#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৭
লিভিং রুম থেকে গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসা সিমরান সে শব্দ শুনেই লাফিয়ে ওঠে বলল,
‘ ও মাই গড! সৌধ ভাই গিটার বাজাচ্ছে! ‘
নামী ওর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। আকস্মিক লাফিয়ে ওঠায় ভয় পেয়ে গেল সে। শুনেছিল সুহাস, সৌধ দুজনই দারুণ গিটার বাজাতে পারে। গানের গলাও অসাধারণ। তাই জিজ্ঞেস করল,
‘ কী করে বুঝলে সৌধ ভাইয়া? তোমার ভাইয়াও তো হতে পারে। ‘
সিমরান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
‘ উহুম কখনোই না। বিলিভ না হলে চলো দেখলেই বুঝবে আ’ম রাইট৷ এত্ত স্লোলি গিটার ব্রো বাজাতে পারে না। ব্রো মানেই ধুমধাড়াক্কা। ‘
বলতে বলতেই আয়নায় নিজেকে দেখে ত্বরিত নামীর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ থ্যাংকিউ সো মাচ নামীপু। এবার জলদি রেডি হয়ে নাও একসঙ্গে ওখানে যাব। ‘
বারকয়েক পলক ফেলে তৈরি হয়ে নিল নামী। এরপর সিমরান নিজেই তার হাত চেপে ধরে নিয়ে গেল লিভিং রুমে। নিধি, প্রাচী মিলে বেশ ভালোই বুঝিয়েছে সিমরানকে। শুধু তাদের বুঝানোতে অবশ্য এতটা গলেনি সিমরানের মন। কথার ছলে যখন শুনল নামীকে সৌধ নিজের বোনের চোখে দেখে৷ তাছাড়া এ বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। অথচ নামী এ বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও পার্টিতে অংশগ্রহণ করবে না৷ এটা একদমই ভালো দেখায় না। বিশেষ করে সৌধর চোখে। বনেদি পরিবারের ছেলে সৌধ। তাদের পরিবার সম্পর্কে নিধি, প্রাচীর থেকেও সুহাস, সিমরান বেশি অবগত। পারিবারিক ভাবে ঐ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক বেশি গাঢ়৷ চৌধুরী বাড়ির প্রায় সব অনুষ্ঠানে সোহান খন্দকার, সুহাস, সিমরান উপস্থিত থাকে৷ উদয়িনীও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করে৷ সময় সাপেক্ষে হয়ে ওঠে না৷ একটা যৌথ পরিবারের বন্ধন কেমন হয় তা সৌধর পরিবার দেখে শেখা উচিত। অমন পরিবারের ছেলে সৌধ৷ তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও অজানা নয় সিমরান। দেখা গেল নামীর অনুপস্থিতি দেখে তাদের দু’ভাইবোনের ওপর নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলো। যে ধারণা তার জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে৷ সিমরান কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। সমস্যা তার বাবা, মা আর নামীর মধ্যে। তার ভাইও জড়িয়ে। সে এসবে জড়িয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখে খারাপ হতে চায় না৷ তাই মায়ের আদেশ আর নামীর ওপর রাগ দূরে সরিয়ে নামীকে নিজের জন্মদিন পার্টিতে নিয়ে এলো। ওদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে নিধি, প্রাচী মিটিমিটি হাসছিল৷ সুহাস অবাক হয়ে আইয়াজকে বলল,
‘ কীরে কাহিনি কী? সিনু ওর সাথে! ‘
আইয়াজ নিধি, প্রাচীকে দেখিয়ে বলল,
‘ সব এদের জাদু। ‘
সিমরান, নামী চলে এলেই সৌধর হাত থেমে গেল। নামীকে দেখে একহাত দূরে বসা নিধির দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে একটি হাসি উপহার দিল। নিধি মাথা দুলিয়ে, ভ্রু নাচিয়ে বুঝাল,
‘ এই নিধির পক্ষে সব সম্ভব। ‘
সৌধ আপ্লুত হয়ে ঠোঁটজোড়া চোকা করে চুমু দেখাল। নিধি বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে আকস্মিক সবার সামনেই মারতে শুরু করল সৌধকে। সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল ওদের দিকে৷ নামী আর সিমরানও দুই বন্ধুর খুনসুটি দেখে হাসল৷ সৌধ নিধিকে থামাতে ওর দু-হাতের কব্জি ধরে বলল,
‘ কী আশ্চর্য! হুটহাট আক্রমণ করছিস। শরীর ঠিক আছে তোর? ‘
সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী তিনজনই সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে। ওরা তিনজন স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিধি এমনি এমনি ক্ষেপেনি৷ সৌধ নাটক করছে এও স্পষ্ট। এই নাটক কেন করছে তাও বুঝল ওরা৷ দু’জন জুনিয়র সদস্য উপস্থিত বলেই সৌধ এই নাটকটা করতে বাধ্য হচ্ছে। মারতে মারতে হাত ব্যথা হয়ে গেলে থামল নিধি৷ ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল সোফায়। প্রাচী ব্যস্ত হলো সিমরানের কেকের ছবি তুলতে। নিধি হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে নামী সিমরানকে খেয়াল করে নামীকে বলল,
‘ খুব সুন্দর সাজিয়েছ তো সিনুকে। ‘
সিমরান খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কোমরের দু’পাশের গাউন ধরে এগিয়ে গেল ভাইয়ের সামনে। বলল,
‘ কেমন লাগছে আমাকে ব্রো বললে না তো! ‘
প্রশ্নটা সুহাসকে করলেও নামী বাদে সবাই এক সুরে বলল,
‘ সো প্রিটি আওয়ার বেবিডল। ‘
খুশিতে আত্মহারা হয়ে সকলের দিকে তাকাল সিমরান। সৌধ সহ সবাই ওঠে দাঁড়িয়েছে। সুহাস বোনের দু’কান চেপে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ হ্যাপি বার্থডে মাই প্রিন্সেস সিস্টার। ‘
একে একে সবাই উইশ করল। নিধি সুহাসকে বলল,
‘ সিনুকে সব ড্রেস আর সব সাজেই মারাত্মক লাগে তাইনারে৷ ‘
সুহাস বেশ ভাব নিয়ে নামীর দিকে এক ঝলক তাকাল৷ এরপর বলল,
‘ বোনটা কার দেখতে হবে না? ‘
প্রাচী বলল,
‘ তোরা কি এভাবেই সময় শেষ করবি? কেকটা কাটবি কখন? সিনু তুই এদিকে আমার কাছে আয়। ‘
সিমরান সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে গেল। দেয়ালের একপাশ জুড়ে হালকা গোলাপি রঙের পর্দা টাঙানো। তার সামনে হালকা গোলাপি, নীল রঙের বাটারফ্লাই বেলুন দিয়ে বৃত্ত আকারে ডেকোরেট করা। বৃত্তের মধ্যবর্তী স্থানে লেখা ” হ্যাপি সেভেনটিন্স বার্থডে সিনু” সবটায় দৃষ্টি বুলিয়ে কেকের দিকে তাকাল সিমরান৷ তার একদম বাচ্চা বয়সের একটি ছবি বসানো কেক। কেকটাই দেখানো হয়নি তাকে। এখন দেখে ভাইয়ের দিকে বিস্মিত চোখে তাকাল। মৃদু হাসল সুহাস। বোনের খুশি দেখলেই অদ্ভুত শান্তি লাগে তার। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত খুশি ওর পায়ের কাছে সমর্পণ করতে। বার্থডে কেকের পুরো আইডিয়াই সৌধর। নিজ দায়িত্বে নিজ খরচে সবটা করেছে ও৷ তাই সৌধর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ তোর ভাই কেমন অকর্মণ্য জানিস তো? এসব সৌধর মাথা থেকে এসেছে ইভেন কেকটা সৌধর তরফ থেকেই তোর বার্থডে গিফ্ট। ‘
