#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৬+০৭
ক্রিকেট বল গিয়ে সোজা রৌধিকের মাথার পেছনে। এতো জায়গা থাকতে মাঠের মাঝখানে হিসু করে চলে এসেছে। শেষে ডাক্তার হয়ে কি-না এডিস মশা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করছে। করাই তো কথা। মনে হয় হসপিটালে পেশেন্টের অভাব পড়েছে। তাই এই নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে। নিয়েছে ভালো কথা, তাই বারবার ঈর্ষার সামনেই পড়তে হবে।
আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো ইতিমধ্যে বাচ্চা ছেলেগুলো ছুটে পালিয়েছে। আর কয়েকজন দৌড়াচ্ছে। যে ছেলের বল সে মাটিতে পড়ে কাঁদছে। ছুটে চলে গেলে যদি বল না পায়, তখন। দ্রুত কোমড় থেকে চাদর খুলে শরীর পেঁচিয়ে নিল। উদ্দেশ্য চুপটি করে গিয়ে বল তুলে দৌড়ে চলে আসা।
রৌধিক মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিচ থেকে বল তুলে মাথা ঘসতে লাগলো। মুখ কুঁচকে করে ফেললো ঈর্ষার। জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক। চাঁদর দিয়ে মাথা ঢেকে কাচুমাচু হয়ে রৌধিকের হাত থেকে বল কেড়ে নিল ঈর্ষা। ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালেই পেছন থেকে হাত ধরে থামিয়ে দিল রৌধিক। হাত থেকে বলটা গড়িয়ে পড়ে গেল তার। সাথে সাথে শরীর-টা কেঁপে উঠলো ঈর্ষার।
বল গড়িয়ে পড়তেই ছেলেটা বলল নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেল। সাদাফ ছোট বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিল ঈর্ষার। ঈর্ষার মলিন মুখটা গোচর হতেই কয়েক-পা পিছিয়ে গেল সাদাফ।
ঈর্ষার হাসৌজ্জ্বল মুখটায় হাসি না থাকলেও সবসময় একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব বিরাজ করে। কিন্তু আজ মুখটা নিস্তেজ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ সঙ্কট নিয়ে বলল.
— “শরীর কেমন আছে তোমার?”
— “ভালো! ”
সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে উল্টো হাঁটা দিল ঈর্ষা। মোড়ের দোকানের সামনে থেকে এক বোতল পানি এনে ফিরে এলো সাদাফের কাছে। বোতল-টা এগিয়ে দিয়ে বলল..
— “মাথায় পানি দিয়ে নিন! ভালো লাগবে?”
হালকা মাথা তুলে তাকালো সাদাফ। তার সামনে ঈর্ষাকে দেখে পার্কের বাইরে দরজার দিকে তাকালো। একটু আগেই তো ঈর্ষা বেরিয়ে গেল, তাহলে তার সামনে কি করে এলো।
এগিয়ে দেওয়ার সময় ফাঁকা হাত নজরে এলো তার। প্রথমবার যখন দেখা হয়েছিল, তখন অন্ধকারের মাঝে কিছু একটা নজরে এসেছিল তার। গতরাতে আদাফের দেওয়া ব্রেসলেট-টা কি ঈর্ষার ছিল।
সাদাফের আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকা দেখে বীতস্পৃহ হলো ঈর্ষা। বোতলটা পার্কের বেন্ধিতে রেখে ধীরে ধীরে হেঁটে এলো সে।
বোতলটা তুলে ঈর্ষার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সাদাফ। ভ্রু কুঁচকে সাদাফের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়ালো ঈর্ষা। এবার নিশ্চয়ই ইংরেজি ঝেড়ে বলবে,,
“ইউ ক্যান নট টু এনিথিং রাইট। আই এম লাইক ইউর ইনিমি। হোয়েন ইউ সি মি, ইদার মাই কার গ্লাস উইল ব্রেক অর মাই হেড উইল ক্রাক”
কিন্তু ঈর্ষাকে অবাক করে দিয়ে তেমন কিছু বললো না সাদাফ। পকেট থেকে একটা বিশ টাকা আর পাঁচ টাকার নোট বের করে ঈর্ষার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল.
