#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২০
বাইরে অতিশয় ঠান্ডা পড়েছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডার ক্রমাগত সাদাফের গাড়ির পেছনে তীব্র ভাবে ছুটে চলেছে ঈর্ষা। দৌড়াতে দৌড়াতে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে ঈর্ষা। থামলো না সে, তবুও দৌড়ে চলেছে। একসময় এসে গাড়ি থামলো সাদাফের বাড়ির সামনে, সাদাফ বিনা বাক্যেয় ভেতরে চলে গেল। ঈর্ষা সেখানে পৌঁছানোর আগেই প্রবেশদ্বার বন্ধ করে সাদাফ ভেতরে চলে গেছে। দমে গেল না ঈর্ষা। বাড়ির পাঁচিল টপকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো সে। লাভ হলো না এতে। সাদাফ তার আগেই ভেতরে চলে গিয়ে দরজা লক করে রেখেছে। সাদাফের বাড়ির দরজার কাছে হেলান দিয়ে বসলো সে। হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ বন্ধ করলো ঈর্ষা। অতি ক্লান্তিতে নয়ন যুগল আপনাআপনি গ্ৰথণ হয়ে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল সে। যখন নিদ্রা ভঙ্গ হলো সে নিজেকে অতি পরিচিত একটি কক্ষে আবিষ্কার করলো। তার চোখের সামনে সাদাফের হাসৌজ্জ্বল ছবি ভেসে উঠেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। ঈর্ষা উঠে বসতেই সাবিহার উপস্থিতি অনুভব করলো তার পাশে। ঈর্ষার পাশে বসে ক্রমাগত মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। ঈর্ষার ঘুম ভাঙতে দেখে হাসি ফুটে উঠল তার। কিছুটা অভিমানী সুরে বলল.
— “তোর উপরে আমি রাগ করেছি ঊর্ষা। সেদিন বাড়িতে গেলি আর একবারের জন্যও তুই এলি না। আমার খবর পর্যন্ত নিলি না। এই আমি তোর মা হই। যদি সত্যি কারের মা হতাম, তাহলে এমন করতে পারতি?”
কানের পেছনের দিকেটায় স্লাইড করলো ঈর্ষা। ইনোসেন্স ফেইস করে বলল.– “সরি মা! এখন থেকে প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলবো। প্লীজ রাগ করো না। প্লীজ”
ঈর্ষার উপর রেগে থাকতে পারবেন না সাবিহা। ঈর্ষার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বললেন.
— “ঊষা। তুই বাড়িতে কখন এসেছিস, বল তো? আমাদের একটা ফোন করবি তো? আমাদের না করতি সাদাফকে করতে পারতি? বাড়িতে এসে দরজার পাশে ঘুমিয়ে ছিলিস কেন?”
ফোনের কথাটা সে বেমালুম ভুলে গেছে। সাবিহার কথা কানে পৌঁছালো ঠিকই। তবে নয়ন যুগল রুমে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুড়াঘুড়ি করছে। কারণ তার আঁখি জোড়া সাদাফের খোঁজে বিভোর হয়ে আছে। আমতা আমতা করে বলল.
— “মা সাদাফ কোথায়? ওকে কোথাও দেখছি না কেন?”
সাবিহা রহস্যময়ী হাসলেন। ততক্ষণে সাদাফ এসে দাঁড়িয়েছে রুমের ভেতরে। হাত দিকে সাদাফকে ইশারা করে মুখ ঢেকে চলে গেল। সাদাফ আড় চোখে ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে কাবার্ড থেকে ড্রেস বের করে নিল। ওয়াশরুমে ঢুকতে যাওয়ার আগেই ঈর্ষা সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সাদাফের। জামা কাপড় গুলো অদূরে ছুঁড়ে সাদাফের বক্কে ঝাঁপিয়ে পড়লো। করুন সুরে বলল.
