#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২১ (অন্তিম)
“কবুল” উচ্চারণ করার আগ মুহূর্তে বিয়ের আসরে উপস্থিত হলো সাদাফ। পড়নে কালকে রাতের পরিধিত টাওয়াল, টি শার্ট। চুলগুলো উস্কো খুস্কো, এলোমেলো হয়ে আছে। চোখ দুটো ঘুমহীন রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে। যেন কয়েক বছর ঘুমহীন কাটিয়েছে সে। দূর থেকে লাল টুকটুকে বেনারসী পড়া রমনীর দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বিয়ের সাজে অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে। কিন্তু কোথায় একটা শূন্যতা রয়েছে মনের কোণে। মুখের মিষ্টি হাসিটা নেই।
দুলতে দুলতে এগিয়ে গেল ঈর্ষার দিকে। স্টেজে শাড়ি পরিধিতা রমনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল সে। ঈর্ষা তাকালো না সাদাফের দিকে। সবাই তখন বিমুখ চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা দেখে মুখ তুলে তাকালো ঈর্ষা। এলোমেলো সাদাফ কে দেখে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নয়ন যুগল থেকে। কাঁপা কাঁপা হাত দুটি সাদাফের মেলে দেওয়া হাতে স্পর্শ করলো সে। সারা দেহে চির পরিচিত সেই শিহরণ খেয়ে গেল তার। এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ঈর্ষা। গলা জড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাদাফের হৃদ মাঝারে। ঈর্ষাসহ নিজেকে সামলাতে দু’পা পিছিয়ে গেল সাদাফ। নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে সেই মহেন্দ্রক্ষণ গহিন থেকে অনুভব করলো সে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঈর্ষাকে। অম্বু ধারা আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে তৃপ্তিকর হাসলো সে। তার সাথে হাঁসি মেলালো ঈর্ষা। এটা অতি সুখের অনুভুতি জানান দিচ্ছে।
সাদাফ ঈর্ষাকে ছেড়ে সাহেলের দিকে এগিয়ে গেল। দুই বন্ধু বেষ্টিত হলো ঘোড় আলিঙ্গনে। পিঠ চাপড়ে সাহেল বলল.
— “তোদের নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইল!”
— “সবটা তো জন্য। তোর মতো বন্ধু পেয়ে আমি গর্বিত।”
গতকালে রাতে ভুলবশত ঈর্ষার রুমে গিয়েছিল সাহেল। তখন দু’জনের মধ্যকার কথা শুনে সাবিহা কে ফোন করেছিলো সাহেল। সাবিহা ফোনে তাকে সবটা জানিয়ে দিয়ে ছিলো। সবটা জেনে শাহিনুজ্জামান সহ বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেয় সাহেল।
সাদাফ ঈর্ষার হাতের মুঠোয় নিজের হাত গ্ৰথণ করে নিল। কারো দিকে না তাকিয়ে ঈর্ষাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো দুজনে। পদধ্বনির সাথে যোগ হলো করতালির আওয়াজ। তদানীং করতালির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিস মন্ডব থেকে।
ফোঁস করে দম ছাড়লো আদাফ। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফল কাঁটাল ছুড়ি বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো অদূরে। ঝনঝন শব্দে সকলের নজরে এলো ছুড়িটা। সাবিহা এগিয়ে এলো সেদিকে। হাত দিয়ে ইশারা করে আদাফ বলল.
— “আজ যদি ভাইয়া এসে ঈর্ষাকে নিয়ে না যেত, তাহলে আপনি খুন হতেন ভাইয়া। আমি হিরো হয়ে আমার ঈর্ষাকে বাঁচাতে এসেছিলাম। কিন্তু দেখুন আপনার বন্ধু এসে নিয়ে গেল। চেয়েছিলাম ভাইয়ের ভাবী করতে, এখন আমার ভাবী বানিয়ে দিল। কি করব, ভাই তো। তাই সবকিছু মেনে নিলাম। ”
ভাব নিয়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে যেতে চাইলে চোখ গেল কর্ণারে দাড়িয়ে থাকা মেয়ের উপর। নীল রঙের শাড়িতে মেয়েটিকে আদাফের কাছে বেশ লাগছে। নিচ থেকে ছুরি টা তুলে নিলো সে। সামিরার দিকে তাক করে ইশারায় বলল.– “এদিকে এসো।”
সামিরা শাড়ির আঁচল মোচরাতে মোচরাতে আদাফের কাছে এগিয়ে এলো। আদাফ পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখে বলল.– “পারফেক্ট!”