— “আমি অন্যের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাইনা। ”
সাদাফের এমন ব্যবহার হজম হলো না ঈর্ষার। টাকা-টা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করলো। টাকার ভাঁজ থেকে এক টাকার কয়েন বের করে সাদাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল..
— “আমিও কারো কাছে ঋণী থাকা পছন্দ করি না। সো ধরুন।
মানুষ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও ওয়েটারকে টিপস্ দেয়; আর আমি তো মোড় থেকে পানি কিনে নিয়ে এলাম। তাও পেলাম নাম। তাই শুধু শুধু ছুঁচো মেরে হাত নষ্ট করতে চাইনা।”
সাদাফের কোনো হেলেদুলে নেই দেখে, কয়েন-টা হালকা উপর থেকে সাবধানে সাদাফের হাতের উপর ফেললো। সাদাফের পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। বাচ্চা ছেলেদের মতো এক টাকার কয়েন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সাদাফ।
____________________
ফাঁকা ক্লাসের হাই বেঞ্চিতে উপরে বসে ফোন টিপছে ঈর্ষা। মাঝে মাঝে উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠছে আবার কখনো কখনো পা দুলিয়ে তালে তালে মেলাতে ব্যস্ত সে। ঈর্ষাকে ঘিরে চারদিকে বসে আছে চৈত্রী, ইপ্সা, মাহিন। আজ আবার তাদের সাথে যোগ দিয়েছে রবিন। চারদিকে কথা বার্তার মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না ঈর্ষার মাঝে। তার চোখজোড়া ফোনের স্ক্রিনে বন্ধ। সেখানে টম এন্ড জেরী চলেছে। তার টম অ্যান্ড জেরী দেখায় ব্যঘাত ঘটলো রিংটোন আসাতে। ফোনের স্ক্রিনে সেভহীন নাম্বার-টা দেখে দম বন্ধ চাঁপা শ্বাস ছাড়লো ঈর্ষা। ফোনটা উল্টো করে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালো সে। বাজতে বাজতে কেটে গেলে। আবার ফোন তুলে টম অ্যান্ড জেরী দেখায় মন দিল সে। পূর্ণরায় আবার ফোন আসলেই চৈত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলল.
— “ফোনটা রিসিভ করে বল; আমি ভার্সিটির কাজে ব্যস্ত আছি।”
ফোনটা নিলো না চৈত্রী। একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল
— “তুই এমন-টা কেন করছিস ঈর্ষা। আঙ্কেল ফোন করেছে কথা বল! তোদের মাঝখানে আমি কেন কথা বলবো।”
কল কেটে যেতেই সুইচ টিপে বন্ধ করে পকেটে রেখে বলল..
— “আমি কি করবো; সেটা আপাতত আমাকেই ভাবতে দে? পারবি না সরাসরি বললেই হয়।”
— “ঈর্ষা তোর কথা বলার দরকার ছিলো। আঙ্কেল অনেক আশা করে ফোন করেছিল।”(মাহিন)
— “আমিও অনেক আশা নিয়ে টম অ্যান্ড জেরী দেখতে বসেছিলাম। বাট সব স্পয়্যাল করে দিল। (তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল) আশা করে নয়, বেঁচে আছি কি-না জানতে ফোন করেছে। সমস্যা নেই! আমার রেসপন্সে বুঝে গেছে আমি বেঁচে আছি।”
ঈর্ষার মুখের হাসিটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না ওদের। যে হাসিতে মানুষকে দেখানোর কোনো মুগ্ধতা নেই। আছে এক রাশ অভিযোগ, অভিমান।
পূর্ণরায় ফ্যামিলি নিয়ে কথা তুললে মন খারাপ হয়ে যাবে ঈর্ষার। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রবিন বলল..
— “মা তোদের যেতে বলেছে। চল একবার দেখে করে আসবি।”
পিঠে হালকা চপল মেরে শান্ত গলায় বলল..
— “আন্টি রিলিজ পেল? বললি না তো?”
— এই তো কালকে সন্ধ্যার পর। গ্ৰামের বাড়ি থেকে অনেক আত্মীয় এসেছে দেখতে। তাই তো আজ ভার্সিটিতে এলাম। না-হলে মায়ের জন্য আসতাম না।এবার চল..
আজ যদি ঈর্ষার জীবনটা স্বাভাবিক জীবন হতো। তাহলে কতো মানুষ আসতো, যেত। সারাক্ষন বাড়িটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত? কিন্তু সেই আনন্দময় ভাগ্য যে, ঈর্ষার নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল..
— “তোরা তো ভালোভাবেই জানিস; হট্টগোল ভীড় ভাট্টা আমার কোনো কালেই পছন্দ নয়। আজ নয়, অন্য একদিন যাবো।”
— “তারা কবে যাবে তার ঠিক নেই আর তুই বলছিস অন্য একদিন যাবি।”
— “ঠিক আছে কালকে যাবো..
ওদের কথার মাঝেই জুনিয়র একটা ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে দাড়ালো। বুকে হাত রেখে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বলছে.
— “আপু আপনাকে আসরাফ স্যার যাইতে কইছে। তিনি গানের ক্লাসে রিয়াল সেল করাচ্ছে!”
ঈর্ষা ইশারায় ছেলেটাকে যেতে বলে, কান ধরে টেনে মাহিনকে সামনে নিয়ে আসলো। দাঁত কেলিয়ে বলল
— “আমি জানি নবীন বরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মন জয় করতে আমার নামটা লিস্টে দিয়ে দিয়েছিস। এবার যা গিয়ে রিয়াল-সেল কর।”
কোনো কথা না বলে কান ধরে উঠবস করতে লাগলো মাহিন। মুখ ছোট করে ইনোসেন্স ফেইস নিয়ে বলল.
— “প্লীজ যা দোস্ত। তুই না গেলে স্যার নির্ঘাত ভর্তা করে ফেলবে।”
___________________
পেসেন্ট দেখা শেষ করে কিছু কাগজ পত্র দেখতে ব্যস্ত সাদাফ। রাত আটটা ছাড়িয়ে। কালকে একটা সিরিয়াল সার্জারি করতে হবে। তার আগেই কাগজ-পত্র, মেডিসিন সব ভালোভাবে চেক করে নিচ্ছে সাদাফ। তখনই হাজির হলো সাদাফের এসিস্ট্যান্ট। দরজায় নক করে বলল.
— “মে আই কাম ইন স্যার।”
সাদাফ একবার ল্যপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এসিস্ট্যান্ট-কে দেখে আবার মন দিল কাগজের পাতায়। কাজ করতে করতে বলল..– “কাম ইন।””
এসিস্ট্যান্ট ভেতরে প্রবেশ করে দরজা হালকা বিড়িয়ে সাদাফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল
— “স্যার; একটা ভার্সিটির প্রোফেসর এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে। বলেছে তিনি আপনার ফ্রেন্ড। ভেতরে আসতে বলবো কি?”
চোখ ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ ভেবে কলমের ক্যাপ কামড়াতে কামড়াতে বলল..
— “ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি ভেতরে পাঠিয়ে দাও। আমাকে বাড়িতে ফিরতে হবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে এসিস্ট্যান্ট চলে গেল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক চেম্বারে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে নক না করেই প্রবেশ করলো।
ক্ষুদ্ধ হলো সাদাফ। অনুমতি না নিয়ে কোনো জিনিসের হাত দেওয়া বা প্রবেশ করা একদমই পছন্দ না তার। তখনও কাগজে মুখ গুঁজে রেখেছে সাদাফ। না তাকিয়ে বলল.
— “শুনলাম আপনি না-কি ভার্সিটির প্রোফেসর। কোনো প্রাইভেট রুমে বা জিনিসে হাত দেওয়ার পূর্বে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে যেটা কি আপনার জানা নেই।”
— “সালা তুই কোন জায়গার মহারাজা রে, যৈ তোর জিনিস টার্চ করতে হলে আমাকে পার্মিশন নিতে হবে।”(পিঠে চাপড় মেরে বলল সাহেল)
চাপলের তালে চেয়ার থেকে সামান্য ঝুঁকে পড়লো রৌধিক। গম্ভীর কন্ঠে কিছু বলার জন্য পাশে ফিরতেই চোখ কপালে তার। সামনে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিন আগে দেখা হয়েছিলো তাদের। কাগজ পত্র পাশে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো রৌধিক। দুহাতের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে নিন আহিরকে। আলিঙ্গনের মাঝেও দুজনের হাসি থামছে না। একবার বক্ক থেকে মুখ তুলে বন্ধুর দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার বক্কে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এসিস্ট্যান্টকে ডেকে দুকাপ কফি অর্ডার করলো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বলল.
— “কবে দেশে এলি আগে সেটা বল। আগে আমাকে একটা ফোন করতি। আমি এয়ার-পোটে গিয়ে হাজির হতাম।”
— “তোকে আমার ভালোভাবে চেনা আছে! তুই তখন পেসেন্টের বাহানা দিয়ে ঠিক থেকে যেতিস।
এসেছি তিন মাস ছাড়িয়েছে। এখানের একটা ভার্সিটিতে প্রোফেসর হিসেবে জয়েন করেছি বেশ কিছুদিন আছে। এবার তোর খবর বল।”
ইতিমধ্যে কফি পৌঁছে দিয়ে গেছে এসিস্ট্যান্ট। টিস্যু পেপার দিয়ে কাপ তুলে হালকা চিয়ার করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দুজনে। আহির বলে উঠলো..
— “গতবার ভার্সিটি থেকে তোকে ইনভার্ট করা হয়েছিল, তুই না-কি ব্যস্ততার কারণে যেতে পারিস নি। এবার আমি নিজে তোকে ইনভার্ট করতে এসেছি, এবার কোনো প্রকার ব্যস্ততা আমি শুনবো না। যেতে হবে মানে যেতে হবে।”
কফির কাপে হালকা চুমুক দিয়ে বলল.
— “কালকে সিরিয়াস সার্জারি আছে! চিন্তা করিস না, যদি পেসেন্টের অবস্থা ভালো থাকে থাকলে ইনশাআল্লাহ যাবো।”
পূর্ণরায় হাস গল্পে মেতে উঠলো দুই বন্ধু। পুরোনো দিনের কথায় হারিয়ে গেল দুজনে।
_________________________
রোজা-কারের মতো দেরী করে বাড়ি ফিরেছে ঈর্ষা। ড্রাইনিং রুম অতিক্রম করে ভেতরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন শাহিনুজ্জামান। গম্ভীর মুখে বলল.
— “তোমার বাবা তোমাকে ফোন করেছিল! রিসিভ করো নি কেন? উল্টো ফোন কেটে বন্ধ করে রেখেছ? এটা কোন ধরনের অসভ্যেতামো একটু বলবে?”
বিরক্তিকর চোখে মাটিতে দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঘাত ফোন করে প্রাণের সালাকে জানিয়েছে। হাই তুলে বলল.
— “আমার কাছে ফোন দেওয়ার কি আছে?”
