ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
891

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৪

নিজের প্রতি খুবই অবাক হলো সুহাস৷ সে তো এটা বলতে চায়নি। খেলার শর্ত মেনে নামীকে আই লাভ ইউ’ই বলতে চাচ্ছিল৷ তাহলে কী করে আই হেইট ইউ বলে ফেলল! ভালোবাসি বলতে গিয়ে ঘৃণা করি বলে ফেলল কেন? এসব ভাবনার ভীড়ে নামীর ঝাপসা চোখ, গাল বেয়ে পড়া অশ্রু নজর এড়াল না। কেন জানি খুব খারাপ লাগল সুহাসের৷ দৃষ্টি নত করে নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াল সে৷ নামীও নিজেকে চটজলদি স্বাভাবিক করে নিল। বাঁকা হেসে নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ এটা খুব ভালো গুণ সুহাস। আপনি মিথ্যেমিথ্যি কিছু বলতে পারেন না৷ ‘

কথাটা বলেই তাকাল সকলের দিকে। মিষ্টি হেসে গিয়ে বসল ফারাহর পাশে। বলল,

‘ সবাই এমন চুপ কেন খেলা কি শেষ? ‘

সুহাসের কাণ্ড দেখে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেছিল। নামীর কথায় হুঁশ ফিরল। ফারাহ নামীর দিকে মায়াভরা চাউনিতে তাকিয়ে। আইয়াজ নির্বিকার। সৌধ, নিধি সুহাসের দিকে ছুঁড়েছে অগ্নি দৃষ্টি। আইয়াজ তখন ওদের শান্ত করতে নিচু গলায় বলল,

‘ কিপ কুল ফ্রেন্ড’স। হাঁদারামটাকে ধরে বসা৷ এখনো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়নি৷ প্রয়োজনে সারারাত আজ খেলাধুলা করব আমরা। ‘

নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিল তিন বন্ধু। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি বলল,

‘ না না খেলা তো সবে শুরু। ‘

সুহাসের কানে তখন নামীর কথাটা বারেবারে বাজছিল,

‘ এটা খুব ভালো গুণ সুহাস। আপনি মিথ্যেমিথ্যি কিছু বলতে পারেন না। ‘

নামীর ও কথার প্রতিত্তোরে সে ভাবল, সত্যি কি তাই? সত্যিই কি সে মিথ্যা কিছু বলতে পারে না? নাকি তার সর্বস্ব জুড়েই মিথ্যার খোলসে আবৃত?

সৌধর শক্ত হাতের হেঁচকা টানে মেঝেতে বসে পড়ল সুহাস। চমকে ওঠে নিঃশ্বাস ছাড়ল শব্দ করে। বলল,

‘ তোরা খেল, আমার এসব বিরক্ত লাগছে। ‘

নিধি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ কেন সমস্যা কী তোর এত ভাব মারিস কেন সবসময়? ‘

আড়চোখে নামীর সরল চোখ দু’টোয় তাকাল সুহাস। এরপর আচমকাই বলে ফেলল,

‘ দেখছিস না এই মেয়েটা আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। ‘

সকলেই বিস্মিত হয়ে নামীর দিকে তাকাল। সে সুহাসকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে? এমন সিরিয়াস মুহুর্তে সুহাসের বলা এই কথাটি পরিস্থিতিই বদলে ফেলল। সুহাস এতেই ক্ষ্যান্ত রইল না। নামীর দিকে বক্র চাউনি নিক্ষেপ করে ধমকের সুরে বলল,

‘ আই নো আই এম হ্যান্ডসাম নামীদামি। তাই বলে সর্বক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার নজর লাগে। আর নজর লাগলে খুব গার্লফ্রেন্ডের ঘাটতি পড়ে আমার। শোনো মেয়ে, এই সুহাস সব লোকসান মেনে নিতে পারে, কিন্তু গার্লফ্রেন্ড লোকসান মানতে পারে না। ‘

আজগুবি কথা শুনে মুখ বিকৃত করে ফেলল নামী। বাকি সবাই হো হো হেসে ফেলল। ফারাহ হাসল ঠোঁট টিপে। সুহাস ভাই নামীকে কষ্ট দেয় এদিকে খারাপ হলেও অন্যদিকে মানুষটা বেশ মজার। মানুষের মাঝে ভালো গুণ, খারাপ গুণ উভয়ই বিদ্যমান থাকে৷ সুহাস যেমন তার খারাপ আচরণ দিয়ে পরিস্থিতি বিগড়ে দিতে পারে৷ তেমনি ভালো গুণ দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেও তুলতে পারে৷ সুহাসের কথার প্রেক্ষিতে নিধি বলল,

‘ ভাই তুই থাম। আর কিছু বলিস না৷ হাসির চোটে পেট ফেটে যাচ্ছে আমার। ‘

সৌধ বিরক্ত সূচক শব্দ করে বলল,

‘ হাসির চোটে মানুষের পেট ফাটে কীভাবে? সুহাসের মতো তোরও মাথা খারাপ হলো নাকি? ‘

‘ আরেহ ভাই… ‘

নিধি এ পর্যন্ত বলতেই সৌধ ধমকে ওঠল,

‘ চুপপ! ‘

আঁতকে ওঠে বড়ো বড়ো চোখে তাকাল নিধি। ডানহাতটা বুকে চেপে ঢোক গিলে বলল,

‘ কীরে ভাইই এভাবে ধমকাস ক্যান। ‘

অসহ্য হয়ে নিধির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সৌধ। নিচু কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘ কীরে বাল এই মেয়ের সমস্যা কী! ‘

সুহাস শুনতে পেয়ে মিটিমিটি হাসল। খেয়াল করে সৌধ চোখ রাঙাল। বলল,

‘ সুহাস, অহেতুক নামীর সাথে ঝগড়া করবি না। এমনিতেই খেলার নিয়ম ভেঙে মেজাজ গরম করে দিছিস। ‘

সুহাস ফিসফিস করে বলল,

‘ আমার জন্য মেজাজ বেশি বিগড়েছে নাকি ভবিষ্যত বউয়ের মুখে ভাই শুনে বেশি বিগড়েছে? ‘

ওদের ফিসফাসের মাঝে হঠাৎ নামী বলে ওঠল,

‘ ওয়েট ভাইয়া, আপনার বন্ধুকে জবাবটা দিয়ে দিই। কিছু সময় যোগ্য জবাব দিতে হয়। ‘

সৌধ চুপ মেরে তাকাল নামীর দিকে। নিধি, আইয়াজ, ফারাহ উৎসুক চাউনি নিক্ষেপ করল নামীর দিকে। সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নামী সেই কুঁচকানো মুখে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে লেপ্টে বলল,

‘ তো মিস্টার সুহাস, কী বলছিলেন? ‘

একটু ভাবার ভাণ করে পুনরায় বলল,

‘ আপনি হ্যান্ডসাম? ওহ রেইলি তাই মনে হয় আপনার? নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছেন? আমার মনে হচ্ছে দেখেননি। যদি দেখতেন আপনার এই পাটকাঠির মতো ফকফকা দেহটি আর যাইহোক সুদর্শন মনে হতো না। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে একবার তাকাল সৌধর দিকে। আরেকবার তাকাল আইয়াজের দিকে। এরপর শক্ত মুখে বলল,

‘ শুনুন মিস্টার ফকফকা চেঙ্গিস খান, হ্যান্ডসাম শব্দটির ডেফিনেশন আপনার এই দুই বন্ধুকে দেখে যখন বুঝেননি। তাহলে তাদের থেকে ভালো করে জেনে নেবেন৷ ডেফিনেশন না জানা অবধি আর মেডিকেল কলেজে পা রাখবেন না৷ তাহলে ঐ কলেজের আঙিনাও লজ্জা পেয়ে যাবে আপনাকে দেখে। ‘

উপস্থিত সকলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সুহাস যেন একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে গেল অকস্মাৎ আক্রমণে। পুরুষ মানুষ আর যাইহোক নিজের সঙ্গে অন্য পুরুষের তুলনা সহ্য করতে পারে না। তুলনা দেয়া মানুষটা যদি হয় নিজের বিয়ে করা বউ তাহলে তো কথাই নেই। সবচেয়ে বেশি আহত হলো নামী তার বন্ধুদের সুদর্শনতার তুলনা দিচ্ছে বলে। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে সৌধ আর আইয়াজের দিকে তাকাল সুহাস। বয়স হিসেবে শুধু উচ্চতাই বেড়েছে তার। স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি নেই। তার গায়ের রঙ ফরসা, উচ্চতা ছ’ফুট এক। তবুও সে সুদর্শন নয়৷ এদিকে সৌধ উচ্চতায় তার চেয়ে এক ইঞ্চি কম আইয়াজ কম তিন ইঞ্চি। গায়ের রঙে সৌধ তার থেকে পিছিয়ে না থাকলেও শ্যামবর্ণের আইয়াজ পিছিয়ে৷ তবু নামীর চোখে তারা সুদর্শন। কারণ তাদের নজরকাড়া শরীর আছে। পুরুষের ব্যায়ামপুষ্ট দেহ নারীর দুর্বলতা। সে জানত তবু কখনো এসবে আগ্রহ পায়নি। তবে আজ পেল। মনে তীব্র জেদ চাপল নামীদামিকে সে দেখিয়ে দেবে। এই পাতলা শরীরের জন্য সকলের সামনে এভাবে অপমান করল নামীদামি? এর জবাব সে একদিন দেবেই দেবে। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সুহাস। নামীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘ এর জবাব তুমি একদিন পাবে। ‘