আচমকা সৌধর দিকে তাকাল সিমরান৷ সৌধ ওর তাকানো দেখে মুচকি হাসি উপহার দিল। বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠল মেয়েটার। উত্তেজনায় গা শিরশির করছে। এদিকে নিজেকে অকর্মণ্য বলে হঠাৎ নামীর দিকে চোখ পড়ে সুহাসের। দেখতে পায় নামী তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। অমনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এমনিতেই এই মেয়ের ওপর ভয়ানক রেগে আছে সে। সকালের ব্যাপারটা নিয়ে মারাত্মক রাগান্বিত। আর এই মেয়ে কিনা গা জ্বালানো হাসি দিচ্ছে! সে অকর্মণ্য এটা বোনকে জাস্ট ফর্মালিটি করে বলেছে। তাই বলে এভাবে হাসার কী আছে? ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাস ফেলল সুহাস৷ নামী ততক্ষণে সুহাসের ক্ষুব্ধ দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিধির সঙ্গে সিমরানের কাছে চলে গেছে। কেক কাটার আগে সৌধ সবাইকে সাবধান করে দিল কেউ যেন কেক ছোড়াছুড়ি না করে। কিন্তু সুহাস মনে মনে ছক কষে ফেলেছে নামীকে একটা শিক্ষা দেবে। কোন সাহসে সে পাশের বাড়ির মহিলার সঙ্গে মিষ্টি মুখে কথা বলেছে? কোন সাহসেই বা পাশের বাসার আন্টি এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে যায়? এটা ঠিক কোন ধরনের ইতিহাস? যে জামাইয়ের কাছে বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসে ছিঃ! পরোক্ষণেই আবার মত পাল্টাল। পাছে দেখা হলো নামীদামি তেজ দেখিয়ে পার্টি থেকেই চলে যাবে।
মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটল সিমরান৷ সর্বপ্রথম কেক খাইয়ে দিল সুহাসকে। এরপর সৌধকে খাইয়ে দিতে গেলে সৌধ নিজে না নিয়ে পাল্টা ওকেই খাইয়ে দিল। মৃদু হেসে নাজুক ভঙ্গিতে একে একে সবাইকে কেক খাইয়ে শুরু করল কিছু সেলফি তুলতে। সবার সাথে সেলফি নিয়ে নামীর সাথে নিতেও বাদ রাখল না। সব শেষে সেলফি নিতে গেল সৌধর কাছে। সৌধ দু’টো সেলফি নিয়ে হঠাৎ অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ সিনু, আমাদের ড্রেস তো ম্যাচিং হয়ে গেছে। ‘
সিমরান মুখ ফসকে বলে ফেলল,
‘ কাপল লাগছে না? ‘
সৌধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ উহুম, যতই ম্যাচিং হোক বাচ্চাদের সাথে কাপল লাগে না। ‘
কথাটা বলেই কিছু একটা ভেবে আবার বলল,
‘নিধিরে ডাক তো বল আমি ডাকছি। ‘
মুখটা চুপসে গেল সিমরানের। বাচ্চা, বাচ্চা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। কবে সে বড়ো হবে? কবে অনার্সে পড়বে? কবেই বা সৌধ ভাইকে প্রপোজ করতে পারবে? বুকে অস্থিরতা শুরু হলো সিমরানের। নিধির কাছে গিয়ে বলল,
‘ আপু সৌধ ভাইয়া ডাকে। ‘
নিধি আইয়াজের সাথে কয়েকটা সেলফি নিয়ে সৌধর কাছে গেল। সৌধ ওর সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নিতে নিতে নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ চুলটা ছেড়ে দে। ‘
নিধি আড়চোখে তাকিয়ে ওর মতো করেই বলল,
‘ না রে গরম লাগে খুব। ‘
সৌধ এবার মুখটা আরেকটু নিচু করে বলল,
‘ তোর বাঁধা চুলে আমার আরো বেশি গরম লাগছে। ‘
সৌধর দৃষ্টি আর কণ্ঠ শুনে চাপা আর্তনাদ করে ওঠল নিধি,
‘ মানে! ‘
‘ ঘাড়ের এই তিলটা অসহ্য করে তুলছে আমায়। চুল না ছেড়ে ওটা আড়াল না করলে না জানি কখন জাপ্টে ধরে ফাঁকা ঘরে নিয়ে যাই আর চুমুতে চুমুতে অসহ্য করে তুলি তোকে! ‘
ঘাড়ে ঠিক যেখানটায় তিল সেখানে তর্জনী ছুঁয়ে কথাটা বলল সৌধ। কান গরম হয়ে চোখ দু’টি বড়ো হয়ে গেল নিধির। সর্বাঙ্গে কম্পন ধরে গেল নিমিষেই। অবিশ্বাস্য চোখে কয়েক পল তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। এরপর আচমকা মুখটা কঠিন করে বলল,
‘ আমাদের বন্ধুত্বের সমাপ্তি টানতে না চাইলে নিজেকে কন্ট্রোল কর সৌধ। ‘
সহসা সৌধর মুখো ভঙ্গি পাল্টে গেল। নিধি খেয়াল করল সৌধর চোয়াল জোড়া ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। ঢোক গিলে আশপাশে তাকাল সে। সবাই সেলফি নিতে ব্যস্ত। এরপর সৌধর দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
‘ সৌধ… ‘
বাকিটুকু আর বলতে দিল না সৌধ। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো৷ অমনি খপ করে হাত চেপে ধরল নিধি৷ বলল,
‘ রাগছিস কেন? ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে সৌধ বলল,
‘ রাগব কেন? তুই ভুল বা অন্যায় কিছু বলিসনি। ‘
নিধি অপরাধীর সুরে বলল,
‘ সৌধ প্লিজ, আমি জানি তুই ভয়ংকর রেগে গেছিস।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ। আশপাশে তাকিয়ে দেখল তাদের দিকে কারো নজর নেই। তাই চট করে নিধির হাত টেনে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। এরপর দরজাটা সপাৎ শব্দে বন্ধ করে দিল।
নামী প্রাচীর সাথে ছবি তোলার ফাঁকে এ দৃশ্যটা দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। তাকাল ভাইয়ের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকা সিমরানের দিকে৷ এরপর কে কে সিমরানের জন্য কী গিফ্ট এনেছে এসব দেখানো শুরু করল প্রাচী৷ সিমরান সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এমন সময় নামী বলল,
‘ আমার গিফ্ট তোলা রইল সিমরান। পেয়ে যাবে। ‘
সুহাস ফোড়ন কেটে বলল,
‘ আমার বোন বাসি জিনিস নেয় না। ‘
সুহাস ভেবেছিল নামী তার সঙ্গে এবার তর্ক দেবে৷ কিন্তু না সে তর্ক দিল না। হঠাৎই মনটা খুব খারাপ করে চুপ হয়ে গেল। সিমরান তাকে পছন্দ করে না। ভেবেছিল বার্থডে পার্টিতেও আসা হবে না৷ তাই গিফ্ট নিয়ে ভাবা হয়নি৷ অথচ আসা ঠিকি হলো, গিফ্ট দেয়া হলো না৷ এ নিয়ে আর কেউ ছাড় দিলেও সুহাস দিল না৷ আত্মসম্মানে আঘাত পড়ল খুব। তাই চুপ রইল সে। তার এই চুপ থাকাটাও সহ্য হলো সুহাসের। প্রথমে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করল। লাভ হলো না বলে শেষে ভদ্র হয়ে এসে বসল নামীর পাশে। এতে শুধু নামীর সাথে হকচকিয়ে গেল উপস্থিত সবাই। সিমরান বলল,
‘ নামীপু তো আমাকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। এটাও তো একটা উপহার৷ ‘
প্রাচী ওর কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ বাহ দারুণ বললি তো। ‘
নামী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সিমরানের দিকে। সিমরান মুচকি হাসি দিল। সুহাস বলল,
‘ আমার বোনকে পটালে কী করে? ‘
চমকে তাকাল নামী। সুহাসের মুখটা এক পলক দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সিদ্ধান্ত নিল ওঠে যাবে৷ সুহাসের পাশে বসার রুচি নেই তার৷ কিন্তু তার আগেই সুহাস আবার বলে ওঠল,
‘ যেভাবে পাশের বাসার ব্যাংকারকে পটিয়েছ? মানতে হবে চয়েজটা! কালাচাঁদ তাতে কি ব্যাংকার তো। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল নামীর। এসব কী বলছে সুহাস? কে কালাচাঁদ, কেই বা ব্যাংকার? মনের প্রশ্ন মুখে করতেই সুহাস ঠোঁট কামড়াল। নামী কি এসব জানে না? কৌতূহলী চিত্তে বলল,
‘ আমাদের পাশের বাসার ইয়ামিনকে চেনো না? ব্যাংকে জব করে? ‘
বিরক্ত সূচক শব্দ করে নামী জবাব দিল,
‘ না। ‘
***
দরজার কপাটের সাথে একদম পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিধি। দু’হাত কপাটে রেখে মধ্যস্থে নিধিকে বন্দি করে রেখেছে সৌধ। লাগাতার প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
‘ আমি রাগি তাতে তোর কী? বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। অপরাধ হয়ে গেছে। শাস্তি সরূপ বন্ধুত্বের শেষ টানবি৷ আমি রাগলাম না মরলাম তোর কী যায় আসে হু? ‘
সৌধর মুখের ভারিক্কি নিঃশ্বাস গুলো মুখের ওপর পড়তেই চোখ বুজে মুখ ঘুরিয়ে রইল নিধি। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ছাড় সৌধ। পাগলামি করিস না। ‘
‘ ধরে রাখিনি। ‘
‘ বেঁধে রেখেছিস। ‘
চ্যাঁচিয়ে বলল নিধি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সৌধর। সুহাসের মতো দরজায় চিপায় না পড়লে এই মেয়েও মুখ খুলবে না৷ তাই ঘাড় বাঁকিয়ে সুইচবোর্ডে নজর বুলাল। এরপর তাকাল নিধির সরল মুখটায়। বলল,
‘ সোজা কথায় স্বীকার করবি না যখন বাঁকা কাণ্ড করতেই হবে৷ ‘
বলতে বলতেই তড়াক করে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে বাতি নিভিয়ে পুনরায় নিধির সামনে চলে এলো। আকস্মিক রুম অন্ধকার হতে ভয়ে চিৎকার দিল নিধি৷ কিন্তু সে চিৎকার বাইরে গেল না৷ সৌধ ওর মুখ চেপে ধরল। নিধি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে শুরু করল। সৌধ ওকে শান্ত করতে দু’হাতে জড়িয়ে নিল বুকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘ আরে পাগলি মেয়ে ভয় কীসের আমি আছি৷ নে এবার ঝটপট বলত মনের ভেতরটা উগ্রে দে। ‘,
‘ প্লিজ সৌধ। ‘
‘ আই লাভ ইউ সৌধ বল। তারপর ছাড়ব। ‘
‘ বলব না৷ ‘
‘আমিও ছাড়ব না। ‘
কথাটা বলার পর নিধি খেয়াল করল সৌধ শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। ধীরেধীরে মুখ এগুচ্ছে ঘাড়ের দিকে। আচমকা সৌধর বুকে ধাক্কা মারল দুহাতে। বলল,
‘ আমাকে সময় দে দোস্ত প্লিজ প্লিজ প্লিজ। প্লিজ কিছু করিস না৷ মরে যাব, মরে যাব আমি। প্লিজ সৌধ আমাকে সময় দে। ‘
থেমে গেল সৌধ। ত্বরিত গিয়ে লাইট অন করে ছুটে এলো আবার৷ দু’হাতে আলতো করে নিধির গাল চেপে ধরে বলল,
‘ এই, এই কাঁদছিস কেন? কিছু করিনি আচ্ছা সরি সরি। আমারি ভুল সময় চাই তোর? ওকে ফাইন। আরে মেয়ে কাঁদবি না। একদম না। ‘
চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল সৌধ। নিধি ওর বুকে শক্ত দুটো কিল দিয়ে বলল,
‘ তুই খুব খারাপ সৌধ। ‘
আলতো হেসে সৌধ বলল,
‘ তোর জন্য আমি খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারি নিধি৷ আবার তোর জন্যই ভালোদের শীর্ষে থাকতে রাজি। ‘
অশ্রুসিক্ত নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে নিধি। মনে মনে বলল,
‘ অনেক ভাগ্য করে তোর মতো ছেলের ভালোবাসা পাওয়া যায় সৌধ। ‘
সৌধ কি শুনল কথাটা? অদ্ভুত ভাবে হাসল একটুখানি। এরপর ওর গলার ওড়না ঠিক করে দিল নিজ হাতে। চুলগুলোও ঠিক করে দিয়ে বলল,
‘ চল সবাই আমাদের খুঁজছে হয়তো। ‘
***
তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে উদয়িনী। এই তিনদিন নামীকে খুব সাবধানে থাকতে হবে৷ উদয়িনীর সামনে পড়া যাবে না একদম৷ এই মহিলা খুব সাংঘাতিক। অপমান করে কলিজা সিদ্ধ করে ফেলে। আর সে জবাব দিলেই সুহাস রেগেমেগে ভুত হয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়। কয়েকমাস হলো সুহাসের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। পায়ে পা লাগিয়ে এখন আর ঝগড়া করতে আসে না। মাঝেমধ্যেই ছাদে দেখা হয়ে গেলে টুকটাক স্বাভাবিক কথাবার্তা হয় এখন৷ নামীর কেন যেন ভালো লাগে এই সুহাসকে। ইচ্ছে করে ছেলেটাকে ভালোবেসে আরো বদলে দিতে৷ যে ছেলে কয়েকটা কড়া কথায় এতটুকু পরিবর্তন হতে পারে। সে ছেলেকে ভালোবাসা দিয়ে বুঝালে আরো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। শুনেছে অরিন বাদে আর কারো সাথেই কথা বলে না সুহাস। অরিনের সাথেও খুব অল্প কথাবার্তা হয় এখন। নামমাত্র গার্লফ্রেন্ড। দেখাসাক্ষাৎ একেবারে বন্ধই করে দিয়েছে। এসব আইয়াজ বলেছে ফারাহকে। আর ফারাহ বলেছে নামীকে। কলেজ থেকে এসে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছিল নামী। ঘুম ভেঙে গেল দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে৷ দরজা খুলতেই দেখতে পেল উদয়িনী রণমুর্তি ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে দরজা খুলতেই দু’টো বস্ত্র ছুঁড়ে মারল মুখে। বস্ত্র দু’টির মধ্যে একটি নামীর ওড়না আরেকটি অন্তর্বাস। যা সুহাসের কাভার্ড গোছাতে গিয়ে পেয়েছে উদয়িনী। ছেলের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস আর ক্রোধটুকু প্রকাশ করতে পারেনি সে৷ কারণ সুহাস ক্লাসে গেছে। পাঁচটার পর বাসায় আসবে। সুহাসকে পড়ে বুঝে নেবে। আপাতত নিলুর মেয়েকে শায়েস্তা করবে সে।
নামীর শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই সুহাসের ঘরে এসব পেয়েছে মিসেস উদয়িনী? একদিকে লজ্জা অপরদিকে ভয়ে শরীরে ঘাম ছেড়ে দিল নামীর। আর উদয়িনী করে বসল ভয়াবহ এক ঘটনা। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে সম্পূর্ণ ছাই ফেলল নামীর ওপর৷ আকস্মিক নিজের হাতের পাঁচটা আঙুল বসিয়ে দিল নামীর শ্যামলাটে নরম গালে। শুধু তাই নয় একাধারে কুরুচিপূর্ণ বাক্যে নামীর সমস্ত সত্তাকে নাড়িয়ে তুলল। ঠোঁটের কোণা বেয়ে রক্ত ছলকে পড়ছে নামীর। দু’চোখ উপচে বেরোচ্ছে অশ্রুধারা। সেদিকে খেয়াল নেই উদয়িনীর। সে নামীর শরীরে আঘাত করার পাশাপাশি মনকেও আঘাতে আঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ব্যস্ত৷ বাবা, মায়ের আদুরে সন্তান নামীর আজ কী এটাই প্রাপ্য ছিল? এ বাড়িতে সে রয়েছে শুধুমাত্র সোহান খন্দকারের অনুরোধে। সে যেচে পড়ে থাকতে আসেনি৷ এমনও নয় তার ভরণপোষণের দায়িত্ব সোহান খন্দকারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে তার দুটো ব্যাংক একাউন্ট। একটাতে আমেরিকা থেকে প্রতি মাসে বাবা টাকা পাঠায়৷ আরেকটাতে তার নামে টাকা রয়েছে পয়ত্রিশ লক্ষ। একজন সফল ব্যবসায়ীর মেয়ে হয়ে এভাবে ডক্টর উদয়িনীর অপমান, খাওয়া পরার খোঁটা শুনবে? কী ভেবেছে উদয়িনী তার হাজব্যন্ডের অর্থে সে চলছে৷ পড়াশোনা করছে? পৃথিবী উলটেপালটে যাক। ধ্বংস হয়ে যাক এ পৃথিবী। তবু এই অপমান সহ্য করবে না সে। মিসেস উদয়িনীকে আজ যোগ্য কিছু জবাব দিয়ে বেরিয়ে যাবে এ বাড়ি থেকে। তার কাছে সম্পর্কের চেয়েও, সোহান খন্দকারের অনুরোধের চেয়েও নিজের আত্মসম্মানটা বড়ো!
চলবে..
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৮
ঠোঁটের কোণা বেয়ে পড়া রক্ত টুকু তর্জনীতে মুছে নিল নামী৷ মুছে নিল গাল বেয়ে পড়া অশ্রুটুকুও৷ এরপর নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ মিসেস উদয়িনী, অনেক বলেছেন আপনি। এবার আপনার শোনার পালা। ‘
চমকে গেল উদয়িনী। হতভম্ব মুখে তাকিয়ে রইল নামীর বিধ্বস্ত মুখপানে। বুক কেঁপে ওঠল বহু বছর পূর্বে দেখা সেই মুখটিকে মনে করে। সে মুখটা নিলুর। আজ নামী যেন নিলু রূপেই তার সামনে দাঁড়িয়ে। ঢোক গিলল সে। দৃষ্টিজোড়া তির্যক করে বলল,
‘ বেয়াদব মেয়ে নাম ধরে ডাকছিস আমার? ‘
‘ আপনি আমার খুব আদবের শাশুড়ি নন, অধিকারও দেননি যে শাশুড়ি মা বলে ডাকব। ‘
দাঁতে দাঁত পিষে কম্পিত গলায় বলল নামী। উদয়িনী স্তম্ভিত হয়ে গেল এই মেয়ের সাহস দেখে। তেড়ে আসল কষিয়ে আরো একটা থাপ্পড় লাগাতে। কিন্তু সফল হলো না। তার পূর্বেই নামী তার হাত ধরে ময়লা ঝাড়ার মতো করে ছুঁড়ে ফেলল। কিঞ্চিৎ ব্যথা পেয়ে মুখ হা হয়ে গেল উদয়িনীর। ডান বাহুতে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল৷ তার সে চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে সেলিনা আপা দৌড়ে এলেন। নামী আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। এই নিচু মহিলার আর একটি কথা শোনা তো দূরে থাক মুখ দর্শনও করার ইচ্ছে নেই তার। শুধু সঠিক কিছু জবাব দিয়ে চলে যাওয়ার অপেক্ষা। এ ঘরে তার জন্য ছোট্ট একটা বুকশেলফ এনেছিল সোহান খন্দকার। উপরের তাকে শেষ দিকে কয়েকটা ডায়ারি। তার মধ্যে সবুজ রঙের সবচেয়ে পুরোনো ডায়ারিটা নিয়ে ফের উদয়িনীর সম্মুখে দাঁড়াল নামী। উদয়িনী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নামী মুখে তাচ্ছিল্যতা মিশিয়ে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ এই ডায়ারিটা আপনার ছেলেকে পড়তে বলেছিলাম। সে আপনাকে এতটাই বিশ্বাস করে। উহুম অন্ধ বিশ্বাস করে যে এটা ছুঁয়েও দেখেনি। ‘
ভয়ানক ভাবে চমকে গেল উদয়িনী। ত্বরিত তাকাল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিনার দিকে৷ কড়া গলায় বলল,
‘ সেলিনা, তুই এখান থেকে যা। ‘
ভয়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেল সেলিনা। উদয়িনী মানুষটাই এমন যার ভয়ে বাড়ির কাজের লোক থেকে পরিবারের সদস্য। সবাই তটস্থ থাকে। সেলিনা চলে যেতেই নামী আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,
‘ এত ভয়! এটাই স্বাভাবিক। যারা অন্যায় করে ভয় তো তারাই পায়। ‘
‘ কী বলতে চাচ্ছিস তুই? ‘
চোখ, মুখ শক্ত হয়ে গেল নামীর। পৃথিবীতে বোধহয় এই মহিলাই প্রথম যে তার সঙ্গে কদর্য আচরণ করছে। তাই আর সময় নিল না সে। ডায়ারিটা দেখিয়ে বলতে শুরু করল,
‘ আমার কি মনে হয় জানেন? সুহাস ভয় পেত এটা পড়তে৷ যদি মায়ের বিরুদ্ধে কোনো চরম সত্যি জেনে যায়? পৃথিবীতে সবার বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু জন্মদাত্রী মায়ের বিশ্বাসঘাতকতা না। যখন এটা বুঝতে পারলাম তখন থেকে আর চেষ্টা করিনি সুহাসের ভুল ভাঙাতে। আংকেলকেও নিষেধ করে দিয়েছিলাম। ডক্টর উদয়িনীকে দয়া করেছিলাম যেন তার ছেলে তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে না যায়। আপনি কি জানেন, আপনার ভেতরের অমানবিকতা পুরোপুরি আপনার দুই ছেলেমেয়ে ধারণ করেনি। ওদের ভেতরে নিষ্পাপ একটা মন আছে? ‘
শেষ বাক্য দুটো ফিসফিস করেই বলল নামী। তীব্র ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল উদয়িনী৷ ইচ্ছে হলো মেয়েটার গলা টিপে কণ্ঠনালী রোধ করতে৷ দু-হাত শক্ত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির ন্যায়। নামী থেমে রইল না। সে বলতে থাকল লুকিয়ে রাখা সেই অতীত৷ যে অতীত ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করে গেছে নামীর মা নিলু।
‘ উদয়িনী আর নিলুফা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল তাই না ডক্টর উদয়িনী? ‘
এ প্রশ্নে আতঙ্কিত হয়ে তাকাল উদয়িনী। নামী সব জানে সব৷ ঘামতে শুরু করল সে। ওড়নার কোণা ধরে মুছতে শুরু করল কপাল, মুখ আর গলা বেয়ে নিঃসৃত হওয়া স্বেদজল। নামী বলল,
‘ আম্মু আর আংকেলের সাত বছরের সম্পর্ক ছিল। আপনি ছিলেন আমার মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। আম্মু তার জীবনের সমস্ত ঘটনা আপনার সাথে শেয়ার করত৷ শেয়ার করেছিল আংকেলের কথাও। আপনাকে নিয়ে জাস্ট তিনবার দেখা করেছিল আংকেলের সাথে। প্রথম দেখাতেই আপনি চিনতে পারেন সোহান আংকেলকে। সোহান আংকেল আপনার বাবার বন্ধুর ছেলে। আপনার অহমিকায় আঘাত পড়ে সেদিনই। অত্যাধিক সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিখুঁত প্রেমিক আর ভালোবাসা পাননি। আর নিলু শ্যামলা চেহারার হয়েও সোহান খন্দকারের মতো সুদর্শন পুরুষের খাঁটি ভালোবাসা পাচ্ছে। ঠিক এখানটাতেই আঘাত পান আপনি। আপনার মনে হতে থাকে সোহান খন্দকার নিলুর জন্য পারফেক্ট নয়৷ উনি পারফেক্ট কেবল আপনার জন্যই। সেদিন থেকেই একের পর এক ষড়যন্ত্র শুরু করে দেন৷ আর আপনাকে সাহায্য করে আপনার বড়োলোক দাদুভাই, বাবা আর আপনার প্রয়াত শশুর, শাশুড়ি। তারা চাইতেন আপনার সঙ্গে আংকেলের বিয়ে হোক৷ এরপর আপনার বাবার সকল প্রোপার্টির মালিক হোক সোহান আংকেল। কারণ আম্মু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিল। মধ্যবিত্ত ছিল আংকেলের পরিবারও৷ তাই তারা আপনার মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েকে ঘরের বউ করার স্বপ্ন দেখেছিল। দু’জন মানুষের হৃদয় ভেঙে, স্বপ্ন ধ্বংস করে আপনারা সফল হয়েছেন৷ পূরণ করেছেন নিজেদের অন্যায় স্বপ্নকে। আম্মু যেদিন জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে তারই প্রিয় বান্ধবী। সেদিন একদিকে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা অপরদিকে বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষাক্ত ব্যথা সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সে যাত্রায় আম্মু বেঁচে যায়৷ সোহান আংকেল সব বাঁধা পেরিয়ে হসপিটালে ছুটে আসে। নানা, নানু, মামাদের সামনে পা ধরে ক্ষমা চায় আম্মুর। আমার আম্মু নির্বাক হয়ে শুধু দুচোখে অশ্রু ঝাড়িয়েছিল। সোহান আংকেল বুঝে গিয়েছিল তার নিলু তাকে ক্ষমা করলেও তার সঙ্গে কথা বলতে বা তার মুখ দেখতে আগ্রহী নয়। ভালোবাসার মানুষকে চাইলেও ঘৃণা করা যায় না। আম্মুও পারেনি ঘৃণা করতে৷ তাই ক্ষমার সঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করা পুরুষকে চিরমুক্তি দিয়ে দান করেছিল আপনাকে। আফসোস আপনার মনের কদর্যতার ভীড়ে সোহান আংকেল জায়গা পায়নি। একটা কথা চিরসত্য যা আম্মু স্পষ্ট করে লিখে গেছে, ঐ সময় পরিস্থিতি এমনই ছিল যে সোহান আংকেলকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না৷ তবে আংশিক দোষী সে ছিলই৷ আমার কী মনে হয় জানেন মিসেস উদয়িনী? ওই ঘটনা গুলো যদি আজকের এই সময়ে ঘটত সোহান খন্দকারকে আপনি পেতেন না৷ আংশিক দোষীও সে হতো না। আফসোস সময়টা তখন অন্যরকম ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই জানে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা কেমন হয় কী প্রকারের হয়? আংকেল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিল। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সেক্রিফাইস করতে করতে জীবন, যৌবন সব ধ্বংস হয়ে যায়। যার চাক্ষুষ প্রমাণ সোহান আংকেল! তিনি তার নিলুকে এতটাই ভালোবাসত যে শেষে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে তার বন্ধু মানে আমার বাবার হাতে তুলে দেয় আম্মুকে। আম্মুও প্রেমিকের বাছাই করা পাত্রকে সাদরে গ্রহণ করে সুখের সংসার পাতে। আপনি হেরে গিয়েছিলেন, আবারো হেরে গিয়েছিলেন নিলুর কাছে। কারণ সে স্বামীর পরিপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে সংসার করেছে। যা আপনি আজো পারেননি। ‘
দু’হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল উদয়িনী।
‘ তুই থাম, থাম তুই নিলুর বাচ্চা! ‘
ঘৃণাভরে তাকায় নামী। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কতটা হিংসাত্মক হতে পারে উদয়িনীই তার প্রমাণ।
সে খেয়াল করল, উদয়িনীর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠেছে৷ কান থেকে হাত সরিয়ে বুকের বা’পাশে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
‘ কষ্ট হচ্ছে নিজের ব্যর্থতাকে স্মরণ করে? বয়স তো অনেক হলো তবু কেন বুঝতে পারছেন না, ষড়যন্ত্র করে আর যাইহোক জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় না। ‘
‘ শাটআপ! ‘
‘ সত্যিই মানতে হবে.. মনে জোর না থাকলেও মুখে বেশ জোর আপনার। আম্মু ঠিকই বলেছে আই মিন ঠিকই লিখেছে। ‘
মৃদু হাসল নামী। যে হাসি উদয়িনীকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত করে তুলল। আর সহ্য করতে পারছিল না সে। নামীও বুঝল যতটুকু বলার ছিল বলা শেষ। এবার যেতে হবে। তাই বলল,
‘ মিসেস উদয়িনী? আজ আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনার যদি ক্ষমতা থাকে স্বামী আর পুত্রকে আমার থেকে আটকে রাখবেন৷ যদি না পারেন সেই দায় আমার নয়। আমি স্টিল নাও সুহাস খন্দকারের স্ত্রী। আমার স্বামী যদি সম্মানের সাথে আমাকে গ্রহণ করতে চায় পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই আমাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দেয়ার৷ আর আমার স্বামী যদি আমাকে ত্যাগ করতে চায় পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই তার জীবনে আমাকে আটকে রাখার জাস্ট মাইন্ড ইট। ‘
এরপরই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায় নামী।
উদয়িনী নামীর মুখে অতীত শুনে কিছুক্ষণের জন্য অস্বাভাবিক হলেও পরোক্ষণেই সামলে ওঠে। আর মনে মনে বিজয়ের হাসি হাসে৷
দু’জন যুবক, যুবতী এক বাড়িতে রয়েছে। সম্পর্কে স্বামী – স্ত্রী৷ যতই ছেলের মনে বিষ ঢুকিয়ে দিক। পুরুষ মানুষ তো। আর নামী, সে তো নিলুর মতোই বশীকরণমন্ত্র জানে৷ নয়তো কীভাবে আকস্মিক তাদের জীবনে হানা দিল? স্বামী, সন্তানকে বশ করে কীভাবে প্রবেশ করল এ বাড়িতে? নিজের ভুলটা বুঝতে পারল উদয়িনী। একদমই উচিত হয়নি সুহাসকে এভাবে ছেড়ে রাখা। না জানি ঠিক কতটা গভীরতায় পৌঁছেছিল নামী আর সুহাসের সম্পর্ক। সে ভয়েই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে উদয়িনী। মুখে যা ইচ্ছে তাই বলেই ক্ষ্যান্ত হননি। গায়েও হাত তুলেছে৷ কিন্তু ভাবতেও পারেননি এর পরিণাম ঠিক কী দাঁড়াতে পারে। যে ভয়ে সে নামীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করল। আজকের পর থেকে সেটাই যে সত্যি হবে ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না। সে কেবল নামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা উপভোগ করলেন। বহু বছর আগের মতোই মনে মনে মিথ্যা স্বান্তনা পেলেন। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল সোহান খন্দকার নিলুকে ভালোবাসলেও বিয়ে করতে পারেনি। এই একটা জায়গায় আটকে ছিল সোহান।
আর সুহাস নামীকে ভালো না বাসলেও তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছে। আইনিভাবেও স্বীকৃত বউ নামী সুহাসের। যেখানে সম্পর্ক হালাল সেখানে মনের মিলন হতে কতক্ষণ? সৃষ্টিকর্তা হারাম সম্পর্কে রহমত দান না করলেও হালাল সম্পর্কে ঠিকই রহমত দান করেন৷
***
ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসের পেছনে চলে এলো চার বন্ধু আর দুই বান্ধবী। পরপর সিঁড়িতে বসল সবাই। আইয়াজের মুখ ভার। তার মনের বিষণ্ণতা চোখ, মুখ উপচে বেরুচ্ছে। সর্বপ্রথম খেয়াল করেছে নিধি। ক্লাস টাইমেই সে খেয়াল করে আজ আইয়াজ অন্যমনস্ক। ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্রের অমনোযোগী রূপ দেখে শুধু বন্ধুরাই নয়। বায়োকেমিস্ট্রি লেকচারারও ধমকেছে। হঠাৎ করে কী হলো আইয়াজের? সবাই বেশ চিন্তিত। সৌধ আজিজকে বলল,
‘ ও তো কিছু বলবে না। নিজের সমস্যা গুলো বরাবরই চেপে রাখে৷ তুই’ই ওর এ কয়েকদিনের গতিবিধি জানা৷ ‘
আজিজ আর আইয়াজ হোস্টেলে একই রুমে থাকে। তাই আজিজ গড়গড় করে বলতে শুরু করল,
‘ আর বলিস না মাম্মা, কয়টা মাস ধরে এই শা’লার জন্য ঘুমাইতে পারি না৷ এগারোটা পর্যন্ত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। তারপরই শুরু হয় ক্যালমা। এই ক্যালমা চলতে চলতে ফজরের আজানও দিয়া দেয়। তাও শা’লার ক্যালমা শেষ হয় না। ক্যালমা দেখাইতে দেখাইতে কাল রাত থেকে ভং ধরছে৷ ‘
আজিজের কথার ধরন দেখে সুহাস হেসে কুটিকুটি। প্রাচী সুহাসের মাথা গাট্টা মেরে বলল,
‘ সিরিয়াস মোমেন্টে হাসবি না সুহাস৷ ‘
সুহাস হাসি থামালে নিধি আজিজকে বলল,
‘ মন মেজাজ ভালো নাই আজিজ৷ ভণিতা না করে ভালোয় ভালোয় বল কাল রাতে কী হয়েছে? ‘
সৌধ নিধির কুঁচকানো কপালের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোর সমস্যা কী? ঠিক কাকে মেজাজ দেখাচ্ছিস তুই? ‘
সৌধর কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না নিধি। আজিজের সামনে গিয়ে কড়া গলায় বলল,
‘ তুই বলবি? ‘
ঢোক গিলল আজিজ। বলল,
‘ আররে মাম্মি ডর দেখাস ক্যান।’
চোয়াল শক্ত করে কঠিন চোখে তাকাল নিধি। আজিজ ভড়কে গিয়ে বলল,
‘বলতাছি বলতাছি।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে থম মেরে বসে থাকা আইয়াজের দিকে তাকাল নিধি। আজিজ বলল,
‘ কাল রাত দুইটার সময় ফারাহ ফোন করে নাকি অনেক কান্নাকাটি করেছে৷ আর বলেছে সম্পর্কটা আর আগানো সম্ভব না। ‘
‘ হোয়াট! ‘
সৌধ, নিধি, প্রাচী, সুহাস চারজন একইসঙ্গে চ্যাঁচিয়ে ওঠল। সৌধ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
‘ মামাবাড়ির আবদার নাকি! আইয়াজ এই মেয়ে তোর ইমোশন নিয়ে খেলল না তো? ‘
প্রাচী ক্রোধ মিশ্রিত গলায় বলল,
‘ ভোলাভালা পোলাপানের সাথে এটাই হয়। ধূরর বা’ল ইনোসেন্ট পোলাডার জীবনে একটা প্রেম আসল তাও নাকি এমন। ‘
বলতে বলতেই আইয়াজের পাশে গিয়ে বসল প্রাচী৷ চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ দোস্ত প্লিজ তুই ভেঙে পড়িস না। মাত্র কয়েক মাসেরই তো ব্যাপার। মুভ অন করে ফেল। ‘
প্রাচীর এহেন কথা আইয়াজ এমন ভাবে তাকাল যে উপস্থিত সকলেই ভয় পেয়ে গেল। সৌধ বুঝতে পারল আইয়াজের মনের অবস্থা তাই সবাইকে সরতে বলে ও গিয়ে বসল পাশে। বলল,
‘ কী কারণে ফারাহ এমনটা বলেছে? ‘
নিধি বলল,
‘ আমি কি একবার নামীর সাথে কথা বলব? ‘
তৎক্ষনাৎ সুহাস বলল,
‘ নামীদামির কারসাজি নয়তো? ‘
সৌধ ধমকে ওঠল। বলল,
‘ ফাইজলামি করবি না সুহাস৷ আমরা এখন সিরিয়াস আলোচনা করছি৷ ‘
এ কথা বলেই আইয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ কারণ বলেনি? ‘
আইয়াজ মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে বলল,
‘ অনেক কান্নাকাটি করছিল আর সম্পর্কের ইতি টানতে চাচ্ছিল। এ-র বেশি কিছুই বলেনি। ‘
‘ তুই কি বললি? ‘
‘কিছু না, ফোন কেটে দিয়েছি। ‘
নিধি বলল,
‘ শখ করে ব্রেকআপ করলে কাঁদবে কেন? ‘
আইয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ শখ করে করলে মেনে নিতাম। আমার মনে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। ‘
সৌধ নাক খিঁচাল ভালোবাসার ঊর্ধ্বে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না৷ তাই বলল,
‘ ব্রেকআপ চাইলেই ব্রেকআপ দিবি? মানানোর চেষ্টা কর৷ না মানলে তুলে এনে জাস্ট বিয়ে করাই দিব চিল ম্যান। ‘
সকলের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা। নিধি নড়েচড়ে ওঠল সৌধর কথা শুনে৷ উপস্থিত সকলেই জানে সৌধ মোটেই ফাঁকা আওয়াজ দেয়নি। এ জন্যই মুখটা চুপসে গেছে নিধির। যা দেখে ফিচেল হাসল সৌধ। বলল,
‘ চল ওঠ সবাই। আর আইয়াজ তুই আমার সঙ্গে চল আজ আমার সাথে থাকবি৷ ফারাহকে বুঝাবি না বুঝলে আমি বুঝাব। আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে৷ না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিব৷ আপাতত প্রথমটা ট্রাই করব আজ। ‘
আইয়াজকে কথাটা বলেই সুহাসকে বলল,
‘ আর তুই নামীর কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবি। বেস্ট ফ্রেন্ড ওরা৷ হতে পারে পার্সোনাল কোনো প্রবলেম যা আইয়াজকে বলতে পারছে না কিন্তু নামীকে বলেছে।’
***
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফারাহকে কল করেছিল নামী৷ ফারাহর ফোন বন্ধ। কী করবে কোথায় যাবে মাথা কাজ করছিল না তার। অতিরিক্ত রাগ আর দুঃশ্চিন্তায় মাথা ঘুরছিল খুব। কোনো উপায় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত নিজের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবে। তারপর বাড়ির লোকের সাথে আলোচনা করে হোস্টেলে ওঠবে। বড়ো মুখ করে উদয়িনীকে বলে এসেছে তার ছেলে কাছে এলে গ্রহণ করবে। কিন্তু অতো সৌভাগ্য যে তার নেই সে খুব ভালো করেই জানে। সুহাস হয়তো এখন তার সঙ্গে আগের মতো খারাপ আচরণ করে না৷ তাই বলে তাকে বউ বলে মানে এমনটাও নয়৷ জেদের বশে উদয়িনীকে আঘাত করতেই কথাটা বলেছিল সে। ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রিকশা নিল বাসটার্মিনালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে রিকশা থেকে পড়ে গেল মেয়েটা। মুহুর্তেই হুলস্থুল অবস্থা তৈরি হয়ে গেল রাস্তায়। জ্ঞানহারা মেয়েটাকে ধরাধরি করে নেয়া হলো সদর হাসপাতালে। নিধির এক বান্ধবী সে সময় ওই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল। চলন্ত রিকশা থেকে সে নামীকে চিনতে পারে। আর তৎক্ষনাৎ নিধিকে কল করে জানায়,
‘ এই নিধি আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়র মেয়েটা আছে না? ঐ যে যার সাথে তোর বেশ ভালো সম্পর্ক। শ্যামলা করে মেয়েটা? সে তো সেন্স লেস হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছে৷ সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল! ‘
.
সুহাস মাত্রই বাড়িতে এসেছে। উদয়িনী তখন নিজ রুমে কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিল। এই সুযোগে সেলিনা আপা সুহাসকে গড়গড় করে বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বলে দিল। যতটুকু সে জেনেছে শুনেছে ঠিক ততটুকুই। এরপর ওড়না মুখে চেপে কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ আহারে গো মেয়াডারে ক্যামনে মারল। চাচির মনে আল্লাহ দয়ামায়া দেয়নাই গো ভাই। মেয়েডা এত কষ্ট অপমান সহ্য করবার না পাইয়া চইলা গেল। আল্লাহ জানে চাচা রাইতে আইসা কী তাণ্ডব বাজায়! আল্লাহ জানে মেয়াডা কই গেল? মা নাই, বাবা দেশে নাই আহারে গো! ‘
সেলিনার বলা কথাগুলো আর হায় হুতাশ শুনে সুহাসের সমস্ত পৃথিবীই যেন থমকে গেল। তার মা হঠাৎ কেন এমন করল? বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে এলো তার। হুঁশে হোক আর বেহুঁশে নিজের রুম পর্যন্ত আর গেল না সে।ড্রয়িংরুমেই ব্যাগ ফেলে অ্যাপ্রোন ফেলে মোবাইল আর বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল। এদিকে প্রাচীকে নিয়ে নিধি সদর হাসপাতালের পথে পা বাড়িয়েছে। রিকশায় ওঠেই সৌধকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে,
‘ সুহাসকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি সদর হাসপাতাল চলে আয় সৌধ। ‘
সৌধকে কথাটা বলেই ফোন কেটে কল করল নামীকে। এদিকে সুহাসও নামীর ফোনে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে নিধি, সুহাস একসঙ্গে ফোন দেয়া শুরু করল দু’জনই দু’দিকে থেকে নামীর ফোন ব্যস্ত পায়। সুহাসের ফোনে ঐ সময়ই একটি ম্যাসেজ আসে সৌধর,
‘ এই শা’লা তোর ফোন ব্যস্ত কেন? নিধি তোকে নিয়ে এক্ষুনি সদর হাসপাতালে যেতে বলল। আমি তোর বাড়ির কাছাকাছিই বের হ দ্রুত। ‘
সুহাসের বুকের ভেতর ধক করে ওঠল ম্যাসেজটা পেয়ে। হাসপাতালে কেন যেতে বলছে নিধি? নামীর কিছু হলো কী? ভীতিগ্রস্ত হয়ে চোখ, মুখ রক্তিম হয়ে ওঠল সুহাসের। বিড়বিড় করে বলল, ‘ না না নামী হাসপাতালে যাবে কী করে নিধি হয়তো অন্য কোনো দরকার বা অন্যকারো দরকারে যেতে বলেছে। ‘
অবিশ্বাস হলেও সত্যি সুহাসের এ মুহুর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। নামীদামির জন্য দুঃশ্চিন্তায় নিজেকে এত অসহায় লাগছে কেন? আকস্মিক এ কোন সঙ্কটে পড়ল সে?