হালকা ধমকে উঠলেন শাহিনুজ্জামান।
— “নিজেকে কি মনে করো তুমি। মিনিমাম ধারণা আছে, তোমার মতো উশৃঙ্খল মেয়ের জন্য আমাকে কতোটা সাফার করতে হচ্ছে। সেই ছোট বলা থেকে নিজের বউ সন্তানকে ফেলে তোমাকে মানুষ করেছি! কি মানুষ করেছি আমি, নিজেই হতবাক। একটা উশৃঙ্খল, অভদ্র বানিয়েছি।
আমার বোন তোকে আমার হাতে ছেড়ে চলে গেছে, আর আমি সেই দায়িত্ব টুকু পালন করতে পারলাম না। একটু শাসন করার দরকার ছিলো। যে মেয়ের বাবা মা নিজেই ফেলে রেখে গেছে, সে মেয়ের থেকে এর বেশী কিছু আশা করা যায় না।
বাইরে বেরিয়ে দেখ, এক টাকা উপার্জন করতে কতোটা পরিশ্রম করতে হয়। আজ কষ্ট করে উপার্জন করছি আর তুমি বসে বসে নষ্ট করছ? তোমার বাবা মা বোন দেশে ফিরলে তুমি তাদের সাথে চলে যাবে। আমি তোমার টেনশন আর নিতে পারছি না।
কবে তুই এই মানসিক অসুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবি আর কবে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবো। আদোও কখনো সম্ভব কি-না জানা নেই।”
চোখের পাপড়ি গুলো অম্বুতে ছলছল করে উঠলো। হালকা হাসির রেখা টেনে হাসলো ঈর্ষা। কতোদিন হয়েছে কাঁদে না তার হিসেব নেই।
ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে রুমের দিকে এগিয়ে গেল ঈর্ষা। হালকা পা জোড়া যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। টেনে টেনে সামনে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও হাতরিয়ে হাতরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিচ্ছবির উপর হাত বুলিয়ে দিল ঈর্ষা। নিজের ফেইসটার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ নিজেকে আর পাঁচটা দিনের থেকে অদ্ভুত লাগছে। চোখগুলো হালকা ফুলে আছে, নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। এলোমেলো চুলগুলো আর মলিন চেহারার মাঝে নিজেকে চিনতে ব্যর্থ হলো সে। কখনও মামার কথাগুলো ভেবেই দেখা হয়নি।
বেডের কোণ থেকে একটা বালিশ নিয়ে বেলকেনিতে চলে গেল ঈর্ষা। মাথার নিচে বালিশ চেপে ঠান্ডা ফ্লোরে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো ঈর্ষা। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরা শ্বাস নিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো সে।
______________________
দিন কালের তুলনায় আজ বড্ড ঠান্ডা পড়েছে। বেলা দশটা ছাড়িয়ে গেছে এখনো আকাশের কোনে আংশিক কুয়াশা জমে আছে। সূর্যের রশ্মি ভেদ করে সামান্য আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। চারদিকে শীতল ভাব বিরাজ করছে। কেউ মৃদু উষ্ণময় টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিজের গন্তব্যে ছুটে চলেছে। যেন প্রকৃতির কোনো প্রভাব তার উপরে পরছে না।
স্কুটি-তে হেলান দিয়ে বসে আছে ঈর্ষা। তার পাশে যে যার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঈর্ষা মলিন হেসে পূর্বের ন্যায় দৃষ্টি রাস্তার মাঝে থাকা ছোট ছোট গর্তের দিকে দিয়ে তাকিয়ে রইল। ঈর্ষার এমন কান্ডে চরম ক্ষদ্ধ হয়ে চৈত্রী বলল..
— “আমরা জানি তুই কিভাবে হাসিস। তাই ইঁদুরের মতো দাঁত দেখাতে ঠোঁট বাকাস না। ”
চৈত্রীর কথায় জবাব দেওয়ার মতো কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না ঈর্ষার ভেতরে। সে নিজের মতো ভেবেই চলেছে। স্পৃহা হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল..