নামী গা ঝাড়ার মতো করে কথাটা ঝেড়ে ফেলল। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘ ওহ হ্যাঁ আরো একটা কথা। আপনার মুখের এই চাকমা গড়ন আর যাইহোক কোনো বাঙালি মেয়ের কাছে সুদর্শন মনে হবে না। ‘

প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী। এবার শান্তি লাগছে খুব৷ বুকের ভেতর আনন্দেরা লুটোপুটি খাচ্ছে শান্তিতে। স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিতে মন চাচ্ছে, আজকের এই মুহুর্তটুকু। দ্য গ্রেট সুহাস ওরফে মিস্টার ফকফকা চেঙ্গিস খানের অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া মানসিক শান্তি ফিরে পাচ্ছে সে।

তীব্র ক্রোধে দপদপ করতে করতে সুহাস কিছু বলতে যাবে, তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিল নিধি। কড়াভাবে সকলকে ধমক দিয়ে বলল, খেলা শুরু করতে। এদিকে আইয়াজও তাদের আসল পরিকল্পনার কথা স্মরণ করিয়ে দিল৷ একবার নামীর পালা আসুক। খেলা শুরু হলো যথারীতি। ঘুরতে ঘুরতে বোতল থামল ফারাহর মুখ করে। সবাই হইহই করে ওঠল। নামী বলল,

‘ ফারাহ ঝটপট বলে ফেল তো এ যাবৎ কয়টা প্রেম করেছিস? ‘

নাকের ডগায় আসা চশমা ঠেলতে ঠেলতে আইয়াজের দিকে এক পলক তাকাল ফারাহ। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,

‘ একটাও না। ‘

সুহাস বিশ্বাস করল না। তাই বলল,

‘ পুরাই ঢপ। ‘

নিধি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ চুপ কর তুই। সবাই কি তোর মতো রোমিও হবে নাকি? ‘

আইয়াজের চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি৷ সৌধ বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে নিচুস্বরে তাকে বলল,

‘ বেস্ট অফ লাক দোস্ত একদম খাপে খাপ। ‘

ফারাহর পর আবার নিধির দিকে বোতল থামল। সুহাস হইহই করে বলল,

‘ দোস্ত তুই জানি কয়টা ছ্যাঁকা খাইছিস? ‘

নিধি খোশমেজাজে জবাব দিল,

‘ একটাই তো,ঐ যে ক্লাস সেভেনে। রোল এক হওয়ার অপরাধে ফেল্টুস বয়ফ্রেন্ড ব্রেকআপ করে দিল। শালা নিশ্চিত এখন ভ্যান চালিয়ে খায়। ‘

সৌধ ছোটো-ছোটো চোখে তাকিয়ে আছে৷ নিধির চোখে চোখ পড়তেই ফোঁস করে বলল,

‘ তোর কি সেই ভ্যানে চড়ে আমার সাথে প্রেম করার স্বাদ জাগছে? ‘

‘ মোটেই না আমি বরং চিন্তিত এই ভেবে যে, অর্পণ স্যার না পটলে সেকেণ্ড ছ্যাঁকা আসন্ন। ‘

চোখ কটমট করে তাকাল সৌধ। সবাই মিটিমিটি হাসতে হাসতে আবার খেলা শুরু করল। এবারে বোতল ঘুরতে ঘুরতে মুখটা গিয়ে থামল সৌধের দিকে। সুহাস কাউকেই কিছু বলতে দিল না। সে যেন প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল,

‘ সৌধ, আংকেলকে ফোন দে। দিয়ে বল, তুই একটা মেয়েকে ভালোবাসিস। ‘

সৌধ প্রচণ্ড সাহসী ছেলে হলেও বাবাকে খুব মান্য করে। তাই সুহাসের ধারণা ছিল সৌধ এ যাত্রায় হার মেনে নিবে। সামান্য গেমকে এতটা প্রাধান্য দেবে না।
কিন্তু সৌধ তো হার মানার পাত্র না৷ জীবনের ছোটোখাটো বিষয় থেকে বড়ো বড়ো বিষয়াদি। কোনোটাতেই এই ছেলে হারতে রাজি হয়নি। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য জীবনের সব লড়াইয়ে জিততে হবে। জীবনের সব পরিস্থিতিতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে৷ এখনো হলো তাই। সে মুহুর্তেই বাবাকে ফোন করল। সালাম দিল লম্বা করে,

‘ আসসালামু আলাইকুম বাবা। ‘

‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম আব্বাজান। ঘুমাওনি এখনো? ‘

‘ না বাবা, জরুরি কথা বলতে ফোন করেছি। ‘

‘ জি? ‘

‘ আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। ‘

সকলে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে। নিধির চোখে একই সাথে বিস্ময় আর অবিশ্বাস। কারণ সৌধ ফোনে বাবাকে এ কথা বলার সময় তার দিকেই দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ঢোক গিলল সে৷ অনুভব করল বুক কাঁপছে তার। ফোনের ওপাশে ছেলের কথা শুনে এমপি সুজা চৌধুরী হো হো করে হাসলেন। বললেন,

‘ ডাক্তারি পাশ দিয়ে বিয়ে করবা নাকি পড়ার ফাঁকেই? যা বলবা তাই করব। শর্ত একটাই আমাকে ডাক্তারি লাইসেন্স এনে দিতে হবো। সবাই যেন এক ডাকে বলতে পারে এমপি সুজা চৌধুরীর তিন সন্তানই মানুষের মতো মানুষ হইছে। ‘

ছেলের থেকে বাবা কত ধাপ এগিয়ে টের পেল সুহাস৷ কারণ সে সৌধর খুব কাছাকাছি বসাতে সুজা আংকেলের কথা শুনতে পেল সব। সৌধ সুহাস সহ সকলের দিকে নজর বুলাল। এরপর দৃষ্টি গিয়ে স্থির করল নিধির ভীত মুখটায়। বলল,

‘ এ ব্যাপারে পরে কথা বলব বাবা। রাখছি। ‘

ফোন কেটে দিল সে। সকলের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। নামী শুধু অবাক হয়ে দেখতে লাগল সৌধ ভাইকে। এখানে থাকা সবচেয়ে শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষ সৌধ। যেমন সাহস তেমনি ঠোঁটকাটা। মানুষের প্রতি তীব্র সম্মান বোধ যেমন আছে। তেমনি মানুষকে নিয়ে ভয়ডরের লেশমাত্র নেই। যে ছেলে বাবাকে অকপটে ভালোবাসার কথা জানাতে পারে সে ছেলের পক্ষে সব সম্ভব সব৷ নিধির দিকে তাকাল সে। তার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে। নিধি আপুর প্রতি সৌধর চোখে ভালোবাসার চিহ্ন দেখেছে সে৷ কিন্তু নিধি আপু? নিশ্চয়ই সেও বাসে। এমন শক্ত মেরুদণ্ডের পুরুষকে ভালো না বাসাটা মারাত্মক অন্যায়।

সকলের স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগল। আইয়াজ সৌধর বুকে চাপড় দিয়ে বাহবা দিল। সুহাসও বুঝে গেল এখানে সবচেয়ে অকর্মণ্য সে। কারণ এরপর আইয়াজের পালা এলে আইয়াজকে প্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যে দু লাইন গান করতে বলা হলো। সে গান পারে না। বন্ধুদের মধ্যে সুহাস খুব ভালো গান পারে। সৌধও গানের পাশাপাশি খুব ভালো গিটারিস্টও। গান, বাজনা আইয়াজ অপটু। তবু প্রিয় মানুষের সামনে বলতে পারল না সে গান পারে না৷ চেষ্টা করল
ফারাহকে উদ্দেশ্য করে দু’লাইন গাওয়ার,

‘ তোমায় দেখলে মনে হয়
হাজার বছর তোমার সাথে
ছিল পরিচয় বুঝি
ছিল পরিচয়…’

আইয়াজের কণ্ঠে গান শুনে ফারাহ লজ্জা পেল। মোটা সুর তবু কাঁপা কাঁপা। বাকিরা হাততালি দিল। এরপর বোতল ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে থামল নামীর দিকে। ঠিক এই সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিল সকলে। সুহাস নামীকে জব্দ করে নিজের মতো কিছু করতে বলতে উদ্যত হচ্ছিল। কিন্তু তাকে সবাই থামিয়ে দিয়ে নিধি বলল,

