিন যাবৎ উধাও নিধি৷ সৌধর অবস্থা করুণ। ইদের ছুটি পড়ে গেছে এরই মধ্যে। কিন্তু বাড়ি ফেরার উদ্যম নেই কারোরি। একদিকে নিধির চিন্তা অপরদিকে সৌধ। বিপন্ন অবস্থা বন্ধুদের৷ শেষমেশ ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করতে দেখা গেল সৌধকে। মুখাবয়ব বিধ্বস্ত। পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারে না৷ সৌধর মতো কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষরা তো একদমই না৷ কিন্তু মনের কান্না কি থামানো যায়? যায় না তো। থামাতে পারছে না সৌধ। তিনরাত নির্ঘুম কাটিয়ে চোখ, মুখ ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে৷ ওর রক্তিম চোখ দু’টোয় তাকালেই বুক ধক করে ওঠছে। কারো সাথে কথা বলে না। আর না কেউ সাহস দেখায় কথা বলার। খাবার বেলায় সুহাসের জোরাজুরিতে একটুআধটু খেয়ে ওঠে পড়ে৷ আর সারাবেলা কাটায় ঘনঘন পানি খেয়ে আর ফোন দেখে৷ ঘনঘন নিধির ফোনে কল করতেও দেখা যায়৷ কিন্তু ওপাশে রিং বাজে না। আর না কেউ রিসিভ করে সৌধর বুকের আগুন নেভায়। হঠাৎ ব্যাগপত্র গোছাতে দেখে সুহাস, আইয়াজ দু’জনই নিজেদের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। ওরা ভেবেছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরুবে সৌধ৷ কিন্তু ওদের ভুল প্রমাণ করে গম্ভীর গলায় সৌধ বলল,

‘ আমি ফুলবাড়িয়া যাব। তোরা যেতে চাইলে আসতে পারিস। নয়তো বাড়ি ফিরে যা। ‘

চমকে গেল সুহাস৷ চমকাল আইয়াজও। বেচারার ধৈর্যের সব বাঁধই ভেঙে গেছে বুঝতে পেরে সুহাস বলল,

‘ আমরা যাব তোর সাথে। ‘

আইয়াজ বাঁধ সেধে বলল,

‘ নিধির পরিবারে যদি সমস্যা হয়ে থাকে? ওর বাবা, কাকারা নাকি সাংঘাতিক মানুষ। হিতে বিপরীত হবে না তো? ‘

কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সৌধ। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল নিমিষেই । আইয়াজ ঢোক গিলল। ঈষৎ হাসার চেষ্টা করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ তুই যেতে চাইলে যাবি বারণ নেই তো। কিন্তু গেলে কী সমস্যা হতে পারে স্মরণ করিয়ে দিলাম। সবশেষে আমরা তো আর নিধির ক্ষতি হবে এমন কিছু করতে পারি না। ‘

সৌধর মনের অস্বস্তি তীব্র হলো। সে ওখানে গেলে নিধির ক্ষতি হবে এটা বিশ্বাস হচ্ছে না৷ বারবার মন বলছে সে ওখানে না গেলেই ওর ক্ষতি হবে। তাই তো আর মন মানছে না। নিজেকে আর আঁটকেও রাখতে পারছে না। অদৃশ্য এক সুতো যেন টানছে খুব। যেতে হবে তাকে। শিঘ্রই যেতে হবে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি তিন বন্ধু। এমনই সময় সুহাসের ফোন বেজে ওঠল। স্ক্রিনে নিধির নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ দোস্ত নিধির কল। ‘

মুহুর্তেই ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল সৌধ। বুকের পাটা হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার। হাত, পা কাঁপছে ভীষণ। সে কাঁপা হাতেই ফোন রিসিভ করল। অমনি শুনতে পেল আত্মায় প্রশান্তি দেয়া কণ্ঠস্বর,