চলবে…
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৯
সৌধর গাড়ি এসে থামল সদর হাসপাতালের সামনে। সুহাস ত্বরিত গাড়ি থেকে নেমে দৌড় লাগাল৷ সৌধ মুখে মাস্ক পরে অপেক্ষা করতে লাগল ওদের ফিরে আসার৷ সে নিজে আর নামল না৷ দেখা গেল কেউ চিনে ফেললে বাবা, ভাইকে জানিয়ে দেবে। আর তারা রাগারাগি করবে একা একা বের হওয়ায়।
সুজা এমপির অত্যাধিক সুদর্শন, ছোটো পুত্রকে এ শহরের কে না চেনে? বাবা, চাচা, ভাইরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সে এসবে জড়ায়নি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। এমপির ছেলে সৌধ চৌধুরী। বর্তমানে মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। যেমন মেধাবী তেমন সুদর্শন। মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব জিমে এক্সারসাইজ করা ভিডিয়ো আপলোড দেয়। যেগুলোতে হিউজ পরিমাণ ভিউ পড়ে৷ কমেন্ট বক্সে জড়ো হয় অগণিত মেয়েদের ঘায়েল হওয়ার বার্তা। এত অল্প বয়সে সকলের নজড়ে এভাবে চলে আসবে সৌধ তার পরিবারের কেউ ধারণাও করতে পারেনি৷ মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞায় বড়ো ভাই, বাবা তাকে রাজনীতির পথেও আসতে দেয়নি৷ অথচ বড়ো ভাইয়ের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয় সে। সৌধর ফ্যান ফলোয়ারদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক জানে সে সুজা চৌধুরীর ছেলে৷ এরপরও সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। তার বন্ধুর ঝুলি পূর্ণ হলেও শত্রুর ঝুলি শূন্য। কিন্তু পারিবারিক শত্রুর অভাব নেই। বাবার আদেশ আছে একা একা ঘুরাফেরা না করার। সেই আদেশ অমান্য করেই বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে৷ নিজ বুদ্ধিমত্তায় যতটুকু সম্ভব নিরাপদে থাকারও চেষ্টা করে।
নামীকে দেখে যারপরনাই অবাক হচ্ছে নিধি, প্রাচী। এই মেয়েটা কি পাথর দিয়ে গড়া? বাড়িতে কী ঘটেছে জানে না তারা৷ তবে বুঝে নিল, সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে বলেই ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। উপরে উপরে শক্ত থাকলেও ভিতরে ভিতরে তীব্র কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ অথচ এ মুহুর্তে চোখ দু’টো নির্বিকার। মুখে মলিন হাসি। হাত, পায়ে ছিলে যাওয়া ত্বকে মেডিসিন দিয়ে ওষুধ লিখে দেয়া হয়েছে৷ নামী সে সব বুঝে নিয়ে নিধি, প্রাচীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ আমার বিপদের কথা শুনে তোমরা এভাবে ছুটে আসবে ভাবতে পারিনি। ধন্যবাদ। ‘
এইটুকু বলেই ব্যাগপত্র নিয়ে বাসটার্মিনাল যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াল। যে মেয়েটা কিছুক্ষণ পূর্বে অজ্ঞান হয়ে পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সে মেয়েটা এত দ্রুতই নিজেকে কীভাবে শক্ত করে নিল? ভাবতেই গা শিউরে ওঠল নিধির৷ সে ত্বরিত নামীর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে প্রাচীকে বলল,
‘ ওর জন্য ডাব কিনে নিয়ে আয়। আমরা ওপাশে বসার জায়গায় গিয়ে বসি৷ ‘
এরপর নামীকে বলল,
‘ এদিকে এসো বসো এখানে। ‘
নামী বসতে রাজি হলো না। সে মুহূর্তেই তীব্র দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ নিয়ে উপস্থিত হলো সুহাস। একটু চমকালেও নিজেকে সামলে নিল নামী। সুহাস কোনোদিকে না তাকিয়ে আচমকা ওর হাত চেপে ধরে বলল,
‘ কী হয়েছে তোমার? ‘
নামী চাপা আর্তনাদ করে ওঠল। নিধি চ্যাঁচিয়ে বলল,
‘ ওই ছাড়, রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পাইছে। ওখানেও জখম হইছে। ‘
সহসা হাত ছেড়ে দিল সুহাস। নামী শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের পাশ দিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ লোক হাঁটা পা থামিয়ে তাকিয়ে রইল ভ্রু কুঁচকে। নিধি খেয়াল করে মুখ ফিরিয়ে নিল। নামী ইতস্ততভাবে দাঁড়িয়ে। ওদের ভাবমূর্তি দেখে সুহাস পাশে থাকা ভদ্রলোককে দেখে মৃদু হাসল। ভদ্রলোকের মুখ কঠিন হলো এতে। সুহাস বুঝল লোকটা তাকে সন্দেহ করছে। তার চটপটে চেহেরা নিয়ে হয়েছে জ্বালা। সবাই দুষ্ট প্রকৃতিরই ভাবে। তাই বলল,
‘ কিছু বলবেন আংকেল? ‘
উত্তর দিল না ভদ্রলোক। তাকাল নামীর দিকে। তার চাহনি খেয়াল করে সুহাস চোখমুখ কুঁচকে বলল,
‘ ও আমার বউ। ‘
লোকটা চমকে ওঠল। চমকে ওঠল নামী আর নিধিও৷ সে চমকানো দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল সুহাস৷ নামীর বিস্মিত দৃষ্টি দেখে কানের নিচে চুলকাতে শুরু করল৷ ভদ্রলোক নামীর দিকে তাকাল জহরি চোখে। নামী খেয়াল করল লোকটা তার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকিয়ে। তাই জোরপূর্বক হেসে বোঝাল সুহাসের কথাই ঠিক৷ সে তার বউ। এবারে লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থান ত্যাগ করল। সুহাস তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এদের জন্য শান্তি নেই। ব্যাটা হসপিটালে আসছিস নিজের রোগি থাকলে তাকে সামলা। অন্যের রোগির দিকে খেয়াল দিতে কে বলেছে? ‘
নিধি বিস্মিত দৃষ্টিতে সুহাসকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল৷ নামী তার সকল বিস্ময় ঝেড়ে প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে নিধির থেকে লাগেজ নিয়ে বলল,
‘ আসছি আপু। ‘
সুহাস চমকে ওঠে খপ করে লাগেজ নিয়ে নিল হাত থেকে। অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ আসছি মানে! ‘
নামী জবাব দিল না। প্রাচী ডাব কিনে এনে নামীকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা খেয়ে নাও শরীর ভালো লাগবে। ‘
নামী নিতে চাইল না। সে দম আটকে দাঁড়িয়ে রইল। সুহাসের সামনে থেকে যেতে পারলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আজ সুহাসের কর্মকাণ্ড দেখে বান্ধবীরা ভাবল, নিশ্চিত নেশা করেছে এই ছেলে। প্রাচীর হাত থেকে ডাব নিয়ে নামীর সামনে ধরল সুহাস। বলল,
‘ আমি ধরে রেখেছি৷ তুমি খাও। ‘
আকস্মিক দরদে মেজাজ খারাপ করল নামীর৷ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ এসব আলগা দরদ দেখাতে আসবেন না। ‘
‘ এই নামীদামি একদম দাম দেখাবে না। যা বলছি তাই করো। ‘
ধমকে ওঠল সুহাস। নিধি বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বিস্ময়ে কেশে ওঠল প্রাচীও। নামী থমথমে মুখে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কয়েকজন তাদের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিধি ভীত স্বরে বলল,
‘ এই সুহাস আস্তে কথা বল। ছিঃ ছিঃ মানুষ তাকাই আছে। ‘
সুহাস আশপাশে একবার তাকিয়ে নামীকে বলল,
‘ খাও। ‘
নামী কথা বাড়াল না। তীব্র অনীহা নিয়ে ডাবের পানি শেষ করতে লাগল। পাশাপাশি ভদ্র কিছু গালিগালাজ করতে লাগল সুহাসকে। আর সুহাস থম মেরে তাকিয়ে দেখতে লাগল, তার হৃদয়ের কলহপ্রিয় নারীটির কোমল ঠোঁটজোড়ার মাঝ বরাবর থাকা হলদে রঙা পাইপটাকে। যা দৃষ্টিপাত করে মনে মনে আওড়াল,
‘ আজ এই পাইপটাকেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হচ্ছে!’
সৌধর গাড়ির সামনে এসে ছোটোখাটো সুনামি ঘটিয়ে ফেলল সুহাস, নামী দম্পতি৷ সুহাস কিছুতেই নামীকে গ্রামে যেতে দেবে না। আর নামী কিছুতেই সুহাসের মতো দুর্বল মনের পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করবে না। এই নিয়ে তাণ্ডব শুরু হলো। সুহাস বুঝতে পারল মুখ চললেও নামীর শরীর ভালো নেই। ওর চোখ দু’টোই বলে দিচ্ছে প্রচণ্ড দুর্বল সে৷ তাই শেষে চিৎকার করে বলল,
‘ তোমার জন্য ঐ ব্যাংকার আর ব্যাংকারের মায়ের কাছে ছোটো হয়েছি আমি। আর তুমি আমাকে ফেলে চলে যাবে! তা তো হবে না নামীদামি। ‘
মুখ বন্ধ হয়ে গেল নামীর। তার সঙ্গে নিধি, প্রাচীও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নামী চাপা স্বরে বলল,
‘ এ কথার মানে কী?’
সৌধ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করল। বলল,
‘ নামী লোকজন দেখছে। গাড়িতে বসে কথা বলো। এরপর সিদ্ধান্ত নাও। প্রয়োজনে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে। ‘
সৌধর ব্যবহার এতটাই অমায়িক যে নামী কখনোই তার কথা ফেলতে পারে না। আজো পারল না। ওঠে বসল গাড়িতে। নিধি বসল সামনে। বাকিরা পেছনে। নামী, সুহাসকে বসানো হলো পাশাপাশি। এরপর নামী বলল,
‘ আপনি কী চান সুহাস? ‘
‘ তুমি কোথাও যেতে পারবে না নামী। ‘
একগুঁয়ে স্বর সুহাসের। নামীও জিদি কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘ আমি কোথায় যাব না যাব এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। ‘
‘ শাটআপ! ‘
ধমকে ওঠল সুহাস। নিধি কিছু বলতে নিলে সৌধ ওর হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় বলল,
‘ ওদের টা ওদের বুঝে নিতে দে। ‘
এদিকে প্রাচীও পার্স থেকে ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে নিউজফিড স্ক্রোল করতে শুরু করল। নামী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সুহাসও রক্তিম চোখে তাকিয়ে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলছে। যা দেখে চাপাস্বরে নামী বলল,
‘ অধিকার ফলাচ্ছেন? ‘
চোখে চোখ রেখে সুহাস বলল,
‘ ধরে নাও তাই। ‘
‘কিন্তু কেন অধিকার দেখাচ্ছেন? কী অর্থে? ‘
‘ অর্থ আবার কীসের? আমার অধিকার আমি ফলাই তোমার কী সমস্যা? ‘
ওপাশ থেকে সৌধ বলল,
‘ বলে দে ভালোবাসিস তাই অধিকার ফলাস। ‘
‘ অসম্ভব ওর মতো মেয়েকে আমি ভালোবাসি না। ‘
এ কথায় উত্তেজিত মনটা নিভে গেল নামীর। সৌধ তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘ তাহলে ঐ ব্যাংকারের মাকে কেন বললি নামী ম্যারেড আর তুই ওর হাজব্যন্ড। তোরা পড়াশোনা করছিস বলে এসব গোপন আছে। তাই উনারা যেন নামীকে নিয়ে তোর বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাব না দেয়। ‘
বিস্ময়ে নামীর চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এসব কী শুনছে সে? সুহাস এসব বলেছে পাশের বাসার আন্টিকে! সৌধর প্রশ্নে সুহাস উত্তর দিল,
‘ যা সত্যি তাই বলেছি। ‘
‘ তাহলে সাহস করে ভালোবাসার কথাটাও বলে দে। ‘
নামীর হাত, পা কাঁপতে শুরু করেছে। সুহাসের দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে সে। সুহাস চোরা দৃষ্টিতে নামীর অবস্থা দেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ আমি কোনো নামীদামিকে ভালোবাসি না। ‘
এ কথা শুনে সৌধর মারতে ইচ্ছে করল ও’কে। আর নামীর ইচ্ছে হলো কষিয়ে দু’টো থাপ্পড় দিতে। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল নিজের গাল ইশারা করে বলল,
‘ দেখেছেন? ‘
সুহাস চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এরজন্য আমি দায়ী নই। এর শাস্তি আমি পেতে পারি না। ‘
বাঁকা হেসে নামী বলল,
‘ একজনের জন্য অপরজন শাস্তি পায় এটা আপনিই শিখিয়েছেন আমায়। ‘
‘ তার মানে বলছ তোমার মায়ের ভুলে তুমি শাস্তি পাচ্ছ? ‘
‘ নেভার, আমার মা কোনো ভুল করেনি। ভুল করেছে… ‘
‘ ব্যস, ‘
তাচ্ছিল্য হেসে নামী বলল,
‘ আমার মেরুদণ্ড আপনার মতো নিচু নয় সুহাস৷ আমাকে যেতে দিন। যদি স্বামীর অধিকার দেখাতে চান তাহলে নিজের মায়ের মুখোমুখি হয়ে আমাকে স্বীকার করুন। পারবেন? আপনি যদি এটা পারেন আমি ফিরে যাব আপনার সঙ্গে। ‘
নামীর এ কথায় সকলেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। নামী দুচোখ ভরে দেখতে লাগল এক অসহায়, ভঙ্গুর পুরুষকে। যেন ক্লাস ফোরের একটি বাচ্চা ছেলে ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করার দরুন মাথা নত করে বসে আছে। মায়া হলো খুব, তিন কবুল বলে গ্রহণ করা স্বামী নামক পুরুষটির অসহায়ত্ব যন্ত্রণা দিল তাকেও। ঠিক সে সময়ই সুহাসের মনের অবস্থা টের পেয়ে নিধি প্রস্তাব দিল,
‘ গ্রামে যাওয়ার কী দরকার নামী? তুমি আমাদের বাসায় ভাড়া ওঠতে পারো। চিন্তা নেই এমনি এমনি ওঠতে বলছি না। রুমমেট খুঁজছিলাম আমরা। তুমি ওঠলে বেশ ভালোই হবে৷ ‘
নিধির উপস্থিত বুদ্ধি বাহবা দেয়ার মতো। সৌধ অভিভূত হয়ে চেয়ে রইল। সুহাস তাকাল কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে। প্রাচী দুহাত জোড় করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল নামী যেন রাজি হয়। আর নামী তাকিয়ে রইল সুহাসের ধূসর বর্ণের রক্তিম চোখজোড়ায়। ও চোখের ভাষা আজ বড্ড অপরিচিত তার। অপরিচিত এই ভাষা তার হৃদয় অস্থির করে তুলছে। মনে হচ্ছে এই দৃষ্টির মালিক তার আপন খুব খুব আপন। এই দৃষ্টির আকুলতা তার জন্য শুধুই তার জন্য। এই দৃষ্টির মালিক তার একান্তই তার। সকলে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তার সিদ্ধান্ত জানার জন্য। সে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করল অনেকক্ষণ। মা নেই। বাবা দেশের বাইরে। গ্রামে যারা আছে তারা তাকে কিছু পরামর্শ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না৷ মাঝখান থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে, তাকে শশুর ঘরের লোক মেনে নেয়নি, স্বামী গ্রহণ করেনি। কী দরকার এসব জলঘোলা করার। তার সমস্যা একান্ত তার সমস্যা হয়েই থাকুক না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। বলল,
‘ আমি রাজি। ‘
***
সুহাস বাড়ি ফিরছে বেশ রাত করে। মায়ের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিধিকে ম্যাসেজ করে বলল,
‘ নামীকে বলে দিস, মায়ের হয়ে আমি সরি খুব সরি।’
নিধি রিপ্লাই করল,
‘ বলতে পারব না৷ তোর দেয়া ম্যাসেজটা দেখিয়ে দিব। ‘
নিধির ম্যাসেজ দেখা শেষে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল সে। দেখতে পেল সিমরানের একটি বড়োসড় ম্যাসেজ,
‘ আব্বু, আম্মুর মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছে ব্রো। আব্বুর গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল আম্মু আমি বাঁধা দেয়ায় থাপ্পড়টা আমার গালে পড়েছে। আমার আর এসব ভালো লাগে না। বাবা, মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতে আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমাকে তুমি হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করো প্লিজ ব্রো প্লিজ। আমি এ বাড়িতে আর থাকব না। আমি আমার বাবা, মায়ের থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই। আমি ভুলতে পারছি না ব্রো আমার গালে আম্মুর পাঁচ আঙুলের দাগ। আমি সহ্য করতে পারছি না, একটুও সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ ব্রো তুমি আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচাও। এরা আমাদের বিষাক্ত বাবা, মা বিলিভ মি ব্রো এরা দুজনই আমাদের জন্য অভিশাপ! আমি খুব ডিপ্রেশড ব্রো খুব। আমি কিছু একটা করে ফেলব দেখো। কিছু একটা করে এই দু’জনকে কঠিন একটা শিক্ষা দিয়ে যাব। ‘
বোনের ম্যাসজটা পড়েই ক্রোধে মাথা দপদপিয়ে ওঠল৷ আচমকা মোবাইল ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে ওঠল। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এরপর ত্বরিত চলে গেল বোনের ঘরে। রুম অন্ধকার করে এক কোণে বসে ছিল সিমরান। ভাই গিয়ে লাইট অন করতেই ছুটে এসে ভাইকে জাপ্টে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আম্মু আমাকে মেরেছে ব্রো! আমি মেনে নিতে পারছি না। একদমই পারছি না। আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইট ব্রো, আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইট! ‘
বোনকে শক্ত করে বুকে চেপে রইল সুহাস। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ সিনু শান্ত হ প্লিজ। চুপ, চুপ কাঁদবি না, একদম না সিনু। ‘
কথাটা বলেই বোনের মুখ উঁচু করল। দুধে আলতা মসৃণ ত্বকে পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে বুক কেঁপে ওঠল সুহাসের। মনে পড়ল নামীর গালেও একই দাগের কথা। শ্বাসরোধ হয়ে এলো তার। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘ মা পাগল হয়ে গেছে সিনু। আমি আমার এই মাকে চিনতে পারছি না, একদম চিনতে পারছি না। ‘
সিমরানের কান্নার বেগ বাড়ল। সুহাস ওকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ বাবা কোথায়? ‘
‘ জানি না। সেই যে রেগে বেড়িয়েছে… ‘
সুহাস সিদ্ধান্ত নিল আগে বোনের মন ভালো করবে। শান্ত করবে বোনকে এরপর বাবার সাথে দেখা করবে। কিন্তু মায়ের মুখোমুখি সে কিছুতেই হবে না। যে রূপে মাকে সে ভাবতে পারে না, মায়ের যে রূপ সে বিশ্বাস করে না। সেই রূপ স্বচক্ষে দেখতে সামনে যাবে না। তবে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে মাকে ঠিক বোঝাবে সে যা করেছে ভুল করেছে। যে কারণে নামীর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছে আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি। ভুল বোঝাবুঝি থেকে এত বড়ো ঘটনা ঘটানো, নামীর গায়ে হাত তোলা, সিমরানের গায়ে অবধি হাত তোলা! একদম উচিত হয়নি, একদম না।
চলবে…