‘ খেলার সমাপ্তি তাহলে নামীকে দিয়েই হোক। ‘

এ কথা বলেই এক পলক সুহাসের দিকে তাকিয়ে নামীর দিকে তাকাল। বলল,

‘ নামী আজ সারারাত তুমি আর সুহাস এক ঘরে, এক বিছানায় কাটাবে। ‘

নিধি থামল। এবার আইয়াজ বলল,

‘ শুধু তাই নয়। সুহাসকে মাথা টিপে ঘুম পারাতে হবে। ‘

চমকে ওঠল নামী সুহাস দু’জনই। সুহাস খেয়াল করল চোখ, মুখ শক্ত করে নামী এই ডেয়ার নাকচ করতে উদ্যত হয়েছে। সুহাসও প্রথমে নাকচ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝল নামীদামিকে জব্দ করার সুবর্ণ সুযোগ এটাই তখন আর না করল না। বরং চোখ মুখে দ্যুতি ফুটিয়ে দুরন্ত হাসি হাসতে লাগল। নামী না করবে করবে ভাব এমন সময় সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘ জানিস আজ দুপুরে ছাদে গিয়েছিলাম। তারপর একজনের ইজ্জত হরণ করে নিয়ে এসেছি। ‘

কপাল কুঁচকে ফেলল নামী। সুহাস তার দিকে তাকিয়ে এসব কী বলছে? নামীকে বুঝিয়ে দিতে সুহাস পুনরায় বলল,

‘ কারো বোধহয় কোনো মূল্যবান জামাকাপড় হারানো গিয়াছে। ‘

মুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেল নামী। বুকের ভেতর দপদপানি
শুরু হলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল সুহাসের দিকে। সুহাস বলল,

‘ ডেয়ার পূরণ না করলে এদের সবাইকে স্বাক্ষী রেখে মালিকের কাছে তার মূল্যবান সম্পদ ফেরত দিব। ‘

একদিকে ডেয়ার অপরদিকে সুহাসের হুমকি। সবদিক দিয়েই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। সবদিক বিবেচনায় বাধ্য হয়ে ডেয়ার পূরণ করতে রাজি হলো। সুহাস যদি পরপুরুষ হতো তাহলে হয়তো হার মেনে নিত৷ যেহেতু সে পরপুরুষ নয় সেহেতু হার মানার প্রশ্নই ওঠে না। সুহাস যখন বুঝল নামী ডেয়ার পূরণ করবে তখন মনে মনে তীব্র জিদ্দি হয়ে বলল,

‘ আজকের রাতটা তুমি কখনো ভুলতে পারবে না নামীদামি। ‘

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৫

সুহাস নামীকে একঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল নিধি৷ এরপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে সৌধ, আইয়াজ আর ফারাহর সঙ্গে খুঁড়িয়ে নিচে চলে এলো। তাকে সাহায্য করল সৌধ। সুহাস, নামীর মধ্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। বদ্ধঘরে এবার দু’জন মা’রামারি করুক, কা’টাকা’টি করুক। বা প্রেম, ভালোবাসায় হাবুডুবু খাক। এটা সম্পূর্ণ ওদের ব্যাপার। তবু দু’জন কাছাকাছি থাকুক। অচেনা, অজানা দু’টো ছেলেমেয়ে। অল্প বয়সে বিয়ের মতো একটি সম্পর্কে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক। পরিবারের উচিত ছিল ওদের একে অপরকে বোঝাপড়ার সময় দেয়ার। তা না করে মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাঁধা নয় ছেলেমেয়ে দুটোর মনে এমন বিষ ঢেলেছে যে তারা একে অপরকে শত্রুর চোখে দেখে৷ বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ইমম্যাচিওর সুহাস। ফলে মা ভক্তি তাকে আরো বেশি ইমম্যাচিওর করে তুলেছে। তবে বন্ধুদের বিশ্বাস সুহাস যেটা দেখাচ্ছে এটা আসলে ও নয়৷ সে দুরন্ত মনের ছেলে হলেও অনেক দিন ধরে চেনে তারা। গড়মিল তো আছেই। সেই গড়মিলের সমাধান আজকের রাতেই মিলবে। নিজেদের পরিকল্পনায় সফল হলো ওরা। ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসল সকলে। নিধি বলল,

‘ ফারাহ কফি বানাতে পারো?’

ফারাহ মাথা নাড়াল সে পারে। নিধি বলল,

‘ আচ্ছা, আমাদের জন্য কফি করে নিয়ে এসো। আমিত সাহায্য করতে পারব না৷ তাই আইয়াজ তোমাকে সাহায্য করবে।

কথাটা বলেই তাকাল আইয়াজের দিকে। বলল,

‘ আমাদের সব বন্ধুর প্রতিই যত্নশীল হওয়া উচিত। ‘

আইয়াজ থতমত খেলেও খুশি হলো। প্রচণ্ড ভদ্র, সভ্য বন্ধুর এই খুশিটা দেখতে চেয়েছিল নিধি। পাশের সোফায় বসে থাকা ফারাহ প্রচণ্ড লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে দাঁড়াল। চলে গেল রান্নাঘরে পিছন পিছন গেল আইয়াজও৷

এদিকে সম্মুখে আয়েশি ভঙ্গিতে বসা সৌধ নিধির কথার পাল্টা জবাব দিল,

‘ হ্যাঁ আমাদের সব বন্ধুর প্রতিই যত্নশীল হওয়া উচিত। এই যে তুই একা একা এখানে বসে আছিস। আর আমি সঙ্গ দিচ্ছি। এটাও যত্ন৷ ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল নিধি। বন্ধুদের মধ্যে সবাই জানে একাকী ঘরে থাকতে পারে না সে৷ ভয় পেয়ে প্রচণ্ড খারাপ অবস্থা হয়। একবার জরুরি প্রয়োজনে প্রাচী বাড়ি গিয়েছিল। সে একা ছিল বাসায়। মাঝরাতে কারেন্ট চলে যাবার পর ভয়ে প্যানিক এট্যাক হয়েছিল। খুব কষ্টে ফোন চেপে শুধু কল করতে পেরেছিল সুহাসকে৷ এ শহরে তার আপন বলতে এরাই। নিজের সমস্যা গুলোর কথা পরিবারে জানাতে না পারলেই এই চার বন্ধুকে অবলীলায় জানাতে পারে। নিধির পরিবার কখনো চায়নি সে ডাক্তারি পড়াশোনা করুক৷ নিজ মেধায় মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার পরও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বাবা। চার কন্যার মধ্যে সে দ্বিতীয় জন। বড়ো বোন ডিভোর্সি। বাবা, চাচারা চেয়েছিল সে অনার্স ভর্তি হয়ে বিয়ে করে সংসারি হোক। শক্ত মনোবলের মেয়ে হয়ে বাবা, চাচাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি নিধি। মাকে বুঝিয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে৷ মায়েরা আর যাইহোক মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না৷ নিধির মাও পারেনি। তাই স্বামীর সঙ্গে লড়াই করেছে। রাগ করে পড়াশোনার জন্য নিধির পিছনে একটা টাকাও খরচ করে না বাবা। নিধির মাও স্বামীর সহায়তা আশা করেনি। সে তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তি ভাইয়ের নামে লিখে দিয়েছে। বিনিময়ে ভাই নিয়েছে নিধির পড়াশোনার দায়িত্ব। পারিবারিক এই জটিলতা গুলোর জন্যই নিধি নিজের জীবনের কোনো সমস্যার কথাই মাকে জানায় না৷ কপাল গুণে কিছু বন্ধু পেয়েছে। তারা জীবনে আসার পর জীবন যতটা কঠিন ভেবেছিল ততটা কঠিন মনে হয়নি আর। সেদিন মধ্যরাতেই উপস্থিত হয়েছিল সুহাস। সঙ্গে সৌধ আর স্মৃতি আপুকে নিয়ে। যতই বন্ধু হোক, যতই সৌধ এমপির ছেলে হোক৷ বাড়িওয়ালা মধ্যরাতে তাদের ঢুকতে দেবে না৷ তাছাড়া নিধিকে সামলাতে একজন মেয়ে লাগবেই। তাই বুদ্ধি করে বড়ো বোনকে নিয়ে এসেছিল সৌধ। স্মৃতি আপু সৌধর জীবনের প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই সে খুব সুন্দর ভাবেই সামলে নিয়েছিল সবটা। নিধির সঙ্গে স্মৃতি আপুর বন্ধুত্বের সূচনা সেখান থেকেই। সেদিনের পর থেকে সবাই জানে অতিরিক্ত ভয় পেলে প্যানিক এট্যাক হয় নিধির। ঠিক সেটা ভেবেই সৌধ মিটিমিটি হাসছিল তখন। কারণ সে জানে, জরুরি কথা বাহানা মাত্র৷ সেদিনের পর থেকে অন্ধকারেও এলার্জি নিধির। এই মেয়ে নাকি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্তারি পড়ছে। বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হয় সৌধর।

কফি বানানো কী এমন কঠিন কাজ যে আইয়াজের সহায়তা নিতে হবে? তাই নরম সুরে ফারাহ বলল,

‘ আপনার কিছু করতে হবে না। আমি করতে পারব।’

কথাটা শুনে আইয়াজ একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর ফারাহ তাকাল তার দিকে। তাকানোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠল,

‘ কিছু করতে হবে না যখন তখন দাঁড়িয়ে না থেকে ওখানে গিয়ে বসুন। ‘

নড়েচড়ে ওঠল আইয়াজ। প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফারাহর দিকে। বলতে চাইল,

‘ তুমি কফি বানাও, আমি এখানেই থাকি। একসঙ্গে ওদের কাছে যাব৷ ‘

কিন্তু বলে ফেলল,

‘ তুমি কফি বানাও, আর আমি তোমাকে দেখি!’