‘ এই সুহাস কই তুই? ‘

‘ নিধি! ‘

থমকানো কণ্ঠ সৌধর। যা শুনে নিধির কণ্ঠও রোধ হয়ে এলো। সৌধ থমকানো স্বর এবার ব্যগ্রতায় রূপ নিল। অধৈর্য গলায় সে বলল,

‘ তুই কোথায়? কেমন আছিস নিধি? কী হয়েছিল তোর, ফোন বন্ধ ছিল কেন? ‘

‘ ভাইই, সব প্রশ্নের উত্তর দিব। আমি আর প্রাচী তোদের বাসার সামনে আছি। বাসায় থাকলে জলদি চলে আয়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে একদম সিএনজি করে বেরিয়েছি। এটা নিয়েই বাড়ি ফিরে যাব। আসব একদম ছুটি কাটিয়ে। তার আগে দেখা করে যাই তোদের সঙ্গে। ‘

তিন বন্ধু বেরিয়ে এলো। নিধি প্রাচীও সিএনজির ভিতর থেকে বেরিয়েছে। সৌধ সামনে আসতেই নিধি বিস্মিত হয়ে গেল! বড়ো বড়ো চোখ করে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ এ কী অবস্থা তোর? চোখ মুখের এ কী হাল! মনে হয় তিনদিন না ঘুমিয়ে গাঞ্জা খাইছিস। ‘

সুহাস, আইয়াজ নিধির ওপর প্রথমে রাগান্বিত থাকলেও পরমুহূর্তে ওর কথাবার্তা শুনে হেসে ফেলল। নিধি কথা বলার ফাঁকে সৌধর কপালে একবার হাত রাখল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ জ্বর তো আসেনি। ও’কে এমন লাগছে কেন? তোদেরও তো চোখমুখ শুঁকনো। আরে ভাইই আমি মরে যাইনি যে তোদের অবস্থা এমন হবে। আমাদের ওখানে চারদিন যাবৎ বিদ্যুৎ ছিল না। ফোনে চার্জ ছিল না বলে বন্ধ দেখিয়েছে। তাছাড়া মামা এতটাই অসুস্থ ছিল যে ব্যস্ততায় আমি ফোন করারও সুযোগ পাইনি। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে সৌধর কপাল থেকে হাত সরিয়ে একটু সরে যাচ্ছিল নিধি৷ কিন্তু সরতে পারল না। সকলের সম্মুখে আকস্মিক নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সৌধ। বরফের মতো শীতল আর শক্ত হয়ে গেল নিধি। দু-চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল পাশে দাঁড়ানো সুহাস, আইয়াজের দিকে৷ ওরা ইশারা করে বোঝাল, ‘ প্লিজ নিধি রাগ করিস না। ওকে একটু সামলে ওঠতে দে। হুট করে তোর সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে ছেলেটা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ‘ ওদের ঠোঁট নাড়ানো, ইশারায় বলা কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হলো না নিধির৷ আকস্মিক বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব করল সে। স্মিত হেসে নিজের কষ্ট গুলো আড়ালে রেখে সৌধর পিঠে হাত রাখল সন্তর্পণে। টের পেল সৌধর হৃৎস্পন্দনের ভয়াবহ গতি। যা আচমকা বুক কাঁপিয়ে দিল তার। চোখ বুজে এলো আপনাআপনি। দু-চোখের কার্ণিশ বেয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুজল। সৌধর ভারী নিঃশ্বাস, হৃৎস্পন্দ সমস্তই অনুভব করল নিধি৷ তার সর্ব দেহে, সর্ব মনে কাঁপন ধরিয়ে দিল সৌধর প্রগাঢ় অনুভূতি। নিজেকে দূর্ভাগিনী মনে করবে নাকি সৌভাগিনী? এক কঠিন দ্বিধায় দিশেহারা হলো মন৷

| চলবে |
®জান্নাতুল নাঈমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে