#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৮+০৯
সালা বড়লোক হয়েও ফকিরের অভ্যাস গেল না। এতো টাকার মালিক একটা গাড়ির জন্য এক পা নড়বে না। তোর কপালে বউ জুটবে না ইতর।
ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পকেট থেকে একটা চুইগাম বের করে মুখে পুড়ে নিল। হাই তোলার ভঙ্গি করে সাদাফের দিকে না তাকিয়ে বলল.
— “ওরা তোমার হসপিটালের সামনে গাড়ি পৌঁছে দিবে। যদি যেত হয় চলো। না-হলে মোড়ের দোকান থেকে বিস্কুট খেতে খেতে বাড়ি যাও।”
বিদ্বিষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে প্রবেশদ্বার খুলে বেরিয়ে এলো সাদাফ। প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঠাস করে গাড়ির দরজা আটকে ঈর্ষার সামনে এসে দাড়ালো।
ঈর্ষা নিঃস্পৃহ চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল.
— “কার্টুনের মতো এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে বাইকে উঠে বসো। আমরা তোমাকে ঠেলে নিয়ে যাবো না।”
রাগে সাদাফের শরীরটা মৃদু কাঁপছে। সামান্য একটু রাগলেই তীব্র ভাবে শরীর-টা কম্পিত হয় সাদাফের। তবুও নিজের রাগটা সংযত করে ঈর্ষার বাইকে উঠে বসলো। তখন ঈর্ষা হাসি চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে চুইংগাম চিবুচ্ছে। হাসির চেপে রাখার মাঝে অধর প্রশস্ত মুখটা এড়িয়ে গেল না সাদাফের চোখ থেকে। সেই হাসির মাঝে অনন্ত কষ্ট লুকিয়ে আছে। কেন জানি অদ্ভুত ভাবে সাদাফের মুখের কোণেও হাসি ফুটে উঠল। প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দুজনের মাঝে রেখে দুরত্ব বজায় রেখে বসে পড়লো সাদাফ।
ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকালো ঈর্ষা। তার বলার আগেই ছেলেটা সরে আছে। সামনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল.
— “যেভাবে বসেছ, সেভাবেই থাকবে। একচুল নড়াচড়া করবে না। চাইলে নড়াচড়া করতে পারো। সেটা শুধুমাত্র পেছনের দিকে, সামনে নয়।”
সাদাফ মুখ ভেংচি কেটে ঘুড়িয়ে নিল। ঈর্ষা নিজের হেলমেটটা এগিয়ে দিলো সাদাফের দিকে। রবিনের এগিয়ে দেওয়া হেলমেটটা নিজের মাথায় রেখে স্কুটি ইশারায় বলল.
— “তোরা গাড়িটাকে নিয়ে আয়। আমি তাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
স্কুটি স্টার্ট দিয়ে জ্যামে মাঝ দিয়ে সাইড কাটিয়ে চলে গেল ঈর্ষা। ট্রাফিক পুলিশের সামনে বাইক না থামিয়ে চলে যেতে নিলে ইশারায় থামিয়ে দিল সে। সামনে এগিয়ে লাঠি দেখিয়ে রাগি গলায় বলল.
— “তোরা চোখে দেখছিস না, এখানে সার্চ করছে। তাহলে যাচ্ছিস কেন? থানায় নিয়ে দুঘা দিলেই শুরশুর করে আইনের পথে চলে আসবি।”
বিরক্তিতে ললাট কুঁচকে গেল সাদাফের। এখনো যেতে ঢেড় দেরী আছে, তার উপর ট্রাফিক পুলিশের টর্চার। ফোঁস করে দম ছাড়লো ঈর্ষা। হালকা হেলমেট তুলে তার দিকে ক্ষুদ্ধ চোখে তাকাতেই পিছিয়ে গেল সে। দু আঙ্গুলে চোখের দিকে ইশারা করলো তাকে।
ঠোঁট প্রশস্ত করে মিথ্যা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন.
— “ঈর্ষা তুমি! ঠিক আছে যাও.