কথাটা শুনতেই দেহ শিউরে ওঠল ফারাহর। সহসা দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাজে মন দিল সে। আইয়াজ হতভম্ব হয়ে গেল। এটা কী বলে ফেলল সে? হয়েছে টা কী তার? এমন উল্টাপাল্টা করলে ফারাহ তাকে কী মনে করবে? নিজেকে ধাতস্থ করে নিল আইয়াজ। বড়ো বড়ো করে দু’বার নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বদলাতে হবে৷ কিন্তু কী বলা যায়… ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল তারা ম্যাসেজে অনেক কথাই বলেছে। পড়াশোনা নিয়ে, নিজেদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে। এর বাইরে কিছু বলা বা জানা হয়নি। তাই বলল,

‘ তোমার পরিবারে কে কে আছে? ‘

‘ আমি আপু, দুলাভাই, আর ভাগ্নি। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল আইয়াজের। বলল,

‘ বাবা, মায়ের সাথে থাকো না? ‘

মুখে মেঘ জমল ফারাহর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমার বাবা, মা নেই। আমি এতিম! ‘

আমি এতিম! বাক্যটিতে আহত হলো আইয়াজ। তার দুচোখে মেয়েটির জন্য অদ্ভুত মায়া জেগে ওঠল। বুকের ভেতর অনুভব করল চিনচিনে ব্যথা। অপরাধীর ন্যায় মস্তক নত করে বলল,

‘ আই এম সরি। ‘

নিজের ঝাপসা চোখ চশমার আড়ালে রেখেই মৃদু হাসল ফারাহ৷ বলল,

‘ সরি বলছেন কেন? আপনি কোনো ভুল করেননি। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর বাবা মারা যায় তিন বছর আগে। তাই বড়ো বোনের কাছেই থাকি আমি। ‘

নিজের দূর্ভাগ্যের কথা শুনে আইয়াজের মুখ ব্যথিত হলো বলে খারাপ লাগল ফারাহর। তাই নিজের কথার ইতি টেনে জিজ্ঞেস করল ,

‘ আপনার পরিবারে কে কে আছেন? ‘

আইয়াজ তাকাল ফারাহর মলিন মুখটায়। ঈষৎ হেসে বলল,

‘ মা, বাবা, বড়ো ভাই, ভাবি আর ছোটো বোন। ‘
***
প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে নামীর৷ বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়েছে ওরা। আজ এই ত্যাঁদড় ছেলে সুহাসের সাথে রাত কাটাতে হবে। বিছানার এক কোণে বসে হাসফাস করছে মেয়েটা৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নামীর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেল সুহাস। এরপর তাকাল নিজের দিকে। আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আর ভাবল, সে নিঃসন্দেহে সুদর্শন। গায়ের রঙ, হাইট দু’টোই ঠিকঠাক তবে কমতিটা কী? সৌধ অনেকবার তাকে বলেছিল তার সঙ্গে জিমে যেতে৷ নিয়মিত ব্যায়াম করতে। সে কথা শুনেনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সৌধর কথা শোনা উচিত ছিল৷ আগে শুনেনি তাতে কী হয়েছে? এবার থেকে শরীর চর্চা করবে সে। সুহাসের কেন জানি মনে হলো তার গার্লফ্রেন্ডদের তুলনায় নামী অনেক বেশি স্মার্ট। উন্নত মনের মেয়ে। অরিনকে সে সবচেয়ে স্মার্ট মনে করত। অথচ অরিনও কোনোদিন তাকে শরীর চর্চা করতে বলেনি। নিজের হ্যাংলা, পাতলা শরীরটা বিরক্ত লাগল সুহাসের। কল্পনায় আঁকল নিজের ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। বাহ দারুণ, শরীর তাহলে ফিট করতেই হবে। ভেবেই আয়নায় তাকাল। নামীকে দেখে দিল দুর্ভেদ্য হাসি। বলল,

‘ কী নামীদামি? ভয় করছে? ‘

চকিতে তাকাল নামী। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,

‘ কেন ভয় পাব কেন? ‘

প্রশ্নটি করে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না সে। পা দুলাতে শুরু করল ক্রমাগত৷ সুহাস সেদিকে খেয়াল করে ঘুরে দাঁড়াল। কেন জানি মনে হলো অতিরিক্ত টেনশনে নামীর মুখটা চুপসে গেছে৷ আর এই যে পা দুলাচ্ছে এটাও অতিরিক্ত চিন্তার ফল। নামীর মুখে ভয়, দুঃশ্চিতার ছাপ দেখে তার মনে সুড়সুড়ি লাগল। চনমনে চিত্তে বলল,

‘ এই ফকফকা চেঙ্গিস খান এখন তোমার সব অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। তবুও ভয় লাগছে না? ‘

‘ তার মানে স্বীকার করলেন আপনি ফকফকা চেঙ্গিস খান? ‘

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সুহাস বলল,

‘ তোমার ভাষ্যে। ‘

কথাটা বলেই ধীরপায়ে এগুতে লাগল সে। তার ভাবমূর্তি আর আগানো দেখে নামী আতঙ্কিত হলো। মনে মনে বিপদের দোয়া পড়ে আশপাশে তাকাল সচেতন চোখে৷ চিৎকার দিতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল৷ কী লাভ চিৎকার করে? সুহাস তার স্বামী। সম্পর্কে জটিলতা আছে ঠিক। কিন্তু সুহাস যদি তার ওপর অধিকার ফলায় সে কি সত্যি বাঁধা দিতে পারে? হ্যাঁ পারে কিন্তু সেটা সকলের চোখে অশোভন দেখাবে। কিন্তু নিজের চোখে না। তাই ধাতস্থ হয়ে কাঁপা গলায় বলল,

‘ সুহাস, আপনি আমার কথাটা শুনুন। ‘

সুহাস হাসল। হাসিটা কেন যেন বিকৃত দেখাল নামীর চোখে। সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পা তুলে বসল। ততক্ষণে সুহাস কাছাকাছি এসে গেছে। নামীর শরীর কাঁপতে শুরু করল। পিছিয়ে গেল তড়াক করে। সুহাস হো হো করে হেসে ওঠল। বসল বিছানায়। বিদ্রুপ করে বলল,

‘ এ কী কাণ্ড! নামীদামি যে ভয় পাচ্ছে। ‘

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে বড়ো বড়ো করে শ্বাস টানল নামী। সুহাস ভ্রু কুঁচকে অকস্মাৎ বলল,

‘ অ্যাজমা কি ছোঁয়াচে রোগ? ‘

সুহাস জানে হাঁপানি ছোঁয়াচে রোগ না৷ তবু নামীকে চটাতে বলল কথাটা৷ কিন্তু নামী অদ্ভুত চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ পড়াশোনা করে নিজের গরজে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছেন? নাকি বাবা, মা টাকার জোরে জোর পূর্বক ওখানে ভর্তি করিয়েছে? ‘

ক্ষেপে গেল সুহাস। চোখ, মুখ শক্ত করে বলল,

‘ মানে? আমার মেধা নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুলছ! ‘

ঢোক গিলল নামী। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল মুহুর্তেই। ভাবল কথার প্যাঁচে ফেলে সুহাসকে বাগে আনতে হবে৷ তাই বলল

‘ শুধু আপনার মেধা নিয়ে নয় মেরুদণ্ড নিয়েও আমি সন্দিহান। ‘

‘ হোয়াট! ‘

‘ হ্যাঁ। আপনি একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ। এজন্যই বাবার আদেশে বিয়ে করেছেন, মায়ের আদেশে বিয়ে অস্বীকার করেছেন৷ ‘

‘ নামী! ‘

‘ ধমকালেই সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না সুহাস। আর আপনি যাকে সহ্য করতে পারেন না, নির্লজ্জের মতো তার কাছাকাছি আসছেন কেন? বিবেকে বাঁধছে না? নিজেই ভাবুন তো এসব দেখে আপনাকে নিয়ে আমার ধারণা এছাড়া আর কী হবে? ‘