— তুমি আমাকে বিয়ে করবে সামু!
সামিরা কয়েকপা পিছিয়ে গেল। আদাফ ছুরি দিয়ে ইশারা করে দাঁড়িয়ে যেতে বলল। দাঁড়িয়ে গেল সে। নত সুরে বলল. — “তুমি গুন্ডা, সন্ত্রাসী, খুনী! আমি তোমাকে বিয়ে করব না। তুমি পঁচা।”
কদাচিৎ হাসলো আদাফ। ছুরিটা ফেলে দিয়ে বলল.
— “ফেলে দিলাম। এবার বিয়ে করবে আমায়। যদি বিয়ে না করো, তাহলে ঐ ছুরিটা দিয়ে তোমার পেট ফুটো করে বাস্কেটবল খেলবো। বুঝতে পেরেছি।
এবার এসো.
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো সামিরা। নত মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো সে। আদাফ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল.
— একটু বড় হলে আমরা বিয়ে করব; কেমন। এবার একটু ঘুড়ে আসা যাক।
আদাফের হাত ধরলো সামিরা। সাদাফ ঈর্ষাকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে বিয়ের আসর থেকে বেরিয়ে গেল।
দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে হেঁসে দিলো সকলে। আদাফ যাওয়ার পর একটা কুকুর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সাহেল করুন হাসলো। এগিয়ে গিয়ে কুকুরটাকে কোলে তুলে নিলো। কুকুরের মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মুখ মুছে নিলো। ওয়াক থু ফেলে। বলল. — “ছিঃ! কি বিচ্ছিরি।”
সাহেল কুকুরটিকে নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল.
— “সবাই তার জোড়াকে নিয়ে যাচ্ছে। সাদু তার হবু বউকে নিয়ে গেল। আদু তার বউকে। আমি একা থাকবো কেন? আমিও আমার কুকুর 🐶 বউকে নিয়ে যাই।”
কোমড় হেলিয়ে দুলিয়ে সাহেলও অনুসরণ করলো পূর্বের পথ।
________________
কুয়াশা জমে আছে আকাশের প্রান্তে প্রান্তে। দেখা যাচ্ছে না দিগন্ত। শীতময় এই রাতে আকাশে চাঁদের দেখা নেই। ঝড়োঝড়ো শিশির মাটি স্পর্শ করছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে কিছু বর্ষনমুখর মেঘ। মৃদু মৃদু উত্তাল ঝড়োহাওয়ার বইছে। সেই হাওয়া ভেদ করে দুই তরুণ তরুণী এগিয়ে যাচ্ছে সামনে দিকে। প্রতিটি আঙুলের ভাঁজে আঙুলে গুঁজে, পায়ের গতি সমান রেখে হাঁটছে। সেই তরুণ তরুণী সাদাফ ঈর্ষা। ইতিমধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে তারা দুজনে। হুট করে ঈর্ষার সাদাফের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। সাদাফের চরণ থেমে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো ঈর্ষার দিকে। ঈর্ষাও দৃষ্টি সরালো, তবে সাদাফের দিকে নয়। বিপরীত দিকে। ঈর্ষার এমন ব্যবহারে বিচলিত হয়ে উঠলো সাদাফ। ঈর্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিব্রত কন্ঠে বলল.
— “ঊষা। এই সকালময়ী। কি হয়েছে তোমার। হাত সরিয়ে নিলে কেন?”