বাঁকা হেঁসে ফুল স্পীডে ড্রাইভ করে সামনে এগিয়ে গেল ঈর্ষা।
সূর্যের তির্যক রশ্মিতে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে জামা কাপড়। কিছুক্ষণ পরপর কাঁচের ফাঁক দিয়ে ঘাম মুছে নিচ্ছে ঈর্ষা। স্পীডে ড্রাইভ করার ফলে তাপ তেমন না লাগলেও ঘেমে গেছে ঈর্ষা।
বাইকের সামনে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে পড়তেই বাইক ব্রেক করে ঈর্ষার পা জোড়া সামনে রেখে ব্যালেন্জ করে নিল। হঠাৎ ব্যালেন্জ করাতে সামনে দিকে খানিকটা ঝুকে পড়লো দু’জনে। সাদাফ নিজেকে সামলাতে ঈর্ষার কোমড় স্পর্শ করলো। আতঙ্কের বশে চোখ জোড়া গ্ৰথণ করে নিল। অজানা স্পর্শে শিহরিত হলো ঈর্ষা। সে স্পর্শ তার গভীর ভাবে চেনা। এতো গভীর স্পর্শে আর কখনো কোনো পুরুষের সংস্পর্শে আসে নি। অধর কামড়ে ঈর্ষা একহাত নিজের কোমড়ে থাকা সাদাফের হাত স্পর্শ করে অন্যহাতের বাইক সামলে নিল। এই ধরনের পরিস্থিতির সাথে প্রথমবার সে পরিচিত নয়। বহুবার এমন করেছে আবার সামলেও নিয়েছে।
— “আপু তড়াতাড়ি বাইক থেকে নেমে এসো। দেখ কাঠি আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। আমরা আইসক্রিম খাবো!”
হাত ছাড়িয়ে নেমে দাঁড়ালো ঈর্ষা। পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে বাচ্চার মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল.
— “সরি পুচকি সোনা! আজকে আমাকে একটু যেতে হবে। তোমরা কিনে খেও, আমি অন্য একদিন খাবো।”
বাচ্চার গুলো ঈর্ষার কথা তোয়াক্কা না করে ঈর্ষাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ঈর্ষাও আর বাঁধা দিল না, বাচ্চাদের সাথে চলে গেল।
বাচ্চার কষ্ঠস্বর শুনে বেষ্টিত নয়ন যুগল মেলে তাকালো সাদাফ। কিছু বলার আগেই ঈর্ষা বাচ্চাকে নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে হাত ঘড়িটার দিকে দিকে। এগারোটা তিপ্পান্ন বাজে। উদাসীন চোখে তাকালো সাদাফ। নিজের প্রতি নিজেই বিরাগী সে। ঘাত হয়েছে তার, একটা ইরেসপন্সবল মেয়ের কথায় বিশ্বাস করে গাড়ি ছেড়ে আসা। অনুরক্তহীন হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে এসিস্ট্যান্ট কে ফোন করে সবকিছুর ব্যবস্থা করতে বলল।
চোখের সামনে কাঠি আইসক্রিম দেখে ভ্রু কুঁচকালো সাদাফ। ঈর্ষা আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপাট রাগ দেখিয়ে স্কুটিতে উঠে বসলো। ঈর্ষার আইসক্রিমটা পূর্ণরায় সাদাফের দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলল.
— “আইসক্রিম না খেলে আমি হসপিটালের উদ্দেশ্য যাবো না। যেখান থেকে তোমাকে এনেছি, আবার সেখানে পাঠিয়ে দিবো।”
না তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে আইসক্রিমটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বলল.
— “এইসব রাস্তার আইসক্রিম খেলে, শরীর অসুস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো প্রকার উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
— “আপনার মতো পৃথিবীর সবাই বড়লোক নয়। তাদের দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য থাকে না। তারা নিজেদের মনের তৃষ্ণা মেটাতে এইসব খায়।
তাছাড়া আজকাল মানুষ অতোটা স্বার্থপর হয়ে যায় নি যে, খাবারে মেডিসিন মিশিয়ে অন্যকে অসুস্থ করে ফেলবে।”
এক নিমিষেই সাদাফের মনের সব রাগ উধাও হয়ে গেল। তার মনে জমে থাকা ভুল ধারণা গুলো দূর হয়ে কোথাও একটা ঈর্ষার প্রতি সম্মান বোধ কাজ করছে। গরমে গলা প্রায় শুকিয়ে গেছে, প্যাকেট ছাড়িয়ে আইসক্রিম টা মুখে পুড়ে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। লুকিং গ্লাসে ঈর্ষার মুখের দিয়ে তাকিয়ে রইল।
আইসক্রিম খাওয়ার মাঝেই স্কুটি এসে থামলো হসপিটালের সামনে। সাদাফের ধ্যান ভাঙল ঈর্ষার কথায়.
— “এই ডাঃ সাহেব, আমরা এসে গেছি। তুমি কি ভেতরে যাবে নাকি বসেই থাকবে।”
আশে পাশে না তাকিয়ে মুখ থেকে কাঠি ফেলে কাগজ পত্র নিয়ে ভেতরে চলে গেল সাদাফ। মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে গেল ঈর্ষার। সে সরি, ধন্যবাদে বিশ্বাসী নয় ঠিকই। কিন্তু সাদাফের থেকে একটা ধন্যবাদ আশা করেছিল।
সেকেন্ড ফ্লোরে গিয়ে ফিরে এলো সাদাফ। চারপাশে তাকিয়ে ঈর্ষা কিংবা তার স্কুটি নজরে এলো না। ঈর্ষার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো সে।
____________________________
দুজনের দেখা হতে বেশী সময় লাগল না। পরেরদিন ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে দেখা হলো।
চারপাশের রঙিন আলোয় সেজেছিল ভার্সিটির প্রতিটি কোণে। ভিড় ভাট্টা খেয়াল না করে ভার্সিটির ভেতরে পা রাখতেই ধাক্কা খেল অপরিচিত একজন ছেলের সাথে। পরতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। পিছু ফিরতেই পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো। অপরাধী কন্ঠে সরি বলছে! পূর্ণরায় হাতের ইশারা করে ভেতরে ঢুকতে নিলে এক ছেলে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ঈর্ষাকে। ললাটের কোণের রগগুলো ফুটে উঠলো স্পষ্ট। সেই রাগ বেশিক্ষন স্থায়ী রইলো না। তাকে আদাফ জড়িয়ে ধরেছে। তবে মনে মনে খানিকটা বিরক্ত হলো বটে। হুট হাট স্পর্শ করা মোটেও পছন্দ নয় ঈর্ষার। তবে মুখে সেটা বহির্ভূত করলো না সে। থুতনি ধরে টেনে মৃদু হেসে বলল.
— “কেমন আছো আদু!”
ঈর্ষাকে ছেড়ে মুখ ভাড় করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল আদাফ। মনে মনে বেশ খুশি হলো, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাকে ভালোবেসে আদু বলে ডাকছে ভাবা যায়। মন খারাপের ভঙ্গিতে বলল.
— “আমি ভালো নেই! তুমি আমাকে ভালো থাকতে দাও নি। আমাকে বলেছিলে, আমি ভার্সিটিতে আসলে তুমি আমাকে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখাবে। আসার পর থেকে তোমাকে খুঁজছি, কোথায় ছিলে তুমি?”
তখনই পাশ থেকে অন্যএকটা অতি পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে.
— “আদাফ তোমাকে আমি পুরো ভার্সিটি ঘুড়িয়ে দেখিয়েছি। আবার কেন অন্যকে ডিস্টার্ব করছ?”
ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকাতেই সাদাফের মুখশ্রী নজরে এলো ঈর্ষা। তার মানে দুজনে সম্পর্কে ভাই হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয়, একজন ঈর্ষাকে ভালোবাসে আরেকজন দুচোখে সহ্য করতে পারেনা।
আদাফকে হাত ধরে ঈর্ষার থেকে সরিয়ে নিজের সামনে এনে বলল.
— “ধন্যবাদ ঈর্ষা। আমাকে ঠিক সময়ে হসপিটালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।”
শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল.
— “আমি আপনাকে আগেই বলেছি, আমি সরি আর ধন্যবাদে বিশ্বাসী নই।”
.
— “আমার বউটাকে কি কিউট লাগছে। ইচ্ছে করছে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখি। আচ্ছা,পকেটে না পকেট-পারফিউম রেখেছি! আপাতত সেটাই দেওয়া যাক।”
কলার টেনে নাকের কাছে নিয়ে স্মেল নিল আদাফ। অনেকটা বাজে স্মেম আসছে। আড়চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে পারফিউম বের করে স্প্রে করে নিল আদাফ। অরিনেশনে আসার উপলক্ষে গতকাল পাঁচটা পারমিউম কিনেছে আদাফ।আসার আগে সবচেয়ে ভালো এবং দামীটা নিয়ে এসেছে।
শরীরে স্প্রে করে পূর্ণরায় পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সে। সম্পূর্ণ মন দিল স্ট্রেজের দিকে। চেয়েছিলো, একা একা বন্ধুদের সাথে আসবে, কিন্তু সাদাফের চক্করে তা সম্ভব হয়নি।
ততক্ষণে স্টেজে উঠে গেছে ঈর্ষা। বেশ কিছুক্ষণ আগে তার নাম এনাউজ করা হয়েছে। হাতে একটা গিটার নিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখ জোড়া গ্রথণ করতেই শ্রেয়া ঘোষালের কন্ঠে, “আমার একলা আকাশ থমকে গেছে” গানটা কানের কাছে ভেসে উঠল। বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে চারপাশে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন বোধ করলো না ঈর্ষা। ধীরে ধীরে গিটারের টুং টাং ধ্বনিতে সুর তুললো। ছোট বেলা থেকে গানের প্রতি ভিশন ভাবে পরিচিত সে। তাই অযথা গিটারে দৃষ্টি রাখতে হলো না। সুরে তালে মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে গাইতে শুরু করলো.
🎶 আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রং চিনছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবাসে
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে
আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঠোঁট ছুঁয়ে যায়
তোমায় ভালোবেসে
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে🎶
মুগ্ধ নয়নে ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে আদাফ।বক্কের বাম পাশে হাত রেখে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়লো সাহেলের কাঁধে। সাহেল বাহুতে হাত রেখে আদাফকে সরিয়ে সাদাফের কাঁধে দিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বলল.
— “তোর ভাইকে সামলা মামা। একটু গান শুনবো তাও শুনতে পারছি না। ”
মাথা চুলকে সামনে তাকালো সাদাফ। আদাফকে সামলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ঈর্ষার গানে।
🎶 আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন
ঘর ভরা দুপুর
আমার একলা থাকার সুর
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতোদূর
আমার বেসুরে গিটার সুর বেঁধেছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে
তোমার হাসি হেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে 🎶
থেমে গেল ঈর্ষার হাত। বাকিটুকু গান গাওয়ার মতো শক্তিটুকু অবকাশ নেই তার। কেউ একজন যেন ভেতর থেকে গলা চেপে আছে। সুর হারিয়ে যেতে বসেছে। কথা বলার নূন্যতম শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে। মৃদু মৃদু কম্পিত হচ্ছে শরীর। বেষ্টিত নয়নজোড়া অম্বুতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিষেধ মানার আগেই গাল গড়িয়ে ঝড়ে পড়লো নিচে। নিভু নিভু চোখে মেলে তাকালো ঈর্ষা। মলিন হেসে সকলের অগোচরে অশ্রু মুছে নিল। হালকা ঝুঁকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। সাথে সাথে পুরোমহল ছেয়ে গেল করতালির আওয়াজে। এতোক্ষণ যেন ভুলেই গিয়েছিলাম, তাদের কি করা উচিত।
একহাতে গিটার অন্যহাতে চুল ঠিক করতে করতে স্টেজ থেকে নেমে এলো ঈর্ষা। ঈর্ষা নামতেই এগিয়ে এলো সকলে। তব্ধ নিঃশ্বাস ছেড়ে গিটার এগিয়ে দিলো সে। হতাশাগ্ৰস্থ কন্ঠে বলল.
— “আমাকে এবার বাড়িতে যেতে হবে। তাই দেরী না-করে চলে যাওয়াই ভালো। তোরাও চলে যা। আজ নাহয় ক্লাবে না গেলি।”
চমকে উঠলো রবিন। গিটার-টা হাতে নিয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল.
— “লাইক সিরিয়াসলি তুই। তুই বলছিস, আজকে ক্লাবে যাবি না। শরীর টরীর খারাপ করে নি তো।”
আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিজের ভেতরের কষ্টগুলো বিসর্জন দিয়ে বলল.
— “কালকে একটা ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আছে। সকাল সকাল যেতে হবে। কালকে কিছু টেস্ট করিয়েছি, আজকে রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। আমি যাইনি। কালকে একসাথে রিপোর্ট নিয়ে দেখা করব।”
_______________________
চেম্বারের সামনে বঞ্চিতে বসে আছে ঈর্ষা। ক্ষনেক্ষনে হাতের রিপোর্টের দিকে তাকাচ্ছে অতঃপর চেম্বারের দরজার দিকে। মিনিট দশেক সময় অপেক্ষা করতে বলেছে তাকে। ভিড় নেই বললেই চলে। কোথাও একটা অজানা ভয় কাজ করছে তার মনে কোণে।
— “আপনি এবার ভেতরে যেতে পারেন!”
কারো অস্ফুট কথায় ধ্যান ভাঙল ঈর্ষার। লোকটার দিকে না তাকিয়ে রিপোর্টখানা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজায় নক করে অনুমতি নিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে ভেতরে গেল। মৃদু হেসে রিপোর্ট খানা এগিয়ে দিতেই হাতের ভাজে নিয়ে নিলেন ডাঃ অথৈ। বললেন.
— “প্লীজ সিট।”
অতঃপর গভীর মনে রিপোর্ট দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো। ঈর্ষা চেম্বার দেখতে মন দিলো আর ডাঃ অথৈ রিপোর্টে। ঠাস ঠাস পদধ্বনি কানে আসতেই হালকা ঘুড়ে দরজার দিকে তাকালো ঈর্ষা। সাদাফ এসেছে।
সাদাফ ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে চেম্বারের ভেতরে ঢুকলেন। ফাইলটা ডাঃ অথৈর দিকে এগিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন.
— “তোর ফাইল আমার কাছে কি করছে একটু বলবি। মিনিমাম সেন্সটুকু তোর নেই। ইডিয়েট।”
ফিল্টার থেকে গ্লাসে পানি ভর্তি করে সাদাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল.
— “এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? তোর কাছেই তো গেছে অন্যকারো কাছে তো নয়। বসে পানিটা খেয়ে নে.”
একপ্রকার ডাঃ অথৈর হাত থেকে পানির গ্লাসটা ছিনিয়ে নিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো সাদাফ। তিন ঢকে খাওয়া শেষ করে টেবিলের উপরে রেখে বলল.
— “সবকিছু নিয়ে এভাবে ছেলে খেলা করিস না। মনে রাখিস, একজন পেসেন্টের বাঁচা মরা ৯০% একটা ডাক্তারের উপর নির্ভর করে.
কথা শেষ করার আগেই তার চোখ আটকে গেল এক অপরুপ সুন্দর রমনীর উপর। তার থেকে দেড়েক হাত দুড়ে বসে আছে সে। ফর্সা শরীরে লাল রঙের চুড়িদার মুগ্ধতা কয়েক থেকে কয়েকশ’ গুন বাড়িয়ে তুলেছে। এলোমেলো অগোছালো চুলগুলো একপাশে বেনুনী করে সামনে রাখা। অন্যপাশে ভাঁজ করা ওরনা। সাজগোজ বিহীন মুখটা স্নিগ্ধ লাগছে। প্রথমবার ঈর্ষাকে এমন রুপে দেখে কয়েক দফা ক্রাশ খেলো সাদাফ। তবে আগের মতো ডোন্ট কেয়ার ভাবটা নেই। তবুও কিছু একটা কমতি মনে হচ্ছে সাদাফের কাছে। আচ্ছা যদি ঈর্ষার মুখে সেই এক চিলতে হাসি থাকতো তাহলে কেমন হতো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। কি সব যাতা ভাবছে সে। ডাঃ অথৈর কথায় ধ্যান ভাঙলো তার।
— “মিস্ ঈর্ষা, আপনার পরিবারের কেউ এসেছে এখানে? আমি তাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। ”
মুহুর্তেই ঈর্ষার মলিন মুখটা রক্তিম আকার ধারণ করতে সময় নিলো না। উঠে দাঁড়িয়ে এক লাথি দিয়ে চেয়ার টা ফেলে দিল। টেবিলের উপর জোরে আঘাত করে চেঁচিয়ে বললো.
— “ওয়ার্ট! আই থিংক ইজ ইউর। অসুস্থ আমি, আমার পরিবার না। যদি বলতে হয় আমাকে বলতে হবে এবং আপনি বলতে বাধ্য। ভালোভাবে, ভদ্রভাবে কিছু জানতে চাইলে আপনারা ভদ্র থাকতে দিবেন না। ঠিক করে নিয়েছেন।”
সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ডাঃ অথৈ। শান্ত কন্ঠে বললেন.
— “কুল! কুল মিস্ ঈর্ষা। ডোন্ট বি সুড হাইপার। আ’ম এক্সপ্লেইন টু ইউ। প্লীজ টেক ইউর সিট। প্লীজ।”
নিজের রাগ দমন করে চেয়ারে বসল ঈর্ষা। ডাঃ অথৈ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সাদাফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো.
— “তোর সাথে পরে কথা বলছি। তুই একটু যা। ওনার সাথে কথা আছে।”
একবার ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে আবার অথৈর দিকে তাকালো সাদাফ। কি এমন সমস্যা যেটা তার সামনে বলতে পারবে না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বেরিয়ে গেল সাদাফ।
(চলবে)