‘ এটা একটা গেম। শর্ত অনুযায়ী সারারাত মাথা টিপে দেবে আমার। ‘

চমকাল নামী। তার মানে সে যা ভাবছে অমন কিছু নয়? তাহলে সুহাস ওভাবে কেন বলল সব অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে? মনের প্রশ্ন মুখে বেরিয়ে এলো তার। সুহাস টের পেল কথাটা শুনে নামী ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই এমন করছে। তৎক্ষনাৎ আবার সুহাস পূর্বের রূপ ধারণ করল। আজ এই নামীদামিকে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে৷ ভাবনা অনুযায়ী হাত বাড়াল সে। নামী ছিটকে সরে গিয়ে চাপা ক্রোধে বলল,

‘ আমাকে স্পর্শ করবেন না আপনি। ‘

সুহাস শুনল না সে কথা। হেঁচকা টান দিয়ে নামীকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো। একহাতে নামীর বাহু অন্যহাতে নামীর কোমর চেপে ধরল শক্ত হাতে। মুখ খিঁচিয়ে রইল নামী৷ নিজেকে সুহাসের বাঁধন থেকে ছুটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। শাসাতে লাগল অসংখ্য বাক্য দ্বারা৷ কিন্তু সুহাস সেসবের ধার ধারল না৷ সন্তর্পণে নামীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাক ঘষতে শুরু করল। নামী দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করল অপ্রিয় স্বামীর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো। সুহাস তার নরম শরীর ছুঁয়ে বদ্ধ দৃষ্টিজোড়ায় তাকিয়ে মাতাল সুরে বলল,

‘ এই চেঙ্গিস খানের এটুকু শক্তির সঙ্গেই কুলোতে পারছ না নামীদামি? তাহলে আজ কী হবে ভাবো একবার। ‘

শাসাল বাক্যটি শুনে শরীর কাঁপতে শুরু করল নামীর। চোখের পাতা, ঠোঁটজোড়াও কেঁপে কেঁপে ওঠল। সুহাস খুব কাছ থেকে দেখল সেই কম্পন। যতটা বোঝাল ততটা করবে না সে। তবু তার এটুকু স্পর্শেই যে নামী ঘৃণায় মূর্ছা যাচ্ছে। এতেই আত্মতৃপ্তি মিলছে৷ বাঁকা হাসল সুহাস। একেবারে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রও সে নয়। কিছু একটা ঘটানো উচিত। ভেবেই চট করে নামীর গলা জুড়ে থাকা ওড়নাটা খুলে ফেলল। চোখের সামনে ভেসে ওঠল শ্যামলাটে নামীর লাস্যময়ী রূপ। মস্তিষ্কই এলোমেলো হয়ে গেল সুহাসের৷ নামী কাচুমাচু হয়ে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করল। সুহাস বক্র হাসি ঝুলিয়েই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

‘ মেয়ে, তোমার রূপে আগুন না থাকলেও কথায় আগুন আছে। আজ এই নরম বিছানায় প্রমাণ করব
তোমার ঐ অগ্নিবাণ কথার ক্ষমতা বেশি নাকি
এই হ্যাংলা, পাতলা সুহাসের ক্ষমতা বেশি। ‘

সুহাসের এহেন কথায় থমকে গেল নামী৷ তার দুচোখ বেয়ে গড়াল নোনাপানির ধারা। সুহাসের কাঁধ ভিজে ওঠল। নামীর হঠাৎ চুপসে যাওয়া, নোনা পানির স্পর্শে চুপসে গেল সুহাস। বলল,

‘ আর ইউ ওকে? ‘

নামী রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল৷ রক্তবর্ণ চোখে তাকাল সুহাসের চোখে। কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের গালে। সুহাস অবাক হলো। হঠাৎ নামীর এই অদ্ভুত আচরণে হিমশিম খেয়ে গেল সে। কিছু বলতে উদ্যত হবে তৎক্ষনাৎই নামী ভাঙা কন্ঠে বলল,

‘ আমরা স্বামী-স্ত্রী সুহাস। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন। আমাকে স্পর্শ করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার৷ কিন্তু কি জানেন? মন থেকে আমি আপনার স্পর্শ গুলো গ্রহণ করতে পারব না৷ আফসোস টা আমার এখানেই। মনের বিরুদ্ধে কোনো পুরুষকে শরীর দিয়ে দেওয়া খুব যন্ত্রণার। যে ছেলে আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, সে ছেলে আমার এই শরীরটাকে কত সহজে গ্রহণ করতে চাইছে। ‘

শেষ বাক্যে প্রচণ্ড তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ পেল। সুহাসের মুখের আকৃতি বদলে গেল নিমেষে৷ বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠল তার। নামী ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে পুনরায় বলল,

‘ নারীকে ছোঁয়া সাধনার বিষয় সুহাস। নারীর শরীর ছুঁয়ে নারীকে ছুঁয়েছি ভাবা ঘোলকে দই ভেবে খাওয়া একই কথা৷ দইয়ের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে পুরুষরা নিজেদের শক্তিমান, ক্ষমতাবান মনে করে৷ কিন্তু তারা জানে না তাদের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা এখানেই। কারণ তারা নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনি। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সুহাসের। বলল,

‘ তার মানে তোমার শরীর ঘোল? আর হৃদয় দই? ‘

ম্লান হাসল নামী। আফসোস হলো সুহাসের অপরিপক্ক মানসিকতার কথা ভেবে৷ এই ছেলে কবে বড়ো হবে? কোনোদিন কি এই ছেলে বুঝবে ভালোবাসা কী? সম্পর্ক কী? নাকি সবটা বোঝার আগেই মিসেস উদয়িনী তাদের সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে দেবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। নিজেকে সুহাসের দুই হাতের বন্ধনে আবদ্ধ দেখে নিয়ে পুনরায় চোখ রাখল ধূসর রাঙা চোখ দুটোয়। বলল,

‘ শুনেন নির্বোধ পুরুষ, নারীর হৃদয় না ছুঁয়ে দেহ ছোঁয়া পুরুষকে ধর্ষক বলে। ‘

সহসা নামীকে নিজের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল সুহাস। মুক্তি পেয়েও কোনো ভাবান্তর হলো না নামীর। বরং সে ভয়ানক এক কাণ্ড করে বসল। শরীর ছেড়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। শরীরে ওড়না না থাকায় ঘনঘন নিঃশ্বাসের সাথে গলা এবং উদরের মধ্যবর্তী আকর্ষক অংশটুকু উঠানামা করছে। সুহাস দৃষ্টি সংযত করল এবার। নামী সেসব খেয়াল করল না। তীব্র জেদি কণ্ঠে বলল,

‘ নিজেকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে মেলে দিলাম। আমাকে ভোগ করুন সুহাস। নাম মাত্র বিয়ের বদৌলতে আজকের রাতটার জন্য আমার শরীরটাকে দিয়ে দিলাম। বিনিময়ে একটা জিনিস চাই আপনার থেকে। ‘

থমকানো দৃষ্টিতে নামীর অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকাল সুহাস। ঈষৎ হেসে নামী বলল,

‘ ডিভোর্স চাই। ‘

বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল সুহাসের। হতভম্ব মুখে পলক ফেলতে ভুলে গেল সে৷ নামী পুনরায় বলল,

‘ ভয় নেই। আপনার মা, বাবার সংসার নষ্ট হবে না। ডিভোর্সটা গোপন থাকবে সাড়ে পাঁচ বছর বা ছ’বছর। পড়াশোনা শেষ করে দেশে চাকরি করার ইচ্ছে নেই আমার। ইন্টার্ন শেষে লাইসেন্স পেয়ে গেলেই আমেরিকায় চলে যাব। আর তখনি সবাই জানবে আমাদের ডিভোর্সের কথা। এরজন্য আপনাকে কোনোভাবেই দায়ী করা হবে না। সম্পূর্ণ দায় আমার ঘাড়ে নিব৷ এতে আশা করি আংকেল আপনার বা আপনার মায়ের ওপর অহেতুক রাগ ঝাড়বে না। আপনার হয়তো মনে হতে পরে এখুনি কেন ডিভোর্স চাইছি। কয়েক বছর পরে ডিভোর্স নিলেও তো চলবে। না সুহাস চলবে না। ডিভোর্স আমার এখুনি চাই৷ আপনার বউ হওয়ার পর থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। অপমানে, অসম্মানে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার আত্মসম্মানে আঘাত পড়ছে। যে ছেলে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। যে জনসম্মুখে স্বীকার করে না আমাকে, গোপনে তার বউ হয়ে থাকাটা তীব্র যন্ত্রণার। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর অসম্মান থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করুন প্লিজ। ‘

সমাজের এক অমোঘ সত্য নারীরা শরীর বেঁচে সম্মান খোয়ায়। আজ আরো এক সত্যির সম্মুখীন হলো সুহাস। কেউ শরীর বেঁচে সম্মান খোয়ায়। কেউ বা সম্মানের বিনিময়ে শরীর বেঁচতে চায়। হ্যাঁ নামী এক রাত তার স্বামীর দৈহিক চাহিদা মিটিয়ে চিরদিনের জন্য নিজে সম্মানের সাথে বাঁচতে চাইছে৷ তীব্র ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠল সুহাসের৷ এতটা অধঃপতনও হয়নি তার। নামী কী করে পারল তাকে এতটা নীচ ভাবতে? সে তো শুধু ভয় দেখাচ্ছিল! জব্দ করছিল দেমাকি নামীদামিকে। তীব্র ক্রোধে দপদপিয়ে ওঠল মাথাটা। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। নিধি দরজা লক করে দিয়েছে। তাই বাথরুমে ঢুকে প্রচণ্ড শব্দ করে দরজা আটকে দিল। টিশার্ট খুলে আছড়ে ফেলল মেঝেতে। এরপর শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিচে দাঁড়িয়ে রইল। নামীর দৃষ্টি ছাদের দিকে। নিশ্চল দেহে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কর্ণে ঠিকই শুনতে পেল শাওয়ারের শব্দ!