কথা বললো না ঈর্ষা। অভিমান জমে আছে, এই মানুষটির উপর। বড্ড অভিমান। কেন সে এতো দিন তাকে দোটানায় ফেলে রেখেছে? কেন? এতো দিন ভাবী সাহেবা বলে সম্মোধন করতো। তাহলে আজ সেই ভাবী সাহেবা কোথায়? কেন আজ সকালময়ী বলে ডাকছে। কেন বুঝতে পারে না। এই ডাকটার জন্য বিগত রাতগুলো তীব্র যন্ত্রণাদায়ক কেটেছে তার। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে এই ডাকটার জন্য। কোথায় ছিলো তখন সে।
ঈর্ষার অভিমানের সাথে প্রকৃতিও যেন সায় দিলো। আকাশের বক্ক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো বৃষ্টির অবাধ্য ধারা। সচরাচর শীতে বৃষ্টির চিহ্নমাত্র দেখা পাওয়া দায়, সেখানে বৃষ্টিরা সয়ং নেমে এসেছে। মুষলধারে বৃষ্টিরা নেমে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শহরকে ভিজিয়ে দিলো তাদের তালে। রাস্তায় পানিতে পূর্ণ হয়ে গেল। সাদাফ ঈর্ষা সেই বৃষ্টিতে ভিজে কাক ভেজা হয়ে গেছে।
রাস্তার গর্তে জমে থাকা পানিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ঈর্ষা। বেনারসী শাড়ি দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে এগিয়ে গেল সেদিকে। বৃষ্টির তালে তালে পানিগুলোর উপর ক্রমাগত লাফ ঝাঁপ দিতে শুরু করলো। ঈর্ষার খুশীরা এবার আকাশ ছুঁলো। শব্দ করে হাসতে লাগলো সেই আনন্দিত মুহূর্তের সাথে।
দূর থেকে সেই মনমাতানো হাঁসি মন কাড়ল সাদাফের। না জানি কতোদিন তার সকালময়ী এভাবে হাসেনি। তার ভালোবাসার অদ্ভুত টান ঈর্ষার রোগের চিহ্ন গুলো মুছে দিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো তৈরী করেছে।
ঈর্ষার দিকে এগিয়ে গেল সাদাফ। ঈর্ষার একদম পেছনে দাঁড়ালো। দুজনে মাঝে দূরত্ব হীন। সাদাফের উপস্থিতি অনুভব করল না সে। তবে সাদাফ অনুভব করাতে বাধ্য করল। পেছনে থেকে কোমড় জড়িয়ে চিবুকে মাথা রাখল সে। বৃষ্টিময় সন্ধ্যায় কেঁপে উঠলো ঈর্ষা। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে আলতো উচ্চারণ করল.
— “ক-কি ক-করছেন? ছাড়ুন! ”
ছাড়লো না সাদাফ। ঈর্ষাকে নিজের দিকে না ফিরিয়ে অধর ছুয়ে দিল কাঁধে। কথা বলার নূন্যতম শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে ঈর্ষা। ঈর্ষাকে ফ্রিজ হয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সাদাফ। সময় অবিলম্ব না করে শাড়িসহ ভেজা ঈর্ষাকে কোলে তুলে নিলো সাদাফ। নাকের ডগার সাথে ঈর্ষার নাকের ডগা মিলিয়ে বলল.
— “সকালময়ী এতোটা রাগ আমার প্রতি। আমি তোমার সব রাগ দূর করে দিবো। তোমার নেশার মতো পৃথিবীতে কোনো নেশা নেই। কাল রাতে কতো গুলো মেডিসিন খেলাম। কিন্তু দেখো, একটা মেডিসিনও কাজে দিলো না। সারারাত জেগে বুঝতে পেরেছি; আমি তোমাকে ছাড়া অচল। প্লীজ ক্ষমা করে দাও আমায়! আই প্রমিস, আর কখনো তোমায় রাগতে দিবো না। ”
বৃষ্টির ফোঁটার সাথে তাল মিলিয়ে ঈর্ষার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নয়ন থেকে বের হতেই বৃষ্টির ফোঁটার সাথে প্রবাহিত হয়ে হারিয়ে গেল। লজ্জার্থ মুখটা সাদাফের বুকের গহিনে রেখে লাজুক হেঁসে বলল.
— দিলাম! দিলাম! তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আমার মনের সব অধিকার তোমায় দিলাম। পুরো আমি-টাকে তোমায় দিলাম। শুধু তোর মন পাড়ায় আমাকে জায়গা করে দিস! সেখানেই চুপটি করে না-হয় আমি থাকবো!
সাদাফের চরণ পূর্ণরায় গতিশীল হলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনে দিকে। একটু একটু করে হারিয়ে গেল অনেকটা দূরে। একসময় অজানায়। তখনই শোনা গেল সাদাফের কন্ঠস্বর। তার রমনীকে খুশী করতে গানের সুর ধরেছে সে..
🎶🎶 তোর মনপাড়ায়, থাকতে দে আমায়..
আমি চুপটি করে থাকবো আর ডাকবো ইশারায়।
তুই চাইলে বল, আমার সঙ্গে চল..
ঐ-উদাস পুরের বৃষ্টিতে আজ ভিজবো দুজনায়, অভিমানী মন আমার, চাই তোকে বারবার..🎶🎶
(সমাপ্ত______