— “সাদাফ তুমি বিশ্বাস করো; আমার সাথে সাহেলের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি! আমি তোমাকে পুরোটা বুঝিয়ে বলছি।”
বুকের মাঝে এক প্রকার ঝড় বয়ে গেল সাদাফের। তার প্রিয়সী তার অভিমান ভাঙাতে এসেছে। নিজেকে সামলে নিজের থেকে ঈর্ষাকে ছাড়িয়ে নিল সাদাফ। দুজনের মাঝে বেশ খানিকটা জায়গা রেখে দাঁড়ালো। ঈর্ষার মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে যতোটা আনন্দিত হওয়ার কথা ছিলো তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। মুখ ঘুরিয়ে বলল.
— “ঈর্ষা; তুমি অন্যকারো ওয়াইফ হতে চলেছ। আমার সাথে এতোটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকাই ভালো। বলেছিলে না, আমরা বন্ধু। আজ থেকে সেটাই আমাদের মাঝে বিরাজ থাক।”
চমকে উঠলো ঈর্ষা। সাদাফের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দিকে ফিরিয়ে নিল ঈর্ষা। চোখে চোখ রেখে বলল. — “তুমি এইসব জানলে কীভাবে?”
সৌজন্যে হাসলো সাদাফ। ঈর্ষাকে নিজের থেকে সরিয়ে রাখতে কাল অবিচার করেছিল আর আজ। তবুও মেয়েটা তার কাছে ছুটে এসেছে। ঠোঁট চেপে বলল.
— “ঈর্ষা আমি সব জানি! সাহেল আমাকে বলেছে?তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল!”
সাদাফের কঠিন স্বরে কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠলো ঈর্ষা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল.
— “সাদাফ। তুমি আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা করো। মামনি শর্ত দিয়েছে ঠিকই কিন্তু মামা বলেছে, আমি যদি কাউকে ভালোবাসি। তাহলে সব ক্যান্সেল।”
— “মামা হয়তো এমনটাই বলেছে! কিন্তু তিনি মনে মনে চাই, তার পরিবারকে ফিরে পেতে। আর আমিও চাই তুমি সুখী হও। আমি চাইনা, দুটো মানুষের জন্য দুটো পরিবার কষ্ট পায়। সাহেল আমার বন্ধু বলে বলছি না। ও খুব ভালো ছেলে। তোমায় ভালো রাখবে?”
সাদাফ নিজেকে সামলে জামা কাপড় গুলো তুলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। পেছনে থেকে তখন ঈর্ষার কন্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে.
— “হয়তো সাহেল আমাকে ভালো রাখবে! কিন্তু আদোও কি আমি ভালো থাকবো সাদাফ। তুমিও কি থাকবে সাদাফ।”
পেছনে ফিরে তাকালো না সাদাফ। দ্রুত ওয়াশরুমের ভেতরে মুখে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটু মাথা গুঁজে নিল সে। সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল ঈর্ষা। নিজেকে অসহায় লাগছে আজ। কাউকে তার পাশে প্রয়োজন। খুব করে প্রয়োজন।
___________________
রাত পোহালে ঈর্ষার বিয়ে। পুরো বাড়িতে বিয়ের তোরজোর চলছে। বাড়ির প্রতিটি কোণ রঙিন আলোয় সেজেছে। বাইরে থেকে গান বাজনার আওয়াজ আসছে। মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সময়গুলো অতি দ্রুত অতিবাহিত হয়েছে। এই দিনগুলোর যন্ত্রণাদায়ক ছিলো দুজন মানুষের কাছে। দুজনের সাথে দেখা হয়নি, কথা হয়নি। সাদাফের উপর অভিমান করে এতো গুলো দিন পার করেছে কিন্তু আজ নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। ফোন তুলে সাদাফের নাম্বারে ডায়াল করলো। সাথে সাথে রিসিভ হলো ও পাশ থেকে। হয়তো সেও ঈর্ষার মতো রাত জেগে পার করেছে। বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিলো কিছু মুহূর্ত। দুজন দুজনার নিঃশ্বাসের প্রতিটি শব্দ গুনছিলো। নিরবতা ভেঙ্গে মুখ খুললো সাদাফ.
— “কি হলো ভাবী সাহেবা। এতো রাতে পরপুরুষের কাছে ফোন করেছেন? জরুরী কিছু বলার ছিল না-কি?”
— “খবরদার এই শব্দটি আমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে না। আর না আমি সাহেলের ওয়াইফ। এখনো অনেকটা সময় আছে। নিয়ে যাও আমায়।”
দুজনেই চুপ হয়ে গেল। সাদাফ তৃষ্ণার্ত ভঙ্গিতে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বলল.– “আমি আমার সিদ্ধান্তে অবিচল ঈর্ষা। খামোখা জেদ ধরো না। বিয়েতে ইনজয় করো। আমাকে নিয়ে সংসার না সাজাতে পারলেও “”তোর_মনপাড়ায়”” আমিই থাকবো। ”
— “আমার ইচ্ছে নেই তুমিই বড্ড ইনজয় করো। ধ্যাত.
বলেই ফোনটা ছুঁড়ে ফেললো সে। সাদাফ হাসলো। সে আজ অ-পারক। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে রইল। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো সে। সাবিহা এসেছে। হুট করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো সে। সাবিহা ছেলের কান্না দেখে ভেঙ্গে পড়লো। ছেলের অম্বু মুছিয়ে দিতে বলল.
— “সাদাফ; তুই যা। ঊষাকে নিয়ে আয়!”
নিজেকে শক্ত করে সাদাফ উত্তর দিলো. — “সেটা হয়না মা।”
— “সাদাফ আমি সেদিন তোদের কথা শুনেছি। তুই কি জানো বলেছিলি, দুটো মানুষের জন্য দুটো পরিবারের কষ্ট পাবে। দুটো পরিবারের তখনই কষ্ট পায়, যখন দুটো মানুষ কষ্ট পায়। আর শাহিনুজ্জামান সাহেব ঊষার জন্য তার সংসার ছেড়েছে। যদি তিনি সংসার করতে চাইতেন, তাহলে ঈর্ষাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতেন না। একবার ভেবে দেখ, যখন ঐ মানুষটা জানতে পারবে, তার জন্য তার ভাগ্নি ভালো নেই। তখন সে কতোটা কষ্ট পাবে।
এখনও সময় আছে সাদাফ, ঈর্ষাকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। ও তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আর তুইও থাকতে পারবি না।”
সাদাফ সাবিহার কথা শুনলো না। মুখ ঘুরিয়ে বলল.
— “মা আমি যা ভাবার আগেই ভেবে ফেলেছি। নতুন করে কিছু ভাবতে চাই না।”
— “নিজের ভালোটা পাগলেও বুঝে সাদু; কিন্তু তুই বুঝলি না। তোর যা ভালো লাগে তুই তাই কর।”
সাবিহা ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সাদাফের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সাদাফ মেডিসিনের বক্স বের করে কয়েক-টা ডরমিকাম খেয়ে নিলো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেডের মাঝ বরাবর শুয়ে পড়লো। ফোনের স্ক্রিনে ঈর্ষার একটা হাসৌজ্জ্বল ছবি বের করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। বুকের মাঝ বরাবর নিয়ে বিরবির করে বলল.
— “স্যরি ঊষা। আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী রুপে দেখতে পারবো না। কিভাবে পারবো নিজের সুখের জন্য প্রিয় বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে। আমি অপারক, ভুল লোককে ভালো-বেসেছ তুমি! ক্ষমা করে দিও। যদি কখনো আমার ঘুম ভাঙে, তখন তুমি অন্য কারো হয়ে যাবে। ভালো থেকো! সুখে থেকো সকালময়ী। তোমার প্রতিটি দিন হোক শুভময়।”
(চলবে)