চলবে..

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৬

সুহাস, নামী এক সঙ্গে এক রাত বদ্ধ ঘরে থাকা মানে ভয়াবহ সুনামি ঘটবেই ঘটবে। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল বন্ধুরা। কিন্তু সেই সুনামির পরিণাম যে সুহাসকে এভাবে বদলাতে শুরু করবে ভাবতে পারেনি ওরা। ভাবতে পারেনি স্বয়ং নামীও। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেদিনের পর সুহাস আর নামীর পেছনে লাগেনি৷ কখনো সামনে পড়লে অল্প সময় চোখাচোখি হয়েছে শুধু৷ নামী ঐ চোখে পূর্বের মতো ক্রোধ দেখতে পায়নি। পায়নি বিন্দুমাত্র দুরন্তপনাও। ও চোখের ভাষা ঠিক কী বুঝতেও পারেনি সে। বুঝতে চায়ও না৷ শুধু কৌতূহল জাগে একটি বিষয় নিয়ে। ডিভোর্সের ব্যাপারে সুহাস আগাচ্ছে না কেন? সে যেভাবে আশ্বাস দিয়েছে তাতে সুহাসেরই বেশি আগ্রহী থাকার কথা। তাহলে সুহাস নিশ্চুপ কেন? সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সেদিনের পর রোজ ফজর ওয়াক্তের পর সুহাসকে বাড়ির বাইরে যেতে দেখা যায়। জিমের পোশাক পড়ে সাইকেল নিয়ে চলে যায় সৌধদের বাড়িতে৷ তাদের বাড়ি থেকে সৌধদের বাড়ির দূরত্ব সাইকেল করে পঁচিশ মিনিট। এ বাড়িতে যে মহিলা কাজ করতে আসে তার সঙ্গে নামীর খুব ভালো সম্পর্ক। তার কাছেই শুনেছে সুহাস সৌধর ব্যক্তিগত শরীরচর্চা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছে। এ কথা সেলিনা আপাকে বলেছে সিমরান৷ সে নাকি খুব ভাব নিয়ে বলেছে,

‘ সেলিনা আপা, খুব তাড়াতাড়ি আমার ব্রোও সৌধ ভাইয়ের মতো ড্যাশিং ম্যান হয়ে যাবে। এই একটা কমতিই ছিল আমার ভাইয়ের। কত বলেছি, ভাগ্যিস এতদিনে উইজডম হলো। ‘

সুহাস ড্যাশিং ম্যান হোক বা ফাঁসিং ম্যান, যায় আসে না নামীর। তার ফোকাস কেবল ক্যারিয়ারের দিকে।

সকালবেলা নাস্তা সেরে রেডি হয়ে নিল নামী। হলুদ রঙের ঘেরওয়ালা সূতি একটি গাউন পরে তার ওপর সাদা অ্যাপ্রোন পরে নিল ঝটপট। এরপর কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে বা’হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বেরিয়ে পড়ল। গেটের সামনে আসতেই পাশের বাসার ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলেন৷ যেন নামীর অপেক্ষাতেই ছিল সে। এর আগে পরিচয় হয়েছিল উনার সাথে তাই সৌজন্যতা দেখিয়ে সালাম দিল নামী। ভদ্রমহিলা সালাম ফিরিয়ে বলল,

‘ তোমার আংকেল, আন্টি কবে ফিরবে জানো? ‘

নামী অটো দাঁড় করিয়ে তাড়াহুড়োয় উত্তর দিল,

‘ আংকেল সাতদিন পর, আন্টির কথা জানি না। আমার সাথে কথা হয়নি তার সাথে। আসি আন্টি। ‘

ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে মাথা কাত করল। নামী চলে গেলে সে ভাবল, আপাতত সোহান খন্দকারের ছেলেমেয়ের সাথেই কথা বলে যাবে। ভাবা অনুযায়ী কলিং বেলে চাপ দিল বারকয়েক। ভিতর থেকে সেলিনা এসে গেট খুলে বলল,

‘ চাচা, চাচি বাসায় নাই। ‘

‘ উনার ছেলেমেয়েরা আছে? ‘

‘ সিনু আপা কলেজে। আর সুহাস ভাই মাত্রই জিম থিকা ফিরল। ‘

ভদ্র মহিলা হাসল। বলল,

‘ আমি সুহাসের সাথেই কথা বলব। ‘

সেলিনা সন্দেহের চোখে তাকিয়েই তাকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিল। এরপর দোতলায় গিয়ে ডেকে আনল সুহাসকে৷ সুহাস রেডি হচ্ছিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য৷ এরই মধ্যে পাশের বাসার মহিলা চলে আসায় ভীষণ অবাক হলো। হঠাৎ তার কাছে কী প্রয়োজন? সে তো এদেরকে ঠিকভাবে চিনেই না। আলাপও হয়নি কখনো। কৌতূহলী চিত্তে নিচে নেমে এলো সে। বসল ভদ্রমহিলার মুখোমুখি হয়ে। ভদ্রমহিলা এক গাল হেসে বলল,

‘ আমি তোমাদের প্রতিবেশী। আমার ছেলে ইয়ামিন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। খুব ব্রিলিয়ান্ট! দেখতে লম্বা, চওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। শুধু গায়ের রঙই কালো। প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে অফিসে যায়। দেখেছ বোধহয়। ‘

সুহাস তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। ভদ্রমহিলার বেশভূষায় বলে দিচ্ছে সে যথেষ্ট শিক্ষিত আর রুচিশীল। কিন্তু আচমকা এসে এসব কথাবার্তা বলায় বিব্রত হলো সে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,

‘ হ্যাঁ দেখেছি কয়েকবার। ‘

সুহাসের এ কথায় মহিলাটির জোশ বাড়ল। বলল,

‘ তোমার বাবা, মায়ের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি অনেকদিন৷ দু’জনই ব্যস্ত মানুষ বলে সুযোগ পাচ্ছি না। তুমি কি তোমার বাবা, মায়ের নাম্বারটা দিতে পারবে? ‘

সুহাস দেরি করল না। ইয়ামিন সাহেবের মাকে বাবা, মায়ের নাম্বার দিয়ে উদ্ধার হতে চাইল। কিন্তু ইয়ামিনের মা তাকে উদ্ধার হতে দিল না। সে নাম্বার নিয়ে হঠাৎ চাপা স্বরে বলল,

‘ একটু আগে বের হলো মেয়েটার নাম তো নামী রহমান? ‘

সুহাসের ভ্রু জোড়া কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল,

‘ হুম। ‘

‘ তোমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে তো? ডাক্তারি পড়তেছে। তুমি যেখানে পড়ো ওখানেই তাই না? ‘

বাবার বন্ধুর মেয়ে নামী। এ মহিলা মায়ের বলছে কেন? তবে কি নামী বলেছে? নাকি বাবাই সবাইকে এটা বলে ম্যানেজ করেছে? আর ভাবতে পারল না সুহাস। একই তো হলো। তাই বলল,

‘ হ্যাঁ। ‘

মহিলাটি এবার আরো নিচু স্বরে বলল,

‘ মেয়েটা বেশ সুশীল আছে তাই না? কারো সাথে রিলেশনশিপেও নেই। জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন। ‘

এবারে অস্বস্তি ঠেকল সুহাসের। এমন স্মার্ট একজন মহিলা ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছে তাকে বোধগম্য হলো না। শুধু অপেক্ষা করতে লাগল পরের কথা গুলো শোনার জন্য৷ তার মন বলছে আরো কিছু বলবে সে। হলোই তাই। মহিলাটি বলল,

‘ আমার ছেলেকে তো দেখেছ? ওর জন্য পাত্রী খুঁজছি। সমস্যা হচ্ছে ফরসা চামড়ার মেয়েরা ওকে পছন্দ করে না৷ গায়ের রঙ বেশি ডার্ক হওয়াতে ওর ছবি দেখে মেয়ে তো দূরে থাক মেয়ের পরিবারই প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়৷ এজন্য আমিও আর ফরসা মেয়ে খুঁজি না। আমার ছেলেও বলে দিয়েছে ফরসা মেয়ে না দেখে সুশীল মেয়ে খুঁজো গায়ের রঙ যাই হোক ওর সমস্যা নেই। ‘