— “দেখ; আমরা জানি। মামার সাথে তোর ঝগড়া না-হলে তুই এমন বিহেবিয়ার করিস না। প্লীজ টক আপ, ওয়াট হ্যাপেন্ড।”
— “কিছু ভালো লাগছে না আজকে। আচ্ছা তোরা কেউ আমার মাকে এনে দিতে পারবি। শেষবার যখন মাকে দেখেছিলাম, তখন খুব ছোট ছিলাম। আর প্রায় প্রায়ই দরজার ফাঁক দিয়ে বাবা মায়ের ঝগড়া শুনতাম। দুজনের মাঝে কথা কাটাকাটি হতো। আজ মায়ের মুখটা মনে নেই। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত ভর স্কুটির উপর ছেড়ে শুয়ে পড়ো ঈর্ষা। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল উপস্থিত সবাই। একটা বাবা মা হীন মেয়ে কতোটা কষ্ট আড়াল করে হাসি মুখে থাকার চেষ্টা করছে। ঈর্ষাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে সবাই।
সিদ্ধ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে ফোড়ন কেটে বলল.
— “গুরু আজকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। আর তুমি এখানে বসে আছিস মামি। মা অপেক্ষা করছে তোদের দেখার জন্য, তাড়াতাড়ি চল।”
পরপর দুইটা বাইক একটা স্কুটি নিয়ে বেড়িয়ে গেল পাঁচজনে। কিছুটা দূরে যেতেই সিগন্যালে থেকে গেল স্কুটি। সামনে চেক পোস্ট পড়েছে। সিগন্যালের স্কুটি থামিয়ে হেলমেট ঠিক করলো ঈর্ষা। ঘাম গুলো মুছে হেলমেট পড়ে নিল। তখনই পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো ঈর্ষার কানে। গ্লাসে নক করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,
— “এই যে মিস, সামনে কি হয়েছে বলতে পারবেন?”
ঈর্ষা আড়চোখে সাদাফের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। সাথে সাথে দৃষ্টি সামনের দিকে সরিয়ে বলল.
— “সামনে চেকপোস্ট চলছে। প্রতিটি গাড়ির লাইসেন্স থেকে শুরু করে সমস্ত গাড়ি চেক করে তবে ছাড়বে।”
শার্টের কলার ঠিক করে সিলভার রঙের ঘড়িটা দিকে তাকালো সাদাফ। এগারো-টা পয়ত্রিশ। বারোটায় সার্জারি রয়েছে। লেট করে পৌঁছালে পরিস্থিতি কেমন হবে জানা নেই। সার্জারি-টা আগে করা দরকার ছিলো। কিন্তু কিছু টেস্ট, রিপোর্ট মিলিয়ে আজকে ডেট পড়েছে।
নিজের রাগ দমন করতে গাড়ির স্টেয়ারিং এর উপর আঘাত করলো। যার পরিণাম স্বরুপ আঙুলের ডগায় আঘাত পেল সে। কাউকে একটা ফোন করে সবকিছু রেডি করতে বলল.
— “বলছি কি স্যার। গাড়িতে আঘাত করলে আপনি তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবেন বলে আমার মনে হচ্ছে না। যদি চান, তাহলে আমার বাইকে করে আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। সেটা আপনার ইচ্ছে।”
ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। ইগোতে বাঁধল ঈর্ষার। যেন কেউ তার পাশে নেই। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না সাদাফ। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এগারোটা চল্লিশ। কোনো উপায় না পেয়ে বলল..
— “তুমি সত্যি আমাকে হসপিটালে পৌঁছে দিতে পারবে। আসলে আজ আমার সার্জারি ছিল।
তুমি তো নিজেই যেতে পারছ না, আমাকে কি পৌঁছে দেবে।”
— “প্রথমত সার্জারিটা আপনার নয়, আপনি করবেন। দ্বিতীয়ত, আমার তাড়া নেই তাই অপেক্ষা করছি।”
সময় ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিদা কাটিয়ে বলল.
— “আমি যদি তোমার সাথে যাই তাহলে আমার গাড়ির কি হবে।”
(চলবে)