আকস্মিক কপালের রগ দপদপিয়ে ওঠল সুহাসের। এই মহিলা কী বলতে চাচ্ছে? কী বোঝাতে চাচ্ছে তাকে? নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখে চোয়াল শক্ত করে সে বলল,

‘ আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন। ‘

‘ নামী মেয়েটাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে খুব পছন্দ হয়েছে। মেধাবী মেয়ে। দেখতে শ্যামলা হলেও মুখের আদল মাশাআল্লাহ। আমার ছেলের উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় আর ওর পাঁচ ফুট পাঁচ। আমার ছেলের ওজন পচাত্তর আর নামীর ওজন তিপ্পান্ন। একদম পারফেক্ট ম্যাচ। শুনেছি ওর মা নেই সৎ মা আর বাবা আমেরিকায় থাকেন৷ ওর সব দায়িত্ব এখন তোমার বাবার। শুনো তোমার বাবার সাথে আমি কথা বলব। তুমিও উনাকে বলো আমার কোনো মেয়ে নেই৷ তিন ছেলের মধ্যে ইয়ামিনই বড়ো। ওর বউকে একদম নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো আমি। ‘

কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে সুহাসের। আর সহ্য করতে পারছে না সে। নামীর সাথে তার সম্পর্কটা হয়তো স্বাভাবিক না। তাই বলে তাদের ডিভোর্স না হতেই অন্য একজন বিয়ের প্রস্তাব আনবে? আর নামী। সেই বা কোন লজ্জায় নিজের ব্যাপারে এত কিছু বলতে গেছে? তবে কি সে নতুন করে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইছে? এজন্যই কি সেদিন ওভাবে ডিভোর্স চাইল? দু-হাত শক্ত মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল সুহাস। ইয়ামিন সাহেবের মা খেয়াল করলেন সুহাসের চোখ, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। কপাল চুইয়ে চোয়াল বেয়ে ঝড়ছে ঘাম। তাই বললেন,

‘ কী হয়েছে বাবা, গরম লাগছে? ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সুহাস। চাপা গলায় বলল,

‘ হ্যাঁ গরম লাগছে। আপনি বসুন আমি উপরে যাচ্ছি। ‘

‘ না, না বাবা আর বসব না৷ কথা তো সব বলেই দিলাম। বাকিটা তোমার বাবা, মায়ের সাথে বলব। ‘

চমকে ওঠল সুহাস। মহিলাটি বিদায় নিল। তার হৃদয় জুড়ে শুরু হলো প্রবল তরঙ্গ। বাবার সাথে কথা বললে কী হবে জানে না। কিন্তু মায়ের সাথে কথা বললে মা নির্ঘাত এর সুযোগ নেবে! মা চাইবে নামী তার জীবন থেকে পুরোপুরি চলে যাক। বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক চাপ অনুভব করল সুহাস৷ দুরুদুরু বুকে
ঢোক গিলল সে। মাথাটা জাস্ট ধরে গেল। সহ্য করতে না পেরে পকেট থেকে দ্রুত মোবাইল বের করে কল করল সৌধকে। আজ সিমরানের জন্মদিন। মা, বাবা নেই। তাই বন্ধুদের নিয়ে ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করেছে সে। তারা ভাই, বোন মা, বাবাকে খুব কম সময়ই পেয়েছে। সরকারি ছুটি ছাড়া মাকে তো পাওয়াই হয় না। জন্মদিনে সিমরান খুব মন খারাপ করে মা কাছে থাকে না বলে৷ এবার তো বাবাও কাছে নেই। তাই বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যান করেছে এবার অন্যভাবে সিমরানের জন্মদিন পালন করবে৷
সিমরান তার বন্ধুদের সাথে সারাদিন এনজয় করে রাতে ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে কেক কাটবে। সেই কেক এর দায়িত্ব দিয়েছে সৌধ আর আইয়াজের ওপর৷ ওরা কেকের সাথে মেয়ে বান্ধবী নিয়ে সিমরানের জন্য গিফট কিনতেও গেছে৷ সব কেনাকাটা শেষে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ক্লাসে যাবে। ক্লাস শেষ হবে বিকাল পাঁচটায়। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের পার্টি। সব পরিকল্পনা মাফিকই আগাচ্ছিল। এর মধ্যে ইয়ামিনের মা এসে গণ্ডগোল করে দিল। সুহাসও প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বাসায় আসতে বলল সৌধদের।

আধা ঘন্টার মধ্যে সৌধ, আইয়াজ, নিধি, প্রাচী এসে উপস্থিত হলো৷ ড্রয়িংরুম সাজানোর দায়িত্ব নিল নিধি, প্রাচী আর আইয়াজ। সাথে সেলিনা আপাও৷ ওরা ওদের কাজে লেগে পড়ল ঝটপট। ক্লাস টাইম হওয়ার পূর্বে যতটা করা যায়। এদিকে সুহাস সৌধকে নিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। এরপর নামীর ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপা সুরে বলল,

‘ সব ঐ নামীদামির কারসাজি। ও ইচ্ছে করে এটা করেছে। ‘

বলতে বলতেই নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরল। সৌধ বেআক্কলের মতো তাকিয়ে। বলল,

‘ বুঝলাম না, এখানে নামীর দোষটা কী? ‘

সুহাস বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে ওঠল। সৌধও বাদ রইল না। তেড়ে এসে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলল ওকে। এরপর ওর পেটের ওপর বসে গলা চেপে ধরে বলল,

‘ শা’লা, ম্যাঁ ম্যাঁ করে বউকে স্বীকৃতি দিবা না। সেই বউ তোমার পা চেটে পড়ে থাকব আশা করো? ‘

দুই বন্ধুর বদ্ধ ঘরের কীর্তি কেউ দেখল না৷ ওরা একে অপরের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করতে থাকল৷ সৌধর ভাষ্যে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। এটাই সুহাসের প্রাপ্য ছিল। সুহাসের ভাষ্যে নামীদামি কেন এসবে আগ্রহ প্রকাশ করবে তারা এখনো স্বামী- স্ত্রী। কোন সাহসে ঐ মহিলাকে নিজের হাইট, ওয়েট সম্পর্কে অবগত করেছে। কী প্রয়োজন ছিল উনার সাথে মিষ্টি স্বরে আলাপ করার? তার বেলায় তো ঠিকি নিম পাতার রসের মতো তেঁতো স্বর বেরোয়। প্রচণ্ড ডেসপারেট হয়ে পড়ল সুহাস৷ ভাবগতিক স্বাভাবিক না, টের পেয়ে সৌধ প্রশ্ন করল,

‘ তুই নামীকে ভালোবাসিস? ‘

সুহাস তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল,

‘ জিন্দিগি তে না। ‘

সৌধর মেজাজ খারাপ হলো। এই ছেলে ভাঙবে তবু মচকাবে না৷ তাই সে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,

‘ দেখ সুহাস ইগো টিগো দূরে রেখে ভালোই ভালোই সবটা বল। ‘

সহসা শান্ত হলো সুহাস। ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল সৌধর পাশে। বলল,

‘ তুই নামীকে বলবি না কিছু। ‘

‘ ওকে বলব না। ‘

‘ সেই রাতের পর আমি ফিল করেছি ওর প্রতি আমার তীব্র ফিলিংস আছে। আর আজ সেই ফিলিংস একদম পরিষ্কার। ‘

হো হো করে হেসে ওঠল সৌধ। বলল,

‘ তবু বলবি না তুই ওকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছিস। ‘

মুখ নিচু করে সুহাস বলল,

‘ না বলব না৷ আমি কোনো নামীদামি কে ভালোবাসি না। ‘

মিটিমিটি হাসল সৌধ। তার বন্ধুর অতিরিক্ত ইগো এরওপর আবার মায়ের ন্যাওটা। সবটা বুঝে ভরসার স্পর্শ রাখল সুহাসের কাঁধে। বলল,

‘ কুল ম্যান। নামীকে ভালোবাসা লজ্জার বা অস্বস্তির না৷ ওর মতো কঠিন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েকে ভালোবাসা গর্বের। ‘

হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। বলল,

‘ দরজার চিপায় পড়েছিরে দোস্ত। ‘

‘ আমি আছি চাপ নিস না। বের করে ফেলব। ‘

চমকে তাকাল সুহাস৷ সৌধ চোখ উপর নিচ করে বলল,

‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য রাখ, সবচেয়ে বড়ো কথা নিজের মনকে স্থির কর। কোনটা সঠিক কোনটা ভুল সুক্ষ্ম মনে বোঝার চেষ্টা কর। স্যালিউশন পাবি। না পেলে আমরা আছি৷ ‘

শেষ কথাটা বলেই চোখ টিপ দিল সৌধ৷ মাথার ওপর থেকে অনেক বড়ো একটি বোঝা নেমে গেল নিমেষে। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। বলল,

‘ পার্টিতে নামীদামিকে রাখার ব্যবস্থা করিস। ‘

ফিচেল হেসে সৌধ বলল,

‘ নিধির ওপর ছেড়ে দিছি। ও সিমরানকে বোঝাবে। সিমরান যেচে ইনভাইট করলে নামী প্রেজেন্ট থাকবে৷ সিমরান না বললে সিয়র দিতে পারছি না৷ ‘
***
জমকালো আয়োজনে ড্রয়িংরুম সজ্জিত করা হয়েছে। নামী জানত আজ সিমরানের জন্মদিন। সেলিনা আপার কাছে শুনল, সন্ধ্যায় পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। নিধি আপুও ম্যাসেজ করেছিল তাকে উপস্থিত থাকতে হবে৷ ম্যাসেজটা দেখে নামী বাঁকা হেসেছে। তার আত্মসম্মানকে এতটা ঠুনকো ভাবে কেন এরা? সিমরান তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সে না হয় ছোটো মেয়ে। কিন্তু সুহাস তো এতটাও ছোটো নয়৷ সুহাসও তাকে বলেনি জন্মদিনের আয়োজনে উপস্থিত থাকতে। তাহলে সে কেন থাকবে? নিধি আপুর কথায়? অসম্ভব। নিধি আপু সুহাসের বান্ধবী। তার দেয়া দাওয়াতে সে তার ননদের জন্মদিনে উপস্থিত থাকবে? ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর আর অপমানের। তাই কলেজ থেকে এসে লম্বা ঘুম দিয়েছিল সে। ভেবেছিল রাতের আগে ওঠবে না। অথচ সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দিলেই আচমকা ঘুম ছুটে যায়৷
আজান শেষে আচমকা দরজার বাইরে সিমরানের গলা শুনে চমকেও ওঠে সে।

‘ নামী আপু, নামী আপু, আসব? ‘

এ প্রথম সিমরান তার সঙ্গে কথা বলছে৷ ভাবি হিসেবে মানতে পারেনি বলেই বোধহয় আপু বলছে। অস্বস্তি হলো না নামীর বরং মন থেকে না মেনে ভাবি ডাকলেই তীব্র অস্বস্তিতে ভুগত৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল,

‘ দরজা খোলা আছে, ভেতরে এসো। ‘

বলতে বলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল সিমরান। হাতে দু’টো শপিং ব্যাগ। সে এসেই চটপটে গলায় বলল,

‘ শোনো তোমার ওপর আমার যত রাগ ছিল সব একপাশে রেখে এসেছি। আশা করি তুমিও সব রাগ একপাশে রেখে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। ‘

কথাগুলো বলেই নামীর সামনে এসে বসল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে হঠাৎ নামীর হাত দু’টো ধরে বলল,

‘ আমাকে একটু সিম্পল সাজে সাজিয়ে দাও তো। ‘

বিস্মিত হলো নামী৷ যতটুকু জানে সুহাসের বোন সিমরান প্রচণ্ড গর্জিয়াস একটা মেয়ে। চুলে করা ব্রাউন কালার, ভ্রু প্লাক করা, চেহারার চাকচিক্যেই সেটা বোঝা যায়। সে মেয়ে হঠাৎ সিম্পল সাজতে চাইছে। তাও আবার তার কাছে! সিমরান বুঝতে পারল আকস্মিক তার এত ভালো আচরণে অবাক হচ্ছে নামী। তাই তাকে স্বাভাবিক করতে বলল,

‘ শোনো আমি নিজের স্বার্থেই তোমার কাছে এসেছি এত সন্দেহ করার দরকার নেই। ‘

সতেরো বছর বয়সী মেয়েটার স্পষ্টভাষী স্বভাবে যারপরনাই বিস্মিত হলো নামী। সুহাসের বিপরীত এই মেয়ে টের পেল৷ সেই সঙ্গে মুগ্ধ হলো, ওর চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে। মুখের আদল মা ভাইয়ের মতো হলেও চোখ দু’টো তাদের মতো হয়নি৷ কাজল কালো টানা চোখ দুটোর জন্যই নিখুঁত রূপবতী তকমা দেয়া যাচ্ছে। যুবতী বয়সে না জানি কত রূপবতী লাগবে!
এই বাচ্চা মেয়েটার রূপে তারই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে হয়েই যদি তার এ অবস্থা হয় ছেলেদের না জানি কি হাল! ঢোক গিলল নামী। বলল,

‘ তুমি তো খুব সুন্দর দেখতে! ‘

আকস্মাৎ কথায় ভড়কে গেল সিমরান। লজ্জা পেয়ে গেল খুব। নিচু গলায় বলল,

‘ থ্যাংকিউ। ‘

নামী বলল,

‘ ড্রেস কি এটাই থাকবে এভাবেই সাজাব? ‘

সিমরানের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। নিচু গলায় বলল,

‘ এখানে দুটো জর্জেট গাউন আছে। একটা চুজ করে দাও। নিধি আপু বা প্রাচী আপুকে হেল্প করতে বলতে পারতাম৷ কিন্তু খুব লজ্জা পাচ্ছি ওদের সামনে। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল নামীর। লজ্জা পাচ্ছে কেন? মেয়েটা কি অনেক লাজুক? কোথায় এতদিন তো এ কথা মনে হয়নি। সিমরান গাউন দু’টো বের করে দেখাল। দুটোই আকাশি রঙা। নামী অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ ওমা, দুটোই আকাশি রঙের কেন? ‘

‘ আমার তো সব রঙেরই ড্রেস আছে। জন্মদিন উপলক্ষেও সব রঙের ড্রেস কিনেছি। তার মধ্যে এই দুটোর সঙ্গে আজ সৌধ ভাইয়ের পরা শার্টের মিল পেয়েছি! ‘

মুখ ফসকে কথাটা বলেই জিভ কামড়াল সিমরান। নামী হকচকিয়ে গেল। এই মেয়ে বলে কী? সিমরান তৎক্ষনাৎ নামীর হাত ধরে বলল,

‘ প্লিজ প্লিজ কিছু ভেবো না। আসলে আই এম ইন লাভ উইথ সৌধ ভাই ফর টু ইয়ার্স। সেই ক্লাস নাইন থেকে৷ এই সিক্রেটটা কিন্তু কেউ জানে না। আমি আরেকটু বড়ো হলেই আই মিন ইন্টারটা শেষ করলেই ওকে মনের কথা জানাব। এখন বললে ভাববে বাচ্চা বয়সের আবেগ। তুমি কিন্তু কাউকে বলো না৷ বললে খুব খারাপ হবে তোমার সঙ্গে। ‘

দম ছাড়ল সিমরান। নামী নির্বাক দৃষ্টিতে এক আনাড়ি মেয়ের প্রেমের পাগলামি প্রলাপ শুনছে। সিমরান তাড়া দিয়ে আবার বলল,

‘ সৌধ ভাই একদম সিম্পল সাজ লাইক করে। শুনেছি আমি, তাই আজকে তার পছন্দ অনুযায়ীই সাজব। এবার বুঝতে পেরেছ তো কেন তোমার কাছে এসেছি? নিধি, প্রাচী আপুকে তো এসব বলে কনভিন্স করতে পারতাম না৷ লজ্জা পেতাম, লাভ সিক্রেটটাও সবাই এখনি জেনে যেত। তাই তোমার কাছে আসা। ‘

আরো একবার দম নিয়ে পুনরায় বলল,

‘ আর শোনো আমাদের মধ্যে যে সমস্যা আছে এটার প্রভাব কিন্তু সাজে ফেলো না৷ তাহলে কিন্তু ব্রো’কে বলে তোমাকে খুব অপদস্ত করাব। একদম অনেস্ট ভাবে সাজিয়ে দেবে। দেখতে ভালো না লাগলে কিন্তু বাড়ি মাথায় তুলব, তোমার রুমের সব জিনিস ভাঙচুরও করব৷ রেগে গেলে আমি খুব ভয়ানক হয়ে যাই৷ কেউ সামলাতে পারে না। এবার বলো কোনটা পড়লে বেশি সুন্দর লাগবে। বলো বলো। ‘

সিমরানের পরিবর্তে অন্য কেউ হলে নামী দুটো কঠিন কথা বলে দিত। এমন উদ্ধতস্বভাব তার একদম পছন্দ না৷ কিন্তু সিমরান যখন কথা গুলো বলছিল একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল। রাগ তো হলোই না বরং খুব আদর পেল এই মেয়ের প্রতি। সেই সাথে আরো একটা জিনিস অনুভব করল। ওরা দুই ভাই বোনই খুব সরল মনের। ওদের ভেতরে রাগ, জেদ, অহংকার এসব ছাপিয়ে খুব সরল একটা মন আছে। শুধুমাত্র সঠিক গাইডলাইনের অভাবে এরা অনেকটা বেঁকে গেছে। যাবে নাই বা কেন? বাবা, মা ছেড়ে কাজের লোকের কাছে বড়ো হওয়া সন্তানরা আর কতোই সুশীল হবে? কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে আর যাইহোক সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা যায় না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে